হরতন ইশকাপন (মিসির আলি) – হুমায়ূন আহমেদ

হরতন ইশকাপন (মিসির আলি) – হুমায়ূন আহমেদ

স্যার ম্যাজিক দেখবেন

স্যার ম্যাজিক দেখবেন? মিসির আলি বিরক্ত মুখে প্রশ্ন কর্তার দিকে তাকালেন। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের যুবক। বোঝা যাচ্ছে অভাব-অনটনে আছে। গায়ের শার্ট মলিন। চেহারাও শার্টের মতোই মলিন। যদিও হাসি-খুশি ভাব ধরে রাখার চেষ্টা করছে। সেই চেষ্টায় লাভ হচ্ছে না। যুবকের চোখেও মনে হয় সামান্য সমস্যা আছে। সারাক্ষণ চোখ পিটপিট করছে। চোখের অশ্রুগ্রন্থি ঠিকমতো কাজ না করলে চোখ পিটপিট রোগ হয়। এর কি তাই হয়েছে? সে ক্ষুধার্তও। তাকে পিরিচে করে বিস্কিট এবং চানাচুর দেয়া হয়েছিল। সে সবই খেয়েছে। বিস্কিটের কিছু কণা পড়ে ছিল। তৰ্জনীর মাথায় সেই কণাগুলো মাখিয়ে সে জিভে ছোঁয়াল।

যুবকের নাম তিনি জানেন না। নাম জানার কোনো আগ্রহও বোধ করছেন না। তাঁর কাছে যুবকটি কেন এসেছে তা-ও ধরতে পারছেন না। তিনি এমন কোনো মজার চরিত্র না যে তাঁর সঙ্গে কথা বলে কেউ মজা পাবে। যুবক আবার বলল, স্যার, ম্যাজিক দেখবেন?

মিসির আলি বললেন, ম্যাজিক দেখব না। ম্যাজিক আমার পছন্দের বিষয় নয়।

যুবক হাসি হাসি গলায় বলল, কেন পছন্দ না জানতে পারি?

মিসির আলি বললেন, ম্যাজিকের ভেতর প্রতারণার একটা ব্যাপার থাকে। এই প্রতারণার অংশটা আমার অপছন্দ। আমি প্রতারণা পছন্দ করি না।

স্যার আমি যে ম্যাজিক দেখাব তার মধ্যে কোনো প্রতারণা নেই। মেন্টাল ম্যাজিক। আমার অনেক দিনের শখ আমি আমার মানসিক ক্ষমতার নমুনা আপনাকে দেখাই।

যুবকের মানসিক ক্ষমতা দেখার ব্যাপারেও মিসির আলি কোনো আগ্ৰহ বোধ করলেন না। তিনি নিজের উপর সামান্য বিরক্তও হলেন। তাঁর কৌতুহল এত দ্রুত কমছে কেন? বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের কৌতুহল কমতে থাকে? সেই কমার হারটা কেমন?

মিসির আলি বললেন, তোমার নাম কী?

যুবক আগ্রহের সঙ্গে বলল, মনসুর। আপনার সঙ্গে আমার কিছু মিল আছে। আপনার নামের শুরু ম দিয়ে। আমার নামের শুরুও ম দিয়ে।

যুবক আবারো বলল, আমি কি স্যার আমার মানসিক ক্ষমতার একটা ম্যাজিক আপনাকে দেখাব? দেখলে আপনি খুবই মজা পাবেন।

মিসির আলি হ্যাঁ বা না বলার আগেই মনসুর পকেটে হাত দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। হতদরিদ্র যুবকদের পকেটেও কেন জানি দামি সিগারেটের প্যাকেট থাকে। এর কাছে তা নেই। সমস্ত সিগারেটের প্যাকেটের ন্যাতন্যাতা ফিল্টারবিনীহ সিগারেট।

আমি ম্যাঞ্জিকটা দেখাব সিগারেট দিয়ে।

মনসুর একটা সিগারেট টেবিলের উপর রাখল। মেরুদণ্ড সোজা করে বসল। সিগারেটের দিকে এখন সে তাকিয়ে আছে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে। তার মাথা নিচু হয়ে আছে। চোখে পিটপিটানিও বন্ধ।

স্যার ভালো করে দেখুন। আমি সিগারেটটা হাত দিয়ে স্পর্শও করি নি। আমি শুধু তাকিয়ে আছি। দেখুন চোখের দৃষ্টিতে আমি কী করছি!

মিসির আলি মোটামুটি বিস্মিত হলেন। সিগারেট নড়ছে। গড়িয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছে। বিস্মিত হবার মতোই ব্যাপার।

যুবকের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মুখের মাংসপেশি শক্ত হয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে মানসিক ক্ষমতার এই ম্যাজিক দেখাতে তার রীতিমতো কষ্ট হচ্ছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে।

স্যার কেমন দেখলেন?

ভালো। ইমপ্রেসিভ।

এখন যা দেখলাম তার নাম টেলি-কাইনেটিক্স। মানসিক শক্তির সাহায্যে বস্তুকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরানো! আপনি কি টেলি-কাইনেটিক্সের কথা শুনেছেন?

শুনেছি।

মনসুর লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল, ইসরায়েলের এক যুবক, তার নাম যুরি গেলার। সে মানসিক ক্ষমতা দিয়ে চামচ বাঁকা করে ফেলতে পারত। আমার এত ক্ষমতা নেই। তবে যা আছে তা-ও খারাপ না। চামচ বাঁকা করতে না পারলেও আমি পাতলা তার বাঁকা করতে পারি। ঠিক বলেছি না। স্যার?

মিসির আলি সামান্য নড়ে বসলেন। হ্যাঁ-না কিছু বললেন না। টেবিলের উপর থেকে সিগারেট নিয়ে ঠোঁটে দিল। দিয়াশলাই দিয়ে সিগারেট ধরাল। সিগারেট একবারে ধরল না। বেশ কয়েকটা কাঠি খরচ করতে হল। একজন বয়স্ক মানুষ সামনে বসে আছে তা নিয়ে তার মধ্যে কোনো সঙ্কোচ দেখা গেল না।

সিগারেট থেকে তীব্ৰ গন্ধ আসছে। গাঁজার গন্ধ। মিসির আলির মন সামান্য খারাপ হল।

সিগারেট শেষ করে আমি আমার ক্ষমতার অন্য একটা ভার্সান আপনাকে দেখাব। আপনি মজা পাবেন।

আচ্ছা।

আপনার সামনে সিগারেট টানছি আপনি কিছু মনে করছেন না তো? সস্তা সিগারেট বলেই এমন কড়া গন্ধ আসছে। আপনি যা ভাবছেন তা কিন্তু না। গাঁজা না।

মনে করছি না।

এখন স্যার মোটা দেখে একটা বই আমার হাতে দিন। যতটা মোটা হয় তত ভালো।

ডিকশনারি দিলে চলবে?

চলবে।

মনসুরের সিগারেট শেষ হয় নি। সে আধা খাওয়া সিগারেট ফেলে দিয়ে বই নিয়ে বসল। তার ধানমগ্ন মূর্তি দেখতে ভালো লাগছে। মিসির আলি বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন। মনসুর তার দুই হাত দিয়ে কোমর ধরে আছে। একটু ঝুঁকে এসেছে বইয়ের দিকে। তার কপাল আবারো ঘামছে! ঘটনা যা ঘটছে তা বিস্ময়কর। বইয়ের পাতা একের পর এক উল্টে যাচ্ছে।

স্যার কেমন দেখছেন?

ভালো। আমি হিপনেটিজমও পারি। যে কোনো মানুষের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারি।

ও আচ্ছা।

আজ অবশ্য পারব না। আজ আমার মন ভালো নেই। কোনো কিছুতেই কনসেনট্রেট করতে পারছি না। মন অসম্ভব খারাপ। এই মুহুর্তে আমার চেয়ে বেশি মন খারাপ মানুষ বাংলাদেশে আছে বলে মনে হয় না।

মিসির আলি ঘড়ির দিকে তাকালেন। ছটা দশ। সন্ধ্যা হয়-হয় করছে। সন্ধ্যাবেলাটা তাঁর একা থাকতেই ভালো লাগে! মানসিক ক্ষমতাওয়ালা কারো সামনে বসে থাকতে ইচ্ছা করে না। মনসুর এখনো বসে কেন তিনি বুঝতে পারছেন না। সে তার মেন্টাল ম্যাজিক দেখাতে চেয়েছিল দেখানো হয়েছে। আরো কিছু কি বাকি আছে? নাকি সে তার ঘুম পাড়ানো ক্ষমতাও দেখাবো! যাবার আগে তাকে ঘুম পাড়িয়ে চলে যাবে। সন্ধ্যাবেল তিনি চেয়ারে বাঁকা হয়ে বসে নাক ডাকিয়ে ঘুমাতে পারবেন।

মনসুর আরেকটা সিগারেট ধরাল। মিসির আলি লক্ষ করলেন, দিয়াশলাই জ্বালানোর সময় তার হাত সামান্য কাঁপছে! পারকিনসন্স ডিজিজ প্রাথমিক অবস্থায় এরকম হয়। এই যুবকের পারকিনসন্স ডিজিজ আছে বলে মনে হচ্ছে না। তা হলে আঙুল কাঁপছে কেন? মানসিক অস্থিরতা? মনের প্রবল অস্থিরতা শরীরে ছায়া ফেলে। মনের প্রবল কাঁপুনি শরীরে চলে আসে।

মনসুর সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে মিসির আলির দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে বলল, এই জাতীয় ক্ষমতা সবচে বেশি দেখা যায় যোগী-সন্ন্যাসীদের মধ্যে। এদের অনেকেই লেভিটেশন করতে পারেন। লেভিটেশন হচ্ছে শূন্যে ভাসা। অসম্ভব কোনো ব্যাপার না। দীর্ঘ সাধনার প্রয়োজন। সাধনা এবং মনের কনসেনট্রেশন। সাধনা আমি করে যাচ্ছি-সমস্যা একটাই, মনের একাগ্রতাটা আসছে না। মন খুবই বিক্ষিপ্ত।

ও আচ্ছা।

লেভিটেশনের দিকে আমি অনেকটা এগিয়েছি! মাটি থেকে এক ইঞ্চির মতো উঠতে পারি।

ও আচ্ছা।

বেশিক্ষণ থাকতে পারি না। পাঁচ-দশ সেকেণ্ড পারি।

যুবক বিস্মিত চোখে তাকাল। তার বিস্মিত হবার কারণ আছে। মিসির আলি তাকিয়ে আছেন আগ্রহশূন্য চোখে। তার ভাবভঙ্গিতে এটা স্পষ্ট যে-মানসিক ক্ষমতাধর যুবকটি বিদায় হলে তিনি খুশি হবেন। তিনি যুবকের শূন্যে ভাসা দেখতে চান না।

স্যার, আমি উঠি?

আচ্ছা।

আমার মেন্টাল ম্যাজিক মনে হয় আপনার ভালো লাগে নি?

মিসির আলি জবাব দিলেন না। মনসুর বলল, আমার ক্ষমতার ব্যাপারটা কেমন লেগেছে একটু কি বলবেন?

মিসির আলি বললেন, মোটামুটি লেগেছে।

যুবক চাপা গলায় বলল, মানুষের মনের ক্ষমতা অনুভবের ব্যাপার। মানসিক ক্ষমতার প্রত্যক্ষ প্রমাণ কখনোই পাওয়া যায় না। সেই প্ৰমাণ আমি দেখালাম তারপরেও আপনি বলছেন মোটামুটি?

হ্যাঁ তা বলছি।

আমি কি জানতে পারি এখন আপনি মোটামুটি না বলে বলবেন—চমৎকার?

মিসির আলি ছোট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। অপ্রীতিকর একটা কথা এখন তাকে বলতে হবে। বলতে না পারলেই তিনি খুশি হতেন। কিন্তু উপায় নেই। এই যুবক অপ্রীতিকর কথা বলতে তাকে বাধ্য করছে।

মানসুর।

জি।

তুমি যদি সত্যি তোমার মানসিক ক্ষমতার কোনো প্ৰমাণ দেখাতে আমি খুশি হতাম। তুমি যা দেখিয়েছ তা হচ্ছে সাধারণ ম্যাজিকের কৌশল। সিগারেট টেবিলের উপর রেখেছ, তারপর মাথা নিচু করে খুব সাবধানে ফুঁ দিয়েছ। তুমি যা দেখিয়েছ তা মানসিক ক্ষমতা না, ফুসফুসের ক্ষমতা।

মনসুর তাকিয়ে আছে। মিসির আলি লক্ষ করলেন, তার চোখ ধক করে জ্বলে উঠেই নিভে গেল। মিসির আলি বললেন, আমি কি ভুল বলেছি?

না।

তুমি তা হলে ওঠো।

আপনার কি এখন কাজ আছে?

আমার এখন কোনো কাজ নেই। কাজ না থাকলেই আমি যে লোকজনের সঙ্গে গল্প করি তা না।

আপনি আমাকে বাসা থেকে বের করে দিচ্ছেন?

তা-ও না। আমি খুব অদ্রভাবে বলার চেষ্টা করছি যে আমি এখন একা থাকতে চাচ্ছি।

আপনার ধারণা আমি একজন ফ্রড, ভাঁওতাবাজ?

তা-ও না। ম্যাজিশিয়ানরা ম্যাজিক দেখাতে গিয়ে যে ধরনের কথা বলেন তুমিও তাই বলেছ, এতে দোষ ধরার কিছু নেই।

আমার কিন্তু সত্যি সত্যি মানসিক ক্ষমতা আছে। আজ দেখাতে পারলাম না। একদিন এসে দেখিয়ে যাব।

সত্যি ক্ষমতাটা আজ দেখালে তো তোমাকে দ্বিতীয়বার দেখাতে হতো না।

মনসুর চাপা গলায় বলল, সত্যি ক্ষমতা আমি কাউকে দেখাই না। দেখাতে চাইলেও দেখাতে পারি না। বিশেষ বিশেষ সময়ে এই ক্ষমতা আমার মধ্যে আসে। যদি কখনো আসে আপনাকে দেখাব।

ঠিক আছে।

আপনাকে বিরক্ত করার জন্য এবং আপনার সঙ্গে যে মিথ্যা কথা বলেছি সে জন্য আমি দুঃখিত।

আচ্ছা, ঠিক আছে।

মোটেই ঠিক নেই। সবই বেঠিক। তবে আমি একদিন এসে সব ঠিক করে দিয়ে যাব।

যুবক মাটিতে ফেলে দেয়া তার আধ খাওয়া সিগারেট আবার হাতে নিয়ে ধরাল। তামাকের কটু গন্ধে মাথা ধরে যাবার মতো অবস্থা হল।

মিসির আলি চোখ বন্ধ করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন। কথাবার্তা পর্ব শেষ হয়েছে এই সিগন্যাল দেয়া হল। এরপরও মানসিক ক্ষমতাসম্পন্ন যুবক নিশ্চয়ই দাড়িয়ে থাকবে না। তার সামান্য চক্ষুলজ্জা থাকলে সে চলে যাবে।

স্যার যাই?

মিসির আলি চোখ খুললেন না। মাথা নাড়লেন। মনসুর চলে যাচ্ছে, চোখ বন্ধ করেও তা বোঝা যাচ্ছে। পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। জুতার শব্দ। মনসুর স্যান্ডেল পরে আসে নি, জুতা পরে এসেছে। কী রকম জুতা, কালো না ব্ৰাউন? কত দিনের পুরোনো জুতা? জুতার ফিতাগুলো কীভাবে বেঁধেছে? জুতার ফিতা বাধা থেকে একজন মানুষের চরিত্র খানিকটা বলে দেয়া যায়! কেউ খুব শক্ত করে ফিতা বাঁধে। কারো ফ্রিতা বাধায় টিলাঢালা ভাব থাকে। মিসির আলি লক্ষ করেন নি।

বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বদলায়। তিনিও সম্ভবত বদলাচ্ছেন। আগের মতো খুঁটিয়ে কিছু লক্ষ করছেন না। মনসুর একটা চেকশার্ট পরে এসেছে। এটা মনে আছে! সাদা কাপড়ে নীল সবুজ চেক। শার্টের বুক পকেটে একটা ফাউন্টেন পেন ছিল। ফাউন্টেন পেনের কথা মনে আছে।–কারণ আজকাল ফাউন্টেন পেন কেউ ব্যবহার করে না। ফাউন্টেন পেন কেন, বিল পয়েন্ট কলামও কেউ সঙ্গে রাখে না। বল পয়েন্ট কলম, যেখানে যাওয়া যাবে সেখানেই পাওয়া যাবে, কাজেই সঙ্গে রাখার দরকার কী।

একটা সময় ছিল যখন কলম, ঘড়ি, চশমা এই তিনটি জিনিসকে সাজগোছের অংশ ধরা হতো। ইন্ত্রি করা শার্টের পকেটে থাকবে কািলম। চোখে জিরো পাওয়ারের চশমা, হাতে ঘড়ি। রেডিওতে যখন খবর পাঠ করা হবে তখন চট করে হাতঘড়ির সময় মিলিয়ে নেয়াও কালচারের অঙ্গ ছিল। একে বলা হতো রেডিও টাইম। আজকাল কেউ বোধ হয় খবর শুনে ঘড়ির টাইম ঠিক করে না। রেডিও টাইম বলেও বোধ হয় কিছু নেই। রেডিওর পরে অনেক কিছু চলে এসেছে-টিভি টাইম, স্যাটেলাইট টাইম। আচ্ছা মনসুরের হাতে কি ঘড়ি ছিল? মিসির আলি মনে করতে পারলেন না। সম্ভবত ছিল না। থাকলে চোখে পড়ত। কিংবা হয়তো ছিল, তার চোখে পড়ে নি। চোখে পড়ার ক্ষমতা কমে গেছে। বাৰ্ধক্য গুণনাশিনী।

এই যুবকের মধ্যে বিশেষ কিছু কি আছে যা দিয়ে তাকে আলাদা করা যায়? identification Mark, পাসপোর্টে যেমন লেখা থাকে, অবশ্যই আছে। থাকতে হবে! পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই আলাদা। প্রতিটি মানুষের আঙুলের ছাপ আলাদা। একজন মানুষের আঙুলের ছাপ পৃথিবীর জীবিত বা মৃত কোনো মানুষের সঙ্গে মিলবে না! গায়ের গন্ধ দিয়েও মানুষকে আলাদা করা যায়। প্রতিটি মানুষের গায়ের গন্ধ আলাদা। কুকুর মানুষকে তার চেহারা বা কাপড়-চোপড় দিয়ে চেনে না, চেনে গায়ের গন্ধ দিয়ে।

মিসির আলির চোেখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে। আধ্যাত্মিক ক্ষমতাধর যুবক কি যাবার আগে তাঁকে হিপনোটাইজি করে গেছে? সন্ধ্যাকেলায় তার কখনো ঘুম আসে না। আজ কেন আসছে? মিসির আলি কয়েকবারই চেষ্টা করলেন ঘুমের ঘোর থেকে উঠে আসতে। পারলেন না। তার চোখের পাতায় কেউ যেন অম্বাইক গাম লাগিয়ে দিয়েছে।

ঘুমাচ্ছেন?

মিসির আলি চোখ মেললেন। বাড়িওয়ালার ভাগ্নি তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা আজ শাড়ি পরেছে। শাড়িতে তাকে শুধু যে বড় লাগছে। তাই না, সুন্দরও লাগছে। কিছুটা সাজগোছও করেছে। গোসল করে চুল বেঁধেছে। চোখে কাজল দিয়েছে। গলায় সোনার চেইন চিকচিক করছে। দুই হাতে সোনার চুড়ি। পায়ের লাল স্যান্ডেল জোড়াও মনে হয় নতুন। চোখে কাজল দেয়ার জন্য হয়তো-চোখের দিকে তাকালে মায়া-মায়া ভাব হচ্ছে। চোখে কাজল পরলে মায়া ভাব আসে কেন? কালো রঙের সঙ্গে কি মায়া সম্পর্কিত?

তোমার কী খবর রেবু?

জি ভালো। আপনি অসময়ে চেয়ারে বসে ঘুমুচ্ছিলেন কেন? শরীর খারাপ?

ঘুমাচ্ছিলাম না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলাম।

আমি কি বসবা আপনার সামনের চেয়ারটায়?

বস।

আমি যে প্রায়ই এসে আপনাকে বিরক্ত করি আপনি বিরক্ত হন না তো?

না, আমি বিরক্ত হই না। তা ছাড়া তুমি প্রায়ই আস না তো। হঠাৎ হঠাৎ আস।

মেয়েটা মাথা দুলিয়ে বলল, আমি রোজই আসি। সব দিন আপনার সঙ্গে কথা বুলি না। ধারাহ্মা থেকে অ্যাবাউট টার্ন করে চলে যাই। আপনার কাছে আসি না। মামার কারণে আসি না। বারবার আপনার এখানে আসতে দেখলে মামা হয়তো অন্য কিছু ভেবে বসবে।

মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, কী ভাববে?

রেবু শান্ত গলায় বলল, ভাববে আপনার সঙ্গে আমার প্রেম হয়ে গেছে।

রেবু চেয়ারে বসল। মিসির আলি মেয়েটির কথায় হকচকিয়ে গেলেও নিজেকে সামলালেন। চেয়ারে বসার ভঙ্গি খুব ভালো করে লক্ষ করলেন। সব মানুষ একভাবে চেয়ারে বসে না। একেকজন একেকভাবে বসে। কেউ ধাপ করে বসে পড়ে। কেউ বসে নরম ভঙ্গিতে। যেন চেয়ারে বসছে না, কারো কোলে বসছে।

রেবু বলল, আজ আমাকে খুব সুন্দর লাগছে না?

হুঁ, লাগছে।

আপনার ঘরে আলো কম তো, এই জন্য ঠিকমতো দেখতে পারছেন না। আজ আমাকে ফরাসাও লাগছে।

ও, আচ্ছা!

আজ আমি এত সাজগোছ করেছি। কেন, বলুন তো?

বুলতে পারছি না।

কী আশ্চৰ্য, বলতে পারছেন না কেন? আমার মামার ধারণা আপনার অসম্ভব বুদ্ধি এবং আপনি সবকিছু বলতে পাবেন! মামা কী বলে জানেন? মামা বলে, আপনি যে কোনো মানুষকে পাঁচ মিনিট চোখের দেখা দেখে বলে দিতে পারেন দুদিন আগে দুপুরবেলা সে কোন তরকারি দিয়ে ভাত খেয়েছিল।

মিসির আলি হেসে ফেললেন। প্লেবুর মামা আজমল সাহেবের তার প্রসঙ্গে উচ্চ ধারণার কথা মিসির আলি জানেন। সেই ধারণা এতটা উঁচুতে তা জানতেন না। মানুষ বাড়িয়ে কথা বলতে ভালবাসে। এই ভদ্রলোক অনেক বেশি ভালবাসেন।

রেবু পা দোলাতে দোলাতে বলল, বলুন তো, আজ দুপুরবেলা আমি কী দিয়ে ভাত খেয়েছি?

মিসির আলি শান্ত গলায় বললেন, ইলিশ মাছ দিয়ে কচুর লতিও রান্না হয়েছিল। তুমি কচুর লতি খাও নি?

রেবু হতভম্ব গলায় বলল, আশ্চর্য কী করে বললেন?

কী করে বললাম সেটা তো আমি বলব না।

প্লিজ বলুন! আমি আপনার পায়ে পড়ি। কথার কথা না। আমি কিন্তু সত্যি আপনার পায়ে ধরব। প্রশ্নের উত্তর না দেয়া পর্যন্ত ছাড়ব না। আমি পাগল টাইপ মেয়ে। যা বলি তা করে ফেলি।

মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, আজ সকালে তোমার মামা যখন বাজার করে ফিরছিলেন তখন আমি বারান্দায় বসা! তোমার মামা বললেন, বাজারে কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। মাছের মধ্যে শুধু ইলিশ। আমি দেখলাম বাজারের ব্যাগে দুটা ইলিশ মাছ! আর কচুর লতি। তুমি একবার বলেছিলে তুমি কচুর লতি খাও না। তোমার গলা কুটকুট করে। কাজেই সব মিলিয়ে-ঝিলিয়ে বলেছি। আমার কোনো আধ্যাত্মিক ক্ষমতা নেই।

আমি প্ৰায় বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম।—আপনার অনেক ক্ষমতা।

মিসির আলি হাসলেন। রেবু বলল, আজ আমি সাজগোছ করেছি। কারণ হলআজ বিকেলে আমাকে দেখতে আসার কথা ছিল। আমাকে বিয়ে দেবার খুব চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রায়ই লোকজন আমাকে দেখতে আসছে।

আজ যাদের দেখতে আসার কথা ছিল তারা দেখতে আসে নি?

উঁহু! খবর পাঠিয়েছে। একটা জরুরি কাজে আটকা পড়েছে বলে আসতে পারছে না, পরে এক সময় আসবে। আমার ধারণা এরা আর কোনোদিনই আসবে না।

এরকম ধারণা কেন?

বিয়ের কথাবার্তা হলে সবাই মেয়ে সম্পর্কে গোপনে খোঁজখবর করে। এরাও আমার সম্পর্কে খোঁজ করে ভয়ঙ্কর খবরটা জেনে ফেলেছে। আমার জীবনে একটা ভয়ঙ্কর খবর আছে।

ভয়ঙ্কর খবরটা কী?

রেবু খুব সহজভাবে বলল, আমার যখন ষোল বছর বয়স তখন আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। এক বছরের মতো পাগল ছিলাম। জেনেশুনে কেউ কি আর পাগল বউ ঘরে আনবে?

এখন তো তুমি আর পাগল না?

এখনো পাগল, তবে খুব সামান্য। আচ্ছা আমি উঠি, সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে তো, সন্ধ্যাবেলা আপনার ঘরে বসে থাকলে মামা খুব রাগ করবে। খারাপ কিছু ভাববে। খুব খারাপ কিছু। খুব খারাপ বলতে আমি কী বোঝাতে চাচ্ছি বুঝতে পারছেন তো? অবশ্যই বুঝতে পারছেন। আপনার যা বুদ্ধি!

আবার এস।

আপনাকে বলতে হবে না। আমি আসব। আপনি তো আর জানেন না। আপনি আমাকে যা করতে বলবেন আমি তাই করব। আপনি যদি আমাকে রান্ত তিনটার সময় আসতে বলেন আমি আসব। যদিও স্থানি আপনি সেটা কখনো করবেন না।

মিসির আলি হতাশ ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন। রেবু ঠিকই বলেছে তার পাগলামি পুরোপুরি সারে নি। এখনো বেশ খানিকটা আছে।

রেবু বলল, আচ্ছা কিছুক্ষণ আগে একটা লোক এসেছিল। আপনার কাছে। সে কে?

তার নাম মনসুর।

লোকটা অনেকক্ষণ আপনার কাছে ছিল।

হুঁ।

কে আপনার কাছে আসে, কখন আসে, কতক্ষণ থাকে।—সব আমি খেয়াল রাখি।

ও আচ্ছা!

লোকটা কিন্তু ভালো না। আপনি ওকে আপনার কাছে আসতে নিষেধ করে দেবেন।

লোকটা ভালো না বুঝলে কী করে?

সে যখন চলে যাচ্ছিল তখন আমি দোতলায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। লোকটা আমার দিকে তাকাল। খুব খারাপভাবে তাকিয়েছিল। আপনি অবশ্যই তাকে এখানে আসতে নিষেধ করে দেবেন।

আচ্ছা।

যদি দেখি সে আবারো আপনার কাছে এসেছে তাহলে আমি কিন্তু খুব রাগ করব। আজ যাই?

আচ্ছা।

আপনার জন্য কি চা বানিয়ে ফ্লাঙ্কে করে পাঠিয়ে দেব?

না, দরকার নেই।

অবশ্যই দরকার আছে। সন্ধ্যাবেলা মানুষের চা খেতে ইচ্ছা করে না! আমি চা পাঠিয়ে দেব। ঘরে যদি কোনো খাবার থাকে তাও পাঠাব। মনে হয় নেই। মামাদের বাসায় বিকেলে নাশতা খাবার চল নেই। সন্ধ্যা মিলাতে না মিলান্ত্ৰে সবাই চা খেয়ে ফেলে। যাই হোক, আমি আপনার জন্য চা পাঠাচ্ছি।

আচ্ছা ঠিক আছে।

সুগার পটে আলাদা করে চিনি দিয়ে দেব। কষ্ট করে নিজে মিশিয়ে নেবেন। পারবেন না?

পারব।

রেবু চলে গেল। মিসির আলি মনে মনে হাসলেন। চা পাঠানের কথা, নাশতা পাঠানোর কথা এই মেয়ে আগে অনেকবার বলেছে। চা-নাশতা কখনো আসে নি। আজো আসবে না।

মেয়েটি সম্পর্কে মিসির আলি তেমন কিছু জানেন না। সে চাঁদপুরে থাকে। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে মামার কাছে বেড়াতে এসেছে। মামা মেয়েটির বিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন। রেবু সম্পর্কে এইটুকু তথ্য তাঁর কাছে আছে। আজ তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেকটি তথ্য। ষোল বছর বয়সে মেয়েটি পাগল হয়ে গিয়েছিল। খুবই ভয়াবহ তথ্য। ভয়াবহ কারণ পাগলামিকে এক ধরনের অসুখ বলা হলেও এই অসুখের জাত আলাদা। এই অসুখ মানুষের কনসেন্সকে আক্রমণ করে। কনসেন্স হচ্ছে মানুষের অস্তিত্ব। যে অসুখ অস্তিত্বের শিকড় ধরে টান দেয়। সেই অসুখ অসুখ না, অন্য কিছু।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মিসির আলি চেয়ারে বসে আছেন। তার মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা। যেন কোনো একটা জটিল হিসেব মিলছে না।

জটিল হিসেবের ব্যাপারটা আসছে। কেন তাও বুঝতে পারছেন না। আজ সারা দিন তিনজন মানুষের সঙ্গে কথা হয়েছে-রেবুর মামা, মনসুর এবং বেবু। এরা এমন কিছু কি করেছে যা তিনি সারা দিন ধরতে পারেন নি।–তার অবচেতন মন ধরে ফেলেছে। এবং অবচেতন মন চেতন মনের কাছে একটু পরপর খবর পাঠাচ্ছে। অবচেতন মন খবর পাঠায় নানা ধরনের প্রতীকের মাধ্যমে, ধাঁধার মাধ্যমে। সেই সব প্রতীক এবং রিডলস ডিকোড করার দায়িত্ব চেতন মনের। চেতন মন তা করতে পারছে না।

আচ্ছা, এক এক করে। ধরা যাক। প্রথমে রেবুর মামা-আজমল সাহেব।

আজমল হোসেন

বয়স চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ। রোগী! সামান্য ইস্পানির মতো আছে। জর্দা দিয়ে প্রচুর পান খান! ব্যবসায়ী মানুষ বাড়ি ভাড়া দেন। কর্ম টাইপ! সারা দিন কাজ করেন। রাত দশটার মধ্যে শুয়ে পড়েন। ব্যবসায়ীদের কখনো সুনিদ্রা হয় না। তার হয়। মোটামুটি রুটিনে বাধা জীবন। সপ্তাহে তিন দিন বাজার করেন। বুধ, শুক্র, রবি। রবিবারে আমিন বাজার থেকে গরুর মাংস কেনেন। বৃহস্পতিবার রাতটা ধর্ম-কর্মের জন্য আলাদা করা। সেদিন সন্ধ্যায় কাকরাইল মসজিদে যান মাগরেবের নামাজ পড়তে। নামাজ শেষ করে বাসায় ফিরে এসে স্ট্রর স্বাড়ির ছাদের ঘরে জিকির করেন। মিসির আলি এক বছর হল এ বাড়িতে সাবলেট থাকেন। এক বছর রুটিনের ব্যতিক্রম হতে দেখেন নি।

মনসুর নামে যুবকটির কথা ভাবা যাক। মনসুর কি তার আসল নাম? কেন জানি মনে হয় মনসুর তার আসল নাম না। কেন জানি মনে হচ্ছে আবার কী? অকারণে মানুষের কিছু মনে হয় না। প্রতিটি মনে হবার পেছনে কোনো না কোনো কারণ থাকতে হবে। মনসুর যুবকটির আসল নাম না এটা মনে হবার কারণ কী? মনসুর শব্দটা সে অদ্ভুত ভালো উচ্চারণ করছে এইটা কি কারণ? সেই দুই সিলেবলেই বলে মন সুর। মনসুর যদি যুবকটির নাম হতো তা হলে সে এক সিলেবলেই উচ্চারণ করত। শব্দটির সঙ্গে সে খুব পরিচিত নয় বলেই…

যুক্তিটা মিসির আলির পছন্দ হচ্ছে না। ভাসা ভাসা যুক্তি। মনে হচ্ছে তিনি জলের উপর ওড়াউড়ি করছেন। জল স্পর্শ করতে পারছেন না।

বাইরে ঝুম ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে

রাত দশটা।

বাইরে ঝুম ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। মিসির আলি বাড়ির যে অংশে থাকেন তার বারান্দায় টিনের চালা। বৃষ্টির শব্দ সেই কারণেই স্পষ্ট। বাড়ির সঙ্গে কোনো বড় গাছ থাকলে গাছের পাতায় বৃষ্টি হতো। গাছের পাতায় পড়া বৃষ্টির শব্দও অদ্ভূত হয়। কিছুক্ষণ শুনলে নেশা ধরে যায়।

বৃষ্টির সঙ্গে বাতাস হচ্ছে। বেশ ভালো বাতাস। বাতাসের জন্য বৃষ্টি পড়ার একটানা শব্দে হেরফের হচ্ছে। কখনো বাড়ছে, কখনো হঠাৎ করে মিলিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কনসার্ট শুনছেন।

দুবার ইলেকট্রসিটি যাই যাই করেও যায় নি। এখন তৃতীয় বারের মতো যাই যাই করছে। ভোল্টেজ নেমে গেছে! একশ পাওয়ারের বালু থেকে দশ পাওয়ারের মতো আলো আসছে। মিসির আলি তাকিয়ে আছেন বাম্বের দিকে। বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টির শব্দ যেমন ওঠা-নমা করছে, বাম্বের আলোও ওঠা-নামা করছে। বালের কাছেই পেটমোটা একটা টিকটিকি। সে শিকার ধরার চেষ্টা করছে! বাল্লের আলোর ওঠা-নামার কারণে তার মনে হয় বেশ অসুবিধা হচ্ছে। সে ঠিকমতো নিশানা করতে পারছে না। শিকার আটকাতে পারছে না। নিম্নশ্রেণীর কীটপতঙ্গরা ব্ৰাণনির্ভর জীবনযাপন করে। আলোর ওঠা-নমায় টিকটিকির অসুবিধা হবে কেন? সে ভরসা করবে তার ঘ্রাণশক্তির উপর। মিসির আলি বালু থেকে তার দৃষ্টি পুরোপুরি টিকটিকিটার উপর নিয়ে এলেন। বেশ উত্তেজনাময় দৃশ্য। টিকটিকিটা পোকা নিয়ে খেলছে না পোকা টিকটিকি নিয়ে খেলছে। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। পোকাটা উড়তে পারে। তার উচিত উড়ে গিয়ে নিরাপদ কোনো জায়গায় গিয়ে বসা। সে তা করছে না। আলোর পাশেই ওড়াউড়ি করছে। সে কি জানে আলোর প্রতি এই তীব্র আকর্ষণের কারণেই তার মৃত্যু হবে! মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও আলোর মায়া সে ত্যাগ করতে পারছে না।

মানুষ কীটপতঙ্গ নয় বলেই তার চিন্তাভাবনা অন্য রকম। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও সে অন্ধকারের মায়া ত্যাগ করতে পারে মা। মানুষ কি ভালবাসে অন্ধকার। কীটপতঙ্গ আলো ভালবাসে।

মিসির আলির ভুরু কুঞ্চিত হল। তাঁর হঠাৎ করে কেন যেন মনে হল মানুষ অন্ধকার ভালবাসে। মানুষ আলোর সন্তান। সে সব সময় আলো ভালবেসেছে। অন্ধকার ভালবেসেছে এমন মানুষের সংখ্যা অতি নগণ্য।

বাল্ব্বের পাশে পোকাটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। খাদক জয়লাভ করেছে খাদ্য পরাজিত। মিসির আলি চিন্তিত বোধ করছেন। এরকম বৃষ্টি আরো ঘণ্টাখানেক হলে ঘরে পানি ঢুকে যাবে। নর্দমার দুর্গন্ধ পানি একসময় নেমে যাবে কিন্তু গন্ধ থেকে যাবে।

দরজায় খটখট শব্দ হচ্ছে। মিসির আলি কে? বলে চিৎকার দিলেন না। কারণ দরজা কে খটখট করছে তিনি জানেন। বাড়িওয়ালা! এই ভদ্রলোক কড়া নাড়েন না-কড় ধরে হ্যাচক টান দেন। কড়া খুলে আনতে চান। হ্যাচকা টান দিয়ে কড়া নাড়তে তিনি আগে কাউকে দেখেন নি।

মিসির আলি দরজা খুলে বিস্মিত হয়ে বললেন, কী ব্যাপার?

আজমল সাহেবব মাথায় ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, আপনার টেলিফোন। খুব নাকি জরুরি। আসুন তো।

মিসির আলি বিস্মিত হলেন। বাড়িওয়ালার টেলিফোন নাস্বার তিনি কাউকে দেন নি। তিনি নিজেই জানেন না, কাজেই নাম্বার অন্যকে দেয়ার প্রশ্ন আসে না। জরুরি টেলিফোন মানে অসুখবিসুখ। মিসির আলির পরিচিত এমন কেউ নেই যার অসুখে জরুরি ভিত্তিতে তার খোঁজ পড়বে।

আজমল সাহেব বললেন, দেরি করছেন কেন, চলুন।

মিসির আলি বললেন, টেলিফোন ধরতে ইচ্ছা করছে না। তাদের বলুন আমি শুয়ে পড়েছি। মিথ্যা বলা হবে না। কারণ, আমি শুয়ে ছিলাম।

খুবই জরুরি কল। জরুরি না হলে ঝড়বৃষ্টির রাতে কেউ কল করে?

মিসির আলি অনিচ্ছার সঙ্গে পাঞ্জাবি পায়ে দিলেন। তখনই ইলেকট্রসিটি চলে গেল। পাঞ্জাবি উল্টা হয়েছে। পকেট ভেতরের দিকে চলে গেছে। পাঞ্জাবি ঠিক করতে ইচ্ছা হচ্ছে না। আজমল সাহেব সাবধানী মানুষ ইলেকট্রসিটি থাকা সত্ত্বেও তিন ব্যাটারির একটা টর্চ সাথে নিয়ে এসেছেন। টৰ্চটা এখন কাজে আসছে।

আঞ্জামাল সাহেব বললেন, দরজায় তালা না দিয়েই রওনা হচ্ছেন। তালা দিন।

এখন তালা খুঁজে পাব না।

টাৰ্চটা নিয়ে খুঁজে বের করুন। ঘর খোলা রেখে যাবেন নাকি?

অসুবিধা নেই।

অবশ্যই অসুবিধা আছে। আমি প্রায়ই লক্ষ করেছি। দরজায় তালা না দিয়ে আপনি বাইরে যান। এটা ঠিক না। পাঞ্জাবিও দেখি উল্টা পরেছেন। পাঞ্জাবি ঠিক করে পরুন। মেয়েরা উন্টা শাড়ি পরলে নতুন শাড়ি পায়। ছেলেরা উল্টা কাপড় পরলে অসুখে পড়ে। এটা পরীক্ষিত সত্য।

আজমল সাহেবের বসার ঘরে টেলিফোন। সেখানেই বাড়ির মেয়েরা ভিসিআরো ছুবি দেখছে। ইলেকট্রসিটি নেই। এদের জেনারেটরও নেই। তারপরেও টিভিভিসিআর চলছে কী করে! দর্শকরা মিসির আলির দিকে তাকাল। তিনি সংকুচিত বোধ করলেন। অকারণে এতগুলো মানুষের বিরক্তি তৈরি করা। টেলিফোন না ধরলেই হতো! টেলিফোন নিয়ে যে দূরে চলে যাবেন সে উপায় নেই। কথাবার্তা ভিসিআরের দর্শকদের সামনেই বলতে হবে।

হ্যালো।

মিসির আলি সাহেব কথা বলছেন?

জি।

আমাকে চিনতে পারছেন?

জি না।

গলার স্বরটি কি চেনা মনে হচ্ছে না?

আমি টেলিফোনে গলার স্বর চিনতে পারি না।

আপনাদের দিকে কি বৃষ্টি হচ্ছে?

হুঁ হচ্ছে।

ক্যাটস অ্যান্ড ডগস, মুষলধারে?

হ্যাঁ, মুষলধারে।

আপনাদের ওদিকে ইলেকট্রসিটি চলে গেছে না আছে?

মিসির আলি জবাব দিলেন না। টেলিফোনে একজন পুরুষ কথা বলছে। সে তার গলার স্বর বদলানোর চেষ্টা করছে। গলা ভূগরী করে কথা বলছে। এটা কোনো জরুরি কল না। লুইসেন্স কল। মানুষকে বিরক্ত করে আনন্দ পাওয়ার জন্য এ ধরনের টেলিফোন করা হয়। টেলিফোনের এক পর্যায়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা থাকে।

মিসির আলি সাহেব?

জি।

আমি আপনার খুবই পরিচিত একজন।

ভালো।

আপনি কি আমার উপর বিরক্ত হচ্ছেন?

বিরক্ত হচ্ছি। আপনি অকারণে কথা বলে যাচ্ছেন। মূল কথাটা বলুন।

মূল কথা অবশ্যই বলব। কথাটা ভয়াবহ বলে সামান্য সময় নিচ্ছি। আচ্ছা আপনি কি অপরিচিত মানুষের কথা বিশ্বাস করেন?

কী বলতে চাচ্ছেন বলুন। আমি টেলিফোন রেখে দেব।

আমি টেলিফোন করেছি আপনাকে সাবধান করার জন্য। আপনি একটা ভয়ঙ্কর বাড়িতে বাস করছেন।

ও আচ্ছা।

রেবু নামের একটা মেয়ের সঙ্গে আপনার পরিচয় হয়েছে না? অল্পবয়সী মেয়ে তার মামার বাসায় থাকতে এসেছে। এই মেয়ে একটা ভয়ঙ্কর মেয়ে।

কোন অৰ্থে?

সৰ্বঅর্থে। মেয়েটা খুনি।

আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না?

মিসির আলি বললেন, আপনার কথা কি শেষ হয়েছে?

প্রায় শেষ। মেয়েটা তার স্বামীকে আর তিন মাস বয়সী মেয়েকে খুন করেছে। পুলিশি মামলা হয়। অবশ্য মেয়েটা ছাড়া পায়। মেয়েটা তার মাকেও খুন করেছে। এখন যে বাড়িতে আছে সে বাড়ির কেউ না কেউ অবশ্যই খুন হবে। কিন্তু কেউ কিছু ধরতে পারবে না। আপনি এসব বিষয় নিয়ে কাজ করেন। আপনাকে এই কারণেই জানালাম।

আচ্ছা।

মেয়েটি যে তার স্বামী-সন্তানকে খুন করেছে সেটি নিয়ে কাগজে নিউজ হয়েছিল তার কাটিং আমি পোষ্ট করে আপনার ঠিকানায় পাঠিয়েছি। দু-একদিনের মধ্যে পাবেন। স্যার, আমার কথা কি আপনার কাছে মিথ্যা বলে মনে হচ্ছে?

মানুষের কথা আমি চট করে বিশ্বাস করি না। আবার অবিশ্বাসও করি না।

স্যার, আপনি কি আমাকে এখনো চিনতে পারেন নি?

চিনতে পেরেছি। তুমি মনসুর।

জি। কে খুন হবে বলব স্যার?

মিসির আলি রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। ভিসিআর দর্শকদের মধ্যে রেবু বসে আছে। সে তাকিয়ে আছে মিসির আলির দিকে। মিসির আলির চোখে চোখ পড়তেই সে চোখ ফিরিয়ে নিল। মেয়েটি তাকে চিনতে না পারার ভঙ্গি করছে। কিংবা এও হতে পারে খুব ভালো কোনো ছবি চলছে। মেয়েটা ছবি থেকে চোখ সরাতে পারছে। না। তার সমস্ত মনোযোগ টিভি পর্দায়। মানুষ একসঙ্গে দুজায়গায় মনোযোগ দিতে পারে না। মেয়েটিকে ভয়াবহ খুনি বলে মনে হচ্ছে না। সহজ-সরল মুখ। যে ভঙ্গিতে বসে আছে তার মধ্যেও আরামদায়ক আলস্য আছে।

মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। আজমল সাহেব বললেন, চা খেয়ে যান। চা দিতে বলেছি। রাতের খানা কি হয়েছে?

জি হয়েছে।

নিজেই রেঁধেছেন?

জি।

আপনার জন্য একটা কাজের মেয়ে আনতে বলেছি। ময়মনসিংহের দিকে আমার কর্মচারীরা যায়। ওদের বলেছি। একজন আনতে। ময়মনসিংহের কাজের মেয়ে ভালো হয়।

তাই নাকি?

জি একেকটার জন্য একেক জায়গা। মাটিকাটা লেবারের জন্য ভালো ফরিদপুর। অফিসের পিয়ান-দারোয়ানের জন্য রংপুর। আর কাজের মেয়ের জন্য ময়মনসিংহ।

আমি এইভাবে কখনো বিবেচনা করি মা।

টেলিফোনে কোনো দুঃসংবাদ পেয়েছেন নাকি?

জি না।

যেভাবে আপনাকে চেয়েছিল, ভাবলাম দুঃসংবাদ।

মিসির আলি চা খেলেন। পান খেলেন। পানে প্রচুর জুর্দা ছিল বলে মাথা ঘুরতে লাগল। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ভাই সাহেব আজ যাই।

আজমল সাহেব বললেন, যাই-যাই করছেন কেন? ইলেকট্রসিটি আসুক তারপর যাবেন! বসেন ছবি দেখেন। নতুন ইউপিএস লাগিয়েছি। কারেন্ট চলে গেলে দুইতিন ঘণ্টা টিভি চলে, ফ্যান ঘোরে। সায়েন্স ধাই—ধাই করে কোথায় যে চলে যাচ্ছে! পয়সা খরচ করে ইউপিএস লাগিয়ে ভালো করেছি না?

জি, ভালো।

পয়সা থাকলে সবই করা যায়। আমার এক বন্ধু গাজীপুর জঙ্গলে বাড়ি বানিয়েছে। সেখানেও সে সোলার এনার্জির ব্যবস্থা করেছে। সূর্যের আলো থেকে সোলার প্যানেল দিয়ে ইলেকট্রসিটি।

তাই নাকি?

আপনাকে একদিন নিয়ে যাব, অবশ্য আপনাকে কোথাও যেতে দেখি না। যখনই দেখি-হাতে বই! এত পড়লে চোখের তো বারোটা বেজে যাবে। চোখের ক্ষতি যখন হয়েছে, আরেকটু হোক। আসুন ছবি দেখি।

মাঝখান থেকে দেখলে কি ভালো লাগবে?

হিন্দি ছবি যে কোনো জায়গা থেকে দেখা যায়। হিন্দি ছবির আগা-মাথা বলে কিছু নেই।

মিসির আলিকে ছবি দেখতে হল। মনে হচ্ছে ভ্ৰাতৃপ্ৰেম বিষয়ক কাহিনী। দুই ভাইয়ের একজন পুলিশ অফিসার, অন্যজন দুর্ধর্ষ খুনি। তবে খুনি হলেও সে সমাজসেবক। দুষ্ট লোকের যম। পুলিশ তাই ধরতে চেষ্টা করছে দুর্ধর্ষ ভাইকে। এদিকে আবার একই মেয়ে দুই ভাইকে ভালবাসে। কাউকে বেশি বা কাউকে কম না। দুজনকেই সমান সমান। দুজনকেই সে বিয়ে করতে চায়।

আজমল সাহেব বললেন, গল্পটা কোনো সমস্যাই না। দুই ভাইয়ের একজন মারা যাবে। যে বেঁচে থাকবে মেয়েটার বিয়ে হবে তার সঙ্গে। সবই ফর্মুলা।

মিসির আলি এখন আগ্রহ নিয়েই ছবি দেখছেন-ফর্মুলা ব্যাপারটা সত্যি কি না। জানতে চান। সবই ফর্মুলা এই বাক্যটি তাঁর পছন্দ হয়েছে। আসলে তো সবই ফর্মুলা। পৃথিবী ফর্মুলা মতো তার উপর ঘুরছে। ফর্মুলা মতোই আসছে শীত গ্ৰীষ্ম বর্ষা হেমন্ত। তরুণ-তরুণী বিয়ে করছে। ফর্মুলা মতো তাদের ঘরে সন্তান আসছে। সবই ফর্মুলা।

মিসির আলি সাহেব।

জি।

আপনার ঘরে তো টিভি-ভিসিআর কিছুই নাই। ছবি যখন দেখতে ইচ্ছা করবে চলে আসবেন।

জি আচ্ছা।

আপনাকে আমি পরিবারের একজন বলে মনে করি। আপনি একা একা থাকেন, খুবই মায়া লাগে।

মিসির আলি ছবির দিকে মন দিতে পারছেন না। বাড়িওয়ালা ক্ৰমাগত কথা বলে যাচ্ছেন। তবে এ বাড়ির অন্যদের তাতে অসুবিধা হচ্ছে না। তারা আজমল সাহেবের ধারাবাহিক কথা বলার মধ্যেও ছবি দেখতে অভ্যস্ত।

মিসির আলি সাহেব!

জি।

বিয়ে-শাদির কথা কি কিছু ভাবছেন? পুরুষ মানুষ যে কোনো বয়সে বিবাহ করতে পারে। হাসান-হোসেনকে মোরল যে ইয়াজিদ তার পিতা আশি বছর বয়সে বিবাহ করেছিলেন। বিষাদসিন্ধুতে পড়েছি। মারাত্মক বই। বিষাদসিন্ধু পড়েছেন?

জি।

কত বার পড়েছেন?

একবারই পড়েছি।

আমি সময় পেলেই পড়ি। প্রথম পড়েছিলাম। অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র থাকার সময়, শেষ পড়েছি গত রমজানে। নোবেল প্রাইজ পাওয়ার মতো বই। ঠিক কি না বলুন তো?

মিসির আলি কিছু বলার আগেই রেবু বলল, মামা চুপ করে তো। তোমার কথার যন্ত্রণায় উনি ছবিটা ঠিকমতো দেখতে পারছেন না। মানুষ এত কথা বলতে পারে, উফ।

ভাগ্নির কথায় আজমল সাহেব রাগ করলেন না। বরং খুশি খুশি গলায় বললেন, রেবু, ইয়াজিদের বাবার নাম তোর মনে আছে? তুই তো বিষাদসিন্ধু পড়েছিস।

ইয়াজিদের বাবার নাম মোয়াবিয়া।

ও আচ্ছা মোয়াবিয়া, এখন মনে পড়েছে।

মামা চুপ করে থাক। ছবি এখন শেষের দিকে চলে এসেছে। হাই টেনশন।

আজমল সাহেব চুপ করলেন। মিসির আলি গভীর মনোযোগে ছবি দেখছেন। আজমল সাহেবের কথাই সত্যি হয়েছে। খুনি-ভাই পুলিশ-ভাইযের হাতে মারা গিয়েছে। শেষ দৃশ্যে পুলিশ-ভাইয়ের সঙ্গে মেয়েটির বিবাহ। বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী খুনি-ভাইয়ের বিশাল একটা অয়েল পেইনটিংয়ের সামনে দাঁড়িয়েছে। দুজনের চোখেই পানি। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে অয়েল পেইনটিংয়ের চোখেও অশ্রু টলমল করছে।

দর্শকদের মধ্যে রেবুর চোখেও পানি। শুধু আজমল সাহেবের মুখভর্তি হাসি। তিনি মিসির আলির দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, বলেছিলাম না ফর্মুলা মতো কাহিনী শেষ হবে!

মিসির আলি বললেন, তাই দেখলাম। আজ উঠি।

ছাতা নিয়ে যান। বাইরে এখনো বৃষ্টি হচ্ছে।

মিসির আলি ছাতা হাতে নিলেন। আজমল সাহেব বললেন, কাজের ছেলেটাকে পাঠাচ্ছি। তার হাতে ছাতাটা দিয়ে দেবেন। আপনি যে মানুষ, দেখা যাবে ঘরের বাইরে ছাতা রেখে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। ভালো কথা, আগামী বিষ্যুদবার রাতটা ফ্রি রাখবেন। আমার পীর ভাই আসবেন। হালকা-জিকির হবে। দেয়া করা হবে। পীর ভাই কোরানে হাফেজ। তাঁর ক্ষমতা মারাত্মক।

কী ক্ষমতা?

বাতেনি ক্ষমতা। এইসব আপনারা বুঝবেন না। সায়েন্স দিয়ে এই জিনিস বোঝা যায় না। পীর ভাইকে আমি আপনার সঙ্গে পরিচয় কবিয়ে দিব। ঠিক আছে?

মিসির আলি নিজের ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তিনটা ঘটনা ঘটল। বৃষ্টি থেমে গেল, ইলেকট্রসিটি চলে এল এবং মিসির আলির ভয় করতে লাগল। তাঁর মনে হল, কেউ একজন বাড়িতে হাঁটাইটি করছে। এরকম মনে করার কোনোই কারণ নেই। যদি ঘর অন্ধকার থাকত তা হলে ভয় পাওয়ার ব্যাপারটার ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যেত। ঘরে আলো আছে! মিসির আলি যে দুর্বল মনের মানুষ তাও না। অশরীরী কোনো কিছুতেই তাঁর বিশ্বাস নেই। তা হলে ভয়টা তিনি পাচ্ছেন কেন?

রান্নাঘরে খুঁটিখাট খুঁটিখাট শব্দ হচ্ছে। কেউ কি আছে রান্নাঘরে? রান্নাঘরে বাতি জুলছে না। অশরীরী কেউ অন্ধকারে রান্নাবান্না করছে নাকি? মিসির আলি রান্নাঘরে ঢুকলেন। বাতি জ্বালালেন। কেউ নেই। তিনি বাতি জ্বালিয়ে রেখেই শোবার ঘরে ঢুকলেন। মনে হচ্ছে আজ রাতে ঘুম আসবে না। ঘুম যখন আসবেই না। শুধু শুধু বিছানায় গড়াগড়ি করার কোনো অর্থ হয় না। তার চেয়ে বিছানায় পা তুলে বসে জটিল কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করা যায়।

চিন্তা করার মতো জটিল বিষয় এই মুহুর্তে তার কাছে আছে। একটু আগে যে ছবিটা দেখেছেন সেই ছবির একটা বিষয়ে বড় ধরনের খটকা তাঁর মনে তৈরি হয়েছে। ছবির গুণ্ডা-ভাইট যখন গুলি খেল তখন তিনি দেখেছেন গুণ্ডাটার হাওয়াই শার্টের তিন নম্বর বোতামটা নেই। অথচ গুণ্ডাটা যখন তার প্রেমিকার কোলে মাথা রেখে মারা যাচ্ছে তখন দেখা গেল। তিন নাম্বার বোতামটা ঠিকই আছে। এটা কী করে সম্ভব? গুলি খাওয়া গুণ্ডাটার সেবা না করে প্রেমিকা মেয়েটি কি শার্টের বোতাম লাগিয়েছে? খুবই অবিশ্বাস্য ব্যাপার। তবে যদি এমন কোনো লোকজ বিশ্বাস থাকে যে মৃত্যুপথযাত্রীর শার্টের বোতাম না থাকা অলক্ষণ, তা হলে একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করা যায়। মেয়েটা অলক্ষণের কথা বিবেচনা করে কোনো এক ফাঁকে শার্টে বোতাম লাগিয়েছে। মৃত্যুপথযাত্রীদের নিয়ে অনেক কুসংস্কার কাজ করে। যেমন মৃত্যুপথযাত্রীর ঘরে কোনো পাখি ঢুকে পড়া বিরাট অলক্ষণ। গ্লাস থেকে পানি পড়ে যাওয়া অলক্ষণ। জুতা বা স্যান্ডেল উল্টে যাওযা গুপ্তফণ। শার্টের বোতাম না থাকাও হয়তো অলক্ষণ।

মিসির আলি গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন।

মেয়ের নাম আঁখিতারা

মেয়ের নাম আঁখিতারা।

নেত্রকোনার অতি অজপাড়াগাঁর মেয়ের জন্য খুবই আধুনিক নাম। বয়স দশ থেকে এগারো। শশকের মতো ভীত চোখ। মিসির আলি ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেললেন। তার কাছে মনে হলো মেয়েটি রবীন্দ্ৰনাথের ‘পোস্টমাস্টার’-এর মেয়েটির চেয়েও অসহায়। ‘পোস্টমাস্টার’-এর মেয়ে ছিল নিজের গ্রামে। এই মেয়েটি হঠাৎ উঠে এসেছে অতি আধুনিক এক শহরে। আজমল সাহেব মিসির

মেয়েটির ভয় কাটানো দরকার। এমন কি তাকে বলা দরকার যা শোনামাত্র তার ভয় কেটে যায়। এই ঘর তার নিজের ঘর বলে মনে হতে থাকে। মিসির আলি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, ভয় লাগছে গো মা?

মেয়েটি সামান্য চমকাল। মিসির আলি তার চোখ দেখেই বুঝলেন মেয়েটির প্ৰাথমিক ভয় কেটে গেছে। মিসির আলি বললেন, আঁখিতারা, শোনো, তোমার যখনই দেশের বাড়িতে চলে যেতে ইচ্ছা করবে। আমি তখনই তোমাকে পাঠিয়ে দেব। এখন কি তোমার বাবা-মার কাছে চলে যেতে ইচ্ছা করছে?

আঁখিতারা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

মিসির আলি বললেন, আচ্ছা, আজ সন্ধ্যার মধ্যে তোমাকে দেশে পাঠিয়ে দেব। আজমল সাহেবকে বলে এর মধ্যে একজন কাউকে জোগাড় করব যে তোমাকে দেশের বাড়িতে দিয়ে আসবে। কেউ মনে কষ্ট নিয়ে আমার সামনে হাঁটাহাঁটি করলে আমার ভালো লাগে না। আঁখিতারা, তুমি কি ডাল-ভাত এইসব রাধতে পারো?

পারি।

আমার খুবই ক্ষিদে লেগেছে। গ্যাসের চুলা কীভাবে ধরায় তোমাকে দেখিয়ে দেই। তুমি আমাদের দু’জনের জন্য ডাল-ভাত রান্না করে ফেলো।

আঁখিতারা হ্যাসূচক ভঙ্গিতে ঘাড় কাত করল।

ডিম রান্না করতে পারে?

পারি।

একসেলেন্ট, ঘরে ডিম আছে। ডিমের ঝোল রান্না করো। আজ সকাল থেকে কেন জানি ডিমের ঝোল খেতে ইচ্ছা করছে।

মেয়েটি তার ছোট্ট পুটলি এক পাশে রেখে রান্না শুরু করল। মিসির আলি লক্ষ্য করলেন মেয়েটির চোখ চাপা আগ্রহে চকচক করছে। তার মুখ থেকে শঙ্কার ভাব অনেকটাই চলে গেছে। বেচারির বোধহয় খুব ক্ষিদে লেগেছে। রান্নার আগ্রহটা সেই কারণে।

দুপুরে মিসির আলি তাকে নিয়ে খেতে বসলেন। বেগুন দিয়ে ডিমের ঝোল রান্না হয়েছে। তরকারির রঙ দেখে মনে হচ্ছে খেতে ভালো হয়েছে। আঁখিতারা একটা মাত্র ডিম রান্না করেছে। মিসির আলি বললেন, ডিম একটা কেন?

আঁখিতারা ভয়ে ভয়ে বলল, আপনার জন্য রানছি।

তুমি ডিম খাও না?

আঁখিতারা নিচু গলায় বলল, খাই।

মিসির আলি ডিমটা সমান করে দু’ভাগ করে একটি ভাগ মেয়েটির থালায় তুলে দিলেন। এবং গভীর বেদনায় লক্ষ করলেন মেয়েটির চোখে পানি এসে গেছে। বোধ হয় বেচারীকে কেউ কোনোদিন আদর করে পাতে কিছু তুলে দেয়নি।

আঁখিতারা, তোমার রান্না খুব ভালো হয়েছে। তুমি আরাম করে খাও। খেয়ে বিশ্রাম করো। সন্ধ্যাবেলা আমি তোমাকে তোমার দেশে পাঠিয়ে দেব। মেয়েটি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

দুপুরের খাবারের পর কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকা মিসির আলির অনেক দিনের অভ্যাস। আগে ঘুমাতেন না। ইদানীং ঘুম এসে যায়। ঘুম ভাঙার পর খুবই অস্বস্তি লাগে। কিছুদিন থেকে তিনি চেষ্টা করছেন দুপুরে না ঘুমাতে। এই সময় জটিল ধরনের কিছু বই নিয়ে বসেন। বইয়ের জটিলতার ভেতর একবার ঢুকে পড়লে ঘুম কেটে যায়। ঘুম কাটানোর ওষুধ হিসেবে সায়েন্স অ্যান্ড প্যারাডক্স বইটা খুব কাজ করছে। আজও তাই করেছেন। তবে আজ সায়েন্স অ্যান্ড প্যারাডক্স বইটির সঙ্গে কুরিয়ার সার্ভিসে আসা মফস্বলের একটা পত্রিকাও আছে। প্রেরকের নাম–মনসুর। মেন্টাল ম্যাজিকের যুবক। মিসির আলি ঠিক করেছেন বিজ্ঞানের বই পড়ার পর ঘুম যখন পুরোপুরি কাটবে তখন পত্রিকা নেড়েচেড়ে দেখবেন।

আপনার মাথায় তেল দিয়া দিব?

মিসির আলি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। আঁখিতারা সঙ্কুচির ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি বললেন, লাগবে না। আমি মাথায় তেল দেই না।

আঁখিতারা বলল, আমি যাব না। আমি আপনার সাথে থাকব।

আচ্ছা, ঠিক আছে।

আমি কোন ঘরে থাকিব?

মিসির আলি আঙুল দিয়ে ঘর দেখিয়ে দিলেন। আঁখিতারা বলল, আপনারে আমি কী ডাকব?

তোমার যা ডাকতে ইচ্ছা করে ডাকবে। কোনো অসুবিধা নেই।

বড় বাবা ডাকি? এত কিছু থাকতে বড় বাবা ডাকতে চাও কেন? মেয়েটা জবাব দিল না। পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মেঝেতে নকশা করতে লাগল। মিসির আলি বললেন, বড় বাবা ডাকটা খারাপ না; ডাকো, বড় বাবা ডাকো।

আঁখিতারা সামনে থেকে চলে গেল। মিসির আলি কুরিয়ার সার্ভিসে আসা প্যাকেট খুললেন। মফস্বল পত্রিকা। পত্রিকার নাম সোনার বাংলা। প্রথম পৃষ্ঠাতেই লেখা অনিয়মিত পাক্ষিক। পত্রিকার মালিকই যেখানে ঘোষণা করেন। অনিয়মিত তখন বোঝা যায়। এই পাক্ষিক হঠাৎ হঠাৎ বের হয়। ছয় পাতার পত্রিকার তিন পাতাই সাহিত্যে নিবেদন। কবিতা, গল্প, রম্যরচনা। এক পাতা সিনেমা সংক্রান্তহলিউড-বিচিত্রা, ঢালিউড-বিচিত্রা। পাতাটি সচিত্ৰ। নায়ক-নায়িকাদের ছবি আছে। কোনো ছবি দেখেই বোঝার উপায় নেই ছবিটা কার। পত্রিকার প্রথম পাড়ার লিড নিউজ–

স্বামী-পুত্ৰ হস্তারক স্ত্রী
নিজস্ব সংবাদদাতা জানাচ্ছেন, রাবেয়া খন্দকার ওরফে রেবু হিংসার বশবতী হয়ে স্বামী-পুত্ৰকে হত্যা করেছে। হিংসার কারণ রেবুর স্বামীর আপনি চাচীর সঙ্গে অবৈধ প্ৰেম। নিজস্ব সংবাদদাতা অবৈধ প্রেমের অংশটি যত্ন করে লিখেছেন। ভাতিজা নিশিরাতে চাচীর সঙ্গে কোথায় কোথায় মিলিত হতেন তার বিবরণ আছে। দীর্ঘ দুই কলামের সংবাদ। সংবাদের শেষে লেখা–

‘আগামী সংখ্যায়। চাচী-ভাতিজার অবৈধ প্ৰণয় বিষয়ে আরো বিস্তারিতভাবে লেখা হইবে।’

ছয় পাতার পুরো কাগজটা মিসির আলি আগ্রহ নিয়ে পড়লেন। সাহিত্য অংশও বাদ দিলেন না। চৌধুরী খালেকুজ্জামান মিয়ার লেখা ছোটগল্প পড়লেন। একটি রম্যরচনা পড়লেন। লেখক সেখানে ছদ্মনাম নিয়েছেন চৌখামি। এই চৌখামি যে চৌধুরী খালেকুজ্জামান সেটা বোঝা যাচ্ছে। ইনিই পত্রিকার সম্পাদক এবং মুদ্রাকর।

সোনার বাংলা পত্রিকার সঙ্গে একটি হাতে লেখা চিঠিও আছে। চিঠিটি লিখেছে মনসুর।

পরম শ্রদ্ধাভাজন
জনাব মিসির আলি। সোনার বাংলা পত্রিকাটা পাঠালাম। রেবুর খবরটা প্ৰথম পাতায় আছে। আপনি খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন রাবেয়া খোন্দকারই রেবু।

মেয়েটি অতি ভয়ানক। আপনার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা আছে। আমি ভয় পাচ্ছি। সে আপনার কোনো ক্ষতি না করে ফেলে।

আমি আপনাকে অত্যন্ত পছন্দ করি। মানুষকে বেশি পছন্দ করা ঠিক না। হয়তোবা বেশি পছন্দের কারণেই আপনার সঙ্গে কখনো আমার সম্পর্ক হবে না। আপনাকে সাবধান করতে চাচ্ছি। সাবধান হোন।

ঐদিন মেন্টাল ম্যাজিকের নাম করে আপনাকে বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করেছি।

এই ক্ষমতা আমার সত্যি সত্যি আছে। বিশেষ বিশেষ সময়ে সেটা বোঝা যায়। যদি কখনো বিশেষ সময় এসে উপস্থিত হয় আপনাকে ক্ষমতার পরিচয় দিয়ে যাব। তখন হয়তোবা আপনি আমার আগের

অপরাধ ক্ষমা করবেন।

ইতি
মনসুর।

চিঠিতে তারিখ নেই। ঠিকানা নেই। কোনো বানান ভুল নেই। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এই চিঠি আগে একবার ড্রাফট করা হয়েছে, তারপর সেই ড্রাফট দেখে দেখে কপি করা হয়েছে। সরাসরি লেখা চিঠি এবং কপি করা চিঠি সহজেই বোঝা যায়। কপি করার সময় মূল চিঠি পড়তে হয়। একটি লাইন পড়ে শেষ করে লেখায় আসতে হয়। যে কারণেই ড্রাফট করা চিঠির প্রতি লাইনের শুরুর শব্দটা লেখা হয় সাবধানে।

মিসির আলি ভুরু কুঁচকালেন। মনসুর নামের ছেলেটা ড্রাফট করার পর তাকে চিঠি লিখছে নাকি সরাসরি লিখছে এটা কোনোই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার না। তাকে নিয়ে গবেষণা করার মতো কিছু ঘটেনি। তবুও তার বিষয়ে জানা তথ্যগুলি মাথার ভিতরে সাজিয়ে রাখতে দোষ নেই।

নাম : মনসুর (নকল নাম হওয়ার সম্ভাবনা!)

স্বভাব : ???

স্বভাব সম্পর্কে এখনো পরিষ্কার কোনো ধারণা তৈরি হয় নি। সময় লাগবে। অনেক সময় লাগবে। মিসির আলি চোখ বন্ধ করলেন। পাশের ঘর থেকে খুটাখুটি শব্দ হচ্ছে। আঁখিতারা নামের মেয়েটা হয়তো নিজের ঘর গুছাচ্ছে। ঝাড়ুর শব্দও পাওয়া গেল। মনসুর প্রসঙ্গ থাক। মেয়েটাকে নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবা যাক। মেয়েটা কেমন, কোন ধরনের পরিবার থেকে এসেছে–এইসব। পরে মিলিয়ে দেখা যাবে তাঁর অনুমান কতটুকু শুদ্ধ। এটা এক ধরনের খেলা। মানুষ দুটা সময়ে খেলতে পছন্দ করে। শৈশবে এবং বৃদ্ধ বয়সে। শৈশবে খেলার সঙ্গী জুটে যায়। বৃদ্ধ বয়সে কাউকে পাওয়া যায় না। তখন খেলতে হয় নিজের মনের সঙ্গে।

আঁখিতারার বিষয়ে মিসির আলি অনুমান করতে শুরু করলেন—

১. মেয়েটা দুঃখী। (এই বিষয়টা অনুমান করতে চিন্তাশক্তির প্রয়োজন হয় না। যে মেয়ে গ্রাম থেকে শহরে কাজ করতে এসেছে সে দুঃখী হবেই।)

২. মেয়েটির বাবা নেই। (এই অনুমানও সহজ অনুমান। বাবা জীবিত অবস্থায় এমন ফুটফুটে একটা মেয়েকে শহরে কাজ করতে পাঠাবেন না।)

৩. মেয়েটি তার নিজের সংসারে বাস করে না। আশ্রিত। (একমাত্র আশ্রিতরাই সামান্য আদরে অভিভূত হয়। তিনি অর্ধেকটা ডিম তার পাতে তুলে দিয়েছেন। এতেই তার চোখে পানি এসে গেছে। যে মেয়ে নিজের সংসারে থাকে। সে আব্দর পেয়ে অভ্যস্ত।)

মিসির আলির চিন্তা বাধাগ্ৰস্ত হয়েছে। আঁখিতারা সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে ঠিক আগের মতো করেই বলল, মাথায় তেল দিয়া দেই?

মিসির আলি বললেন, তোমাকে তো আমি একবার বলেছি আমি মাথায় তেল দেই না।

মেয়েটি তারপরেও মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। সে মনে হয় মাথায় তেল দিয়েই ছাড়বে। গ্রামের বাচ্চা একটা মেয়ের তুলনায় জেদ তো ভালোই আছে।

মিসির আলি বললেন, আঁখিতারা, শোনো। তুমি কি তোমার বড় বাবার মাথায় রোজ তেল দিয়ে দিতে?

মেয়েটি খুবই বিস্মিত হলো। অবাক হয়ে মিসির আলির দিকে তাকিয়ে রইল।

মিসির আলি বললেন, কীভাবে বললাম জানো? তুমি আমাকে বড় বাবা ডাকছি। আমার মাথায় তেল দিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। খুব সহজ অনুমান। আচ্ছা, শোনো, তোমার বাবা কি মারা গেছেন না বেঁচে আছেন?

বাঁইচা আছেন।

তুমি কি তোমার বাবার সঙ্গে থাকো?

হুঁ।

তোমার সঙ্গে আর কে থাকে?

আমরা তিন ভইন আর বড় বাবা।

মিসির আলি বললেন, যাও, তেল নিয়ে এসে তেল দাও। কী তেল দেবে? ঘরে তো সয়াবিন তেল ছাড়া কোনো তেল নেই। সয়াবিন তেল কি মাথায় দেয়া যায়?

নারিকেল তেল দিমু। আমি সাথে কইরা আনছি।

তুমি তো দেখি খুবই গোছানো মেয়ে!

মিসির আলির মেজাজ, সামান্য খারাপ হয়েছে। মেয়েটির ব্যাপারে তার বেশিরভাগ অনুমানই ঠিক হয় নি। কেমন কথা? তিনি কি আগের মতো চিন্তা করতে পারছেন না? বৃদ্ধ বয়সের স্থবিরতা তাঁকে গ্রাস করছে? এগিয়ে আসছে মহাশক্তিধর জরা?

মাথায় তেল দেওয়ার ব্যাপারটা এত আরামদায়ক তা তিনি জানতেন না। শারীরিক আরাম পেয়ে তার অভ্যাস নেই। কেউ একজন আরাম দিচ্ছে। আরাম নিতে অস্বস্তি লাগছে। সেই অস্বস্তিটা কাটাতে পারছেন না। কিন্তু আরামটা অগ্রাহ্য করতে পারছেন না। আঁখিতারা মাথায় তেল দিতে দিতে টুকটুক করে কথা বলছে। কথাগুলি যে পরিষ্কার কানে আসছে তা না। তিনি কিছু শুনছেন। কিছু শুনছেন না। মাঝে মাঝে ই হাঁ করে যাচ্ছেন। কথার পিঠে কথা বলছেন। তাকে কথা না বললেও চলত। আঁখিতারা মিসির আলির জন্য অপেক্ষা করছে না। নিজের মনেই কথা বলছে।

আমার ব্যাপজান বাদাইম্যা।

বাদাইম্যাটা কী?

ঘর থাইক্যা চইল্যা যায়, ফিরে না। এক মাস, দুই মাস, তিন মাস পরে ফিরে। চাইর-পাঁচ দিন থাকে, আবার চইল্যা যায়।

সংসার চলে কীভাবে?

চলে না। মা চিড়া কুটে, মুড়ি ভাজে, মুড়ি-লাডভু বানায়। আমি লুচি-লাডভু বানাইতে পারি। আমাকে ভেলিগুড় আইন্যা দিয়েন।

ভেলিগুড়টা কী?

ভেলিগুড় চিনেন না?

না।

কুষার থাইক্যা হয়। কুষার চিনেন?

না।

ইক্ষু চিনেন?

হুঁ। এখন বুঝেছি। আখের গুড়।

আমরা চাইর ভাইনের মধ্যে সবচাইতে সুন্দর যে জন তার নাম নয়নতারা। আমার বড়। তিন বছরের বড়।

তোমাদের সব বোনের নামের শেষেই তারা আছে নাকি?

হুঁ। আমার পরেরটার নাম স্বৰ্ণতারা, তার পরের জনের নাম লজ্জাতারা।

তোমরা দেখি তারা-পরিবার। ভাই হলে কী নাম হতো?

বাপজান সেইটাও ঠিক কইরা রাখছে। ভাই হইলে নাম হইত। তারা মিয়া। হি হি হি…

আঁখিতারার হাসির মধ্যেই মিসির আলি ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের মধ্যেও তাঁর চেতনার কিছু অংশ কাজ করতে লাগল। তিনি স্বপ্নে দেখছেন নৌকায় করে কোথাও যেন যাচ্ছেন। নৌকা খুব দুলছে। নৌকায় কোনো মাঝি নেই। অথচ নৌকা ঠিকই যাচ্ছে। স্বপ্নের ভেতরও তিনি চিন্তিত বোধ করছেন। মাঝি নেই, নৌকা চলছে কীভাবে? স্রোতের অনুকূলে যাচ্ছে? নাকি নৌকায় পাল আছে? পালের নৌকার তো এত দ্রুত যাওয়ার কথা না। নাকি এটা ইনজিনের নৌকা? ইনজিনের নৌকা হলে ভটভট আওয়াজ আসত। কোনো আওয়াজ নেই। শুধুই ঝড়ের শব্দ।

মিসির আলির ঘুম ভাঙল ঠিক সন্ধ্যায়। দুপুরে এত লম্বা ঘুম তিনি এর আগে ঘুমান নি। অসময়ের লম্বা ঘুম শরীর আউলে ফেলে, মাথায় ভোঁতা। যন্ত্রণা হয়। তার হচ্ছে। মাথার এই যন্ত্রণা কমানোর জন্য আবার ঘুমিয়ে পড়তে হয়। ঘুমের যন্ত্রণা ঘুম দিয়ে সারানো।

রান্নাঘরে খুঁটিখাট শব্দ হচ্ছে। আঁখিতারা মনে হয় রান্নাবান্নায় লেগে গেছে। তাকে কয়েকটা জিনিস শেখাতে হবে। চা বানানো। নানা রকম চা। দুধ চা, লিকার চা, আদা চা, মসলা চা, ঠাণ্ডা। চা।

রাত ন’টার দিকে বাড়িওয়ালা আজমল সাহেব বেড়াতে এলেন। তাঁর আসার প্ৰধান উদ্দেশ্য আঁখিতারা কাজকর্ম কেমন করছে খোঁজ নেওয়া। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, কাজের মেয়ে রাখতে হয় মারের ওপর। সকালে একটা থাপ্পড় দেবেন, সারাদিন ভালো থাকবে। মাগরেবের নামাজের পর আবার থাপ্নড়, রাতটা আরামে কাটবে।

মিসির আলি বললেন, মেয়েটা ভালো, থাপ্পড় দিতে হবে বলে মনে হয় না। আজমল সাহেব বললেন, গ্রামের পিচকা মেয়ে কখনো ভালো হয় না। মায়ের পেট থেকে এরা যখন বের হয় তাদের ভালো জিনিস সব মায়ের পেটে রেখে দিয়ে বের হয়। রান্নাবান্না কিছু জানে?

মনে হয় জানে।

রেবুর কাছে পাঠিয়ে দেবেন? দু-একটা আইটেম শিখিয়ে দেবে।

রেবু রান্না জানে?

খুব ভালো রান্না জানে। তার হাতে চিতলের পেটি খেলে বাকি জীবন মনে থাকবে।

মিসির আলি বললেন, রেবুর ভালো নাম কি রাবেয়া? আজমল সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, ভালো নাম রাবেয়া হবে কোন দুঃখে। ভালো নাম শেফালী। রেবু কি বলেছে তার ভালো নাম রাবেয়া?

না।

বলতেও পারে। মাথা ঠিক নাই। কখন কী বলে নিজেও জানে না। আপনাকে বলে নাই তো তার বিবাহ হয়েছে? স্বামী তালাক দিয়ে চলে গেছে?

জি না, এ রকম কিছু বলে নাই।

আজমল সাহেব দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, পাগলামি এমন এক অসুখ একবার হয়ে গেলে কখনো পুরোপুরি সারে না। অসুখের বীজ থেকেই যায়। ঠিকমতো আলো-হাওয়া পেলে বীজ থেকে গাছ হয়ে যায়? ঠিক বলেছি না ভাই সাহেব।

মিসির আলি কিছু বললেন না। আজমল সাহেব হতাশ গলায় বললেন, গত বৃহস্পতিবার সে তার মামীর সঙ্গে আপনাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলেছে।

মিসির আলি বললেন, কী বলেছে?

বলেছে, আপনি নাকি তাকে বলেছেন, দুদিন পরপর তোমাকে দেখার জন্য পাত্ৰ পক্ষের লোকজন আসে। পছন্দ হয় না বলে ফিরত যায়। এত ঝামেলার দরকার কী? আমাকে বিয়ে করে ফেলো। তার মামী আবার তার কথা বিশ্বাসও করে ফেলেছে। মেয়েরা এই জাতীয় কথা দ্রুত বিশ্বাস করে। আমার কানে যখন কথাটা আসল আমি রেবুকে ডেকে কষে এক চড় লাগালাম। রেবু সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করল যে মজা করার জন্য বানিয়ে বানিয়ে এইসব বলেছে।

বলেন কী!

আজমল সাহেব দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, সাধারণ মানুষের কথা এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিতে হয়। পাগলের কথা যে কান দিয়ে শুনবেন সেই কান দিয়েই বের করবেন। এক কান থেকে আরেক কানে যাওয়ার সময় দেবেন না, বুঝেছেন?

মিসির আলি মাথা নেড়ে জানালেন যে বুঝেছেন। আজমল সাহেব হঠাৎ প্ৰসঙ্গ পরিবর্তন করে বললেন, আপনি কি খাজা বাবার ডাক পেয়েছেন?

মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, কার ডাক?

খাজা বাবার, উনার ডাক পেয়েছেন?

আপনি কী বলছেন বুঝতে পারছি না।

আজমল সাহেব বললেন, খাজা বাবা আজমীর থেকে না ডাকলে কেউ আজমীর শরিফ যেতে পারে না। আপনি কখনো আজমীর শরীফে গিয়েছেন?

জি না।

তার মানে ডাক পান নাই। আমি আগামী নভেম্বরে ইনশাল্লাহ। আজমীর যাব। চলেন আমার সঙ্গে। যাবতীয় খরচ আমার। ট্রেনে উঠে যদি একটা পান খেতে ইচ্ছা করে সেই পানটাও আমি কিনে দেব।

মিসির আলি জবাব দিলেন না। আজমল সাহেব বললেন, কথা ফাইনাল। না। করবেন না। আমি দু-তিন বছর অন্তর একবার করে খাজা বাবার কাছে। যাই। সমস্যা নিয়ে যাই। উনার রওজা মোবারকে উপস্থিত হয়ে সমস্যার ফানা চাই। উনি ব্যবস্থা করেন। আজ পর্যন্ত তার কাছে গিয়ে খালি হাতে ফিরত আসিনি।

এইবার কী সমস্যা নিয়ে যাচ্ছেন?

রেবুর সমস্যা নিয়ে যাচ্ছি। তার মাথাটা যেন ঠিক হয়ে যায়। তার একটা ভালো বিবাহ যেন দিতে পারি। ভাইজান, অনেক কথা বলে ফেললাম। আজমীরের ব্যাপারটা যেন মনে থাকে। জবান যখন দিয়ে ফেলেছি তখন আপনাকে নিয়ে যাবই। আর আমার পীর ভাই-এর সঙ্গেও আপনাকে পরিচয় করিয়ে দিব। কথা বললেই বুঝবেন ইনি এই দুনিয়ার মানুষ না। উনাকে আপনার কথা বলেছি। উনিও আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।

আজমল সাহেব উঠে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই মনসুরের আসল নাম কি মিসির আলি ধরে ফেললেন। আজমল সাহেবের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ানোর সঙ্গে মনসুরের আসল নামের কোনো সম্পর্ক নেই। তবু নামের ব্যাপারটা পরিষ্কার হওয়ার ঘটনা। এই সময়ই ঘটল।

মনসুরের আসল নাম চৌধুরী খালেকুজ্জামান মিয়া। সোনার বাংলা পত্রিকার সম্পাদক। চৌধুরী খালেকুজ্জামান মিয়ার লেখা–সম্পাদকীয়, গল্প এবং রম্যরচনা তিনটিতেই বিশেষ একটা শব্দ দিয়ে বাক্য শুরুর প্রবণতা আছে। শব্দটা হলো ‘হয়তোবা’। মনসুর তাকে যে চিঠি লিখেছে সেই চিঠিতেও দুটি বাক্য শুরু হয়েছে হয়তোবা দিয়ে।

সোনার বাংলা পত্রিকার প্ৰিন্টার্স লাইনে পত্রিকার ডিক্লারেশন নাম্বার, রেজিষ্ট্রেশন নাম্বার সবই দেওয়া। বাংলাদেশ সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব ফিল্ম অ্যান্ড পাবলিকেশন-এ টেলিফোন করলে চৌধুরী খালেকুজ্জামান মিয়ার সব খবর বের হয়ে আসবে। ছোট্ট একটা জটি খুললে অনেকগুলি জট খুলে যায়।

রান্নাঘর থেকে আঁখিতারা উকি দিচ্ছে। মিসির আলি বললেন, আঁখিতারা, চা, বানাতে পারে?

আঁখিতারা হাসি মুখে বলল, পারি।

কোথায় শিখেছি?

বাপজান খুব চা খায়।

কড়া করে এক কাপ চা বানাও। চিনি দেবে এক চামচ। সমান সমান করে এক চামচ দেবে কনডেন্সড মিল্ক।

আঁখিতারা অতিদ্রুত চা বানিয়ে নিল। কাপে একটা চুমুক দিয়েই মিসির আলি বললেন, আজ থেকে তোমার নাম চা-কন্যা। আমি এত ভালো চা আমার জীবনে খাই নি।

আতরের গন্ধ

আতরের গন্ধে বাড়ি ম মা করছে। আজমল সাহেবের পীর ভাই–হুজুরে কেবলা বিন নেশান আলি আসগর কুতুবী মিসির আলির বসার ঘরে বসে আছেন। আজমল সাহেব হুজুরে কেবলাকে এখানে বসিয়ে রেখে নাশতার জোগাড় করতে গেছেন। হুজুরে কেবল বসে আছেন মূর্তির মতো। মূর্তিও মাঝে মধ্যে বাতাসে এদিক-ওদিক দুলে–পীর ভাই-এর মধ্যে সেই দুলুনিও নেই।

মিসির আলি বললেন, কেমন আছেন?

তিনি জবাব দিলেন না। তবে মিসির আলির দিকে তাকালেন। সামান্য হাসলেন।

যিনি কথা বললে জবাব দেন না তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালানোর প্রশ্ন ওঠে না। মিসির আলি চুপচাপ বসে রইলেন। আজমল সাহেব তাঁর পীর ভাইকে এখানে কেন নিয়ে এসেছেন এটা ঠিক স্পষ্ট হচ্ছে না। হয়তো ধর্মের লাইনে মিসির আলিকে টানতে চান। সব মানুষই নিজের দিকে মানুষকে টানতে চায়। এক চোর অন্য একজনকে চোর বানাতে চেষ্টা করে। সাধু চেষ্টা করে সাধু বানাতে।

মিসির আলির সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে। তার পাঞ্জাবির পকেটে সিগারেটও আছে। দেয়াশলাইও আছে। সিগারেট ধরালে এই পীর সাহেব কি মনে করেন তা বুঝতে পারছেন না বলেই সিগারেট ধরাচ্ছেন না।

হুজুরে কেবল এতক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন। এখন চোখ বন্ধ করে ফেলেছেন। তাঁর মাথাও খানিকটা ঝুকে এসেছে। থুতনি বুকের সঙ্গে লেগে যাচ্ছে। ভদ্রলোক কি ঘুমিয়ে পড়েছেন? পুরোপুরি ঘুমিয়ে পড়লে সিগারেট একটা ধরানো যেতে পারে। ভদ্রলোকের চোখের পাতা দেখতে পারলে মিসির আলি সহজেই ধরতে পারতেন। ভদ্রলোক ঘুমিয়েছেন কি-না। চোখের পাতা দেখা যাচ্ছে না।

মিসির আলিকে অবাক করে দিয়ে ভদ্রলোক হঠাৎ মাথা তুললেন। চোখ মেললেন। মিসির আলির দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট স্বরে বললেন–আপনি আমাকে প্রশ্ন করেছেন–কেমন আছেন? আমি সেই প্রশ্নের জবাব দেই নাই। কারণ তখন ওজিফা পাঠ করছিলাম। জবাব না দেওয়ায় আপনি হয়তো ভেবেছেন আমি বেয়াদবি করেছি। ইচ্ছাকৃত বেয়াদবি করি নি। আপনার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে অনিচ্ছাকৃত বেয়াদবি করেছি–তার জন্যে ক্ষমা চাই।

মিসির আলি বললেন, ক্ষমা করলাম।

শুকরিয়া।

মিসির আলি বললেন, ক্ষমা করলাম ঠিকই, আপনি কিন্তু এখনো প্রশ্নের জবাব দেন নি। এখনো বলেন নি কেমন আছেন।

হুজুরে কেবলা শব্দ করে হাসলেন। হাসি থামিয়ে বললেন, জনাব আমি ভালো আছি। আপনি ইচ্ছা করলে আমার সামনে সিগারেট খেতে পারেন। আমি এমন কোনো ব্যক্তি না যে আমার সামনে সিগারেট খাওয়া যাবে না। যদিও এই অভ্যাস স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

মিসির আলি সামান্য চমকালেন। হুজুরে কেবলা এমন ভঙ্গিতে কথা বলেছেন যাতে মনে হতে পারে তিনি থট রিডিং জানেন। মিসির আলি মনে মনে ঠিক যা ভাবছেন তা বলতে পারছেন।

সিগারেট ধরাবার ইচ্ছা মিসির আলির হচ্ছে এটা ঠিক। হুজুরে কেবলার জন্যে সিগারেট ধরাতে সংকোচ হচ্ছে এটাও ঠিক। কিন্তু ব্যাপারটা হুজুরে কেবলার জানার কথা না।

মিসির আলি সিগারেট ধরালেন। হুজুরে কেবল বললেন, আপনাকে সিগারেট ধরাতে বলেছি। এতে আপনি সামান্য চমকেছেন বলে আমার মনে হলো। চমকানোর কিছু নেই। আপনার এশট্রেতে সিগারেট দেখে বুঝেছি আপনি সিগারেট খান। আপনার গা থেকেও সিগারেটের গন্ধ আসছিল। যারা সিগারেট খায় তারা যখন অস্বস্তিকর পরিবেশে পড়ে তখন তাদের সিগারেট ধরাতে ইচ্ছা! করে। আমার সামনে আপনি বসে আছেন, আপনি আমাকে প্রশ্ন করছেন, আমি জবাব দিচ্ছি না। আপনি পড়েছেন অস্বস্তিকর পরিবেশে। কাজেই আমি ধরে নিয়েছি আপনার সিগারেট ধরাবার ইচ্ছা হচ্ছে।

মিসির আলি এতক্ষণ ভদ্রলোকের দিকে ভালোভাবে তাকান নি। এবার তাকালেন। বয়স অল্প। পাঁচিশ-ছাব্বিশ। টকটকে গৌরবর্ণ। টানাটানা চোখ সুরমা দিয়ে সেই চোখ আরো টানা হয়েছে। ঠোঁট টকটকে গোলাপি। পুরুষদের যে কোনো সৌন্দৰ্য প্রতিযোগিতায় তিনি অবশ্যই ফাস্ট প্রাইজ কিংবা রানার্সআপ প্ৰাইজ নিয়ে নেবেন।

মিসির আলি সাহেব!

কি।

আমি বুদ্ধি খাটিয়ে এ রকম দু’একটা কথা বলি। লোকে মনে করে আমার বিরাট আধ্যাত্মিক ক্ষমতা। কেউ চিন্তাও করে না। আমার ক্ষমতাটা আধ্যাত্মিক নাও হতে পারে। আমি যতদূর শুনেছি আপনি একজন মানুষ সম্পর্কে অনেক কিছু বলতে পারেন। আপনি যখন বলেন তখন কিন্তু আপনার ক্ষমতাকে কেউ আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ভাবে না।

মিসির আলি বললেন, আমি যদি আপনার মতো লম্বা দাড়ি রাখি, চোখে সুরমা দেই, মাথায় পাগড়ি পরি তখন আমার ক্ষমতাকেও লোকে ভাববে আধ্যাত্মিক ক্ষমতা।

হুজুরে কেবলা বললেন, আমি মাঝে মাঝে ভবিষ্যদ্বাণী করি। আমাকে করতে হয়। আমি যাকে যা বলি তাই নাকি সত্যি হয়। এই বিষয়ে আপনার মতামত কি।

মিসির আলি বললেন, আপনি হয়তো নস্ট্রাডেমাস স্টাইলে ভবিষ্যদ্বাণী করেন।

সেটা কি?

নস্ট্রাডেমাসের জন্ম ফরাসিতে ১৫০৩ সনে। তিনি অনেক ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। তার ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে সারা পৃথিবীতে খুব হৈচৈ হচ্ছে। কারণ সবাই বলছে তিনি যা বলেছেন সব মিলে যাচ্ছে। আসলে কিন্তু তা না। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন কবিতার আকারে। সরাসরি কখনো কিছু বলেননি। এই কারণে মনে হয় যা বলা হচ্ছে সবই মিলে যাচ্ছে।

ভদ্রলোকের নাম কি বললেন?

নস্ট্রাডেমাস।

উনি অস্পষ্টভাবে কবিতায় ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন?

জি।

উদাহরণ দিতে পারবেন?

উনি বলেছেন

An emperor will be born near Italy.
Who will cost the empire very dearly.

খুবই অস্পষ্ট কথা। এই emperor নেপোলিয়ান হতে পারেন, আবার হিটলারও হতে পারেন। আবার অস্ট্রিয়ার রাজাও হতে পারেন।

আপনি কি বলতে চাচ্ছেন আমি বুঝেছি। তবে আমি কিন্তু অস্পষ্টভাবে কিছু বলি না। আমি যা বলি স্পষ্টভাবে বলি। আপনার সম্পর্কে একটা ভবিষ্যদ্বাণী করব?

মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, করুন।

পীর ভাই নির্বিকার ভঙ্গিতে অত্যন্ত স্পষ্ট স্বরে বললেন–আপনি দু’একদিনের মধ্যে বিরাট বিপদে পড়তে যাচ্ছেন। এমন বিপদ যার কোনো পারাপার নাই।

কি ধরনের বিপদ?

জীবন সংশয় হয় এমন বিপদ। এর বেশি কিছু বলব না।

পীর ভাই উঠে দাঁড়ালেন। মিসির আলি তাকিয়ে আছেন। পীর ভাই-এর মুখে হাসি। হাসির মধ্যে শিশুর ভঙ্গিমা আছে। শিশুরা কোনো একটা চালাকি করে বড়দের হারিয়ে দিলে এ রকম করে হাসে।

রাতে তিনি স্বপ্নে দেখলেন লম্বা এক মানুষ তাঁর ঘরে ঢুকেছে। মানুষটা ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আতরের গন্ধে ঘর ভর্তি হয়ে গেল। স্বপ্নের মধ্যেই মিসির আলি অস্বস্তি বোধ করছেন। স্বপ্ন হবে বর্ণ এবং গন্ধহীন, তাহলে তিনি গন্ধ পাচ্ছেন কেন? লম্বা মানুষটা তার দিকে তাকিয়ে বললেন, আসসালামুআলাইকুম। তার গলা অপূর্ব সুরেলা। স্বপ্নের মধ্যেই মিসির আলি উঠে বসলেন। লম্বা মানুষটা বললেন, আমার ভবিষ্যদ্বাণী কি মিলেছে মিসির আলি সাহেব?

মিসির আলি বললেন, ও আচ্ছ। আপনি।

লম্বা মানুষটা বললেন, কথার জবাব দিন, আমার ভবিষ্যদ্বাণী কি মিলেছে?

মিসির আলি বললেন, না। আমি কোনো বিপদে পড়িনি। আঁখিতারা বিপদে পড়েছে।

আপনি বিপদে পড়েছেন। আপনি বুঝতে পারছেন না।

মিসির আলি বললেন, আপনার কথা আমি সত্যি বলে ধরে নিলাম। ধরে নিলাম আমিই বিপদে পড়েছি। এখন বলুন আপনি কি করে বুঝলেন আমি বিপদে পড়ব।

সেটা বলব না।

কেন বলবেন না?

সব কিছু সবাইকে বলতে নেই। সব রহস্য সবাইকে জানতে নেই।

মিসির আলি বললেন, রহস্য আগলে রাখা ঠিক না। বিজ্ঞানীরা যখনই কোনো রহস্য ধরে ফেলেন তখনই তাঁরা তা সবাইকে জানান। পৃথিবী যে আজ এত দূর এগিয়েছে এই কারণেই এগিয়েছে। তারা রহস্য আগলে বসে থাকলে আমরা এত দূর আসতে পারতাম না। অন্ধকারে ড়ুবে থাকতাম।

অন্ধকারে ড়ুবে থাকাই ভালো।

তাই কি?

হ্যাঁ ভাই। আপনি ঘুমুচ্ছেন। ঘুম হলো অন্ধকার। অন্ধকার ভালো না?

মিসির আলি জবাব দিলেন না। গাঢ় ঘুমে তলিয়ে গেলেন।

আঁখিতারার জ্বর এসেছে

আঁখিতারার জ্বর এসেছে।

সে চাদর গায়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। চাদরে শীত মানছে না। একটু পরপর কোপে কেঁপে উঠছে। মিসির আলি তার কপালে হাত রেখে চমকে উঠেছেন। জুরে গা পুড়ে যায় বলে যে বাক্যটি প্রচলিত সেটা পুরোপুরি সত্যি বলে

মনে হচ্ছে।

আঁখিতারা, শরীর বেশি খারাপ লাগছে?

সে চোখ মেলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল। মিসির আলি অস্থির বোধ করলেন। অসুখ-বিসুখের ব্যাপারগুলিতে তিনি অস্থির বোধ করেন। অসহায়ও বোধ করেন। অসুখ-বিসুখের সমস্যা মোকাবিলার মতো শক্তি তার নেই।

পানি খাবে? পানি?

আঁখিতারা আবারও চোখ মেলল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ বন্ধ করে ফেলল।

মেয়েটির জ্বর কমানোর ব্যবস্থা করা দরকার। ডাক্তার ডাকা দরকার। মেয়েটি যেভাবে কেঁপে কেঁপে উঠছে তার অবশ্যই শীত লাগছে। তিনি কি এখন তার গায়ে লেপ দিয়ে দেবেন? এতে মেয়েটার শীত ভাব কমবে। অথচ তিনি জানেন জ্বর কমানো কী করে সম্ভব।

আঁখিতারা, শরীর বেশি খারাপ লাগছে?

না।

অনেকক্ষণ পর সে প্রথম একটা শব্দ করল। এক অক্ষরের এই শব্দ করতেও মনে হয় তার খুব কষ্ট হলো।

মিসির আলি বললেন, শীত লাগছে?

হুঁ।

গায়ে লেপ দিয়ে দেব?

হুঁ।

মিসির আলি কী করবেন বুঝতে পারছেন না। লেপ দিয়ে কি মেয়েটাকে ঢেকে দেবেন? শরীর তার প্রয়োজনের কথা জানাচ্ছে। এই প্রয়োজন কি মিটানো উচিত নয়? আমাদের যখন ক্ষিদে পায় শরীর সেটা জানান দেয়। তখন খাদ্য গ্ৰহণ করতে হয়। আঁখিতারার শরীর জানাচ্ছে তার শীত লাগছে। কাজেই তার শীত কমানোর ব্যবস্থা করাই তো যুক্তিযুক্ত। যদিও ডাক্তাররা বলেন–এই অবস্থায় গায়ে পানি ঢালতে হবে। প্রয়োজনে বরফ-মেশানো পানিতে বাথটাবে গলা পর্যন্ত ড়ুবিয়ে রাখতে হবে। ব্যাপারটা এমনও হতে পারে–জ্বরতপ্ত মস্তিষ্ক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। নিউরোন এলোমেলো সিগন্যাল দেয়।

দরজার কড়া নড়ছে। কেউ একজন এসেছে। মিসির আলি স্বস্তিবোধ করলেন। যে এসেছে তার সঙ্গে পরামর্শ করা যাবে। বিপদের সময় নিজের বুদ্ধির ওপর মানুষের আস্থা কমে যায়। সে অন্যের বুদ্ধির দিকে তাকিয়ে থাকে।

কড়া নাড়ছিল মনসুর।

মিসির আলি দরজা খুলতেই সে বলল, জ্বর কার?

মিসির আলি বললেন, আমার একটা কাজের মেয়ে আছে, নাম আঁখিতারা। তার অসুখ। মিসির আলির একবারও মনে হলো না মনসুরের জানার কথা না জ্বর কার। প্রশ্নটা সে করল কীভাবে?

মনসুর বলল, জ্বর কি বেশি?

অনেক বেশি। কী করা যায় বলো তো?

মনসুর বলল, আপনি অস্থির হবেন না। আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি।

মিসির আলি স্বস্তির সঙ্গে লক্ষ করলেন মনসুর ছেলেটা কাজের। সে অতিদ্রুত মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করল। পাঞ্জাবির পকেট থেকে একপাতা প্যারাসিটামল বের করে দুটা টেবলেট খাইয়ে দিল। মিসির আলি বললেন, তুমি অষুধ পকেটে নিয়ে ঘোরো নাকি?

মনসুর বলল, আমার মাথাধরা রোগ আছে। যখন-তখন মাথা ধরে। সঙ্গে অষুধ রাখতে হয়। স্যার, আপনার ঘরে কি থার্মোমিটার আছে?

না।

জ্বরটা দেখা দরকার। আপনি মাথায় পানি ঢালতে থাকুন, আমি চট করে একটা থার্মোমিটার কিনে নিয়ে আসি।

মনসুর ঘর থেকে বের হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই থার্মোমিটার নিয়ে ফিরে এলো। জ্বর মাপা হলো। একশ’ পাঁচ।

কারোর জ্বর একশ’ পাঁচ হতে পারে তা মিসির আলির ধারণার মধ্যেও নেই। মেয়েটির মুখ ছাইবৰ্ণ হয়ে গেছে। চোখ লাল টকটক করছে। মিসির আলি বললেন, মনসুর, এখন আমাদের করণীয় কী?

মনসুর বলল, আপনার করণীয় হলো চুপচাপ বসে থাকা। আমি বাকিটা দেখছি। সামান্য অসুখে এতটা নাৰ্ভাস হতে আমি কাউকে দেখিনি।

একশ’ পাঁচ জ্বর, এটাকে তুমি সামান্য বলছ?

ভাইরাসের জ্বর ধুমধাম করে বাড়ে। বাচ্চারা সামাল দিতে পারে। বয়স্ক মানুষের জন্য অসুবিধা হয়। স্যার, আপনি বসার ঘরে চুপচাপ বসে থাকুন। আমি যা করার করছি।

তুমি কী করবে?

প্ৰথমে আপনাকে কড়া করে এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়াব। তারপর মেয়েটাকে বাথরুমে নিয়ে যাব। মাথায় চার-পাঁচ বালতি পানি ঢালব।

আমাকে চা খাওয়াতে হবে না। তুমি একজন ডাক্তার ডেকে আনো।

সকালে কোনো ডাক্তার পাওয়া যায় না। ডাক্তাররা প্ৰাইভেট রোগী দেখতে শুরু করেন বিকেলে। আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি আঁখিতারার জ্বর নামিয়ে দিচ্ছি। বিকেলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। আপনি সিগারেট টানতে থাকুন। আমি এক ফাঁকে চা বানিয়ে দিয়ে যাব।

মিসির আলি বসার ঘরে এসে সিগারেট ধরালেন। মেয়েটাকে বাথরুমে নেওয়া হয়েছে এবং তার মাথায় বালতি বালতি পানি ঢালা হচ্ছে। একেকবার পানি ঢালা হচ্ছে মেয়েটা আর্তনাদের মতো করছে। মিসির আলি চমকে চমকে উঠছেন।

স্যার, চা নিন।

পানি ঢালার ফাঁকে ফাঁকে মনসুর চা বানিয়ে ফেলেছে। ছেলেটার কাজ করার ক্ষমতা আছে। মিসির আলি বললেন, জ্বর কি কিছু কমেছে?

মনসুর বলল, এখনো থার্মোমিটার দিয়ে মাপি নি। তবে কিছু নিশ্চয়ই কমেছে। চায়ে চিনি-টিনি সব ঠিক আছে কি-না দেখুন।

মিসির আলি চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। চিনি ঠিক আছে। যে রকম ঘন লিকার খেয়ে তিনি অভ্যস্ত সেই ঘনত্ব ঠিক আছে। মিসির আলি দ্বিতীয় সিগারেট ধরালেন। বাথরুমে পানি ঢালার শব্দ শুনতে শুনতে তিনি সিগারেট টানছেন। তার মাথায় কিছু প্রশ্ন চলে এসেছে। তিনি চাচ্ছেন না। এই মুহুর্তে প্রশ্নগুলি আসুক। কিন্তু প্রশ্নগুলি আসছে।

১. মনসুরকে তিনি মেয়েটির নাম বলেন নি। কিন্তু সে স্পষ্ট বলেছে আমি আঁখিতারার জ্বর নামিয়ে দিচ্ছি। নামটা সে জানল কীভাবে?

২ থার্মোমিটার আনার জন্য সে ছুটে ঘর থেকে বের হলো। থার্মোমিটার নিয়ে দু’মিনিটের মাথায় ফিরে এলো। আশপাশে কোনো ফার্মেসি নেই।

অষুধ যেমন তার পকেটে ছিল। থার্মোমিটারও কি পকেটে ছিল? অনেকেই অষুধ সঙ্গে নিয়ে ঘোরে। পকেটে থার্মোমিটার নিয়ে ক’জন আর ঘুরে? তারপরেও ধরে নেওয়া যাক মনসুর অল্প কিছু অদ্ভুত মানুষের একজন, যার স্বভাব পকেটে থার্মোমিটার নিয়ে ঘোরা। তাহলেও সমস্যা আছে। কেন সে বলল, থার্মোমিটার কিনে নিয়ে আসি? সে বলতে পারত। আমার সঙ্গে থার্মোমিটার আছে।

স্যার, আরেক কাপ চা খাবেন?

মিসির আলি বললেন, না। মেয়েটার অবস্থা কী?

অবস্থা ভালো না স্যার।

ভালো না মানে?

জ্বর নামে নি। হাসপাতালে ফেলে দিয়ে আসি?

মিসির আলি কঠিন গলায় বললেন, হাসপাতালে ফেলে দিয়ে আসি মানে! এটা কেমন কথা?

কথার কথা বলেছি। স্যার। শিশু হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেই। আমার জানাশোনা আছে অসুবিধা হবে না। একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে আসি। আপনি কি সঙ্গে যাবেন?

অবশ্যই আমি সঙ্গে যাব।

আপনি রেস্ট নিন, আমি ভর্তি করিয়ে আপনাকে খবর দিয়ে যাব। কোনো সমস্যা নেই।

আমার রেস্টের চেয়ে মেয়েটির চিকিৎসা অনেক বেশি প্রয়োজন। তুমি সময় নষ্ট না করে ট্যাক্সি, বেবিট্যাক্সি কী আনবে আনো।

মনসুর সিগারেট ধরাল। মিসির আলির দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট স্বরে বলল, মেয়েটা বাঁচবে না।

মিসির আলি হতভম্ভ হয়ে বললেন, তুমি কী বলতে চাচ্ছ?

মনসুর আবেগশূন্য গলায় বলল, মেয়েটা বাঁচবে না।

তুমি কী করে বুঝলে?

স্যার, আমি ডাক্তার না। কিন্তু আমার কিছু ক্ষমতা আছে। আমি কিছু কিছু জিনিস আগে আগে বুঝতে পারি। আমি মৃত্যুর গন্ধ পাই। আপনাকে তো স্যার আগেও বলেছি আমার কিছু বিশেষ ক্ষমতা আছে। মৃত্যুর গন্ধ কেমন আপনাকে একটু ব্যাখ্যা করি।

কোনো ব্যাখ্যা করতে হবে না। তুমি মেয়েটকে হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করে।

এক কাপ চা খেয়ে নেই। স্যার? পাঁচ মিনিট লাগবে। পানি গরম দিয়েছি। আপনি আরেক কাপ খাবেন?

মিসির আলি জবাব দিলেন না।

তিনি মনসুরের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন।

আঁখিতারাকে শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর ডাক্তার এনে সঙ্গে সঙ্গে রোগীকে দেখানোর ব্যবস্থা মনসুর অতি দ্রুত করে ফেলল। মিসির আলি তার কর্মক্ষমতার প্রশংসা না করে পারলেন না। সব কিছুই যেন তার হাতের মুঠোয়। সিস্টারদের সঙ্গে হাসিমুখে আপা আপা করে কথা বলছে। যেন কত দীর্ঘদিনের পরিচয়। এক ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলার সময় ডাক্তারের বাড়ি মাদারীপুর শুনে মনসুর এমন ভঙ্গি করল যেন মাদারীপুর বাড়ি হওয়াটা বিস্ময়কর ঘটনা। এমন বিস্ময়কর ঘটনা শতাব্দীতে একটা-দুটার বেশি ঘটে না। গলা অন্যরকম করে সে দু’বার বলল ও, আচ্ছা আপনার বাড়ি মাদারীপুর। বলেন কি!

মিসির আলি হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। মেয়েটা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে তিনি খানিকটা স্বস্তি পাচ্ছেন। চিকিৎসা শুরু হবে। ডাক্তাররা দেখবেন। দেশের ডাক্তারদের প্রতি তাঁর আস্থা আছে। আস্থার পেছনের লজিক হচ্ছে। এ দেশের সব ডাক্তারকেই অসংখ্য রোগী দেখতে হয়। রোগীর প্যাথলজিক্যাল রিপোর্টের ওপর ডাক্তাররা তেমন ভরসা করেন না। কারণ প্যাথলজিক্যাল ল্যাবগুলির অবস্থা তারা জানেন। ডাক্তারদের নির্ভর করতে হয় অভিজ্ঞতার ওপর। লক্ষণ বিচার করে রোগ নির্ণয়ে তাদের দক্ষতা অসামান্য।

সব কমপ্লিট করে দিয়ে এসেছি স্যার।

বলতে বলতে সিগারেট হাতে মনসুর এসে তার সামনে দাঁড়াল। তাকে কেমন যেন হাসি-খুশি মনে হচ্ছে।

মনসুর সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল, রোগীর যদি কিছু হয়ে যায় কেউ আমাদের দোষ দিতে পারবে না। আমরা প্রপার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। আমাদের দিক থেকে কোনো ভুল নেই। রোগীর মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে।

মিসির আলি বললেন, তুমি বারবার মৃত্যুর প্রসঙ্গ আনিছ কেন? মৃত্যু কেন হবে?

মানুষ তো স্যার অমর না। মানুষের মৃত্যু হয়। মানুষ মরণশীল।

তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

বলুন।

মিসির আলি বললেন, তুমি এত নিশ্চিত কীভাবে যে মেয়েটা মারা যাবে?

সব মানুষের মৃত্যুর ব্যাপারেই আমি নিশ্চিত। তবে আঁখিতারার মৃত্যু যে ঘনিয়ে এসেছে এটা বুঝতে পারছি।

আঁখিতারা মেয়েটাকে তুমি চিনতে?

জি না। আমি চিনিব কী করে? সে কাজ করে আপনার এখানে।

মিসির আলি বললেন, চৌধুরী খালেকুজ্জামান মিয়া কি তোমার আসল নাম? নাকি এটাও ছদ্মনাম?

চৌধুরী খালেকুজ্জামান মিয়া?

হ্যাঁ, চৌধুরী খালেকুজ্জামান মিয়া।

মনসুর সিগারেটে ঘন ঘন কয়েকটা টান দিয়ে সিগারেট ছুড়ে ফেলে সেই দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমার এই নাম আপনি কীভাবে জানলেন?

মিসির আলি বললেন, একেকজনের পদ্ধতি একেক রকম। তুমি একটা পদ্ধতিতে বের করেছ যে আঁখিতারা আজ রাতে মারা যাবে। আমি অন্য পদ্ধতিতে তোমার নাম-ধাম-পরিচয় বের করেছি। দু’জনের পদ্ধতি দু’রকম।

আমার নাম-ধাম-পরিচয় বের করেছেন?

হ্যাঁ, বের করেছি। আমার কথা কি তোমার বিশ্বাস হচ্ছে?

বিশ্বাস হচ্ছে। স্যার, আসুন আমরা কোথাও বসে চা খাই। রেস্টুরেন্টে বসে চা খেতে কি আপনার আপত্তি আছে।

না, আপত্তি নেই।

মনসুর বলল, আমার নাম যে চৌধুরী খালেকুজ্জামান এই তথ্য আপনাকে কে দিল?

মিসির আলি বললেন, তুমিই দিয়েছ! অন্য কেউ দেয় নি।

আমি দিয়েছি?

হ্যাঁ তুমি দিয়েছ। কিভাবে দিয়েছ। শুনতে চাও?

না।

হাসপাতালের কাছাকাছি একটা চায়ের দোকানে দু’জন ঢুকল। চায়ের দোকানের মালিক মনসুরের দিকে তাকিয়ে আনন্দিত গলায় বলল, আরে ময়না ভাই। কেমন আছেন?

মনসুর জবাব দিল না। একবার শুধু আড়চোখে মিসির আলিকে দেখল। চৌধুরী খালেকুজ্জামানের আরেক নাম ময়না এটা জেনে মিসির আলির তেমন কোনো ভাবান্তর হলো না। রেস্টুরেন্ট ফাঁকা। যে তিনজন খদের চা-পাউরুটি খাচ্ছে তারা রেস্টুরেন্টের বাইরে বেঞ্চিতে বসে আছে। ভেতরে মানুষ বলতে তারা দু’জন এবং সাত-আট বছরের একটা ছেলে। ছেলেটা বেঞ্চির ওপর কান্নাকান্না মুখ করে বসে আছে। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে মালিকের ছেলে। কোনো অপরাধ করায় কিছুক্ষণ আগে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তখন কান্নাকাটি করেছিল। চোখে পানির দাগ রয়ে গেছে। মিসির আলি আগ্রহ নিয়ে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইলেন।

দোকানের চা ভালো। এই ব্যাপারটা মিসির আলির খুব অদ্ভুত লাগে। নামিদামি রেস্টুরেন্টের চায়ের চেয়ে রাস্তার পাশের সস্তা দোকানগুলোর চা ভালো হয়। সম্ভবত চা বানানোর কোনো বিশেষ কায়দা আছে। বিশেষ কায়দাটা শিখে নিতে হবে।

মনসুর বলল, স্যার, আপনি মনে হয় ধরেই নিয়েছেন। আমি খারাপ লোক।

মিসির আলি বললেন, আমি আগেভাগে কিছু ধরে নেই না। তুমি আমার কাছে আসল নাম গোপন করেছ। নাম গোপন করলেই মানুষ খারাপ হয়ে যায় না। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত মানুষ নাম গোপন করতে ভালোবাসতেন। অন্য কোনো পরিচয়ে নিজেকে পরিচিত করতে চাইতেন। এই অস্বাভাবিকতা অনেকের ভেতর আছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজের নাম গোপন করে নাম নিয়েছেন নীল লোহিত। বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায়ের আরেক নাম বনফুল।

মনসুর বলল, স্যার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় না, বলাই চাঁদও না। তবে আমি খারাপ লোক না।

আমি বলি নি তুমি খারাপ লোক। আমার কাজের মেয়েটার নাম যে আঁখিতারা এটা কীভাবে জানলে?

মনসুর তাকিয়ে আছে। চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। মনে হচ্ছে না। এই প্রশ্নের জবাব সে দেবে।

মিসির আলি বললেন, মেয়েটার জন্য থার্মোমিটার আনার কথা বলে তুমি দৌড় দিয়ে বের হলো। থার্মোমিটার তোমার পকেটেই ছিল। তুমি কি থার্মোমিটার পকেটে নিয়ে চলাফেরা করে?

জি।

কেন?

থার্মোমিটার দিয়ে আমি একটা মেন্টাল ম্যাজিক দেখাই। থার্মোমিটারের দিকে তাকিয়ে থেকে আমি থার্মোমিটারের পারদ ওপরে উঠাতে পারি। আপনাকে এটা দেখাব বলে থার্মোমিটার সঙ্গে করে এনেছিলাম।

দেখি তোমার এই খেলাটা।

থার্মোমিটার। আপনার বাসায় রেখে এসেছি। আপনি সত্যি দেখতে চান?

হ্যাঁ, দেখতে চাই।

আমি থার্মোমিটার একটা কিনে নিয়ে আসি। দু’মিনিট লাগবে। আপনি আরেক কাপ চা নিন। চা শেষ করার আগেই আমি চলে আসব।

মিসির আলি দ্বিতীয় কাপ চা শেষ করার পরেও আরো আধঘণ্টা বসে রইলেন। মনসুর ফিরল না। আর অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। আঁখিতারার খোঁজ নেওয়ার জন্য হাসপাতালে যাওয়া দরকার। মনসুরকে নিয়ে এই মুহুর্তে কিছু না ভাবলেও চলবে। মিসির আলি চায়ের দাম দিতে গেলেন। রেস্টুরেন্টের মালিক খুবই অবাক হয়ে বলল, আপনে ময়না ভাইয়ের লোক, আপনার কাছে থাইক্যা চায়ের দাম নিব এইটা কেমন কথা!

ময়না ভাই এই মানুষটার কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। কেন গুরুত্বপূর্ণ কে জানে। জানতে ইচ্ছা করছে না। কোনো সমস্যা মাথার ভেতর ঘুরপাক থাক তা চাচ্ছেন না। তাঁর নিজেরই শরীর খারাপ লাগছে। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে শুয়ে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে থাকলে ভালো হতো।

মিসির আলি তাঁর ঘরে

রাত প্ৰায় আটটা। মিসির আলি তাঁর ঘরে। ঘরের কোনো বাতি জ্বালানো হয় নি। এতক্ষণ অন্ধকারেই হাঁটাহাঁটি করছিলেন। বসার ঘর থেকে রান্নাঘরে যাওয়া, রান্নাঘর থেকে আবার বসার ঘর। জায়গাটা খুব ভালো করে চেনা। হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে না। অন্ধকারে কেন হাঁটাহাঁটি করছেন তা তিনি জানেন না। অস্থিরতা কাটানোর কোনো চেষ্টা হতে পারে। অস্থিরতা কাটানোর এই প্রক্রিয়া মিসির আলির চরিত্রের সঙ্গে মানাচ্ছে না। খুব অস্থির অবস্থায় তিনি চুপচাপ বসে থাকেন।

আঁখিতারাকে নিয়ে তিনি হঠাৎ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। মনে হচ্ছে মনসুরের কথা ঠিক। মেয়েটা বাঁচবে না। অথচ হাসপাতালের ডাক্তার বলে দিয়েছেন ভয়ের কিছু নেই। এশিয়া জোনে ভাইরাসের নতুন কিছু ষ্ট্রেইন দেখা দিয়েছে। এতে হাই ফিভার হয়। ডেঙ্গু তার মধ্যে একটা।

মিসির আলি ডাক্তারকে বললেন, মেয়েটার কি ডেঙ্গু হয়েছে?

ডাক্তার সাহেব ভরসা দেয়ার মতো গলায় বললেন, হতে পারে। তবে চার-পাঁচদিন পার না হলে কিছুই বলা যাবে না। আমরা সিস্টেমেটিক চিকিৎসা চালিয়ে যাব। আপনি নিশ্চিত থাকুন।

ডাক্তারের কথায় তাঁর ভরসা পাওয়া উচিত। ভরসা পাচ্ছেন না। ভরসা না পাওয়ার কারণ কি মনসুর? সে পীর-দরবেশের মতো বলে বসিল মেয়েটা বাঁচবে না। সে কোনো পীর-দরবেশ না। পীর-দরবেশদেরও মানুষের মৃত্যু নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা থাকে বলে তিনি মনে করেন না। তারপরেও কি কোনো কারণে মনসুরের কথা তার মনের গভীরে ঢুকে গেছে। হিপনোটিক সাজেশান?

আচ্ছা বাড়িওয়ালার পীর ভাই-এর এখানে কোনো ভূমিকা আছে! এই মানুষটিও তো ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন–মহাবিপদ আসছে। জীবন সংশয় হবার মতো বিপদ। তাই তো হয়েছে। শুধু জীবন সংশয়টা তার না হয়ে আঁখিতারার হয়েছে।

মিসির আলি হাঁটাহাঁটি বন্ধ করে খাটে উঠে বসলেন। এখনো বাতি জ্বালাতে ইচ্ছা করছে না। একটা ছোট্ট হিসাব মিলছে না। তিনি ঠিক করলেন ছোট্ট হিসাবটা না মেলা পর্যন্ত তিনি বাতি জ্বালাবেন না। হিসাব মেলানোর জন্য তিনি তাড়াহুড়ো করে হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন। এখন মনে হচ্ছে ফেরা ঠিক হয় নি।

হাসপাতালে মেয়েটার পাশে থাকা উচিত ছিল। মেয়েটার মা-বাবা মেয়েটাকে হাসপাতালে ফেলে রেখে চলে আসতে পারত না। তার বিছানার পাশে সারা রাত জেগে বসে থাকত।

বেচারি আঁখিতারা প্রবল জুরের ঘোরে আশপাশে অপরিচিত মানুষজন দেখবে, নার্স দেখবে, ডাক্তার দেখবে। কাউকেই সে চিনতে পারবে না। কী প্ৰচণ্ড ভয়ই না সে পাবে। কী করে তিনি মেয়েটাকে ফেলে চলে এলেন?

মিসির আলি ঠিক করলেন রাতের খাবার খেয়ে আবার হাসপাতালে ফিরে যাবেন। থাকবেন মেয়েটার পাশে। যত বার সে চোখ মেলবে তত বার তিনি বলবেন, ভয় পেও না, আমি আছি। ভালো হয়ে যাও। এক ধরনের হিপনোটিক সাজেশান দেওয়া হবে। মেয়েটা এই সাজেশানের মর্ম বুঝতে পারবে না। তাতে কোনো ক্ষতি নেই।

আপনি ঘর অন্ধকার করে বসে আছেন কেন?

মিসির আলি চমকে উঠে বললেন, কে?

কী আশ্চৰ্য, আমার গলা চিনতে পারছেন না। আমি রেবু। আপনার সুইচবোর্ড কোনদিকে বলুন তো। আমি বাতি জ্বেলে দেই।

মিসির আলি খাটে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। তার হাতের কাছেই সুইচবোর্ড। তিনি সুইচ টিপলেন। রেবু বলল, আপনার দরজা খোলা, ঘর অন্ধকার। আমি ভাবলাম চোর এসে দরজা খুলে সবকিছু নিয়ে গেছে। কি কি নিয়েছে তা দেখার জন্যে এসেছিলাম। আপনি ঘর অন্ধকার করে বসে ছিলেন কেন? আপনি কি বসে বসে ঘুমুচ্ছিলেন।

মিসির আলি জবাব দিলেন না। জবাব দেবার কিছু নেই। তিনি কি বলবেন, না, আমি বসে বসে ঘুমুচ্ছিলাম না।

রেবু বলল, আমি একবার পরীক্ষার হলে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। জিওগ্রাফি ফাইনাল পরীক্ষার দিন। সারারাত জেগে পড়েছি। হলে বসার পর লক্ষ করলাম। এমন ঘুম ধরেছে, চোখ মেলে রাখতে পারছি না। টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম। ইনভিজিলেটর আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। সেই থেকে আমার নাম হয়ে গেল ঘুম রাবেয়া। আমাদের ক্লাসে দু’জন রাবেয়া ছিল। একজন খুব নামাজ পড়ত। বোরকা পরে স্কুলে আসত। তাকে সবাই ডাকত তাপসী রাবেয়া, আমাকে ডাকত ঘুম রাবেয়া।

মিসির আলি বললেন, তোমার নাম রাবেয়া?

হুঁ। শুধু রাবেয়া না। ঘুম রাবেয়া।

তোমার ভালো নাম শেফালী না?

না তো! আমি কি কখনো আপনাকে বলেছি আমার নাম শেফালী? তবে আপনার যদি আমাকে শেফালী ডাকতে ভালো লাগে আপনি ডাকতে পারেন। আমি রাগ করব না। আপনার কোনো কিছুতেই আমি রাগ করব না।

রেবু আজ শাড়ি পরে আসে নি। সালোয়ার-কামিজ পরেছে। পোশাকের জন্যই হয়তো তাকে কিশোরীদের মতো লাগছে। শাড়ি না পরার কারণে তার মধ্যে এখন তরুণী ভাব একেবারেই নেই। শাড়ি অদ্ভুত একটা পোশাক। ছেলেদের এমন কোনো পোশাক নেই। যা পরলে একটা কিশোরকে যুবক মনে হবে। মিসির আলির মনে হলো শাড়ি নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। বারো-তেরো হাত লম্বা একটা কাপড় কেন একজন কিশোরীকে তরুণী বানিয়ে দেবে?

রেবু বলল, আপনি আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?

কীভাবে তাকিয়ে আছি?

মনে হচ্ছে আপনি আমার কথা শুনে খুবই অবাক হচ্ছেন।

তোমার ভালো নাম রাবেয়া এটা শুনে অবাক হচ্ছি।

কেন? মানুষের ভালো নাম রাবেয়া থাকতে পারে না?

অবশ্যই পারে। তোমার নাম তো শুধু রাবেয়া না, তোমার নাম ঘুম রাবেয়া।

আমি খুব মজা করে গল্প করতে পারি, তাই না?

হুঁ।

যার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে সে আমার গল্প শুনে খুব মজা পাবে। আগে আরো মজা করে গল্প করতে পারতাম। অসুখের পর আগের মতো মজা করে গল্প করতে পারি না। আপনার তো খুব বুদ্ধি, বলুন তো কেন আগের মতো মজা করে গল্প করতে পারি না?

বলতে পারছি না। তুমিই বলো?

যখনই কারো সঙ্গে গল্প করি তখনই মনে হয়। সে বুঝে ফেলছে আমার মাথা পুরোপুরি ঠিক নেই। তখন সাবধান হয়ে যাই। সাবধান হয়ে কথা বললে কি আর গল্পের মধ্যে মজা থাকে?

মিসির আলি বললেন, থাকে না।

রেবু গলার স্বর নামিয়ে বলল, আপনি কি জানেন, আপনার এখানে আসা আমার জন্য পুরোপুরি নিষেধ হয়ে গেছে?

না, জানি না।

আমার ওপর সামরিক আইন জারি করা হয়েছে। মামা বলে দিয়েছে। আর কোনোদিনও যেন আপনার এখানে না আসি।

নিষেধ অমান্য করে এসেছ, তোমার মামা তো রাগ করবেন।

মামা জানতে পারলে তবেই না রাগ করবে। আজ বৃহস্পতিবার না?

বৃহস্পতিবার কী?

বৃহস্পতিবারে মামার পীর ভাই আসে। মামা সন্ধ্যার পর থেকে ছাদের ঘরে চলে যায়। জিকির করে। সারারাত ছাদের ঘরে থাকে। নামে না।

বলতে বলতে রেবু খিলখিল করে হেসে ফেলল। মিসির আলি বললেন, হাসছ কেন?

রাবেয়া হাসি থামিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, কারণটা আপনাকে বলব না। আচ্ছা শুনুন, আপনার কি জ্বর?

না।

আমার মনে হয় আপনার জ্বর। জ্বর হলে আপনার খুব কষ্ট হয়, তাই না? সেবা করার কেউ নেই। অসুখ-বিসুখ হলে সেবা পেতে খুব ভালো লাগে। ঠিক বলেছি না?

মিসির আলি জবাব দিলেন না। মেয়েটির সঙ্গে এখন আর কথা বলতে ভালো লাগছে না। তাকে হাসপাতালে যেতে হবে। হঠাৎ করেই তার মনে হচ্ছে আঁখিতারার শরীর ভালো না। তার কোনো একটা সমস্যা হচ্ছে। মিসির আলি বললেন, রেবু আমি এখন একটু বের হব।

আচ্ছা, আমি চলে যাচ্ছি। আপনি কিন্তু আর কখনো দরজা খোলা রেখে ঘর অন্ধকার করে বসে থাকবেন না।

রেবু চলে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মিসির আলি বাতি নিভিয়ে দিলেন। ছোট্ট হিসাবটা এখনো মেলে নি। বাতি নেভানোর পর যদি মেলে। একটা উত্তর তার কাছে আছে। উত্তরটা গ্রহণযোগ্য না। গ্রহণযোগ্য না এমন উত্তরও অনেক সময় সঠিক হয়। রেবুকে জিজ্ঞেস করে উত্তরটা যাচাই করে নেওয়া যেত। কিন্তু রেবুর কথাবার্তায় তাঁর সংশয় আছে। সে মানসিকভাবে সুস্থ না। তার কোনো কথাই গ্রহণযোগ্য না।

মিসির আলি খাট থেকে নামলেন। তার শরীর খারাপ লাগছিল। শরীর খারাপের কারণ ধরতে পারছিলেন না। খাট থেকে নামার পর শরীর খারাপের কারণ ধরতে পারলেন। আজ সারা দিন তার খাওয়া হয় নি।

রিকশায় উঠে মিসির আলির ক্ষুধাবোধ চলে গেল। তাঁর মনেই রইল না। রিকশায় ওঠার আগ পর্যন্ত তিনি ভেবে রেখেছিলেন আলি মিয়ার রেস্টুরেন্ট থেকে কিছু খেয়ে নেবেন। তাঁর যখন রান্না করতে ইচ্ছা করে না। তখন এই রেস্টুরেন্টে খেতে যান। বিচিত্র কারণে রেস্টুরেন্টের মালিক চান মিয়া তাঁকে অসম্ভব পছন্দ করে। তাঁকে দেখলেই হাসিমুখে বলেন, বাবুরে খানা দে। ঠিকমতো দিবি। আগে টেবিল সাফা কর। টেবিলে যেন আর কেউ না বসে।

চান মিয়া কেন তাকে বাবু ডাকে, কেনইবা তার জন্য এতটা ব্যস্ত হয় তা তিনি জানেন না। জিজ্ঞেসও করেন নি। প্রশ্ন করে কারণ জানতে তার ভালো লাগে না। কোনো একদিন কারণটা নিজেই ধরতে পারবেন। আর ধরতে না পারলেও ক্ষতি নেই। কারণ ধরতেই হবে এমন কথা নেই।

আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। যে কোনো মুহুর্তে বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টি নামার আগে আগে প্রকৃতি কিছু বোধ হয় করে। চারদিকে এক ধরনের অস্থিরতা ছড়িয়ে দেয়।

রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করেন, তোমারও কি অস্থির লাগছে?

তিনি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই রিকশাওয়ালা বলল, আসমানের অবস্থা দেখছেন? আইজ এক্কেবারে ভাসাইয়া দিব।

মিসির আলি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলেন, ভাসিয়ে দেবার প্রবণতা প্রকৃতির ভেতর আছে। সে জোছনা দিয়ে ভাসিয়ে দেয়, বৃষ্টি দিয়ে ভাসিয়ে দেয়, তুষারপাত দিয়ে ভাসিয়ে দেয়। আবার প্রবল প্রেম, প্রবল বেদনা দিয়েও তার সৃষ্ট জগৎকে ভাসিয়ে দেয়। প্রকৃতি যে খেলা খেলে তার নাম ‘ভাসিয়ে দেওয়া খেলা’।

প্রকৃতি ভাসিয়ে দিতে পছন্দ করে। আঁখিতারা মেয়েটা যদি সত্যি সত্যি মারা যায়, প্রবল দুঃখবোধ মিসির আলিকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।

আঁখিতারাকে দেখে মিসির আলি চমকালেন। সে হাসপাতালের বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছে। তার কোলে হাসপাতাল থেকে দেওয়া খাবার। হলুদ রঙের প্লাস্টিকের ট্রেতে ভাত, এক টুকরা মাছ, ভাজি, ডাল। আঁখিতারা আগ্ৰহ নিয়ে খাচ্ছে। মনে হলো মিসির আলিকে দেখে সে লজ্জা পেয়েছে।

মেয়েটা হাসিমাখানো লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, ভালো।

জ্বর চলে গেছে?

হুঁ।

হাসপাতালে থাকতে ভয় লাগছে?

না।

একা একা রাতে থাকতে পারবে?

হুঁ।

খাওয়া বন্ধ করেছ কেন, খাও।

আঁখিতারা বলল, বাবা, আপনে খাইছেন?

মিসির আলি বললেন, না। তোমার এখান থেকে যাবার পথে হোটেলে খেয়ে

নেব। হাসপাতালের খাবার কেমন?

আঁখিতারা বলল, লবণ কম।

লবন দিয়ে বলব?

না।

মেয়েটা যে তাকে দেখে খুবই আনন্দ পাচ্ছে তা তিনি বুঝতে পারছেন। আনন্দিত মানুষের পাশে বসে থাকাও আনন্দের ব্যাপার। একজনের দুঃখ অন্যজনকে তেমন স্পর্শ করে না, কিন্তু আনন্দ করে।

আঁখিতারা বলল, বড় বাবা আপনি চলে যান। হোটেলে গিয়া ভাত খান।

মিসির আলি বললেন, হঠাৎ করে তোমার এত জ্বর! আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এ রকম জ্বর কি তোমার আগেও হয়েছে?

হুঁ।

বলো কী!!

তুমি ভয় পেয়েছিলে?

হুঁ।

ভয় পেয়েছিলে কেন?

আঁখিতারা নিচু গলায় বলল, রাইতে আমার কাছে একটা জিন আসছিল। জিন দেইখা ভয় পাইছি।

মিসির আলি বললেন, তুমি ভয়ের স্বপ্ন দেখছিলে। স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছ।

স্বপ্ন দেখি নাই। জিন আমার বিছানার ধারে বসছে। আমার শইল্যে হাত দিছে। আমারে চিমটি দিছে।

কোথায় চিমটি দিয়েছে?

ঘাড়ে।

দেখি তোমার ঘাড় দেখি। কোন জায়গায় চিমটি দিয়েছে?

আঁখিতারা দেখাল। জায়গাটা লাল হয়ে ফুলে আছে।

মিসির আলি বললেন, এটা চিমটি না। কাঁকড়া-বিছার কামড়। কাঁকড়াবিছার বিষের কারণে তোমার জ্বর এসেছে। ওই বাড়িতে কাঁকড়া-বিছা আছে। আমি নিজে দেখেছি। তুমি এরপর থেকে সব সময় মশারি ফেলে ঘুমাবে।

আঁখিতারা বলল, বিছানার ধারে জিন বসছিল। আমি দেখছি।

মিসির আলি বললেন, আচ্ছা থাক, এই বিষয় নিয়ে আমরা পরে কথা বলব। ডাক্তার তোমাকে কবে ছাড়বে কিছু বলেছেন?

কাল সকালে ছাড়বেন।

আমি সকালে এসে তোমাকে নিয়ে যাব। ঠিক আছে?

হ্যাঁ।

একা একা থাকতে পারবে তো?

হুঁ।

তোমার কি কিছু লাগবে?

মৌলানা সাবের কাছ থাইকা আমারে একটা তাবিজ আইন্যা দিয়েন। তাবিজ থাকলে জিন আসব না।

মিসির আলি বললেন, আমি অবশ্যই তাবিজ নিয়ে আসব। তাবিজ ছাড়া আসব না।

আঁখিতারা হাসছে। সে খুবই আনন্দিত।

বৃষ্টি শুরু হলো মিসির আলি বাসায় ফেরার পর। যত গর্জে তত বর্ষে না টাইপ বৃষ্টি। তেমন কোনো ভাসিয়ে দেওয়া ধরনের বৃষ্টি না। ভ্যাপসা গরম ছিল, বৃষ্টিতে গরমটা কেটেছে। সামান্য শীত-শীতও লাগছে। ঘুমের জন্য এ ধরনের বৃষ্টিমাখা রাত খুব ভালো। ঠাণ্ড ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় মাথার ওপর ফ্যান ঘুরবে। গায়ে থাকবে পাতলা চাদর। হাতে বই। বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে এক সময় চোখে ঘুম জড়িয়ে আসবে। তখন একসঙ্গে দুটা ব্যাপার হবে–বই পড়তে ইচ্ছা করবে, আবার ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছা করবে। মিসির আলির জন্য এই সময়টাই শ্রেষ্ঠতম সময়।

সায়েন্স অ্যান্ড প্যারাডক্স বইটি এমন যে, কয়েক পাতা পড়লেই ঘুম কেটে যায়। লেখক বইটির তৃতীয় চ্যাপ্টারে প্রমাণ করেছেন গ্যালাক্সির ভর শূন্য। পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা এটমকে ভেঙে পাওয়া যাচ্ছে ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন। এদেরকেও ভাঙা যাচ্ছে। এক পর্যায়ে পাওয়া যাচ্ছে লেপটন। লেপটনের কোনো ভর নেই, কাজেই বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডেরও কোনো ভর নেই।

গভীর মনোযোগে বই পড়তে পড়তে তিনি কখন ঘুমিয়ে পড়লেন জানেন না। তাঁর ঘুম ভাঙল খুঁটিখাট শব্দে। কেউ একজন বিছানার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। যে হেঁটে যাচ্ছে তাকে তিনি দেখতে পারছেন না। কারণ ঘর অন্ধকার। ঘুমানোর আগে তিনি বাতি নেভাননি। ঘর অন্ধকার থাকার কারণ নেই। হয়তো ঝড়-বৃষ্টির কারণে ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে।

বিছানার পাশ দিয়ে যে হেঁটে যাচ্ছে সে একবার ব্যস্ত ভঙ্গিতে রান্নাঘরে ঢুকাল। দরজার পাশে রাখা টুলের সঙ্গে ধাক্কা লাগল। মিসির আলি একবার সুইচ স্পর্শ করলেন। কেউ একজন সুইচ টিপে বাতি নিভিয়ে দিয়েছে। সেই কেউ একজনটা কে? চোর?

যে ঘরে ঢুকেছে সে এখনো ঘরেই আছে। মিসির আলি ইচ্ছা করলেই বাতি জ্বালাতে পারেন। তিনি বাতি জ্বালালেন না। হঠাৎ করেই তাঁর মনে হলো যে, এখন ঘরে ঢুকে সাবধানে হাঁটছে আঁখিতারা। সে কি তাকেই দেখেছে? তাকে দেখেই ভেবেছে জিন? যে ঘরে ঢুকেছে সে পুরুষ না রমণী? বাতি জ্বলিয়ে কে কে করে চিৎকার করার চেয়ে এই সমস্যা নিয়ে চিন্তা করা ভালো।

ঘরে যে ঢুকছে সে পুরুষ না রমণী তা অতি সহজেই বের করে ফেলা যায়। একটি রমণীর পায়ের স্টেপ ছোট। লম্বা রমণীও পুরুষদের মতো দীর্ঘ কদমে হাঁটে না। তাদের গায়ে থাকে প্রসাধন সামগ্ৰীীর সুগন্ধ। চুলের তেলের গন্ধ, মুখে মাখা ক্রিমের গন্ধ। পুরুষদের গায়ে ঘামের গন্ধই প্রবল। রমণীরা হাতে চুড়ি পরে। অতি সাবধানে যে রমণী হাঁটবে তার হাতের চুড়িতেও কখনো না কখনো রিনঝিন করে উঠবে। রিনঝিন শব্দের সঙ্গে পুরুষ সম্পর্কিত না।

আগন্তুক পুরুষ না রমণী তার মীমাংসা হবার আগেই মিসির আলি ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের মধ্যেই বিচিত্র স্বপ্ন দেখলেন।

আঁখিতারা বাসায় ফিরেছে

আঁখিতারা বাসায় ফিরেছে। তার গলায় দুটা তাবিজ। মিসির আলি কাকরাইল মসজিদের সামনের ফুটপাতের দোকান থেকে তাবিজ দুটা কিনেছেন। আঁখিতারা খুবই আগ্রহের সঙ্গে গলায় তাবিজ পরে ঘুরছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সে অনেক দিন পর বাবার বাড়িতে ফিরে আনন্দে আত্মহারা। মেয়েটাের আনন্দ দেখে মিসির আলির ভালো লাগছে।

আঁখিতারা বলল, বড় বাবা, চা বানায়ে দিব?

মিসির আলি বললেন, দাও।

দুপুরে রান্ধা কী হইব? ঘরে বাজার নাই।

ডাল-ভাত করে। ঘন ঘন বাজারে যেতে আমার ভালো লাগে না।

রসুন ভর্তা করব? রসুন ভর্তা খাইবেন? রসুন আর শুকনা করিচ পুড়াইয়া ভর্তা বানাইতে হয়। খাইবেন?

হুঁ, খাব।

মিসির আলির মনে হলো হাসপাতাল থেকে ফিরে আঁখিতারার মুখে বুলি ফুটেছে। মেয়েটা ফটফট করে কথা বলছে। ‘পোস্টমাস্টার’-এর রতনের সঙ্গে এই মেয়ের ভালোই মিল আছে। রতনও ছিল ফটফটানি মেয়ে।

চা বানিয়ে মিসির আলির সামনে রাখতে রাখতে আঁখিতারা বলল, বড় বাবা, চাইরটা ঘর-বন্ধন তাবিজ ঘরের চাইর কোনায় লটকাইয়া দিলে ঘরে কিছু ঢুকব না।

ঘর-বন্ধন তাবিজ কোথায় পাওয়া যায়?

আমরার দেশের মৌলানা সাব ঘর-বন্ধন তাবিজ দেন।

তুমি যখন দেশে যাবে, তখন আমার জন্য ঘর-বন্ধন তাবিজ নিয়ে এসো।

আইচ্ছা।

আঁখিতারা, শোনো, আজ তোমার এত কাজকর্ম করার দরকার নেই। হাসপাতাল থেকে এসেছি। বিশ্রাম করো। খাবার আমি হোটেল থেকে আনিয়ে নেব।

আমার অন্ত বিশ্রামের দরকার নাই। অনেক বিশ্রাম হইছে।

মিসির আলি চায়ের কাপ নিয়ে বসার ঘরে বেতের চেয়ারে বসলেন। তিনি সেখান থেকেই আঁখিতারার প্রবল বেগে ঘর বাট দেবার শব্দ শুনলেন। মেয়েটার কাণ্ডকারখানায় তিনি বেশ আনন্দ পাচ্ছেন।

মিসির আলির আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হলো না। কিছুক্ষণের মধ্যে তাঁর ভ্ৰ কুঁচকে গেল। সিগারেটে টান দিয়ে আনাড়ি সিগারেটখোরদের মতো খকখক করে কাশতে লাগলেন। কোনো কারণে তার মনে যদি খটকা তৈরি হয়, তখন এই ব্যাপারটা ঘটে। সিগারেটে টান দিয়ে কাশতে শুরু করেন। আজকের এই খটকা তৈরি হয়েছে মনসুরের চিঠির কারণে। মনসুর এই চিঠি ডাকে পাঠায়নি। খামে বন্ধ করে দরজার ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে।

পরম শ্ৰদ্ধেয় স্যার
জনাব মিসির আলি।
স্যার, আমি আপনার সঙ্গে পরপর কয়েকটি অন্যায় করেছি। অন্যায়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার কারণে আপনাকে লিখছি। হয়তোবা আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন।

আমার প্রথম অন্যায় থার্মোমিটার আনার কথা বলে আমি চলে গিয়েছিলাম, আর ফিরে আসি নি। এই অন্যায়টি কেন করেছি আপনার মতো বুদ্ধিমান মানুষের তা না বোঝার কোনো কারণ নেই। স্যার, আমি থার্মোমিটার দিয়ে কোনো ম্যাজিক দেখাতে পারি না। থার্মেমিটার নিয়ে উপস্থিত হলে ম্যাজিক দেখাতে হতো। কাজেই আমি পালিয়ে চলে গেছি।

আপনি আমার কাজকর্মে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। সন্দেহভাজন একজন মানুষ যত ভালো কাজই করুক তার কাজকে দেখা হয় সন্দেহের চোখে।

আপনি যখন জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তো আঁখিতারাকে চেনো না, তাহলে তার নাম কীভাবে জানলে? আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাবার কারণে তৎক্ষণাৎ জবাব দিলাম না। কী করে তার নাম জানি আর কেনইবা আমি পকেটে থার্মোমিটার নিয়ে ঘুরছিলাম সেটা বলি। আপনার কাছে জোড়হাতে অনুরোধ করি, আমার কথাগুলি দয়া করে পড়ুন। হয়তোবা আপনি আমার বিচিত্র কর্মকাণ্ড বুঝতে পারবেন।

ওইদিন আঁখিতারা মেয়েটি প্রবল জুরে ছটফট করছিল। আমি তখন এসেছি আপনার সঙ্গে দেখা করতে। আপনার ঘরের দরজা বেশিরভাগ সময়ই খোলা থাকে। আমি ঢুকে গেলাম আপনার বসার ঘরে। সেখান থেকে শুনলাম। আপনি মেয়েটার সঙ্গে কথা বলছেন। মেয়েটার প্রবল জ্বর তাও বুঝলাম। আমি আপনাকে চমকে দেবার জন্যই ঘর থেকে বের হয়ে ফার্মেসিতে চলে গেলাম। জ্বর কমানোর অষুধ প্যারসিটামল কিনলাম। আপনার বাসায় থার্মোমিটার নাও থাকতে পারে, এই ভেবে একটা থার্মোমিটারও কিনলাম। স্যার, আমি যে সত্যি কথা বলছি তা কি বিশ্বাস করছেন? যদি বিশ্বাস করেন তাহলে আরেকটা সত্যি কথা বলি। রেবু (রাবেয়া) নামের মেয়েটা তার স্বামী ও সন্তানকে হত্যা করেছে–এই ঘটনাটাও সত্যি। মেয়েটা সাইকোপ্যাথিক! সে তার পছন্দের মানুষদের খুন করে। আমি জানি আপনি তার পছন্দের মানুষদের একজন। একই ঘটনা আপনার ক্ষেত্রেও ঘটতে যাচ্ছে। আপনি অতি বুদ্ধিমান মানুষ হয়েও ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না। এইখানেই আমার দুঃখ।

স্যার, আমার কথা। আপনি যদি বিশ্বাস নাও করেন, একটু সাবধানে থাকবেন। আমার মন বলছে কোনো এক গভীর রাতে সে আপনার ঘরে ঢুকে পড়বে। হয়তোবা ইতিমধ্যেই ঢুকেছে।

ইতি চৌধুরী খালেকুজ্জামান।

চিঠি শেষ করে মিসির আলি সিগারেটে টান দিয়ে আবারও খকখক করে কাশতে লাগলেন। আঁখিতারা বলল, বড় বাবা, আপনারে আরেক কাপ চা দিব?

মিসির আলি বললেন, দাও।

চা সে বানিয়েই রেখেছিল। মিসির আলির কথা শেষ হবার আগেই সে চায়ের কাপ নিয়ে উপস্থিত হলো। মিসির আলি কাপ হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। আজমল সাহেব ব্যাগভর্তি বাজার নিয়ে রিকশা করে ফিরছিলেন। মিসির আলিকে দেখে বললেন, আপনার কাজের মেয়েটার কী হয়েছে? হাসপাতালে নাকি ভর্তি করিয়েছেন? ডেঙ্গু-ফেঙ্গু নাকি?

মিসির আলি বললেন, না। এখন সুস্থ। বাসায় নিয়ে এসেছি।

এই এক যন্ত্রণা, একশ’ টাকা মাসের কাজের মেয়ে তার চিকিৎসার পেছনে খরচ পাঁচশ’। আমার ঘরে তো অসুখ-বিসুখ লেগেই আছে। এখন আবার একটার হয়েছে জণ্ডিস। বড় বিপদে আছি।

মিসির আলি বললেন, ব্যাগভর্তি বাজার। আজ কি কোনো উৎসব?

আজমল সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন, আপনি বুদ্ধিমান লোক। ঠিকই ধরে ফেলেছেন। রেবুকে আজ দেখতে আসবে। ছেলে সুইডেনে থাকে। ভালো কিছু করে বলে মনে হয় না। লেবার টাইপ। আমি মেয়ে পার করতে পারলেই খুশি। বিদেশে গিয়ে বাথরুমের গু-মুত পরিষ্কার করলে করবে। আমার কি? আপনি আমার নিজের লোক। আপনাকে বলতে অসুবিধা নাই। ওর ইতিহাস ভালো না। শুনলে চমকে উঠবেন। যদি ভালোয় ভালোয় বিয়ে হয়ে যায়, রেবুকে বিদায় করতে পারি, তাহলে দুঃখের কথা বলব। কাউকে বলতে ভালো লাগে না।

বলতে ইচ্ছা না করলে বলবেন না।

আপনাকে তো আমি বলতেই পারি। শুনুন ভাই, আজ রাতে আমাদের সঙ্গে খানা খাবেন। আমিন বাজার থেকে গরুর মাংস কিনেছি। খেলে বুঝবেন কী জিনিস। আসবেন কিন্তু মনে করে। আর একটু খাস দিলে দোয়া করবেন। আমার পীর ভাই বলেছেন, এই বিয়ে হবে। উনি যা বলেন তাই হয়। উনি কিন্তু বলেছেন আর হয় নি তা কখনো হয় নাই। অতি কামেল লোক, উনার কথা মিথ্যা হবে না। বাকি আল্লাহ মালিক। আপনাকে এত চিন্তিত লাগছে কেন? এত চিন্তা করবেন। না। সব আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিয়ে বসে থাকেন। রাতে মনে করে খানা খেতে আসবেন।

মিসির আলি বললেন, আজ বরং বাদ থাকুক। বাইরের লোকজন থাকবে। আমি আবার অপরিচিত মানুষদের সঙ্গে খেতে পারি না।

আজমল সাহেব বললেন, আমারও একই প্রবলেম। আমিও পারি না। আপদরা বিদায় হলে আপনাকে খবর দিব। তারপর দুই ভাই মিলে খানা খাব। এই আমার ফাইনাল কথা।

আজমল সাহেব বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলেন। মিসির আলি লক্ষ করলেন দোতলার বারান্দায় রেবু এসে দাঁড়িয়েছে। সে একদৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। রেবুকে একটা প্রশ্ন করবেন বলে তিনি ভেবে রেখেছিলেন। তার সঙ্গে যখন দেখা হয় তখন আর প্রশ্নটা করা হয় না। আজ অবশ্যই প্রশ্নটা করতে হবে। প্রশ্নটা হিন্দি ছবি নিয়ে। মারামারির দৃশ্যে দেখা গেল নায়কের শার্টের একটা বোতাম নেই। কিন্তু মৃত্যুদৃশ্যে বোতামটা ঠিকই আছে। এর পেছনে রহস্যটা কী?

রসুন ভর্তা জিনিসটা যে এত সুস্বাদু মিসির আলি কল্পনাও করেন নি। তিনি শুধু রসুন ভর্তা দিয়েই এক গামলা ভাত খেয়ে ফেললেন। আঁখিতারার দিকে তাকিয়ে বললেন, আজ থেকে আমি তোমার নাম দিলাম কুটু মিয়া।

কুটু মিয়া কে?

কুটু মিয়া একটা উপন্যাসের চরিত্র। তার মতো রান্না কেউ করতে পারে না।

আঁখিতারা আনন্দে নুয়ে পড়ল। মিসির আলি বললেন, এখন তুমি আমাকে বলো, তুমি যে রাতে জ্বিনকে দেখলে সেই জিন কী করল?

চিমটি দিছে।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিমটি দিল না বসে চিমটি দিল?

বসছে। তারপরে চিমটি দিছে।

ভূত চিমটি দেয় আমি কোনোদিন শুনি নি। চিমটি দেয় মেয়েরা।

আঁখিতারা গম্ভীর গলায় বলল, আমারে চিমটি দিছে জিনে।

মিসির আলি বললেন, এখন তো আর চিমটি দিতে পারবে না। গলায় তাবিজ। ঠিক নয়?

হুঁ।

তোমার চৌকিটা আমি আমার ঘরে ঢুকিয়ে ফেলব। জিন যদি আসে তুমি আমাকে ডাকবে।

আনন্দে অভিভূত হয়ে আঁখিতারা ডান দিকে ঘাড় কাত করল। মিসির আলির মনে হলো বাচ্চা এই মেয়েটির জীবনে যে ক’টি আনন্দময় ঘটনা ঘটেছে আজকের এই সিদ্ধান্ত তার একটি।

আঁখিতারা।

জি।

মন দিয়ে শোনো, ভবিষ্যতে তুমি যতবার রান্না করবে একটা আইটেম যেন অবশ্যই থাকে। রসুন ভর্তা।

আঁখিতারা আবার ঘাড় কাত করল। তার এতই আনন্দ হচ্ছে যে, কেঁদে ফেলতে ইচ্ছা করছে। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না একটা মানুষ এত ভালো হয় কীভাবে? সামান্য কিছু মন্দ তো মানুষের মধ্যে থাকতে হবে। যদি না থাকে তাহলে মানুষ আর ফেরেশতায় তফাৎ কী?

আঁখিতারা!

জি।

তুমি লেখাপড়া জানো?

না।

লেখাপড়া শিখতে হবে। রসুন ভর্তা বানালে হবে না। আমি তোমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব।

আঁখিতারা ঘাড় কাত করল। এইবার সে আর চোখের পানি আটকাতে পারল না। তার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল।

মিসির আলি তাকিয়ে দেখলেন। কিছু বললেন না। তিনি চাচ্ছেন মেয়েটা আরো কাদুক। আনন্দের কান্না দেখতে তাঁর বড় ভালো লাগে।

আঁখিতারা।

জি।

খাওয়া শেষ করে আমার মাথায় তেল দিয়ে দাও। তুমি আমার অভ্যাস খারাপ করে দিয়েছ। রসুন ভর্তা দিয়ে যে খাওয়া খেয়েছি আজ দুপুরে না ঘুমুলে চলবে না। আজ আমি মড়ার মতো ঘুমাব।

মিসির আলি সত্যি সত্যি মড়ার মতো ঘুমালেন। তার ঘুম ভাঙল রাত ন’টায়। দিনের বেলায় এত লম্বা ঘুম তিনি তাঁর জীবনে আর কখনো ঘুমিয়েছেন বলে মনে করতে পারলেন না। মৃত্যুর কাছাকাছি ঘুম। শান্তি এবং তৃপ্তির ঘুম। সবকিছুরই কারণ আছে। তৃপ্তিময় দীর্ঘ ঘুমেরও নিশ্চয়ই কারণ আছে। সব সময় কারণ খুঁজতে ভালো লাগে না। তিনি হাত-মুখ ধুতে গেলেন। রাতে আজমল সাহেবের বাড়িতে খেতে যেতে হবে। আঁখিতারাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন। মেয়েটাকে অবশ্যই একা রেখে যাওয়া যাবে না। জিনবিষয়ক ভীতি মেয়েটার মাথার ভিতর আছে। যে কোনো সুযোগে আবার সেই ভয় ডালপালা মেলতে পারে।

আঁখিতারা বলল, বড় বাবা, চা খাইবেন?

মিসির আলি বললেন, না। দাওয়াত খেতে যাব। তুমিও সঙ্গে যাবে।

আঁখিতারা বলল, আপনের কি শইল খারাপ?

মিসির আলি বললেন, শরীর খারাপ না। শরীর ভালো।

আপনে ঘুমাইতেই আছেন। ঘুমাইতেই আছেন। ঘুমাইতে ঘুমাইতে মানুষ মারা যায়।

কে বলেছে?

বড় বাবা বলেছে। এই জন্যে বড় বাবা যখন বেশি ঘুমায় তখন আমার ভয় লাগে। আমি ডাক দিয়া তুলি।

আমাকে ডাক দিয়ে তুললে না কেন?

আমি ডাকছি। আপনের ঘুম ভাঙে নাই।

মিসির আলি বললেন এত লম্বা আরামের ঘুম কেন ঘুমিয়েছি শোনো। কারণটা কিছুক্ষণ আগে পরিষ্কার হয়েছে। আমার মাথা জট পাকিয়ে গিয়েছিল। আন্ধা গিন্টু লেগে গিয়েছিল। গিন্টু খুলে গেছে বলে আরাম করে ঘুমিয়েছি, বুঝেছি?

কিছু না বুঝেই আঁখিতারা মাথা নাড়ল। মানুষটা যে ঘুমের মধ্যে মরে যায় নি। এতেই সে খুশি।

রাতে মিসির আলি আজমল সাহেবের বাড়িতে খেতে গিয়ে অস্বস্তিতে পড়লেন। বাড়িতে শোকের ছায়া। বরপক্ষের লোকজন কেউ আসে নি। তারা কোনো খবরও পাঠায় নি। আজমল সাহেব বললেন, মানুষ এত খারাপ কেন, বলেন তো ভাই সাহেব? আসবি না ভালো কথা। একটা খবর তো দিবি।

মিসির আলি বললেন, ক’টার সময়ে আসার কথা?

সন্ধ্যাবেলা আসার কথা। মুরুব্বিরা আসবে, বিয়ের কথাবার্তা হবে, তারপর খানাপিনী।

রাস্তার যানজটে মনে হয় আটকা পড়েছে। সব মুরুব্বিদের একত্র করে আসতেও দেরি হয়।

আজমল সাহেব হতাশ গলায় বললেন, ওরা আসল খবর পেয়ে গেছে। সবকিছু এত গোপন করে রাখি, তারপরেও আসল খবর বের হয়ে যায়। আপনি আমার নিজের লোক, আপনাকে বলি। রেবুর আগে বিয়ে হয়েছিল। একটা মেয়েও হয়েছিল। স্বামী-সন্তান দু’জনই মারা যায়। তারপর থেকে রেবুর মাথা খারাপ। নতুন করে ঘর-সংসার হলে মাথা ঠিক হয়ে যেত। মাথা খারাপের আসল অষুধ বিবাহ।

প্রশ্ন করবেন না করবেন না ভেবেও মিসির আলি প্রশ্ন করে ফেললেন। তিনি ইতস্তত করে বললেন, তারা মারা যায় কীভাবে?

আজমল সাহেব বললেন, কাজের মেয়ে খুন করে টাকা-পয়সা, গয়নাগাটি নিয়ে পালিয়ে যায়। বিশাল ইতিহাস। আরেকদিন বলব। আপনাকে বলতে কোনো বাধা নেই রে ভাই। আপনি আমার আপনা লোক। পুলিশ টাকা খাওয়ার জন্যে কী যে করেছে বললে বিশ্বাস হবে না। পুলিশ আসামি করেছিল রাবেয়াকে।

রাবেয়া কে?

রেবুর ভালো নাম রাবেয়া। ঘটনার পরে আমরা রেবুর নাম চেঞ্জ করে ফেলি–তার নাম দেই শেফালী। ডাক নাম শেফু। মেয়েটার বিয়ে তো দিতে হবে। আগের নামধাম রাখার কোনো যুক্তি আছে, আপনিই বলেন?

মিসির আলি কিছু বললেন না। ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেললেন। আজমল সাহেব মিসির আলির দিকে এগিয়ে এসে গলা নিচু করে বললেন, স্ত্রী স্বামীকে খুন করে, এ ইতিহাস আছে। কিন্তু কোনো মা তার সাত মাসের ফুটফুটে বাচ্চা খুন করতে পারে? আপনি বলেন? আপনি তো ‘বোকা.. না’ খারাপ কথা বলে ফেলেছি। ভাই, কিছু মনে করবেন না।

আজমল সাহেব বললেন, তোরা পারলে যে কাজের মেয়ে খুন করে পালিয়েছে তাকে ধরে আন। তা না, উল্টাপাল্টা জেরা। রেবুর মাথাটাই খারাপ করে দিল। মামলা থেকে রেবুকে বের করে আনতে কত টাকা গেছে বলুন তো? দেখি আপনার অনুমান?

বলতে পারছি না। মামলা-মুকাদমা বিষয়ে আমার অনুমান খুবই খারাপ।

চার লাখ একুশ হাজার। থানা স্টাফ নিয়েছে দুই লাখ, আর এসপি সাহেবকে দিয়েছি দুই লাখ।

মিসির আলি বললেন, একুশ হাজার টাকার হিসাবটা কী?

পত্রিকাওয়ালাদের দিতে হয়েছে। উল্টাপাল্টা খবর ছেপে দিলে মুশকিল না? ভাই সাহেব আপনার কি ক্ষিদে লেগেছে? খানা দিতে বলি?

মিসির আলি বললেন, আরেকটু অপেক্ষা করি।

আজমল সাহেব বললেন, কোনো লাভ নেই। শুয়োরের বাচ্চারা আসবে না। রেবু মেয়েটা কী কপাল নিয়ে এসেছে! ঝাড়ু মারি কপালে। একবার ইচ্ছা করে আমিই গলা টিপে মেয়েটিকে শেষ করে দেই। যন্ত্রণা শেষ হোক।

নিচে গাড়ির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। একটা না, বেশ কয়েকটা গাড়ি। মিসির আলি বললেন, আমার ধারণা বর পক্ষের লোকজন চলে এসেছে। আপনার পীর ভাই-এর কথা সত্যিই হয়েছে।

আজ রেবুর বিয়ে

আজ রেবুর বিয়ে। আয়োজনের হৈচৈ ধরনের বিয়ে না। নিয়মরক্ষা বিয়ে। মগবাজারের কাজী অফিস থেকে কাজী সাহেব আসবেন। বর পক্ষে কিছু লোকজন থাকবে। পাঁচ লক্ষ এক টাকা কাবিন। অর্ধেক গয়নাপাতিতে উসুল। আজমল সাহেব প্রায় জীবন দিয়ে দিচ্ছেন মিসির আলি যাতে কনের দিকের একজন উকিল হন। মিসির আলি কাটান দিয়ে যাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত কাটান দিতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না।

বিয়ের কনে রেবুর সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। সে সকালবেলা নতুন পাঞ্জাবি নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। আজমল সাহেব পাঞ্জাবি পাঠিয়েছেন। তিনি চান মিসির আলি বিয়ের আসরে এই পাঞ্জাবি পরে উপস্থিত হবেন। আঁখিতারাও এই উপলক্ষে লাল পাড় ড়ুরে লাল শাড়ি পেয়েছে। বিয়ে হবে সন্ধ্যায়, আঁখিতারা সকাল থেকেই শাড়ি পরে সেজেগুঁজে বেড়াচ্ছে। মিসির আলিকে বলেছে, তাকে কাচের চুড়ি কিনে দিতে হবে। কাচের চুড়ি না পেলে সে বিয়েতে যাবে না।

রেবু মিসির আলির পা ছুঁয়ে সালাম করল। মিসির আলি বললেন, আজ তোমার জন্য বিশেষ দিন।

পাঞ্জাবি টেবিলে রেখে রেবু কিছু বলল না।

মিসির আলি বললেন, উন্নত একটা দেশে যাচ্ছ। তাদের চিকিৎসাব্যবস্থা খুব ভালো। অবশ্যই সেখানে তুমি ভালো ডাক্তার দেখাবে। সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। তোমার ভালো চিকিৎসা দরকার।

রেবু ঘাড় কাত করল।

মিসির আলি বললেন, তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও?

রেবু বলল, না।

মিসির আলি বললেন, তোমার কাছে আমার একটা প্রশ্ন ছিল।

রেবু সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে বসল। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। অতিরিক্ত টেনশনে তার নাক ফুলে ফুলে উঠছে। মিসির আলি বললেন, তুমি ঘাবড়ে গেছ কেন? জটিল কোনো প্রশ্ন না। হিন্দি ছবি দেখেছিলাম তোমাকে সঙ্গে নিয়ে। সেই ছবি নিয়ে প্রশ্ন।

কী প্রশ্ন?

নায়ক যখন মারামারি করছিল তখন দেখলাম তার শার্টের একটা বোতাম নেই। কিন্তু মৃত্যুদৃশ্যের সময় দেখলাম শার্টের সবগুলো বোতামই আছে। এটা কী করে সম্ভব?

রেবু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, মৃত্যুদৃশ্যটা তারা আগে করেছে। তখন শার্টের বোতাম ছিল। মারামারি দৃশ্যের সময় বোতাম খুলে গেছে।

মিসির আলি বললেন, এত জটিল সমস্যার এত সহজ সমাধান? আমি বুঝতেই পারি নি।

রেবু বলল, আপনি ঠিকই বুঝতে পেরেছেন। আমার কাছে বুঝতে না পারার ভাব করেছেন।

তোমার সঙ্গে এটা কেন করব?

আমাকে বোঝানোর জন্য যে, আপনার বুদ্ধি কম। আপনার যে খুব বুদ্ধি এটা আমি জানি। এত বুদ্ধি থাকা ভালো না।

মিসির আলি আচমকা অন্য একটা প্রশ্ন করলেন। তিনি রেবুর দিকে ঝুকে এসে বললেন, তোমাদের বাড়ির বারান্দার দিক থেকে আমার এই বাসায় ঢোকার একটা দরজা আছে। দরজাটা তোমাদের দিক থেকে তালাবন্ধ থাকে। সেই তালার চাবি কি তোমার আছে?

রেবু কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, আছে। আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন?

মিসির আলি বললেন, না।

রেবু তাকিয়ে আছে। তার চোখ বড় বড়। মিসির আলির ধারণা ছিল তিনি মানুষের চোখের ভাষা পড়তে পারেন। তিনি হঠাৎ লক্ষ করলেন, রেবুর চোখের ভাষা তিনি পড়তে পারছেন না। এর চোখের ভাষা অচেনা হয়ে গেছে।

রাত নটা বাজে। আজমল সাহেব দুইবার মিসির আলিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য লোক পাঠিয়েছেন। মিসির আলি যেতে পারছেন না। কারণ মনসুর তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। সে সঙ্গে করে অনেকগুলো তাজা দোলনচাঁপা নিয়ে এসেছে। মিসির আলি দোলনচাঁপার নাম পড়েছেন নজরুলের কবিতা বইয়ে। দোলনচাঁপা আগে কখনো দেখেন নি। ফুল দেখে এবং ফুলের গন্ধে তিনি মুগ্ধ হলেন। পুরো বাড়িতেই মিষ্টি সৌরভ ছড়িয়ে পড়েছে। মিসির আলি বললেন, বাহ!

মনসুর বলল, স্যার ফুলগুলো আপনার পছন্দ হয়েছে?

মিসির আলি বললেন, খুব পছন্দ হয়েছে। থ্যাঙ্ক য়্যু।

মনসুর পকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে বলল, স্যার, মাঝে মাঝে আমি আপনার সামনে বেয়াদবি করি। সিগারেট খাই। আপনি কিছু মনে করবেন। না। টেনশনের সময় আমি সিগারেট না খেয়ে থাকতে পারি না।

মিসির আলি বললেন, সামনে সিগারেট খাওয়া-না-খাওয়া নিয়ে আদবের সম্পর্কটা আমি ঠিক বুঝতে পারি না। তুমি যত ইচ্ছা সিগারেট খাও। কোনো সমস্যা নেই।

মনসুর কয়েকবার চেষ্টার পর তার লাইটারটা ধরাল। মিসির আলি হঠাৎ শব্দ করে হেসে ফেললেন।

মনসুর অবাক হয়ে বলল, আপনি হাসছেন কেন?

মিসির আলি বললেন, লাইটারের শব্দ শুনে হাসলাম। লাইটারটা তুমি বাঁ হাতে ধরিয়েছ, এটা দেখেও হাসলাম।

মনসুর বলল, আমি লেফটহ্যান্ডার। স্যার, এটা কি কোনো হাসির ব্যাপার। আমি যতদূর জানি, এই পৃথিবীর দুই পারসেন্ট মানুষ লেফটহ্যান্ডার।

মিসির আলি বললেন, আমি কেন হেসেছি ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি। একবার আমার বাসায় গভীর রাতে কেউ একজন ঢুকেছিল। সেটা খুব বৃষ্টির রাত ছিল। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল। যে ঢুকেছিল সে চাচ্ছিল আমি যেন টের পাই কেউ একজন এসেছে, কিন্তু কে এসেছে সেটা যেন বুঝতে না পারি।

আপনি বুঝে ফেলেন কে এসেছে?

হ্যাঁ। তুমি এসেছিলে।

মনসুর শান্ত গলায় বলল, আমি লেফটহ্যান্ডার এটা জেনেই আপনি টের পেলেন আমি আপনার ঘরে ঢুকেছি? লেফটহ্যান্ডাররা গভীর রাতে মানুষের বাড়িতে ঢোকে?

মিসির আলি বললেন, তুমি পুরোটা না শুনেই উত্তেজিত হয়ে পড়ছি। আগে পুরোটা শোনো। নাৰ্ভ ঠাণ্ডা করো। আরেকটা সিগারেট ধরাও।

মনসুর আরেকটা সিগারেট ধরাল। আর তখনি ব্যস্ত ভঙ্গিতে আঁখিতারা ঘরে ঢুকে বলল, বড় বাবা, আপনি যাবেন না?

মিসির আলি বললেন, তুমি বিয়ে বাড়িতে চলে যাও, আমি আসছি।

আঁখিতারা বলল, আমি আপনেরে না নিয়া যাব না।

তাহলে অপেক্ষা করো। সুন্দর করে দু’কাপ চা বানিয়ে দিয়ে যাও।

খিতারা চলে গেল। মিসির আলি মনসুরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ওই রাতে তুমি কিছুক্ষণ আমার ঘরে হাঁটাহাঁটি করলে। আমার ঘুমভাঙা পর্যন্ত অপেক্ষা করলে। তারপর ঘর থেকে বের হলে। যতক্ষণ ঘরে ছিলে ততক্ষণ টেনশনে তোমার স্নায়ু আড়ষ্ট ছিল। স্মোকাররা টেনশন কমাতে সিগারেট টানে। ঘর থেকে বের হয়েই তুমি সিগারেট ধরালে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল বলেই পুরো সিগারেটটা তুমি আমার বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে শেষ করলে। সিগারেটের গন্ধে আমি তোমাকে চিনলাম না। তোমাকে চিনলাম লাইটারের শব্দে। তোমার লাইটারের শব্দ আমি চিনি।

মনসুর চুপ করে আছে। সে এখন আর সিগারেটে টান দিচ্ছে না। তবে তাকিয়ে আছে সিগারেটের ধোঁয়ার দিকে।

মিসির আলি বললেন, তুমি লেফটহ্যান্ডার এটাও কিন্তু একটা ইন্টারেস্টিং কো-ইনসিডেন্স। শুনলে তুমি মজা পাবে। বলব?

বলুন।

তুমি আঁখিতারার বিছানায় বসেছ। তার ঘাড়ের ডান দিকে চিমটি দিয়েছ। আঁখিতারা উত্তর দিকে মাথা দিয়ে শুয়ে ছিল। এই অবস্থায় তার ঘাড়ের ডান দিকে একজন লেফটহ্যান্ডার চিমটি দেবে। রাইটহ্যান্ডার চিমটি দেবে ঘাড়ের বা দিকে। ব্যাপারটা বুঝতে না পারলে আমি একটা কাজ করি, আঁখিতারাকে বিছানায় শুইয়ে তার পাশে বসে দেখাই কেন একজন ঘাড়ের বাঁ দিকে চিমটি দেবে, আরেকজন দেবে ডান দিকে। দেখাব?

মনসুর শান্ত গলায় বলল, দেখাতে হবে না। আপনি কি বলছেন আমি বুঝতে পারছি।

আঁখিতারা চা নিয়ে ঢুকেছে। মনসুর সহজভাবেই চায়ের কাপে চুমুক দিল। মিসির আলি বললেন, মনসুর শোনো। লজিক হচ্ছে সিঁড়ির মতো। লজিকের একটি সিঁড়িতে পা দিলে অন্য সিঁড়ি দেখা যায়। তুমি আমার ঘরে ঢুকেছ এটা জানার পর বুঝতে পারলাম রেবু মেয়েটির সঙ্গে তোমার যোগাযোগ আছে।

কীভাবে বুঝলেন?

আমার বাসার একটা দরজা বাইরে থেকে তালা দেওয়া। সেই তালা খুলে এ বাসায় ঢোকা যায়। তালার চাবি রেবুর কাছে আছে। সেই চাবির একটা নিশ্চয়ই তোমার কাছেও আছে। আছে না?

হ্যাঁ আছে।

রেবুদের বাড়ির টেলিফোন নাম্বারও তুমি জানো। তুমি আমাকে ওই বাড়িতে টেলিফোন করেছিলে। মনে আছে?

আছে।

আমি একটা নতুন পাঞ্জাবি পরে সেজোগুজে বসে আছি। আমার কাজের মেয়েটা আমাকে তাড়া দিচ্ছে বের হওয়ার জন্য। তুমি একবারও জিজ্ঞেস করলে না আমরা কোথায় যাচ্ছি। জিজ্ঞেস করোনি কারণ তুমি জানো আমরা কোথায় যাচ্ছি। রেবুর সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলে তা জানা সম্ভব না। তুমি কি জানো আজ রেবুর বিয়ে?

মনসুর বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসল।

মিসির আলি বললেন, তুমি এই বাসায় এক সময় ভাড়াটে ছিলো। আমার এই অনুমান কি ঠিক আছে?

মনসুর চমকে উঠে বলল, এই তথ্য আপনাকে কে দিয়েছে?

মিসির আলি সহজ গলায় বললেন, রান্নাঘর দিয়েছে। রান্নাঘরের দেয়ালে হাজি আজমত আলি নামের এক ভদ্রলোকের নাম এবং টেলিফোন নাম্বার লেখা। তোমার হাতের লেখা আমি চিনি।

আপনি কি আমার সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার জন্য হাজি আজমত আলিকে টেলিফোন করেছিলেন?

না, টেলিফোন করি নি। তুমি এই বাড়িতে কতদিন ছিলে?

তিন মাস।

আমার ধারণা রেবুর সঙ্গে তখনই তোমার পরিচয় এবং প্রণয়। রেবু কি নিশিরাতে তালা খুলে তোমার ঘরে আসত?

হ্যাঁ।

অবস্থাটা তো তোমার জন্য ভালোই ছিল। তুমি তিন মাসের মধ্যে চলে গেলে কেন? রেবুর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল বলে?

হুঁ।

মিসির আলি বললেন, আমার সিগারেট শেষ হয়ে গেছে, একটা সিগারেট দাও। মনসুর সিগারেট দিল। লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে দিল। মিসির আলি বললেন, মনসুর তুমি কি মানুষ খুন করেছ?

মনসুর বলল, জি না।

রেবুকে পরামর্শ দিয়েছিলে তার স্বামী-সন্তান খুন করতে?

জি না।

তুমি যদি কিছু বলতে চাও বলো। আমি তোমার কথা খুব মন দিয়ে শুনব।

স্যার, রেবুর বাচ্চা হওয়ার পর তার সংসারে খুব অশান্তি শুরু হলো। রেবুর স্বামীর ধারণা হলো বাচ্চাটা তার না। রেবু একদিন স্বীকারও করল বাচ্চার বাবা অন্য একজন। তারপর দু’জনকেই বঁটি দিয়ে কেটে টুকরা টুকরা করে ফেলল।

তুমি আমার ঘরে কেন আসতে?

স্যার, আমি আপনাকে ভয় দেখিয়ে এই বাসা থেকে সরিয়ে দিতে চাচ্ছিলাম। কারণ, রেবু প্রায়ই বলত সে আপনাকে খুন করতে চায়। সে অসুস্থ একটা মেয়ে। ভয়ঙ্কর অসুস্থ। আপনাকে এই কথাটাই বারবার বলার চেষ্টা করেছি। আপনার বেঁচে থাকা আমার জন্য দরকার।

কেন?

স্যার, একমাত্র আপনিই রেবুকে সুস্থ করে তুলতে পারবেন। আর কেউ পারবে না। স্যার, আমি এই অসুস্থ মেয়েটাকে ভয়ঙ্কর ভালোবাসি।

মনসুর তাকিয়ে আছে। এই চোখের ভাষা মিসির আলি পড়তে পারছেন না। এই চোখ মমতা এবং ভালোবাসায় আর্দ্র।

মনসুরের চোখে পানি জমতে শুরু করছে। মিসির আলি অপেক্ষা করছেন চোখ থেকে পানির ফোঁটাটা কখন টেবিলের ওপর পড়ে। মনসুর যেভাবে বসে। আছে পানির ফোটা টেবিলে পড়ার কথা। অশ্রু চোখেই মানায়। কাঠের টেবিলে মানায় কি-না এটা তার দেখার ইচ্ছা।

No comments