রাতদুপুরে অন্ধকারে – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

রাতদুপুরে অন্ধকারে – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

কী একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। তারপর টের পেলাম সারা পাড়াজুড়ে লোডশেডিং। কারণ, জানলা খোলা আছে, অথচ ঘরের ভেতর ঘুরঘুট্টে অন্ধকার আর ভ্যাপসা গরম।

কিন্তু শব্দটা অস্বস্তিকর এবং সেটা হচ্ছে আমার খাটেরই তলায়। সেখানে থাকার মধ্যে আছে কিছু পুরোনো খবরের কাগজ। একটা সুটকেস। তার মধ্যে কেউ যেন নড়াচড়া করছে। সেই সঙ্গে অদ্ভুত ফোঁস-ফোঁস শব্দ।

প্রথমে ভাবলাম, সাপ নয় তো? পরে মনে হল, তিনতলার এই ঘরে সাপ কোথা থেকে আসবে? ধেড়ে ইঁদুর বা ছুঁচো হলেও হতে পারে। কিন্তু ওরা কি ফেস-ফোঁস শব্দ করে? নড়াচড়াটাও যেন কোনও ওজনদার প্রাণীর। প্রাণীটা সম্ভবত লম্বাটে গড়নের। নাহ। কখনওই বিড়াল নয়। অস্বস্তি বেড়েই গেল। টেবিলে একটা দেশলাই আছে। মোমবাতি আছে। হাত বাড়ালেই পেয়ে যাব। কিন্তু সাহস পাচ্ছি না, যদি চোর হয়? আজকাল চোরদের সঙ্গে ছোরা-ভোজালি-পিস্তল থাকে শুনেছি। একটা টর্চ আছে অবশ্য। কিন্তু সেটা বিগড়ে যাওয়ার আর সময় পায়নি, আজ সন্ধ্যাবেলাতেই বিগড়ে গেছে। খুব অসহায় বোধ করলাম। এদিকে নড়াচড়া আর স্বাসপ্রশ্বাসের মতো ফোঁস-ফোঁস শব্দটা বেড়েই চলেছে।

কিছুক্ষণ পরে আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। মরিয়া হয়ে করুণস্বরে বলে উঠলাম, দেখুন সার (কেন যে মুখ দিয়ে সার বেরিয়ে গেল কে জানে!) আমার খাটের তলায় সোনাদানা বা টাকাকড়ি কিছু নেই! টেবিলের ড্রয়ারে আমার মানিব্যাগ আছে। তাতেও বেশি টাকাকড়ি নেই। তবে ওটা আপনি স্বচ্ছন্দে নিয়ে চলে যেতে পারেন। আমার রিস্ট ওয়াচটা দাবি করলে সেটাও আপনার হাতে তুলে দিয়ে ধন্য হব। কিন্তু দয়া করে আমাকে যেন মারবেন না সার।

নড়াচড়া আর ফোঁস-ফোঁস থেমে গিয়েছিল। আমার কথা শেষ হওয়ার পর খাটের তলা থেকে কেউ খ্যানখেনে গলায় বলল,–মলোচ্ছাই! এ যে দেখছি আমার চেয়েও ভীতু! এই একটুতেই ভ্যা করে কেঁদে ফেলবে যেন। আবার আমাকে সারসার করা হচ্ছে। খবরদার! আমাকে সার বলবে না বলে দিচ্ছি!

–আজ্ঞে, বলব না। কিন্তু রাতদুপুরে আপনি আমার খাটের তলায় কী করছেন? কে আপনি?

–আমি যে-ই হই, তা নিয়ে তোমার মাথাব্যথা কীসের? আমি একটা জিনিস খুঁজছি। পাচ্ছি না।

–খাটের তলায় আপনার জিনিস আছে বুঝি?

–থাকার কথা। কিন্তু গেল কোথায়? তুমি ফেলে দিয়েছ নাকি?

–কী জিনিস বলুন তো?

–একটা ছোট্ট শিশি।

–আজ্ঞে আমি তো তেমন কোনও শিশি দেখিনি।

–তুমি কবে থেকে এই ঘর ভাড়া নিয়েছ?

–প্রায় এক মাস হয়ে এল।

–বুঝেছি। তাহলে হারাধনেরই কাজ। বাকিটুকু অন্য কাকেও খাইয়ে দিয়েছে। ব্যাটাছেলে মহা ধড়িবাজ।

ক্রমে-ক্রমে আমার সাহস বেড়ে যাচ্ছিল। তাই জিগ্যেস করলাম, হারাধন কে বলুন তো?

–হুঁ। তোমাকে তার পরিচয় দিই আর তুমি তাকে পুলিশে ধরিয়ে দাও। বাহ! আমাকে অত বোকা ভেবো না হে ছোকরা।

–আজ্ঞে, জাস্ট একটা কৌতূহল! তা ঠিক আছে। শিশিতে কী ছিল বলতে আপত্তি আছে?

–নেই। শিশিটা পেয়ে গেলে তোমাকেই একটুখানি খাইয়ে দিতাম। আমার একজন সঙ্গীর দরকার বলেই তো ওটা খুঁজতে এসেছি। হারাধনকে জিগ্যেস করতে হবে, আর কাকে সাপ্লাই করেছে।

–প্লিজ দাদা! আপনার সঙ্গী হতে আপত্তি নেই। কিন্তু জিনিসটা কী, যা খেলে আপনার সঙ্গী হতে পারতাম?

–বলব! আগে হারাধনটাকে জিগ্যেস করে আসি আর একটু-আধটু ওর কাছে আছে কি না।

এই সময় আমার মাথার দিকে জানালার পাশ থেকে কেউ চাপাগলায় বলে উঠল,–কেষ্টদা আছেন নাকি?

খাটের তলার লোকটি খাপ্পা হয়ে বলল, তুমি কে হে ছোকরা, আমাকে এখানে ডাকতে এসেছ?

সাবধানে মাথা একটু ঘুরিয়ে দেখলাম, জানালার ওধারে একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে বললে ভুল হবে, ভেসে আছে। কারণ এটা তিনতলার একটা ঘর। ওদিকে খাড়া দেয়াল নেমে গেছে। বুকটা ধড়াস করে উঠল।

ছায়ামূর্তিটা কেমন অদ্ভুত খিখি শব্দে হেসে বলল, আমি হারাধন কেষ্টাদা!

কেষ্টবাবু বললে,–এই এক্ষুনি তোমার নাম করছিলাম। এসো, কথা আছে।

কেষ্টাদা! আমরা তোমাকে খুঁজে খুঁজে হন্যে হয়ে শেষে এখানে এলাম। পানুবাবু বললেন, কেষ্টবাবু হয়তো শিশিটার খোঁজে গেছেন!

–পানুবাবু কোথায়?

–ওই চিলকোঠায় ছাদে বসে আছেন।

–তাকে ডেকে আনো! তিনজনে বসে একটু আলোচনা করব।

চোখের কোণ দিয়ে দেখলাম ছায়ামূর্তিটা উধাও হয়ে গেল। এবার ডাকলুম,–কেষ্টাদা!

–মলোচ্ছাই! আগেই কেষ্টাদা বলে ডাকছ কেন হে? ডাকার কাজ করো। তবে তো কোদা বলে ডাকবে!

–কী কাজ বলুন তো?

–একটু ওয়েট করো। ওরা দুজনে আসুক। শিশিটার খোঁজখবর নিই। তবে?

–শিশির ভেতর যা আছে, তা খেলে পরেই আপনি আমার কেষ্টাদা হয়ে যাবেন?

–বাহ! তোমার মাথা আছে হে ছোকরা!

–কিন্তু শিশিটা যদি না পাওয়া যায়, তাহলে?

–দেখো ভায়া, যদি সত্যি তুমি আমাদের দলে ভিড়তে চাও, শিশির দরকার অবশ্য হবে না। আরও কত উপায় আছে। তবে শিশির জিনিসটা বেস্ট। তুমি টেরও পাবে না কী ঘটে গেল!

–সে কী দাদা! টেরও পাব না? কিন্তু ঘটবেটা কী?

–চুপ! বকবক কোরো না। খাটের তলায় যা বিচ্ছিরি গরম!

এই সময় মনে হল, এবার দেশলাই জ্বেলে মোমবাতিটা ধরিয়ে ফেলি। লোডশেডিং দু-ঘণ্টা থেকে তিন ঘণ্টাও চলতে পারে। কিন্তু টেবিলের দিকে হাত বাড়াতে সাহস হল না।

একটু পরেই আমার মাথার দিকে জানালায় কেউ বলে উঠল,-কেষ্টবাবু! আছেন না কেটে পড়েছেন।

কেষ্টবাবু সাড়া দিলেন –আসুন পানুবাবু! কেটে পড়ার মতো অবস্থা হয়নি এখনও। হারাধন চলে এসো।

–পানুবাবু বললেন,–আরে! এখানে কে শুয়ে আছে দেখছি!

–ওর ব্যাপারেই একটু আলোচনা আছে।

–খাটের তলায় ঢুকে আলোচনা চলে না। বেরিয়ে আসুন।

–বিচ্ছিরি গরম লাগছে বটে, কিন্তু বেরুতে ইচ্ছে করছে না।

–কেন?

–কোথাও এমন নিরুপদ্রব জায়গা নেই মনে হচ্ছে। আজকাল সবখানেই লোকের ভিড়। আপনারা দুজনেও এখানে থাকতে পারেন। পুরোনো জায়গায় পুরোনো কথা মনে পড়ে আনন্দ পাওয়া যাবে।

–ধুর মশাই! একজন জলজ্যান্ত লোক মাথার ওপর শুয়ে থাকবে। অস্বস্তি হবে না বুঝি?

–মোটেও না পানুবাবু! এ ছোকরা খুব নিরীহ আর শান্ত। দেখছেন না কেমন চুপচাপ শুয়ে আছে।

–জেগে নেই, তা-ই।

–নাহ। দিব্যি জেগে আছে।

–সে কী! ও হারাধন! কেষ্টবাবু কী বলছেন শুনলে?

হারাধন বলল, কই দেখি, দেখি!

খাটের তলা থেকে কেষ্টবাবু বললেন,-খামোকা ওকে ভয় পাইয়ে দিয়ো না। বরং ওকে আমাদের সঙ্গী করে নিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। পানুবাবু! আসুন এখানে। হারাধন এসো হে!

পানুবাবু বললেন,-হারাধন যায় তো যাক। আমি যাচ্ছি না! খাটের ছোকরাকে বিশ্বাস করা যায় না। আজকাল ছেলে-ছোকরাদের মতিগতি বোঝা কঠিন।

হারাধন বলল,–ঠিক বলেছেন পানুবাবু!

কেষ্টবাবু চটে গেলেন। বেশ। আসতে হবে না, কিন্তু শিশিটা কোথায় গেল?

হারাধন বলল,–তুমি খাওয়ার পর যেটুকু ছিল, তার খানিকটা পানুবাবু খেয়েছিলেন। বাকিটুকু কী হল পানুবাবু বলুন।

পানুবাবু বললেন, আমি চায়ের কাপে একটুখানি মিশিয়ে দিয়ে শিশিটা ছুঁড়ে ফেলেছিলাম। পরে দেখেছি, নর্দমার ধারে একটা বেড়াল দাঁত বার করে পড়ে আছে। বাকিটুকু সে-ই সাবাড় করেছিল।

হারাধন বলে উঠল,–কোদা! ওই সেই বেড়ালটা!

কেষ্টবাবু হুঙ্কার দিয়ে বললেন,-বেড়ালটাকে ধরো হারাধন! আমি এই ছোকরার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে দেখি, কীভাবে একে দলে দেওয়া যায়।

পানুবাবু বললেন,–অত আলাপ-আলোচনার কী আছে? ছোকরা যদি নিরীহ আর শান্ত হয়, ওকে বলুন না! ওই তো একটা সিলিংফ্যান ঝুলছে। চাই শুধু একটা শক্ত দড়ি। ঘরেই পেয়ে যাবে। হ্যাঁ, আমার নাইলনের মজবুত দড়িটা এখনও আছে নিশ্চয়। বৃষ্টি-বাদলের দিনে ঘরে ভিজে কাপড় শুকোতে দিতুম। অত ভালো দড়ি কি এই ছোকরা ফেলে দেবে?

এতক্ষণে আর্তনাদ করে উঠলাম,–না না না! ওরে বাবা। আমি ফ্যান থেকে ঝুলতে পারব না!

তারপরই বিদ্যুৎ এসে গেল। টেবিল ল্যাম্পের সুইচ টিপে দিলাম। অমনি খাটের তলা থেকে আমার মাথার পিছন দিয়ে কালো লম্বাটে একটা ছায়ামূর্তি যেন পিছলে বেরিয়ে গেল। মাথার দিকে ঠান্ডাহিম বাতাসের ঝাঁপটানি টের পেলাম। এক লাফে উঠে গিয়ে ঘরের টিউবলাইট জ্বালিয়ে দিলাম।

সেই সময় চোখে পড়ল, একটা কালো বেড়াল পাশের দিকের জানালা থেকে সরে-সরে গেল। ওদিকে একটা আম গাছ আছে। আম গাছে কাকেরা বাসা করে। বেড়ালটাকে ওই গাছের গুঁড়ি বেয়ে একদিন উঠতে দেখেছিলাম না?

কিন্তু এতক্ষণে মনে হল, ব্যাপারটা বুঝে গেছি। তবে আগাগোড়া সবটাই নিছক দুঃস্বপ্ন কি না কে জানে! আতঙ্কে গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। এক গ্লাস জল খেয়ে একটু সুস্থ বোধ করলাম। তারপর টেবিলল্যাম্পটা নামিয়ে খাটের তলাটা দেখে নিলাম। খবরের কাগজগুলো এবং সুটকেসটা যথাস্থানে আছে। তবে সুটকেসটা একটু যেন কাত হয়ে গেছে…

কীভাবে সেই রাত্রিটা কাটিয়েছিলাম, সে আমিই জানি। পরদিন সকালে দোতলার ফ্ল্যাটে আমার পরিচিত রামবাবুকে গিয়ে ধরলাম। উনিই তেতলার ওয়ানরুম ফ্ল্যাটটা আমাকে পাইয়ে দিয়েছিলেন। বাড়ির মালিক তার বন্ধু।

আমার পীড়াপীড়িতে রামবাবু বললেন, হ্যাঁ। আজকাল ফ্ল্যাটটি খালি পড়ে থাকে। আসলে আপনার একটা মাথাগোঁজার জায়গা দরকার ছিল। তাই ওই ফ্ল্যাটটাই

বাধা দিয়ে বললাম, কিন্তু আপনার একটু আভাস দেওয়া উচিত ছিল।

রামবাবু হাসলেন।–আপনাকে যদি বলতাম ওই ফ্ল্যাটে হারাধনবাবু, তারপর পানুবাবু, শেষে কেষ্টবাবু পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন, আপনি কি ওখানে থাকতে রাজি হতেন? তবে দেখুন, ওরা আপনার কোনও ক্ষতি তো করেনি।

–কী বলছেন! লোডশেডিং আর একটু চললে আমাকে ওরা সিলিংফ্যান থেকে ঝুলিয়ে ছাড়ত!

রামবাবু জিভ কেটে বললেন, না, না! আমি আছি কী করতে? আপনি ওদের কারও সাড়া পেলেই আমার নাম ধরে ডাকবেন। আমার নাম শুনেই ওরা পালিয়ে যাবে। কেন বুঝলেন তো? আমার নামে রাম শব্দটা আছে। রামনাম শুনেই ওরা– বুঝলেন তো?

বুঝলাম এবং সাহসও পেলাম যথেষ্ট। কিন্তু কথা হচ্ছে, খাটের তলায় শিশিটা পেয়ে গেলে ওরা আমাকে জোর করে খাওয়াতই। আর আমি–

বাপস!–ভাবতেই হৃৎকম্প হচ্ছিল। ভাগ্যিস একটা কালো বেড়ালের ওপর দিয়েই ফাড়াটা গেছে। তবে এখনই গিয়ে লাল রঙের নাইলনের দড়িটা পুড়িয়ে ফেলতেই হবে। কিছু না জেনে পরের জিনিস ব্যবহার করা আমার মোটেই উচিত হয়নি।…

No comments