অন্ধদের আজব গ্রাম – এইচ জি ওয়েলস

অন্ধদের আজব গ্রাম – এইচ জি ওয়েলস

আন্দেজ পর্বতমালার একদম শেষ প্রান্তে দারুণ অদ্ভুত এক গ্রাম ছিল। সেই গ্রামে কারও পক্ষে যাওয়া অসম্ভব। শক্তিশালী এক ভূমিকম্পের কারণে সেই গ্রামটা সভ্যজগৎ থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পর্বতারোহীরা অনেক চেষ্টা করেও সেই পার্বত্য অঞ্চল অতিক্রম করতে পারেনি। পর্বতমালার ওই প্রান্তের গ্রামবাসীরা বেশ সুখেই ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে এমন এক মহামারি দেখা দিল, যার ফলে সেই গ্রামের সবাই অন্ধ হয়ে গেল। শুধু তা-ই নয়, যারা জন্ম নিচ্ছিল তারাও অন্ধ হয়েই জন্ম নিচ্ছিল। সেই গ্রামে হঠাৎ একবার এক পর্বতারোহী গিয়েছিল। নাম তার নিনাজ। এই গল্পটা সে-ই বলেছে। তার মুখের সেই গল্প পরে সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে।

নিনাজ দারুণ দুঃসাহসী অভিযাত্রী ছিল। আন্দেজ পর্বতমালার চূড়ায় উঠতে গিয়ে সে পড়ে যায় হঠাৎ করেই। ভাগ্য ভালো যে দুর্গম জঙ্গলের লতাপাতায় জড়িয়ে সে পাহাড়ের অপর প্রান্তে ছিটকে পড়েছিল। তাই বেঁচে যায় নিনাজ। দুদিন অতিকষ্টে পাহাড়ি দুর্গম রাস্তাগুলো পার হয়ে সে গিয়ে ওঠে একটা গ্রামে। তাতে সে যাত্রায় সে বেঁচে যায়।

কিন্তু গ্রামে ঢুকেই তার কেমন গা ছমছম করতে থাকে। গ্রামের ঘরগুলো অদ্ভুত। ঘরগুলোতে কোনো জানালা ছিল না। গ্রামের রাস্তায় কোনো লোকজন নেই। সব সুনসান। নিনাজ ভয়ে ভয়ে গ্রামের রাস্তায় ঢোকে। সে যখন গ্রামে ঢুকছিল তখনো সূর্য বেশ আলো দিচ্ছে। হয়তো ঘণ্টা খানেকের মধ্যে সন্ধে হয়ে যাবে। হাঁটতে হাঁটতেই সে দেখল একটু দূরে রাস্তা দিয়ে তিনজন লোক হেঁটে যাচ্ছে। বেশ অদ্ভুতভাবে হাঁটছিল তারা। একজনের পেছনে আরেকজন। তবে বেশ সাবলীলভাবে তারা হাঁটছিল। নিনাজ প্রথমে ভাবল লোকগুলো অন্ধ নাকি! তারপর মনে হলো অন্ধ হলে এত সহজভাবে তারা হাঁটতে পারত না। নিনাজ লোকগুলোর কাছে গিয়েই বুঝতে পারে, আসলেই তারা অন্ধ। কারণ, তিনজনের চোখই নষ্ট। সে লোকগুলোর কাছে যেতেই তিনজন লোক হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায়। বাতাসে কী যেন তারা শুঁকতে থাকে। তারপর সামনের লোকটা তার হাতের লাঠি উঁচু করে নিনাজের দিকে তাক করে বলে, ‘এই তুমি কে? নতুন ঘ্রাণ পাচ্ছি তোমার শরীর থেকে। তুমি আমাদের গাঁয়ের কেউ না। অন্য গ্রাম থেকে এখানে এসেছ। বলো তুমি কে?’

নিনাজ প্রথমে একটু অবাক হলো। সে এদিক-সেদিক নড়াচড়া করে বোঝার চেষ্টা করল লোকগুলো তাকে দেখতে পায় কি না। সে নিশ্চিত হলো লোকগুলো দেখতে পায় না। তখন তার অনেক প্রাচীন একটা প্রবাদের কথা মনে হলো, ‘অন্ধদের দেশে একচোখা ব্যক্তি হলো রাজা।’ সে দুচোখেই দেখতে পায়। ফলে সে এখন এই গ্রামের রাজা। আহ্! কী আনন্দ। তার কথায় সবাই ওঠবস করবে। সে বেশ আনন্দের সঙ্গে লোকগুলোর কাছে যেতেই তিনজন লোক তাকে খপ করে ধরে ফেলল। তারপর বলল, ‘এই লোকের মতিগতি বেশ খারাপ। একে বন্দী করো।’

নিনাজ বলল, ‘আমাকে বন্দী করতে হবে না। আমি কোথাও পালিয়ে যাচ্ছি না। বলো কোথায় যেতে হবে?’

‘আমাদের সাথে চলো।’

একজন এসে নিনাজের হাত ধরলে সে বলল, ‘আমার হাত ধরতে হবে না, আমি দেখতে পাই।’

তিনজন লোকই দাঁড়িয়ে গেল।

‘দেখতে পাও! দেখতে পাও মানে কী?’

‘তোমাদের চোখ নেই তাই তোমরা বিষয়টা বুঝতে পারছ না। দেখতে পাই মানে আমার চারপাশে যা কিছু আছে সবকিছু আমি দেখতে পাই। মাথার ওপর সূর্য, অনেক দূরে পাহাড়, আকাশ, নদী।’

‘পাহাড়, নদী, আকাশ এই সব আবার কী? তুমি নিশ্চয়ই পাগল। তোমার মাথায় কোনো সমস্যা আছে। একে সরদারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।’

নিনাজ অনেক চেষ্টা করেও তাদের হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারল না। সন্ধে নেমে এসেছে। চারদিকে বেশ হিম হিম ঠান্ডা। তাদের চিৎকারে গ্রামের লোকজন জড়ো হতে শুরু করল। নিনাজ লক্ষ করল গ্রামের সবাই অন্ধ। যেখানে চোখ থাকার কথা, সেই জায়গাটা একদম ফাঁকা।

নিনাজকে ঠেলতে ঠেলতে একটা ঘরের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। নিনাজ লক্ষ করল, মানুষগুলো অন্ধ হলেও চলাফেরা করছে বেশ সাবলীলভাবে। যেন তারা সবকিছুই দেখতে পাচ্ছে। হঠাৎ করেই গ্রামে অন্ধকার নেমে এল। সূর্যের আলোয় যেই গ্রামটা নীরব ছিল রাতের আঁধারে মানুষের কথাবার্তায় গ্রামটা যেন আচমকা জীবিত হয়ে উঠল। নিনাজ লক্ষ করল গ্রামের কোথাও কোনো ঘরে কেউ বাতি জ্বালেনি। তাকে ধাক্কা দিয়ে বেশ বড় একটা ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। একজন বুড়ো তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কোত্থেকে এসেছ তুমি?

নিনাজ বলল, ‘পাহাড়ের ওপারের শহর থেকে। সেই শহরের মানুষ তাদের মতো নয়।’

‘তোমার কথাবার্তা শুনেই বুঝতে পারছি সেই শহরের মানুষগুলো পাগল-মূর্খ। তুমি দেখার কথা কী যেন বলছিলে? পাহাড়, আকাশ আরও কী সব উল্টাপাল্টা কথা বলছ। এ গ্রামে এসব বলা চলবে না।’

নিনাজ বুঝতে পারল এদের সঙ্গে তর্ক করে সে থাকতে পারবে না। সে ভেবেছিল দেখতে পাওয়ার কারণে এই লোকগুলো তাকে সম্মান করবে, সমীহ করবে। কিন্তু ঘটনা ঘটছে উল্টো।

নিনাজ বলল, ‘আমি খুব ক্ষুধার্ত।’

তাকে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। গ্রামের সরদার নির্দেশ দিলেন এই লোক যেহেতু কিছুই জানে না তাই ওকে গ্রামের সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিমান পণ্ডিত লোক জেকভের বাসায় রাখা হোক।

জেকভের বাসায় থেকে নিনাজ এই গ্রামের আরও অনেক কিছু জানতে পারল। সে পরিষ্কার বুঝতে পারল গ্রামের লোকজন বংশপরম্পরায় কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে সবাই অন্ধ হয়েই জন্ম নিচ্ছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে সে আরও জানতে পারল যে সময়কে তারা গরম আর ঠান্ডা এই অনুভূতি দিয়ে ভাগ করে নিয়েছে। যখন গরম থাকে তখন তারা সবাই ঘুমায় আর যখন ঠান্ডা থাকে তখন তারা জেগে ওঠে কাজ করে। নিনাজ বুঝতে পারল দিন আর রাতকে তারা গরম আর ঠান্ডা দিয়ে ভাগ করে নিয়েছে। দিনের বেলা সবাই ঘুমায় আর রাতের বেলা সবাই জেগে ওঠে।

জেকভের কাছ থেকে সে আরও অনেক কিছু জানতে পারল। সে বুঝতে পারল গ্রামের লোকগুলো অন্ধ হলেও প্রাকৃতিকভাবে তাদের চোখের অভাব তারা ঘ্রাণ আর ত্বকের অনুভূতি দিয়ে পুষিয়ে নিয়েছে। তাদের ত্বক আর ঘ্রাণ প্রচণ্ড রকম স্পর্শকাতর। তাদের শোনার ক্ষমতা ভীষণ।

জেকভের একটা মেয়ে ছিল। নিনাজ দেখল মেয়েটা বেশ সুন্দরী। মেয়েটার সঙ্গে কথা বলে নিনাজ বুঝতে পারল, মেয়েটা বুদ্ধিমতীও বটে। মেয়েটার নাম সায়রা। সে নিনাজকে গ্রামের সবকিছু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাল। নিনাজকে বলল, ‘তুমি দেখতে পাও, আরও কী কী সব অদ্ভুত অচেনা জিনিসের কথা বলো, পাহাড়, নদী, শহর, গাড়ি এই সব আর বলবে না। নয়তো সবাই তোমাকে পাগল বলবে। আমাদের মতো করে চলার চেষ্টা করো।’

মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেল নিনাজ। একদিন সে তাকে বলল, ‘সায়রা, তোমাকে বিয়ে করতে চাই।’

সায়রা সম্মতি দিল। কিন্তু ওর বাবা জেকভ কিছুতেই রাজি হলো না। বলল, ‘এমন পাগল ছেলের কাছে বিয়ে দেওয়া যাবে না। ছেলেটা পাগলের মতো কথা বলে ওদের মতো চলাফেরা কাজকর্ম এখনো করতে পারছে না।’

এই কথা শুনে সায়রা কান্নাকাটি শুরু করল। মেয়ের কান্না দেখে জেকভের মনটা নরম হলো। সে গ্রামের সরদারের কাছে গেল। সরদার সব শুনে বলল, ‘এই ছেলে যদি আমাদের রীতিনীতি না বোঝে তাহলে কীভাবে সে তোমার মেয়েকে বিয়ে করবে। ও এখনো কিছুই শিখতে পারেনি।’

পাশ থেকে গ্রামের একজন বলল, ‘ওর চোখ দুটোই ঝামেলা। ওই দুটোর কারণেই সে উল্টাপাল্টা কথা বলছে। চোখ দুটো আমাদের চিকিৎসককে দিয়ে তুলে ফেলুন। তখন ও আমাদের মতো হয়ে যাবে। তারপর সে আস্তে আস্তে সবকিছু শিখে নেবে।’

সরদার বলল, ‘তুমি ঠিক কথাই বলছ। ঠিক আছে জেকভ ওই ছেলেকে তুমি আমাদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দাও। ওর চোখ তুলে নেওয়ার পর সে যখন আমাদের মতো হয়ে যাবে তখন ওর সাথে তোমার মেয়ের বিয়ে দেওয়া হবে।’

নিনাজকে এই কথা বলার পর নিনাজ খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল। সায়রা বলল, ‘এত চিন্তা করো না। আমাদের চিকিৎসক খুব ভালো। তুমি একটু ব্যথা পাবে। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে।’

নিনাজ বলল, ‘আমাকে এক সপ্তাহ সময় দাও। আমি একটু শান্ত হয়ে ভাবি।’

‘আমাকে পাবার জন্য এত সামান্য ত্যাগ তুমি স্বীকার করতে পারবা না?’

‘সব পারব। একটু সময় দাও।’ নিনাজ বলল।

নিনাজ কয়েক দিন চিন্তাভাবনা করল। তারপর ষষ্ঠ দিন সে সায়রাকে বলল, ‘সায়রা আমার কাছে এসো। আমি তোমাকে ভালোভাবে দেখে নিই। আজকের পর হয়তো আমি তোমাকে আর দেখতে পাব না।’

সায়রা বলল, ‘তুমি আবারও দেখার কথা বলছ? এই চোখ দুটোই তোমাকে ধ্বংস করল। কাল থেকে তুমি আমাকে আরও ভালোভাবে অনুভব করতে পারবে। তোমার একটু কষ্ট হবে কিন্তু সব ঠিক হয়ে যাবে।’

‘আমি আজ একটু একা থাকতে চাই’, বলে বিদায় নিল নিনাজ। সারা রাত কাজ করে গ্রামের সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ল তখন জেগে উঠল নিনাজ। সে তার বাক্স-পেটরা গুছিয়ে পাহাড়ের দিকে হাঁটা দিল। যেভাবেই হোক এই গ্রাম ছেড়ে তাকে চলে যেতে হবে। দিনের শেষ ভাগে নিনাজ পাহাড়ের ওই পারে চলে এল। লম্বা শ্বাস নিয়ে অনেক দূরে সাগরের দিকে তাকাল। আকাশটাকে ভালোভাবে দেখল। তার মনে হলো, আহ্ এই সমুদ্র, নীল আকাশ, সবুজ অরণ্য, মরুভূমি, নদী পাহাড়-পর্বত বড় অট্টালিকা এই শহর সবকিছু তার। এই পৃথিবী তার। সে কিছুতেই তার চোখ দুটো হারাতে চায় না। সায়রার জন্য তার মন একটু খারাপ হলো। একটু পরেই সে মন খারাপ ভাব ঝেড়ে ফেলে আবার পাহাড়ের অপর প্রান্তে ওঠা শুরু করল। যেভাবেই হোক তার নিজের শহরে যেতে হবে তাকে।

রূপান্তর: রাফিক হারিরি

No comments