মেক্সিকোর রূপকথা: ভালুক রাজকুমার ও নিনফা

মেক্সিকোর রূপকথা: ভালুক রাজকুমার ও নিনফা

সে অ-নে-ক দিন আগের কথা। এক ছিল কাঠুরে। সে ছিল খুব গরীব। বন থেক কাঠ কেটে বাজারে বিক্রি করে সে তার দিন গুজরান করত। তার ছিল তিনটি মেয়ে। তার মধ্যে ছোটটি ছিল সব থেকে সুন্দরী।

একদিন কাঠুরে বনের মধ্যে এক বিশাল গাছ কাটছে। এমন সময়ে , হঠাৎ কোথা থেক এক বিশাল, ভয়ানক ভালুক তেড়ে এসে তার হাত মুচড়ে কুঠারটা কেড়ে নিল “এটা আমার জঙ্গল। এখানে তোমাকে কাঠ কাটার অনুমতি কে দিল?” হুঙ্কার দিয়ে বলল ভালুক। “তুমি আমার কাঠ চুরি করেছ! এবার তোমাকে নিজের প্রাণ দিয়ে এর দাম দিতে হবে”।

“ভালুক মশাই, আমাকে ক্ষমা করুন”, কেঁদে বলল কাঠুরে বেচারা, “আমি তো শুধু একটু কাঠ কাঠছিলাম- এগুলিকে বেচে আমার তিনটে ছোট ছোট মেয়েকে খাইয়ে পরিয়ে রাখি। আপনি যদি আমাকে মেরে ফেলেন, তাহলে তো ওরা না খেতে পেয়ে মারা যাবে”।

ভালুক খানিক ভাবল। তারপরে বলল- “তোমার বাঁচার একটাই মাত্র উপায় আছে। তোমার যে কোন একটি মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দাও”। কাঠুরে তো হতবাক! কি বলবে বা কি করবে ভেবেই পেল না। তারপরে যখন ভেবে দেখল যে সে মরে গেলে তার মেয়েগুলি আশ্রয়হীন হয়ে পড়বে, তখন সে ভালুকের প্রস্তাব মেনে নিল।

দিনের শেষে কাঠুরে বাড়ি ফিরে এল। খেতে বসে তার তিন মেয়েকে বললে সব কথা।
কাঠুরের বড় মেয়ে বলল- ” বাবা, ভালুককে বিয়ে করার থেকে মরে যাওয়া ভাল”।
মেজ মেয়ে বলল- ” বাবা, আমারও একই কথা”।

বড় দুই মেয়ের কথা শুনে কাঠুরে মুষড়ে পড়ল। তখন তার ছোট মেয়ে নিন্‌ফা বলল- “বাবা, আমি ভালুককে বিয়ে করব”।

পরের দিন নিন্‌ফা আর তার বাবা জঙ্গলে গেল। সেখানে ভালুক তাদের জন্য অপেক্ষা করেছিল। সুন্দরী নিন্‌ফাকে দেখে ভালুকের বেশ পছন্দ হল।

নিন্‌ফা ভালুককে শর্ত দিল। সে বলল- “আমার মা আমাকে বলেছিলেন সব সময়ে ঈশ্বরের নির্দেশ মেনে চলতে। তাই আমি যদি আপনাকে বিয়ে করি, তাহলে পাদ্‌রির সামনে বিয়ে করব”।

ভালুক নিন্‌ফার কথায় রাজি হল। সে জানাল, পাদ্রীকে তাহলে জঙ্গলে আসতে হবে। কাঠুরে পড়িমড়ি করে ছুটল পাদ্রীর খোঁজে। অনেক খুঁজে একজন পাদ্রীকে নিয়েও এল। তিনি মন্ত্র পড়ে ভালুক আর নিন্‌ফার বিয়ে দিলেন।

বিয়ের পরে ভালুক নিন্‌ফাকে নিয়ে জঙ্গলের গভীরে নিজের গুহার দিকে রওনা দিল। কাঠুরে মন খারাপ করে পাদ্রীর সাথে ঘরের পথ ধরল।

যখন সন্ধ্যা নেমে এল, তখন গুহার ভেতরে অন্ধকার ঘনিয়ে এল। সেই অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে জোরালো গলায় ভালুক এক মন্ত্র আওড়ালোঃ
বিরাট ভালুক, লোমশ ভালুক, ভালুক ভয়ঙ্কর-
বদলে হও রাজপুত্তুর- সাহসী, সুন্দর!

মন্ত্র পড়ার সাথে সাথে ভালুক বদলে হয়ে গেল এক সুন্দর রাজপুত্র। সে নিন্‌ফাকে বলল- “আমি এক অভিশপ্ত রাজকুমার; এক ডাইনির অভিশাপে আমি দিনে ভালুক হয়ে যাই, আর রাতে আবার মানুষ হয়ে যাই। তুমি এখানে নিজের মনের আনন্দে থাক, যা ইচ্ছা তাই কর। একটাই শর্ত- তুমি কাউকে বলতে পারবে না যে আমি একজন অভিশপ্ত রাজকুমার।”

পরের দিন রাজপুত্র ঘুম থেকে উঠে বলল-
রাজপুত্তুর- সাহসী, রাজপুত্তুর সুন্দর!
বদলে হও বিরাট ভালুক, লোমশ ,ভয়ঙ্কর !
মন্ত্র বলার মুহুর্তের মধ্যে রাজপুত্র বদলে আবার ভালুক হয়ে গেল।

বেশি কিছুদিন কেটে গেল। নিন্‌ফা ভালুকের সাথে আনন্দেই থাকে, কিন্তু তার বাড়ি যেতে ইচ্ছা করে, বাবা আর দিদিদের দেখতে ইচ্ছা করে। শেষে সে একদিন সাহস সঞ্চয় করে রাজপুত্রের কাছে অনুমতি চাইল- “এই জঙ্গলে তোমার সাথে ছাড়া তো আর কারোর সাথেই কথা বলতে পারি না। আমার খুব ইচ্ছা করছে বাবা আর দিদিদের সাথে দেখা করতে। বাড়ি তো এমন কিছু দূরে নয়। আমি তাড়াতাড়ি যাব আর অন্ধকার হওয়ার আগেই ফিরে আসব।”

রাজপুত্র নিন্‌ফাকে যেতে দিতে চাইছিল না। কিন্তু নিন্‌ফা যখন খুব মনখারাপ করে কাঁদতে শুরু করল, তখন সে রাজি হল। কিন্তু সে নিন্‌ফাকে বার বার করে বলে দিল যেন কে কিছুতেই তার গোপন কথা কাউকে না বলে।

পরের দিন নিন্‌ফা ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠল। সে রাজপুত্রের দেওয়া ভাল জামাকাপড় পরে সুন্দর করে সেজে নিল। বাড়ি গিয়ে বাবা আর দিদিদের সাথে দেখা হতেই তাদের তো আনন্দের আর শেষ নেই।

কিন্তু কিছুক্ষণ পরে তার ভাল জামা, আর সুন্দর গয়না দেখে তার দিদিদের খুব হিংসা হল। তারা তখন ছোট বোন কে দুঃখ দেওয়ার জন্য বলতে থাকল- “কি লজ্জা! তোর একটা ভালুকের সাথে বিয়ে হয়েছে।” আর ভালুকের সম্পর্কে আরো খারাপ খারাপ কথা বলতে থাকল।

দিদিদের মুখে ভালুকের সম্পর্কে মন্দ কথা অনেকবার শুনতে শুনতে নিন্‌ফার এক সময়ে খুব রাগ হল। রাগের মাথায় সে ভালুকের জীবনের গোপন অভিশাপের কথা দিদিদের কাছে বলে দিল। দিদিরা তো সেই কথা শুনে অবাক!

নিন্‌ফার বড় দিদি তখন এক বুদ্ধি দিল –” তুমি এক কাজ কর। আজ তারে ভালুককে অনেক ভাল ভাল খেতে দাও। প্রচুর খেয়ে ভালুক যখন গভীরভাবে ঘুমাবে, তখন ওর হাত আর মুখ বেঁধে দাও। সকালে ঘুম ভাঙলে ভালুক আর চেহারা বদলানোর মন্ত্র বলতে পারবে না। তাহলেই ওই মন্ত্রের জাদু নষ্ট হয়ে যাবে। তখন তোমার বর আর কোনদিনই ভালুক হবে না নিন্‌ফা সন্ধ্যেবেলা ভালুকের গুহায় ফিরে এসে দিদির কথামত ভালুককে ভালমন্দ খেতে দিল। পরের দিন সকাল বেলা ঘুম ভেঙে উঠে ভালুক তো অবাক হয়ে গেল তার নিজের হাত-মুখ বাঁধা দেখে।

তার ইশারায় নিন্‌ফা তার মুখের এবং হাতের বাঁধন খুলে দিল। তখন রাজপুত্র তাকে করুণ স্বরে বলল- “তুমি তোমার শপথ ভেঙে ফেলেছ নিন্‌ফা; এখন তোমাকে এর ফল ভোগ করতেই হবে; এই অভিশাপ থেকে আমি মুক্ত হতে পারতাম যদি তোমার সাথে এক বছর এক দিন থাকতে পারতাম। কিন্তু তুমি তো সেটা হতে দিলে না। আমি এখন চলে যাচ্ছি। তোমাকে এবার আমাকে খুঁজে নিতে হবে। আর তার জন্য তোমাকে আগে খুঁজে বার করতে হবে ‘বিশ্বাসের প্রাসাদ’।”

এই বলেই রাজপুত্র অদৃশ্য হয়ে গেল। নিন্‌ফা একা একা বসে অনেক্ষণ কাঁদল। তারপরে সে ঠিক করল সে তার স্বামীকে খুঁজে আনতে বিশ্বাসের প্রাসাদে যাবে।

নিজের সামান্য কিছু জিনিষ একটা পুঁটুলিতে বেঁধে নিনফা বিশ্বাসের প্রাসাদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। মাঠ-ঘাট-বন-জঙ্গল পেরিয়ে অনেক , অনেক দূর হেঁটে চলল সে।

এক সময়ে নিন্‌ফা গিয়ে পৌঁছাল এক গভীর জঙ্গলের মধ্যে। সেখানে তার দেখা হল এক বুড়ো জাদুকরের সাথে। বুড়ো তাকে জিজ্ঞাসা করল –” কন্যে, তুমি এই গভীর জঙ্গলে কি করছ?”
-“আমি বিশ্বাসের প্রাসাদ খুঁজছি। আপনি জানেন, সেটা কোন দিকে?”
“আমি জানি না বিশ্বাসের প্রাসাদ কোথায় রয়েছে। তবে কিনা চাঁদ ঠাকরুণ বলতে পারেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করতে পার। তবে তিনি কিন্তু বড্ড রাগী, তাই খুব সাবধান। আর এই তিনটে বাদাম সাথে রাখ। যদি কোন বিপদে পড় তাহলে একটা করে বাদাম ভেঙে ফেল।তোমার উপকার হবে।”

বুড়োর সাথে কথা বলার পর নিন্‌ফা আবার চলতে শুরু করল। পথ চলে চলে ক্লান্ত মেয়েটা শেষে অবধি গভীর রাতে চাঁদ ঠাকরুণের বাড়ির সামনে পৌঁছাল। সে দরজায় ঠুকঠুক করে কড়া নাড়ল। এক বুড়ি এসে দরজা খুলে দিল। সে ছিল চাঁদ ঠাকরুণের রাঁধুনী।
“আহারে দুঃখিনী বাছা! তুমি এখানে কি করছ?” জিজ্ঞেস করল বুড়ি। ” তোমাকে দেখতে পেলে তো রাগী চাঁদ ঠাকরুণ তোমার ঘাড় মটাকাবে!” নিন্‌ফা তাকে চোখের জল ফেলতে ফেলতে নিজের দুঃখের কথা সব খুলে বলল।

বুড়ি নিন্‌ফাকে বলল- “তুমি চুল্লির পেছনে গিয়ে লুকাও। চাঁদ ঠাকরুণ এলে আমি জিজ্ঞাসা করে দেখব উনি বিশ্বাসের প্রাসাদ সম্পর্কে কিছু জানেন কিনা।

উষাকালে কাজকম্মো সেরে চাঁদ ঠাকরুণ বাড়ি ফিরলেন। তাঁর মেজাজ তখন খুব গরম; আঙুলে বুনোফলের কাঁটা ফুটে গিয়েছে যে! রান্নাঘরে ঢুকেই চাঁদ ঠাকরুণ নাক-মুখ কুঁচকে বললেন- মানুষের গন্ধ যেন পাচ্ছি মনে হচ্ছে! এক্ষুনি মানুষটাকে ধরে এনে আমাকে দিবি, নাকি তোকেই ধরে খাব?”

সে কথা শুনে রাধুনী বুড়ি মুখ বেঁকিয়ে বলল- “আ মোলো যা! তোমার মাথা খারাপ হয়েছে ঠাকরুণ” চুল্লীতে মুরগি সেঁকতে দিয়েছি, আর তোমার মনে হচ্ছে মানুষের মাংস?? বসে তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমাতে যাও দিকি। তুমি কাজ করে ক্লান্ত, তোমার মাথার ঠিক নেই।”

চাঁদ ঠাকরুণ তো গুছিয়ে খেতে বসলেন। ওদিকে রাঁধুনী বুড়ি বকবক শুরু করলে – “আগের দিন প্যাঁচা এই পথ দিয়ে যাচ্ছিল, তা আমি ওর সাথে একটু গল্পগুজব করলাম আর কি…তা প্যাঁচা বলছিল সে নাকি কোন এক বিশ্বাসের প্রাসাদ এর কথা শুনেছে। তা আমি তাকে বললুম- আমাদের চাঁদ ঠাকরুণ কত কিছু জানেন, তিনি নিশ্চয় ওই প্রাসাদের কথাও জানেন।”

খেয়ে দেয়ে চাঁদ ঠাকরুণের মেজাজ একটু ঠাণ্ডা হয়েছে। তিনি বুড়িকে বললেন- “সত্যি বলতে কি, এটা আমি জানিনা । তবে কিনা সুয্যি মশাই জানতে পারেন।”

এই বলে চাঁদ ঠাকরুণ তো ঘুমাতে গেলেন। রাঁধুনী বুড়ি তাড়াতাড়ি দরজা খুলে নিন্‌ফাকে বাড়ি থেকে বার করে দিয়ে বলল- তাড়াতাড়ি হাঁটা লাগাও। চাঁদবুড়ি জেগে গেলেই মুশকিল! ওই সামনের পথ দিয়ে হাঁটো। সু্য্যি মশাই-এর বাড়ি পেয়ে যাবে।

নিনফা আবার হাঁটা শুরু করল, আর অনেক পথ হেঁটে শেষে সূয্যি মশাই- এর বাড়ির পৌঁছাল। তার কড়া নাড়া শুনে দরজা খুলে দিল এক ছোট্টখাট্টো বুড়ি।

“হা ভগবান, সুন্দরী কন্যে!” সে অবাক হয়ে বলল- “তুমি এখানে কি করছ? তুমি কি জাননা সূয্যিমশাই তোমাকে এখানে দেখলে রেগে গিয়ে তোমাকে ঝলসে দিতে পারেন?”

বেচারি নিন্‌ফা কেঁদে কেঁদে বুড়িকে তার দুঃখের কথা সব জানাল। তার করুণ কাহিনী শুনে তো বুড়িও দুঃখিত হয়ে পড়ল। তাদের কথার মাঝেই ঘর ভরে গেল তীব্র আলোয়, আর সূয্যিমশাই সারাদিনের কাজ সেরে বাড়ি ফিরলেন। নিন্‌ফা বুঝল এইবার তাকে মরতে হবেই। সে ভয়ে চোখ বুজে ফেলল।

“আরে, আরে কত্তামশাই, করেন কি? থামুন থামুন! “চেঁচিয়ে উঠল বুড়ি ।” এই দুঃখিনী মেয়েটি বিশ্বাসের প্রাসাদ খুঁজছে…”
“ওহঃ তুমিই তাহলে বিশ্বাসের প্রাসাদ খুঁজতে এসেছ?” সূয্যিমশাই অবাক হয়ে বললেন
চোখের জল ফেলতে ফেলতে নিন্‌ফা তার সাথে ঘটে যাওয়া সব দুর্ঘটনার কথা জানাল।
“হুম,আমি জানি সেই বিশ্বাসের প্রাসাদ ঠিক কোথায় আছেল কিন্তু দেখ, সন্ধ্যা হয়ে গেল, এখন তো আমার বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু হ্যাঁ, একটা উপায় আছে ! আমার খুব ভাল বন্ধু হলেন বাতাস বাবুমশাই। তিনি তোমাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারেন। তুমি এক কাজ কর- এই পথ ধরে হেঁটে যাও, তাহলেই পৌঁছে যাবে বাতাস বাবুমশাই-এর বাড়ি; ওনাকে গিয়ে বল আমি তোমাকে পাঠিয়েছি”।

আবার হেঁটে চলল নিন্‌ফা; আবারো অনেক পথ পেরিয়ে সে পৌঁছাল বাতাস বাবুমশাই-এর দরজায়; ঠুকঠুক করে দরজায় টোকা দিল সে। ভেতর থেকে ভেসে এক শনশন করে উত্তর –” কে এসেছ বাইরে, ভেতরে চলে এস”
নিন্‌ফা ভেতরে ঢুকে বাতাস বাবুমশাইকে বলল তাকে পাঠিয়েছেন সূয্যিমশাই, একটা অনুরোধ নিয়ে।
“রাখব তোমার অনুরোধ” বললেন বাতাস বাবুমশাই, “সে যা-ই হোক না কেন”
নিন্‌ফা তখন বাতাস বাবুমশাইকে তার সব দুঃখের কথা প্রথম থেকে খুলে বলল।
“কোন চিন্তা কর না, আমি নিজে তোমাকে সেখানে নিয়ে যাব,” বললেন বাতাস বাবুমশাই।

বাতাস বাবুমশাই-এর পিঠে চেপে বসল নিন্‌ফা, আর এক লহমায় পৌঁছে গেল এক বিরাট প্রাসাদের সামনে।
“এই হল বিশ্বাসের প্রাসাদ,” বললেন বাতাস বাবুমশাই, “দেখেশুনে মনে হচ্ছে ভেতরে কোন বড় উৎসব হচ্ছে!”
পুরো প্রাসাদটা দারুণ সুন্দর করে আলোয় সাজানো ছিল; ভেতর থেকে ভেসে আসছিল মিষ্টি বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ।
“আমাকে এবার যেতে হবে,” বললেন বাতাস বাবুমশাই, ” ভয় পেওনা, তুমি তোমার কাজে ঠিক সফল হবে” নিন্‌ফা প্রাসাদের দরজার কড়া নাড়ল, আর এক কর্মচারী বেরিয়ে এল।
” আমি আপনাকে কি সাহায্য করতে পারি?” জিজ্ঞাসা করল কর্মচারী।
“আমি রাজপুত্রের সাথে দেখা করতে চাই,” জানাল নিন্‌ফা।
“মহাশয়া,” কর্মচারীটি বলল, “আপনি তো তাঁর সাথে এখন দেখা করতে পারবেন না। তাঁর আজ বিয়ে হচ্ছে কিনা, আর তিনি এখন রাজকন্যার সাথে বাজনার তালে তালে নৃত্য করছেন।”
একথা শুনে নিন্‌ফা বলল, “তাহলে আমাকে অন্তত এই আনন্দ অনুষ্ঠান দেখার একটা সুযোগ করে দিন দয়া করে। আমি এইরকম বড় অনুষ্ঠান আগে কোনদিন দেখিনি”।

নিন্‌ফার আবদার শুনে কর্মচারী অনেক ভেবে বলল- “ঠিক আছে, আমি আপনাকে ভেতরে ঢুকতে দিতে পারি, কিন্তু খেয়াল রাখবেন, বিয়ের কনে রাজকন্যা যেন আপনাকে দেখে না ফেলেন; দেখেল কিন্তু খুব রেগে যাবেন, আপনি নিমন্ত্রিত নন কিনা…”

নিন্‌ফা ভেতরে ঢুকে দেখে তার স্বামী সেই রাজপুত্র, টেবিলে বসে অনেক অতিথিদের সাথে খাওয়াদাওয়া করছে।
সে নিজে দেওয়ালের কোণ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রাজপুত্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করতে থাকল। কিন্তু রাজপুত্র তো অন্যদের সাথে গল্প করে যাচ্ছে। সে বেচারি নিন্‌ফাকে দেখতেই পেল না।

এদিকে এক সময়ে নিন্‌ফাকে দেখে ফেলল সেই বিয়ের কনে। সে আসলে ছিল এক দুষ্টু ডাইনি, যে নিজের জাদুর জালে জড়িয়ে রাজপুত্রকে বন্দী করে বিয়ে করছিল।

এই সময়ে রাজপুত্রও নিন্‌ফাকে দেখতে পেল। সে সঙ্গে সঙ্গে তার স্ত্রীকে চিনতে পারল। সে কর্মচারীদের হাঁক দিয়ে ডেকে বলল নিন্‌ফাকে তার কাছে নিয়ে আসতে। কিন্তু হই-হট্টগোলের মধ্যে কেউ তার কথা শুনতেই পেল না।

ওদিকে দুষ্টু রাজকন্যা তার রক্ষীদের ডেকে বলল – “শিগ্‌গির তোমরা ওই ভিখারিনী মেয়েটাকে ধরে বার করে দাও” রক্ষীরা নিন্‌ফাকে সেই ধরতে গেল, সে তক্ষুণি সেই বুড়ো যাদুকরের দেওয়া একটা জাদু বাদাম ভেঙে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে সে এক ছোট্ট ইঁদুর হয়ে এদিক ওদিক ছুটতে লাগল। সেই দেখে ডাইনি এক বিরাট কালো বিড়াল হয়ে ইঁদুরকে তাড়া করল।

ইঁদুর তখন এক লাফে টেবিলে উঠে রাজপুত্রের থালায় গিয়ে পড়ল। তখন ইঁদুর রূপী নিন্‌ফা আরেকটা বাদাম ভেঙে ফেলল। সে সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেল ভাতের একটা কণা। রাজপুত্রের থালায় ছড়ানো অনেক ভাতের মধ্যে সে মিশে গেল। বিড়াল বেশী ডাইনী তখুনি টেবিলে উঠে পড়ে নিজেকে মুরগিতে বদলে নিল, আর কপকপ করে ভাত খেতে লাগল।

নিন্‌ফা তখন বুড়ো জাদুকরের দেওয়া তৃতীয় জাদু বাদামটি ভেঙে ফেলল, আর নিজেকে কয়োটির রূপ দিল। সেই কয়োটি তখন মুরগিকে ধরে খেয়ে ফেলল।

ডাইনী রাজকন্যাকে শায়েস্তা করার পরে নিন্‌ফা আবার মানুষের চেহারায় ফিরে এল। এর পরে সে রাজপুত্রের সাথে সুখে ঘরকন্না করতে থাকল।

অনুবাদ : মহাশ্বেতা রায়

No comments