মইয়ের বদলে বই – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

মইয়ের বদলে বই – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

বাঘ যেমন মানুষ দেখলে খেপে যায়, যাঁরা বইয়ের নেশায় পড়েছেন, তাঁরা সেই রকম বই দেখলে নিজেকে আর সংযত রাখতে পারেন না, হামলে পড়েন। ছেলের লেখাপড়া, মেয়ের বিয়ে, বউয়ের অপারেশন সব মাথায় উঠে যায়। বইয়ের এমন আকর্ষণ! মনে পড়ে প্রথম যখন অক্ষর। পরিচয় হল, সে কী আনন্দ! অ-এ অজগর আসছে তেড়ে। বানান করে করে যখন পড়তে শিখলুম, তখন মনে হল চারপাশ বন্ধ ঘরের জানলা খুলে গেল! এখন ভাবি পড়তে না শিখলে কী হত! মন জলাশয়ে পচে, দুর্গন্ধ হয়ে, জীবনেই মৃত করে দিত। এখনও মনে আছে ঈশপস ফেবলসের কথা। আমাদের ক্লাস সেভেনের পাঠ্য ছিল। জানুয়ারির এক শীতের রাতে, অন্যান্য পাঠ্য পুস্তকের সঙ্গে আমার বাবা ওই বইটি কিনে আনলেন।


প্রকাশক-ম্যাকলিন। চকচকে পাতা, গোটা গোটা কালো অক্ষর, পাতায় পাতায় রঙিন ছবি। ঝুঁকে পড়ে, শুয়ে, বসে নানাভাবে দেখেও আশ আর মেটে না। হি হি করছে শীত। ঘরের ঠান্ডা লাল মেঝে যেন কামড়াতে আসছে। কোনও দৃকপাত নেই। আমি দেখছি সেই বুদ্ধিমান কাককে। ঠোঁটে করে পাথর তুলে তুলে কলসির মধ্যে ফেলছে। দেখছি সেই ধূর্ত শৃগালকে! দ্রাক্ষাফল অতিশয় টক বলে সে সরে পড়ছে। প্রথম দিনের প্রথম দেখা সেই ফেবলসের স্মৃতি আজও লেগে আছে মনে। এখন তো স্কুল থেকে। ইংরেজি বিদায় নিয়েছে। থাকলেও বইপত্র বদলে গেছে। ফেবলস আর পড়ানো হয় না। একালের পাঠ্যপুস্তক মানেই রদ্দি কাগজ, নিকৃষ্ট বাঁধাই, ভাঙা টাইপ, লাইনে লাইনে ছাপার ভুল।

আর একটু উঁচু ক্লাসে আর একটি বইও মনে গেঁথে আছে, ডিকেনসের ‘ডেভিড কপারফিল্ড’। অক্সফোর্ডের বই। কোনও চাকচিক্য নেই, কিন্তু সুন্দর ইংরেজি, অপূর্ব কাহিনি। ভালো-মন্দ অসংখ্য চরিত্র। একটি কিশোরের জীবনকাহিনি। ‘উই আর রাফ বাট রেডি’ উক্তিটি আজও ভুলিনি। আমার সহপাঠী কেষ্ট অসাধারণ ছবি আঁকতে পারত। আমাদের স্কুলটা ছিল একেবারে গঙ্গার ধারে। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। গঙ্গার ধারে একটা সুন্দর জেটি ছিল। সেই জেটির গায়ে বাঁধা থাকত ফেলে রেখে যাওয়া কিছু ফ্রিগেট আর ডেস্ট্রয়ার। বিকেলে জেটিতে। আমাদের জমায়েত হত। কেষ্ট লাফ মেরে চলে যেত ফ্রিগেটে। হাতে তার রংবেরং-এর চকখড়ি। সেই খড়ি দিয়ে কেবিনের গায়ে কেষ্ট আঁকত কপারফিল্ডের চরিত্র, মিস্টার ক্রিকল, লুসি পেগট।

ছেলেবেলার কল্পনার সঙ্গে যেসব বই জড়িয়ে আছে, তা মন থেকে আজও ঝেড়ে ফেলা সম্ভব হয়নি। যৌবনে মন যখন উড়ু উড়ু, সদা সর্বদাই যখন দখিনা বাতাস বইছে, তখন ধরা পড়লে ‘পথের পাঁচালী’, নয় ‘আরণ্যক’। সেই লবটুলিয়া, বৃক্ষ, বনজ্যোৎস্না। বিভূতিভূষণের প্রেমে পড়ে। গেলুম। তাঁর লেখা সব বই পড়তে হবে। পাই কোথায়! তখনও ছাত্র। টাকাপয়সার বড়ই অভাব। আমাদের এক দাদাস্থানীয় ব্যক্তির বাড়িতে বেশকিছু বই ছিল। ছোটদের, বড়দের। সেই বইয়ের র‍্যাক থেকে একখণ্ড ‘পথের পাঁচালী’ আবিষ্কার করলুম। মলাট নেই। ছিঁড়ে-খুঁড়ে গেছে। তা। হোক। সেই বয়সে, সে যেন আমার আমেরিকা আবিষ্কার। বইটা বাড়িতে এনে সাবধানে পড়ে ফেললুম। সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। এক-একটি পরিচ্ছেদের এক-একটি নাম—আম আঁটির ভেঁপু, বল্লালি বালাই। অপুকে যে অনুচ্ছেদটি পণ্ডিতমশাই তিলিখন লিখতে দিচ্ছেন—’এই সেই গিরিস্থান মধ্যবর্তী জনপদ’, সেই অনুচ্ছেদটি আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। দুপুরে চোখ বুজলেই যেন দেখতে পেতুম, নিশ্চিন্দিপুরের মাঠে অপু আর দুর্গা ছুটছে। ইন্দির ঠাকরুন ছেঁড়া মাদুর বগলে গ্রামের হাটতলা দিয়ে চলেছেন। উনুনের ছাইগাদায় বেড়াল বাচ্চা দিয়েছে রাতে। ভোরে অপুর সঙ্গে আমিও যেন শুনতে পাচ্ছি নবজাতকের মিউ মিউ ডাক। বইটাকে মেরে দেবার তালে ছিলুম। ওদিক থেকেও বইটির জন্যে তেমন কোনও তাগিদ ছিল না। ভাবলুম ছেঁড়া-খোঁড়া বই তো, দাদা আমার বেমালুম ভুলে গেছেন। বইটা আমার হয়েই গেছে ভেবে, পয়সা খরচা করে বাঁধিয়ে আনলুম। বাঁধিয়ে আনার পর বইটা পড়তে আরও যেন ভালো লাগল। পাঁচ বছর পর। দাদা একদিন আমার বাড়িতে এলেন বেড়াতে। আমাদের বাড়িতে তাঁর প্রথম পদার্পণের আনন্দে আত্মহারা হয়ে চা-জলখাবারের ব্যবস্থার জন্যে ছোটাছুটি করছি, সেই ফাঁকে দাদা আমার বইয়ের রাক থেকে সযত্নে বাঁধানো ‘পথের পাঁচালী’টি টেনে বের করেছেন। আমি জলখাবারের প্লেট হাতে ঘরে ঢুকতেই বললেন, ‘আরে এই তো আমার সেই বইটা! বাঃ বাঁধিয়ে-টাধিয়ে কী সুন্দর। করেছ! থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ।’

আমার মনে হচ্ছিল খাবারের প্লেটটা নিয়ে চলে যাই। সে অভদ্রতা আর করা গেল না। চামড়ার বাঁধাই ‘পথের পাঁচালী’, স্পাইনে সোনার জলে নাম লেখা। দাদা আমার গরম সিঙাড়া খেতে খেতে বললেন, ‘বই শুধু পড়লেই হয় না, যত্নও করতে হয়। তোমার যত্ন দেখে খুবই ভালো। লাগল। আমার ভেঁড়া-খোঁড়া বইটাকে তুমি কী সুন্দর করেছ। কেবল একটা ভুল তুমি করে। ফেলেছ, নিজের নামটা লিখে ফেলেছ। খেয়াল ছিল না বুঝি? যাক, ও পেট্রল দিয়ে ঘষে দিলেই উঠে যাবে।’ খেয়েদেয়ে, মুখ মুছে, তিনি উঠে গেলেন বইয়ের র‍্যাকের কাছে। এ বই টানেন, ও বই টানেন। র‍্যাকের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, আমি মুখ গোঁজ করে বসে আছি আমার জায়গায়। বসে বসে ভাবছি, মলাটটা ছিঁড়ে নিতে পারলে মনে তবু একটু শান্তি পেতুম। ঘরের ও মাথা থেকে দাদা বললেন, ‘বুঝলে, চেনাজানা আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বাড়ি ঘুরে দেখতে হয়। দেখতে দেখতে দু-একটা চোরাই বই এইভাবে বেরিয়ে আসে। জানো তো সব বাড়িতেই ফিফটি পারসেন্ট বই চুরির। তুমি কি আর কোথাও বই রাখো?’

‘কেন বলুন তো?’

‘আমার আর একটা বই, যোগেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সোনার পাহাড়’, সেই বইটা কে মেরে দিয়েছে!

‘পথের পাঁচালী’ পুনরুদ্ধার করে আমার সেই দাদা চলে গেলেন। ভাগ্যিস, ‘সোনার পাহাড়’ বইটা চিলেকোঠায় রেখে এসেছিলুম।

একবার এক ভদ্রলোকের বসার ঘরের আলমারিতে অনেক ভালো ভালো বই সাজানো দেখে গৃহস্বামীকে অনুরোধ করলাম, ‘আলমারিটা একবার খুলবেন?’ ভদ্রলোক বললেন, ‘আজ তো খোলা যাবে না। চাবি আমার স্ত্রীর কাছে। তিনি দুর্গাপুরে চাকরি করেন। সপ্তাহে একবার আসেন, তখন খুলে ঝাড়-পোঁছ করা হয়।’ জিগ্যেস করলুম, ‘পড়েন কখন?’ বললেন, ‘ওগুলো ঠিক পড়ার বই নয়।’

এমনও দেখেছি, মাপ মিলিয়ে বই কেনা হচ্ছে। স্বামী স্ত্রীকে বলছেন, ‘আমার মনে হয়, খুকুর এই বইটা ফিট করবে।’ আমি পাশে ছিলুম। ভীষণ কৌতূহল হল। ফিট করবে মানে? বই কি জুতো? থাকতে না পেরে জিগ্যেস করলুম, ‘কোথায় ফিট করবেন?’ তখন জানা গেল, অর্ডার দিয়ে বুককেস তৈরি করিয়েছেন। ‘ফাস্ট তাকে, বুঝলেন, এই ইঞ্চি তিনেক ফাঁক আছে। মানে ভালো ভালো যাস্টকে ছিল ঢুকিয়েছি, জাস্ট তিন ইঞ্চি মাপের একটা পেলেই টাইট!’

আমি বললুম, ‘ইঞ্চি তিন মোটা মিনিমাম ষাট টাকা পড়ে যাবে। এখন বইয়ের দাম ইঞ্চি প্রতি কুড়ি টাকা যাচ্ছে। আপনি তার চেয়ে একটা গেঞ্জির বাক্স কিনে ঢুকিয়ে দিন। কম খরচে হয়ে যাবে।’

ব্যাপার তো ওইরকমই দাঁড়িয়েছে। বিয়ের উপহারের বই কিনতে ঢুকেছেন তিন বান্ধবী। কথা হচ্ছে, ‘কুড়ি টাকার মধ্যে একটা বই দিন তো!’ কুড়ির মধ্যে, পনেরোর মধ্যে, দশের মধ্যে। আজকাল আবার উপহার দেওয়া হয় ব্লকে। চল্লিশজনের ব্লক। পার হেড দশ। মোট চারশো। দে একটা টেবিল ফ্যান অথবা মিক্সার। বইয়ের কপাল পুড়েছে!

বিদেশে কেউ আর বই পড়বে না অদূর ভবিষ্যতে। টিভি দেখবে। আর ক্যাসেটে ক্লাসিক

সাহিত্যের পাঠ শুনবে। আমাদের দেশেও সেই দিন আসছে। বইয়ের ‘বুম’ চলছে, পাল্লা দিয়ে মানুষের অবসর সময় কমছে। এখন বই দিয়ে টেবিল ল্যাম্প উঁচু করা হয়। এর পর খাটের পায়ার তলায় বই দেওয়া হবে। যাক, পিতৃপুরুষের বই তবু একটা কাজে লাগল।

No comments