আশৈশব দুর্বলতা – হুমায়ূন আহমেদ

আশৈশব দুর্বলতা – হুমায়ূন আহমেদ

ঘড়ি নামক বস্তুটির প্রতি আমার আশৈশব দুর্বলতা।

কেউ আবার মনে করে বসবেন না আমি হাই থটের কিছু বলার চেষ্টা করছি–ঘড়ি বহতা সময়ের প্রতীক, মহাকালের প্রহরী ইত্যাদি ইত্যাদি। মোটেই সে রকম কিছু নয়। আমার দুর্বলতার কারণ ঘড়ি সুন্দর একটা জিনিস। সেকেণ্ডের কাঁটা ক্রমাগত ঘুরছে। তাকিয়ে থাকলে মনে হয় বস্তুটির প্রাণ আছে। কানের কাছে ধরলে হৃদপিণ্ডের শব্দের মত টিকটিক শব্দ হয়।

ক্লাস এইটে প্রথম বৃত্তির টাকা পেয়ে মাকে বললাম, একটা ঘড়ি কিনে দাও।

মা চমকে উঠে বললেন, এই বয়সে ঘড়ি কি রে? আমি তো আমার জন্মে শুনি নি মেট্রিকের আগে কেউ ঘড়ি পরে। না না, এইসব চিন্তা বাদ দে।

লোয়ার কোর্টে মামলা খারিজ হবার পর হাইকোর্টে আপীল করা হয়। আমিও তাই করলাম। এক সন্ধ্যায় বাবার কানে গোপন ইচ্ছার কথা তুললাম। নিজের বলার সাহস নেই। ছোট বোন শেফু আমার হয়ে বলল।

বাবা বিস্মিত হয়ে বললেন, এই বাচ্চা বয়সে ঘড়ি? বাবুয়ানা শেখা হবে। সব কিছুর একটা সময় আছে। প্রথম দাড়ি-গোঁফ কামাতে হয় মেট্রিক পাসের পর। ঘড়ি কিনতে হয় কলেজে উঠে। আমি প্রথম ঘড়ি কিনি বি.এ. ক্লাসে পড়ার সময়। পাঁচ টাকার কেনা ঘড়ি–এখনো পরছি।

হাইকোর্টে মামলা খারিজ।

আমার ব্যথিত মুখ দেখে হয়ত বাবা খানিকটা নরম হলেন। উদার গলায় বললেন–মেট্রিক পরীক্ষা আসুক, তখন দেখা যাবে।

শেফু বলল, একটা কিনে দিয়ে দিও বাবা। দাদাভাইয়ের খুব বেশি শখ।

আচ্ছা আচ্ছা দেব। হাতে ঘড়ি পরেই পরীক্ষা দিতে যাবি।

দুবছর পার হল। কয়েকবার মনেও করিয়ে দিলাম। বাবা প্রতিবারই হাসিমুখে বললেন, তাঁর মনে আছে। যথাসময়ে পাওয়া যাবে।

বাবার মধ্যে নাটক করার প্রবণতা আছে। আমি নিশ্চিত, প্রথম পরীক্ষা দিতে যাবার সময় বাবাকে সালাম করব, তিনি পকেট থেকে ঝকঝকে ঘড়ি বের করে দেবেন। এবং হাসতে হাসতে বলবেন–কি খুশি?

প্রথমদিন বাংলা পরীক্ষা। বাবাকে সালাম করে উঠে দাঁড়ালাম–তিনি বিব্রত গলায় বললেন, বাবা, তুই আমার হাতঘড়িটা নিয়ে যা। কিছু মনে করিস না। টাকা পয়সার খুব সমস্যা যাচ্ছে, কিনতে পারি নি। কি মন খারাপ না তো?

না

মন খারাপ না হলে মুখ এমন অন্ধকার কেন? এই সংসারে ঘড়ি কি খুব বড় জিনিস? দেব, আমি কিনে দেব। খুব দামী ঘড়ি কিনে দেব।

বাবার পাঁচ টাকা দামের ঘড়ি বুক পকেটে নিয়ে পরীক্ষা দিতে রওনা হলাম। হাতে পরার উপায় নেই। বেল্ট বড়, হাতে ঢলঢল করে।

কলেজ জীবনটাও আমার ঘড়ি ছাড়া কাটল। আমার হোস্টেলের খরচ জোগাতেই বাবা তখন হিমশিম খাচ্ছেন। কিছুতেই সামাল দিতে পারছেন না। ঘড়ি আসবে কোত্থেকে!

প্রথম ঘড়ি কিনলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকারও দেড় বছর পর। ইউনিভার্সিটি শীতের বন্ধ হচ্ছে। বন্ধ হবার দুদিন আগে একসঙ্গে স্কলারশীপের একবছরের টাকা পেয়ে গেলাম। প্রায় হাজারখানিক টাকা! একসঙ্গে এত টাকা? মাথা খারাপ হয়ে যাবার মত অবস্থা। চলে গেলাম ইসলামপুর। সেই সময়কার হিসেবে সবচে দামী হাত ঘড়িটা কিনলাম। সাড়ে তিনশ টাকা। খুব সহজ ঘড়ি না। বিশেষ ধরনের জিনিস। একের ভেতর দুই। একটা স্টপ ওয়াচও আছে। স্টপ ওয়াচের উপকারিতা এখনো বুঝতে পারছি না। আপাতত কতক্ষণ নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাখা যায় সেই পরীক্ষা চলছে। হাতে পরেছি, হাত কেমন ভার ভার লাগে। মনে হয়। অন্য মানুষের হাত। দশ মিনিট পরপর সময় দেখতে ইচ্ছে করে। পাশ দিয়ে ঘড়ি-পরা কেউ যাচ্ছে, আমি গভীর আগ্রহে জিজ্ঞেস করি, ভাই কটা বাজে?

সে হয়ত বলল, দুটা দশ।

আমি চট করে নিজের ঘড়ি দেখে নেই–হ্যাঁ, আমারটাতেও দুটা দশ বাজে।

চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ঘড়ি কেনার আনন্দ অনেকখানি কমে গেল। কেবলি মনে হতে লাগল, খুব একটা ভুল কাজ করেছি। বাবা যখন দেখবেন আমি নিজের টাকায় ঘড়ি কিনেছি তখন তিনি নিশ্চয়ই মন খারাপ করবেন। অক্ষমতার কষ্ট খানিকটা হলেও পাবেন। তাঁকে সেই কষ্ট দেবার কোন অধিকার আমার নেই। ঘড়ি ফিরিয়ে দেয়া যায়। দোকানি বলে দিয়েছে–পছন্দ না হলে ফেরত নেবে। রিসিট সঙ্গে থাকলেই হল। অল্পবয়সের লোভই জয়ী হল। ফেরত দেয়া হল না। আর ফেরত দেবই বা কিভাবে? কি চমৎকার জিনিস! একের ভেতর দুই।

বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হয়ে গেল। রাত দশটার বাহাদুরাবাদ এক্সপ্রেসে চেপে রওনা হলাম। যাচ্ছি বগুড়া। তখন আমার বাবা-মা থাকতেন বগুড়া।

জানালার পাশে বসেছি। ঘড়িপরা হাত বাইরে বের করা–গফরগাঁ রেল স্টেশন থেকে গাড়ি ছেড়েছে। হঠাৎ তীব্র ব্যথায় আমার বাঁ হাত অবশ হয়ে গেল। কোন এক হৃদয়হীন মানুষ টান দিয়ে ঘড়ি ছিনিয়ে নিয়েছে–হাত কেটে গলগল করে রক্ত পড়ছে। হাতের ব্যথায় নয় প্রবল অভিমানে আমার চোখে পানি এসে গেল। অভিমান ভালবাসার মত, কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয় না। আমার বেলায় হল। আমি আর ঘড়ি কিনলাম না।

বিয়ের পর হাতে ঘড়ি নেই দেখেই হয়ত আমার শ্বশুর সাহেব তার কন্যার হাতে এক হাজার টাকা দিয়ে বললেন আমাকে ঘড়ি কিনে দিতে। আমার সংসারে তখন চরম অভাব। মহা সংকট। আমি গুলতেকিনকে বললাম, ঘড়ি জিনিসটা আমার খুবই অপছন্দ।

সে বিস্মিত হয়ে বলল, কেন?

দেখছ না সব সময় টিকটিক করে মনে করিয়ে দিচ্ছে–সময় ফুরিয়ে গেল। এই জন্যে ঘড়ি দেখলেই আমার গা জ্বালা করে।

সেই সময় আমি যা বলতাম গুলতেকিন বিশ্বাস করত। তার ধারণা হয়ে গিয়েছিল পৃথিবীর সবচে জ্ঞানী (!!) মানুষটিকে সে বিয়ে করেছে। সে প্রাণপণে চেষ্টা করছে জ্ঞানী (!!) মানুষটির রুচি এবং অভ্যাসের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে। সে বলল, টাকাটা তাহলে কি করব? বাবাকে ফিরিয়ে দেব?

পাগল হয়েছ? উনাকে ফেরত দিলে উনি অপমানিত বোধ করবেন না? আমার কাছে দাও, আমি খরচ করি।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যখন আমেরিকা যাচ্ছি তখনো আমার হাতে ঘড়ি নেই। অবশ্যি ততদিনে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। সময় বোঝা আমার জন্যে। কোন সমস্যাই না।

নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পি-এইচ ডি করছি–আমার এক বন্ধু শ্রীলংকার রত্ন সভাপতি সুরিয়াকুমারণ একদিন হতভম্ব হয়ে বলল, আমেরিকার মত জায়গায় তুমি ঘড়ি ছাড়া চলছ, ব্যাপারটা কি?

আমি বললাম, সময় জানা আমার কোন সমস্যা না। তুমি আমাকে সময় জিজ্ঞেস কর, আমি বলে দেব।

দশ ডলার বাজি?

হ্যাঁ, দশ ডলার। এখন বাজছে একটা কুড়ি।

সুরিয়াকুমারণ তার হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল। আসলেই একটা কুড়ি। পাঠকদের কাছে ব্যাপারটা যতটা রহস্যময় মনে হচ্ছে আসল ঘটনা তেমন রহস্যময় নয়। কিছুক্ষণ পরপর অন্যের হাতঘড়িতে সময় দেখে নেয়া আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। সুরিয়াকুমারণের হাতঘড়িতে কটা বাজে তা তার সঙ্গে দেখা হওয়ামাত্র এক ফাঁকে দেখে নিয়েছিলাম।

আমার ৩২তম জন্মদিনে আমার স্ত্রী তার বেবী সিটিং-এর টাকায় আমাকে অত্যন্ত দামী একটি সিকো ঘড়ি কিনে দিল। হাসতে হাসতে বলল, এটা কোয়ার্টজ ঘড়ি। টিকটিক করে বলবে না–সময় শেষ। নাও, হাতে পর। এই ঘড়ি আমি অনেক কষ্টের টাকায় কিনেছি।

ঘড়ির উপর থেকে অভিমান উঠিয়ে নিয়ে প্রথম হাতঘড়ি পরলাম। নিজেকে কেন জানি অন্যমানুষ, অন্যমানুষ মনে হতে লাগল। প্রথমবারের মত মনে হল, আর আমাকে অন্যের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না।

আমার এই সিকো ঘড়িটির বয়স এখন দশ। এখনো চমৎকার সময় দিচ্ছে। তবে এই ঘড়ির একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে–যখন আমার স্ত্রী কোন কারণে আমার উপর রাগ করে–ঘড়ি বন্ধ হয়ে যায়। এই ব্যাপারটা একবার না, আমি অসংখ্যবার লক্ষ্য করেছি।

গুলতেকিন রাগ করে। ঘড়ি বন্ধ হয়ে যায়। একদিন দুদিন কাটে। ঘড়ি হঠাৎ এক সময় আপনা-আপনি চলতে শুরু করে। আমি হাসিমুখে বাড়ি ফিরি। জানি, গুলতেকিনের রাগ পড়ে গেছে। ঘরে ফেরামাত্রই সে বলবে–চা খাবে? চা বানিয়ে এনে দেব?

No comments