নিরামিষাশী বাঘ – রাজশেখর বসু

নিরামিষাশী বাঘ – রাজশেখর বসু

অনেক বৎসর আগেকার কথা, তখন আলীপুর জন্তু বাগানের কর্তা ডাক্তার যোগীন মুখুজ্যে। যোগীন আমার বন্ধু। একদিন টেলিফোনে বললে, ওহে, বড় বড় একজোড়া তিব্বতী পাণ্ডা এসেছে, খাসা জানোয়ার, দেখলেই জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। সাদা গা, কালো পা, কাজলপরা চোখ, ভাল্লুককে টেনে লম্বা করলে যেমন হয় সেইরকম চেহারা। তোমারই মতন নিরামিষ খায়। দুদিন পরেই হামবুর্গ জু—তে চলে যাবে, দেখতে চাও তো কাল বিকেলে এস।

পরদিন বিকালে যোগীনের কাছে গেলুম। পাণ্ডা, কাঙ্গারু, হিপ্পো, কালো রাজহাঁস, সাদা ময়ূর প্রভৃতি সব রকম দুর্লভ প্রাণী দেখা হল। তারপর বাঘ সিংগির খাওয়া দেখছি এমন সময় নজরে পড়ল একটা বাঘ ভাল করে খাচ্ছে না, যেন অরুচি হয়েছে। মাংসের চার দিকে তিন পায়ে খুঁড়িয়ে বেড়াচ্ছে আর মাঝে মাঝে একটু কামড় দিচ্ছে। যোগীনকে বললুম, আহা, বেচারার একটা পা জখম হয়েছে, খানিকটা মাংস কেউ যেন খাবলে নিয়েছে। গুলি লেগেছিল নাকি?

যোগীন বললে, গুলি লাগে নি। বাঘটির নাম রামখেলাওন, এর ইতিহাস বড় করুণ। পাশের খাঁচার বাঘিনীটিকে দেখ।

পাশের খাঁচায় দেখলুম একটি খোঁড়া বাঘিনী রয়েছে। এরও অরুচি, কিন্তু তবুও কিছু খাচ্ছে। প্রশ্ন করলুম দুটোই খোঁড়া দেখছি, কি করে এমন হল?

যোগীন বললে, এই বাঘিনীটির নাম রামপিয়ারী। রামখেলাওন আর রামপিয়ারী দুটোই বছর—দুই আগে গয়া জেলার গড়বড়িয়ার জঙ্গলে ধরা পড়ে। এদের দস্তুর মত মন্ত্র পড়িয়ে বিবাহ হয়েছিল, কিন্তু মনের মিল হল না, তাই আলাদা খাঁচায় রাখতে হয়েছে।

—ভারী অদ্ভুত তো। ইতিহাসটা বল না শুনি।

—তোমার তো সব দেখা হয়ে গেছে, এখন আমার বাসায় চল, চা খেতে খেতে ইতিহাস শুনবে।

যোগীনের কাছে যে ইতিহাস শুনেছিলুম তাই এখন বলছি।

গয়া জেলায় অনেক বড় বড় জমিদার আছেন। একজন হচ্ছেন চৌধুরী রঘুবীর সিং, প্রতাপপুর গ্রামে বাস করেন। ইনি খুব ধনী লোক, অনেক বিষয় সম্পত্তি, গড়বড়িয়ার জঙ্গল এঁরই জমিদারির অন্তর্গত। রঘুবীর রাজপুত ছত্রী, এককালে খুব শিকার করতেন, কিন্তু বুড়ো বয়সে তাঁর গুরু মহাৎমা রামভরোস স্বামীর উপদেশে সব রকম জীবহিংসা ত্যাগ করেছেন, নিরামিষ খান, ত্রিসন্ধ্যা রামনাম জপ করেন। তাঁর কড়া শাসনে বাড়ির সকলেই মায় কাছারির আমলারা পর্যন্ত নিরামিষ খেতে বাধ্য হয়েছে।

রঘুবীর যখন শিকার করতেন তখন তাঁর সহচর ছিল অকলু খাঁ। সে এখন বেকার, কিন্তু নিয়মিত মাসহারা পায় এবং মনিবের সেলাখানায় যত বন্দুক তলোয়ার বর্শা ইত্যাদি অস্ত্র আছে সমস্ত মেজে ঘষে চকচকে করে রাখে।

একদিন সকালবেলা রঘুবীর সিং বাড়ির সামনের চাতালে একটা খাটিয়ায় বসে গুড়গুড়ি টানছেন আর তাঁর পাঁচ বছরের নাতি লল্লুলালের সঙ্গে গল্প করছেন, এমন সময় অকলু খাঁ এসে সেলাম করে বললে, হুজুর, একটা বড় বাঘ গড়বড়িয়ার জঙ্গলে ধরা পড়েছে।

রঘুবীর বললেন, আহা,, রামজীর জানবর, ওকে ফের জঙ্গলে ছেড়ে দাও।

লল্লুলাল বললে, না দাদুজী, ওকে আমি পুষব।

রঘুবীর নাতির আবদার ঠেলতে পারলেন না। হুকুম দিলেন, শাল কাঠের একটা বড় পিঁজরা বানাও, তার সামনে একটা আর পিছনে একটা কামরা থাকবে, যেমন কলকাতার চিড়িয়াখানায় আছে। মোটা মোটা সিক লাগানো হবে। দুই কামরার মাঝে একটা ফটক থাকবে, ছাদ থেকে জিঞ্জির টানলে ফটক খুলবে, তখন বাঘ কামরা বদল করতে পারবে।

দু দিনের মধ্যেই খাঁচা তৈরি হয়ে গেল, তাতে বাঘকে পোরা হল। দেখা শোনার ভার অকলু খাঁর উপর পড়ল। সে তার মনিবকে বললে, হুজুর আমাদের যে বাঙালী ডাক্তারবাবু আছেন তিনি বলেছেন আলীপুরের চিড়িয়াখানায় প্রত্যেক বাঘকে দু—তিন দিন অন্তর সাত সের ঘোড়ার মাংস খেতে দেওয়া হয়। এখানে তো তা মিলবে না, আপনি খাসীর হুকুম করুন।

রঘুবীর বললেন, কোনও রকম গোশত আমার কোঠির এলাকায় ঢুকবে না। এই বাঘের নাম দিয়েছি রামখেলাওন, ও গোশত খাবে না!

—তবে কি রকম খানা দেওয়া হবে হুজুর?

—খানা কি কমী ক্যা? পুরি কচৌড়ি হালুয়া লড্ডু খিলাও, চাহে দুধ পিলাও, রাবড়ি মালাই পেড়া বরফি ভি খিলাও।

ওই সব পবিত্র খাদ্যেরই ব্যবস্থা হল। রঘুবীর তাঁর লোকজনদের বিশ্বাস করলেন না, নাতিকে সঙ্গে নিয়ে নিজের সামনে বাঘকে খাওয়াতে এলেন। বাঘ একবার শুঁকে ফিরে বসল। রঘুবীর বললেন, ওসব জিনিস খাওয়া তো অভ্যাস নেই, নিয়মিত দিয়ে যাও, দিন কতক পরেই খেতে শিখবে।

দু দিন অন্তর রামখেলাওনকে নৈবেদ্য সাজিয়ে দেওয়া হতে লাগল, কিন্তু একটু দুধ আর মালাই ছাড়া সে কিছুই খায় না। পুরি কচৌড়ি পেড়া ইত্যাদি সবই অকলু খাঁ আর অন্যান্য চাকরদের জঠরে যেতে লাগল।

মানুষকে যদি অন্য কোনও খাবার না দিয়ে শুধু ঘাস দেওয়া হয় তবে খিদের তাড়নায় সে ঘাসই খাবে। রামখেলাওনও অবশেষে পুরি কচৌড়ি পেড়া প্রভৃতি সাত্ত্বিক খাদ্য খেতে শুরু করলে।

চৌধুরী রঘুবীর সিং—এর একটি দাতব্য দাবাখানা আছে, ডাক্তার কালীচরণ পাল তার অধ্যক্ষ। মনিবের আদেশে কালীবাবু রোজই একবার বাঘটিকে দেখেন। তিনি জন্তুর ডাক্তার নন, তবু বুঝতে দেরি হল না যে রামখেলাওনের গতিক ভাল নয়। তার পেট মোটা হচ্ছে, কিন্তু ফুর্তি নেই, ঝিমিয়ে আছে। কালীবাবু ডায়াগনোসিস করে রঘুবীরের কাছে এলেন।

রঘুবীর প্রশ্ন করলেন, ক্যা খবর ডকটর বাবু রামখেলাওন তো বহুত মজে মে হৈ?

কালীবাবু বললেন, না চৌধুরীজী, মোটেই ভাল নেই। ওর ডায়াবিটিস হয়েছে।

—সে কি? ভাল ভাল জিনিসই তো ওকে খেতে দেওয়া হচ্ছে, আমি যা খাই বাঘও তাই খাচ্ছে।

—কি জানেন, বাঘ হল কার্নিভোরস গোশতখোর জানোয়ার। কার্বোহাইড্রেট খাদ্য ওর সহ্য হচ্ছে না, গ্লুকোজ হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। রোজ তিন বার ইনসুলিন দেওয়া দরকার কিন্তু দেবে কে?

—কি বলছ বুঝতে পারছি না। তুমি বাঘের ইলাজ করতে না পার তো পাটনা থেকে বড় ডাক্তার আনাও।

—আপনি ইচ্ছা করলে বড় ডাক্তার আনতে পারেন, কিন্তু কেউ কিছুই করতে পারবে না, ছাগল যেমন মাংস হজম করতে পারে না, বাঘ তেমনি পুরি কচৌড়ি পারে না। ওকে যদি বাঁচাতে চান তবে মাংসের ব্যবস্থা করুন।

রঘুবীর সিং চিন্তিত হয়ে বললেন, বড়ী মুশকিল কি বাত। আচ্ছা, কাল আমার গুরুমহারাজ রামভরোসজী আসছেন, তিনি কি বলেন দেখা যাক।

গুরুমহারাজ এলেন, রঘুবীর তাঁকে বাঘ দেখাতে নিয়ে গেলেন, ডাক্তার কালীবাবুও সঙ্গে গেলেন।

রামভরোসজী খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে বাঘকে প্রশ্ন করলেন, ক্যা বেটা রামখেলাওন, ক্যা হুয়া তেরা? বাঘ মৃদুস্বরে উত্তর দিলে, হুলুম।

রামভরোস বললে, সমঝ লিয়া। আরে ই তো বহুত মামুলী বীমারী। বির্হা হুয়া।

কালীবাবু বললেন, বির্হা কি রকম বেয়ারাম?

—নহি সমঝা? বাঘ বাঘিনী মাংতা।

কালীবাবু বললেন, ও, বাঘের বিরহ হয়েছে, তাই ঝিমিয়ে আছে। তবে চটপট বাঘিনী যোগাড় করুন।

চৌধুরী রঘুবীর সিংএর লোকবল অর্থবল প্রচুর। তিনদিনের মধ্যে একটা তরুণী বাঘিনী ধরা পড়ল। রামভরোসজী তার নাম রাখলেন রামপিয়ারী। বিধান দিলেন, আলাদা পিঁজরায় রেখে বাঘিনীকেও পুরি কচৌরি ওগয়রহ খেতে দেওয়া হক। যখন নিরামিষ ভোজনে অভ্যস্ত হবে, বাঘ বাঘিনী দুজনেই সাত্ত্বিক স্বভাব পাবে, তখন পুরুত ডাকিয়ে বিয়ে দিয়ে এক খাঁচায় রাখবে।

খিদের জ্বালায় বাঘিনীও ক্রমশঃ পুরি কচৌড়ি পেড়া ইত্যাদি খেতে আরম্ভ করলে। সাত্ত্বিক আহারের ফলে বাঘের যেসব উপসর্গ দেখা দিয়েছিল বাঘিনীরও তাই দেখা গেল। তখন রামভরোস স্বামীর উপদেশে ঘটা করে বিয়ে দেবার আয়োজন হল, ঢোল বাজল, পুরোহিত মিসিরজী মন্ত্রপাঠ করলেন, তবে দুই থাবা এক করে দেবার সাহস তাঁর হল না। বাঘ—বাঘিনীর বাসের জন্য একটা খাঁচা ফুল দিয়ে সাজিয়ে তার মধ্যে বড় বড় বারকোশ নানাপ্রকার খাদ্যসামগ্রী এবং পান সুপারী কর্পূর ছোয়ারা নারকেল—কুচি প্রভৃতি মাঙ্গল্য দ্রব্য রাখা হল।

বিবাহসভায় রঘুবীর সিং তাঁর আত্মীয়—স্বজন, রামভরোসজী কালীবাবু অকলু খাঁ এবং আরও বিস্তর লোক উপস্থিত ছিলেন। সকলেই আশা করলেন যে এইবারে এদের মেজাজ ভাল থাকবে। খাদ্য হজম হবে, দুটিতে মিলে মিশে সুখে ঘরকন্না করবে।

বর—কনের শুভদৃষ্টি—বিনিময় কেমন হয় দেখবার জন্যে সকলেই উদগ্রীব হয়ে আছেন। শুভ মুহূর্তে শাঁখ বেজে উঠল, বিহারের প্রথা অনুসারে পুরনারীরা চিৎকার করে গাইতে লাগল—পরদেসীয়া আওল আঙ্গানা। অকলু খাঁ কপাট টেনে নিয়ে নবদম্পতিকে এক খাঁচায় পুরে দিলে।

ফ্রয়েডের শিষ্যরা যাই বলুন, প্রাণীর আদিম প্রেরণা ক্ষুৎপিপাসা। রামখেলাওন আর রামপিয়ারী হিংস্র শ্বাপদ, নামের আগে রাম যোগ করে এবং অনেক দিন নিরামিষ খাইয়েও তাদের স্বভাব বদলানো যায় নি। চার চক্ষুর মিলন হবা মাত্র আমিষবুভুক্ষু দুই প্রাণীর ক্যানিবল প্রবৃত্তি চাগিয়ে উঠল, প্রচণ্ড গর্জন করে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা পরস্পরের সামনের বাঁ পায়ে কামড় দিয়ে এক এক গ্রাস মাংস তুলে নিলে।

বাঘের গর্জন, রক্তের স্রোত, মানুষের চিৎকার, লল্লুলালের কান্না সমস্ত মিলে সেই বিবাহসভায় হুলস্থুল পড়ে গেল। রঘুবীরের আদেশে অকলু খাঁ একটা জ্বলন্ত মশালের খোঁচা দিয়ে কোনও রকমে বাঘ দুটোকে তফাত করে তাদের নিজের নিজের খাঁচায় পুরে দিলে। রামভরোস মহারাজ বললেন, এই দুই জীব পূর্বজন্মে পাপ করেছিল তাই এই দশা হয়েছে, এদের চরিত্র দুরস্ত হতে আরও চুরাশি জন্ম লাগবে।

রঘুবীর সিং জিজ্ঞাসা করলেন, ডাক্তারবাবু, এখন কি করা উচিত?

কালীবাবু বললেন, চৌধুরীজী, আপনি চেষ্টার ত্রুটি করেন নি, এরা যখন কিছুতেই সাত্ত্বিক হল না তখন আর দেরি না করে এদের আলীপুর পাঠিয়ে দিন।

তারপর যোগীন আমাকে বললে, রঘুবীর সিং বাঘ দুটোকে বিদেয় করতে রাজী হলেন। কালীবাবুর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল, তিনি সমস্ত ঘটনা জানিয়ে আমাকে একটি চিঠি লিখলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, আলীপুর জু এই দুটো বাঘকে রাখবে কিনা। খোঁড়া বাঘ শুনে ট্রাস্টীরা প্রথমে একটু খুঁতখুঁত করেছিলেন। কিন্তু চৌধুরী রঘুবীর সিং দিলদরিয়া লোক, ব্যাঘ্রদম্পতির যৌতুক স্বরূপ হাজার—এক টাকার একটি চেক আগাম পাঠিয়ে দিলেন। আর কোনও আপত্তি হল না, রামখেলাওন আর রামপিয়ারী কালীবাবুর সঙ্গে এসে আমাদের এখানে ভরতি হল। এখন মোটের ওপর ভালই আছে, তবে অনেক দিন সাত্ত্বিক আহারের ফলে ওদের প্যাংক্রিয়াস ড্যামেজ হয়েছে, হজমশক্তি কমে গেছে, মেজাজও খিটখিটে হয়েছে। স্বামী—স্ত্রীর মোটেই বনে না।

১৩৫৯ (১৯৫২)

No comments