লোহাগড়ার দুর্বাসা মুনি – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

লোহাগড়ার দুর্বাসা মুনি – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

এপ্রিলের এক রবিবারের সকালে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখি আবহাওয়া বেজায় গুরুগম্ভীর। ওঁর ভৃত্য ষষ্ঠীচরণ কঁচুমাচু মুখে মেঝে থেকে কাচের টুকরো কুড়োচ্ছ। কর্নেলের মুখে বিরক্তি ও চাপা রাগ থমথমে করছে। আমি ঢুকলেও দুমিনিট কথা বললেন না যখন, তখন আমার একটু রাগ হল। ঘুরে দরজার দিকে পা বাড়ালাম।

সেই সময় কর্নেল গলায় ভেতর গমগম করে বললেন, জয়ন্ত, আমার এ সর্বনাশ দেখেও তুমি চলে যাচ্ছ? আশ্চর্য, আশ্চর্য! আজ দেখছি পৃথিবী শুদ্ধ আমার শত্রু হয়ে উঠেছে।

অগত্যা ফিরে এসে সোফায় বসলুম। বললুম সর্বনাশটা কী আর এমন করেছে? ষষ্ঠীচরণ একটা গেলাস-টেলাস ভেঙে ফেলেছে। এই তো? সব বাড়িতেই ঝি -চাকরেরা এমন ভাঙে। তার জন্যে

কথা কেড়ে কর্নেল বললেন, গেলাস নয়, জয়ন্ত। সেদিন লোহাগড়া থেকে যে আশ্চর্য সুন্দর ঘাসফড়িংটা এনেছিলাম, জার ভেঙে, সেটা উড়ে গেছে। আর জারটা ভেঙেছে কে জানো? ওই গবেট, বুন্ধু হাঁদারাম, হতচ্ছাড়া ষষ্ঠীচরণটা।

ষষ্ঠীচরণ কাচ কুড়িয়ে চুপচাপ ঘর থেকে চলে গেল। আমি বললুম, একটা ঘাসফড়িং, নিয়ে এত উত্তেজনার কী আছে?

কর্নেল চটে গিয়ে বললেন, ওটা সেই সিস্টোসার্কা গ্রেগরিয়া! অর্থোপটেরা প্রজাতির ঘাসফড়িং, যাকে বলা হয় পঙ্গপাল। এসব ঘাসফড়িং মরুভূমিতে বাস করে।

হাসতে হাসতে বললুম, লোহাগড়া নিশ্চয় মরুভূমি নয়। শুনেছি জায়গাটা জঙ্গল। সেখানেও মরুভূমির পঙ্গপাল পেয়ে গেলেন? আপনার বাহাদুরি আছে।

কর্নেল বিরক্ত হয়ে বললেন জয়ন্ত! সিস্টোসার্কা গ্রেগরিয়া হল মাইগ্রেটরি পতঙ্গ। অর্থাৎ সাইবেরিয়ার হাঁসের মতো এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঝাঁক বেঁধে যাতায়াত করে। অনেক সময় হয় কী, দুচারটে পঙ্গপাল বা ঘাসফড়িং কেন কে জানে, ঝাঁকের সঙ্গে মরুভূমিতে ফিরে যায় না। দলছুট হয়ে থেকে যায়। হাঁসের বেলাতেও তাই। এখন কথা হল, এরকম দলছুট ঘাসফড়িং দস্তুরমতো গবেষণার বিষয়। কেন তারা দলের সঙ্গে ফেরে না? তারা কি ইচ্ছে করেই আলাদা হয়ে থেকে যায় দলের চোখ এড়িয়ে? কেন থাকে? কী তাদের উদ্দেশ্য?

কর্নেল মাঝে মাঝে কান ঝালাপালা করে দেন। বললুম বুঝেছি, বুঝেছি! তাহলে ষষ্ঠীচরণ সত্যি বড্ড দোষ করে ফেলেছে। কিন্তু ঘাসফড়িংটা যাবে কোথায়? দাঁড়ান—খুঁজে দেখি।

কর্নেল দুঃখিত মুখে বললেন, খুঁজলেও আর পাবে না জয়ন্ত! ষষ্ঠীচরণকে কি শুধু জার ভাঙার

জন্যে বকাবকি করছিলুম ভাবছ? করছিলুম ওর বেড়াল পোষার জন্য।

বেড়াল? অবাক হয়ে বললুম। বেড়াল পুষলে দোষ কী? ইঁদুর হবে না ঘরে। ভালই তো। কর্নেল চটে গিয়ে বললেন, আহা ওর বেড়ালটাই যে ঘাসফড়িংটাকে গপ করে গিলে ফেলল। তুমি আসল কথাটা শুনবে না, খালি স্তব্ধ করবে। জারটা ষষ্ঠীচরণের কনুইয়ের খুঁত লেগে যেই পড়ে গিয়ে ভেঙেছ, ঘাসফড়িংটা উড়ছে। এদিকে ষষ্ঠীচরণের পায়ে পায়ে ঘোরে নচ্ছার কালেকুচ্ছিত বেড়ালটা। চোখের পলকে গপ করে গিলে ফেলল ফড়িংটা। উঃ! কী সাংঘাতিক দৃশ্য! বেড়ালটাকে আমি গুলি করে মারতে যাচ্ছিলুম। পালিয়ে গেল।

জানালা দিয়ে পাশেই একটা প্রকাণ্ড নিমগাছ দেখা যায়। সেই গাছে কাকের চেঁচামেচি শুনে উঁকি মেরে দেখলুম, কালো একটা বেড়াল নিমগাছের ডাকে কুঁকড়ে বসে আছে এবং কাকগুলো মহা খাপ্পা হয়ে তাকে তাড়ানোর চেষ্টা করছে। পঙ্গপাল ফড়িং খেয়ে কি বেড়ালটার বদহজম হয়েছে যে কাকদের সঙ্গে লড়াই করতে গেছে? বললুম, কর্নেল! কর্নেল! ওই দেখুন নচ্ছার খুনি ওখানে বসে আছে।

কর্নেল হন্তদন্ত হয়ে উঠে এসে দেখতে দেখতে বললেন, রিভলভারের রেঞ্জের বাইরে। ঠিক আছে। দেখি, কতক্ষণ পালিয়ে বেড়ায়।

আমার ইদানীং বড্ড অবাক লাগে এই কর্নেলবুড়োর আচরণ। একসময় মানুষ খুন বা রহস্যময় চুরি ডাকাতি নিয়ে মাথা ঘামাতেন! পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর অফিসাররা গণ্ডগোলে পড়লেই তার সাহায্য চাইতে ছুটে আসতেন। এখনও আদর করে কর্নেলকে ওরা বলেন বুড়ো ঘুঘু। ওঁর এই ফ্ল্যাটটার নাম দেওয়া হয়েছিল বুড়োঘুঘুর বাসা। সেই ঘুঘু অর্থাৎ গোয়েন্দাপ্রবর এখন প্রকৃতিবিদ হয়ে উঠেছেন দিনে দিনে। দেশবিদেশের প্রকৃতিবিষয়ক পত্রিকায় পাখি প্রজাপতি-ফড়িং কিংবা অর্কিড-ক্যাকটাস ইত্যাদি নিয়ে প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেছেন। মানুষের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে প্রকৃতি-টকৃতি নিয়ে মাথা ঘামানোর কারণ কী? এ কি বার্ধক্যজনিত বৈরাগ্যেরই রকমফের? অথচ জানি, এখনও গায়ে অসুরের শক্তি। পাহাড় বনজঙ্গল চষে বেড়ানোর সময় আমার মতো যুবকও ওঁর সঙ্গে হাঁটতে হাঁপিয়ে উঠি।

কিছুক্ষণ পরে কফি খেতে খেতে বললুম, হতভাগ্য বিড়ালকে ক্ষমা করে দিয়ে বরং ফের লোহাগড়া গিয়ে ওই পতঙ্গটিকে খুঁজে আনুন।

কর্নেল হতাশ ভঙ্গিতে বললেন, আর কি পাওয়া যাবে?

বললুম, আহা! খুঁজে দেখতে দোষ কী? আমিও না হয় যাব আপনার সঙ্গে।

এবার কর্নেল একটু হাসলেন। তুমি বুঝি ছুটিতে আছ?

আছি। এই বসন্তকালে কলকাতায় পচে মরার মানে হয় না তাই ভাবছিলুম, কোথাও বেড়াতে যাওয়া যায় কি না। আসল কথাটা এতক্ষণে খুলে বললুম। এবং সেই উদ্দেশ্যেই সাতসকালে আপনার কাছে হাজির হয়েছি।

কর্নেল ফোনের কাছে গেলেন। একমিনিট জয়ন্ত, রেলদফতরে আমার বন্ধু মিঃ রামস্বামীকে ফোন করে দেখি দুটো বাৰ্থ আজ রাতে পাওয়া যায় নাকি।…

লোহাগড়া মধ্যপ্রদেশের পাহাড়ি এলাকার একটি সংরক্ষিত জঙ্গল। জঙ্গলের ভেতর একটা সুপ্রাচীন ঐতিহাসিক দুর্গ আছে। এখন ভাঙাচোরা অবস্থা। খয়েরি রঙের পাথরে তৈরি এই দুর্গকে লোহার পুরী বলে মনে হত বলেই এর নাম ছিল লৌহগড়। তাই থেকে লোহাগড়া হয়েছে।

ফরেস্ট বাংলো জঙ্গলে ঢোকার মুখে। সেই বাংলোর চৌকিদার বলল, সাবধানে থাকবেন স্যার। ইদানীং ওখানে একটা মানুষখেকো বাঘের উপদ্রব হয়েছে। সরকার থেকে দুজন শিকারি পাঠানো হয়েছিল। তাদেরও বাঘটা খেয়ে ফেলেছে, তাই কোনও শিকারি আর আসতে সাহস পাচ্ছে না। গ্রামে দিনের বেলাতেও বাইরে বেরুচ্ছে না লোকে। ঢোকা তা দূরের কথা।

কর্নেল ওর কথা গ্রাহ্য করেছেন বলে মনে হল না। আমার শিকারের শখ আছে এবং বনে-জঙ্গলে এলে তাই রাইফেলটা আনতে ভুলি না। তাই কথা শুনেও তত দমে গেলুম না।

কর্নেল একটা ছোট্ট জাল, বাইনোকুলার আর ক্যামেরা নিয়ে বেরুলেন। আমি রাইফেলটায় গুলি ভরে সঙ্গে নিলুম। তারপর পায়ে হেঁটে বেরিয়ে পড়লুম লোহাগড়া দুর্গের দিকে।

পাহাড়ি ঢলের নিচে একটা নদী আছে। নদী পেরিয়ে যেতেই অবাক হয়ে দেখি, এক সাধু, হনহন করে এগিয়ে আসছে। আমাদের সামনে এসে সে চোখ কটমটিয়ে হিন্দিতে বলল, কোথায় যাচ্ছ তোমরা? মরার সাধ যদি না থাকে, আর এক পাও এগিও না। আমার বাহনকে ছেড়ে দিয়েছি। তোমাদের মুণ্ডু কড়মড়িয়ে খাবে, ওই শোনো!

সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গলের ভেতর কোথাও বাঘের গর্জন শোনা গেল পরপর দুবার। কর্নেল সাধুকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছিলেন। আমি রাইফেলটা শক্ত করে ধরলুম। কর্নেল একটু হেসে বললেন, সাধুজি! আপনার বাহনকে দয়া করে একটু সামলে রাখুন। আমরা লোহাগড়ায় গিয়ে মাত্র দুটো ঘাসফড়িং ধরব। ধয়া করে তার অনুমতি দিন। আর যদি অনুমতি না দেন, আমরা বিনা অনুমতিতেই দুর্গে যাব।

কর্নেল তামাশা করছেন কি না বুঝতে পারলুম না। সাধু তাঁর কথায় প্রচণ্ড ক্ষেপে গেল কেন কে জানে। তিড়িংবিড়িং করে কতকটা নাচের ভঙ্গিতে লাফালাফি করে বলল, অভিশাপ দেব বলে দিচ্ছি, সাবধান। আমি কে জানো? ঋষি দুর্বাসা!

কর্নেল বললেন, দুর্বাসার বাহন মানুষখেকো বাঘ—এমন কথা তো শুনিনি সাধুজি।

সাধু লম্ফঝম্ফ করে বলল, আবার তামাশা হচ্ছে আমার সঙ্গে? রোসো, দেখাচ্ছি মজা!

বলে সে তিনবার হাততালি দিল। অমনি বাঘের ডাক শোনা গেল আবার! এবার মনে হল ডাকটা আরও কাছে। তারপর আন্দাজ পঞ্চাশ গজ তফাতে একটা ঝোপের ভেতর আবছা ডোরাকাটা প্রাণীটাকে নড়াচড়া করতে দেখতে পেলুম। আমি গুলি করতে যাচ্ছি, কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন, আহা! করো কী জয়ন্ত! ঋষি দুর্বাসার বাহনকে মেরে কাজ নেই। চলো আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে যাই।

সাধু দাঁত কড়মড় করে বলল, মরবে। প্রাণে মারা পড়বে বলে দিচ্ছি।

কর্নেল গ্রাহ্য করলেন না। হাসতে হাসতে পা বাড়ালেন। আমি তো হতভম্ব হয়ে গেছি। ঝোপের আড়ালে বাঘটাকে আর দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু যে কোনও মুহূর্তে আমাদের ওপর আঁপিয়ে পড়তে পারে তো! বারবার সে গর্জন করছে।

সাধু চোখ কটমট করে আমাদের যাওয়া দেখছিল। যতদূর গেলুম পিছু ফিরে দেখলুম; সে একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। বললুম, বাঘটা যদি হামলা করে?

কর্নেল বললেন, জয়ন্ত! বাঘটা হামলা করবে না, তুমি নিশ্চিন্তে চলো।

অবাক হয়ে বললুম, কী বলছেন! মানুষখেকো, বাঘ বড় ভয়ংকর প্রাণী!

কর্নেল বললেন, আমার ধারণা, তার চেয়ে সাংঘাতিক প্রাণী ওই সাধু।

বলেই আমার হাত ধরে হ্যাচকা টান মেরে পাশের ঝোপে ঢুকে পড়লেন। তারপর গুড়ি মেরে হাঁটতে শুরু করলেন। দেখাদেখি আমিও সেই ভঙ্গিতে ওতে অনুসরণ করলুম। কর্নেলের এমন বিদঘুটে আচরণ আমার অজানা নয়। এসব সময় কোনও প্রশ্ন করে জবাবও পাব না, তাও জানি।

কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর কর্নেল ফিস ফিস করে বললেন, ওই দেখো জয়ন্ত। বাঘটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে, সেইখানেই।

আমি রাইফেল বাগিয়ে ধরতেই ফের বাধা দিলেন। তারপর গুড়ি মেরে দৌড়ে গেলেন। বাঘটাকে দেখতে পাচ্ছিলুম। ঝোপের ভেতর দাঁড়িয়ে উল্টোদিকে তাকিয়ে আছে। অথচ আশ্চর্য, বাঘের কান খুব প্রখর। মৃদুতম শব্দ বা নড়াচড়া টের পাওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা আছে বাঘের। বিশেষ করে এটা যদি সত্যি মানুখেকো বাঘ হয়, তাহলে এখনও ঘুরে দেখে আমাদের আক্রমণ করতে আসছে না কেন?

এরপর কর্নেল যা করলেন, দেখে আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। কাছে গিয়ে বাঘটার কান ধরে মাথায় দুই চাঁটি মারলেন। বাঘটা একটুও নড়ল না।

কাছে গিয়ে সব বুঝতে পারলুম। এটা আদতে বাঘের চামড়া পরানো একটা খড়ের বাঘ। কিন্তু তারপর আরেক কাণ্ড করলেন কর্নেল। ঝোপের ওপরে একটা ঝাকড়া গাছ রয়েছে। গাছের দিকে মুখ তুলে চাপা গলায় কাকে বললেন, ওহে। এবার সুড়সুড় করে নেমে এস তো! উঁহু উঁহু! পালানোর চেষ্টা কোরো না। গুলি খেয়ে প্রাণটি যাবে।

গাছের ডাল থেকে কৌপিনপরা কমবয়েসী আরেক সাধু ঝুপ করে লাফিয়ে পড়ল। কর্নেল তাঁর জটা ধরে ফেললেন। জটা উপড়ে এল। ন্যাড়া মাথা নিয়ে নকল সাধু গুলতির বেগে পালিয়ে গেল ঝোপঝাড় ভেঙে। কর্নেল হো হো করে হেসে ফেললেন।

বললুম, ব্যাপারটা কী?

কর্নেল বললেন, নকলবাঘের পিঠে এই যে দড়িটা বাঁধা রয়েছে দেখছ, এইটা হাতে নিয়ে লোকটা চড়ে বসে ছিল। এ একরকমের পুতুলনাচ বলতে পারো। তুমি গুলি করলেও এ বাঘকে আর খুঁজে পেতে না।

কিন্তু কেন?

আমাদের জঙ্গলে ঢুকতে দেওয়ার ইচ্ছে নয় দুর্বাসা মুনির। কেন তাই বলুন না?

সেটা বোঝা যাচ্ছে না। কর্নেল টুপি খুলে টাকে হাত বুলিয়ে যেন মগজকে চাঙ্গা করতে থাকলেন। তারপর সাদা দাড়ি থেকে একটা পোকা বের করে পোকাটা পরখ করে দেখে ফেলে দিলেন।

বললুম, কিন্তু বাঘের গর্জন?

কর্নেল বললেন, গর্জনটাও নকল। অভ্যাস করলে মানুষ বাঘের ডাক অবিকল নকল করতে পারে। তুমি কি জিম করবেটের শিকার কাহিনী পড়োনি? করবেট বাঘের ডাক ডেকে বাঘকে কাছে এনে গুলি করতেন। আরও অনেক শিকারির বইতেও এ ঘটনা পাওয়া যায়। শিকারি কেনেথ অ্যানডারসনও এভাবে অনেক বাঘ মেরেছিলেন। কিন্তু অবাক লাগছে জয়ন্ত, তুমি গর্জন শুনে বুঝতে পারলে না যে ওটা নকল বাঘের গর্জন? তুমি শিকার-টিকার তো অনেক করেছ!

একটু হেসে বললুম, তাই বলে কি কখনও বাঘ শিকার করেছি? বড় জোর পাখি কিংবা দু-একটা খরগোশ! অবশ্য একবার একটা শম্বর মেরেছিলাম ওড়িশার জঙ্গলে।

কর্নেল বললেন, যাকগে। চলো, আমরা দুর্গের ওখানে যাই…

দুর্গের ভেতরকার চত্বরে ঘন ঘাসের জঙ্গল। কর্নেল বললেন, এখানেই সেই ঘাসফড়িং দেখতে পেয়েছিলাম। জয়ন্ত, তুমিও খুঁজে দেখ। ফড়িংয়ের ডাক শুনতে পাচ্ছি যখন, তখন দু-একটা নিশ্চয় খুঁজে পাব।

যে ফড়িং ধরি, দেখে কর্নেল বলেন, নয়। সিস্টোসার্কা গ্রেগারিয়া এত সবুজ নয়! ধূসর রং। আরও মোটা। এদিকে মাথার ভেতর চৌকিদারের কাছে শোনা মানুষখেকো বাঘের কথাটা আছে। তাই বারবার চঞ্চল চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। বলা যায় না, দুর্গের এইসব ভাঙাচোরা ঘরে সত্যিকারের বাঘটা হয়তো এখন ঘুমোচ্ছিল। সাড়া পেয়ে জিভ চাটছে ওত পেতে। হালুম করে এখুনি ঝাঁপ দেবে।

কর্নেল টের পেয়ে বললেন, মানুষখেকো বাঘের ভয় কোরো না জয়ন্ত। বরং তার চেয়ে সাংঘাতিক প্রাণী সম্ভবত সেই সাধু—দুর্বাসা মুনি!

বলেই একলাফে সরে গেলেন। আঁতকে উঠে দেখলুম, সাঁই করে একটা তীর এসে কর্নেল যেখানে হাঁটু দুমুড়ে ঘাসে বসেছিলেন, সেখানে বিধে গেল। কর্নেল একটা পাথরের আড়ালে সরে গেছেন। আমিও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আরেকটা পাথরের আড়ালে লুকিয়েছি।

শোঁ শোঁ করে কয়েকটা তীর এসে বিঁধে গেল-এপাশ-ওপাশে। তারপর দৃষ্টি গেল বাঁদিকে একটা ভাঙা ঘরের দেওয়ালে ওপর। একটা লোক তীর-ধনুক নিয়ে দেওয়ালের ওপর গুড়ি মেরে বসে আছে। আরে! এ তো দেখছি, ফরেস্টবাংলোর সেই চৌকিদার! আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলুম কয়েক মিনিট। তারপর মরিয়া হয়ে উঠলুম। দুর্গের প্রাঙ্গণে ধ্বংসস্তুপের আড়ালে প্রায় বুকে হেঁটে সেই ভাঙা ঘরের বারান্দায় গিয়ে উঠলুম। কর্নেলকে কোথাও পেলুম না। পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকে দেখি ছাদ ভেঙে পড়েছে। দেয়ালের মাথায় চৌকিদার ধনুকে তীর জুড়ে উঁকি মেরে আমাদের খুঁজছে। তার পশ্চাদ্দেশে রাইফেলের নল ঠেকাতেই চমকে উঠে ঘুরল। চাপা গর্জন করে। বললুম, তীর-ধনুক ফেলে দাও। নইলে এফেঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাবে গুলিতে!

চৌকিদার তীরধনুক ফেলে দিল। তারপর কাকুতি-মিনতি করে বলল, দোহাই হুজুর। গুলি করবেন না। নামছি।

সে নেমে এল! তার পিঠে রাইফেলের নল ঠেকিয়ে ডাকলুম, কর্নেল! কর্নেল! বদমাশটাকে ধরেছি। ওদিকের ঘর থেকে কর্নেলের সাড়া এল।

….এখানে নিয়ে এস ওকে!

চত্বর পেরিয়ে গিয়ে দেখি, বারান্দায় সেই সাধুর সামনে রিভলভার হাতে কর্নেল দাঁড়িয়ে আছেন। সাধু কাকুতি মিনতি করছে। …. হুজুর! গরিব মানুষ পেটের দায়ে এ কাজ করছি। ছেড়ে দিন পুলিশে দিলে জেল হয়ে যাবে।

কর্নেল তাঁর জটা আর দাড়ি উপড়ে নিলেন। তারপর হাসতে হাসতে বললেন, দেখেছ জয়ন্ত, এ দুর্বাসা বাবাজিও তার চেলার মতো নকল সাধু।

বললুম, কিন্তু ব্যাপারটা কী?

কর্নেল বললেন, ব্যাপার খুব সামান্য। ওই ঘরে চোলাই মদের পিপে বোঝাই করে রেখেছে। এরা মনে হচ্ছে, এ কারবারের মালিক নয়, নিতান্ত পাহারাদার। এখানে রাখা পিপেগুলো সম্ভবত আজকালের মধ্যে চালান যাবে। আমরা এসে পড়ায় এবং লোহাগড়া দুর্গে যাব বলায় এরা বেগতিক দেখেছিল। তাই মানুষখেকো বাঘের ভয় দেখিয়েছিল। শেষে যখন দেখল, তাতেও ভয় পেলুম না এবং ওদের চালাকি ধরে পেলুম, তখন তীর ছুড়ে প্রাণে মারতে চেয়েছিল। তবে জয়ন্ত, মাঝখান থেকে লাভটা তোমারই হল! তোমার কাগজ দৈনিক সত্যসেবকে বড় করে খবর ছাপা হবে।

মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলে চোলাই মদের গুদাম আবিষ্কার!

বললুম, সম্প্রতি প্রায়ই বিষাক্ত চোলাই খেয়ে অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে এই এলাকায়। কর্নেল, আমার ধারণা, এসব সেই বিষাক্ত চোলাই মদ!

কর্নেল বললেন, পরীক্ষা করলে বোঝা যাবে। তবে চললা, আসামিদের পুলিশের জিম্মায় দিয়ে আসি। ওবেলা বরং এসে সিস্টোসার্কা গ্রেগারিয়া খুঁজে বের করব। আমার বিশ্বাস, ওই ঘাসফড়িংগুলো এখনও দুচারটে ঘাসে লুকিয়ে আছে।

চৌকিদার ও দুর্বাসা মুনিকে নিয়ে আমরা ফিরে চললুম জঙ্গলের পথে। যেতে যেতে কর্নেল ফের বললেন, চোলাই মদের তিন নম্বর পাহারাদারটাকেও ধরতে পারলে ভাল হত। লোকটা কিন্তু চমৎকার বাঘের ডাক ডাকতে পারে। কর্নেলের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দূরে আবার বাঘের ডাক শোনা গেল

—আউংঘ। আউং। বললুম, ওই শুনুন তিন নম্বর আসামি এখন ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছে।

কর্নেল আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়ে বললেন, না জয়ন্ত! এ ডাক সত্যিকার বাঘের। এখন বাঘের সঙ্গী খোঁজার ঋতু। লোহারগড়ার জঙ্গলে এতক্ষণে একটা সত্যিকারের বাঘ সঙ্গী খুঁজতে বেরিয়েছে। এসময় ওদের মেজাজ বড় চড়া থাকে। ওবেলা সাবধানে জঙ্গলে ঢুকতে হবে।…

No comments