আমার বন্ধুরা – হুমায়ূন আহমেদ

আমার বন্ধুরা – হুমায়ূন আহমেদ

বইমেলার সময় শেষ।

এ সাতটাতেই সময় শেষ হয়, এখন বাজছে নটা।

কোথাও কেউ নেই নামের স্টলে বসে আছি। হলুদ পর্দা ফেলে দেয়া হয়েছে। চা এসেছে, ঝালমুড়ি এসেছে।

চা, ঝালমুড়ি, সিগারেট সমানে খাওয়া হচ্ছে। দিনের ক্লান্তির শেষে জমিয়ে আড্ডা দেয়া। অতি সামান্য রসিকতাতেই আমরা হো হো করে হাসছি। মনে হচ্ছে এই জীবনটা তো খুব খারাপ না।

এমন এক আনন্দময় সময়ে মনে পড়ল জনৈক তরুণ আমাকে একটা স্লিপ ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, বাসায় গিয়ে পড়বেন।

স্লিপে মজার কিছু থাকতে পারে, মজার সেই ব্যাপার নিয়ে সবাই আরো আনন্দ করতে পারেন ভেবে স্টলে বসেই স্লিপটা পড়লাম। মুহূর্তেই সমস্ত আনন্দ বাতাসে মিশে গেল। স্লিপটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেললাম–আমার বন্ধুরা যেন সেই লেখা পড়তে না পারেন। যে আনন্দ-মুহূর্ত আমরা তৈরি করেছি–স্লিপের এই লেখা সেই আনন্দকে বিষাক্ত করে তুলবে।

আড্ডার একজন বললেন, কি লেখা?

আমি বললাম, গালাগালি।

অভিনেতা মোজাম্মেল হোসেন বললেন, চিঠি লিখে গালাগালি কেন? মুখে গালাগালি করলেই হয়। গালাগালি যদি কেউ শুনতেই না পেল, তাহলে কিসের গালাগালি?

সবাই হাসতে শুরু করল। আমিও হাসছি। আড্ডার আনন্দধারা প্রবাহিত হচ্ছে আমি সেই ধারায় নিজেকে যুক্ত করতে পারছি না। স্লিপের সামান্য কয়েক লাইন আমাকে তীব্র যন্ত্রণার মুখোমুখি করে দিল।

না, সেখানে গালাগালি ছিল না। গালাগালিতে আমার কিছু হয় না। আমি এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমার অতি প্রিয়জনরাও আমাকে লিখিতভাবে পত্রিকার ছাপার অক্ষরে এত গালাগালি করেছেন এবং এমন নোংরা ভাষা ব্যবহার করেছেন যে ট্যানারিতে না গিয়েও আমার চামড়া ট্যান হয়ে গিয়েছে। এই চামড়ায় কিছুই লেগে থাকে না। পিছলে যায়। উদাহরণ দিতে পারতাম, ইচ্ছে করছে না। রুচিতে বাধছে।

মানুষের গালাগালি, অপমান এইসব আমি সেধে এনেছি। আমি যদি লেখালেখি না। করতাম, যদি নিজের ছোট্ট সংসারে নিজেকে আটকে রেখে জীবন পার করে দিতে পারতাম তাহলে কেউ আমাকে গালাগালিও করত না, অপমান করার সাহসও পেত না। ধন নয়, মান নয় এতটুকু বাসার ফিলসফি মন্দ নয়।

জীবনের শুরুতে আমার আশা-আকাঙ্ক্ষা এতটুকুই ছিল–তারপর কি যে হল, এক নিশিরাতে আমার ছোট্ট ঘরে জোছনার আলো এসে পড়ল। ইচ্ছে করল জোছনার এই আলোর কথা সবাইকে জানিয়ে দি। কাগজ এবং কলম হাতে তুলে নিলাম। একদল চোখ লাল করে বললেন–কি লিখছে এসব? গেল গেল, সাহিত্য গেল! বই পাড়া ভর্তি হয়ে গেল জঞ্জালে। ঘর মে এত্তা জঞ্জাল। তাঁরা মর্জিনা হয়ে ঝাড়ুর সন্ধানে গেলেন। অতি বিজ্ঞদের একজন, যার জীবনের একমাত্র ব্যর্থতা না কি ব্যর্থতার অভাব, ভুরু কুঁচকে ভাবতে বসলেন এই সাহিত্যের কি নাম দেয়া যায়? নাম খুঁজেও পেলেন–অপন্যাস। তার মহান আবিষ্কার স্বাভাবিক নিয়মে তার কাছেই ফিরে। গেছে। জীবনের গভীর সত্য অনুসন্ধানের ভান যারা করেন তারা কখনোই সহজ সত্য টের পান না। এও এক অমোঘ জাগতিক নিয়ম।

যাই হোক। স্লিপের প্রসঙ্গে ফিরে যাই। সেখানে লেখা—

হুমায়ূন সাহেব,

আপনাকে সব সময় ঘিরে থাকে একদল মুর্খ প্রকাশক এবং কিছু শিক্ষিত মুর্খ চাটুকার। মোসাহেব ছাড়া আপনি চলাফেরা করতে পারেন না। আপনার সবচে ক্ষতি করছে স্তাবকরা এবং মুর্খ প্রকাশকরা। এদের ত্যাগ করুন। আখেরে ভাল হবে।

অথচ আমার চারপাশে যারা বসে আছেন এঁরা আমার অতি প্রিয়জন। লেখালেখি করতে গিয়ে আমি তো সবই ত্যাগ করেছি। আর কত? আমার পাশে বসে আছেন সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী। আমরা স্তাবকতা করে তার কিছু পাবার নেই। আছেন কবি হাসান হাফিজ। তার থাকা উচিত ছিল কবিদের সঙ্গে। কিন্তু তিনি কবিদের ছেড়ে একজন গদ্যকারের সঙ্গে কেন আড্ডা দিতে আসেন, তা তিনিই জানেন। দৈনিক বাংলার জন্যে লেখা দরকার, এই কারণেই কি তার আমার পাশে বসে থাকা? আমার স্তাবকতা করার জন্যে দৈনিক বাংলা তাঁকে বেতন দিচ্ছে না।

আমি আমার নিজের নিঃসঙ্গতা ঘোচাবার জন্যে এঁদের আটকে রাখি। পত্রিকার কাজের দোহাই দিয়ে হাসান হাফিজ উঠতে যান–আমি তার শার্ট খামচে ধরে বলি–অসম্ভব যেতে পারবেন না। থাকতে হবে।

হাসান হাফিজ রুখে গিয়ে বলেন আপনার না হয় চাকরি বাকরির ব্যাপার নেই। অটোগ্রাফ দিতে পারলেই হল। কিন্তু আমি তো চাকরি করি।

অসম্ভব। আপনাকে কিছুতেই যেতে দেয়া হবে না।

হতাশ হয়ে তিনি বসে পড়েন।

শুরু হয় গল্প। সেই গল্পে আর যাই থাকুক হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য থাকে। এরা আমার অতি প্রিয়জন। নিজের অপমান আমি সহ্য করতে পারি, বন্ধুদের অপমান কখনোই না।

প্রকাশকদের কথা বলা হচ্ছে–হ্যাঁ আমাকে দিয়ে তাদের কিছু স্বার্থ সিদ্ধি তো হবেই। কিন্তু একটা ব্যাপার ভুললে চলবে না। এঁরা আমার উপর যতটা নির্ভরশীল–আমি তাদের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। আমার লেখা এদেশের প্রতিটি আনাচে কানাচে পৌঁছে দিচ্ছেন তারাই। আজকের এই বইমেলার বিশাল আয়েজনের নেপথ্য নায়ক এঁরাই। পাঁচ বছর আগের বইমেলার সর্বাধিক বিক্রিত একটি গ্রন্থের বিক্রয় সংখ্যা ছিল সাত শ। আজ একজন নবীন লেখকের লেখাও মেলার প্রথম দশদিনে এক হাজার কপির বেশি বিক্রি হয়।

মানুষকে গ্রন্থের প্রতি আগ্রহী করার প্রধান ভূমিকা এই প্রকাশকদের। এঁরা ব্যবসায়ী। একজন ব্যবসায়ী লাভ-লোকসান দেখবেন। কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে, এরা লাভ-লোকসান বিবেচনা করে চিনি বা পেঁয়াজের ব্যবসায় যাননি। এসেছেন বই-এর ব্যবসায়, যার কোন স্থিরতা নেই। এঁদের যুদ্ধ করতে হচ্ছে পাশের দেশের শক্তিমান প্রকাশকদের সঙ্গে। যাদের আছে দীর্ঘদিনের প্রকাশনার অভিজ্ঞতা।

আমার বই-এর যারা প্রকাশক তারা সবাই অল্পবয়স্ক। কারো বয়সই আমার। চেয়ে বেশি নয়। প্রতিষ্ঠিত পুরানো প্রকাশকরা আমার প্রতি আগ্রহী হননি। আগ্রহী হয়েছেন তরুণ-প্রকাশকরা–আজ আমাদের প্রকাশনা শিল্পের যে জয়জয়কার তা তাদের উদ্যম এবং কর্মপ্রচেষ্টার সোনালী ফসল।

কলকাতার প্রকাশকরা সেখানে আমার নয়টি বই প্রকাশ করেছেন। মনিলিখো কাগজ নামে চমৎকার কাগজ ব্যবহার করেছেন। তারপরেও সেসব বই এবং এদেশে। প্রকাশিত আমার বইগুলি যখন পাশাপাশি রাখি তখন কোন রকম দ্বিধা ছাড়াই বলতে বাধ্য হই–আমাদের দেশে প্রকাশিত বইগুলির প্রকাশনা মান অনেক অনেক উপরে।

আমরা যাত্রা শুরু করেছি–এই যাত্রা দীর্ঘ যাত্রা। পথ তৈরি নেই। বন কেটে পথ বানাতে হচ্ছে। বানাচ্ছেন এই সময়ের তরুণ প্রকাশকরা। তাদের মুখ বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করতে চাইলে করা যেতে পারে। কিন্তু এই মুর্খ(!)রাই চেষ্টা করে যাচ্ছেন যেন। দেশ থেকে মুর্খ শব্দটি উঠে যায়।

আমার বন্ধু এঁরাই। মহা আঁতেল বিজ্ঞ পণ্ডিতরা নন। আমার লেখা ছেপে ওঁরা যে অপরাধ করেছেন–বিজ্ঞ পণ্ডিতদের লেখা ছেপে সেই অপরাধ তারা কাটান দেবার চেষ্টাও করছেন। অন্তত এই ধন্যবাদটুকু তো তাদের প্রাপ্য।

No comments