চিকিৎসা-সঙ্কট – রাজশেখর বসু

চিকিৎসা-সঙ্কট – রাজশেখর বসু

সন্ধ্যা হব হব। নন্দবাবু হগ সাহেবের বাজার হইতে ট্রামে বাড়ি ফিরিতেছেন। বীডন স্ট্রীট পার হইয়া গাড়ি আস্তে আস্তে চলিতে লাগিল। সম্মুখে গরুর গাড়ি। আর একটু গেলেই নন্দবাবুর বাড়ির মোড়। এমন সময় দেখিলেন পাশের একটা গলি হইতে তার বন্ধু বঙ্কু বাহির হইতেছেন। নন্দবাবু উৎফুল্ল হইয়া ডাকিলেন—’দাঁড়াও হে বঙ্কু, আমি নাবছি।’ নন্দর দু—বগলে দুই বান্ডিল, ব্যস্ত হইয়া চলন্ত গাড়ি হইতে যেমন নামিবেন অমনি কোঁচায় পা বাধিয়া নীচে পড়িয়া গেলেন।

গাড়িতে একটা শোরগোল উঠিল এবং ঘ্যাচাং করিয়া গাড়ি থামিল। জনকতক যাত্রী নামিয়া নন্দকে ধরিয়া তুলিলেন। যাঁরা গাড়ির মধ্যে ছিলেন তাঁরা গলা বাড়াইয়া নানাপ্রকারের সমবেদনা জানাইতে লাগিলেন। ‘—আহা হা বড্ড লেগেছে —থোড়া গরম দুধ পিলা দোও— দুটো পা—ই কি কাটা গেছে?’ একজন সিদ্বান্ত করিল মৃগি। আর একজন বলিল ভির্মি। কেউ বলিল মাতাল, কেউ বলিল বাঙাল, কেউ বলিল পাড়াগেঁয়ে ভূত।

বাস্তবিক নন্দবাবুর মোটেই আঘাত লাগে নাই। কিন্তু কে তা শোনে। ‘লাগে নি কি মশায়, খুব লেগেছে—দু—মাসের ধাক্কা— বাড়ি গিয়ে টের পাবেন।’ নন্দ বার বার করজোড়ে নিবেদন করিলেন যে প্রকৃতই কিছুমাত্র চোট লাগে নাই। একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক বলিলেন— ‘আরে মোলো, ভাল করলে মন্দ হয়। স্পষ্ট দেখলুম লেগেছে তবু বলে লাগে নি।’

এমন সময় বঙ্কুবাবু আসিয়া পড়ায় নন্দবাবু পরিত্রাণ পাইলেন, মনঃক্ষুণ্ণ যাত্রীগণসহ ট্রাম গাড়িও ছাড়িয়া গেল।

বঙ্কু বলিলেন—মাথাটা হঠাৎ ঘুরে গিয়েছিল আর কি। যা হোক, বাড়ির পথটুকু আর হেঁটে গিয়ে কাজ নেই। এই রিকশ—’

রিকশ নন্দবাবুকে আস্তে আস্তে লইয়া গেল, বঙ্কু পিছনে হাঁটিয়া চলিলেন।

নন্দবাবুর বয়স চল্লিশ, শ্যামবর্ণ, বেঁটে গোলগাল চেহারা। তাঁহার পিতা পশ্চিমে কমিসারিয়টে চাকরি করিয়া বিস্তর টাকা উপার্জন করিয়াছিলেন এবং মৃত্যুকালে একমাত্র সন্তান নন্দর জন্য কলিকাতায় একটি বড় বাড়ি, বিস্তর আসবাব এবং মস্ত একগোছা কোম্পানির কাগজ রাখিয়া যান। নন্দর বিবাহ অল্পবয়সেই হইয়াছিল, কিন্তু এক বৎসর পরেই তিনি বিপত্নীক হন এবং তারপর আর বিবাহ করেন নাই। মাতা বহুদিন মৃতা, বাড়িতে একমাত্র স্ত্রীলোক এক বৃদ্ধা পিসী। তিনি ঠাকুরসেবা লইয়া বিব্রত, সংসারের কাজ ঝি চাকররাই দেখে। নন্দবাবুর দ্বিতীয়বার বিবাহ করিতে আপত্তি নাই, কিন্তু এ পর্যন্ত তাহা হইয়া উঠে নাই। প্রধান কারণ—আলস্য। থিয়েটার, সিনেমা, ফুটবল ম্যাচ, রেস এবং বন্ধু বর্গের সংসর্গ—ইহাতে নির্বিবাদে দিন কাটিয়া যায়, বিবাহের ফুরসত কোথা? তার পর ক্রমেই বয়স বাড়িয়া যাইতেছে, আর এখন না করাই ভাল। মোটের ওপর নন্দ নিরীহ গোবেচারা অল্পভাষী উদ্যমহীন আরামপ্রিয় লোক।

নন্দবাবুর বাড়ির নীচে সুবৃহৎ ঘরে সান্ধ্য আড্ডা বসিয়াছে। নন্দ আজ কিছু ক্লান্ত বোধ করিতেছেন, সেজন্য বালাপোশ গায়ে দিয়া লম্বা হইয়া শুইয়া আছেন। বন্ধুগণের চা ও পাঁপরভাজা শেষ হইয়াছে, এখন পান সিগারেট ও গল্প চলিতেছে।

গুপীবাবু বলিতেছিলেন—’উঁহু। শরীরের ওপর এত অযত্ন ক’রো না নন্দ। এই শীতকালে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া ভাল লক্ষণ নয়।’

নন্দ। মাথা ঠিক ঘোরে নি, কেবল কোঁচার কাপড় বেধে—

গুপী। আরে, না না। ঘুরেছিল বই কি! শরীরটা কাহিল হয়েছে। এই তো কাছাকাছি ডাক্তার তফাদার রয়েছেন। অত বড় ফিজিশিয়ান আর শহরে পাবে কোথা? যাও না কাল সকালে একবার তাঁর কাছে।

বঙ্কু বলিলেন—’আমার মতে একবার নেপালবাবুকে দেখালেই ভাল হয়। অমন বিচক্ষণ হোমিওপ্যাথ আর দুটি নেই। মেজাজটা একটু তিরিক্ষি বটে, কিন্তু বুড়োর বিদ্যে অসাধারণ।’

ষষ্ঠীবাবু মুড়িশুড়ি দিয়া এক কোণে বসিয়াছিলেন। তাঁর মাথায় বালাক্লাভা টুপি, গলায় দাড়ি এবং তার উপর কম্ফর্টার। বলিলেন—’বাপ, এত শীতে অবেলায় কখনও ট্রামে চড়ে? শরীর অসাড় হলে আছাড় খেতেই হবে। নন্দর শরীর একটু গরম রাখা দরকার।’

নিধু বলিল—’নন—দা, মোটা চাল ছাড়। সেই এক বিরিঞ্চির আমলের ফরাস তাকিয়া, লক্কড় পালকি গাড়ি আর পক্ষীরাজ ঘোড়া, এতে গায়ে গত্তি লাগবে কিসে? তোমার পয়হার অভাব কি বাওআ? একটু ফুর্তি করতে শেখ।’

সাব্যস্ত হইল কাল সকালে নন্দবাবু ডাক্তার তফাদারের বাড়ি যাইবেন।

ডাক্তার তফাদার M.D M.R.A.S গ্রে স্ট্রীটে থাকেন। প্রকাণ্ড বাড়ি, দু—খানা মোটর, একটা ল্যাণ্ড। খুব পসার, রোগীরা ডাকিয়া সহজে পায় না। দেড় ঘণ্টা পাশের কামরায় অপেক্ষা করার পর নন্দবাবুর ডাক পড়িল। ডাক্তারসাহেবের ঘরে গিয়া দেখিলেন এখনও একটি রোগীর পরীক্ষা চলিতেছে। একজন স্থূলকায় মারোয়াড়ী নগ্নগাত্রে দাঁড়াইয়া আছে। ডাক্তার ফিতা দিয়া তাঁহার ভুঁড়ির পরিধি মাপিয়া বলিলেন—’বস, সওয়া ইঞ্চি বঢ় গিয়া।’ রোগী খুশি হইয়া বলিল—’নবজ তো দেখিয়ে।’ ডাক্তার রোগীর মণিবন্ধে নাড়ীর উপর একটি মোটর কারের স্পার্কিং প্লাগ ঠেকাইয়া বলিলেন—’বহুত মজেসে চল রহা।’ রোগী বলিল—’জবান তো দেখিয়ে। রোগী হাঁ করিল, ডাক্তার ঘরের অপর দিকে দাঁড়াইয়া অপেরা প্লাস দ্বারা তাহার জিব দেখিয়া বলিলেন—’থোড়েসি কসর হ্যায়। কল ফিন আনা।’

রোগী চলিয়া গেলে তফাদার নন্দর দিকে চাহিয়া বলিলেন—’ওয়েল?’

নন্দ বলিলেন—’আজ্ঞে বড় বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি। কাল হঠাৎ ট্রাম থেকে—

তফাদার। কম্পাউন্ড ফ্রাকচার? হাড় ভেঙেছে?

নন্দবাবু আনুপূর্বিক তাঁর অবস্থার বর্ণনা করিলেন। বেদনা নাই, জ্বর হয় না, পেটের অসুখ, সর্দি, হাঁপানি নাই। ক্ষুধা কাল হইতে একটু কমিয়াছে। রাত্রে দুঃস্বপ্ন দেখিয়াছেন। মনে বড় আতঙ্ক।

ডাক্তার তাঁহার বুক পেট মাথা হাত পা নাড়ী পরীক্ষা করিয়া বলিলেন—’জিব দেখি।’

নন্দবাবু জিভ বাহির করিলেন।

ডাক্তার ক্ষণকাল মুখ বাঁকাইয়া কলম ধরিলেন। প্রেসক্রিপশন লেখা শেষ হইলে নন্দর দিকে চাহিয়া বলিলেন—’আপনি এখন জিব টেনে নিতে পারেন। এই ওষুধ রোজ তিনবার খাবেন।’

নন্দ। কি রকম বুঝলেন?

তফাদার। ভেরি ব্যাড।

নন্দ সভয়ে বলিলেন—’কি হয়েছে?’

তফাদার। আরও দিন কতক ওয়াচ না করলে ঠিক বলা যায় না। তবে সন্দেহ করছি cerebral tumour with strangulated ganglia। ট্রিফাইন ক’রে মাথার খুলি ফুটো করে অস্ত্র করতে হবে, আর ঘাড় চিরে নার্ভের জট ছাড়াতে হবে। শর্ট—সার্কিট হয়ে গেছে।

নন্দ। বাঁচব তো?

তফাদার। দ’মে যাবেন না, তা হ’লে সারাতে পারব না। সাত দিন পরে ফের আসবেন। মাই ফ্রেণ্ড মেজর গোঁসাই এর সঙ্গে একটা কনসলটেশনের ব্যবস্থা করা যাবে। ভাত—ডাল বড় একটা খাবেন না। এগ—ফ্লিপ, বোনম্যারো সুপ, চিকেন—স্টু, এইসব। বিকেলে একটু বার্গণ্ডি খেতে পারেন। বরফ—জল খুব খাবেন। হ্যাঁ, বত্রিশ টাকা। থ্যাঙ্ক ইউ।

নন্দবাবু কম্পিত পদে প্রস্থান করিলেন।

সন্ধ্যাবেলা বঙ্কুবাবু বলিলেন—’আরে তখনি আমি বারণ করেছিলুম ওর কাছে যেয়ো না। ব্যাটা মেড়োর পেটে হাত বুলিয়ে খায়। এঁঃ, খুলির ওপর তুরপুন চালাবেন!’

ষষ্ঠীবাবু। আমাদের পাড়ার তারিণী কবিরাজকে দেখালে হয় না?

গুপীবাবু। না না, যদি বাস্তবিক নন্দর মাথার ভেতর ওলট—পালট হয়ে গিয়ে থাকে তবে হাতুড়ে বদ্দির কম্ম নয়। হোমিওপ্যাথিই ভাল।

নিধু। আমার কথা তো শুনবে না বাওআ। ডাক্তারি তোমার ধাতে না সয় তো একটু কোবরেজি করতে শেখ। দরওয়ানজী দিব্বি একলোটা বানিয়েছে। বল তো একটু চেয়ে আনি।

হোমিওপ্যাথিই স্থির হইল।

পরদিন খুব ভোরে নন্দবাবু নেপাল ডাক্তারের বাড়ি আসিলেন। রোগীর ভিড় এখনও আরম্ভ হয় নাই, অল্পক্ষণ পরেই তাঁর ডাক পড়িল। একটি প্রকাণ্ড ঘরের মেঝেতে ফরাশ পাতা। চারিদিকে স্তূপাকারে বহি সাজানো। বহির দেওয়ালের মধ্যে গল্পবর্ণিত শেয়ালের মত বৃদ্ধ নেপালবাবু বসিয়া আছেন। মুখে গড়গড়ার নল, ঘরটি ধোঁয়ায় ঝাপসা হইয়া গিয়াছে।

নন্দবাবু নমস্কার করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। নেপাল ডাক্তার কটমট দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিলেন—’বসবার জায়গা আছে।’ নন্দ বসিলেন।

নেপাল। শ্বাস উঠেছে?

নন্দ। আজ্ঞে?

নেপাল। রুগীর শেষ অবস্থা না হ’লে তো আমায় ডাকা হয় না, তাই জিজ্ঞেস করছি।

নন্দ সবিনয়ে জানালেন তিনিই রোগী।

নেপাল। অ্যালোপ্যাথ ডাকাত ব্যাটারা ছেড়ে দিলে যে বড়? তোমার হয়েছে কি?

নন্দবাবু তাঁহার ইতিবৃত্ত বর্ণনা করিলেন।

নেপাল। তফাদার কী বলেছে?

নন্দ। বললেন আমার মাথায় টিউমার আছে।

নেপাল। তফাদারের মাথায় কি আছে জান? গোবর। আর টুপির ভেতর শিং, জুতোর ভেতর খুর। পাতলুনের ভেতর ল্যাজ। খিদে হয়?

নন্দ। দু—দিন থেকে একেবারে হয় না।

নেপাল। ঘুম হয়?

নন্দ। না।

নেপাল। মাথা ধরে?

নন্দ। কাল সন্ধ্যেবেলা ধরেছিল।

নেপাল। বাঁ দিক?

নন্দ। আজ্ঞে হ্যাঁ।

নেপাল। না ডান দিক?

নন্দ। আজ্ঞে হ্যাঁ।

নেপাল ধমক দিয়া বলিলেন—’ঠিক ক’রে বল।’

নন্দ। আজ্ঞে ঠিক মধ্যিখানে।

নেপাল। পেট কামড়ায়?

নন্দ। সেদিন কামড়েছিল। নিধে কাবলী মটরভাজা এনেছিল তাই খেয়ে—

নেপাল। পেট কামড়ায় না মোচড় দেয় তাই বল।

নন্দ বিব্রত হইয়া বলিলেন—’হাঁচোড়—পাঁচোড় করে।’

ডাক্তার কয়েকটি মোটা মোটা বহি দেখিলেন, তার পর অনেকক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলেন—’হু’। একটা ওষুধ দিচ্ছি নিয়ে যাও। আগে শরীর থেকে অ্যালোপ্যাথিক বিষ তাড়াতে হবে। পাঁচ বছর বয়সে আমায় খুনে ব্যাটারা দু—গ্রেন কুইনীন দিয়েছিল, এখনও বিকেলে মাথা টিপ টিপ করে। সাতদিন পরে ফের এসো। তখন আসল চিকিৎসা শুরু হবে।’

নন্দ। ব্যারামটা কি আন্দাজ করছেন?

ডাক্তার ভ্রূকুটি করিয়া বলিলেন—’তা জেনে তোমার চারটে হাত বেরবে নাকি? যদি বলি তোমার পেটে ডিফারেনশ্যাল ক্যালকুলস হয়েছে কিছু বুঝবে? ভাত খাবে না, দু—বেলা রুটি, মাছ—মাংস বারণ, শুধু মুগের ডালের যূষ, স্নান বন্ধ, গরম জল একটু খেতে পার, তামাক খাবে না, ধোঁয়া লাগলে ওষুধের গুণ নষ্ট হবে। ভাবছো আমার আলমারির ওষুধ নষ্ট হয়ে গেছে? সে ভয় নেই, আমার তামাকে সালফার—থার্টি মেশানো থাকে। ফী কত, তাও ব’লে দিতে হবে নাকি? দেখছো না দেওয়ালে নোটিশ লটকানো রয়েছে বত্রিশ টাকা? আর ওষুধের দাম চার টাকা।’

নন্দবাবু টাকা দিয়া বিদায় লইলেন।

নিধু বলিল—’কেন বাওআ কাঁচা পয়হা নষ্ট করছ? থাকলে পাঁচ রাত বক্সে ব’সে ঠিয়াটার দেখা চলত। ও নেপাল—বুড়ো মস্ত ঘুঘু, নন—দাকে ভালমানুষ পেয়ে জেরা ক’রে থ ক’রে দিয়েছে। পড়ত আমার পাল্লায় বাছাধন, কত বড় হোমিওফাঁক দেকে নিতুম। এক চুমুকে তার আলমারি সুদ্ধ ওষুধ সাবড়ে না দিতে পারি তো আমার নাক কেটে দিও।’

গুপী। আজ আপিসে শুনছিলুম কে একজন বড় হাকিম ফারাক্কাবাদ থেকে এখানে এসেছে। খুব নামডাক, রাজা—মহারাজারা সব চিকিৎসা করাচ্ছে। একবার দেখালে হয় না?

ষষ্ঠী। এই শীতে হাকিমী ওষুধ? বাপ, শরবত খাইয়েই মারবে। তার চেয়ে তারিণী কোবরেজ ভাল।

অতঃপর কবিরাজী চিকিৎসাই সাব্যস্ত হইল।

পরদিন সকালে নন্দবাবু তারিণী কবিরাজের বাড়ি উপস্থিত হইলেন। কবিরাজ মহাশয়ের বয়স ষাট, ক্ষীণ শরীর, দাড়ি—গোঁফ কামানো। তেল মাখিয়া আটহাতী ধুতি পরিয়া একটি চেয়ারের উপর উবু হইয়া বসিয়া তামাক খাইতেছেন। এই অবস্থাতেই ইনি প্রত্যহ রোগী দেখেন। ঘরে একটি তক্তপোশ, তাহার উপর তেলচিটে পাটি এবং কয়েকটি মলিন তাকিয়া। দেওয়ালের কোলে দুটি ঔষধের আলমারি।

নন্দবাবু নমস্কার করিয়া তক্তপোশে বসিলে কবিরাজ জিজ্ঞাসা করিলেন—’বাবুর কনথে আসা হচ্চেচ?’ নন্দবাবু নিজের নাম ও ঠিকানা বলিলেন।

তারিণী। রুগীর ব্যামোডা কী?

নন্দবাবু জানাইলেন তিনিই রোগী এবং সমস্ত ইতিহাস বিবৃত করিলেন।

তারিণী। মাথার খুলি ছেঁদা করে দিয়েছে নাকি?

নন্দ। আজ্ঞে না, নেপালবাবু বললেন পাথুরি, তাই আর মাথায় অস্তর করাই নি।

তারিণী। নেপাল! সে আবার কেডা?

নন্দ। জানেন না? চোরবাগানের নেপালচন্দ্র রায় M.B.F.T.S—মস্ত হোমিওপ্যাথ।

তারিণী। অঃ, ন্যাপলা, তাই কও। সেডা আবার ডাগদর হ’ল কবে? বলি, পাড়ায় এমন বিচক্ষণ কোবরেজ থাকতি ছেলেছোকরার কাছে যাও কেন?

নন্দ। আজ্ঞে, বন্ধু—বান্ধবরা বললে ডাক্তারের মতটা আগে নেওয়া দরকার, যদিই অস্ত্র চিকিৎসা করতে হয়।

তারিণী। যন্তিবাবু—রি চেন? খুলনের উকিল যন্তিবাবু?

নন্দ। ঘাড় নাড়িলেন।

তারিণী। তাঁর মামার হয় ঊরুস্তম্ভ। সিভিল সার্জন পা কাটলে। তিন দিন অচৈতন্যি। জ্ঞান হলি পর কইলেন, আমার ঠ্যাং কই? ডাক তারিণী স্যানরে। দেলাম ঠুকে এক দলা চ্যবনপ্রাশ। তারপর কি হ’ল কও দিকি?

নন্দ। আবার পা গজিয়েছে বুঝি?

‘ওরে অ ক্যাবলা, দেখ দেখ বিড়েলে সবডা ছাগলাদ্য ঘ্রেত খেয়ে গেল’— বলিতে বলিতে কবিরাজ মহাশয় পাশের ঘরে ছুটিলেন। একটু পরে ফিরে আসিয়া যথাস্থানে বসিয়া বলিলেন—’দ্যাও নাড়ীডা একবার দেখি। হঃ, যা ভাবছিলাম তাই। ভারী ব্যামো হয়েছিল কখনও?’

নন্দ। অনেক দিন আগে টাইফয়েড হয়েছিল।

তারিণী। ঠিক ঠাউরেছি। পাঁচ বছর আগে?

নন্দ। প্রায় সাড়ে সাত বছর হ’ল।

তারিণী। একই কথা, পাঁচ দেরা সারে সাত। প্রাতিক্কালে বোমি হয়?

নন্দ। আজ্ঞে না।

তারিণী। হয় জানতি পার না। নিদ্রা হয়?

নন্দ। ভাল হয় না।

তারিণী। হবেই না তো। উর্ধু হয়েছে কি না। দাঁত কনকন করে?

নন্দ। আজ্ঞে না।

তারিণী। করে, জানতি পার না, যা হোক, তুমি চিন্তা কোরো নি বাবা। আরাম হয়ে যাবানে। আমি ওষুধ দিচ্চি।

কবিরাজ মহাশয় আলমারি হইতে একটি শিশি বাহির করিলেন, এবং তাঁহার মধ্যস্থিত বড়ির উদ্দেশ্যে বলিলেন— ‘লাফাস নে, থাম থাম। আমার সব জীয়ন্ত ওষুধ, ডাকলি ডাক শোনে। এই বড়ি সকাল—সন্ধি একটা করি খাবা। আবার তিনদিন পরে আসবা। বুজেচ?’

নন্দ। আজ্ঞে হ্যাঁ।

তারিণী। ছাই বুজেচ। অনুপান দিতি হবে না? ট্যাবা লেবুর রস আর মধুর সাথি মাড়ি খাবা। ভাত খাবা না। ওলসিদ্ধ, কচুসিদ্ধ এইসব খাবা। নুন ছোবা না। মাগুর মাছের ঝোল একটু চ্যানি দিয়া রাঁধি খাতি পার। গরম জল ঠান্ডা করি খাবা।

নন্দ। ব্যারামটা কি?

তারিণী। যারে কয় উদুরি। উর্ধুশ্লেষ্মাও কইতি পার।

নন্দবাবু কবিরাজের দর্শনী ও ঔষধের মূল্য দিয়া বিমর্ষচিত্তে বিদায় লইলেন।

নিধু বলিল—’কি দাদা, কোব্রেজির সাধ মিটল?

গুপী। নাঃ এ—সব বাজে চিকিৎসার কাজ নয়। কোথাও চেঞ্জে চল।

বঙ্কু। আমি বলি কি, নন্দ বে—থা করে ঘরে পরিবার আনুক। এ—রকম দামড়া হয়ে থাকা কিছু নয়।

নন্দ চিঁ চিঁ স্বরে বলিলেন—’আর পরিবার। কোন দিন আছি, কোন দিন নেই। এই বয়সে একটা কচি বউ এনে মিথ্যে জঞ্জাল জোটানো।’

নিধু বলিল—’নন—দা, একটা মোটর কেন মাইরি। দু—দিন হাওয়া খেলেই চাঙ্গা হয়ে উঠবে। সেভেন সিটার হডসন; ষেটের কোলে আমরা তো পাঁচজন আছি।’

ষষ্ঠী। তা যদি বললে, তবে আমার মতে মোটর—কারও যা পরিবারও তা। ঘরে আনা সোজা; কিন্তু মেরামতী খরচ যোগাতে প্রাণান্ত। আজ টায়ার ফাটল কাল গিন্নীর অম্বল—শূল, পরশু ব্যাটারি খারাপ, তরশু ছেলেটার ঠাণ্ডা লেগে জ্বর। অমন কাজ ক’রো না, নন্দ! জেরবার হবে। এই শীতকালে কোথা, দু—দণ্ড লেপের মধ্যে ঘুমুব মশায়, তা নয়, সারারাত প্যান প্যান ট্যাঁ ট্যাঁ।

নিধু। ষষ্ঠী খুড়ো যে রকম হিসেবী লোক, একটি মোটা—সোটা রোঁ—ওলা ভাল্লুকের মেয়ে বে করলে ভাল করতেন। লেপ—কম্বলের খরচা বাঁচত।

গুপী। যাঁহা বাহান্ন তাঁহা তিপান্ন। কাল সকালে নন্দ একবার হাকিম সাহেবের কাছে যাও। তারপর যা হয় করা যাবে।

নন্দবাবু অগত্যা রাজী হইলেন।

হাজিক—উল—মুলক বিন লোকমান নূরুল্লা গজন ফরুল্লা অল হকিম য়ুনানী লোয়ার চিৎপুর রোডে বাসা লইয়াছেন। নন্দবাবু তেতলায় উঠিলে একজন লুঙ্গিপরা ফেজ—ধারী লোক তাহাকে বলিল— ‘আসেন বাবুমশায়। হামি হাকিম সাহেবের মীরমুন্সী। কি বেমারি বোলেন, হামি লিখে হুজুরকে ইতালা ভেজিয়ে দিব।’

নন্দ। বেমারি কি সেটা জানতেই তো আসা বাপু।

মুন্সী। তব ভি কুছু তো বোলেন। না —তাকতি, বুখার, পিল্লি, চেকে ঘেঘ, বাওআসির, রাত—অন্ধি—

নন্দ। ও—সব কিছু বুঝলুম না বাপু। আমার প্রাণটা ধড়ফড় করছে।

মুন্সী। সো হি বোলেন। দিল তড়পনা। মোহর এনেছেন?

নন্দ। মোহর?

মুন্সী। হাকিম সাহেব চাঁদি ছোন না। নজরানা দো মোহর। না থাকে আমি দিচ্ছি। পয়তালিশ টাকা, আর বাট্টা দো টাকা, আর রেশমী রুমাল দো টাকা। দরবারে যেয়ে আগে হুজুরকে বন্দগি জনাব বোলবেন, তার পর রুমালের ওপর মোহর রেখে সামনে ধরবেন।

মুন্সী নন্দবাবুকে তালিম দিয়া দরবারে লইয়া গেল। একটি বৃহৎ ঘরে গালিচা পাতা, একপার্শ্বে মসনদের উপর তাকিয়া হেলান দিয়া হাকিম সাহেব ফরসিতে ধুমপান করিতেছেন। বয়স পঞ্চান্ন, বাবরী চুল, গোঁফ খুব ছোট করিয়া ছাঁটা। আবক্ষলম্বিত দাড়ির গোড়ার দিক সাদা, মধ্য লাল, ডগায় নীল। পরিধান সাটিনের চুড়িদার ইজার, কিংখাপের জোব্বা, জরির তাজ। সম্মুখে ধূপদানে মুসব্বর এবং রুমী মস্তগি জ্বলিতেছে, পাশে পিকদান, পানদান, আতরদান ইত্যাদি। চার—পাঁচজন পারিষদ হাঁটু মুড়িয়া বসিয়া আছে এবং হাকিমের প্রতি কথায় ‘কেরামত’ বলিতেছে। ঘরের কোণে একজন ঝাঁকড়া—চুলো চাপ—দেড়ে লোক সেতার লইয়া পিড়িং পিড়িং এবং বিকট অঙ্গভঙ্গী করিতেছে।

নন্দবাবু অভিবাদন করিয়া মোহর নজর দিলেন। হাকিম ঈষৎ হাসিয়া আতরদান হইতে কিঞ্চিৎ তুলা লইয়া নন্দর কানে গুঁজিয়া দিলেন। মুন্সী বলিল—’আপনি বাংলায় বাতচিত বোলেন। হামি হুজুরকে সমঝিয়ে দিব।’

নন্দবাবুর ইতিবৃত্ত শেষ হইলে হাকিম ঋষভকণ্ঠে বলিলেন—’সর লাও!’

নন্দ শিহরিয়া উঠিলেন। মুন্সী আশ্বাস দিয়া বলিল—’ডরবেন না মশায়। জনাবকে আপনার শির দেখলান!’

নন্দর মাথা টিপিয়া হাকিম বলিলেন—’হড্ডি পিলপিলায় গয়া।’

মুন্সী। শুনেছেন? মাথার হাড় বিলকুল লরম হয়ে গেছে।

হাকিম তিনরঙা দাড়িতে আঙুল চালাইয়া বলিলেন—’সুর্মা সুর্খ!’

একজন একটা লাল গুঁড়া নন্দর চোখের পল্লবে লাগাইয়া দিল। মুন্সী বুঝাইল—’আঁখ ঠাণ্ডা থাকবে, নিদ হোবে।’ হাকিম আবার বালিলেন—’রোগন বব্বর।’ মুন্সী হাঁকিল ‘এ জী বালবর, অস্তুরা লাও।’

নন্দবাবু—’হাঁ—হাঁ’ আরে তুম করো কি’—বলিতে বলিতে চট করিয়া তাঁহার ব্রহ্মতালুর উপর দু—ইঞ্চি সমচতুষ্কোণ কামাইয়া দিল, আর একজন তাহার উপর একটা দুর্গন্ধ প্রলেপ লাগাইল। মুন্সী বলিল—’ঘবড়ান কেন মশয়, এ হচ্ছে বব্বরী সিংগির মাথার ঘি। বহুত কিম্মত। মাথার হাড্ডি সকত হোবে।’

নন্দবাবু কিয়ৎক্ষণ হতভম্ব অবস্থায় রহিলেন। তার পর প্রকৃতিস্থ হইয়া বেগে ঘর হইতে পলায়ন করিলেন। মুন্সী পিছনে ছুটিতে ছুটিতে বলিল—’হামার দস্তুরি?’ নন্দ একটা টাকা ফেলিয়া দিয়া তিন লাফে নীচে নামিয়া গাড়িতে উঠিয়া কোচমানকে বলিলেন—’হাঁকাও!’

সন্ধ্যাকালে বন্ধুগণ আসিয়া দেখিলেন বৈঠকখানার দরজা বন্ধ। চাকর বলিল, বাবুর বড় অসুখ, দেখা হইবে না। সকলে বিষণ্ণচিত্তে ফিরিয়া গেলেন।

সমস্ত রাত বিছনায় ছটফট করিয়া ভোর চারটার সময় নন্দবাবু ভীষণ প্রতিজ্ঞা করিলেন যে আর বন্ধুগণের পরামর্শ শুনিবেন না, নিজের ব্যবস্থা নিজেই করিবেন।

বেলা আটটার সময় নন্দ বাড়ি হইতে বাহির হইলেন এবং বড় রাস্তায় ট্যাক্সি ধরিয়া বলিলেন—’সিধা চলো।’ সঙ্কল্প করিয়াছেন, মিটারে এক টাকা উঠিলেই ট্যাক্সি হইতে নামিয়া পড়িবেন, এবং কাছাকাছি যে চিকিৎসক পান তাহারই মতে চলিবেন—তা সে অ্যালোপ্যাথ, হোমিওপ্যাথ, কবিরাজ, হাতুড়ে, অবধূত, মাদ্রাজী বা চাঁদসীর ডাক্তার যেই হউক।

বউবাজারে নামিয়া একটি গলিতে ঢুকিতেই সাইনবোর্ড নজরে পড়িল—’ডাক্তার মিস বি, মল্লিক।’ নন্দবাবু ‘মিস’ শব্দটি লক্ষ্য করেন নাই, নতুবা হয়তো ইতস্ততঃ করিতেন। একেবারে সোজা পরদা ঠেলিয়া একটি ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলেন।

মিস বিপুলা মল্লিক তখন বাহিরে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া কাঁধের উপর সেফটি—পিন আঁটিতেছিলেন। নন্দকে দেখিয়া মৃদুস্বরে বলিলেন—’কি চাই আপনার?’

নন্দবাবু প্রথমটা অপ্রস্তুত হইলেন, তার পর মরিয়া হইয়া ভাবিলেন—’দূর হ’ক না—হয় লেডি ডাক্তারের পরামর্শই নেব। বলিলেন—’বড় বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি।’

মিস মল্লিক। পেন আরম্ভ হয়েছে?

নন্দ। পেন তো কিছু টের পাচ্ছি না।

মিস। ফার্স্ট কনফাইনমেণ্ট?

নন্দ। আজ্ঞে?

মিস। প্রথম পোয়াতী?

নন্দ অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন—’আমি নিজের চিকিৎসার জন্যই এসেছি।’

মিস মল্লিক আশ্চর্য হইয়া বলিলেন—’নিজের জন্যে? ব্যাপার কি?’

সমগ্র ইতিহাস বর্ণনা শেষ হইলে মিস মল্লিক নন্দবাবুর স্বাস্থ্য সম্বন্ধে দু—চারটি প্রশ্ন করিয়া কহিলেন—’আপনার নামটি জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?’

নন্দ। শ্রীনন্দদুলাল মিত্র।

মিস। বাড়িতে কে আছেন?

নন্দ জানাইলেন তিনি বহুদিন বিপত্নীক, বাড়িতে এক বৃদ্ধা পিসী ছাড়া কেউ নাই।

মিস। কজকর্ম কি করা হয়

নন্দ। তা কিছু করি না। পৈতৃক সম্পত্তি আছে।

মিস। মোটর—কার আছে?

নন্দ। নেই তবে কেনবার ইচ্ছে আছে।

মিস মল্লিক আরও নানা প্রকার প্রশ্ন করিয়া কিছুক্ষণ ঠোঁটে হাত দিয়া চিন্তা করিলেন তার পর ধীরে ধীরে বামে দক্ষিণে ঘাড় নাড়িলেন।

নন্দ ব্যাকুল হইয়া বলিলেন—’দোহাই আপনার, সত্যি ক’রে বলুন আমার কি হয়েছে। ঢিউমার, না পাথুরি, না উদরী, না কালাজ্বর, না হাইড্রোফোবিয়া?’

মিস মল্লিক হাসিয়া বলিলেন—’কেন আপনি ভাবছেন? ও—সব কিছুই হয় নি। আপনার শুধু একজন অভিভাবক দরকার।’

নন্দ অধিকতর কাতরকণ্ঠে বলিলেন—’তবে কি আমি পাগল হয়েছি?’

মিস মল্লিক মুখে রুমাল দিয়া খিল খিল করিয়া হাসিয়া বলিলেন—’ও ডিয়ার ডিয়ার নো। পাগল হবেন কেন? আমি বলছিলুম আপনার যত্ন নেবার জন্যে বাড়িতে উপযুক্ত লোক থাকা দরকার।

নন্দ। কেন পিসীমা তো আছেন।

মিস মল্লিক পুনরায় হাসিয়া বলিলেন—দি আইডিয়া! মাসীপিসীর কাজ নয়। যাক, আপাতত একটা ওষুধ দিচ্ছি, খেয়ে দেখবেন। বেশ মিষ্টি, এলাচের গন্ধ। এক হপ্তা পরে আবার আসবেন।

নন্দবাবু সাত দিন পরে পুনরায় মিস বিপুলা মল্লিকের কাছে গেলেন। তার পর দু—দিন পরে আবার গেলেন। তার পর প্রত্যহ।

তার পর একদিন নন্দবাবু পিসীমাতাকে কাশীধামে রওনা করাইয়া দিয়া মস্ত বাজার করিলেন। এক ঝুড়ি গলদা চিংড়ি, এক ঝুড়ি মটন, তদনুযায়ী ঘি, ময়দা, দই, সন্দেশ ইত্যাদি। বন্ধুবর্গ খুব খাইলেন। নন্দবাবু জরিপাড় সুক্ষ্ম ধুতির উপর সিল্কের পাঞ্জাবি পরিয়া সলজ্জ সম্মিতমুখে সকলকে আপ্যায়িত করিলেন।

মিসেস বিপুলা মিত্র এখন আর স্বামী ভিন্ন অপর রোগীর চিকিৎসা করেন না। তবে নন্দবাবু ভালই আছেন। মোটর—কার কেনা হইয়াছে। দুঃখের বিষয়, সান্ধ্য আড্ডাটি ভাঙিয়া গিয়াছে।

ভারতবর্ষ, কার্তিক ১৩৩০ (১৯২৩)

No comments