ঘোড়ামামার অবদান – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

ঘোড়ামামার অবদান – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

সেদিন রাস্তায় বেরিয়েই আমার ঘোড়ামামার সঙ্গে দেখা হল। ঘোড়ামামা আসলে কারও মামা নন, তাঁর কোনও ভাগ্নে-টাগ্নেকে আমরা কোনওদিন দেখিনি; আর ঘোড়া তো তিনি নিশ্চয়ই নন, কারণ খুরওয়ালা চারটে পা তার নেই, তিনি কখনও চিহি চিহি করেও ডাকেন না। তবু সবাই তাঁকে সামনে মামা বলে, আড়ালে ঘোড়ামামা বলে ডাকে।

ঘোড়ামামা রাস্তা থেকে কী কুড়োচ্ছিলেন। সেটা কাঁধের একটা থলের মধ্যে ফেলে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর আমাকে বললেন, এই যে পেলারাম, কী বেপার?

ঘোড়ামামার জিভে একটু গণ্ডগোল আছে। চ্যাঁচানো-কে বলেন চিঁচানো, হাতিকে বলেন হেতি, বিউটি-কে বলেন বেউটি। লোকটি যে খুব খারাপ তা নন, কিন্তু দুটো ব্যাপারে তাঁর একটু স্বাধীন মতামত আছে। এক নম্বর কখনও দাড়ি কামাবেন না আর চান করবেন না, কারণ দাড়ি নাকি মুখের বেউটি–ঝিমোন পাতায় ঢাকা গোলাপ ফুল। তাঁর মুখ গোলাপ ফুলের মতো কি না তা নিয়ে আলোচনা করে অবশ্য লাভ নেই কিন্তু একরাশ ঝন্ধু দাড়িতে তাঁকে যা দেখায় সে আর কী বলব। আর চান করলে? ঘোড়ামামা বলেন, একটা গামছা তিনদিন জলে ভিজিয়ে রাখলে কী হয়? পচে যায়। তিমনি রোজ চান করলে– ইত্যাদি ইত্যাদি। মোক্ষম যুক্তি সন্দেহ কী!

ঘোড়ামামার দুনম্বর কাজ হল, রোজ সকালে থলে কাঁধে রাস্তায় বেরিয়ে পড়া। শ্যামবাজারে শুরু করেন, এসপ্লানেড পর্যন্ত আসেন, কখনও কখনও ভবানীপুর পর্যন্ত এগিয়ে যান। উদ্দেশ্য আর কিছু নয়, রাস্তা থেকে এটা-ওটা কুড়োতে থাকেন। যেমন সিগারেটের খালি বাক্স, জুতোর সোল, টিনের চাকতি, আলপিন, পেরেক, ছেঁড়া দড়ি–আরও নানারকম।

আমরা জিজ্ঞাসা করি : ঘো–সরি, মামা, এসব করেন কেন? উত্তরে মামা বলেন, লোকে না বুঝে কত দরকারি জিনিস ফেলে দেয়। আমি কুড়িয়ে জমা করি। কখন কী কাজে লাগে কে জানে!

তাই বলে জুতোর সোল?

হেঁ-হেঁ-জুতোর সোল। আজ জুতোর সোল পেলাম, কাল খানিক চামড়া পাব, পরশু একটা ফিতে পাব, ঘরে অনেক পিরেক আছে, তাই দিয়ে ঠুকে লাগিয়ে নেব। ব্যস, বিনি পয়সায় জুতো হয়ে যাবে। বুঝলে না পেলারাম?

এ বোঝা আর শক্ত কী! কিন্তু এভাবে করে যে কে জোড়া সম্পূর্ণ জুতো তৈরি হবে, মানে ঘোড়ামামার সারা জীবনেও সেটা সম্ভব হবে কি না–এ-সব কথাও যে মনে আসে না তা নয়। ঘোড়ামামাকে অবশ্য তা বলা যাবে না, তর্ক তিনি একদম পছন্দ করে না।

তিনবার ক্লাস সেভেনে ফেল করেও খাওয়ার ভাবনা ঘোড়ামামার নেই। তাঁর বাবা খানতিনেক বাড়ি রেখে গেছেন শ্যামপুকুরে, তার ভাড়া থেকেই তাঁর চলে। কাজেই নিশ্চিন্তে কলকাতার রাস্তায় তিনি দরকারি জিনিস কুড়িয়ে বেড়ান আর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সেগুলি জমা করেন।

আজও ঘোড়ামামা পথে বেরিয়েছিলেন। আমাকে দেখে বিকট দাড়ির ভেতর থেকে, তাঁর সেই গোলাপ ফুলের মতো মুখে, একটা বত্রিশ ইঞ্চি হাসি ফুটে বেরুল।

কোথায় যাচ্ছ পেলারাম?

বললুম, আমার বন্ধু হাবুল সেনের ওখানে।

–হেঁঃ, হেবুল সেন! গিয়ে তো খালি আড্ডা দিবে।

বললুম, তা এই ছুটির দিনে একটু গল্প-টল্প

–গোলপো? গোলপো আবার কী?–ঘোড়ামামা আমাকে ধিক্কার দিলেন : গোলপো তো ছোট ছোট ছিলেমেয়েরা শোনে। কাজ করো–কাজ। লেইফ ইজ শর্ট এণ্ড-এন্ড

আমি আন্দাজে বাকিটা জুড়ে দিলুম : ওয়ার্ক ইজ লং।

–হেঁ–লং। ভেরি লং। এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত। চলো আমার সঙ্গে। আজ আর তোমায় ছাড়ব না।

এই সেরেছে! ঘোড়ামামার পাল্লায় পড়লে কারও যে আর ছাড়ান নেই, সে আমি হাড়েহাড়ে জানি। একবার আমাদের পাড়ার ভজা ওরফে ভজসত্য ভাদুড়ী ঘোড়ামামার প্যাঁচে পড়ে যে কী নাজেহাল হয়েছিল, সে কথা মনে করে ভজা তো এখনও কাঁদেই, আমাদেরও কান্না পায়। আমি তিন পা পিছিয়ে গিয়ে বললুম, আমার ভারি খিদে পেয়েছে মামা। হাবুল আমায় খাওয়াবে।

–হেঁঃ, কী খাওয়াবে তোমাকে হেবুল সেন? আমি খাওয়াব যত চাও, তত খাওয়াব। কী রাজি?

ঘোড়ামামা খাওয়াবে? শুনে আমার চোখ তড়াং করে কপালে লাফিয়ে উঠল। আজ পর্যন্ত দুপয়সার চীনেবাদামও তো কাউকে খাইয়েছে বলে শুনিনি।

আমি বললুম, কী খাওয়াবেন ঘো–মানে মামা? চপ কাটলেট?

–ছেঃ, চোপ-কাটলেট! কী থাকে চোপ-কেটলেটে? পোচা মাংস-খেলেই অসুখ করে। রসগোল্লা খাবে?

আমি বললুম আলবাত খাব।

-কেঁচাগোল্লা?

–হ্যাঁ, কাঁচাগোল্লাও আমি খুব পছন্দ করি।

–তালশাঁস সন্দেশ?

আমি সুড়ৎ করে জিভে খানিকটা জল টেনে বললুম, খুব খাই মামা, পেলেই খাই।

–পাবে, পাবে, সোব পাবে। আচ্ছা, ছেনার জিলিপি?

এবার আনন্দে আমার নাচতে ইচ্ছে করল। ঘোড়ামামা যদি মাঝে-মাঝে চান করতেন আর ওঁর গায়ে ওরকম গন্ধ না থাকত, তাহলে আমি দু-হাতে মামাকে জাপটে ধরতুম। বললুম, বললে বিশ্বাস করবেন না মামা, ছানার জিলিপি খাওয়ার জন্যে আমি সাতমাইল রাস্তা হেঁটে যেতে পারি!

ঘোড়ামামা হাসলেন। একরাশ জংলা দাড়ির ভেতর তাঁর মুখোনাকে সত্যিই এবার গোলাপ ফুলের মতো বেউটিফুল মনে হল আমার। ঘোড়ামামা বললেন, তাহলে হাঁটো-হাঁটো আমার সঙ্গে। সব খেতে পাবে। বিনা কোষ্টে কি কিষ্টো পাওয়া যায় হে পেলারাম?

কিন্তু এখন এই পটলডাঙার মোড় থেকে রাস্তা কুড়োতে কুড়োতে এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত হন্টন! আমি মাথা চুলকে বললুম, মামা কী বলে ইয়ে মানে, আজকে ওয়ার্কটাকে একটু শর্ট করা যায় না? মানে, বেশ খিদেও পেয়েছে–

ঘোড়ামামা কট কট করে আমার দিকে চাইলেন। গম্ভীর মোটা গলায় বললেন, না ওয়ার্ক, নো ইটিং–হেঁ-হেঁ!

বুঝতে পারলুম, ঘোড়ামামা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, কথায় চিঁড়ে ভিজবে না। কিন্তু রসগোল্লা, তালশাঁস সন্দেশ, কাঁচাগোল্লা, ছানার জিলিপি তখন আমার চোখের সামনে লাফাতে শুরু করেছে। এমন মওকা জীবনে কবার আসে? একটু কষ্ট করলেই যদি

আমি বললুম, চলুন ঘোড়া–আই মিন মামা–যা থাকে কপালে।

–কোপাল তোমার আজ খুবই ভালো হে, শিয়াল বাঁয়ে করে বেরিয়েছিলো বলেই ঘোড়ামামা খপ করে আমার হাত চেপে ধরলেন : নাও টু একশন!

অ্যাকশন তো বটেই। দুজনে দেশলাইয়ের খাপ, ভাঙা টিনের বাক্স, কার একটা ফেলে দেওয়া টুথব্রাশ, পেরেক, এইসব সমানে কুড়িয়ে যেতে লাগলুম। সত্যি কথা বলতে কী, আমার ভীষণ ঘেন্না করছিল, আরও খারাপ লাগছিল, যখন রাস্তার লোকে ডেকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে লাগল : কী মশাই, কী হারিয়েছে? আমি দু-একবার বলেও ছিলুম, ঘোড়ামামা, আজ বরং থাক, অনেক তো হল উত্তরে ঘোড়ামামার এক জবাব : কোষ্টো ছাড়া কিষ্টো মিলে না হে পেলারাম, রসগোল্লা, ছেনার জিলিপি কি এতই সস্তা?

শেষে পিঠ টনটন করতে লাগল, হাঁটু ব্যথা করতে লাগল, খিদেটা আরও বিচ্ছিরিভাবে পেটে মোচড় দিতে লাগল। আমি আর থাকতে না পেরে বললুম, ঘোড়ামামা, কী লাভ হবে এসব কুড়িয়ে?

ঘোড়ামামার চোখ পিটপিট করতে লাগল। হাতের মুঠো খুলে বললে, কী দেখছ?

–একটা ফাউন্টেন পেনের ভাঙা নিব।

হেঁ, নিব। আজ নিব পেলাম, কাল বডি পাব, পরশু হয়তো ক্যাপটাই পেয়ে যাব। ব্যস পুরো একটা ফেউন্টেন পেন হয়ে গেল।

আমি মাথা চুলকে বললুম, কিন্তু

–তোর্ক কোরো না পেলারাম-একশন!

অগত্যা আবার সেই অ্যাকশন! সেই সন্দেশকাঁচাগোল্লা-ছানার জিলিপির লোভে রাস্তার যা পাচ্ছি কুড়োচ্ছি আর ঘোড়ামামার ঝোলায় ভর্তি করে দিচ্ছি। বাড়ি গিয়ে কার্বলিক সাবান মেখে চান করতে হবে, হাতে আবার একজিমা না হলে বাঁচি!

শেষ পর্যন্ত এসপ্ল্যানেড।

তখন মাথা ঘুরছে–চোখে সর্ষে ফুল দেখছি, পিঠের ওপর তিনটে কুঁজ গজিয়েছে এমনি মনে হচ্ছে, পা দুটো যেন হাঁটু থেকে ছিঁড়ে পড়তে চাইছে, খিদের জ্বালায় পেটের ভেতর যেন তিরিশটে চামচিকে দাপাদাপি করছে। আমি ধপাস করে ফুটপাথেই বসে পড়লুম। ঘোড়ামামা সেই বেউটিফুল মুখে এক গাল হেসে আমার পিঠে হাত রাখলেন।

সাবাস পেলারাম, খুব খেটেছ। এইবার তোমার পুরিস্কার?

আমি বললুম, চলুন, শিগগির চলুন ওই মিষ্টির দোকানে। খিদেয় মরে গেলুম!

–মিষ্টির দোকান? কী হবে?–ঝুলি থেকে পায়ে দড়ি বাঁধা কী একটা ছোট্ট প্রাণীকে টেনে বের করলেন ঘোড়ামামা। সেটা শূন্যে তিড়িং তিড়িং করে নাচতে লাগল। একটি নেংটি ইঁদুর। কখন কুড়িয়ে নিয়েছেন–কে জানে।

ঘোড়ামামা বললেন, এই নাও। ইতেই সোব হয়ে যাবে।

তিনটি খাবি খেয়ে আমি বললুম : নেংটি ইঁদুর।

নিশ্চয়! ঘোড়ামামা বত্রিশ ইঞ্চি হাসি ছড়িয়ে বলে চললেন, ইটাকে নিয়ে তোমাদের ভাঁড়ারে ছেড়ে দাও। অনেক বাচ্চা হবে, উৎপাত করবে, তখন তোমার বাবা বেড়াল নিয়ে আসবে। বেড়ালকে দুধ খাওয়াতে হবে, তোমার বাবা গোরু কিনবে। সেই গোরু দুধ দিবে, সেই দুধে সন্দেশ হবে, কেঁচাগোল্লা হবে, ছেনার জিলিপি হবে, ক্ষীরের পেঁড়া হবে, পিঠে হবে–দ্যাখো, আরো কত জিনিস তোমায় খাইয়ে দিলাম। খুশি হয়েছ তো পেলাম।

বলে, দড়িসুদ্ধ নেংটি ইঁদুরটা আমার হাতে গুঁজে দিয়ে, সুট করে যেন কোন দিকে হাওয়া হয়ে গেলেন ঘোড়ামামা।

No comments