ভ্যা-জাল! – শিবরাম চক্রবর্তী

ভ্যা-জাল! – শিবরাম চক্রবর্তী

যেমন গাধার মতো চলেছে ট্রেনটা, তেমনি যাত্রীর গাদাগাদি। তিলধারণের ঠাঁই নেই কোথাও। গাড়ির দোরগোড়াতেই দাঁড়িয়ে ছিল জনান্তিক, ভিড় ঠেলে এগুতে পারেনি। আপিস টাইমের কলকাতা লোকাল, লোকাধিক্য হবেই। জানা কথা।

জনান্তিক রায়। নামটাই খালি নয়, জনান্তিকের বেশভূষা, চালচলন সবই আধুনিক। আপাদমস্তক ফিটফাট। কেতাদুরস্ত পুরোপুরি। আর তার কাজ? কাজটা তো একালের বটেই, বলতে গেলে রীতিমতোই একালীন এবং এককালীন। সব দিক দিয়ে একেবারে একেলে সে।

নামের মতো, কাজটাও তার জনান্তিক। বদনামের কিছু নেই—ধরা না পড়লে। পকেট মারার পেশা তার। এক-একজনের অন্তিম দশা তার হাতে।

আর এই ভিড়ের মধ্যেই তার সুবিধে বেশি। জনসমুদ্রের মধ্যে যে একটা অদ্ভুত নির্জনতা থাকে তার ফাঁকেই তার কাজটা ভালো চলে। সর্বজনের অগোচরে, জনান্তিকেই সেসারতে পারে। কাঁচির কাজ হলেও নেহাত কাঁচা কাজ হয় না। পাকাপাকি উপায় হয়। মোটামুটি মন্দ নয়। গভীর জলের মাছ আমাদের জনান্তিক।

জনান্তিকের সামনেই দাঁড়িয়েছিল এক ছোকরা। বছর সতেরো-আঠারোর, বেশ স্মার্ট ছেলেটি। চকচকে চামড়ার হাতব্যাগটা বুকের কাছে আঁকড়ে ব্যগ্রভাবে সেদাঁড়িয়েছিল। পাছে কেউ তার ব্যাগটা ছিনিয়ে নেয় সেই ভয়ই যেন তার চোখেমুখে ফুটে উঠেছিল মনে হয়।

নজর এড়ায়নি জনান্তিকের। সবজান্তা চোখ তার। যেমন পাকা তেমনি চোখা। হাতসাফাইয়ের এই কারবার তো তার কম দিনের নয়। কম খাটনি আর বিনা মূলধনের এই ব্যাবসা। বেশ উপায়, বেশি রোজগার। রোজ ঘাড় ভাঙা অপরের। আজ এই কচি ঘাড়টার ওপরেই কোপ বসাতে হবে তাকে।

ব্যাগটার মধ্যে মোটামুটি মন্দ নেই, ছেলেটার হাবভাবেই সেটের পেয়েছিল। একশো টাকার নোট দশকের দশ কেতায়। হাজার দশেক টাকা তো বটেই। ব্যাগটাকে অটুট রেখে, ছেলেটার হাতে রেখেই, তাকে একটুও জানতে না দিয়ে ভেতরের মাল যদি সেবাগাতে পারে তা হলে কিছুদিনের জন্যে নিশ্চিন্তি। কিছুকাল তার দিব্যি আরামেই কাটবে এখন। আমোদে আর প্রমোদে।

টাকাটা সেকলকাতার কোনো ব্যাঙ্কে জমা দিতেই নিয়ে যাচ্ছে, মনে হয়। মফসসলের কোনো জমিদারের ছেলেই কি? কিংবা বড়ো কারবারি কারও আপিসের বেয়ারাটেয়ারাই হবে বুঝি? যে-ই হোক গে, আর যতই তুখোড় হোক, জনান্তিকের ধনান্তিক কবল থেকে ত্রাণ নেই আজ ছোকরার।

ছেলেটি সভয় নেত্রে তাকাচ্ছিল—তার দিকে নয়, আর দিকে! তাদের কাছাকাছিই খাড়া ছিল মুশকো চেহারার একটা লোক—লোকটা যেন ছোকরার ঘাড়ে পড়বার তালে রয়েছে মনে হয়। ওপর চড়াও হয়ে চেপে আসছিল ছেলেটার দিকে সে।

জনান্তিক দুজনের মাঝখানে হাইফেনের মতো হয়ে দাঁড়াল। অযাচিত চাপ থেকে বঁাচাল ছেলেটাকে।

ছেলেটা সকৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। মিষ্টি করে হাসল।

‘ইস! ভারি ভিড় আজ গাড়িটায়।’

‘হ্যাঁ, আরেকটু হলেই তুমি চাপা পড়ছিলে।’ জনান্তিক দুর্জনান্তিকে কটাক্ষ করে। দুশমন-লোকটার চেহারাই শুধু শমনসদৃশ না, ওজনেও দুশো মনের ধাক্কা!

‘দামি কিছু আছে বুঝি তোমার ব্যাগে?’ জনান্তিক বলে, কথাচ্ছলেই—‘যেমন করে আঁকড়ে রয়েচ?’

‘আপিসের টাকা। আমাদের কারখানার।’ ছেলেটি জানায়—‘কলকাতার ব্যাঙ্কে জমা দিতে যাচ্ছি।’

কারখানার কান্ড তো অদ্ভুত! চিন্তা করে জনান্তিক। এইটুকু ছেলের উপর বিশ্বাস করে এতগুলো টাকা ছেড়ে দিয়েছে? আশ্চর্য! খুব বাড়িয়ে ধরলেও, বছর কুড়ির বেশি বয়স হবে না ছেলেটির। এমন আনাড়ি? কাছ থেকে টাকাটা কুড়িয়েবাড়িয়ে নেয়া কতই সোজা!

আর একটু ধার ঘেষে এলেই তো হয়! ওকে জানতে না দিয়েই ধারালো ব্লেড চালিয়ে দেয়া যায় ব্যাগের তলায়। ওর অজান্তেই নোটগুলো বেরিয়ে আসে—জনান্তিকের মুঠোয়। একজনও টের পায় না। ছেলেটা তো নয়ই—তার হাতের ব্যাগ হস্তগতই থাকে—যেমনকার তেমনি। দ্বিধান্বিত ব্যাগ নিয়ে বিনা দ্বিধায় সেচলে যায়, কলকাতায়—তার গন্তব্য স্থানে। টের পায় সেই ব্যাঙ্কে গিয়ে একেবারে—

ব্যাঙ্কের সোনালি রেলিংওয়ালা কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাগের মুখ ফাঁক করে তলার ফাঁকি তার নজরে পড়ে যখন—।

‘তুমি এক কাজ করো ভাই! আমার ধার ঘেঁষে দাঁড়াও।’ ছেলেটিকে সেবাতলায়—‘একেবারে আমার গায়ে এসে লেপটে যাও—বুঝেচ? সেইটেই নিরাপদ। আমাদের দুজনের ডবল চাপের ভেতর থেকে কেউ আর খপ করে ওটা ছিনিয়ে নিতে পারবে না তা হলে।’

বলতেই ছেলেটি তার গায়ে এসে লাগে, ব্যাগসমেত। একটু বুঝি তার ব্যগ্রতাই দেখা যায় সাঁটবার। খামের মতন এঁটে যায়—লেফাফাদুরস্ত একেবারে। অবশ্যি, সেই ভিড়ের ভেতর কারও গায়ে ঘেঁষা এমন কিছু কঠিন কান্ড নয়, এক জায়গায় দাঁড়িয়েই একাধিক লোকের গায় পড়া যায়।

ছেলেটি তার গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়াতেই জনান্তিক সক্রিয় হয়ে ওঠে। তার ব্লেডের কাজ চলে—ব্যাগের তলে তলে—বেমালুম। তার যোগাযোগ-নৈপুণ্যে অল্পক্ষণেই ভেতরের মাল বেরিয়ে পড়ে তার পকেটের মধ্যে স্থান লাভ করে—বামালরূপে।

ছেলেটি চাপা গলায় বলতে থাকে—‘এই প্রথম চাকরিটা পেয়েছি দাদা! কারখানার বেয়ারার কাজ। বড়োসাহেব ভালোবাসেন খুব। বিশ্বাস করেন আমায়। ব্যাঙ্কেট্যাঙ্কে যেতে হলে—টাকাকড়ি দিতে-আনতে আমাকেই পাঠান। কিন্তু এই ব্যাগ হাতে নিয়ে যেতে-আসতে এত ভয় করে আমার—এত টাকা নিয়ে! কী বলব মশাই! সব জায়গাতেই যা পকেটমার আজকাল!’

‘যা বলেছ ভাই! কখন যে ফাঁক হয়ে যায় টেরও পাওয়া যায় না। যাকে বলে—চিচিং ফাঁক!’

হেসে হেসেই বলে সে। বেশ অম্লানবদনে। গায়-পড়া কচি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে একটুও কি তার মায়া হয় না? কীসের মায়া? মায়াদয়া সব কচু। বিবেকের কোনো দংশন—কিছু কচকচি তার মনে নেই, কোনো কচি-কাঁচার প্রতি দরদ নেই হৃদয়ে। ব্যাঙ্কে গিয়ে ছেলেটা যখন দেখবে তার তবিল উধাও, স্বচক্ষে দৃশ্যটা দেখতে সেচেষ্টা করে। কেঁদে কয়ে উঠবে—চাকরি তো যাবেই তার, নির্ঘাত, থানাপুলিশে না টানাটানি করে। কিন্তু তার মনে একটুও দুঃখ জাগে না। ব্যথা লাগে না প্রাণে। কত গরিব কেরানির সারা মাসের মাইনে সেমিনিটের মধ্যে সরিয়েছে, কত আপিসের বেয়ারার ভবিষ্যৎ পিষে ফেলেছে তার হাতের মুঠোয়। এক মুহূর্তেই। এই প্রথম নয়।

বালি আসতেই গাড়ি খালি হল খানিক। জনান্তিক বললে—‘এইবার আমার নামতে হবে ভাই। নামব আমি এখানেই। কলকাতা আর কতক্ষণ? এইটুকু পথ তুমি একলাই যেতে পারবে—নিরাপদেই, কেমন?’

‘হ্যাঁ।’ হাসিমুখে ঘাড় নাড়ল ছোকরা।

‘তা হলেও খুব হুঁশিয়ার থেকো, বুঝলে?’ হুঁশ দিতে সেকসুর করে না তা হলেও।

ছেলেটা ব্যগ্র নমস্কার জানায়—হাত তুলে—সহাস্যে। বেহুঁশ আর বলে কাকে!

স্টেশনের এলাকা পেরিয়ে জনান্তিক পকেটে হাত পোরে। নোটগুলোর গায় হাত ঠেকায়। এক গোছা নোট। খসখসে, মসৃণ! ফিতে বঁাধা, কেতাদুরস্ত। দশ হাজারের কম হবে না, তার আন্দাজ ভুল নয়। হাত দিয়েই আঁচ পায়। ব্যাস, এখন কিছু দিনের জন্যে নিশ্চিন্ত। চৌরঙ্গির সাহেবি হোটেলে গিয়ে ওঠো, স্ফূর্তি করে কাটাও। রঙিন হয়ে থাকো দিন-রাত।

কোনো তাড়া নেই, পরের ট্রেনে সুবিধেমতো গেলেই চলবে। চৌরঙ্গির স্বপ্নে মশগুল হয়ে সেহাওয়া লাগাচ্ছে গায়ে, এমন সময়ে পেছন থেকে কার যেন শক্ত হাত তার কাঁধে এসে লাগল। সবল মুষ্টিতে কে যেন এসে পাকড়াল তাকে।

পেছন ফিরে তাকাতেই—সেই লোকটাই না? দুশমন চেহারার সেই মুশকো লোকটা ট্রেনের।

অ্যাঁ? এ কেন? এখানে কেন? তার পেছনে কেন? জনান্তিক অবাকই হয় একটু। এর তো সেই ছোঁড়াটার পিছু পিছু লেগে থাকার কথা। কলকাতা যাবার কথা তার সাথে সাথে। তবে এ ব্যক্তি—এই অতিব্যক্তি—এখানে কেন?

মুশকোর পেছনে আরও দুজন ছিল। মুশকো বলল—‘আমরা পুলিশের লোক। সিআইডি-র। দাঁড়াও, সার্চ করব তোমায়।’

‘সার্চ? কীসের সার্চ?’ জনান্তিক আরও অবাক হবার চেষ্টা করে।

‘জাল নোট আছে তোমার কাছে। তোমার জিম্মায়। টের পেয়েছি আমরা।’ বলতে বলতে সিআইডি-টা সটান তার পকেটের মধ্যে হাত পুরে দেয়। নোটগুলো বের করে আনে একটানে।

‘জাল নোট?’ এবার জনান্তিকের বিস্ময়টা সত্যিই সত্যিকার—‘জাল নোট এগুলো? অ্যাঁ?’

‘ন্যাকা? জান না?’ ধমকে উঠল মুশকো লোকটা—‘ছেলেটা গা ঘেঁষে দাঁড়াল তোমার—তা কি দেখিনি? তুমি ব্যাগের তলায় ব্লেড চালিয়ে নোটগুলো বার করে নিলে তাও কি নজরে পড়েনি আমার? দুজনেই এক দলের লোক। এরকম যোগসাজসের কাজ ঢের ঢের আমরা দেখেছি।’

‘যোগসাজসের কাজ!’ জনান্তিক যেন জনান্তিকেই জানায়।

‘তুমি যখন ব্যাগ কাটছিলে তখন কি আমি দেখিনি? ছোঁড়াটা আড়চোখে সব দেখছিল আর হাসছিল মুখ টিপে টিপে—তা কি আমার চোখে পড়েনি ভেবেছ? তাইতেই তো ধরা পড়ে গেল। ছেলেটা তার ব্যাগের নোটগুলো তোমাকে পাচার করে দিয়ে খালি ব্যাগ নিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেল। আবার ন্যাকা সাজা হচ্ছে!’

ও, তাইতেই! তাইতেই না-বলতেই ছেলেটা এগিয়ে এসে গায়ে পড়েছে, দাঁড়িয়েছে গা ঘেঁষে। ব্যাগসমেত আগিয়েছে। তারপর ওকে বাগিয়ে—বোকা পেয়েই—নোটগুলোর হাত থেকে রেহাই পেয়েছে। যত ভাগাড়ের মাল ভাগিয়েছে গায়ে গা লাগিয়ে। তারপরে কাজ সেরে—জঞ্জাল সাফ করে হাসিমুখে বিদায় নিয়েছে বিনা বাগাড়ম্বরে। ইস কী ভয়ানক ছেলে রে বাবা! কী ভয়ানক!

‘কোথা থেকে যে এইসব আপদ জোটে!’ ভারি বিরক্ত বোধ করে জনান্তিক—‘এ কীরকম বদ ছেলে বাপু! এই কি আপিসের বেয়ারা? এরকম বেয়াড়াপনা আমি জন্মে দেখিনি। ছি:!’ এই বলে সেধিক্কার দেয়—সেই বেয়ারাকে, কি নিজেকেই—কে জানে!

সিআইডি-র লোকটি নোটগুলি গুনে দেখে—একে একে—দশখানা করে একশো টাকার নোট প্রত্যেক কেতায়—দশ কেতায় মোট দশ হাজার। জনান্তিকের আন্দাজ একটুও ভুল নয়! পাকা লোকের হিসেব।

‘দূর! দূর! কে যে এইসব ভেজাল জোটায়!’ ডুকরে ওঠে জনান্তিক।

‘ধুত্তোর!’ বলে সেহাত ওঠায়—

হাতকড়া পরার জন্যই।

No comments