শিবামুখী চিমটে – রাজশেখর বসু

শিবামুখী চিমটে – রাজশেখর বসু

ঝিণ্টুর মুখ থেকে থার্মোমিটার টেনে নিয়ে তার মা বললেন, নিরানব্বই পয়েণ্ট চার। আজ রাত্তিরে শুধু দুধবার্লি খাবি। ঘুরে বেড়াবি না, এই ঘরে থাকবি। আমাদের ফিরতে কতই আর দেরি হবে, এই ধর রাত বারোটা।

ঠোঁট ফুলিয়ে ঝিণ্টু বলল, বা রে, তোমরা সক্কলে মজা করে মাদ্রাজী ভোজ খাবে আর আমি একলাটি বাড়িতে পড়ে থাকব হুঁ—

—আরে রাম বল, ওকে কি ভোজ বলে। মাছ নেই, মাংস নেই, শুধু তেঁতুলের পোলাও, লংকার ঝোল, আর টক দই। যজ্ঞুস্বামী আয়ার ওঁর অফিসের বড় সাহেব, তাঁর মেয়ের বিয়ে, আর আয়ার— গিন্নীও অনেক করে বলেছে, তাই যাচ্ছি। তোর জন্যে এই মেকানো রইল, হাওড়া ব্রিজ তৈরি করিস। সুকুমার রায়ের তিন খানা বই রইল, ছবি দেখিস। কিন্তু বেশী পড়িস নি, মাথা ধরবে। তোর পিসীকে বলে যাচ্ছি রাত সাড়ে আটটায় দুধবার্লি দেবে। খেয়েই শুয়ে পড়বি। পিসী তোর কাছে শোবে।

—না, পিসীমাকে শুতে হবে না। তার ভীষণ নাক ডাকে, আমার ঘুম হবে না। আমি একলাই শোব।

—বেশ, তাই হবে।

ঝিণ্টুর বয়স দশ, লেখাপড়ায় মন্দ নয়, কিন্তু অত্যন্ত চঞ্চল আর দুরন্ত। তার মা বাবা আর ছোট বোন নিমন্ত্রণ খেতে গেল আর সে একলা বাড়িতে পড়ে রইল, এ অসহ্য। একটু জ্বর হয়েছে তো কি হয়েছে? সে এখনই দু মাইল দৌড়তে পারে, ব্যাডমিণ্টন খেলতে পারে, সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে তেতলার ছাতে উঠতে পারে। বাড়িতে গল্প করারও লোক নেই। পিসীমাটা যেন কি, দুপুর বেলা আপিসে যায় আর সকালে বিকেলে রাত্তিরে শুধু নভেল পড়ে। ঝিণ্টুর ক্লাসফ্রেণ্ড জিতুর পিসীমা কেমন চমৎকার বুড়ো মানুষ, কত রকম গল্প বলতে পারে। জিতু বলে, হ্যাঁরে ঝিণ্টু, তোর সরসী পিসী সেজেগুজে আপিস যায় কেন? মালা জপবে, বড়ি দেবে, নারকেলনাড়ু আমসত্ত্ব কুলের আচার বানাবে, তবে না পিসীমা!

মেকানো জোড়া দিয়ে ঝিণ্টু অনেক রকম ব্রিজ করল, আবার খুলে ফেলল। সাড়ে আটটার সময় সরসী পিসী তাকে দুধবার্লি খাইয়ে বলল, এইবার ঘুমিয়ে পড় ঝিণ্টু।

ঝিণ্টু বলল, সাড়ে আটটায় বুঝি লোকে ঘুমোয়? তুমি তো অনেক বই পড়, তা থেকে একটা গল্প বল না।

সরসী উত্তর দিল, ওসব গল্প তোর ভাল লাগবে না।

—খালি প্রেমের গল্প বুঝি?

—অতি জেঠা ছেলে তুই। বড়দের জন্যে লেখা গল্প ছোটদের ভাল লাগে নাকি? এই তো সেদিন তোর মা শেষের কবিতা পড়ছিল, তুই শুনে বললি, বিচ্ছিরি। আলো নিবিয়ে দিই, ঘুমিয়ে পড়।

সরসী পিসী চলে গেলে ঝিণ্টু শুয়ে পড়ল, কিন্তু কিছুতেই ঘুম এল না। এক ঘণ্টা এপাশ ওপাশ করে সে বিছানা থেকে তড়াক করে উঠে পড়ল। তার মাথায় খেয়াল এসেছে, একটা অ্যাডভেঞ্চার করতে হবে। ডিটেকটিভ, ডাকাত, বোম্বেটে, গুপ্ত ধন, এই সবের গল্প সে অনেক পড়েছে। আজ রাত্রে যদি সে গুপ্ত ধন আবিষ্কার করতে পারে তো কেমন মজা হয়! সে তার মায়ের কাছে শুনেছিল, তার এক বৃদ্ধপ্রজেঠামহ অর্থাৎ প্রপিতামহের জেঠা পিশাচসিদ্ধ তান্ত্রিক ছিলেন। অনেককাল হল তিনি মারা গেছেন, কিন্তু তাঁর তোরঙ্গটি তেতলার ঘরে এখনও আছে। সেই তোরঙ্গ খুলে দেখলে কেমন হয়?

ঝিণ্টুর একটা টর্চ আছে, দেড় টাকা দামের একটা পিস্তলও আছে। পিস্তলটা কোমরে ঝুলিয়ে টর্চ নিয়ে সে তেতলায় উঠল। সেখানে সিঁড়ির পাশে একটি মাত্র ঘর, তাতে শুধু অদরকারী বাজে জিনিস থাকে। সেই ঘরে ঢুকে ঝিণ্টু সুইচ টিপে আলো জ্বালল। তার বৃদ্ধপ্রজেঠামহ করালীচরণ মুখুজ্যের তোরঙ্গটা এক কোণে রয়েছে। বেতের তৈরি, তার উপর মোষের চামড়া দিয়ে মোড়া, অদ্ভুত গড়ন, যেন একটা প্রকাণ্ড কচ্ছপ। যে তালা লাগানো আছে তাও অদ্ভুত। দেয়ালে এক গোছা পুরনো চাবি ঝুলছে। ঝিণ্টু একে একে সব চাবি দিয়ে তালা খোলবার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। সে হতাশ হয়ে ফিরে যাবার উপক্রম করছে, হঠাৎ নজরে পড়ল, তোরঙ্গের পিছনের কবজা দুটো মরচে পড়ে খয়ে গেছে। একটু টানাটানি করতেই খসে গেল। ঝিণ্টু তখন তোরঙ্গের ডালা পিছন থেকে উলটে খুলে ফেলল।

বিশ্রী ছাতা—ধরা গন্ধ। উপরে কতকগুলো ময়লা গেরুয়া রঙের কাপড় রয়েছে, তার নীচে এক গোছা তালপাতায় লেখা পুঁথি আর তিনটে মোটা মোটা রুদ্রাক্ষের মালা। তার নীচে আবার কাপড়, তামার কোষা—কুষি, সাদা রঙের সরার মতন একটা পাত্র, একটা মরচে ধরা ছোট ছুরি, একটা সরু কলকে, অত্যন্ত ময়লা এক টুকরো নেকড়া, আর একটা চিমটে। ঝিণ্টু যদি চৌকস লোক হত তা হলে বুঝত— সাদা সরাটা হচ্ছে খর্পর অর্থাৎ মড়ার মাথার খুলি, আর ছুরি কলকে নেকড়া চিমটে হচ্ছে গাঁজা খাওয়ার সরঞ্জাম।

বিরক্ত হয়ে ঝিণ্টু বলল, দুত্তোর, টাকা কড়ি হীরে মানিক কিচ্ছু নেই, তবে চিমটেটি মন্দ নয়, আন্দাজ এক ফুট লম্বা, মাথায় একটা আংটা, তাতে আবার আরও তিনটে আংটা গোছা করে লাগানো আছে। চিমটের গড়ন বেশ মজার, টিপলে মুখটা শেয়ালের মতন দেখায়, দু পাশে দুটো চোখ আর কানও আছে। বহুকালের জিনিস হলেও মরচে ধরে নি, বেশ চকচকে। তোরঙ্গ বন্ধ করে চিমটে নিয়ে ঝিণ্টু তার ঘরে ফিরে এল।

আলো জ্বেলে বিছানায় বসে ঝিন্টু সুকুমার রায়ের বইগুলো কিছুক্ষণ উলটে পালটে দেখল। পাশের ঘরে ঘড়িতে ঢং ঢং করে দশটা বাজল। এইবার ঘুম পাচ্ছে। শোবার আগে সে আর একবার চিমটেটা ভাল করে দেখল। নাড়া পেয়ে মাথার আংটাগুলো ঝমঝম করে বেজে উঠল। তার পরেই এক আশ্চর্য কাণ্ড।

দরজা ঠেলে এক অদ্ভুত মূর্তি ঘরে ঢুকল। বেঁটে গড়ন, ফিকে ব্লু ব্ল্যাক কালির মতন গায়ের রং, মাথার চুলে ঝুঁটি বাঁধা, মুখখানা বাঁদরের মতন, নন্দলালের আঁকা নন্দীর ছবির সঙ্গে কতকটা মিল আছে। পরনে গেরুয়া রঙের নেংটি, পায়ে খড়ম। মূর্তি বলল, কি চাও হে খোকা?

ঝিণ্টু প্রথমটা ভয়ে আঁতকে উঠল। কিন্তু সে সাহসী ছেলে, মূর্তিমান অ্যাডভেঞ্চার তার সামনে উপস্থিত হয়েছে, এখন ভয় পেলে চলবে কেন! ঝিণ্টু প্রশ্ন করল, তুমি কে?

—ঢুণ্ঢুদাস চণ্ড। তোমার পূর্বপুরুষ পিশাচসিদ্ধ হয়েছিলেন তা শুনেছ? আমি সেই পিশাচ।

—তোমাকেই সেদ্ধ করেছিলেন বুঝি?

—দূর বোকা, আমাকে সেদ্ধ করে কার সাধ্য! তিনি সাধনা করে নিজেই সিদ্ধ হয়েছিলেন, আমাকে বশ করেছিলেন। এই শিবামুখী চিমটেটি আমিই তাঁকে দিয়েছিলাম। আমাদের মধ্যে এই বন্দোবস্ত হয়েছিল যে চিমটে বাজালেই আমি হাজির হব আমাকে যা করতে বলা হবে তাই করব। কিন্তু করালী মুখুজ্যে ছিলেন নির্লোভ সাধু পুরুষ, কখনও ধন দৌলতের জন্য আমাকে ফরমাশ করেন নি। শুধু হুকুম করতেন—লে আও তম্বাকু, লে আও গঞ্জা, লে আও ওমদা কারণবারি বিলায়তী শরাব, লে আও অচ্ছী অচ্ছী ভৈরবী। তিনি মারা যাবার পর থেকে আমি নিষ্কর্মা হয়ে আছি। শোন খোকা—আজ হল বৈশাখী অমাবস্যা। এক শ বছর আগে এই অমাবস্যার রাত দুপুরে তোমার প্রপিতামহের জেঠা করালীচরণ মুখুজ্যে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। শর্ত অনুসারে আজ ঠিক সেই লগ্নে আমি কিংকরত্ব থেকে মুক্তি পাব, তারপর যতই চিমটে বাজাও আমি সাড়া দেব না। এখনও ঘন্টা দুই সময় আছে। তোমার ডাক শুনে আমি এসেছি, কি চাই বল।

একটু ভেবে ঝিণ্টু বলল, একটা হাঁসজারু দিতে পার?

—সে আবার কি?

—ঝিন্টু বই খুলে ছবি দেখিয়ে বলল, এই রকম জন্তু, হাঁস আর শজারুর মাঝামাঝি।

—ও, বুঝেছি। কিন্তু এ রকম জানোয়ার তো রেডিমেড পাওয়া যাবে না, সৃষ্টি করতে সময় লাগে। ঘণ্টাখানেক পরে আমি একটা হাঁসজারু পাঠিয়ে দেব।

ঝিণ্টু বলল, তা না হয় এক ঘন্টা দেরিই হল, ততক্ষণ আমি ঘুমুব। কিন্তু তুমি বেশী দেরি করো না, মা বাবা সবাই এসে পড়বে।

পিশাচ অন্তর্হিত হল।

ঝিণ্টু ঘুমোচ্ছিল। হঠাৎ খুটখুট শব্দ শুনে তার ঘুম ভেঙে গেল। আলো জ্বালাই ছিল, ঝিণ্টু দেখল, একটা কিম্ভুত—কিমাকার জানোয়ার ঘরে ছুটোছুটি করছে। তার মাথা আর গলা হাঁসের মতন, ধড় শজারুর মতন, সমস্ত গায়ে কাঁটা খাড়া হয়ে আছে, চার পায়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে আর প্যাঁক প্যাঁক করে ডাকছে। ঝিণ্টু উঠে বসল, আদর করে ডাকল—আ আ চু চ্চু চু। হাঁসজারু পোষা কুকুরের মতন লাফিয়ে দুই থাবা তুলে কোলে উঠতে গেল। ঝিণ্টুর হাঁটুতে কাঁটার খোঁচা লাগল সে বিরক্ত হয়ে বলল, যাঃ, সরে যা, গায়ে যে একটু হাত বুলিয়ে দেব তারও জো নেই!

এই ঘরের ঠিক নীচের ঘরটি সরসী পিসীর। খাওয়ার পর সরসী একটা গোটা উপন্যাস সাবাড় করে ঘুমিয়ে পড়েছিল। মাথার উপর দুপদাপ শব্দ হওয়ায় তার ঘুম ভেঙে গেল, বিরক্ত হয়ে বলল, আঃ, পাজী ছেলেটা এখনও ঘুমোয় নি, দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সরসী উপরে উঠে ঝিণ্টুর ঘরে ঢুকেই চমকে উঠে বলল, ও মা গো, এটা আবার কোত্থেকে এল!

ঝিণ্টু বলল, ও আমি পুষেছি, কোনও ভয় নেই, কিচ্ছু বলবে না। কাল নাপিত ডেকে গায়ের কাঁটা ছাঁটিয়ে দেব, তা হলে আর হাতে ফুটবে না। একটু দুধ আর বিস্কুট এনে দাও না পিসীমা, বেচারার খিদে পেয়েছে।

আত্মরক্ষার জন্য সরসী ঝিণ্টুর খাটের উপর উঠে বলল, এটাকে কোত্থেকে পেয়েছিস শিগগির বল ঝিণ্টে।

হাত নেড়ে মুখভঙ্গী করে ঝিন্টু বলল, ইঃ বলব কেন!

—লক্ষ্মীটি বল কোথা থেকে এটা এল।

—আগে দিব্বি গাল যে, কারুক্কে বলবে না।

—কালীঘাটের মা কালীর দিব্বি, কাকেও বলব না।

ঝিণ্টু তখন সমস্ত ব্যাপারটি খুলে বলল। সরসীর বিশ্বাস হল না, বলল, তুই বানিয়ে বলছিস ঝিণ্টে। করালী জেঠা পিশাচসিদ্ধ ছিলেন এই রকম শুনেছি বটে, কিন্তু ও একটা বাজে গল্প।

—বাজে গল্প! তবে এই দেখ—

ঝিণ্টু চিমটে নেড়ে ঝন ঝন শব্দ করতেই ঢুণ্ঢুদাস চণ্ডের আবির্ভাব হল। সরসী ভয়ে কাঠ হয়ে চোখ কপালে তুলে অবাক হয়ে দেখতে লাগল। পিশাচ বলল, কি চাই খোকা?

ঝিন্টু হুকুম করল, গরম মটর ভাজা, বেশ বড় বড়। বেশী করে দিও, পিসীমাও খাবে।

পিশাচ অন্তর্হিত হল। একটু পরেই একটা কাগজের ঠোঙা শূন্য থেকে ধপ করে ঘরের মেঝেতে পড়ল। সদ্য ভাজা বড় বড় মটরে ভরতি, এখনও গরম রয়েছে। এক মুঠো নিয়ে ঝিণ্টু বলল, পিসীমা, একটু খেয়ে দেখ না।

সরসী গালে হাত দিয়ে বলল, অবাক কাণ্ড! বাপের জন্মে এমন দেখিনি, শুনিও নি। কিন্তু তুই কি বোকা রে খোকা। কোথায় দশ—বিশ লাখ টাকা, মস্ত বাড়ি, দামী মোটর গাড়ি, এই সব চাইবি, তা নয়, চাইলি কিনা হাঁসজারু আর মটর ভাজা! ছি ছি ছি। আচ্ছা, তোর ওই চিমটেটা একবারটি আমাকে দে তো।

পিসীর উপর ঝিণ্টুর কোনও দিনই বিশেষ টান নেই। ভেংচি কেটে বলল, ইস দিলুম আর কি! এই শেয়ালমুখো চিমটে আমি কারুক্কে দিচ্ছি না। তোমার কোন জিনিস দরকার বল না, আমি আনিয়ে দিচ্ছি।

—তুই ছেলেমানুষ, গুছিয়ে বলতে পারবি না।

—আচ্ছা, আমি ঢুণ্ঢুদাসকে ডাকছি। তুমি যা চাও আমাকে বলবে, আর আমি ঠিক সেই কথা তাকে বলব।

অগত্যা সরসী রাজী হল। ঝিণ্টু চিমটে নাড়তেই আবার পিশাচ এসে বলল, কি চাই?

ঝিণ্টু বলল, চটপট বলে ফেল পিসীমা, এক্ষুনি হয়তো বাবা মা এসে পড়বে।

ঝিন্টুর জবানিতে সরসী যা চাইলে তার তাৎপর্য এই। —আগে ওই জানোয়ারটাকে বিদেয় করতে হবে। তারপর দুর্লভ তালুকদার নামক এক ভদ্রলোককে ধারে আনতে হবে। তিনি কানপুরে উলেন মিলে চাকরি করেন। বাসার ঠিকানা জানা নেই।

হাঁসজারু আর পিশাচ অন্তর্হিত হল।

ঝিণ্টু বলল, কানপুরের ভদ্রলোককে এনে কি হবে পিসীমা?

—তাকে আমি বিয়ে করব।

—বিয়ে করবে কি গো! তুমি তো বুড়ো ধাড়ী হয়েছ।

—কে বলল, বুড়ো ধাড়ী! আমার বয়স তো সবে পঁচিশ।

—মা যে বলে তোমার বয়েস চৌত্রিশ—পঁয়ত্রিশ?

—মিথ্যে কথা, তোর মা হিংসুটে, তাই বলে। আর আমি তো আইবুড়ো মেয়ে, বয়েস যাই হোক বিয়ে করব না কেন?

পিশাচ ফিরে আসবার আগে একটু পূর্বকথা বলা দরকার। বারো—তেরো বছর পূর্বে সরসী যখন কলেজে পড়ত তখন দুর্লভ তালুকদারের সঙ্গে তার ভাব হয়। দুর্লভ বলেছিল, আমার একটি ভাল চাকরি পাবার সম্ভাবনা আছে, পেলেই তোমাকে বিয়ে করব। কিছুদিন পরে দুর্লভ চাকরি পেয়ে কানপুরে গেল। সেখান থেকে মাঝে মাঝে চিঠি লিখত—বড় মাগগি জায়গা, তোমার উপযুক্ত বাসাও পাই নি, মাইনে মোটে দু শ টাকা, দুজনের চলবে কি করে? আশা আছে শীঘ্রই, সাড়ে তিন শ টাকার গ্রেডে প্রমোশন পাব, ভাল কোয়াটার্সও পাব। লক্ষ্মীটি সরসী, তত দিন ধৈর্য ধরে থাক। তার পর ক্রমশ চিঠি আসা কমতে লাগল, অবশেষে একেবারে বন্ধ হল। সরসী বুঝল যে দুর্লভ মিথ্যাবাদী, কিন্তু তবু তাকে সে ভুলতে পারে নি।

পিশাচ একটি মোটা লোককে পাঁজাকোলা করে নিয়ে এসে ধপ করে মেঝেতে ফেলে বলল, এই নাও খোকা, তোমার পিসীর বর। এখন বেহুঁশ হয়ে আছে, একটু পরেই চাঙ্গা হবে।

দুর্লভের মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ঝিণ্টু বলল, উঃ, মামাবাবু, ক্লাব থেকে ফিরে এলে যে রকম গন্ধ বেরোয় সেই রকম লাগছে। ও ঢুণ্ঢু মশাই, একে জাগিয়ে দাও না।

পিশাচ বলল, নেশায় চুর হয়ে আছে। কানপুরের একটা বস্তিতে ওর ইয়ারদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিল, সেখান থেকে তুলে এনেছি। এই উঠে পড় শিগগির।

ঠেলা খেয়ে দুর্লভের চেতনা ফিরে এল। চোখ মেলে বলল, তোমরা আবার কে?

ঝিণ্ঢু বলল, পিসীমা, যা বলবার তুমি একে বল।

—আমি পারব না, তুই বল খোকা।

—ও মশাই শুনছেন? এ হচ্ছে আমার সরসী পিসীমা, আইবুড়ো মেয়ে। একে আপনি বিয়ে করুন।

দুর্লভ বলল, আহা কি কথাই শোনালে। বিয়ে কর বললেই বিয়ে করব?

পিশাচ বলল, করবি না কি রকম? তোর বাবা করবে।

একটি পৈশাচিক চড় খেয়ে দুর্লভ বলল, মেরো না বাবা, ঘাট হয়েছে। বেশ, বিয়ে করছি, পুরুত ডাকো। কিন্তু বলে রাখছি, অলরেডি আমার একটি বাঙালী স্ত্রী আর খোট্টা জরু আছে। সরসী যদি তিন নম্বর সহধর্মিনী হতে চায় আমার আর আপত্তি কি। সবাই মিলে এক বিছানায় শুতে হবে কিন্তু।

সরসী বলল, দূর করে দাও হতভাগা মাতালটাকে।

ঝিণ্টুর আদেশে পিশাচ দুর্লভকে তুলে নিয়ে চলে গেল। ঝিণ্টু বলল, আচ্ছা পিসীমা, তোমার আপিসে তো অনেক ভাল ভাল বাবু আছে, তাদের একজনকে আনাও না।

একটু ভেবে সরসী বলল, আমাদের হেড অ্যাসিস্ট্যাণ্ট যোগীন বাঁড়ুজ্যের স্ত্রী দু বছর হল মারা গেছে। যোগীনবাবু লোকটি ভাল, তবে কালচার্ড নয়, একটু বয়সও হয়েছে। বড্ড তামাক খায়, কথা বললে হুঁকো হুঁকো গন্ধ ছাড়ে। তা কি আর করা যাবে, অত খুঁত ধরলে চলে না, সব পুরুষই মোর অর লেস ডার্টি। কিন্তু যোগীনবাবু রাজী হবে কি? মোটা বরপণ পেলে হয়তো—

ঝিণ্টু বলল, বরপণ কি? গয়না আর টাকা? সে তুমি ভেবো না পিসীমা, আমি সব ঠিক করে দিচ্ছি।

চিমটে বাজিয়ে পিশাচকে ডেকে ঝিণ্টু বলল, পিসীমার আপিসে সেই যে যোগীন বাঁড়ুজ্যে কাজ করে—ঠিকানাটা কি পিসীমা? তিন নম্বর বেচু মিস্ত্রী লেন—সেইখান থেকে তাকে ধরে নিয়ে এস। আর শোন, পিসীমাকে একগাদা গয়না আর অনেক টাকা দাও।

সরসীর সর্বাঙ্গ মোটা মোটা সোনার গহনায় ভরে গেল, পাঁচটা থলিও ঝনাত করে তার পায়ের কাছে পড়ল। পিশাচ চলে গেল।

একটা থলি তুলে সরসী বলল, সের পাঁচ—ছয় ওজন হবে।

ঝিণ্টু বলল, পাঁচ শ টাকায় সওয়া ছ—সের, হাজার টাকায় সাড়ে বারো সের, লাখ টাকায় একত্রিশ মন দশ সের। ‘জ্ঞানের সিন্দুক’ বইএ আছে।

পিশাচ যোগীন বাঁড়ুজ্যেকে পাঁজাকোলা করে এনে মেঝেতে ফেলল।

ঝিণ্টু বলল, এও নেশা করেছে নাকি?

পিশাচ বলল, নেশা নয়, অজ্ঞান করে নিয়ে এসেছি, একটু ঠেলা দিলেই চাঙ্গা হবে। থাম, আগে আমি সরে পড়ি, নয়তো আমাকে দেখে আবার ভিরমি যাবে।

ঠেলা খেয়ে যোগীন বাঁড়ুজ্যে উঠে বসলেন। হাই তুলে তুড়ি দিয়ে বললেন, দুর্গা দুর্গা, এ আমি কোথায়? একি, মিস সরসী মুখার্জী এখানে যে! উঃ, কত গহনা পরেছেন! আপনার বিবাহের নিমন্ত্রণে এসেছি নাকি?

মুখ নীচু করে সরসী বলল, খোকা, তুই বল।

ঝিণ্টু বলল, স্যার আপনি আমার এই সরসী পিসীমাকে বিয়ে করুন, ইনি আইবুড়ো মেয়ে, বয়স সবে পঁচিশ। দেখছেন তো, কত গয়না, আবার পাঁচ থলি টাকাও আছে, এক—একটা পাঁচ—ছ সের।

যোগীনবাবু বললেন, বাঃ খোকা, তুমি নিজেই সালংকারা পিসীকে সম্প্রদান করছ নাকি? তা আমার অমত নেই, মিস মুখার্জির ওপর আমার একটু টাঁনও ছিল। তবে কিনা ইনি হলেন মডার্ন মহিলা, তাই এগুতে ভরসা পাই নি। গহনাগুলো বড্ড সেকেলে, কিন্তু বেশ ভারী মনে হচ্ছে, বেচে দিয়ে নতুন ডিজাইনের গড়ালেই চলবে। কিন্তু ব্যাপারটা যে কিছুই বুঝতে পারছি না, এখানে আমি এলুম কি করে?

সরসী বলল,সে কথা পরে শুনবেন। এখন বাড়ি যান, কাল সকালে এসে আমার দাদাকে বিবাহের প্রস্তাব জানাবেন। এই আংটিটা পরুন তা হলে ভুলে যাবেন না।

—ভুলে যাবার জো কি! কাল সকালেই তোমার দাদাকে বলব। এখন কটা বেজেছে? বল কি, পৌনে বারো! তাই তো, বাড়ি যাব কি করে, ট্রাম বাস সব তো বন্ধ।

ঝিণ্টু বলল, কিচ্ছু ভাববেন না, স্যার, একবারটি শুয়ে পড়ে চোখ বুজুন তো।

যোগীন বাঁড়ুজ্যে সুবোধ শিশুর ন্যায় শুয়ে পড়ে চোখ বুজলেন। শিবামুখী চিমটের আওয়াজ শুনে পিশাচ আবার এল। ঝিণ্টু তাকে ইশারায় আজ্ঞা দিল—এঁকে নিজের বাড়িতে পৌঁছে দাও!

বারোটা বাজল। সরসী বলল, দাদা বউদি এখনই এসে পড়বে। যাই, গহনাগুলো খুলে ফেলি গে, টাকার থলিগুলোও তুলে রাখতে হবে। তোর মোটে বুদ্ধি নেই, টাকা না চেয়ে নোট চাইলি না কেন? ঝিণ্টু বাবা আমার, কোনও কথা কাকেও বলিস নি।

—না, না, বলব কেন। এই যা, ঢুণ্ঢুদাসের কাছে একটা বেঁজি চেয়ে নিতে ভুলে গেছি। ইস্কুলের দারোয়ান রামভজনের কেমন চমৎকার একটি আছে, খুব পোষা, কাঁধের ওপর নেপটে থাকে।

—ভাবিস নি খোকা, যত বেঁজি চাস তোর পিসেমশাই তোকে কিনে দেবে। তুই আর জ্বর গায়ে জাগিস নি, শুয়ে পড়।

—কোথায় জ্বর। সে তো ঢুণ্ঢুদাসকে দেখেই সেরে গেছে।

—হ্যাঁরে খোকা, আমরা স্বপ্ন দেখছি না তো? সকালে ঘুম থেকে উঠে যদি দেখি গহনা আর টাকা সব উড়ে গেছে?

—গেলই বা উড়ে। যোগীনবাবু আবার গড়িয়ে দেবে, টাকাও দেবে।

—যোগীনবাবুও যদি উড়ে যায়?

—যাক গে উড়ে। তুমি এই মটরভাজা একটু খেয়ে দেখ না, কেমন কুড়কুড়ে। বেশ করে চিবিয়ে গিলে ফেল, তা হলে কিছুতেই উড়ে যেতে পারবে না?

১৩৬২ (১৯৫৫)

No comments