মাসতুতো ভাই – শিবরাম চক্রবর্তী

মাসতুতো ভাই – শিবরাম চক্রবর্তী

জীবন-মরণ সমস্যার দিন আজ একটা। বৌকে খুন করে সেশন কোর্টের আসামী ভজহরি। তার রায় বেরুবার দিন আজ।

মাসতুতো ভাইকে মাসতুতো ভাই না দেখলে কে দেখবে? কিন্তু আজ আর ভজহরিকে দেখা দিচ্ছেন না হর্ষবর্ধন।

দেখা শোনা, মামলার তদ্বির যা করবার তা এতদিন সবই করেছেন তিনি, এমন কি ষোলোআনার ওপর আঠারো আনাও। কিন্তু আজ আদালতের দিকে পা বাড়াবার তাঁর সাহস হয় না। নিজের চোখে ফাঁসি দেখা যেমন কষ্টকর, নিজের কানে সেই দণ্ডাজ্ঞা শোনাও তার চেয়ে কিছু কম কঠিন নয়। ভজুকে প্রাণদণ্ড থেকে যদি বাঁচানো না গিয়ে থাকে, এগিয়ে নিজের কানদণ্ড নেওয়া কেন?

ভাই গোবর্ধনকে বলে রেখেছেন, আদলতের লাঞ্চের সময়ে সেশন কোর্টের বার লাইব্রেরিতে উকিলবাবুকে ফোন করে যেন খবরটা জেনে নেয়।

কিন্তু গোবর্ধনকে আর ফোন করতে হলো না, সাড়ে বারোটার সময় উকিলবাবুই খবর দিলেন টেলিফোনে। এই মাত্তর ভজহরির দ্বীপান্তর হয়ে গেলো। যাবজ্জীবন। যার মানে আসলে হচ্ছে বারো বছরের জেল, উকিলবাবু জানালেন।

ভজুটা বেঁচে গেলো এ-যাত্রা। হাঁপ ছাড়লেণ হর্ষবর্ধন: ফাঁসিকাঠে লটকাতে হলো না বেচারাকে।

তারপর একটু পরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন : ভজুর ভাগ্যকে আমার হিংসে হয়, জানিস গোবরা?

কিসের হিংসে?

জানিস গোবরা, বছর বারো আগে আমারও মাথায় খুন চেপেছিলো একবার। খুন করবার ইচ্ছে হয়েছিলো তোর বৌদিকে।

বলল কি দাদা? গোবর্ধন আঁতকে ওঠে।

তোর বৌদির জ্বালায় অস্থির হয়ে–আর বলছিস কেন? ভেবেছিলাম যে খুন করে বরং ফাঁসি কাঠে চলে যাই, রেহাই পাই দুজনেই!

অমন কথা মুখেও আনতে নেই।

পারলাম কই করতে? পারলেও তো বাঁচতাম। হাড়মাস ভাজা ভাজা হয়ে গেলো অ্যান্দিনে।

এখনো তোমার সেই মতলব আছে নাকি দাদা?

এখন…এই বয়সে? অসম্ভব। কিন্তু হায়, যদি পারতাম তখন…! হর্ষবর্ধনের হায় হায় শোনা যায়। তাহলে বারো বছর বাদে আজ তো আমি মুক্ত পুরুষ রে!

জেল থেকে বেরিয়ে এসে বিয়ে করতে বুঝি আবার?

আবার? রামোঃ!

তুমি যে এমন সর্বনেশে লোক দাদা, আমি তো তা জানতুম না।

সর্বনেশেই বটে ভাই! নইলে এমন করে নিজের সর্বনাশ করি!

আমাদের অতো ভালো বৌদি–গোবরা মুখ গোমড়া করে–আর তাকেই কিনা তুমি?

তো বৌদি তার ভালো, আমার কে! দাদাও ফোঁস করে ওঠেন। ভজহরির বরাত জোর, নিজেও বাঁচলো বৌয়ের হাত থেকেও বাঁচলো! বারো বছর বাদে ফিরে এসে দিব্যি স্বাধীন হয়ে চরে বেড়াবে।

ভজুদা তোমার জন্যই তো বাঁচলো দাদা! গোবরা বলে।

তা বলতে পারিস–ওকে বাঁচাতে কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি আমায় আবার তোর জন্যেও। বটে!

সত্যি দাদা, এই বুড়ো বয়সে কেঁচে গুণ্ডুষ করতে হলো আমায়। লেখাপড়া শিখতে হলো আবার। তবে আসলে তোমার বুদ্ধিতেই বাঁচলো ভজুদা। যাটালো দাদা, তোমার বুদ্ধি কিন্তু অঢেল।

ভাইয়ের সার্টিফিকেট দাদার বুক বিস্ফারিত হলেও তিনি খাতিয়ে দেখেন বুদ্ধিটা আসলে ভজুরই। নিজের বুদ্ধিতেই বেঁচে গেলো ভজু। কথায় বলে না–আপ্তবুদ্ধি শুভঙ্করী, স্ত্রীবুদ্ধি প্রলয়ঙ্করী! বৌ বেঁচে থাকলে আর বুদ্ধি দেবার সুযোগ পেলে ভজুকে আর বাঁচতে হোত না।

ভজহরির হাজত হবার খবর পেতেই ছুটে গিয়েছিলেন হর্ষবর্ধন। আমি বড়ো বড়ো উকিল লাগাবো, তুমি কিছু ভেবো না ভজু। আশ্বাস দিয়েছিলেন মাসতুতো ভাইকে।

উকিল তো ছাই করবে! উকিলের বিষয়ে বিশেষ ভরসা নেই ভজহরির; উকিল বলবে এখন তো দুর্গা বলে ঝুলে পড়ো বাপু, তারপর তোমায় আপীলে খালাস করে আনবো।

তাহলে? মিথ্যা সাক্ষী দিলে হয় না?

মিথ্যে সাক্ষীতে কাজ হয় বরং, কিন্তু এখানে তো সাফাই দেবার পথ রাখিনি ভাই। খুন করে রক্ত মাথা দা হাতে নিজেই থানায় গিয়ে ধরা দিয়েছি। কবুল করেছি সব।

এক দা-য়ে তোমাদের দুজনকেই কেটেছে দেখছি।

তখন কি আমার কোনো কাণ্ডজ্ঞান ছিলো? যেমন করে পারো আমায় বাঁচাও ভাই। দীপান্তরের আমার দুঃখু নেই, ফাঁসিটা যেন আটকায়।

টাকার আমার অভাব নেই। হর্ষবর্ধন জানায়ঃ তোমাকে বাঁচাবার জন্য খরচের আমি কোনো কসুর করবো না….

আন্দামান থেকে ফিরে এসে মনের মতো বৌ নতুন করে সংসার পাতবো আবার।

বৌ কখনো মনের মতো হয় না দাদা। নিজেকেই বৌয়ের মনের মতো করে নিতে হয়। আমি যেমন নিজেকে গড়ে পিটে করে তুলেছি।

শোনো হর্ষ, নিচের কোর্টে আমার এ মামলার কোনো ফয়সালা হবে না। সেশনে জুরিদের ভাঙচি দিয়ে মোটা টাকা ঘুষ দিয়ে…।

বুঝেচি। আর বলতে হবে না হর্ষবর্ধন বাধা দেন, কেউ শুনতে পেতে আমাকেও ধরে ফাটকে পুরে দেবে। ঘুষ দিতে গেলেও জেলে যেতে হয়। তুমি কিছু ভেবো না। টাকায় যা হতে পারে তার কোনো ত্রুটি হবে না তুমি নিশ্চিত থাকো।

কিন্তু সেশন কোর্টে পৌঁছে দেখলো সে বড়ো কঠিন ঠাই। হোমরা-চোমরা যতো জুরি, গোমড়া মুখ সেখানে তার জারিজুরি খাটবে না।

তবে ওদের মধ্যে চিনতে পারলেন একজনকে। তাঁদের পাড়াতেই থাকেন, দরিদ্র স্কুল-মাস্টার। চল্লিশ টাকা বেতন নিয়ে বেতনের খাতায় একশো কুড়ি টাকা পাইলাম বলে লিখতে হয় যাকে, উদায়াস্ত দশ পাঁচটাকার গোটা দশেক টুইশানি করে সংসার চালাতে হয় যাকে।

ভাবলেন তাকেই পাকড়াবেন।

কথাটা পাড়লেন গোবরার কাছে–বুঝলি শ-দুই টাকার একটা টুইশানি দিয়ে ওকেই হাত করতে হবে।

কিন্তু পড়বে কে? বাড়িতে পড়বার ছেলে কই তোমার? গোবরা শুধায়।

তা বটে। হর্ষবর্ধন খাতিয়ে দেখেন, বাড়িতে ছেলে বলতে গোবরা আর মেয়ে বলতে উনি, গোবরার বৌদি। ওঁকে পড়বার কথা বলতে তাঁর সাহস হয় না, তাহলে হয়তো বৌকে বিধবা করে বৌয়ের হাতের নিজেকেই খুন হতে হবে। অগত্যা–

–কেন তুই তো আছিস। ছোট ভাই তো ছেলের মতই। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সম পিতা বলে থাকে শুনিসনি। তুই-ই পড়বি।

আমি? গোবরা আকাশ থেকে পড়ে। এই বয়সে?

পড়বার আবার বয়স আছে নাকি? সব বয়সেই বিদ্যা শিক্ষা করতে হয়। মরবার আগে পর্যন্ত জ্ঞানার্জন করে যায় মানুষ।

না দাদা, লেখাপড়া করা আমার দ্বারা হবে না।

আরে পড়বি নাকি? পড়ার ছলনা করবি তো।

ছলনা করতে আমি পারবো না। মাস্টারকে আমার ভারি ভয়। নীলডাউন করিয়ে দেবে।

তা দেবে। সে কথা ঠিক। সায় দিতে হয় দাদাকে : আমি না হয় চেয়ার বেঞ্চির বদলে নরম গদির ফরাশ পেতে পড়বার ব্যবস্থা করবো। তাহলে তোর হাঁটুতে আর তেমন লাগবে না।

না লাগুক। আমার আত্মসম্মান হানি হবে তো? যদি আমার কান মলে দেয়?

তখন বাধ্য হয়ে হর্ষবর্ধনকে উদাত্ত হতে হয়:–কিন্তু ভাই গোবরা, বাঙালীকে বাঙালী না রাখিলে কে রাখিবে? কে বলেছিলো এ-কথা?

চন্দ্রশেখর।

চন্দ্রশেখর বলেছিলো? শুনে দাদা তো হতবাক।

না। কপালকুন্ডলা।

কপালকুন্ডলা বলেছিলো এ-কথা?

তাহলে বিষবৃক্ষ। বিষবৃক্ষই বলেছিলো বোধ হচ্ছে।

বিষবৃক্ষ। বৃক্ষ আবার কথা বলে নাকি?

তবে বঙ্কিমচন্দ্রর।

যা বলেছিস। বঙ্কিমচন্দ্রই বলেছিলো এ-কথা। কথাটা একবার ভেবে দ্যাখ তুই। এখানে তো শুধুই বাঙালী নয়। বাঙালীর চেয়েও সে আপনার তার জীবনমরণের প্রশ্ন।…মাসতুতো বাঙালীকে মাসতুতো বাঙালী না রাখিলে কে রাখিবে?

অগত্যা গোবর্ধনকে বুড়ো বয়সে পড়ুয়া হতে হয়। ক্লাস সিক্স যে পেয়নি সে প্রাইভেটে স্কুল ফাইনাল দিতে বসে। মাস্টারের কাছে পাটীগণিত নিয়েই পড়ে প্রথমে।

একেবারে সাঁইত্রিশের উদাহরণ মালা নিয়ে। এই অংকটা আমায় বুঝিয়ে দিন সার। বুঝিয়েই দেন মাস্টার।

এইবার এই আটত্রিশ উদাহরণ মালার অংকগুলো বোঝন।

সাঁইত্রিশের গুলো কষো আগে। কষে দেখাও।

ও আর কষবো কি সার? ওতো বুঝে নিয়েছি।

বুঝেছ কিনা কষে দেখাও।

আপনি বলছেন বুঝিনি আমি? বলছেন কি আপনি। তাহলে এতক্ষণ ধরে আপনি কি বোঝালেন আমায়।

এই রকম দিনের–পর দিন উদাহরণের পর উদাহরণ এগুতে থাকে। অঙ্কের বোঝা বাড়ে। অবশেষে গোবরা আর পারে না, দাদার কাছে এসে কেঁদে পড়ে–আর তো পড়তে পারি না দাদা? অঙ্ক কষতে বলছে কেবল। এবার রক্ষা করো আমায়। তখন দাদা নিজেই ভাইয়ের বোঝা ঘাড় পেতে নেন।

বোঝার ওপর শাকের আঁটি নিয়ে এগোন। একশোখানা একশো টাকার নোট। তার অর্ধেক মাস্টারের হাতে তুলে দিয়ে বলেন-এই বাকিগুলোও আপনার। পরে দেব আপনাকে। বলে মাস্টারকেই একটা নতুন অঙ্ক বোঝাতে লাগেন।

আপনাকে আর এর বেশি করতে হবে না। কেবল বাকি পাঁচজন জুরিকে নিজের মতে আনতে হবে। তা আপনি পারবেন। মাস্টারদের সবাই খাতির করে ভক্তি করে যেমন ভয়ও করে তেমনি। আপনার পক্ষে এ-কাজ কিছুই নয়। ক্লাসে যেমন ছেলেদের পড়ান তেমনি এখানে এই বুড়ো খোকাদের একটু পড়াবেন এই আর কি?

আপনি বলেছেন যেমন করে হোক ওর জেলের ব্যবস্থা করে দিতে হবে এই তো? জেল ছাড়া আর কিছু যেন না হয় এই তো? বেশ, আমার সাধ্যমত আমি চেষ্টা করবো। দেখি কদুর কী পারা যায়।

তা মাস্টারমশাই ভালোই পেরেছেন দেখা যাচ্ছে। হর্ষবর্ধন বলেন গোবর্ধনকে ও ফাঁসিকাঠ থেকে যে করেই হোক বাঁচিয়ে দিয়েছেন ভজুকে। আর এজন্য তোকেও বাহাদুরি দিতে হয় গোবরা। তুই কষ্ট করে এতো ত্যাগ স্বীকার করে পড়েছিলি বলেই তো।

বলতে না বলতে মাস্টারমশাই এসে হাজির–সাফল্যের হাসি মুখে নিয়ে।

আসুন আসুন মাস্টারমশাই। আসতে আজ্ঞা হোক। তাকে দেখে হর্ষবর্ধন উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন : নমস্কার-দণ্ডবৎ-প্রণাম। আপনার ঋণ আমরা জীবনে শুধতে পারবো না।

মাস্টারমশাই বসলে তিনি ড্রয়ার থেকে নোটের তাড়াটা বের করে এগিয়ে দেন-এই নিন, আপনার বাকি পাঁচ হাজার। আমাদের যৎকিঞ্চিৎ প্রণামী। এই সামান্য দিয়ে আপনার মহৎ উপকারের প্রতিশোধ দেওয়া যায় না।

না, না। এমন করে বললেন না। কৃতজ্ঞতার মূল্য কম নয়। এ পৃথিবীতে ক-জন তা দিতে পারে? মাস্টারমশাই বলেন :–কথা রাখতে পেরেছি বলে আমিও কম কৃতার্থ নই হর্ষবর্ধনবাবু।

জুরিদের আপনার মতে আনতে খুব বেগ পেতে হয়েছিল নিশ্চয়?

বেগ বলে বেগ। এরকম বেগ আমি জীবনে পাইনি। তিনি জানান : মুশকিল হয়েছিল কোথায় জানেন? বাকি জুরিদের সবাই বিবাহিত, বৌয়ের জ্বালায় অস্থির। তাঁদের কাছে ভজহরিবাবু একজন হীরো। তাদের মতে ভজহরিবাবু কোনো দোষ করেননি বৌকে মেরে। তারা নিজেরাও পারলে তাই করতে চায়, কিন্তু তারা পরে না, ভজহরিবাবু পেরেছেন। তাদের চেয়ে তিনি একজন বীরপুরুষ।

তাই তারা বুঝি চাইছিল সে বীরের মতই মৃত্যুবরণ করুক? ফাঁসিতে লটকাক?

না ঠিক তা নয়, তবে আমি বৌয়ের মর্ম বুঝিনে, বিয়েই করিনি আদপে। সামান্য আয়ে নিজেরই কুলায় না, বোকে খাওয়াবো কি? আমি দেখলাম না, এমন করতে হবে যাতে আইনের লাঠিও ভাঙে অথচ সাপও না মরে। অনেক কষ্টে দ্বীপান্তর দিতে পেরেছি মশাই। জুরিদের ঘরে গিয়ে–প্রায় তিনঘন্টা ধরে বক্তৃতা দিয়ে তাদের বোঝালাম,….বুঝিয়ে নিজের মতে আনলাম।

তা নইলে তারা ফাঁসি দিয়ে দিত? নিঘাৎ। গোবর্ধন প্রকাশ করে।

না। তারা চাইছিলো বেকসুর খালাস দিতে।

No comments