পাশের ঘরেই সে আছে – মানবেন্দ্র পাল

পাশের ঘরেই সে আছে – মানবেন্দ্র পাল

বেশ অনেক বছর আগের কথা। কাগজে একটা খবর বেরিয়েছিল, একজন খুনী পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে এই কলকাতাতেই লুকিয়ে আছে। পুলিশ তদন্ত করে এই পর্যন্ত বুঝতে পেরেছিল খুনীটা উত্তর কলকাতার কোথাও কোনো বাড়িতে ছদ্মবেশে ডেরা গেড়ে আছে। লোকটার ছবিও ছাপা হয়েছিল। কাগজে বলা হয়েছিল কেউ যদি লোকটির সন্ধান দিতে পারে তাহলে তাকে গভর্নমেন্ট থেকে পুরস্কৃত করা হবে।

সে সময়ে এখনকার মতো এত খুন-খারাপি হতো না। তাই এইরকম একজন ভয়ঙ্কর খুনীকে পুলিশ ধরতে পারছে না, আর সে বহাল তবিয়তে এই কলকাতাতেই রয়েছে জেনে রীতিমতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আর ভয় পেয়েছিলাম বলেই ব্যাপারটা আমার এখনও মনে আছে।

এরপর সেই খুনীটা ধরা পড়েছে কিনা সে খবর আর পাইনি। অন্তত কাগজে কিছু চোখে পড়েনি।

জানতে পেরেছিলাম অনেক বছর পরে। সেও খবরের কাগজ পড়েই।

ঘটনাটা এইরকম–

মানিকতলার ব্রিজের ওপারে একটা টুরুমড ফ্ল্যাট কিনেছিলেন বিভাবতী সরকার। টাকাটা দিয়েছিল তার বড়ো ছেলে। দিল্লিতে চাকরি করে। মাকে বলেছিল, তুমি তো কলকাতা ছেড়ে নড়বে না, টাকা দিচ্ছি একটা নতুন ফ্ল্যাট কিনে নাও। রিটায়ার করে তো কলকাতাতেই তোমার কাছে গিয়ে আমাদের থাকতে হবে।

সেইমতো বিভাবতী ফ্ল্যাটটি কিনলেন। ফ্ল্যাটটি একটা পুরনো ভাঙা বাড়ি আর খানিকটা জলা জায়গার ওপর তৈরি। এক সময়ে এইসব অঞ্চলে বাড়ি-ঘর কমই ছিল। যে বাড়ি ভেঙে এই ফ্ল্যাট–সেটা ছিল কোনো এক বাঘা জমিদারের। জমিদারি কবে চলে গিয়েছিল, জমিদারের বংশধরেরাও কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। কিন্তু সাবেকি জমিদারি মেজাজটি ছিল পূর্বপুরুষদের মতোই। সে আমলের পুরনো বাড়ি জমিদারপুত্রদের পছন্দ হচ্ছিল না। তাই সেটাকে ফেলে রেখে দিয়েছিল। মাঝে-মধ্যে দু’এক ঘর ভাড়াটে আসত। আবার চলে যেত। সামান্য টাকার ভাড়া। তাই জমিদারপুত্রদের মন উঠত না। তারা ঠিক করল বাড়িটা বেচে দেবে। সে জন্য নতুন ভাড়াটেও আর বসাল না। কেননা ভাড়াটেসুদ্ধু বাড়ি কিনতে কেউ চাইবে না।

তারপর কত হাতবদল হয়ে এখন সেই বাড়িটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে একটা হাল ফ্যাশনের নতুন ফ্ল্যাট বাড়ি। কিন্তু পিছনের অংশে এখনও এখানে-সেখানে ডোবা, জলা, ঢোলকলমি আর বনতুলসীর ঝোপ রয়ে গেছে। হঠাৎ দেখলে মনে হয় না জায়গাটা শহর কলকাতার মধ্যে।

এইখানেই দুটো ঘর নিয়ে থাকেন বিভাবতী। একাই থাকেন পুজো-আচ্চা নিয়ে। খুব ভক্তিমতী। নিজেই রাঁধেন।

একটি কাজের মেয়ে আছে। সে সারা দিন তাকে সাহায্য করে। তার সঙ্গেই গল্প করে তার সময় কাটে।

সবই ভাল তবু কোথায় যেন একটা অস্বস্তি। বিভাবতী এমন কিছু প্রমাণ পেয়েছিলেন যাতে তিনি বুঝেছিলেন বাড়িটায় কিছু দোষ আছে। বিশেষ করে উত্তর দিকের ঘরটায়।

তার অসাধারণ মনের জোর আর সাহস ছিল তাই তিনি রাতে একাই থাকতে পারতেন। না থেকেই বা উপায় কি? ছেলের এতগুলো টাকা খরচ করে ফ্ল্যাটটা কিনেছেন। এখন ছেড়ে দিয়ে যাবেন কোথায়? ছেলেকেই বা কী বলবেন? বাধ্য হয়ে তিনি মুখে কুলুপ এঁটে থাকতেন। কাউকে কিছু বলতেন না। এখানে তার কয়েকজন আত্মীয়-স্বজন আছে। তারা মাঝে মাঝেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসত। কিন্তু কাউকে তিনি রাতে থাকতে বলতেন না। আত্মীয়রা তাকে খুব পছন্দ করত। এই বয়সে তিনি এখানে একা থাকেন এই নিয়ে তারা ভাবতও। কিন্তু বিভাবতী হেসে বলতেন তিনি ভালোই আছেন। তা ছাড়া ঠাকুর যা করবেন তাই হবে। অনর্থক ভেবে লাভ কি।

এতখানি ভগবানের ওপর বিশ্বাস দেখে আত্মীয়েরা আর কিছু বলত না। শুধু জানিয়ে যেত অসুখ-বিসুখ করলে তিনি যেন সঙ্গে সঙ্গে খবর দেন।

তা তিনি বুদ্ধিমতীর মতো একটি কাজ করেছিলেন। টেলিফোন নিয়েছিলেন। আর সেটা রেখেছিলেন মাথার কাছে একটা টুলের ওপরে।

মনে মনে অবশ্য জানতেন অসুখ-বিসুখ ছাড়া আর যে ভয়টা নিঃশব্দে তিনি হজম করে যান, তার প্রতিকার টেলিফোন করে তোক ডেকে হবে না।

টেলিফোন নেবার কিছুদিন পরেই একটা ঘটনা ঘটল। মাঝে-মধ্যে তিনিই দু-একজনকে ফোন করেন। কিন্তু তাঁকে বড়ো একটা কেউ ফোন করে না।

হঠাৎ সেদিন গভীর রাতে টেলিফোন বাজার শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল। এত রাতে কে টেলিফোন করছে? নিশ্চয় রং নাম্বার। তিনি মশারির মধ্যে থেকে হাত বাড়াতে যাচ্ছেন, হঠাৎ দেখলেন মশারির বাইরে থেকে একটা কালো লোমশ হাত রিসিভারটা তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। হ্যাঁ, শুধুই একটা হাত।

তিনি চমকে উঠলেন। ভয় পেলেন। কিন্তু মুহূর্তেই সামলে নিয়ে শান্ত গলায় বললেন, কে তুমি? কি চাও?

উত্তর পাওয়া গেল না। শুধু অস্পষ্ট একটা পায়ের আওয়াজ ঘরের বাইরে চলে গেল।

তিনি আর উঠলেন না। ভগবানকে স্মরণ করে আবার শুয়ে পড়লেন।

সকালে উঠে ভাবলেন, তিনি কি স্বপ্ন দেখেছিলেন?

তখনই চোখে পড়ল রিসিভারটা টুলের নিচে ঝুলছে।

বিনবিন করে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠল তার মুখে। তারপরই তিনি নিজেকে শক্ত করে নিলেন। সংসারের সব কাজই রোজকার মতো করলেন। কাউকে রাতের ঘটনা বললেন না। বললেই রটে যাবে ফ্ল্যাটটা ভুতুড়ে। আর সে কথা ছেলের কানে গেলে তারা আর আসবে না।

একটা কথা ভেবে তার ভয় হলো–এখানে এসে পর্যন্ত তিনি বুঝতে পারছিলেন উত্তরের ঐ ঘরটায় কিছু আছে। তবে এ ঘরে কোনোদিন আসেনি। নিশ্চিন্ত ছিলেন। কিন্তু গতরাতের ঘটনায় তিনি বুঝতে পারলেন এ ঘরেও আসতে শুরু করেছে। তাহলে তিনি এখানে থাকবেন কি করে?

তারপরই তার মনে হলো লোকটা কিন্তু তার ক্ষতি করার চেষ্টা করেনি। কে তুমি? কি চাই? শান্ত ধীর গলায় প্রশ্ন করতেই সে রিসিভারটা ফেলে রেখেই চলে গিয়েছিল। কেনই বা এসেছিল, কেনই বা চলে গিয়েছিল তার উত্তর খুঁজে পেলেন না। আরও একটা উত্তর তিনি পেলেন না–অত রাতে কে তাকে ফোন করেছিল? সত্যিই কি রং নাম্বার?

যাই হোক এদিনের পর থেকে আর সে এ ঘরে ঢোকেনি। কিন্তু গোল বাধাল একদিন কাজের মেয়েটা।

তিনি ঠিক করেছিলেন কাজের মেয়েটাকে রাতে তার কাছে থাকতে বলবেন। তার জন্যে বেশি মাইনেও দেবেন। মেয়েটা রাজীও হয়েছিল। কিন্তু এরই মধ্যে একটা ঘটনা ঘটল।

সেদিন সন্ধ্যেবেলা হঠাৎ আলোগুলো নিভে গেল। বিভাবতী বুঝলেন লোডশেডিং। এ তো রোজকার ব্যাপার। কিন্তু হঠাৎই কাজের মেয়েটা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ছুটে এল তার কাছে। মুখ দিয়ে তার কথা বেরোচ্ছে না।

কি রে মালতী? কি হয়েছে?

মালতী অতি কষ্টে শুধু বললে, একটা লোক—

লোক! কোথায়?

মালতী আঙুল দিয়ে ওদিকের ঘরটা দেখিয়ে দিল। তারপর কোনোরকমে বলল, আজকে ঐ ঘরটায় ঝট দিতে ঢুকেছিল। সঙ্গে সঙ্গে লোডশেডিং। আর তখনই ও স্পষ্ট দেখল একটা লম্বা মতো লোক ঘরের মধ্যে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে..

বিভাবতীর বুকটা ভয়ে কেঁপে উঠল। লোক বলতে মালতী যে কি বোঝাতে চাইছে তা বুঝতে তার আর বাকি রইল না। কিন্তু মুখে সাহস দেখিয়ে বললেন, ও ঘরে লোক আসবে কোথা থেকে? নিশ্চয় চোখের ভুল।

মালতী যতই বোঝাতে চায় চোখের ভুল নয়, বিভাবতী ততই বলেন, না চোখে ভুল। ও ঘরে লোক আসবে কোথা থেকে?

মালতী চুপ করে আছে দেখে তিনি আরও জোর দিয়ে বললেন, আমি এত দিন আছি। কই কোনো দিন তো কিছু দেখিনি।

মিথ্যে কথাই বলতে হয়েছিল বিভাবতাঁকে। কিছু না দেখলেও ঐ বন্ধ ঘরে মানুষের চলাফেরার শব্দ তিনি শুনেছিলেন এক-আধবার নয়, বারবার।

বাধ্য হয়েই এই মিথ্যেটুকু বলতে হয়েছিল। না বললে মালতী আর এ বাড়িতে কাজ করত না।

শেষ পর্যন্ত মালতী থাকল। তবে সন্ধ্যে হবার আগেই চলে যেত। তখন থেকে বিভাবতী সারা রাত একা মুখ বুজে। আর পাশের তালাবন্ধ ঘরটায় মূর্তিমান আতঙ্ক।

সেদিনও তার নিস্তব্ধ ঘরটাকে সচকিত করে টেলিফোনটা বেজে উঠল। তবে গভীর রাতে নয়, সন্ধ্যের একটু পরে।

চমকে উঠলেন বিভাবতী। কোনোরকমে তুলে নিলেন রিসিভারটা।

হ্যালো! দিল্লি থেকে? ও বৌমা! খুশিতে তার স্বর আটকে যাচ্ছিল।

হ্যাঁ, তা আছি একরকম–ভালোই আছি। আচ্ছা, তুমি কি আগে একদিন অনেক রাতে ফোন করেছিলে? করনি?…তাহলে রং নাম্বার। হ্যাঁ, অনেক রাতে কেউ করেছিল..কথা বলা হয়নি। কেটে গিয়েছিল।

তুমি আসবে পরশু দিন? খুব খুশি হলাম।..মাত্র এক রাতের জন্যে? তোমার বন্ধুর বিয়েতে?..থাকতে পারবে না দুদিন?…কি আর করা যাবে?…তাই এসো।

বিভাবতী দেবী রিসিভারটা রেখে দিলেন। তারপর মুখ তুলতেই তিনি চমকে উঠলেন। ঘরের বাইরে জানলার গরাদ ধরে লম্বা মতো কেউ যেন দাঁড়িয়ে।

কে? কে ওখানে?

সঙ্গে সঙ্গে মূর্তিটা সরে গেল–যেন অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। বিভাবতীর রক্ত হিম হয়ে গেল। ও কি শুনতে এসেছিল এ বাড়িতে নতুন কেউ আসছে কি না?

বিভাবতীর ছেলের বৌ অঞ্জনা দিল্লির একটা বিখ্যাত ইংরিজি কাগজের অফিসে কাজ করে। কলকাতায় তার এক বন্ধুর বিয়েতে আসছে। রাতটুকু শুধু শাশুড়ির কাছে থাকবে। পরের দিনে সকালের ফ্লাইটেই দিল্লি ফিরে যাবে।

মাত্র একটি রাত বৌমা তার কাছে থাকবে। বিভাবতী মনকে বোঝান-যেটুকু নিজের লোককে কাছে পাওয়া যায় ততটুকুই আনন্দ। তবু তাকে মনের মতো বেঁধেবেড়ে খাওয়াতে পারবেন না এটাই দুঃখ। সে নেমন্তন্নবাড়ি আসছে কিনা।

সেই সঙ্গে তার একটু ভয়ও করল। ঐ যাকে এ বাড়িতে প্রায়ই দেখা যায়–বৌমাও তাকে দেখে ফেলবে না তো?

সেদিন দুপুরবেলাতেই অঞ্জনা হাসতে হাসতে এল। সারা দুপুর বিভাবতীর পাশে শুয়ে কত গল্পই না করল। বিকেলের দিকে বেরিয়ে গেল কিছু কেনাকাটা করতে। বলে গেল সন্ধ্যের আগেই ফিরবে।

ঠিক সন্ধ্যেবেলাতেই ফিরল অঞ্জনা। ফুটপাথ থেকে উঠে কয়েক ধাপ সিঁড়ি। তারপরেই ঢোকার দরজা। কলিংবেল টিপতে যাচ্ছিল, দরকার হলো না। মালতী দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি। বৌদিকে দেখে একটু হাসল।

কাজ হয়ে গেল?

হ্যাঁ।

বাড়ি যাচ্ছ?

হ্যাঁ।

অঞ্জনা ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। এবার একটু প্যাসেজ। প্যাসেজটা অন্ধকার। অঞ্জনা এগিয়ে যাচ্ছিল; হঠাৎ মনে হলো সে যেন এগোতে পারছে না…কিসে যেন বাধা পাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন তাকে ঠেলে বের করে দিতে চাইছে। অঞ্জনা থতমত খেয়ে গেল। তখনই তার মনে হলো তার সামনে দু হাত দূরে কেউ যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে..চোর?

অঞ্জনা দিল্লিতে খবরের কাগজের অফিসে চাকরি করা মেয়ে, সংবাদ সংগ্রহের জন্যে তাকে নানা জায়গায় ছুটতে হয়। অত সহজে সে ভয় পায় না। ধমকের সুরে বলল, কে ওখানে?

পরক্ষণেই মনে হলো কেউ যেন পথ ছেড়ে সরে গেল।

পাছে মা ভয় পান তাই ব্যাপারটা নিয়ে অঞ্জনা বেশি হৈচৈ করল না। মায়ের ঘরে ঢুকে শুধু একটা কথাই বলল, প্যাসেজটায় আলোর ব্যবস্থা নেই?

বিভাবতী অবাক হয়ে বললেন, আছে বৈকি। এই তো মালতী গেল আলো জ্বেলে।

কিন্তু কিন্তু আমি তো দেখলাম অন্ধকার।

বিভাবতী বললেন, তাহলে হয়তো বালবটা কেটে গেছে।

আধঘণ্টার মধ্যে অঞ্জনা সাজসজ্জা করে বিয়েবাড়ি চলে গেল। রাত দশটায় যখন ফিরল তখন দেখল প্যাসেজে দিব্যি আলো জ্বলছে।

এবার তাড়াতাড়ি শোবার পালা। কাল সকালেই আবার প্লেন ধরতে হবে।

বিভাবতী তার বিছানাতেই অঞ্জনার শোবার ব্যবস্থা করেছিলেন। মাত্র একটা রাত নিজের বৌমাকে কাছে নিয়ে শোবেন। অঞ্জনা কিন্তু শাশুড়ির সঙ্গে শুতে রাজী হলো না। বললে, ওদিকের ঘরটা তো খালি পড়ে রয়েছে। ওখানেই আমি শোব।

বিভাবতীর মুখটা ভয়ে শুকিয়ে গেল। তিনি অনেক করে বোঝালেন। বললেন, ও ঘরটা ব্যবহার করা হয় না। পরিষ্কার করা নেই। কি দরকার? একটা রাত তো একটু কষ্ট করে না হয় আমার কাছে শুলেই।

অঞ্জনা ভাবল শাশুড়ি বোধ হয় ও ঘরে বিছানা পাতা, মশারি টাঙানোর হাঙ্গামার জন্যেই বলছেন। তাই বললে, আপনি কিছু ভাববেন না। আমি সব ঠিক করে নিচ্ছি।

বলে উত্তর দিকের ঘরে গিয়ে ঝটপাট দিয়ে বিছানা পেতে নিলো।

নিরুপায় বিভাবতী কি আর করেন, শুধু বললেন, ভয়টয় পেলে আমায় ডেকো।

অঞ্জনা হেসে বলল, কিসের ভয়? ভূতের?

ভূত কথাটা হঠাৎই তার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল।

কি আর করেন, বিভাবতী এক ফাঁকে তার গলার রুদ্রাক্ষের মালাটা অঞ্জনার বালিশের নিচে রেখে দিয়ে এলেন। মনে মনে প্রার্থনা করলেন, ঠাকুর, বৌমাকে রক্ষে কোরো।

.

খুব ক্লান্ত ছিল অঞ্জনা। তাই হাত-পা ছড়িয়ে আরাম করে শোয়ামাত্র ঘুম। তখনও সে জানত না কি ভয়ংকর ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে…।

অনেক রাত্রে আচমকা তার ঘুম ভেঙে গেল। অসহ্য গরমে তার নিঃশ্বাস যেন আটকে যাচ্ছে। মশারির মধ্যে দিয়ে তাকিয়ে দেখল পাখা চলছে না। লোডশেডিং? কলকাতায় এত লোডশেডিং হয়! কিন্তু তখনই বাইরের জানলা দিয়ে চোখ পড়তে দেখল রাস্তার আলোগুলো দিব্যি জ্বলছে।

তাহলে?

হঠাৎই তার মনে হলো ঘরের মধ্যে আরও কেউ রয়েছে। চমকে তাকাতেই দেখল তার বিছানা থেকে মাত্র হাত পাঁচেক দূরে লম্বা মতো একটা লোক কোমরে হাত দিয়ে তার দিকে ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। এইরকমই একটা আবছা চেহারা সে সন্ধ্যেবেলা দেখেছিল বাড়ি ঢোকার সময়ে। তখন মুখ দেখতে পায়নি।

ধড়মড় করে উঠে বসতে গেল অঞ্জনা। কিন্তু পারল না। মনে হলো তার সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে গেছে।

কি করবে ভাবছে, দেখল লোকটা এক পা এক পা করে তার দিকে এগিয়ে আসছে।…

চিৎকার করতে গেল, পারল না। মুখ থেকে শুধু একটা গোঁ গোঁ শব্দ বেরিয়ে এল।

ততক্ষণে মূর্তিটা একেবারে মাথার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। একটা হাত দিয়ে মশারিটা তুলছে…তারপরই কনকনে ঠাণ্ডা একটা হাত তার বাঁ হাতটা চেপে ধরে টানতে লাগল।

মাগো!

একটা শব্দই অঞ্জনার মুখ থেকে বেরিয়ে এল। তারপর আর কিছু মনে নেই।

ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়, শাশুড়ির ডাকাডাকিতে। প্রথমে মনে হয়েছিল রাত্রে দুঃস্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু নিজের হাতের দিকে তাকাতেই স্তম্ভিত হয়ে গেল। হাত মুচড়ে ধরার দাগটা লাল হয়ে আছে। আর–আর মাথার দিকে মশারিটাও খানিকটা তখনও উঁচু হয়ে আছে।

অঞ্জনা বললে, আপনি এখানে একা আর থাকবেন না। আমার সঙ্গে চলুন।

বিভাবতী বললেন, হুট করে কি এখানকার পাট চুকিয়ে চলে যাওয়া যায়?

তবে আমি এখন যাই। খুব তাড়াতাড়ি আপনার ছেলেকে নিয়ে আসছি। তারপর একসঙ্গে বসে আলোচনা করে ঠিক করা যাবে। এ কদিন একটু সাবধানে থাকবেন।

বিভাবতী একটু হাসলেন।

.

ব্যাপারটা অঞ্জনা সহজে ছেড়ে দেয়নি। এই বাড়িতে এক রাত্তির থাকার ভয়ংকর অভিজ্ঞতা কাগজে লিখল। কলকাতায় এসে পুরনো কাগজপত্র ঘেঁটে যে তথ্যটা বের করেছিল তা হচ্ছে– সেই দীর্ঘদেহী খুনীটা পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে এই বাড়িতেই লুকিয়ে ছিল দলবল নিয়ে। সাহস করে কেউ পুলিশকে খবর দিতে পারেনি। কিন্তু জমিদারপুত্রদের একজন বাড়িটা খালি করার জন্যে একদিন লেঠেল পাঠিয়ে তাকে খুন করে ঐখানেই পুঁতে রাখে। পুলিশ পরে এসে মাটি খুঁড়ে লাশের সন্ধান করে। আশ্চর্য! কিন্তু লাশ পাওয়া যায়নি।

[আষাঢ় ১৪০৭]

No comments