আইরিশ রসিকতা – তারাপদ রায়

আইরিশ রসিকতা – তারাপদ রায়

না। আর কাছাকাছি নয়। পথচলতি চুটকি, উদ্ভট শ্লোক অনেক হল। একটু বিদেশ থেকে ঘুরে আসি। আর রসিকতার খোঁজে যদি বাইরেই যেতে হয়, প্রথমে আয়ারল্যান্ডেই যাওয়া উচিত।

অবশ্য এই রসিকতাগুলোর উদ্ভব খুব সরলভাবে, হাসাহাসি করতে করতে বা হাসাহাসি করার জন্যে নয়, এগুলি মোটামুটিভাবে অসূয়াপ্রসূত।

এই রসিকতাগুলো, অধিকাংশ কেন, প্রায় সর্বাংশেই ইংরেজদের সৃষ্টি। ইংরেজরা আইরিশদের দু’চোখে দেখতে পারে না। এই রসিকতাগুলোর উদ্দেশ্য হল বোঝানো যে আইরিশরা মাথামোটা এবং ধান্দাবাজ।

বাস্তব জীবনে আইরিশমাত্রই যে সেরকম, এমন ভাবা অবশ্যই উচিত হবে না। রাজনিতৈক শত্রুতাবশত প্রতিবেশীকে ইংরেজরা এভাবে ভেবে হেয় মনে করে। সে যাক গে, আমাদের বিবেচ্য হল আইরিশ রসিকতা।

লন্ডনের এক খবরের কাগজের সম্পাদক মহোদয় আইরিশম্যান। তাঁর পাসপোর্টের মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে। নতুন পাসপোর্ট করাবেন। ফটো লাগবে। অফিসের ফটোগ্রাফারকে ডেকে বললেন, ফটো তুলে দিতে।

এই আদেশে ফটোগ্রাফার সাহেব একটু বেকায়দায় পড়লেন। সম্পাদক মহোদয় স্বজাতিসুলভ কাঠখোট্টা, খোঁচা খোঁচা গোঁফ, মুখে হাসি নেই—তার ওপরে পাসপোর্ট ফটো সবসময়েই খারাপ ওঠে। সেই ছবি দেখে সম্পাদক নিজেই খেপে উঠবেন, তখন তো আর তাঁকে বলা যাবে না, ‘স্যার, আমার কোনও দোষ নেই। আমি কী করব, আপনার যেমন চেহারা তেমন ছবি উঠেছে।’

খবরের কাগজের বার্তা সম্পাদক ইংরেজ। তিনি ফটোগ্রাফারের সমস্যা শুনে বললেন, ‘আপনাকে কবে ফটো তুলে দিতে বলেছে?’

ফটোগ্রাফার বললেন, ‘সামনের সোমবার সকালে।’

বার্তা সম্পাদক বললেন, ‘তা হলে তো কোনও সমস্যাই নেই। আজ শুক্রবার। ঠিক তিনদিন আছে। আজ একটু পরে একবার সম্পাদকের ঘরে গিয়ে যে-কোনও একটা নতুন রসিকতা শুনিয়ে দিয়ে আসুন। আপনি তো রসিক মানুষ।’

ফটোগ্রাফার বললেন, ‘ওঁকে আর রসিকতা শুনিয়ে কী হবে, উনি তো আর হাসেন না।’

বার্তা সম্পাদক বাধা দিয়ে বললেন, ‘হাসবেন, হাসবেন। আইরিশদের হাসতে তিনদিন লাগে, সোমবার সকালে যখন ছবি তুলতে যাবেন, দেখবেন ফিকফিক করে হাসছেন।’

এই গল্পটা সেই গন্ডারের কাহিনীটা মনে করিয়ে দিল। গন্ডারের চামড়া এত পুরু যে তাতে সুড়সুড়ি, কাতুকুতু দিলে লাগে না। একদা এক গন্ডারকে জোর করে ধরে আচ্ছা করে কাতুকুতু দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ঠিক সাতদিন পরে গন্ডারটা হো হো করে হেসে উঠেছিল।

এই গল্পে আইরিশম্যানদের রসগ্রহণ ক্ষমতাকে গন্ডারের পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়েছে।

আইরিশম্যানের অপর গল্পটি একটু প্যাঁচালো। অবশ্য সেটা কোনও নির্বোধের গল্প নয়।

আদালতে এক আইরিশম্যানের বিচার হচ্ছে। সব শুনে-টুনে মাননীয় আদালত বললেন, ‘আদালতের এখানে কাছাকাছি কোনও লোক আছেন, যিনি বলতে পারবেন যে আপনি একজন সৎ লোক?’

আদালতের মধ্যেই স্থানীয় থানার দারোগাবাবু ছিলেন। তাঁকে দেখিয়ে আইরিশম্যান বললেন, হুজুর, ওঁকেই জিজ্ঞাসা করুন। আমি ওঁর থানার এলাকায় থাকি।’

থানার দারোগা বললেন, ‘আমি কিছু বলতে পারব না স্যার। এ ভদ্রলোককে আমি কখনও চোখেই দেখিনি।’

হাকিম সাহেব কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বিবাদী আইরিশম্যান বললেন, ‘তা হলে বুঝুন স্যার, দারোগাজি আমাকে কখনও চোখেই দেখেননি, আমাকে চেনেনই না। সৎ লোক প্রমাণের জন্যে আর কি সাক্ষী লাগবে, না সার্টিফিকেট লাগবে?’

অবশেষে মদ্যপ আইরিশম্যানের একটি সংক্ষিপ্ত গল্প।

গভীর রাতে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ভদ্রলোক রাস্তার ধারের একটা ল্যাম্পপোস্ট জড়িয়ে ধরে একটার পর একটা পাক খাচ্ছিলেন। একজন সেপাই এসে তাঁকে ধরলেন, ‘অনেক হয়েছে। এবার আমার সঙ্গে চল।’

আইরিশম্যান পুলিশের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন, ‘বলছেন কী সেপাইজি, দেখছেন না ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে জড়িয়ে গেছি! পাক খুলতে পারছি না!’

আইরিশ কথামালা সহজে শেষ হবার নয়। সহস্র এক রজনী না হলেও দিনের পর দিন এ রকম গল্প চালিয়ে যাওয়া যায়।

ডাবলিনের এক পানশালায় এক ষণ্ডা-গুণ্ডা চেহারার আইরিশম্যান ঢুকে দরজার মুখে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘এখানে মাইকেল নামে কে আছ? সাহস থাকে তো এগিয়ে এসো।’

অতি রোগা ও ল্যাকপেকে দুর্বল চেহারার এক ব্যক্তি এগিয়ে এল। সে বলল, ‘কী হয়েছে, শুনি? আমার নাম মাইকেল।’

সঙ্গে সঙ্গে গুণ্ডা লোকটি একটি বিরাশি সিক্কা ওজনের ঘুষি মেরে মাইকেলকে ধরাশায়ী করে বলল, ‘শালা, কী হয়েছে জান না? আমার নামে কী রটিয়ে বেড়াচ্ছ তুমি?’

মাইকেল কিন্তু অদমিত। সে ভূমিশয্যা থেকে গায়ের ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হো হো করে হাসতে লাগল।

‘মার খেয়ে হাসির ব্যাপার কী হল?’ গুণ্ডা লোকটি আরও ক্ষেপে গেল।

প্রহৃত ব্যক্তি অধিকতর হাসতে হাসতে বলল, ‘আমার নাম মোটেই মাইকেল নয়। কেমন জব্দ! কেমন জব্দ!’

এই পথিবীতে শুধুমাত্র একজন আইরিশম্যানের পক্ষে কাউকে এ ধরনের জব্দ করা সম্ভব।

এরপর পর চেয়েও গোলমেলে একটি ঘটনা বলি। একদিন সন্ধ্যাবেলায় থানায় একটা ফোন এল, ‘আমার নাম প্যাডি। আমি অমুক ঠিকানায় থাকি। আমি রাগের বশে সুইসাইড করার একশো ঘুমের বড়ি খেয়েছি।

সঙ্গে সঙ্গে অ্যামবুলেন্স জোগাড় করে থানা থেকে একটা জিপ প্যাডির বাড়িতে ছুটে গেল। থানার অফিসার প্রথমেই প্যাডিকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কখন ঘুমের ওষুধ খেয়েছেন?’

প্যাডি বললেন, ‘কাল রাতে।’

থানার দারোগা অবাক হয়ে বললেন, ‘সে কী? আপনি আজ রাতের কথা বলছেন। আজ শনিবার, আজ সন্ধ্যাতে আপনি ঘুমের ওষুধগুলো খেয়েছেন?’

প্যাডি বললেন, ‘না। না। আমি গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় ওষুধগুলো খেয়েছি।’

দারোগাবাবু বললেন, ‘অসম্ভব। শুক্রবার সন্ধ্যাবেলা আপনি একশোটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে থাকলে এখন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারেন না।’

প্যাডি চিন্তান্বিতভাবে বলেন, “তা হলে বোধহয় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যাবেলায় খেয়েছি।’

আইরিশ কথামালার এবারের মতো শেষ গল্পটি সাদা বাংলায় বলি।

এক ব্যক্তি মৃত্যুর পর পরলোকে গেছেন। চিরদিনই তাঁর টাকা-পয়সার দিকে ঝোঁক। মৃত্যুর পরেও তাঁর সে ঝোঁক কাটেনি।

সে যা হোক, পরলোকে গিয়ে যথারীতি তাঁর চিত্রগুপ্তের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে। তিনি দেখলেন শুধু পরলোকের বাসিন্দাদেরই নয়, চিত্রগুপ্ত সেখানকার তোষাখানারও হিসাবরক্ষক, সে তো কোটি কোটি টাকার ব্যাপার।

আগন্তুক চিত্রগুপ্তকে তোষামোদ করার জন্যে বললেন, ‘বহুকাল ধরে আপনি এইসব ঝামেলা নিজের হাতে সামলাচ্ছেন এটা কম কথা নয়।’

চিত্রগুপ্ত সাবেক দিনের ঝানু লোক, তিনি বললেন, ‘বহুকাল, বহুকাল বলবেন না। পৃথিবীর এক লক্ষ বৎসর এখানে এক মিনিটের সমান। পৃথিবীর এক লক্ষ টাকা এখানকার এক টাকার সমান।’

ধূর্ত ব্যক্তিটি বললেন, ‘পকেটে খুচরো টাকা-পয়সা কিছুই নেই। একটা টাকা ধার দেবেন?

চিত্রগুপ্ত মুচকি হেসে বললেন, ‘এ আর বেশি কথা কী! এক মিনিট অপেক্ষা করুন।’

এসব হাসাহাসির গল্প সহজে শেষ হতে চায় না, বিশেষত গল্পগুলো যখন এক শ্রেণীর লোকের বা কোনও, এক জাতিগোষ্ঠীর কাল্পনিক বা অর্ধসত্য, বোকামি ও নির্বুদ্ধিতা নিয়ে। যদি খুব একটা বিদ্বেষ বা নোংরা ভাব না থাকে, এসব খুচরো গল্প ভালই উপভোগ করা যায়।

প্যাডি নামক আইরিশ ভদ্রলোকটিকে নিয়ে নানা কাহিনী। তাঁরই আর একটি কাহিনী ধরা যাক।

প্যাডি সাহেব একদিন নদীর তীরে প্রাতর্ভমণ করছেন। এমন সময় দেখলেন সামনের ব্রিজের ওপর উঠে এক ব্যক্তি এদিক-ওদিক একটু তাকিয়ে নীচে নদীর মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

প্যাডি সাহেব দায়িত্বশীল নাগরিক। তিনি নিজে ভাল সাঁতার জানেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ডুবন্ত লোকটিকে উদ্ধার করলেন।

লোকটি তীরে উঠে প্যাডি সাহেবকে জানালেন, ‘আমি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলাম। যা হোক আপনি আমাকে প্রাণে বাঁচিয়েছেন। আপনাকে বহু ধন্যবাদ।’ এই বলে লোকটি চলে গেল।

কিন্তু কী সাংঘাতিক! একটু পরেই প্যাডি সাহেব দেখলেন সেই ব্যক্তি আবার ব্রিজে উঠে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

প্যাডি সাহেবের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া অত সহজ নয়। তিনিও আবার সঙ্গে সঙ্গে নদীতে ঝাঁপ দিলেন এবং আত্মহত্যাকারীকে পুনরায় মধ্যনদী থেকে উদ্ধার করলেন। এবারও লোকটি ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেল।

প্যাডি সাহেব সতর্ক দৃষ্টি রাখলেন লোকটির দিকে। লোকটি কিন্তু এবার আর ব্রিজের দিকে এগোল না। নদীর ধারে লম্বা লম্বা গাছ আছে, সেসব গাছে অনেক মোটা মোটা লতা ঝুলছে। প্যাডি সাহেব দেখলেন, লোকটা একটা শক্ত লতা ছিঁড়ে সেটা পাকিয়ে গাছের ডালে ঝোলাল। তারপর নিজের মাথা সেই লতার ফাঁসে গলিয়ে ঝুলে পড়ল।

নদীর ধারে প্রার্তভ্রমণকারী প্যাডি সাহেবের মতো অনেকেই ছিল। এই দৃশ্য চোখে পড়তে তারা ছুটে গেল। কিন্তু ততক্ষণে ব্যক্তিটির অভীষ্ট সিদ্ধ হয়েছে, সে মরে গেছে।

আজ ভ্রমণকারীরা কেউ কেউ ইতিমধ্যে দেখেছিলেন যে পরপর দু’বার প্যাডি সাহেব লোকটিকে জল থেকে উদ্ধার করেছেন। তাঁরা স্বভাবতই এবার প্যাডি সাহেবকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি জলে ডোবা থেকে এত কষ্ট করে বাঁচালেন, আর এত কাছে ছিলেন, গলায় ফাঁস দেওয়ার সময় লোকটাকে থামালেন না?’

প্যাডি সাহেব বললেন, ‘আমি ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারিনি। আমি ভেবেছিলাম ও বুঝি জলে ভিজে গেছে বলে নিজেকে গাছের ডালে ঝোলাচ্ছে, রোদ্দুরে নিজেকে শুকিয়ে নেবে বলে।’

এ অবশ্য খুবই বাড়াবাড়ির গল্প। এবার শেষ করতে হয়। তার আগে দুয়েকটা আলগা গল্প বলি।

এক আইরিশ ভদ্রলোক তাঁর নাম প্যাট্রিক তাঁর বাইরের বাগানে কোদাল দিয়ে গর্ত খুঁড়ছিলেন। এ ব্যাপারে বিশেষ অভ্যেস নেই, তাই গলদঘর্ম হচ্ছিলেন। পথ দিয়ে প্রতিবেশী কোহেন সাহেব যাচ্ছিলেন, তিনি কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ব্যাপার, প্যাট্রিক সাহেব? হঠাৎ বাগানে গর্ত খুঁড়ছেন কেন?

প্যাট্রিক সাহেব বললেন, ‘আমাদের পোষা কুকুর মারা গেছে। কবর দেওয়ার জন্য গর্ত খুঁড়ছি।’

পাশাপাশি তিনটে গর্ত খোঁড়া দেখে কোহেন সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ক’টা কুকুর মারা গেছে?’

প্যাট্রিক সাহেব বলনে, ‘ক’টা আবার? একটা। আমার তো একটাই কুকুর ছিল।’

কোহেন সাহেব গর্ত তিনটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তা হলে তিনটে গর্ত কেন?’

প্যাট্রিক সাহেব বললেন, ‘প্রথমে গর্ত দুটো ছোট করে খুঁড়ে ফেলেছিলাম। আমার কুকুরটা তো বেশ বড়। তাই শেষের গর্তটা বেশ বড় করে খুঁড়লাম।’

No comments