পরমায়ু – সন্তোষকুমার ঘোষ

পরমায়ু – সন্তোষকুমার ঘোষ

হাওড়া ইস্টিশনে গাড়ি দাঁড়াতেই প্রথমে কুলি পরে হোটেলের দালালেরা হেঁকে ধরেছিল, ঠিক দশবছর আগেও যেমন ধরত, তেমনই পায়ে-পায়ে-ঠোক্কর, ভিড়, কানে তালা-লাগা শোরগোল। একটু বেশী বই কম নয়। তবু গেটে টিকিটটি সঁপে বাইরে পা দিয়েই সুরপতি নিজেকে বড় একা বোধ করেছিলেন। ম্যামথকঙ্কাল ব্রীজটার নীচে ভাগীরথী যথাপূর্ব পুণ্যদায়িনী পুণ্যবাহিনী উপরের ধোঁয়াঘঘালাটে আকাশটুকুও চিনতে পারছেন ঠিক। তবু সুরপতি মৃদু গলায় নিজেকে বললেন, ‘কিছুই আসলে তখনকার মত নেই।’ মোড়ে মোড়ে এমন লালচোখ আলোর ধমক কি তখন ছিল, না দূরে দূরে এত আকাশলেহী বাড়ি। সেকালের হিলহিলে পিছল-কেঁচো গলিগুলিও কেমন উদারহৃদয় হয়ে গেছে দেখা।

প্যাঁকপ্যাঁক ট্যাকসিকে কেবলই ডাইনে বাঁয়ে ঘোরার নির্দেশ দিয়েছেন, আর মনে মন ভয় পেয়েছেন, সেই পীতাম্বর সাহা লেনটিকে বোধহয় খুঁজে পাবেন না। ভারী ভারী উৎসাহী শহর সংস্কারক রোলারের তলায় সে হয়ত কবে গুড়িয়ে গেছে। ঝুঁকে পড়ে সুরপতি এদিক ওদিক দেখেছেন, আর সন্দিগ্ধ, হয়রান ট্যাকসিওয়ালাকে ভরসা দিয়েছেন, ‘আর একটু, আরও একটু।’

অবাক ব্যাপার, কী এক সুকৃতির জোরে পীতাম্বর সাহা লেনটি বেঁচে গেছে। আর দশ বছর আগে জীর্ণবাসের মত যাকে ত্যাগ করে গিয়েছিলেন, সেই মেস-বাড়িটিও। ট্যাকসিকে ভাড়া চুকিয়ে দিলেন আগে, সামান্যই সামান, নামিয়ে নিতে অসুবিধে হল না। তার পর কড়া নাড়লেন।

ছাইমাখা হাতের পিঠ দিয়ে যে ঝি দরজা খুলে দিল, তাকে সুরপতি চেনেন না, অন্তত তাঁর আমলে দেখেননি। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘অনুকূলবাবুর মেস ত?’ কম কথার মানুষ ঝি, আঙুল। দিয়ে অফিসঘর দেখিয়ে দিল। একটা চাকর সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে আসছিল, সেও নতুনা অফিসঘরের বাঁধানো কালীর পটটা ধুলো আর ঝুলে ভরে গেছে, কাঁচও ভাঙা, তবু চেনা যায়। কমলেকামিনী ক্যালেন্ডারটা অবশ্য তখন ছিল না। টেবিলের উপরে দু’পা তুলে দিয়ে যিনি নাকে সৰ্গম তুলছিলেন, তিনি সুরপতিবাবুর পায়ের সাড়ায় চোখ মেলে তাকালেন পা দু’টি নামিয়ে নিলেন তাড়াতাড়ি। ‘কী চান?’

নাকে যার মেঘডম্বর, তার গলার আওয়াজ এত মিহি কী করে হয়, এই প্রশ্নের মীমাংসা নিয়ে সুরপতিবাবু তখনই যে ব্যস্ত হয়ে ওঠেননি, তার কারণ তখনও এখানে আশ্রয় পাবেন কিনা, তার নিশ্চয়তা ছিল না। সুতরাং ক্ষীণতর কণ্ঠে বলেছেন, ‘অনুকূলবাবুর মেস? এখানে সীট পাওয়া যাবে? ক’দিন থাকতে চাই।’ শ্রোতার মুখের একটি রেখাও স্থানচ্যুত হল না দেখে তাড়াতাড়ি জুড়ে দিয়েছেন, ‘অনুকূলবাবুকে আমি চিনি। এখানে আমি অনেক দিন আগে থেকে গেছি। আমার নাম সুরপতি চৌধুরী।’

ভেবেছিলেন, নামটা শুনে লোকটা হয়ত চকিত চোখে তাকাবে, শ্রদ্ধায় সমীহে চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে বলবে, বসুন। আশানুরূপ ভাববৈলক্ষণ্য দেখতে পেলেন না লোকটি নিরুত্তরে শুধু একটা খাতা ঠেলে দিয়ে বলল, ‘সই করুন। পেশা, বর্তমান ঠিকানা এ-সবও লিখবেন। রুলটানা ঘর আছে, দেখে নিন।’

পেশার ঘরে লিখতে পারতেন ‘ব্যবসা’ তবু কী ভেবে সুরপতি লিখলেন ‘লেখক’। লোকটার মুখে তবু বিস্ময়ের চিহ্নমাত্র নেই। কতকটা ওকে শুনিয়ে, কতকটা নিজের মনে মনে বললেন, ‘সব কেমন বদলে গেছে, না? পুরনো বোর্ডার কি একজনও নেই?’ কথাটা নিজের কানেই কেমন বোকা-বোকা শোনাল সেটা ঢাকা দিতেই সুরপতি যেন আরও একটু বোকার মত হাসলেন, ‘কালীর পটটা কিন্তু ঠিক আছে। অনুকূলবাবু এখনও দু’ বেলা জপ করেন?’

সে কথার জবাব না দিয়ে লোকটা গম্ভীর গলায় বললে, ‘পাঁচ টাকা অ্যাডভানস।’ ঘণ্টা বাজিয়ে চাকরটাকে ডেকে হুকুম দিলে, ‘মাল দোতলায় ছ’ নম্বর ঘরে তুলে দো’।

অনুকূলবাবু চিনেছেন ঠিক। অফিস-ফেরত খাতায় নাম দেখে সোজা উঠে এসেছেন উপরে। আগেকার তুলনায় কিছু শীর্ণ, একটু বা ময়লা হাসলেন, দেখা গেল দুটি দাঁতও খুইয়েছেন। বললেন, ‘তাই ত বলি, কো ভাগনে বললে, পুরনো বোের্ডার। তা ও ত এই সবে বছর দুই হল দেশ থেকে এসেছে, আপনাদের দেখেনি। শুধু ওই লেখক’ কথাটি লিখেই যা ধাঁধায় ফেলে দিয়েছিলেন মশাই।’

‘কেন, আমি কি লেখক নই?’ ভয়ে ভয়ে, কতকটা আত্মপরিচয় দেবার কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে সুরপতি বললেন, ‘আপনার কিছু মনে থাকে না অনুকূলবাবু। এই মেসে বসেই তিনটে বই—’

‘মনে থাকবে না কেন, আছে। যাবার আগেও মেসে এই ঘরটিতেই ছিলেন। রেলে চাকরি পেলেন, তিন মাসের মাথায় বদলি আমাদের সবাইকে জোর ফীসট দিয়েছিলেন, বলছেন মনে নেই? এ-শর্মার সব মনে থাকে সুরপতিবাবু। কত বোর্ডার এই ত্রিশ বছরে এল গেল, কাউকে ভুলিনি। এখনও সবাইকে ডেকে বলি, তোরা একটুকরো মাছের ভাগ কম হলে চেঁচিয়ে মাথা ফাটাস, জানা আছে কে কোন লাটের বেটা। এই মেসেই আগে অনেক বড় বড় চাকুরে থেকে গেছে, এখানকার ঝোলভাত খেয়ে অনেকে অফিসার হয়েছে, তারা কোনদিন টু শব্দটি করেনি। অনুকূল শর্মার মেসের ভাতের অনেক পয়।’ অনুকূল সহসা উঁচু গ্রামে একটি হাসি ধরলেন, তার তরঙ্গ দেয়ালে দেয়ালে ঠোক্কর খেলা। দু’পা পিছিয়ে দাঁড়ালেন সুরপতি, হাসির গমকে এই কোনমতে মেরামতি খাড়া বাড়িটির চুনবালি না খসে পড়ে। সে-হাসি সংবরণও করলেন অনুকূল নিজেই। উচ্চতম শিখর থেকে খসে কণ্ঠস্বর একেবারে গুহাহিত হল ‘এখনও সেই কাজই করছেন? নিশ্চয়ই এতদিনে গেজেটেড হয়েছেন?’

কেমন অস্বস্তি বোধ করছিলেন সুরপতি, প্রসঙ্গটা চাপা দিতে তাড়াতাড়ি বললেন, ‘কাজ ছেড়ে দিয়ে আমি এখন ব্যবসা করছি অনুকূলবাবু। রেলেরই ঠিকেদারি।’

ভুরু কপালে উঠে গিয়ে অনুকূলবাবুর চোখ দু’টি আপনা থেকে যেন গোল হয়ে গেল। ‘ওরে বাবা, তবে ত আপনি এখন আমাদের নাগালের বাইরে নইলে বলতুম আমার ভাগনেটাকে কোথাও ঢুকিয়ে দিতে বলছেন সে-ক্ষমতা আপনার নেই? জানি সুরপতিবাবু, চিরকালই আপনি এমনি লাজুক, নিজেকে কিছুতেই বড় বলবেন না এত ওপরে উঠেছেন, আপনার হ্যাট-কোট-বুট দেখেই বুঝতে পারছি, তবু তেমনি রয়ে গেছেন। দেখেছেন আপনার কথা কিছুই ভুলিনি, স্বভাবটুকুও মনে করে রেখেছি?’

‘বিশ্রাম করুন’, বলে অনুকূলবাবু একটু পরে উঠে গেছেন, তবু সুরপতি পোশাক না ছেড়ে অনেকক্ষণ খাটে পা ঝুলিয়ে তেমনি বসে থেকেছেন। দেয়ালে পানের পিকের দাগ, বিলিতী মাটি চটে-যাওয়া মেঝে, দরজার কোণে অধ্যবসায়ী মাকড়সার সূক্ষ্ম কারুকর্ম—সব আচ্ছন্ন ক্লান্ত চোখের সামনে ধীরে ধীরে একটি একাকার অবয়ব হয়ে উঠেছে, চোখের পাতা খুঁজে আস্তে আস্তে মাথা নেড়েছেন সুরপতি। কিছুই ভোলেননি, এ-কথা অনুকুলবাবু বার বার তারস্বরে ঘোষণা করে গেছেন, তবু একটা দীর্ঘনিশ্বাসের সঙ্গে মনের নীচতলা থেকে এই ভয়টা উঠে এসেছে, সে দিনের অনেক কথাই বুঝি অনুকূলবাবুর মনে নেই। এই ঘরে বসে একদিন তাঁর লেখা নাটকের পুরো তিনটি অঙ্ক পড়ে শুনিয়েছিলেন, উদাত্ত-অনুদাত্ত-স্বরিত স্বরে, সে-সব না হয় ভুলেই গেছেন, কিন্তু তাঁর একটি উপন্যাস যে অনুকূলবাবুকে উৎসর্গ করেছিলেন তাও কি মনে নেই?

কতক্ষণ চুপচাপ চোখ বুজে ছিলেন হুঁশ নেই, হঠাৎ টুপ করে একটা আওয়াজ হতেই সুরপতি ধড়মড় করে উঠে বসলেন। উপরের কড়িকাঠ অর্ধেকটা উইয়ে খেয়ে গেছে, একটা তড়বড়ে টিকটিকি সেটা টপকাতে গিয়ে খসে গিয়ে থাকবে। পড়েই তরতর দৌড়, কিন্তু লেজটা রেখে গেছে এখানেই, সুরপতির বালিশটার ঠিক পাশেই তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে তিনি টিকটিকিটাকে চেপে ধরেছিলেন কিনা, ঠিক খেয়াল করতে পারলেন না সুরপতি কিন্তু ধরে থাকতেও পারেন এই সন্দেহে গায়ে কেমন কাঁটা দিল, যে হাতটা বালিশে রেখেছিলেন সেটা যেন বশে নেই। হেঁট হয়ে সুরপতি মোজা পরতে শুরু করলেন, হাতড়ে খাটের নীচে থেকে জুতো জোড়াকেও টেনে। আনলেন ঠিক। তাই ত, বড় দেরি হয়ে গেছে। এখুনি অফিসারের বাড়ি দৌড়োতে হবে পাঁচ নম্বর স্কীমের ঠিকেটার জন্যে, যে-তদ্বিরে এতদূর এসেছেন। ঘড়িতে সময় দেখলেন, সাড়ে ছটা। এরই মধ্যে এখানে দিন ফুরিয়ে যায়? এই ত একটু আগে খাটের পায়ার কাছে সে বসেছিল, শেষবেলার নরম একটুকরো রোদ, পা গুটিয়ে ছোট মেয়েটির মা তাকে পাহারা রেখে সুরপতি চোখ বুজেছিলেন। আর যেই চোখ বোঁজা অমনি সঙ্গে সঙ্গে সে পালিয়েছে একছুটে হয়ত সিঁড়ি টপকে, হয়ত জানালা গলিয়ে। এ-ঘরে শুধু একমুঠো অন্ধকার তার পায়ের ধুলোর মত পড়ে আছে।

খুট করে ফের শব্দ হল চাকর চা এনেছে, আলো জ্বলেছে।

গায়ে কোট চড়াতে চড়াতে সুরপতি ঘর্ঘর গলায় তাকে বললেন, ‘ওখানে রেখে যাও।’ দেয়ালের পেরেকে হাত-আয়না ঝুলিয়ে সুরপতি সোজা হয়ে সামনে দাঁড়ালেন দশ বছর আগে এই ঘরে যে-যুবকটি কেরানীগিরির ফাঁকে ফাঁকে সাহিত্যসাধনা করত, আয়নার ছায়ায় তাকে দেখতে পাবেন এ-দুরাশা ছিল না, যদিও সেই পুরোনো পরিচিত পরিবেশ, স্যাঁতসেঁতে দেয়ালে চামচিকের গন্ধ, তবু নিজের-হাতে-কাচা পাঞ্জাবি-পরা সেই উজ্জ্বলচোখে ছেলেটি দেখা দিল না। সুরপতি যাকে দেখলেন, তার সিঁথির দুপাশে চুল বিরল, কানের উপরটা রুপোলী, গলায় ঝকঝকে মসৃণ-ভাঁজ টাই চোখ দু’টি ছাড়া বাকি সবটুকুই তার উজ্জ্বল। মামুলি ছবি, জীবনে সফল প্রৌঢ়ের।

হ্যারিসন রোডের মোড়ে বাসটা যদি অতক্ষণ না দাঁড়াত, তবে কী হত বলা যায় না। সুরপতির হয়ত খেয়ালই হত না, একদা অতি পরিচিত বইয়ের দোকানের সারি পিছনে ফেলে যাচ্ছেনা ফুটপাথে, রেলিঙের ধারে তখনকার মতই ভিড়, কাটা কাপড় আর পুরনো বইয়ের দোকানের সারি। বাস থেকে সেখানে নেমে একবার থমকে দাঁড়িয়েছেন সুরপতি, রকমারি বেসাতির ওপর চোখ বুলিয়েছেন, কিন্তু দাঁড়াননি, তাড়াতাড়ি রাস্তা পার হয়ে গেছেন ওধারে, যেখানে কাচের শো কেসের আড়ালে নয়নাভিরাম নতুন বইয়ের প্রদর্শনী। সেখানে এক মিনিট দাঁড়ালেন, কাঁচ ঘষে নিলেন চশমার, নামগুলো একবার পড়লেন। বেশির ভাগই নতুন নাম, তবু ওরই মধ্যে দু-একটি সুরপতির চেনা। ভিতরে গেলেন, সেখানেও কাউন্টারে আজস্র বই ছড়ানো, কেনাবেচার ভিড়। গলদধর্ম কয়েকটি লোক ক্যাশমেমো কাটছে, আরও বই বয়ে আনছে। আরো, আরো।

‘‘প্রলয়বীণা’’ কী রকম টানছে দেখছিস।’

‘আর সাতটা দিন যেতে দে, দেখবি এডিশন কাবার।’ কাউন্টারের ওপাশে ওরা বলাবলি করছিল, সুরপতি শুনতে পেলেন।

এপাশ থেকেও কয়েকজন ক্রেতা আরেকটা বইয়ের নাম বার বার চেঁচিয়ে বলছিল, ‘মন আগুনা’

‘‘মন-আগুন’, ‘মন-আগুন’ দু’কপি’, কাউন্টারের ওদিকে প্রতিধ্বনি উঠল। বইও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এলা। একটি লকলকে শিখা সমগ্র বইটিকে বেষ্টন করে আছে। এক কোণে পরিপাটি হরফে লেখক আর বইয়ের নাম এমন সুদৃশ্য প্রচ্ছদ সুরপতির চোখে বেশি পড়েনি। লোভ হল হাত বাড়িয়ে বইটি স্পর্শ করেনা করলেন পাতা উলটে গেলেন আসল বইটা যেখানে শুরু তার আগেকার কয়েকটা পৃষ্ঠাই একরকম সাদা। কোনটাতে বইয়ের নাম লেখা আছে, কোনটাতে লেখকেরা একটা জায়গায় প্রথম প্রকাশের তারিখের নীচে সুরপতি দেখতে পেলেন, বড় বড় হরফে লেখা দশম মুদ্রণ। দশম!

আর ঠিক তখনই সুরপতি ছেলেমানুষের মত একটা কাজ করে বসলেন। গলা খাঁকারি দিয়ে একবার ঝেড়ে নিলেন, তারপর স্পষ্ট, একটুও না-কাঁপা স্বরে, জিজ্ঞাসা করলেন, ‘জোয়ারের জল’ আছে?’জোয়ারের জল’ দিতে পারেন এক কপি?’

কাউনটারের ওপাশে ওরা এ ওর মুখের দিকে তাকাল। কেটে গেল কয়েক সেকেন্ড। আবার চাইবেন কিনা সুরপতি ভাবছেন, ওদেরই একজনকে ঢোঁক গিলে বলতে শুনলেন, ‘‘জোয়ারের জল’, কী বললেন, ‘জোয়ারের জল?’

কপট বিনয়ে সুরপতি বললেন, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। বইয়ের দোকানে কাজ করছেন অথচ এ-বইয়ের নামও শোনেননি?’

সে-লোকটি পিছিয়ে গেল কিংবা তাকে পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে এল আরেকজন। ‘‘জোয়ারের জল’? লেখকের নামটা বলতে পারেন?’

দোকানে আয়না নেই, সুতরাং মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল কিনা সুরপতি দেখতে পেলেন না। সামলে নিয়ে, ধীরে কিন্তু দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘লেখকের নাম সুরপতি চৌধুরী।’ অন্য খরিদ্দার দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ছেলেটি বলল, ‘না, ও নামে কোন বই ছাপা নেই।’ অজ্ঞতার লজ্জা নয়, সুরপতি তার মুখে অবহেলার হাসি দেখলেন ‘পাশের দোকানে খোঁজ করতে পারেন।’ উপদেশ দিয়েই ছেলেটিকে হুকুম দিলে, ‘প্রলয়বীণা’ দু’ কপি, মন-আগুন তিনা’

তারপর সারা বিকেল জুড়ে সুরপতি সেদিন শুধু দোকানে দোকানে ঘুরেছেন ‘জোয়ারের জল আছে, দিতে পারেন এক কপি? ‘ত্রিপূর্ণির ঘাট? রাতশেষের খেয়া?’ নেই? সুরপতি চৌধুরীর কোন বই নেই? সবাই বলেছে, না। এক দোকানে কে একজন বুঝি নামটা চিনতে পেরে বলেছে, ‘ওসব বই এখন আর ছাপা হয় না মশাই। চাহিদা নেই। আমরাও রাখি না নতুন কিছু চান ত বলুন, বের করে দিই।’

এক দোকানে শিক্ষিত, অন্তত দেখে সুরপতির তা-ই মনে হয়েছিল, ভদ্রলোক বসে ছিলেন। ‘রাতশেষের খেয়া’ বইটির নাম শুনে হেসে হাই তুললেন। ‘ছিল মশাই লাস্ট কপি, সেলফের নীচের তাকে অনেক দিন ধুলোবালি মেখে পড়ে ছিল মাস ছ’য়েক আগে একজন প্রবীণ অধ্যাপক খোঁজ করে কিনে নিয়ে গেছেন বাংলা সাহিত্যের বিস্মৃত অধ্যায়ের উপর কোন থসিস লিখে ডক্টরেট হাতাবার ফিকিরে আছেন কিনা খবর নিয়ে দেখুনগে যানা’

সেখান থেকে সুরপতি গেছেন পিছনের গলিতে এখানে অনেক প্রকাশক, অনেকেই তাঁর চেনা একটি দোকানের সাইনবোর্ড দেখেই চিনলেন তাঁর ‘জোয়ারের জল’-এর প্রকাশক ত এরাই। একটি টেবিল ঘিরে কয়েকজন বসে। সকলেরই মোটামুটি কম বয়স, অন্তত রাতের আলোতে তাই মনে হল। কণ্ঠস্বর যথাসাধ্য মার্জিত করে সুরপতি বললেন, ‘অপূর্ববাবু আছেন?’

যারা বসে ছিল তাদের সবাই একসঙ্গে ফিরে তাকাল। একজন বললেন, ‘অপূর্ববাবু ত রিটায়ার করেছেন, বিজনেস এখন দেখছেন ইনি, তাঁর ছেলে, নিশীথবাবু। এঁর সঙ্গে কথা বলুন।’

আঙুল দিয়ে যাকে দেখানো হল, সিগারেট আর চায়ের ধোঁয়ায় তার মুখের আধখানা ঢাকা, তবু অপূর্ববাবুর সঙ্গে তার চেহারার মিল সুরপতি সহজেই খুঁজে পেলেন। তাঁর নিজে থেকেই বোঝা উচিত ছিল। নমস্কার করে ধপ করে বসে পড়লেন একটা চেয়ারে, অনুরোধ না হতেই। ঘুরে ঘুরে ঘেমেছিলেন, ঘাড়ে গলায় একবার রুমাল বুলিয়ে নিলেন। নিশীথ চেয়ার ঘুরিয়ে নিয়ে বসল ওঁর মুখোমুখি একটা সিগারেট ধরাল নিজে, একটা বাড়িয়ে দিলে ওঁর দিকে, দেশলাই নেবাতে নেবাতে বলল, ‘মফঃস্বলের লাইব্রেরি বুঝি? কত টাকার বই নেবেন?

আর কথা বাড়ানো বা দেরি করা চলে না সুরপতি মরীয়ার মত গলায় বললেন, ‘আমি সুরপতি চৌধুরী।’

আশ্চর্য, এই প্রথমবার যেন মনে হল, নামটায় কাজ দিয়েছে। ওদের চোখে চোখে কি কথা হল সুরপতি বুঝলেন না, কিন্তু একজনকে বলতে শুনলেন, ‘আপনি আগে লিখতেন, না?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। এখান থেকেই আমার দু’খানা বই বেরিয়েছিল।’ বলতে বলতে সুরপতি সীলিঙের দিকে চাইলেন, যেন হিসেব করলেন, ‘বারো আর পনের বছর আগো’ নিশীথের দিকে ঝুঁকে পড়ে সাগ্রহ গলায় বললেন, ‘সে-সব বই এখন আর কেউ পড়ে না, ছাপাও নেই, না?’

‘ক-বে ফুরিয়েছে!’ হাল্কা, তাচ্ছল্যভরা গলায় নিশীথকে বলতে শুনলেন, ‘সেই বাবার আমলেই। সব বোধ হয় বিক্রি হয়নি। কেন, আপনার অ্যাকাউন্ট ত বাবাই–’

‘হিসেব নিতে আসিনি, বলছিলুম কি বইগুলো যদি আবার—’

‘ছাপতে বলছেন?’ অসহায়ের মত মুখভঙ্গি করে নিশীথ একটার পর একটা ধোঁয়ার বলয় রচনা করে গেল। ‘কিন্তু এখন যে অনেক অসুবিধে এই দেখুন না দশটা বই প্রেসে পড়ে আছে, চালু বই-ই বাজারে দিতে পারছি না, এখনকার ব্যবসায়ে কী যে ঝামেলা—’

‘পরে ছাপবেন?’ অকম্পিত, নির্লজ্জ, প্রায় প্রার্থনার সুরে সুরপতি জিজ্ঞাসা করলেন।

ঠোঁটে সিগারেট, নিশীথের গলা তাই বুঝি কেমন ধরা-ধরা শোনাল, ‘কবে ছাপব ঠিক কথা দিতে পারছিনে যে। দেখুন না, এঁদের কাছেই অপরাধী হয়ে আছি, এখনকার সেরা দু’জন লেখক এখানে বসে আছেন সর্বেশ মুখুজ্যে, ‘মন-আগুন’-এর লেখক। দশ হাজার বই দেড় বছরে কেটে গেছে, লোকে ওঁর নতুন বই চায়। সেটা আমরা নিয়েছি, কিন্তু দপ্তরী আজও বেঁধে এনে দিল না। কী করি বলুন। ইনি সুবীর মিত্র, সিনেমায় হীট বই ‘জীবনদোলা’ দেখেছেন, তার লেখক। এখন টালিগঞ্জ ছাড়ছে না, ওদিকে বোম্বাই থেকে ডাকছে। যমে-মানুষে টানাটানি লোকে বলে না, এ ঠিক তাই। ‘জীবনদোলা’র বাইশ শ’র এডিসন ফুরিয়ে গেছে, বাজারে নেই বলে ইনি মুখ ভার করে বসে আছেন।’

অনাসক্ত গলায় সুরপতি বলেছেন, ‘ও’ চশমার পুরু কাচের আড়ালে ওঁর চোখের পাতা ঘনঘন পড়েছে, ওরা দেখতে পায়নি। চেয়ারটা আরও কাছে নিয়ে এসেছে নিশীথ, অতি বিনীত গলায় বলেছে, ‘এই ত অবস্থা। তার চেয়ে আমি বলি কী সুরপতিবাবু, আপনার বই তুলে নিয়ে আপনি অন্য কোন ঘরে দিন। আমরা কবে ছাপতে পারব ঠিক নেই, কেন খামোখা নিজের লোকসান করবেন।’

‘লোকসান, লোকসান’, মৃদুস্বরে সুরপতি যেন নিজেকে একবার শোনালেন, তারপর মূর্খের মত হঠাৎ জোর গলায় হেসে বললেন, ‘আমার আর লাভ কতটুকু বেঁচেছে নিশীথবাবু, যে লোকসানকে ভয় পাব।’

কোনমতে শুকনো একটা নমস্কার সেরে সুরপতি পথে নেমে এসেছেন। দু’পাশে সেই বইয়ের দোকানের সারি। নতুন নাম, নতুন বই, সংখ্যা কত সুরপতি হিসেব করেও বলতে পারবেন না। পুরো তালিকা একমাত্র তাঁর কাছেই আছে, কালের কাঠের ফলকে সাদা খড়ি দিয়ে নিত্য যিনি নাম লেখেন আর মোছেন।

কিন্তু সেজন্যেই, শুধু সেজন্যেই, সুরপতি দিনই হাওড়া ইস্টিশনে গিয়ে টিকিট কিনে গাড়িতে চড়ে বসেননি আঘাত পেয়েছিলেন বইকি, কিন্তু কেবল ঘা খেয়েই পালাননি। পালিয়েছিলেন অপ্রত্যাশিত পুরস্কারের ভয়ে সুমিতার বাসায় পরদিন সকালে যদি দেখা করতে যেতেন, তবে হয়ত অত তাড়াতাড়ি কলকাতা ছেড়ে চলে আসবার কথা ভাবতেন না।

নইলে বই-পাড়ার অভিজ্ঞতার পর মনের সঙ্গে তিনি ত একটা রফা করে নিয়েই ছিলেন সেদিন মেসে ফেরবার পথে রিকশয় বসে সুরপতি স্বগত বলেছিলেন, ‘এরা বড় তাড়াতাড়ি ভোললা আমি আর কোথাও নেই। ‘মুছে গেছি।’ ‘মুছে গেছি’ কথাটাই দু’বার উচ্চারণ করেছিলেন, মন্ত্রের মতা আর আশ্চর্য, সঙ্গে সঙ্গে খেদের খাদটুকু উবে গিয়ে মনের নিকষে নতুন ভাবনার সোনার জলের দাগ পড়েছিল। ‘মুছে গেছি, ক্ষতি নেই’, সুরপতি আবার আহত অন্তরকে বলেছেন, ‘মুছে গেলেই কি সব মিথ্যে হয়। পাহাড় নিত্য, চিরায়ু। মেঘে মেঘে আকাশে যে ছবি লেখালেখি হয়, তা ক্ষণায়ু কিন্তু দু’টোই কি সুন্দর, অতএব সত্য নয়! ক্ষণকালেও যা সুন্দর, সত্য, তাও শিল্প, যেমন দিনায়ু কুসুম।’

আর এই প্রবোধ মনে স্নিগ্ধ অবলেপের কাজ করেছে। মেসে ফিরে চুপিচুপি সিঁড়ি বেয়ে উঠেছেন। দরজা ভেজিয়ে দিয়েছেন নিঃশব্দে। খাবার ঢাকা ছিল, ছোঁননি। আলো জ্বালেননি। বালিশে মুখ রেখে ঘ্রাণ নিতে নিতে কখন চোখ জড়িয়ে এসেছে। অনেক দিন আগে দেখা একটি গ্রামের ছেলেকে মনে পড়েছে। মেঝেতে মাদুর ছড়ানো, বুকের নীচে বালিশ, সম্মুখে লণ্ঠন, কাঁপাকাঁপা শিখা। ছেলেটি কী লিখছে। পাঠশালার অঙ্ক অবশ্যই নয়, তাহলে আরেকটি মেয়ে সেখানে এসে দাঁড়াতেই ছেলেটি খাতাটা লুকোতে চাইত না।

‘কী লিখছিলি রে?’

‘কিছু না, ছড়া।’

‘আমাকে পড়ে শোনাবি?’

‘পালা।‘

‘তবে মাসিমাকে বলে দিই?’

বলেনি, মেয়েটি একটু পরে নিজে থেকেই ফিরে এসেছে। ‘আমাকে নিয়ে ছড়া লিখবি?’

‘তোকে নিয়ে ছড়া হয় না। ভাগ।’

এবার কাঁদোকাঁদো হয়েছে মেয়েটির মুখ, পিছন থেকে ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরেছে।

‘লেখ না একটা ইস কী অহঙ্কার। আমার নামে ছড়া বাঁধা তোমার লেখায় আমি থাকব না?’

তোমার লেখায় আমি থাকব না? জীবনে বার বার নানাজনের মুখে এই আকৃতির প্রতিধ্বনি শুনতে হয়েছে। সেই গ্রামের ছেলেটি বড় হয়েছে, শহরে এসেছে। অঙ্কের খাতায় লুকনো ছড়া নামকরা পত্রিকায় কবিতা, কাহিনীর পরিণত রূপ নিয়েছে। কত ঘনিষ্ঠ পরিচয়, কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা কত ছেলে কতজন তাকে জীবনের কাহিনী শুনিয়েছে। লিখবে তুমি, লেখ না। এমনি ত মরে আছি, লেখার মধ্যে তবু যদি বেঁচে থাকি। সামান্য মরমানুষের অমৃতসাধা কৃতাঞ্জলি প্রার্থনা। সে-প্রার্থনা যথাসাধ্য পূরণ করেছে যুবক সুরপতি। একদিন গ্রামের সহচরীকে নিয়ে যে ছড়া বেঁধেছিল, পরবর্তীকালে সে পরিচিতমাত্রের ভিতরে কাহিনীর কুশীলব খুঁজেছে। যে সর্বত্যাগী বিপ্লবী সতীশদা একদিন তার হাতে তিনটি রিভলভার গচ্ছিত রেখে জেলে গিয়েছিলেন, তাঁকেই সুরপতি চাপাগলায়-উচ্চার্য পাড়ায় নীলিমার ঘরে শেষ নিশ্বাস ফেলতে দেখেছে। সেদিন কিন্তু মনে তাঁর কোন কামনা ছিল না এমন কি, দেশকে স্বাধীন করে যেতে পারলেন না বলে আফসোসও না। শুধু সুরপতির হাত ধরে বলেছিলেন, ‘আমাদের কথা তুই লিখে রাখিস ভাই। বিফলতা আর সাফল্য, সাহস আর দুর্বলতা দুই-ই দেখাস।’

সুরপতি সে-কথা রেখেছিলেন। সেই বৃহৎ ট্র্যাজেডির কথা লেখা আছে, তাঁর পুরনো আমলের বহু প্রশংসিত একটি দীর্ঘ গল্পে যা জানেন, যা শুনেছেন, যা দেখেছেন তা সবই ছিল এমন কি, শেষ অধ্যায়ের ফকিরচাঁদ লেনের নীলিমাকেও বাদ দেননি।

আজ পীতাম্বর সাহা লেনের বিছানায় শুয়ে শুয়ে সকলকেই মনে পড়ছে। যাদের ব্যর্থ-সার্থক জীবনের কথা সাহিত্যে রূপায়িত করেছেন সুরপতি। কাশী মিত্তিরের ঘাটের সেই সাধু, ওঁর হাতে গাঁজার কলকে তুলে দিয়ে যে বলেছে, ‘লেখ বাবা লেখা আমাকে যে শেষ করেছে সেই শয়তানীর নামে ঢি ঢি পড়িয়ে দে বাবা।’ সব ছেড়ে নেংটিমাত্র যে সম্বল করেছে, গল্পে ঠাঁই পাবার লোভ তারও কিন্তু কম ছিল না। রোজ আসত লুকিয়ে, গাঁজায় দম দিত আর বলত, ‘জ্বলে মলাম বাবা, পুড়ে মলাম’

‘কেন তুমি শান্তি পাওনি? ভগবানকে পাওনি?’

হাতের বুড়ো আঙুল নেড়ে সাধু বলেছে, ‘কিছু পাইনি বাবা, কিছু না। শয়তানীটাকে ভুলতে পারলে ত ভগবানকে পাব। তুই ওর সব কথা ফাঁস করে দে রে বাবা, ফাঁস করে দে।’

ময়লাটানা গাড়ির নীচে চাপা পড়ে সাধু যেদিন মারা যায়, তার আগের দিন কিন্তু সে সুরপতির কাছে এসেছিল। ঘামে ভেজা বিশ্রী দাড়ি-ঢাকা মুখ সুরপতির কানের কাছে নামিয়ে বলেছিল, ‘আমি শান্তি পেয়েছি। তুই আর ওর নামে কিছু লিখিসনি বাবা।’

‘লিখব না?’

‘না।’ সাধু ফিসফিস করে বলেছে, ‘তাকে আজ আমি চাঁদপাল ঘাটে গেরোনের যোগে ভিক্ষে করতে দেখেছি। পাপিষ্ঠার কুষ্ঠ হয়েছে বাবা’

আরও কত আছে। সকলের কথা আজ রাত পুঁইয়ে গেলেও ভাবা শেষ হবে না। সুধাদি। চারু। এই মেসের সদানন্দ, যে দেশ-বিদেশে ভ্রমণের কাহিনী সকলকে ডেকে শোনাত, শুধু একবার ঘোর অসুখের সময় সুরপতিকে চুপেচুপে বলেছিল, ‘আমাকে নিয়ে একটা গল্প লিখুন। বলুন লিখবেন? সারা জীবন খালি গাইডবুক আর রেলের টাইমটেবিল মুখস্থ করে লোককে ধাপ্পা দিলাম, আসলে কিন্তু ওতোরপাড়া ছাড়িয়ে যাইনি আমাদের মত সামান্য কেরানী যারা, তাদের অনেকেই যায় না, যেতে পায় না। এতদিন যত ভ্রমণকাহিনী আপনাদের শুনিয়েছি, সব ভুয়ো, লিখে দেবেন এ-কথা, তবে সঙ্গে সঙ্গে এটাও লিখবেন যে, আমার নানা দেশ দেখবার সাধটুকু কিন্তু খাঁটি ছিল’।

আরও যে কত লোক তাদের জীবনের গোপনতম কথাটি তাঁকে নিবেদন করেছে। দু’দিনের জীবন নিয়ে চিরদিনের কাহিনী রচনা করুক, সুরপতির কাছে তাদের প্রার্থনা মোটে এইটুকু।

গায়ে টিকটিকি পড়েনি, কড়িকাঠ থেকে উইয়ের বাসাও পড়েনি ঝুরঝুর করে, তবু সুরপতি শিউরে উঠলেন। হৃৎপিণ্ড বার বার কুঞ্চিত প্রসারিত হয়ে কণ্ঠতালু অবধি শুকিয়ে ফেলছে। বুকে চেপে ধরে বালিশটাকে কানে কানে বললেন, ‘ভুল, সব ভুলা কত অবুঝ ওরা, সাধারণ মানুষ। লেখকের কাছে অমরত্ব চায়, কিন্তু লেখকের নিজের আয়ু ক’দিনের, কেউ ভাবে না তা মনে রাখে না, লেখকও তুচ্ছ মানুষ, তারও মৃত্যু হতে পারে, হয়। যেমন আমি মরেছি।’

‘আমি মরেছি।’ সুরপতি উচ্চারণ করেছেন ধীরে ধীরে বালিশের যেখানটায় মুখ রেখেছিলেন সেখানটা সিক্ত হয়ে গেছে, নিঃশব্দে সেটাকে সরিয়ে দিয়েছেন। এই টপটপ নোনতা জলের চিহ্ন কেউ যেন না দেখে, কেউ যেন টের না পায়।

তবু যদি পরদিন সকালে জামাটা ছাড়তে গিয়ে খুচরো পয়সা ঘরময় ছড়িয়ে না পড়ত। কিংবা পয়সা পড়েছিল ক্ষতি নেই, চিরকুটটা যদি পকেটেই থেকে যেত। আর সেই চিরকুটে যদি সুমিতাদের বাসার ঠিকানা লেখা না থাকত। এতগুলো যদির বাধা যখন ঘুচলই, তখন সুরপতি যে ফের জামাটা ফিরিয়ে পরবেন, পথে রিকশ নেবেন একটা এবং শিবদাস রাহা সেকেন্ড লেন খুঁজে বের করে তার ষোল বাই দুই বাই এফ নম্বরের বাড়ির দরজায় টোকা দেবেন, একে প্রায় নিয়তি বলা চলে।

নিয়তি বই কি। নইলে সেদিনই হয়ত সুরপতিকে কলকাতা ছাড়তে হত না।

হাওড়া ইস্টিশনের এলাকা ছাড়বার পর প্রথম শ্রেণীর একটা গাড়ির কামরায় আধশোয়া সুরপতি মনে মনে সেদিন সকালবেলাকার ঘটনা আবার রচনা করে নিজেকে শুনিয়েছিলেন। …দু’য়েকটি রূপোলী চুল সামান্য যা একটু বিভ্রম ঘটিয়ে থাকবে, নইলে টোকা দিতেই যে দরজা খুলে দিয়েছিল, হলুদমাখা আঁচল আর কনুইয়ের কাটা দাগ থেকেই তাকে তোমার চেনার কথা। ‘সুমিতা?’ কতকটা ভয়ে কতটা ভরসায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন। সে জবাব দেয়নি, একটু পরে একটি ছোট মেয়ে এসে তোমাকে ডেকে নিয়ে গেছে। বসবার ঘর নয়, এদিক ওদিক তাকালেই বোঝা যায় এটাও শোবার, তাড়াতাড়ি করে এটাকে একটা বসবার ঘরের চেহারা দেবার চেষ্টা করা হয়েছে মাত্রা অর্থাৎ কোথা থেকে একটা টেবিল টেনে এনে রাখা হয়েছে ঘরের ঠিক মাঝখানে, একমেব চেয়ারও আছে, কিন্তু তুলো-ঝুরঝুর তোশকটাকে সরিয়ে ফেলা সম্ভব হয়নি। ছেড়া মাদুরটায় লজ্জা নিবারণ করে, সেটাও ঘরের এক কোণে কুণ্ঠিত হয়ে পড়ে আছে। ‘এই খুকি শোন’ মেয়েটিকে কাছে ডেকে তুমি আলাপ করতে চেয়েছ। একেবারে ছোট মেয়ে হলে পালিয়ে যেত, কিম্বা কিশোরী হলেও কিন্তু দশ-এগার বছরের এই মেয়েটির সঙ্কোচ স্বভাবত কিছু কম, সে একবার ডাকতেই কাছে এসেছে। যথারীতি তার নাম, পড়াশুনার খবর জেনে নেবার পর হঠাৎ জিজ্ঞাসা করছে, ‘বল ত আমি কে।’ মেয়েটি একবারও না ভেবে বলেছে, ‘মামা।’ অবাক হয়েছ বই কি, মেয়েটির সপ্রতিভতায়, না, সম্পর্কের আকস্মিকতায়, বলা যায় না। ‘মামা? কে বলেছে?’

‘বারে, মা বলে দিল যে তা ছাড়া তুমি ত, আপনি ত লেখেন?’

‘লিখি?’ (তুমি যে লেখ একথা আর একজনের মুখে কত দিন পরে যে শুনলে!) ‘লিখি?’ জিজ্ঞাসা করলে আবার, ‘কে বলেছে?’

‘আপনার বই আছে যে আমাদের আলমারিতে। মা মাঝে মাঝে খুলে দেখে, মুছে রাখো একটাতে মার নাম লেখা, আপনি লিখে দিয়েছেন, মা বলেছে। আর দু’টোতে কিন্তু কিছু লেখা নেই। এবার আপনি নাম লিখে দিয়ে যাবেন ত?’

‘যাব।’ অভিভূত গলায় শুধু একটি কথা বলতে পেরেছ। আর ঠিক তখনই সুমিতা এসেছে। হলুদমাখা শাড়িটা বদলাতে পারেনি, কনুইয়ের সেই কাটা দাগটা লুকোতেও না, তবু ওরই মধ্যে যা একটু ফিটফাটা হয়ত তোমার জন্যে চায়ের জল চড়িয়ে কলতলায় গিয়ে ভিজে গামছায় মুখটাই মুছে আসতে পেরেছে। বয়স হয়েছে বোঝা যায়, তবু শ্ৰীটুকু পুরোপুরি ঘোচেনি, বিশেষত হাসিটুকু সেই পনের বছর আগেকার।

‘অনেকদিন পরে এলো।’

‘হ্যাঁ, অনেকদিন’ আর কী বলা যায় ভেবে না পেয়ে ওর কথাটাই তুমি ফিরিয়ে দিলো আর। আঁচলে হাত ঘষে ঘষে ও আঙুলগুলো পর্যন্ত হলদে করে ফেলল।

খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর তুমি নিজেই আবার বলেছ, ‘কলকাতায় থাকি না ত, তাই সব সময় খবর নেওয়া হয়ে ওঠে না। তোমরা ভাল আছ?’ নাম ভুলে গিয়েছিল বলে সুমিতার স্বামীর কুশল আলাদা করে জিজ্ঞাসা করা হল না।

‘ভাল আছি। তুমি যে ভাল আছ দেখতেই পাচ্ছি। হবে না কেন, বিষণ্ণ একটু হাসি জুড়ে দিয়ে সুমিতা বলেছিল, ‘তোমার এখন অনেক টাকা, দেশজোড়া নাম।’

গরম লাগছিল, তুমি একবার হুকহীন সীলিঙের দিকে অসহায় চোখে তাকালে, তারপর রুমাল বার করলে পকেট থেকে। সুমিতা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটা হাতপাখা নিয়ে এল, বোধ হয় রান্নাঘর থেকে, কেননা তার ডাঁটে কয়লার গুঁড়ো লেগে ছিল বলে তুমি ধরতে পারলে না পারলেও অবশ্য সুমিতা পাখাটা তোমার হাতে দিত না, নিজেই হাওয়া করত।

‘তোমার আরও নিশ্চয় অনেক বই বেরিয়েছে, একখানাও ত দাও না। একটা তুমি সেই ষোল বছর আগে দিয়েছিলে, তোমার প্রথম বই, আর দু’টো আমি কিনেছি।’

‘কিনেছ!’ উৎফুল্ল হয়েও আহত হবার ভান করেছ।

‘কিনেছি। দেখবে? এস না এদিকে? এটা আমার বিয়ের পাওয়া আলমারি, কাচ ভেঙেছে, রঙ। চটে গেছে, তবু এইটুকুই যা চিহ্ন আছে। অনেক বই পেয়েছিলাম, ত সব গেছে, লোকে পড়তে নিয়ে ফেরত দেয়নি, শুধু এই শরৎ-গ্রন্থাবলীটা কী ভাগ্যে টিকে আছে। এই দেখ।’

ওর দৃষ্টির পিছু পিছু গিয়ে তোমার চোখ দেখেছে, ভাঙা আলমারির কাপড়, পুতুলের স্কুপের ধারে শরৎচন্দ্রের গ্রন্থাবলীর পাশে সযত্নে রাখা তোমার তিনখানি বই।

অপরাধী গলায় সুমিতা বলেছে, ‘আর কিনতে পারিনি। সংসার বড় হয়েছে, নানা অসুখ বিসুখা কী করব, ছেলেমেয়েদের তোমার এই তিনখানা বই-ই দেখাই, তোমার মত হতে বলি।’ একটু থেমে সুমিতা ফের জিজ্ঞাসা করেছে, ‘তোমার আর কী বই বেরিয়েছে বল তা সিনেমা হয়েছে?’

কাচের আলমারিতে সাজানো তোমার বই দেখার পরে কী নেশা চোখে লেগেছিল, অনায়াসে তাই বলতে পারলে, ‘হয়নি, এবার হবে। সেই কনট্রাক্ট করতেই ত কলকাতায় আসা।’

‘আমরা পাশ পাব ত?’ হঠাৎ কী করে মধ্যবয়সী মেয়েটি একেবারে কিশোরী হয়ে গেছে, আবদারের সুরে বলেছে, ‘আমরা সবাই যেন পাশ পাই। আর, তোমার নতুন বইগুলো দেবে না?’

‘দেব।’ সম্মোহিতের মত বলেছ, ‘দেব। নতুন এডিশন সবে ছাপা হয়ে এসেছে। কাল দিয়ে যাব।’

সুমিতার মুখেচোখে ছেলেমানুষী খুশি ‘কাল আবার আসবে তুমি? তা হলে কী ভাল যে হয়। কাল রবিবার, ওঁর সঙ্গেও দেখা হবে। তুমি এখন অনেক বড়, বলতে ভরসা পাইনে, এসে ওই সঙ্গে যদি দু’টি ঝোলভাত—’

অনেকক্ষণ ধরেই একটু একটু করে ঘামছিলে, এর পরে আর বসে থাকতে পারনি, হঠাৎ এক রকম বিনা নোটিশে, উঠে দাঁড়িয়ে বলেছ, ‘সে হবে এখন, সে হবে। এখন চলি।’

সুমিতাদরজা অবধি এগিয়ে দিতে এসেছে।

‘আরও একটা কথা আছে।’

সবে চৌকাঠের ওদিকে পা দিয়েছিলে, হঠাৎ থেমে গেছ। ঘোমটা কখন খসে গেছে, আরও একটু কাছে এসেছে সুমিতা। ‘আরও একটা কথা আছে। তুমি বোধহয় শুনে হাসবে, ভাববে ছেলেমানুষী। আমার মনে একটা ক্ষোভ রয়ে গেছে কিন্তু এতজনকে নিয়ে এত কথা লিখলে, আমাদের কথা কোনটাতে আজও লেখনি।’

ভাঙা সুইচে যেন হাত ঠেকেছে এমন চমকে উঠেছ! সে-চমক কাটিয়ে উঠতে অবশ্য সময় নাওনি। কণ্ঠস্বরে একটু বা পরিহাসের ছোঁয়া লাগিয়ে বলেছ, ‘সব ক্ষোভ কি শেষে তোমার ছোট্ট এই একটুখানি দুঃখে রূপ নিয়েছে সুমিতা! কিন্তু কী লিখব বল ত?’

কিছু লেপটে-যাওয়া সিঁদুরে, কিছু লজ্জায় সুমিতার মুখখানা লালচে। আড়ষ্ট স্বরে বলেছে, ‘কেন, আমাদের কথা। তোমার সাহিত্যে এই হলুদমাখা আঁচল আর কনুইয়ের কাটা দাগটার কথা লেখা রইল বা’

এবার আর পরিহাস নয়, কঠিন গলায় বলেছ, ‘ভয় করবে না?’

‘কিসের ভয়?’

‘কেন, কলঙ্কের?’

অনেকক্ষণ পরে সুমিতার মুখে চকিত বিদ্যুতের মত এক ঝিলিক হাসি দেখা গেছে। ‘সে-ভয় থাকলে তোমার বইতে আমার নাম-লেখা বই কি আলমারিতে সবাইকে দেখিয়ে রাখি!’

অপলক সেই চোখের দিকে বেশীক্ষণ চেয়ে থাকতে পারনি। মাথা নিচু করে চলে আসতে যাবে, জামার হাতায় আলগোছ টান লেগে আবার ফিরে তাকিয়েছ। দেখেছ সেই দৃষ্টি আর নেই সুমিতার চোখে, খর রৌদ্র ছায়া-কোমল হয়েছে। গাঢ়, অশ্রুতপ্রায় গলায় সুমিতাকে বলতে শুনেছ, ‘আর শোন, যদি কিছু লেখ তবে তাতে আমার ডাকনামটাই দিও, ঝিনুকা বাপের বাড়িতে যে নাম ছিল। ও-নামে এখানে কেউ ডাকে না।’কামরার বাইরে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বিপরীত দিকে দ্রুত-সরন্ত গাছপালা, তারের খুঁটির দিকে চোখ রেখে সুরপতি আবার আপনাকে বললেন, ‘এর পরে এক বেলাও কলকাতায় থাকা তোমার পক্ষে সম্ভব ছিল না বইয়ের বাজারে যা-লেবে-তা-দুটাকার নিলামে তোমার দেউলে হবার খবর কী এক আশ্চর্য কারণে শিবদাস রাহা সেকেন্ড লেনের একটি অধিবাসিনীর কাছে অজানা থেকে গেছে। সেখানে আলমারিতে শরৎচন্দ্রের বইয়ের পাশেই তুমি। কিন্তু আর দু’দিন থাকলে কি কিছু জানাজানি হত না! পরদিন সকালে সুমিতার বাসায় খালিহাতেই ত যেতে হত। গিয়ে কী কৈফিয়ত দিতে?

 প্রাণ গেলেও কি তাকে বলতে পারতে লেখক সুরপতি মরে গেছে, তার বই আর কোনদিন ছাপা হবে না? হয়ত মুগ্ধ একটি মেয়ের নির্জলা স্তুতি শুনতে শুনতে তোমার নিজের বিবেকই মাথা তুলে দাঁড়াত, দুর্বল কোন মুহূর্তে স্বীকার করে বসতে, নতুন বই নয়, ছায়াছবির চুক্তি নয়, শুধু রেলের ঠিকেদারির তদ্বির করতেই দূর প্রবাস থেকে এতদূরে এসেছ। সত্যের রোমশ হাত থেকে একটি মিথ্যাকে বাঁচাতে তাড়াতাড়ি পালিয়ে এসেছ সুরপতি, ভালই করেছ।’

No comments