শুঁড়ওয়ালা বাবা – শিবরাম চক্রবর্তী

শুঁড়ওয়ালা বাবা – শিবরাম চক্রবর্তী

বই-টই গুছিয়ে নিয়ে বেরুবার উদ্যোগ করছে, এমন সময়ে দাদামশাই ডেকে বললেন–আজ আর স্কুল যেতে হবে না। তোর গুঁড়-ওলা বাবা আসচেন, দুপুরে এসে পৌঁছনর তার পেয়েছি। আজ আবার মেল ডে, আমার তো আপিস কামাই করা চলবে না। বাড়ি থাকবি তুই!

ইস্কুলে যেতে হবে না জেনে মন্টুর ফুর্তি হল, কিন্তু সে বেশ ভাবনায় পড়ে গেল। শুঁড়-ওলা বাবা আবার কি রকম বাবা?

সে ত প্রায় বছর দশেক হতে চলল তার বাবা স্বর্গে গেছেন সে শুনেছে, তার কিছুদিন পরে মা ও তাঁর অনুসরণ করলেন। তখন থেকে মন্টু থেকে মামার-বাড়িতেই মানুষ। এতদিন সে কোনো প্রকার বাবার সম্বন্ধেই কিছুমাত্র উচ্চবাচ্য শোনেনি, তবে অকস্মাৎ এই শুঁড়-ওলা বাবার প্রাদুর্ভাব হলো কোত্থেকে আবার?

বই-টই রেখে দিয়ে মন্টু বৈঠকখানায় গিয়ে বসল এবং মনে মনে বাবার বিষয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করতে লাগল।

বাবা তাহলে দুরকম? এক শুঁড় আছে আরেক–শুঁড় নেই। তবে সাধারণত বাবাদের গুঁড় থাকে না। যথা নীতু, নীলিম ও ঝনকুর বাবার নেইকো। যে কটি বন্ধুর বাবার সঙ্গে তার চাক্ষুষ ঘটেছে তাঁদের গুঁড় নেই।

মন্টুর মতে বাবাদের গুঁড় না থাকাই বাঞ্ছনীয়। বাবারা ছেলেদের গাধা হওয়া পছন্দ করেন না, বাবাদের হাতি হওয়াটাও তেমনি ছেলেদের রুচিতে বাঁধে! তবে মন্টুর দুর্ভাগ্য, বেচারার বাবাই নেই। আর সব বন্ধুর কেমন বাবা আছে, তারা বাবার কাছ থেকে কত কি প্রাইজ পায়, তমু তো সেদিন একটা সাইকেল পেয়ে গেছে, কিন্তু বেচারা মন্টু–।

যাক সৌভাগ্য বলতে হবে, এতদিন বাদে তবু মন্টুর একজন বাবা আসছেন। তবে দুঃখের মধ্যে ঐ যা– গুঁড়! তার জন্যে আর কি করা যায়, নেই মামার চেয়ে কানা মামা যেমন ভালো, তেমনি একেবারে বাবা না থাকার চেয়ে শুঁড়ওলা বাবাই মন্দ কি! তারপর কাল আবার মন্টুর জন্মদিন–হয়ত তিনি কেবল উঁড় নাড়তে নাড়তেই আসছেন না, কত কি উপহারও ঝাড়তে আসচেন।

বেলা প্রায় সাড়ে বারোটা, এমন সময়ে এক ভদ্রলোক মন্টুদের বাড়ির সামনে রিক্সা থেকে নামলেন এবং সোজা ভেতরে এসে জিজ্ঞাস করলেন–এইটে ঘনশ্যামবাবুর বাড়ী না?

–হ্যাঁ।

–তাকে বলগে সত্যপ্রিয়বাবু এসেছেন। আমি সকালে তার করেছি, পেয়ে থাকবেন বোধহয়।

তবে ইনিই! মন্টুও পায় এই আন্দাজ করেছিল। খুব মোটা বটে, তবে হাতির কাছাকাছি একেবারে নন। তাছাড়া, শুঁড় নেই। শুঁড় না থাকার জন্য মন্টু যে ক্ষুব্ধ হলো তা নয়, বরং তাকে যেন একটু খুশিই দেখা গেল।

–দাদামশাই আপিস গেছেন। আপনি বসুন।

–তুমিই বুঝি উৎপল? আমি তোমা গুরুজন। প্রণাম করো। মন্টু ঈষৎ হতভম্ভ হয়ে জিজ্ঞাসা করল–কাকে?

–কেন, আমাকে? আশ্চর্য হবার কি আছে? গুরুজনদের ভক্তি করতে শিখবে, তাদের কথা শুনবে। এসব শেখনি?

–ও কি? ও কি প্রাণাম হলো? দেখছি এখানে শিক্ষাদীক্ষা সুবিধা হয়নি। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে হয়। যাক, ক্রমশঃ সব শিখবে। এখান থেকে গেলেই–

–আপনি কি আমাকে নিয়ে যাবেন এখান থেকে? কোথায়?

–কেন? দেশে। তোমার বাবার বাড়িতে। আমাদের বাড়িতে তোমাকে নিয়ে যেতেই ত আমি এসেছি।

–আপনি আমার বাবা যদি তবে আপনার শুঁড় কই?

–শুঁড়?

-–হ্যাঁ। দাদামশাই যে বললেন যে মন্টু তুই তুই বাড়ি থাকিস, তোর শুঁড়গুল বাবা আজ আসবেন। কিন্তু আপনার শুঁড় নেইত! শুঁড় কোথায়?

–হু।

হু বলে ভদ্রলোক ভারী গম্ভীর হয়ে গেলেন, মন্টুর সঙ্গে তারপর আর কোনো কথাই তার হলো না! ঘাট হয়ে গেছে ভেবে মন্টু ম্লান মুখে চুপ করে রইল। সে বইয়ে পড়েছিল বটে যে কানাকে কানা বলিও না, খোঁড়াকে খোঁড়া বলিও না ইত্যাদি–পড়েছিল এবং মুখস্থ করেছিল, কিন্তু বইয়ের হুকুম কাজে না মানলে যে অঘটন ঘটবে তা সে ভাবেনি। যার পা নেই তাকে খোঁড়া বললে সে যেমন মনঃক্ষুণ্ণ হয়, এঁকে শুঁড় নেই বলাতে বোধহয় ইনি তেমনি বিচলিত হয়েছেন! অঙ্গহীনতার অনুযোগ না করাই মন্টুর উচিত ছিল।

ঘনশ্যামবাবু অফিস থেকে ফিরলে অন্যান্য কথাবার্তার পর সত্যপ্রিয়বাবু বললেন–দেখুন, উৎপলকে আমি নিয়ে যেতে চাই। দাদা বৌদি নেই, কিন্তু আমি ত আছি। আমিই এখন ওর অভিভাবক।

-–কেন, এখানে তো ও বেশ আছে। সেই অজ পাড়াগাঁয়ে–

–তাহলে খুলেই বলি। এখানে ওর যথার্থ শিক্ষা হচ্ছে না।

–যথার্থ শিক্ষা বলতে কি বোঝায়?

–অনেক কিছু। তা নিয়ে আপনার সঙ্গে তর্ক করা আমার পক্ষে বাতুলতা। তবে এখানে থেকে যথার্থ অশিক্ষা যে ওর হচ্ছে তাতে ভুল নেই।

–যথার্থ অশিক্ষা হচ্ছে? কি রকম শুনি।

–আপনি বলেচেন আমি নাকি ওর গুঁড়-ওলা বাবা। উৎপল তাই বলছিল। এতদ্বারা ওকে মিথ্যাবাদিতা শেখানো হচ্ছে। আমি তো ওর বাবা নই, তাছাড়া আমার গুঁড়ও নেই।

–এই কথা! তুমি ওর কাকা তো বটে! ব-এ শুঁড় দিলেই ক হয় এও বোঝে না বাপু!

কিন্তু কিছুতেই সত্যপ্রিয়কে বোঝানো গেল না; পরদিন সকালেই মন্টুকে নিয়ে তিনি রওনা হলেন। পথে যেতে যেতেই মন্টুর যথার্থ শিক্ষা শুরু হয়ে গেল।

-–দেখ উৎপল! আজ আমি তোমাকে মাত্র তিনটি উপদেশ দেব। যদি মানুষ হতে চাও তাহলে আমার এই তিনটি উপদেশ তোমার মূলমন্ত্র হবে আর জীবনে সর্বদা মেনে চলবে! প্রথম হচ্ছে, সত্যনিষ্ঠ হবে, সত্যের জন্য ত্যাগ, যে কষ্ট, যে লঞ্ছনাই স্বীকার করতে হোক না কেন, কখনো পিছুবে না। দ্বিতীয় উপদেশ, সব সময়ে নিয়মানুবর্তী হবে। নিয়ম না মানলে শৃঙ্খলা থাকে না, তাতে করে সামাজিক ব্যবস্থায় গোলযোগ ঘটে। আমার তৃতীয় উপদেশ হচ্ছে এই–

উপদেশগুলো মন্টুর কানে যাচ্ছিল কিনা বলা যায় না, কানে গেলেও তার মানে নিশ্চয় তার মাথায় ঢোকেনি। একটু আগে একটি ছেলে তার পাশ দিয়ে যাবার সময় আকারণে, বোধহয় অকারণ পুলকেই, মাথায় চাটি মেরে গেছল, কাকার নিয়ম-নিষ্ঠা প্রচারের মাঝখানে তার প্রতিশোধ নেবার সুযোগ সে খুঁজছিল। তৃতীয় উপদেশের সূত্রপাতেই, পথে চলতি ছেলেটি আবার যেমনি তার পাশে এসেছে, অমনি সে তাকে ল্যাং মেরে ধরাশায়ী করে ফেলল।

মন্টু নিজের ক্ষুদ্রবুদ্ধি অনুসারে সম্ভবত নিয়মরক্ষাই করেছিল, কিন্তু সত্যপ্রিয় উলটো বুঝলেন–দ্যাখো, এইমাত্র তুমি পথে চলার নিয়মভঙ্গ করলে!

–ও যে আমাকে চাটি মারল আগে!

–আমি তো দেখেছি, কিন্তু ওকে ক্ষমা করাই তোমার উচিত ছিল নাকি? আমার তৃতীয় উপদেশ হচ্ছে, কখনো কাউকে আঘাত করবে না। কেউ যদি তোমার বাঁ গালে চড় মারে তাকে ডান গাল ফিরিয়ে দেবে?

স্টেশনে গিয়ে সত্যপ্রিয় দারুণ ভাবনায় পড়লেন। মন্টুকে জিজ্ঞাসা করলেন –তোমার কি টিকিট কিনব? হাফ না ফুল? একটু মুশকিল আছে দেখছি।

-–আমি তো হাফ-টিকিটে যাই।

–বারো বছর পুরে গেলে পুরো ভাড়া দিতে হয়। আজ তোমার ঠিক বারো বছর পূর্ণ হবে। তবে হিসেব করে দেখলে ঠিক বারো বছরে পড়তে এখনো তোমার চার ঘন্টা পঁয়ত্রিশ মিনিট তের সেকেন্ড বাকি। তারপর থেকেই তোমার ফুল টিকিটের বয়স হবে।

–তা কেন? আমাদের পাড়ার হবালা দেখতে বেঁটে? কিন্তু তার বয়স সতের বছর। সে এখনো হাফ-টিকিটে যায়, তাকে কই ধরে না তো।

–এতক্ষণ কি বোঝালাম তোমাকে? সর্বদা সত্যনিষ্ঠ হবে–বাক্যে, চিন্তায় এবং আচরণে। কাজেই এখনো যখন তোমার বারো বছর পূর্ণ হয়নি, এখন ফুল টিকিট কেনা যেতে পারে না। কিন্তু গাড়িতে যেতে যেতে পূর্ণ হবে, সেইটাই ভাবনার কথা! আচ্ছা তখনকার কথা তখন দেখা যাবে।

গাড়িতে উঠে সত্যপ্রিয় একদৃষ্টে হাতঘড়ির দিকে চেয়ে রইলেন। মন্টু জানালার ফাঁকে বাইরের পৃথিবীর পরিচয় দিতে লাগল।

কিন্তু যেই না চার ঘণ্টা পঁয়ত্রিশ মিনিট তের সেকেন্ড গত হওয়া, অমনি সত্যপ্রিয়বাবু তাঁর বিপুল দেহ নিয়ে গাড়ির গ্যালার্ম সিগন্যালের শেকল ধরে ঝুলে পড়লেন। ফল হলো ঠিক মন্ত্রের মত ঝড়ের বেগে যে-গাড়ি ছুটছিল, গাছপালাদের ছোটাচ্ছিল, দুধারের দিগন্ত প্রসারিত মাঠের মধ্যখানে অকস্মাৎ তা থেকে গেল। ট্রেনের গার্ড এসে জিজ্ঞাসা করলেন–কে শেকল টেনেছে?

সত্যপ্রিয় বুঝিয়ে বললেন, দেখুন এই ছেলেটির বারো বছর এইমাত্র পূর্ণ হলো। এর পর তো একে আর হাফ টিকিটে নিয়ে যেতে পারি না; কোনে স্টেশনে থামলেই ভাল হোতো, কিন্তু মাঠের মাঝখানে যে বয়স পূর্ণ হবে তা কি করে জানব বলনু! অসত্যকে প্রশ্রয় দিতে আমি অক্ষম, তা ছাড়া রেল কোম্পনীকে আমি ঠকাতে চাইনে। ওর হাফ-টিকিট আছে। এখান থেকে পুরুলিয়া পর্যন্ত আরেকটা হাফ-টিকিট আপনি আপনি দিন কিম্বা হাফ- টিকিটের ভাড়া নিয়ে রসিদ দিন।

— এই জন্য গাড়ি থামিয়েছেন? আচ্ছা পরের স্টেশনে দেখা যাবে।

–তা দেখতে পারেন, কিন্তু ভাড়া এখান থেকে ধরতে হবে পরের স্টেশন থেকে নিলে চলবে পরের স্টেশনে গাড়ি থামতেই গার্ড সত্যপ্রিয়কে জানালেন যে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে! তিনি আকাশ থেকে পড়ে বললেন–কেন, গ্রেপ্তার কিসের জন্য?

–দেখছেন না। অকারণে শেকল টানলে পঞ্চাশ টাকা জরিমানা! স্পষ্টই লেখা রয়েছে। দরজার মাথায় ওই!

–অকারণে তো টানিনি।

–সে কথা আদালতে বলবেন।

সত্যপ্রিয় কিছুতেই গাড়ি থেকে নামবেন না, সত্যের মর্যাদা রাখবার জন্য যা করা দরকার, যা প্রত্যেক সত্যনিষ্ঠ ভদ্রলোকেই করবে, তাই তিনি করেছেন। তিনি তো কোনো নিয়ম লঙ্ঘন করেননি, কারণ গুরুত্বর কারণ ছিল বলেই শেকল টেনেছেন। কাজেই তিনি প্রেপ্তার হতে নারাজ, এটে বেশ ওজস্বিনী ভাষায় সবাইকে জানিয়ে দিলেন।

তিনি নামতে প্রস্তুত নন, অথচ তিনি না নামলে ট্রেনও ছাড়তে পারে না অনর্থন ডিটেন হতে হবে ভেবে সত্যপ্রিয়র সহযাত্রীরা গার্ডের সাহায্যে অগ্রসর হল। মাঠের মাঝখানে গাড়ি থামানোর জন্য তারা তখন থেকেই বিরক্ত হয়ে আচে। সকলে মিলে তাকে ধরে জোর করে নামাতে গেল। টানা টানিতে সত্যপ্রিয় দামী সিল্কের পাঞ্জাবিটা গেল ছিঁড়ে; সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মেজাজও গেল রুখে, তিনি ধা করে একজন সহযাত্রীর নাকে ঘুসি মেরে বসলেন। তখন সকলে মিলে চাদা করে তাঁকে ইতস্ততঃ মারতে শুরু করে দিলে। কদাচ কাহাকেও আঘাত করিয়ো না– জীবনের এই মূলমন্ত্র তিনি ভুলে গেলেন। তবে, বাঁ গালে মার খাবার পর ডান গাল তিনি বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন বটে, কিন্তু সেটা বোধ হয়, বাধ্য হয়ে এবং অনিচ্ছাসত্বে, কেননা আক্রমণ থেকে এক গাল বাঁচাতে গিয়ে অন্য গাল বিপন্ন হচ্ছিল। অসুবিধা এই যে দুটো গাল এক সঙ্গে ফেরানো যায় না।

একা সত্যপ্রিয় কি করবেন? খানিকক্ষণ খন্ডযুদ্ধের পরেই দেখা গেল যে একা তিনি সাত জনকে মারবার চেষ্টা করে কাউকেই বিশেষ মারতে পারেননি, কিন্তু সাত জনের মার তাঁকে হজম করতে হয়েছে। সকলে মিলে তাকে চ্যাংদোলা করে স্টেশনের একটা গুদাম ঘরে নিয়ে ফেলে তার বাহির থেকে দরজা লাগিয়ে দিল–সেই যতক্ষণ না থানার থেকে পুলিশ এসে তার হেফাজত নেয়। মন্টুও কাকার সঙ্গে স্বেচ্ছায় সেই ঘরে আটক রইল।

তারপর ট্রেন ছাড়ল। স্টেশন জুড়ে ব্যস্ত উত্তেজনা, বিরাট সোরগোল, সেই সব গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল। ছোট্ট স্টেশনটা সত্যপ্রিয়র মত নির্জীব নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে রইল। সেই বদ্ধ ঘরের মধ্যে সত্যপ্রিয় ঘোৎ ঘোঁৎ করতে লাগলেন। তাঁকে তখন আর চেনাই যায় না। সমস্ত মুখখানা ফুলে মস্ত হয়েছে, চোখ দুটো ছোট হয়ে গেছে, প্রকাণ্ড মুখে তাদের খুঁজেই পাওয়া যায় না–হ্যাঁ, এতক্ষণে হাতির মাথার সঙ্গে তুলনা করা চলে। অচিরেই হয়ত শুঁড়ও বেরুতে পারে এমন সম্ভাবনা আছে বলে মন্টুর সন্দেহ হতে থাকে।

No comments