অর্থং অর্থং – সৈয়দ মুজতবা আলী

অর্থং অর্থং – সৈয়দ মুজতবা আলী

একটা ‘ফরেন’-ওলার কথাই বলি।

ইন্টারভ্যুতে আমিও ছিলুম। সেই ছাব্বিশ বছরের ‘ফরেন’–বাট ড্যাম কালা আদমি ছোকরাটা তার বাপের বয়সী ওমেদার অধ্যাপককে যা বেহায়া প্রশ্ন শুধোতে লাগল তাতে আমি স্তম্ভিত। কারণ সেই অধ্যাপকের কিছু কিছু লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। এ যুগে আর কটা হিন্দু ফার্সি শিখে ভারতবর্ষের সাতশ বছরের ইতিহাস অধ্যয়ন করে? ইনি তাদেরই একজন। অথচ ওই ‘ফরেন’-পন্টক ফার্সির এক বর্ণও জানে না। শুধু ইতিহাসের অধ্যাপক ঠিক ইতিহাসও নয়, ইভলজির– বলেই গুণধর বোর্ডে এসেছেন, এবং যে-মোগল ইতিহাস সম্বন্ধে তিনি নিরেট আকাট, সেই সম্বন্ধে চোখাচোখা প্রশ্নবাণ ঝাড়ছেন। সেগুলো তৈরি করে নিয়ে এসেছেন গতকাল লাইব্রেরি থেকে, দু-তিনখানা মোগল ইতিহাসের ইংরেজি অনুবাদ পড়ে– প্রধান উদ্দেশ্য, বাদবাকি মেম্বরদের তাক লাগিয়ে দেওয়া। সে সব মেম্বররা এসেছেন অপরাপর যুনি থেকে। ফলে সে সব য়ুনিতে তিনি একসূটেশন লেকচারে নিমন্ত্রিত হবেন, এগজামিনার হবেন, বহুবিধ কনফারেন্সে নিমন্ত্রিত হবেন, তাঁর প্রিয় ছাত্রের অখাদ্য থিসিসে তারা একটারনল পরীক্ষক হিসেবে ডিটো মারবেন, তিল্লো এ-বাগে তাই করবেন, গয়রহ, ইত্যাদি এটসেটরা। কী কী প্রশ্ন শুধিয়েছিলেন, আমার ঠিক মনে নেই তবে রেডুকৎসিয়ো আড আবসুর্ডুমে পরিণত করতে যদি অনুমতি দেন তবে কাল্পনিক দু-একটি পেশ করতে পারি : ‘আকবর যখন আহমদাবাদ আক্রমণ করেছিলেন তখন সাবরমতী বেয়ে হাওয়া পূর্ব না দক্ষিণ থেকে বইছিল?’ ‘সিলেটের শাহজলাল মসজিদে পূর্বে যে জলালি কবুতর ছিল তারা এখন চলে যাচ্ছে কোথায়?’

এবং এমনই খাজা ইংরেজি উচ্চারণে যে আমি একবার দু-প্রশ্নের ফাঁকে তাঁকে কানে কানে বললুম, ‘I am glad, Oxbridge has not been able to damage your original pronunciation.’

আমি সবিনয়ে নিবেদন করছি, আমি সে অধ্যাপককে বাঁচাতে পারিনি। সেই প্রাচীন গল্প তা হলে আবার বলি। বার্নার্ড শ’র একটি নাট্য করে থিয়েটার থেকে গম গম্ করে তুলে ধরেছে, দ্রষ্টাদের সপ্রশংস চিৎকার, ‘নাট্যলেখককে স্টেজে বেরুতে বল, আমরা তাকে দেখব।’ শ’ এলেন। মিনিট পাঁচ ধরে চলল তুমুল হর্ষরব, করতালি যাবতীয়। সবাই যখন শান্ত হলেন, এবং শ তার ধন্যবাদ জানাবার জন্য মুখ খুলতে যাবেন এমন সময় সর্বশেষ সস্তা গ্যালারি থেকে একটা আওয়াজ এল ‘বূ বূ বূ বূ’! শ’ ওই দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ব্রাদার, ঠিক বলেছ; এ নাট্যটা রদ্দি। কিন্তু তোমাতে-আমাতে, মাত্র দু জনাতে, এই শত শত লোকের পাগলামি ঠেকাই কী করে!’

তারপরই আমি বিদেশ চলে যাই। না, স্যার! sory, কোনও সোভিয়েট, মার্কিন, বার্লিন ডেলিগেশনে নয়। তা সে যাক। ফিরে এসে বোম্বায়ে আমার বন্ধু প্রসাদদাস মানিকলাল শুক্রের বাড়িতে উঠলুম। ওই অকসব্রিজওলার কথা কী করে উঠল জানিনে, কারণ লেখাপড়ির ব্যাপারে আমরা charleton-ধাপ্পাবাজদের নিয়ে কখনও আলোচনা করতুম না।

শুক্ল বললে, ‘সে বড় মজার ব্যাপার! তোমার ওই ব্রাদার চৌধুরী শনৈঃ শনৈঃ উঠতে লাগলেন খ্যাতির শিখর পানে। আজ এই কলেজে, কাল অন্য য়ুনিভার্সিটিতে আস্ত একটা হনুমানের মতো চড় চড় করে পদোন্নতির অশথ গাছের মগডালে, বয়েস পঁয়ত্রিশ পেরুতে না পেরুতে। ইতোমধ্যে তাঁর নিজস্ব উমদা গ্যোবেলসি শানাই তাঁর গুণের রাগ-রাগিণী বাজাতে বাজাতে এটাও জাহির করেছে যে, ওই চৌধুরী স্বচেষ্টায় ফরাসি, জর্মন, রুশ গয়রহ ভাষাও আয়ত্ত করে ফেলেছেন।’

শুল্ক ফিক করে একটুখানি হেসে বললে, ‘সে বড় মজার। তোমার ওই চৌধুরীর তখন এমনই আস্পদ্দা বেড়ে গেছে যে, সে ছাপিয়ে দিলে বুর্নফের একটি অচলিত ছোট লেখার অনুবাদ ইংরেজিতে– চটি বই, ব্রশ্যুর বলতে পার। আসলে সে সেটা করেছিল এক আনাড়ি ছোকরার সাহায্যে, যার ফরাসি জ্ঞান ছিল অত্যন্ত কাঁচা– কিন্তু ছোকরা ধাপ্পা মারতে জানত চৌধুরীর চেয়েও দুই বাঁও বেশি।

শুক্ল বললে, ‘ওহ! সে বই নিয়ে এ দেশে কী তুলকালাম, ফাঁ ফাঁর! অবশ্য তার চোদ্দ আনার উৎপত্তি চৌধুরীর গ্যোবেলসি কলসি থেকে। এবং এখনও এ দেশের লোকের বিশ্বাস এ রকম অনুবাদ হয় না। মাত্র দু-একটি প্রাণী জানে যে, কী করে যেন ওই অনুবাদ প্যারিসে পৌঁছে গেলে তাদের এক পত্রিকায় বেরোয় “The originality of the translator has come out with extraodinary success in those passages where he has failed to understand the original!” অবশ্য তাতে করে চৌধুরীর রত্তিভর লোকসান হয়নি, কারণ এই ফরাসিতে লেখা সমালোচনা– তাও প্রকাশিত হয়েছে পণ্ডিতীয়া — এই দেশে পড়ে কটা লোক! তা সে যাক।

ইতোমধ্যে এদেশে একটি পোলিটিশিয়ানের প্রাণ হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল জননী ভারতের লুপ্ত ইতিহাস উদ্ধার করার জন্য। আসলে তুমি তো জানো, এসব নির্জলা ব্লা। ভদ্রলোক চান, তিনি যে ‘কলচর’-জগতেও সম্মানিত হোন। অবশ্য পরের হাত দিয়ে তামাক খেয়ে। সেই “পরে”রও অভাব হল না। এ অঞ্চলে শেঠীয়াদের টাকের ঠিক জায়গায় হাত বুলোতে পারলে গৌরীশঙ্করের শিখরে মরূদ্যান নির্মাণের জন্যও পিলপিল করে টাকা বেরিয়ে আসে।

তার পর শ্যানায় শ্যানায়(১) কুলাকুলি। তোমার এই প্যারা চৌধুরী–

আমি বললুম, ‘শট্ অপ’।

‘আহা, চটো কেন? তার পর সাড়ম্বর স্থাপিত হয়, “জম্বুদ্বীপ-সমন্বিতা সমুদ্র—” যাকগে যাক, আমার নামটা ঠিক মনে নেই, ওই “কলচর” “মলচর” নিয়ে কী যেন একটা প্রতিষ্ঠান, আর চৌধুরী হলেন তার “সর্বাধিকারী” “মহাস্থবির” না কী যেন একটা।… কিছুদিন পর ইতোমধ্যে অবশ্য প্ল্যানমাফিক দু-দশখানা ভালো-মন্দ-মাঝারি “কলচরল” বই “জম্বুদ্বীপসমন্বিত–“দুচ্ছাই আবার ভুলে গেলুম প্রতিষ্ঠানের নামটা– বই বেরিয়েছে। সর্বাধিকারী চৌধুরী প্রতিষ্ঠানের কর্তাকে বোঝালেন–

(ক) ঋগ্বেদের যেসব অনুবাদ গত এবং এই শতকে ইংরেজি-বাংলা-ফরাসি-জর্মনে বেরিয়েছে, সেগুলো ইতোমধ্যে বিলকুল বেকার ঔট অব ডেট হয়ে গিয়েছে, (খ) একটি নতুন অনুবাদ দরকার, (গ) সেটিকে সর্বাঙ্গসুন্দর করতে হলে বড় বড় পণ্ডিতদের সাহায্য নিতে হবে, (ঘ) এবং তাঁদের দক্ষিণা এবং ছাপা বাবদ লাগবে আশি হাজার টাকা।

আমি তাজ্জব মেনে বললুম, ‘কী বললে, আশি হাজার টাকা? বল কী!‘

‘বিলক্ষণ! আশি হাজার টাকা! ব্যাপারটা হল গিয়ে, ওই যে প্রতিষ্ঠাতা পলিশিয়ান কলচরড হতে চান, তিনি শেয়ারবাজার, টেভয় টিন থেকে ওমরা তুলো, শিবরাজপুর মেঙ্গানিজ সব বোঝেন, কিন্তু কিন্তু বড় বড় পণ্ডিতদের তেজিমন্দি বাবদে বিলকুল না-ওয়াকিফহাল। ঢেলে দিলেন টাকাটা। তার পর বেরুতে লাগল কিস্তিতে কিস্তিতে বেদের নবীন ইংরেজি অনুবাদ! যে রকম আমাদের হরিবাবুর বাংলা কোষ বেরিয়েছিল। উত্তম প্রস্তাব! কিন্তু, ব্রাদার, নিরবচ্ছিন্ন শান্তি এই দগ্ধ সংসারে কোথায়? হঠাৎ পুণার এক পণ্ডিত আমাদের কলচর-প্রতিষ্ঠাতার কাছে এসে উপস্থিত হয়ে অনুবাদের খুনিয়া খুনিয়া সব ভুল দেখাতে লাগলেন। যেমন মনে কর– কথার কথা কইচি, আমি তো ওখানে ছিলুম না– “রবিকর” অনুবাদে হয়েছেন, “সূর্য যে খাজনা দেন” কিংবা “রাজকর” অনুবাদে হয়েছেন “রাজা যে রশ্মি দেন”। এ রকম বিকুটে বরবাদ অনুবাদ কেন হল কিছুই বোঝা গেল না। সামান্যতম বৈদিক ভাষা যে জানে সে-ও তো এরকম ভুল করবে না। হ্যাঁ, আলবৎ, ‘ক্রন্দসী’ ‘রোদসী’ ধরনের অচলিত শব্দ নিয়ে সাতিশয় সাধু মতান্তর হতে পারে, কিন্তু এ ধরনের আকাট, বর্বর– রহস্যটা তবে কী?’

আমিও সময় দিয়ে বললুম, ‘রহস্যটা তবে কী?’

‘ওই কলচরকামী প্রতিষ্ঠাতা বেদবেদান্ত বাবদে বেকুব হতে পারেন, কিন্তু তিনি “ইঁদুরের গন্ধ পান”–শয়তানির শ্বাস পান। নইলে সাদা-কালো-গেরুয়া বাজার কনট্রোল করছেন বৃথাই। তিন দিন যেতে না যেতে স্বয়ং চৌধুরীই এসে যা বললেন তার থেকে স্পষ্ট বোঝা গেল, তিনি কি ভারতীয়, কি ফরাসি, কি ইংরেজ, কি জর্মন কোনও পণ্ডিতকেই অনুবাদ-কর্মে নিযুক্ত করেননি। তাবৎ কর্ম করিয়েছেন একটি দুঃস্থা জর্মন রমণীকে দিয়ে। সে বেচারি সংস্কৃতের এক বর্ণ জানে না– বেদের ভাষা মনোজের ভাষায় কহঁ কহাঁ মুল্লুকে! সে স্রেফ জর্মন পণ্ডিত গেল্টনার-কৃত কয়েক বৎসর পূর্বে প্রকাশিত বেদের অনবদ্য জর্মন অনুবাদ ইংরেজিতে অনুবাদ করে গেছে। মেয়েটি ভালো জর্মন জানে বটে, কিন্তু তার ইংরেজি কাঁচা। কিন্তু সেইটেই মূলতত্ত্ব নয়। আসল বিপদ হয়েছে, বেদের অনেক বস্তু অস্পষ্ট, রহস্যময়, দ্ব্যর্থক কেন– বই অর্থসূচক। সেগুলো জর্মন পণ্ডিত গেল্টনারও করেছেন সন্তর্পণে, ‘আবছা-আবছা’ রেখে, –যেন সান্ধ্যভাষায়। এ নারী তাই তার অনুবাদে –আদৌ সংস্কৃত জানে না বলে–রবিকর, রাজকর, নরকর, হাতির কর (কথার কথা কইচি!) গুবলেট করে বসেছে। তখন পরিষ্কার হল রহস্যটা।

‘তস্য বিগলিতাৰ্থ, চৌধুরী দশ-বিশজন পণ্ডিত লাগিয়ে, তাদের ন্যায্য দক্ষিণা দিয়ে অনুবাদ করাননি। মেমসাহেবকে দিয়ে কম্মটি করিয়ে নিয়েছেন।

‘আরও, অর্থাৎ– এবং সেখানেই অর্থ’, মেমসাহেবকে তিনি দিয়েছেন এক হাজার টাকা, ছাপার খরচা বাদ দিয়ে তিনি পকেটস্থ করেছেন সত্তর হাজার টাকা! হল?’

চৌধুরী এখন ফটকা-বাজারে ভালো পয়সা কামায় ॥

৬।১১।৬৫

———-

১. চলন্তিকা বলেন সজ্ঞান থেকে সেয়ানা। বড়বাবু বলেন, শ্যেনদৃষ্টি রাখে যে জন তার থেকে শেয়ানা, শ্যানা।

No comments