উত্তমপুরুষ – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

উত্তমপুরুষ – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

সামনে আরও পুরো দু-ক্রোশ রাস্তা।

মানিক সর্দারের পা আর চলতে চাইছিল না। ক্রমাগত মনে হচ্ছিল পেছন থেকে কে একটা শক্ত চাপ দিয়ে তার মেরুদন্ডটাকে বাঁকিয়ে দিতে চাইছে ধনুকের মতো হাঁটুর তলা থেকে পা দুটো আলগা হয়ে খসে পড়তে চাইছে। তৃষ্ণায় একরাশ কাঁকর খরখর করছে গলার ভেতরে।

পেছনে আসছে পনেরো বছরের ছেলে বলাই। তার দিক থেকে খুশির অন্ত নেই। জীবনে এই প্রথম সে বাপের সঙ্গে কুসুমডাঙার হাটে এসেছে। এই ছ-মাইল পথে অনেকখানি আকাশ, শাল-পলাশের বন, সীমান্তরেখায় একটা বিশাল বন্য মহিষের মত শুশুনিয়া পাহাড়, সব তার কাছে নতুন—আর এক পৃথিবীর সংবাদ।

পথে আসতে আসতে একটা গাছ থেকে কয়েক ছড়া পাকা তেঁতুল সংগ্রহ করেছিল বলাই। হাটের সওদা থেকে খানিকটা নুন বের করে নিয়ে তাই দিয়ে মনের খুশিতে সে তেঁতুল খাচ্ছিল আর বিচিগুলো দিয়ে কখনো একটা গিরগিটি, কখনো-বা একটা শালিক পাখিকে তাক করবার চেষ্টা করছিল।

হাতের বল্লমটার ওপর ভর দিয়ে মানিক সর্দার দাঁড়িয়ে পড়ল।

কী হল বাবা?

একটু জল খাব। তেষ্টায় বুকটা যেন পাথর হয়ে গেছে।

নদী পাশেই। কচ্ছপের পিঠের মতো বড়ো বড়ো পাথর চারদিকে ছড়ানো আর মোটা মোটা দানার একরাশ বালি কোনো পদ্মগোখরোর খোলসের মতো আঁকাবাঁকা ভঙ্গিতে অন্তহীন মাঠের মধ্যে এলিয়ে রয়েছে। ওই বালির রেখাটাই নদী। কিন্তু এক বিন্দু জল কোথাও নেই, শুকিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

বিকেলের সোনাঝুরি আলোয় নদীটার দিকে একবার তাকিয়ে দেখল মানিক সর্দার। মাঝখানটায় খানিক জায়গা যেন ভিজে ভিজে মনে হচ্ছে, খুঁড়লে হয়তো জল পাওয়া যাবে।

বলাই এদিক-ওদিক তাকাল।

জল কই বাবা?

পাওয়া যাবে বোধ হয় ওখানে। আয় খুঁজে দেখি।

দুজনে নদীর ভেতরে নেমে এল। হ্যাঁ, জল এখনও আছে। পায়ের চাপে চাপে ভিজে বালি থেকে জল বেরিয়ে আসতে লাগল। বল্লমের দরকার হল না, হাত দিয়ে খানিক খুঁড়তেই বালি-মেশানো জলে ভরে উঠল গর্তটা।

বালি খানিক থিতিয়ে এলে আঁজলা আঁজলা করে খানিকটা জল খেল মানিক। বাপের দেখাদেখি বলাইও খেল।

বড়ো দেখে একটা পাথরের ওপর বসে পড়ে মানিক বললে, পা আর চলছে না, একটুখানি জিরিয়ে যাই।

বিকেলের সোনাঝুরি রোদে ঝিকমিক ঝিলমিল করছিল চারদিক। হাওয়াটা এখনও সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা হয়নি—নিভে আসা হাপরের বাতাসের মতো গরম। ওপরে সারবাঁধা কয়েকটা পলাশ গাছ, কালো কালো কুঁড়ি ধরেছে তাতে; দিন কয়েক বাদেই ফুলের আগুন জ্বলবে। একটা পাপিয়া ডাকছে কোথাও। বসন্ত আসছে।

কিন্তু বসন্তের রং কোথাও নেই মানিক সর্দারের মনে। ওই বিশাল বন্য মহিষের মতো শুশুনিয়া পাহাড়ের কালো ছায়াটা ভাসছে চোখের সামনে। আধি চাষের ধান ফুরিয়ে গেছে, আজ কুসুমডাঙার হাটে একটা বলদ বেচে দিয়ে আসতে হল। বাকিটাও বেশিদিন থাকবে না, নতুন ফসল এখনও অনেক দূরে। তারপরে উপোস। তারও পরে…

মানিক সর্দার বসে রইল ভিজে বালির দিকে তাকিয়ে। খোঁড়া গর্তটা বুজে আসছে একটু একটু করে। আরও এক মাস কিংবা দু-মাস বড়োজোর, তারপরেই এ জল পালিয়ে যাবে পাতালে। কোদাল দিয়ে সাত হাত কোপালেও এক আঁজলা পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ, শুধু মুঠো মুঠো নুড়ি আর কাঁকর উঠে আসবে।

একটা বলদ গেল। পরেরটাও যাবে। তারপরে নুড়ি আর কাঁকড়।

এবারে আর আশা নেই। কিছুই করবার উপায় নেই। না, একটা উপায় এখনও আছে। গত বছরে খাদেম আলি মোল্লা যা করেছিল তাই। তারও হালের বলদ ছিল না কিন্তু বলদের দড়িটা ছিল। গোয়ালঘরের আড়ায় সেই দড়ি বেঁধে নিজের গলায় দিয়ে ঝুলে পড়েছিল।

পায়ের নীচের দিকটা খসে পড়ে যাচ্ছে হাঁটু থেকে, পেছন থেকে কে যেন সমানে চাপ দিচ্ছে কাঁধের ওপর; যেন যেমন করে হোক তার মেরুদন্ডটাকে মটকে ভেঙে ফেলবে।

তৃষ্ণায় আবার জ্বালা করে উঠছে গলার ভেতর। কিন্তু নতুন করে উঠে গিয়ে আবার খানিকটা জল খাওয়ার মতো শক্তি কিংবা উদ্যম কিছুই খুঁজে পেল না মানিক সর্দার।

ঘোলা ঘোলা চোখে চেয়ে দেখল, চঞ্চল বলাই একটু দূরেই একটা লাটাবনে গিয়ে লাটা কুড়োচ্ছে—বোধ হয় কুঁচেরও সন্ধান পেয়েছে ওখানে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, গত বছর এমনি কোনো একটা জায়গাতেই একটা শঙ্খচূড় সাপ দেখেছিল সে। বসন্তের হাওয়া দিয়েছে এখন, এই হাওয়াতেই সাপেরা শীতের ঘুম থেকে জেগে ওঠে, খিদেয় রুক্ষ হয়ে থাকে মেজাজ-অকারণে আক্রমণ করতে চায়। এক বার মনে হল বলাইকে সে ডাক দেয়, কিন্তু গলা থেকে স্বর বেরুতে চাইল না।

লড়তে পারত মানিক সর্দার, এ অবস্থাতে লড়তে পারত। চাষের সময় না আসা পর্যন্ত মজুর খাটতে গ্রামে গ্রামে ঘুরে, নাহয় আট মাইল দূরের স্টেশনে গিয়ে কুলিগিরি করেও কয়েকটা পেট চালিয়ে নিত। কিন্তু গত বছর সেই যে সান্নিপাতিক জ্বর গেল, তা থেকে কোনোমতে বেঁচে উঠলেও শরীরে আর কোনো বস্তু রেখে যায়নি। কীভাবে এ বছরে চাষ করেছে তা কেবল ভগবানই জানেন আর সে জানে।

তবু তখন কিছু চাল দিয়েছিল মহাজন, পেট তখন ভরা থাকত। কিন্তু এখন? আধপেটা— না খেয়ে?

শুধু যদি আর একটু দাঁড়াতে পারত বলাই। আরও একটু বড়ো হত। আর খানিকটা চওড়া-চিতেন হত বুক, জোর থাকত হাতে। যদি আর একটু বুঝতে পারত যে, আগ বাড়িয়ে দুনিয়ার টুটি চেপে ধরতে না পারলে দুনিয়াই মানুষের গলা টিপে ধরে।

কিন্তু পনেরো বছর বয়সেও ছেলেটা একেবারে ছেলেমানুষ। মাইতিদের বাড়িতে কলের গান শুনেছে, সেই গান গুনগুন করে রাতদিন। একটা কাজ করতে বললে সাত বার ভুলে যায়, এখনও বনে-বাদাড়ে কুড়িয়ে বেড়ায় নীলকণ্ঠ পাখির পালক, এখনও কোঁচড় ভরে নিয়ে আসে লাটা আর কুঁচফল। বলাই এখনও লড়তে শিখল না।

পলাশ গাছের ওপর সোনাঝুরি রোদ লাল হয়ে এল। নদীর মাঝখানে গর্তটা একেবারে বুজে গেছে। একটুখানি বালিজল তিরতির করছে সেখানে। গরম হাওয়ায় কোত্থেকে একটা শুকনো পাতা উড়ে এসে মানিক সর্দারের গায়ে পড়ল, মনে হল কার একটা খরখরে কর্কশ হাতের ছোঁয়া এসে লেগেছে। চমকে উঠল মানিক সর্দার, বল্লমে ভর করে উঠে দাঁড়াল।

বলাই!

আসছি বাবা।

বলাই ফিরে এল। শুধু লাটা নয়, গিলেও পেয়েছে গোটা কয়েক।

চল বাপ, দু-কোশ রাস্তা আছে এখনও।

দু-ক্রোশ রাস্তা লাঠি নিয়ে তিন লাফে পেরিয়ে যেত একসময়। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে। গোটা শুশুনিয়া পাহাড়টাই যেন ডিঙিয়ে যেতে হবে তাকে। বুকে হাত চেপে কখন যে পথের মাঝখানে বসে পড়বে সেকথা সে নিজেই জানে না।

তার ওপর সামনে জঙ্গলটা আছে। জায়গা ভালো নয়। চোর-ডাকাতের ভয় মানিক সর্দারের নেই, তার কাছে তারা আসবে না। কিন্তু ওই জঙ্গলে প্রায়ই বুনো জানোয়ার বেরোয়। ভালুক আসে, লক্কড় ঘোরে, দু-একটা বাঘেরও খবর মেলে। লোকের মুখে শুনেছিল, কাছাকাছি কোথায় একটা চিতা নাকি মানুষখেকো হয়ে উঠেছে।

সেইজন্যেই বল্লমটা আনা। কিন্তু কতখানি কাজে লাগবে! পিঠের ওপরে সেই প্রকান্ড একটা নিষ্ঠুর চাপ, হাঁটু দুটো নড়বড় করছে ক্রমাগত। এই বল্লম নিয়ে কী করবে মানিক সর্দার? বাঘ যদি সত্যিই আসে, সে কি এ দিয়ে ঠেকাতে পারবে তাকে?

কোঁচরের ভেতরে লাটা আর গিলেগুলোকে ঝমঝম করতে করতে বলাই আসছিল। হঠাৎ তীক্ষ্ণ মিষ্টি গলায় কলের গান থেকে শেখা গুনগুনানিকে সে হাওয়ায় ছড়িয়ে দিলে।

বিরক্ত হয়ে একটা ধমক দিতে গিয়েও থমকে গেল মানিক সর্দার। বেশ তো গায় ছেলেটা —সুন্দর সুরেলা গলা। একেবারে নিখুঁতভাবে তুলেছে কলের গান থেকে। যদি পৃথিবীটা এমন কঠিন জায়গা না হত—যদি বাঁচবার জন্যে এমন করে ফোঁটায় ফোঁটায় বুকের রক্ত শুকিয়ে না যেত, তাহলে…

ও বন্ধু রে–
সোনার খাটে বসো তুমি রুপার
খাটে পাও—

সোনার খাট–রুপোর খাট। আর এক বার গানটাকে থামিয়ে দিতে চাইল মানিক সর্দার, কিন্তু পারল না। একটু একটু করে সন্ধে নেমে-আসা মাঠের ওপর দিয়ে বলাইয়ের গান দূরান্তে ছড়িয়ে যেতে লাগল, আর হাতের বল্লমটার ওপর ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে চলতে লাগল মানিক সর্দার।

এখনও দু-ক্রোশ পথ পড়ে আছে সামনে। শুশুনিয়া পাহাড় ডিঙোনোর চাইতেও দুর্গম।

পুরোনো পেতলের মতো জ্যোৎস্নার রং। দু-পাশের গাছের পাতার ছায়া তার ভেতরে কলঙ্কের দাগের মতো কাঁপছে। হাওয়ায় হাওয়ায় কিশলয়ের গন্ধ। ভারি সুন্দর লাগছে জঙ্গলটাকে।

কিন্তু জঙ্গলের এই রূপ, কিশলয়ের সেই গন্ধকে ছাপিয়ে আর একটা গন্ধে হঠাৎ চকিত হয়ে উঠল মানিক সর্দার। সে-গন্ধ তার অচেনা নয়। এমনি বনের পথ দিয়ে যেতে যেতে কখনো কখনো এইরকম গন্ধের উৎকট উচ্ছ্বাস ভেসে এসেছে, আর…

শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল মানিক সর্দার। এক হাতে তুলে ধরলে বল্লম, আর এক হাতে খপ করে চেপে ধরলে বলাইয়ের কাঁধটা।

কী হল বাবা?

চুপ! বাঘ!

বাঘ! এক বার শিউরে উঠেই পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল বলাই। শিরশিরে হাওয়াটাও যেন আতঙ্কে নিশ্ৰুপ হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। পুরোনো পেতলের মতো জ্যোৎস্নাটা ছায়ার কলঙ্ক মেখে কাঁপতে লাগল অল্প অল্প। মহুয়ার একটা ডাল এগিয়ে এসেছিল ওদের মাথার উপর, মনে হল মৃত্যুর কতকগুলো ধারালো নখ যেন ছোঁ মারবার জন্যে উদ্যত হয়ে রয়েছে।

কয়েক মুহূর্ত কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না কোথাও। থেকে থেকে ঝিঝি ডাকছিল এতক্ষণ, সেটাও থমকে গেছে আপাতত। শরীরের শিরাগুলোকে টানটান করে মানিক সর্দার

অপেক্ষা করতে লাগল।

বাবা চলো, আমরা দৌড়ে পালিয়ে যাই। শুকনো স্তিমিত গলা শোনা গেল বলাইয়ের।

পালাতে গেলেই পেছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়বে ঘাড়ের ওপর। তখন আর কিছু করা যাবে না।

আরও কিছুক্ষণ প্রতীক্ষায় কাটল। তারপর সতর্ক পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল ডান দিকের ঝোপের ভেতরে। বাঘও সুযোগের অপেক্ষা করছে। মানিকের হাতের বল্লমটা দেখেছে কি না কে জানে, কিন্তু হঠাৎ আক্রমণ করবার মতো সাহস পাচ্ছে না।

বলাইকে এক হাতে টেনে পিঠের দিকে সরিয়ে দিলে মানিক সর্দার। দুর্বল ক্লান্ত শরীরে কোথা থেকে একটা ভয়ংকর হিংস্র শক্তির জোয়ার এসেছে। বল্লম ধরা হাতের পেশি থরথর করে কাঁপছে, চোখ দুটো জ্বলে উঠছে দপ দপ করে। আবার বাতাস বইল, কিন্তু কিশলয়ের গন্ধ পাওয়া গেল না—ভেসে এল বাঘের গন্ধের বীভৎস ঝলক।

প্রায় পাঁচ-সাত মিনিট প্রতীক্ষার পরে ডান দিকের ঝোপের ওপর সতর্ক চোখ রেখে একটু একটু করে এগোতে লাগল মানিক। এক হাতে বলাইকে টানতে লাগল পেছন পেছন। বাঘ যদি লাফিয়ে পড়ে তাহলে সোজা তাকে পড়তে হবে এই বল্লমের ওপরে। যদি দুটো-একটা থাবার আঁচড় লাগে, তাহলে সেটা তার ওপর দিয়েই যাবে, বলাইকে ছুঁতেও পারবে না।

একটু একটু করে দুজনে এগোতে লাগল। মানিকের চোখ আর বল্লম স্থির হয়ে রইল জঙ্গলের দিকে। বাঘই ভুল করেছে। গাছের ওপর থেকে যদি লাফ দিয়ে পড়ত, তাহলে কিছু আর করবার ছিল না। কিন্তু ডান দিকে এখন শুধুই ঝোপ, একটা গাছও নেই। আর গাছ থাকলেও আগে থেকেই সতর্ক হয়ে যাবে মানিক সর্দার।

ওরা আস্তে আস্তে এগোতে লাগল, আর তার সঙ্গে ঝোপের মধ্যেও চলল সতর্ক পদচারণা। পাতায় খস খস শব্দে বোঝা যাচ্ছিল বাঘও এগিয়ে যাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে।

অসীম হিংস্রতায় দাঁতে দাঁত চাপল মানিক সর্দার। এক বার একটুখানি দেখতে পেলে হয়। বাঘকে কিছু করতে হবে না, তার বল্লম বিঁধিয়ে দেবে বাঘের পাঁজরায়। কিন্তু বাঘও চিনে নিয়েছে তার সশস্ত্র প্রতিদ্বন্দ্বীকে। সুযোগ সেও দেবে না। আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে এমনিভাবেই চলতে থাকবে সঙ্গে সঙ্গে। তারপর যে মুহূর্তে দেখবে শত্ৰু এতটুকু অসতর্ক হয়েছে—তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে পড়বে তার ওপরে।

প্রায় দশ মিনিট ধরে এইভাবে চলল সুযোগের অপেক্ষা। অসহ্য মানসিক পীড়নে মাথার শিরাগুলো প্রায় ছিঁড়ে যাচ্ছে মানিক সর্দারের। সামনে প্রায় আরও দু-শো গজ জঙ্গল। এতটুকু পেরোতে পারলেই ফাঁকা মাঠ। এক বার মাঠে গিয়ে পৌঁছাতে পারলে বাঘ আর তার সামনে আসতে পারবে না। শুধু একটি বাঘ কেন, তখন সারা দুনিয়ার সমস্ত বুনো জানোয়ারের সঙ্গেই লড়বার জন্যে তৈরি হয়ে আছে মানিক সর্দার।

বাতাসটা আবার বন্ধ হয়ে গেছে। বাঘের সাড়া পেয়েই ঝিঝিরাও ডাক থামিয়েছে হয়তো। শুধু বাঘের পায়ের খসখসানি ছাড়া আর এতটুকু শব্দ নেই কোথাও, যেন সমস্ত জঙ্গলটা নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করে আছে। মানুষ আর জানোয়ারের এই যুদ্ধের ফলাফলটা তারা দেখতে চায়।

বাবা! বলাইয়ের মুমূর্ষ গলার আওয়াজ পাওয়া গেল।

চাপা গর্জনে মানিক সর্দার বললে, চুপ।

পুরোনো পেতলের মতো জ্যোৎস্নার ওপর গাছের কলঙ্ক কাঁপছে। শুধু ঝোপের ভেতরে একটা মাত্র বাঘই না, যেন সমস্ত জঙ্গলটার ওপরেই কে একটা বিশাল চিতা বাঘের চামড়া বিছিয়ে রেখেছে। দু-দিন পরে এখানে মহুয়া পাকবে, পলাশের রঙে লালে লাল হয়ে যাবে সব। দুপুরের ঝিমঝিম বরাদে এখান থেকে চলতে চলতে নেশা ধরে যাবে। কিন্তু এই মুহূর্তে এই জঙ্গলে রূপ নেই, বর্ণ নেই, গন্ধ নেই, কিছুই নেই। শুধু এক-একটা উৎকট গন্ধের ঝলকে মৃত্যু তার বীভৎস অস্তিত্বকে ঘোষণা করছে। শুধু ঝোপের ভেতরে ক্ষুধিত বাঘের চোখ নিষ্ঠুর আদিমতায় ধক ধক দপ দপ করে উঠছে।

এ প্রতীক্ষা অসহ্য। মানিক সর্দারের মাথার শিরা ছিঁড়ে যেতে লাগল। যাহোক কিছু হয়ে যাক, এই মুহূর্তেই হয়ে যাক। এক বারের জন্যে একটুখানি বেরিয়ে আসুক বাঘ। যদি সাহস থাকে মরদের মতো মুখোমুখি দাঁড়াক। তারপর প্রমাণ হয়ে যাক তার বল্লমের ধার বেশি না বাঘের দাঁতের জোর।

বাবা, আমার ভয় করছে। বলাইয়ের ফোঁপানি শোনা গেল।

মানিক সর্দারের ব্রহ্মর জ্বলে গেল দপ করে। পনেরো বছর বয়েস হল কিন্তু এখনও মানুষ হল না ছেলেটা। আজ পঞ্চাশ বছর বয়েস, অসুস্থ জীর্ণ শরীর নিয়ে যখন সে বনের সবচাইতে হিংস্র শত্রুর সামনে রুখে দাঁড়িয়েছে—তখন তার পিঠের আশ্রয়ে থেকেও একটা ছোটো মেয়ের মতো ভ্যানভ্যান করছে বলাই। মানিকের ইচ্ছে করতে লাগল একটা প্রচন্ড চড় বসিয়ে দেয় বলাইয়ের গালের ওপর।

চুপ কর, চুপ কর মেয়েমানুষ কোথাকার। তীব্র চাপা গর্জন করে উঠল মানিক।

আবার সেই বাঘকে মুখোমুখি রেখে এগিয়ে চলা। আবার সেই স্নায়ুছেঁড়া প্রতীক্ষার পালা। ঝোপের ভেতরে বাঘের সতর্ক পদসঞ্চার। দুশো গজ জঙ্গল পার হয়ে যেতে এখনও অনেক সময় লাগবে।

একটা কান্ড হল ঠিক এই সময়।

ঝোপের মধ্যেই কোথাও বাসা করে ডিম নিয়ে বসেছিল বনমুরগি। খুবসম্ভব বাঘের পা পড়ল তার বাসায়। তৎক্ষণাৎ ক্যাঁ-ক্যাঁ করে একটা উৎকট চিৎকার তুলে সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ল বনমুরগি। ঝটপট করে উড়ে গেল মানিক সর্দারের মাথায় পাখার ঝাপটা দিয়ে।

অদ্ভুত ভয়ে আর্তনাদ করে উঠল বলাই, চমকে উঠল মানিক সর্দার। ধনুকের ছিলের মতো টান-করা স্নায়ুর অতি সতর্ক পাহারা বিভ্রান্ত হয়ে গেল মাত্র কয়েক পলকের জন্যে। বাঘ সে সুযোগ ছাড়ল না, তীব্র হুংকার করে স্তব্ধ ভয়ার্ত জঙ্গলকে থরোথরো কাঁপিয়ে সোজা লাফিয়ে পড়ল মানিকের ওপর।

কিন্তু এই বিপর্যয়ের জন্য বাঘও লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। ঠিক গায়ে পড়ল না, পড়ল পাশে। বলাইয়ের আর্ত কান্নায় আর এক বার আঁতকে উঠল জঙ্গল। আর মানিকের হাতের বল্লম বাঘের বুক ফসকে ডান কাঁধের ওপর গিয়ে বিঁধল।

আহত যন্ত্রণায় গোঙানি তুলে বাঘ লাফ মারল উলটো দিকে। বুঝল তারও হিসেবে ভুল হয়ে গেছে। সাধারণ শত্রুর সামনে সে পড়েনি, এখানে শিকার করার চাইতে শিকার হওয়ার সম্ভাবনা আরও বেশি। তারপরে যন্ত্রণায় গর্জন করতে করতে ল্যাজ গুটিয়ে ছুটে পালাল। বহুদূর পর্যন্ত শোনা যেতে লাগল তার গর্জন আর আওয়াজ। কিছুক্ষণ নিঃশব্দে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মানিক সর্দার। তারপর বল্লমের ফলাটা ঘুরিয়ে আনল চোখের সামনে। বাঘের কিছু রোঁয়া আর রক্ত তখনও লেগে আছে তাতে। বাঁ-হাত দিয়ে কপালের ফোঁটা ফোঁটা ঘামগুলোকে মাটিতে ঝরিয়ে দিয়ে বললে, শালা!

আহত হয়ে বাঘ পালিয়েছে। টের পেয়েছে বল্লমের স্বাদ। বুঝেছে পৃথিবীর সব জিনিসই তার খাওয়ার জন্যে তৈরি হয়নি। এর পরে মানুষের কাছে এগিয়ে আসবার আগে সে ভালো করে ভেবে নেবে।

শালা!

জঙ্গলে আবার তীব্র ঝিঝির ডাক উঠেছে। গাছের ডালে ঘুমন্ত পাখিরা জেগে উঠে ভয়ে কিচিরমিচির করছে। মানিক সর্দারের মনে হল, শতকণ্ঠে অরণ্য যেন জয়ধ্বনি তুলছে তার।

এতক্ষণে বলাইয়ের কথা খেয়াল হল। বলাই বসে আছে মাটির ওপর। গলা দিয়ে ঘরঘর করে আওয়াজ বেরুচ্ছে। যেন বোবায় ধরেছে।

ছেলের কাঁধ ধরে প্রাণপণে খানিক ঝাঁকানি দিলে মানিক।

অ্যাঁ!

মানিক সর্দারের ছেলে না তুই?

বলাই বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল, জবাব দিলে না।

মায়ের দুধ খেয়েছিস না ছাগলের দুধ? বলাই তেমনি বিহ্বল চোখ মেলে তাকিয়ে রইল।

পিঠে মেরুদন্ড নেই, এতটুকু সাহস নেই! হতচ্ছাড়া মেয়েমানুষের অধম! কেমন করে বেঁচে থাকবি দুনিয়ায়? কী করে লড়বি চারদিকের এতসব বুনো জন্তুর সঙ্গে?

বলাই চুপ।

এবার মানিক সর্দারের একটা প্রচন্ড চড় বলাইয়ের গালে এসে পড়ল।

ওঠ হারামজাদা, ওঠ। এমন করে ব্যাঙের মতো বসে থাকলে চলবে না, পা চালিয়ে চল। এখানে শুধু যে একটা বাঘই আছে সেকথা বলা যায় না। বার বার বুড়ো বাপ তোকে বাঁচাতে পারবে না।

বাজারের সওদায় ভরা ছোটো থলেটা ছিটকে পড়েছিল, কাঁপা-হাতে সেটা কুড়িয়ে নিলে বলাই। তারপর কুকুরছানার মতো মাথা গুঁজে মানিক সর্দারের পাশে পাশে চলতে লাগল।

এতক্ষণে যেন মানিকের শরীরের সেই ক্লান্তি সেই অবসাদটা আবার এসে নতুন করে ভেঙে পড়েছে। পিঠের ওপরে সেই অসহ্য চাপ তার মেরুদন্ডটাকে মটকে দুখানা করে দিতে চাইছে। পা দুটো খুলে পড়বার উপক্রম করছে হাঁটুর তলা থেকে। যে-হাতে এতক্ষণ বল্লমটাকে উদ্যত করে রেখেছিল সে-হাতটা অদ্ভুতরকম ঢিলা হয়ে গেছে—যেন তাল পাতার পুতুলের হাতের মতো সরু সুতোয় ঝুলছে কাঁধের সঙ্গে।

বাঘ পালিয়েছে, কিন্তু জীবন?

একটা বলদ বিক্রি হয়েছে গেছে, আর একটাও যাবে। নতুন ধান এখনও অনেক দূর, ততদূর পর্যন্ত ঝাপসা চোখের দৃষ্টি চলে। কিছুদিন পরেই আসবে উপোস, বনের কচুকন্দ খেয়ে হয়তো আর এক মাস বেঁচে থাকা চলবে, কিন্তু তারপর?

উপায় নেই, কোনো উপায় নেই।

অথবা একটা উপায় আছে, যা করেছিল খাদেম আলি মোল্লা।

বলদ না থাক বলদের মোটা দড়িগাছটা ছিল, আর ছিল শূন্য গোয়ালঘরের বাঁশের আড়া —যেখান থেকে ঝুলে পড়তে খুব বেশি সময় লাগে না।

কিন্তু শরীরে যদি একটু শক্তি থাকত, যদি গত বছরের সান্নিপাতিক জ্বরটা তাকে এমনভাবে ফোঁপরা করে রেখে না যেত, তাহলে কি এত সহজে হার মানত সে? দিনমজুরি করতে পারত, যেতে পারত রেলের ইস্টেশনে। পশ্চিমি কুলিরা মোট বয়ে বেঁচে থাকে আর সে পারত না?

কিংবা তারও দরকার ছিল না, ছেলেটা যদি মানুষ হত! অপদার্থ মেয়েমানুষ! পান্ডুর জ্যোৎস্নায় ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে মাটিতে থুতু ফেলল মানিক সর্দার।

আর তক্ষুনি বাঘের গর্জনে আবার সমস্ত জঙ্গল কেঁপে উঠল। চোট-পাওয়া চিতা যে অত সহজেই পালায় না-জেনে-শুনেও সেকথা ভুলে গিয়েছিল মানিক সর্দার। খানিক দূরে গিয়েই বাঘ আবার নিঃশব্দে ফিরে এসেছে চোরের মতো, তারপর প্রতিশোধ নেবার জন্যে নির্ঘাত লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মানিকের ওপর।

হাত থেকে ছুটে গেল বল্লম। চিত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল মানিক। শুধু অসাড় আড়ষ্ট চোখ মেলে দেখতে লাগল একসার ধারালো দাঁত তার গলাটা ছিঁড়ে ফেলবার জন্যে নেমে আসছে ধীরে ধীরে। বিষাক্ত দুর্গন্ধ নিশ্বাসে সমস্ত মুখ জ্বলে যাচ্ছে তার। পায়ের ওপর সাপের মতো বাঘের ল্যাজ আছড়ে পড়ছে।

বলাই! অন্তিম প্রার্থনার মতো শুধু মনে হল, বলাই বাঁচবে তো? কিন্তু গলাটাকে ছিঁড়ে ফেলবার আগেই আর এক বার বাঘ আর্তনাদ করল। লাফিয়ে উলটে পড়ল মানিকের বুকের ওপর থেকে। তারপর অসহ্য যন্ত্রণায় গড়াগড়ি খেতে লাগল মাটিতে।

এবার বলাই। এতক্ষণ মানিক তাকে সুযোগ দেয়নি, আড়াল করেই রেখেছিল। সেই আড়াল সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বলাই জেগে উঠেছে। একটা পাথরের চাপে খুলে গিয়ে মুক্তি পেয়েছে তার পৌরুষ, তার পনেরো বছরের প্রথম পৌরুষ।

বল্লম এবার আর কাঁধে গিয়ে লাগেনি, পাঁজরার ভেতর দিয়ে সোজা বাঘের হৎপিন্ড ভেদ করেছে। পঞ্চাশ বছরের মানিক সর্দারের হাত কেঁপেছিল, পনেরো বছরের বলাইয়ের হাত কাঁপেনি।

শেষ মুহূর্তের নিরুপায় যন্ত্রণায় বাঘ ছটফট করতে লাগল। বল্লমের ফলায় উছলে উঠতে লাগল রক্ত-গর্জনের পর গর্জনে জঙ্গল বিদীর্ণ হয়ে যেতে লাগল।

বাবা! বাবা! বলাইয়ের কান্না শোনা গেল। মাটিতে হাতের ভর রেখে উঠে বসল মানিক সর্দার, তারপর দাঁড়িয়ে গেল টলতে টলতে।

তোমার গা দিয়ে যে রক্ত পড়ছে বাবা! আরও শব্দ করে কেঁদে উঠল বলাই।

দু-হাত বাড়িয়ে ছেলেকে বুকে টেনে নিলে মানিক সর্দার। তারপর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললে, ভয় নেই—কোনো ভয় নেই। আমার জন্যেও নয়—তোর জন্যেও না।

No comments