আর এক ঝড় (২) – আশাপূর্ণা দেবী

আর এক ঝড় – আশাপূর্ণা দেবী

৪. অতসীর ভাগ্যলিপি

অতসীর ভাগ্যলিপি রচিত হয়েছিল চিতাভস্মের কালি দিয়ে। এই ভয়ঙ্কর সত্যটা টের পেয়ে গেছে অতসী। টের পেয়ে গেছে বলেই নিজের জীবনের চিতা রচনা করল সে নিজেই। জীবনকে বিদায় দিল জীবন থেকে। জোর করে চলে এল ভালবাসার সংসার থেকে। যে সংসারে আরাম ছিল আশ্রয় ছিল, সমাজের পরিচয় ছিল, আর ছিল একান্ত ব্যাকুলতার আহ্বান।

সে সংসারকে ত্যাগ করে চলে এসেছে অতসী, সে ডাককে অবহেলা করেছে ভাগ্যের উপর প্রতিশোধ নিতে। ভাগ্য যদি তাকে সব দিয়েও সব কিছু থেকে বঞ্চিত করে কৌতুক করতে চায়, নেবে না অতসী সেই কৌতুকের দান।

তুমি কাড়ছ? তার আগেই আমি স্বেচ্ছায় ত্যাগ করছি। কি নিয়ে আত্মপ্রসাদ করবে তুমি কর।

কিন্তু অতসীর সব আক্রোশ কি শুধু ভাগ্যেরই উপর? তার প্রতিশোধের লক্ষ্য কি আর কেউ নয়? নয় আট বছরের একটা নির্বোধ বালক? তার উপরও কি একটা হিংস্র প্রতিশোধ উদগ্র হয়ে ওঠে নি অতসীর?

হ্যাঁ, সীতুর উপরও হিংস্র হয়ে উঠেছিল অতসী। তাই প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হয়েছে।

বুঝুক হতভাগা ছেলে পৃথিবী কাকে বলে, দারিদ্র্য কাকে বলে, অভাবের যন্ত্রণা কাকে বলে। সুরেশ রায়ের পরিচয় নিয়ে এই উদাসীন নির্মম পৃথিবীতে কতদিন টিকে থাকতে পারে সে দেখুক। সে দেখা তো শুধু চোখের দেখা নয়। প্রতিটি রক্তবিন্দু দিয়ে দেখা।

অতসী সেই দিনই মরতে পারত। কিন্তু মরে নি। মরে নি সীতুর জন্যে।

না, সীতুর মায়ায় নয়। সীতুকে রক্ষা করবার জন্যেও নয়, মরে নি সীতুর পরাজয় চোখ মেলে দেখবার জন্যে।

তিলে তিলে অনুভব করুক সীতু মৃগাঙ্ক তাকে কী দিয়েছিল, অনুভব করুক মৃগাঙ্ক তার কি ছিল!

.

সেই রাত্রে অদ্ভুত জিদ করে মৃগাঙ্কর গাড়ি থেকে নেমে পড়েছিল অতসী ছেলেকে নিয়ে। সুরেশ রায়ের ভাইঝির বাড়ির দরজায়।

কী যেন ভেবে মৃগাঙ্ক বেশি বাধা দেন নি। অথবা ক্লান্ত পীড়িত বিপর্যস্ত মন তাঁর বাধা দেবার শক্তি সঞ্চয় করে উঠতেও পারে নি। হয়তো ভেবেছিলেন থাকগে খানিকক্ষণ! হয়তো ছেলের সঙ্গে একটা বোঝাঁপড়া করতে চায়। এই জায়গাটাই যদি অতসী বেশ প্রশস্ত মনে করে থাকে তো করুক।

তারপর ঘণ্টা দুই পরে একবার গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মাইজীকে নিয়ে আসতে। সে গাড়ি ফিরে গিয়েছিল শূন্যহৃদয় নিয়ে।

মাইজী আসলেন না।

মৃগাঙ্ক একটা ভ্রূকুটি করে বলেছিলেন, ঠিক আছে। কাল সবেরমে ফিন যানে পড়ে গা। সাত বাজে।

কিন্তু সকালের গাড়িও ফিরে এল সেই একই বার্তা নিয়ে।

মাইজী আয়া নেই! ওহি কোঠিমে

মৃগাঙ্ক হাত নেড়ে থামিয়ে দিয়েছিলেন।

তারপর মৃগাঙ্ক ডাক্তার নিজেই গিয়েছিলেন সুরেশ রায়ের ভাইঝির বাড়ি। বসেছিলেন তার বসবার ঘরে। রুদ্ধকণ্ঠে বলেছিলেন, পাগলামী করো না অতসী, চল।

অতসীর চোখের সব জল বুঝি কালকেই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল, তাই অত শুকনো গলায় উত্তর দিয়েছিল, পাগলামী নয়, এটা আমার সিদ্ধান্ত।

বৃথা অভিমান করে লাভ কি অতসী? আর কার উপরই বা করছ? আমরা সকলেই ভাগ্যের হাতের খেলনা।

অভিমান নয়। কারও ওপর আমার অভিমান নেই, শুধু যে ভাগ্য আমাদের খেলনার মত খেলতে চায়, তার হাত থেকে ছিটকে সরে যেতে চাই। দেখতে চাই সর্বনাশের রূপ কী?

সে রূপ তো তোমার একেবারে অজানা নয় অতসী! ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন মৃগাঙ্ক।

অতসী বলেছিল, ভুল করছ। সুরেশ রায়ের সংসারে আমার শুধু অসুবিধে ছিল, যন্ত্রণা ছিল, জ্বালা ছিল আর কিছু ছিল না। তাই সুরেশ রায়ের রোগ আর মৃত্যু আমাকে সর্বনাশের চেহারা দেখাতে পারে নি। যা দেখিয়েছিল সে হচ্ছে চিন্তার বিভীষিকা। আর কিছু না। যেখানে কিছু নেই সেখানে সর্বনাশেরও প্রশ্ন নেই।

পরের বাড়িতে আড়ষ্ট পরিবেশের মধ্যে আরও ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন মৃগাঙ্ক। বুঝি অতসীর স্থির সংকল্পের দৃষ্টির মধ্যে নিজের সর্বনাশের ছায়া দেখতে পেয়েছিলেন। তাই বলে উঠেছিলেন, ইচ্ছে করে সবাই মিলে শাস্তি ভোগ করবার এমন ভয়ঙ্কর সাধ তোমায় পেয়ে বসল কেন অতসী? সীতু কি তোমার রাগের যোগ্য?

রাগের কথা নয়।

বল তবে কিসের কথা?

সে তোমায় বোঝাতে পারব না।

বোঝাবার যে কিছু নেই অতসী, কী করে বোঝাবে? হঠাৎ একটা আঘাতে তোমার বুদ্ধিবৃত্তি অসাড় হয়ে গেছে, তাই এমন একটা আজগুবি কল্পনা পেয়ে বসেছে। চলো বাড়ি চলে। সেখানে মাথা ঠাণ্ডা করে ভেবো।

অদ্ভুত রকমের ঠাণ্ডা আছে মাথা। এই ঠাণ্ডা মাথাতেই ভেবে দেখেছি তোমার ঘরে ফিরে যাবার উপায় আমার আর নেই। সীতুর যা সত্যকার ভাগ্য, যে ভাগ্যকেই ও অহরহ চাইছে, সেই ভাগ্যের মধ্যেই সীতুকে নিয়ে বাস করতে হবে আমাকে।

আমি তোমায় কথা দিচ্ছি অতসী, সীতুর উপযুক্ত ব্যবস্থা আমি শীগগিরই করে দেব। এখন বুঝতে পারছি ভুলই করেছিলাম। অন্য কোথাও দূর বিদেশে কোনও বোর্ডিঙে ভর্তি করে দেবো ওকে, ওর যথার্থ পরিচয় দিয়ে, পিতৃহীন সীতেশ রায় নাম দিয়ে। হয়তো তাতেই ও শান্তি পাবে।

না।

না?

না। তোমার দেওয়া ব্যবস্থায় ওকে মানুষ হয়ে উঠতে দেবো না আমি।

আমার দেওয়া ব্যবস্থায় ওকে মানুষ হতে দেবে না? অতসী, আমাকে বুঝিয়ে দেবে কি, এ তোমার অহঙ্কার না অভিমান?

বলেছি তো অহঙ্কার নয় অভিমানও নয়। এ শুধু বিচার বিবেচনার সিদ্ধান্ত। তোমার দেওয়া ব্যবস্থায় মানুষ হয়ে ওঠবার সুযোগ আমি দেব না সীতুকে। দুধকলা আর কালসাপের প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে তোমায় সাপের বংশধর, এবার মুক্তি দাও আমায়। সেই একই দৃশ্য আর দেখবার শক্তি আমার নেই।

বেশ, আমি ওকে কোন দুঃস্থ ছেলেদের সংস্থায় ভর্তি করে দেব, যেখানে পয়সা লাগে না, ফ্রি সীট।

অতসী অপলকে এক সেকেন্ড তাকিয়ে নিয়ে বলেছিল, অনাথ আশ্রম?

এবার মৃগাঙ্ক ডাক্তারের মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। ভয়ঙ্কর একটা চাপা গলায় বলে উঠেছিলেন তিনি, যদি তাই-ই হয়। আমার কোন সাহায্যই যদি নিতে না দাও তোমার ছেলেকে, অনাথ আশ্রম ছাড়া আর কোথায় আশ্রয় জুটবে ওর?

সে আশ্রয় তো জুটিয়ে দিতে হয় না। অবস্থাই ওকে সে জায়গা জুটিয়ে দিতে পারবে।

মৃগাঙ্ক এবার ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলে ফেলেছিলেন, কুটিল বুদ্ধির মারপ্যাঁচ শুধু তোমার ছেলের মধ্যেই নেই অতসী, তোমাকেও তার ছোঁয়া লেগেছে। সহজ কথা, যুক্তির কথা, বুদ্ধির কথা, কিছুতেই বুঝবে না, এই যে প্রতিজ্ঞা করে বসে আছ। যা বলছ তা যে কিছুতেই সম্ভব নয়, এটা যেন চোখ বুজে অস্বীকার করতে চাও। মায়ে ছেলেতে মিলে সব রকমে কেবল আমার মুখ হাসাবে, এমন ভয়ানক প্রতিজ্ঞাই বা কেন তোমাদের? বুঝতে পারছ না কতটা মাথা হেঁট করে এ বাড়িতে আসতে হয়েছে আমাকে? কতটা

অতসী বাধা দিয়ে বলেছিল, বুঝতে পেরেছি বলেই তো এইখানেই তার শেষ করে দিতে চাইছি। চাইছি মাথা হেঁটের পুনরাবৃত্তি আর যাতে না হয়।

চমৎকার! তুমি এইখানে পরের বাড়িতে বাস করবে এতে আমার মুখ খুব উজ্জ্বল হবে? বলেছিলেন মৃগাঙ্ক। শুনে অতসী হেসেছিল।

হ্যাঁ, হেসেই বলেছিল অতসী, তাই কখনো ভাবতে পারি আমি? না তাই থাকতে পারি? থাকব এখানে নয়, হয়তো বা এদেশেও নয়। তোমার চোখ থেকে, তোমার জীবন থেকে নিজেকে একেবারে মুছে নিয়ে সরে যাব।

লোহাও গলে বৈকি! তেমন তাপে গলে। মৃগাঙ্ক ডাক্তারের চোখ দিয়েও জল পড়ে।

আমার জীবন থেকে নিজেকে মুছে নিয়ে সরে যাবে, এ কথাটা উচ্চারণ করতে পারলে অতসী?

পারলাম তো!

হ্যাঁ পারলে তো! তাই দেখছি। আর কত সহজেই পারলে। কিন্তু অতসী, শুধু আমার চোখ থেকেই নিজেকে নয়, নিজের মন থেকেও নিশ্চিহ্ন করে মুছে ফেলতে চাইছ যে, তুমি কেবলমাত্র মৃত সুরেশ রায়ের ছেলের মা নও, খুকুরও মা!

তার উত্তর তো কালই দিয়েছি। লোকের তো মা মরে। খুকুর মত অনেক বাচ্চারও মা থাকে না। খুকুরও মা থাকবে না। ধরে নাও খুকুর মা মরে গেছে।

চমৎকার! চমৎকার তোমার প্রবলেম সলভ করার ক্ষমতা। কিন্তু তবুও প্রশ্নের জের থেকে যায় অতসী, মৃগাঙ্ক ডাক্তার তিক্ত ব্যঙ্গের সুরে বলেন, শেষ হয় না। ভুলে যেও না তুমি আমার বিবাহিতা স্ত্রী। সুরেশ রায়ের বিধবাকে প্রলোভিত করে এমনি নিয়ে এসে আটকে রাখি নি আমি। আইনত তোমার ওপর আমার জোর আছে। যা খুশী করবার স্বাধীনতা তোমার নেই।

অতসী আবার হেসে বলে, জোর খাটাবে?

যদি খাটাই?

তবে তাই দেখো।

অতসী, এত নিষ্ঠুর তুমি হলে কি করে? তোমার এই নিষ্ঠুর নির্দয় ছেলেটা কি তোমাকে এমনি করেই আচ্ছন্ন করে ফেলেছে? এখন কি মনে হচ্ছে জানো অতসী, সুরেশ রায়ের সেই রোগা পাকাটির মত ছেলেটাকে আমি বাঁচতে দিয়েছিলাম কেন? কেন কৌশলে শয়তানের জড়কে শেষ করে দিই নি?

না, অতসী রেগে যায় নি, কেঁদেও ফেলে নি, বরং হাসির মত মুখ করেই বলেছিল, এর চাইতে আরও অনেক বেশি কঠিন কথা বললেও আমি তোমায় দোষ দেব না।

অতসী, তোমায় হাতজোড় করে বলছি, পাগলামী ছাড়ো। রাগের মাথায় যা মুখে আসছে বলছি, ক্ষমা করতে পারো কোর। না পারলে কোর না। দোহাই তোমার, এখন অন্তত বাড়ী চলল। তারপর

ও কথা তো আগেও বলেছ। কিন্তু আমায় মাপ করো।

মৃগাঙ্ক ডাক্তার উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলেছিলেন, না। কিছুতেই আমি তোমাকে মাপ করব না। কিছুতেই তোমার পাগলামীর তালে চলব না। জোরই খাটাব। পুলিশের সাহায্যে নিয়ে যাব তোমাকে। এদের নামে চার্জ আনব, আমার স্ত্রী-পুত্রকে দুরভিসন্ধির বশে আটকে রেখেছে।

অতসী তবুও হেসেছিল।

বলেছিল তা তুমি পারবে না আমি জানি।

জানো? জানো বলে এত সাহস তোমার? তুমি আমার কতটুকু জানো অতসী? কদিন তুমি দেখেছ আমায়?

তবে ডাকো পুলিশ। বলে স্থির হয়ে বসে থেকেছিল অতসী।

তারপরেও অনেক কথা বলেছিলেন মৃগাঙ্ক, অনেক সাধ্যসাধনা করেছিলেন। এমন কি এও বলেছিলেন, অতসী যদি মৃগাঙ্কর সঙ্গে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে চায় তো সে ব্যবস্থাও করে দেবেন মৃগাঙ্ক। চেম্বারে থাকবেন তিনি, নয়তো অন্যত্র কোথাও থাকবার ব্যবস্থা করে নেবেন। অথবা অতসীকেই দেবেন আলাদা ফ্ল্যাটে থাকার সুযোগ। তবু আজ এদের বাড়ি থেকে চলুক অতসী। সুরেশ রায়ের ভাইঝিকে একান্ত আত্মীয় বলে আঁকড়ে ধরে থেকে এমন করে মৃগাঙ্কর গালে কালি না মাখায় যেন।

কিন্তু অতসী টলে নি। শুধু কথা দিয়েছিল এ বাড়িতে ও আর বেশিক্ষণ থাকবে না। ঘণ্টা কয়েক পরেই চলে যাবে।

কোথায় যাবে? ছেলেকে গলায় বেঁধে গঙ্গায় ডুবতে? বলেছিলেন মৃগাঙ্ক। অসহিষ্ণু হয়ে অস্থির হয়ে বলেছিলেন।

অতসী এত জোর সঞ্চয় করল কখন? কোথায় পেল এত সাহস, এত মনোবল? কী করে থাকল এর পরেও অটল থাকতে?

তা আত্মহত্যাও তত করে মানুষ। ধরে নাও এও তাই।

সীতুকে একবার ডেকে দেবে আমার কাছে? আমার ভাগ্যদেবতার সেই নিষ্ঠুর পরিহাসের কাছে, আমার জীবনের সেই শনির কাছে একবার হাতজোড় করি আমি!

ছিঃ, একথা ভেবো না। তুমি কি ভাবছ শুধু সীতুর জন্যেই আমার এই সংকল্প? তা ভাবলে ভুল হবে। এ আমার নিজের জন্যেও। দেখছি ভাগ্যের কাছে আমার যা প্রাপ্য পাওনা নয়, তাই জোর করে পেতে গিয়েই ভাগ্যের সঙ্গে এত সংঘর্ষ। আমি তো তোমার জীবনে বেশিদিন আসি নি, মনে করো সেই আগের জীবনেই আছ তুমি। আমি কোনদিনই–

খুকুটাকে,গোড়া থেকেই হিসেবের বাইরে রাখছ এইটাই এক অদ্ভুত রহস্য বলে মনে হচ্ছে অতসী! আশ্চর্য! তোমার মাতৃস্নেহধারা কি শুধু ওই একটা জায়গায় এসেই জমাট হয়ে থেমে গেছে, আর এগোতে পারে নি? খুকু কি তোমার সন্তান নয়? নাকি ওকে তুমি মনের মধ্যে বৈধ সন্তান বলে গ্রহণ করতে পারোনি? অবৈধের পর্যায়ে রেখে দিয়েছ?

অতসী কি সত্যিই ওর চোখ দুটোকে আর মনটাকে পাথর দিয়ে বাঁধিয়ে ফেলেছিল, তাই একথার পরও একেবারে শুকনো খটখটে চোখে তাকিয়ে বলতে পেরেছিল, বলেছি তো যত কঠিন কথাই তুমি বল, দোষ তোমায় দেবো না আমি।

.

তারপর? তারপর চলে এসেছে অতসী এইখানে।

শিবপুর লেনের একটা জরাজীর্ণ পচাবাড়ির একতলার একখানা ঘরে। শ্যামলীর বর অনুরোধে পড়ে বাধ্য হয়ে এ জায়গা খুঁজে জোগাড় করে দিয়েছে।

সেদিন শ্যামলী অবাক বিস্ময়ে কথা খুঁজে পায়নি। বোবার মত তাকিয়েছিল ফ্যালফ্যাল করে। অতসীই আশ্বাস দিয়ে ওর সাড় এনেছিল। বলেছিল, জীবনের রহস্য অপার শ্যামলী! সে কারও কাছে আসে বন্ধুর বেশে, কারও কাছে আসে রুদ্রের বেশে! তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা, পাথরে নিষ্ফল মাথাকোটার সামিল। জীবনের পঙ্কিল রূপ দেখেছি, সুন্দর রূপও দেখেছি, এবার দেখব ভয়াবহ রুদ্রের মূর্তিটা কেমন।

তার মধ্যে নতুনত্ব কিছুই নেই কাকীমা! হাজার হাজার মানুষ আমাদেরই আশেপাশে সেই রুদ্রের অভিশাপ মাথায় বহে বেড়াচ্ছে। রোগে ওষুধ নেই, পেটে ভাত নেই–।

একটু ভুল করছিস শ্যামলী! ওটা তো হচ্ছে কেবলমাত্র অভাবের চেহারা, দারিদ্র্যের চেহারা। আমার সমস্যা আলাদা। আমার জন্যে খোলা পড়ে আছে আশ্রয় আরাম স্বাচ্ছন্দ্য, কিন্তু ভাগ্য আমাকে তা নিতে দেবে না

হঠাৎ রেগে উঠেছিল শ্যামলী। বলে উঠেছিল, ভাগ্য না হাতী! নিজের জেদেই আপনি রাগ রাখতে পারে নি, কেঁদে ফেলে বলেছিল, নইলে আট নবছরের একটা ছেলের দুষ্টুমিকে এত বড় করে দেখার কোন মানেই হয় না। ডাক্তার কাকাবাবুর মত মানুষকে আপনি ত্যাগ করে চলে যাচ্ছেন, এ আমি ভাবতেই পারছি না

ছিঃ শ্যামলী, ভুল করিস না!

ও আপনার ভুল-ঠিক বোঝবার ক্ষমতা আমার নেই কাকীমা! কিছু নয়, এ আমারই ভাগ্য। হঠাৎ কাছাকাছির মধ্যে আপনাকে পেয়ে গিয়ে বর্তে গিয়েছিলাম কিনা, সেটা ভাগ্যে সইল না।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত সীতুর আচরণে শ্যামলীকেও হার মানতে হয়েছিল। বোর্ডিং থেকে নেমে সেই যে সীতু শ্যামলীদের একটা বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল, পুরো দুদিন তাকে সেখান থেকে মুখ ভোলানো যায় নি। অস্নাত, অভুক্ত, এমন কি জল পর্যন্ত না খেয়ে পড়ে থাকা কাঠের মত শক্ত ছেলেটাকে বারবার খোসামোদ করে ওঠানোর চেষ্টায় হার মেনে হতাশ শ্যামলী বলেছিল, এ তো দেখছি বদ্ধ পাগল! একে স্কুল বোর্ডিঙে ভর্তি করবার চেষ্টা না করে পাগলা গারদে ভর্তি করে দেওয়া উচিত ছিল আপনার!

অতসী বলেছিল, এ রকম পাগল ওর বাপ ছিল, ঠাকুর্দা ছিলেন, তারা তো জীবনের শেষ অবধি গারদের বাইরেই রয়ে গেলেন শ্যামলী! কেউ বলে নি ওদের পাগলা গারদে পাঠিয়ে দাও।

বলে নি, তাই আজ এই অবস্থা। শেষ অবধি হয়তো আপনাকেই সেখানে যেতে হবে।

তা যদি হয় শ্যামলী, সমস্ত কর্তব্যের বোঝা, সমস্ত বিচার বিবেচনার বোঝা মাথা থেকে নামিয়ে হালকা হয়ে বেঁচে যাই। কিন্তু তা হবে না। তোর কাকীমার স্নায়ু বড় বেশি জোরালো শ্যামলী!

তাই অমন ছেলে জন্মেছে। বলে আর একদফা কেঁদে ফেলেছিল শ্যামলী।

বোঝা যায় নি সীতু এসব কথা শুনতে পাচ্ছে কিনা। মনে হচ্ছিল একটা পাথরের পুতুল শুয়ে আছে। দেড়দিনের অক্লান্ত চেষ্টায় যখন শ্যামলীর বর শিবপুরের এই ঘরখানা জোগাড় করে সে খবর নিয়ে এসে দাঁড়াল, আর অতসী বলল, সীতু ওঠ, আমাদের অন্য জায়গায় যেতে হবে, তখন দেখা গেল সীতু বলে ওই ছেলেটার শ্রবণেন্দ্রিয় অবিকল বজায় আছে। ভাবলেশশূন্য মুখে উঠে মায়ের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকল।

.

শিবপুর লেনের এই ঘরখানাতেও মায়ে-ছেলের কাছাকাছি থাকা ছাড়া উপায় নেই, কারণ আটফুট বাই দশফুট এই ভাঙা ঘরখানার মধ্যেই অতসীর এই নতুন জীবনের সমগ্র সংসার। এর মধ্যেই তার খাওয়া শোওয়া থাকার সমস্ত সরঞ্জাম।

হ্যাঁ, মৃগাঙ্ক ডাক্তারের কিছু সাহায্য অতসীকে নিতে হয়েছিল। গলার হারটা আর হাতের চুড়ি কটা তো মৃগাঙ্ক ডাক্তারেরই দেওয়া। ভারী কিছু নয়, ভারী গহনার স্থূলতা অতসীর রুচিতে সইত না, তবু নেহাই হালকা ওই আভরণটুকুই অতসীর নতুন সংসারের মূলধন।

এখানে ওই নিরাভরণতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতেই বুঝি অতসী তার শাড়িখানাও সীমারেখাহীন সাদায় পরিণত করে নিয়েছে। এখানে তার পরিচয় নাবালক সীতেশ রায়ের মা বিধবা অতসী রায়।

তা সন্দেহের দৃষ্টিতে কেউ তাকায় নি।

এযুগ আগের যুগের মত শ্যেনচক্ষু নয়। এ যুগে বাংলাদেশের এমন হাজার হাজার বিধবা মেয়ে আত্মীয়ের আশ্রয় ছেড়ে নাবালক ছেলে নিয়ে জীবনযুদ্ধে নামে।

.

কিন্তু অতসীর হাতে যুদ্ধের অস্ত্র কই?

বাড়িওয়ালা গিন্নী মাঝে মাঝে দোতলা থেকে নেমে এসে ভাড়াটের দরজায় দাঁড়ান, সমবেদনা জানান, আর প্রশ্ন করেন, ছেলে তোমার স্কুলে ভর্তি হয় নি?

মানুষটা সাদাসিধে স্নেহপ্রবণ, কৌতূহলের বশে প্রশ্ন করেন না, সহৃদয়তার বশেই করেন। বলেন, ওটুকুকে মানুষ করে তুলতে পারলেই তোমার দিন কেনা হয়ে গেল মা, ওকে যাহোক করে মানুষ করে তুলতেই হবে। একদিন এই দুঃখিনী তুমিই রাজার মা হয়ে বসবে, তখন পাঁচটা কনের বাপ তোমার দোরে এসে সাধবে। ছেলের মতন জিনিস আর আছে মা? এই যে আমি, তিন-তিনটে তো বিইয়েছি, তিনটেই মাটির ঢিপি। এককড়ি খরচ করে বিয়ে দিয়েছি, যে যার আপন সংসারে রাজত্ব করতে চলে গেছে, আমার কথা কত ভাবছে? যাই এই বাড়িটুকু ছিল কর্তার, তাই ঘর ঘর ভাড়াটে রেখে দিন চলছে। তোমার মেয়ে হয় নি বাঁচোয়া।

মেয়ে হয়নি!

অতসী কি কেঁপে ওঠে? অতসীর মুখটা কি প্যাঙাস হয়ে যায়?

বয়স্থা মহিলা অত বুঝতে পারেন না। তিনি কথা চালিয়ে যান, চেষ্টা বেষ্টা করে একটা ফ্রি স্কুলে ওকে ভর্তি করে দাও বাছা, আখের ভাবো।

অতসী একদিন সাহস করে বলে ফেলে, দেবো তো মাসীমা, কিন্তু তার আগে আমাকে তো কোনও একটা কাজে ফর্মে ভর্তি হতে হবে। হাতের পুঁজি তো সবই কথা শেষ করেছিল অতসী ভাববাচ্যে। একটু হাসি দিয়ে।

ঘরে সীতেশের উপস্থিতি কি ভুলে গেছে অতসী? নাকি সীতেশের আড়ালে কোন জায়গা নেই বলেই নিরুপায় হয়ে সব কথাই তার সামনে উচ্চারণ করতে বাধ্য হচ্ছে?

ঘরকুনো সীতেশ ঘরেই আছে। ঘরেই থাকে।

হরসুন্দরী দেবীর এই পাঁচ ভাড়াটের বাড়িতে তার সমবয়সী ছেলের অভাব নেই, কিন্তু সীতেশকে বোধকরি তারা চক্ষেও দেখে নি।

হরসুন্দরী দেবী বলেন, বললে যদি তো বলি বাছা, আমিও কদিন ভাবছি, নতুন মেয়ে তো কাজকর্ম কিছু করে না, অথচ ছেলে নিয়ে একলা বাস করতে এসেছে। তো ওর চলবে কিসে? তা ভাবি, বোধহয় স্বামীর দরুণ কিছু আছে হাতে। এ যুগে তো আর ভাই-ভাজ দ্যাওর-ভাসুর বিধবাকে দেখে না মা।

অতসী শান্ত গলায় বলে, আমার ওসব কিছুই নেই মাসীমা। আর স্বামীর টাকাও নেই। তেমনি নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে একটু হাসে অতসী। খেয়াল করে না জানালায় পিঠ ফিরিয়ে বসে থাকা ছেলেটার পিঠের চামড়াটা পুড়ে উঠছে কিনা অতসীর এই হাসিতে।

তা ভাল! তিন কুলের কেউ কোথাও নেই?

নাঃ।

হ্যাঁগা, তা ওই যে ছেলেটি ঘর খুঁজতে এসেছিল?

ওটি আমার দূর সম্পর্কের ভাসুরঝি জামাই হয় মাসীমা।

হরসুন্দরী বলেন, দূর আর নিকট! যার শরীরে মায়া মমতা আছে, সেই নিকট। ছেলেটির আকার প্রকার তো ভালই মনে হল, কিছু সাহায্য করে না?

আরক্ত মুখ কোনমতে পাশ ফিরিয়ে অতসী বলে, করলেই বা আমি জামাইয়ের সাহায্যে নেবো কেন মাসীমা?

তা বটে, তা বটে। কথাতেই আছে পরদুয়ারী জামাই ভাতি, এ দুইয়ের নেই ঊর্ধ্বগতি– তা মেয়ে, অপিসে চাকরি বাকরি করবে তাহলে?

অতসী মাথা নীচু করে বলে, অফিসে চাকরি করার মত বিদ্যে সাধ্যি নেই মাসীমা, ছেলেবেলায় বাপ ছিলেন না, মামার বাড়ি মানুষ, তাড়াতাড়ি একটা বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন, পড়ালেখার তেমন সুযোগ হয় নি।

আহা! চিরটাকালই তাহলে দুঃখ! তোমায় দেখলে কিন্তু বাছা এখনকার পাশটাশ করা মেয়ের ধাঁচে লাগে।

অতসী একথার আর কি উত্তর দেবে?

হরসুন্দরী বলেন, মুখ ফুটে তুমি বললে তাই বলতে সাহস করছি বাছা, কিছু মনে না করো তো বলি কাজ একটা আছে। মানে আমাকেই একজন বলেছিল লোক দেখে দেবার জন্যে। আমি তো এ পাড়ায় আজ নেই, চল্লিশ বছর আছি, সবাই চেনে।

লোক দেখে দেবার জন্যে অস্ফুট কণ্ঠে বলে অতসী, কি চান তারা? ঝি?

আহা-হা ঝি কেন, ঝি কেন! হরসুন্দরী ব্যস্তভাবে বলেন, একটা তালমুড়ি বুড়িকে একটু দেখাশোনা করা। নার্সের হাতের সেবা নেবে না এই আর কি! বুড়ির নাকি সত্তর বছর পার হয়ে গেছে। তবে কিনা বড় মানুষের মা, তাই তারা মাসে একশোর বেশি টাকা দিয়েও লোক রাখতে প্রস্তুত। ছেলের বৌটা মহাপাজী মা, স্বামীকে মুখনাড়া দিয়ে বলবে, তোমার মার সুবিধে করতে একটা বাইরের লোক এনে প্রতিষ্ঠা করবে, আর আমি ভাবতে বসব তার কখন কি চাই, সে কী খাবে, কোথায় থাকবে, কোথায় তার জিনিসপত্র রাখবে–পারব না, রক্ষে কর। ঠিকে লোক রেখে মায়ের সেবা করাতে পারো, করাও। ব্যস!

তা বুড়ির ছেলে অশান্তির ভয়ে তাতেই রাজী, কিন্তু ঠিকে বড় কেউ থাকতে চায় না। বলে সারাদিন রুগীর ঘরে থাকব তো রাঁধব বাড়ব কখন? বুড়ির ছেলে তাই বলেছে, দিন চার-পাঁচ টাকা করেও যদি লোক পাই তো রাখব। ছেলেটা ভাল, বৌটা দজ্জাল। অবিশ্যি তার জন্যে ভাবনার কিছু নেই, সে বৌ শাশুড়ির ঘরের ছায়াও মাড়ায় না। বুড়ি কত কাঁদে। এই তো মা, পয়সা থেকেও কত কষ্ট। তবে হ্যাঁ, এই যে লোক রাখতে চায়, পয়সা আছে বলেই তো? আমার মরণকালে যে কী দুর্দশা হবে ভগবানই জানে।

অতসী সান্ত্বনাৰ্থে বলে, তখন কি আর আপনার মেয়েরা আসবেন না?

আসবে। মায়ের এই ইটকাঠটুকুর ভাগ বুঝতে আসবে। আর এসে তিন বোনে ঝগড়া করবে আমি একা কেন করব বলে। মেয়ে সন্তান পরের মাটি দিয়ে গড়া মা! তোমার মেয়ে নেই রক্ষে।

অতসী কষ্টে গলায় স্বর এনে বলে, ওদের সঙ্গে আপনি কথা বলুন মাসীমা, আমি করতে রাজি আছি।

হরসুন্দরী ইতস্তত করে বলেন, অবিশ্যি নার্সের কাজ বলতে যা বোঝায় তার সবই করতে হবে বাছা। তবে কিনা জাতে বামুন–

অতসী দৃঢ়স্বরে বলে, জানে বামুন হোন কায়েত হোন, কিছু এসে যায় না মাসীমা, কাজ করব বলে যখন প্রস্তুত হয়েছি, তখন সবই করব।

হরসুন্দরী সপুলকে বলেন, তবে তাদের তাই বলিগে?

হঠাৎ জানলার দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসে থাকা ছোট মানুষটা ছিটকে এদিকে মুখ ফিরিয়ে চীৎকার করে ওঠে, না, বলবে না।

বলব না? হরসুন্দরী হকচকিয়ে যান।

না না! তোমার এখানে আসার এত কি দরকার?

সীতু!

তীক্ষ্ণ তীব্র গলায় একটি সম্বোধন করে অতসী। যেমন গলায় বোধকরি কোনদিনই সীতুকে ডাকে নি। মৃগাঙ্কর সংসারে সীতুকে নিয়ে অনেক যন্ত্রণা ছিল অতসীর, কিন্তু সীতুকে শাসনের বেলায় কোথায় যেন কানায় কানায় ভরা ছিল অভিমানের বাষ্প, তাই কখনো গলায় এমন নীরসতার সুর বাজে নি।

সীতু মাথা নীচু করে ফের জানলায় গিয়ে বসে। সে জানলার সঙ্গে তার অস্ফুট স্মৃতির কোথায় যেন একটা মিল আছে। জানলার ওপিঠটা একটা সরু পচা গলি, বছরে দুদিন সাফ হয় কিনা সন্দেহ, দুদিকের বাড়ির আবর্জনা পড়ে পড়ে জমা হতে থাকে।

এ বাড়িতে উঠোনের মাঝখানে চৌবাচ্চাও একটা আছে, আর কলের মুখে লাগানো নল বেয়ে জল পড়ে পড়ে সেটা ভরতে থাকে সারাদিনে। সীতুর স্মৃতির সঙ্গে অনেক কিছু মিল আছে এ বাড়ির।

কিন্তু সীতু?

সে কি তবে এতদিনে স্থির হয়েছে, সন্তুষ্ট হয়েছে? তার বিদ্রোহী মন শান্ত হয়েছে?

এসে পর্যন্ত তেমনি এক অবস্থাতেই ছিল সীতু। মা ডেকেছেন সীতু খাবে এসো, সীতু নিঃশব্দে উঠে এসে খেয়েছে। মা বলেছে সীতু বেলা হয়ে যাচ্ছে ওঠ, এর পরে আর কলতলা খালি পাবে না, সীতু উঠে গিয়ে সেই পাঁচ শরিকের কলের থেকে মুখ ধুয়ে এসেছে। কোন প্রতিবাদ কোন দিন ধ্বনিত হয়নি তার কণ্ঠ থেকে।

আজ সীতুর গলায় সেই পুরনো তীব্রতা ঝলসে উঠল।

অতসী হরসুন্দরীর দিকে চোখ টিপে ইশারায় বলে, ওর কথা ছেড়ে দিন, আপনি ব্যবস্থা করুন।

হরসুন্দরী বোঝেন–বালক ছেলে, মাকে ছেড়ে থাকার কথায় বিচলিত হয়েছে। পরম আনন্দে তিনি চক্রবর্তী গিন্নীর কাছে সুখবর দিতে ছুটলেন। বুড়ি এমনি একটি ভদ্র গৃহস্থঘরের মেয়ের জন্যেই হা-পিত্যেশ করে বসে আছে। হরসুন্দরী জোগাড় করে দেওয়ার গৌরবটা নেবেন।

.

সারাদিন নর্দমার ধারে বসে বসে স্বাস্থ্যটা নষ্ট করে কোন লাভ আছে?

অতসীর এই প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গেই সীতু জানলা থেকে নেমে এসে ঘরের প্রায়ান্ধকার কোণে পাতা চৌকীটায় গিয়ে বসে।

অতসী বলে, কাল তোমায় স্কুলে ভর্তি করতে নিয়ে যাব। হেডমাস্টার মশাইয়ের সঙ্গে দেখা করে এসেছি আমি, ওপরের মাসীমার তিনি চেনা লোক, কাজেই ভর্তি হতে বেশি অসুবিধে হবে না। তবে একটি কথা তোমাকে শিখিয়ে রাখছি সত্যি কথা নয়, মিথ্যা কথা। হ্যাঁ, এখন অনেক মিথ্যা কথা তোমায় শেখাতে হবে আমাকে, বলতে হবে নিজেকে। নইলে কোথাও টিকতে পাব না। তুমি বলবে, এর আগে তুমি কোন স্কুলে পড় নি, বাড়িতে মায়ের কাছে পড়েছ। মনে থাকবে? বলতে পারবে? স্কুলে পড়েছিলে জানতে পারলেই এ স্কুল তোমার পুরনো স্কুলের সার্টিফিকেট চাইবে। জিজ্ঞেস করবে, কেন ছেড়ে এসেছ? সেখানের রেজাল্ট দেখি। তা হলে কি বিপদে পড়বে বুঝতে পারছ? সে স্কুলে তোমার নাম সীতেশ রায় নয়, সীতেশ মজুমদার, তা মনে আছে বোধ হয়? কি কাজের কি ফল তোমাকে বোঝাবার বয়স নয়, কিন্তু তুমি বুঝতে পারো, বুঝতে চাও, তাই এত করে বুঝিয়ে শিখিয়ে রাখলাম। আর যা করো করো, দয়া করে নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট কোর না।

আমিও ভুলে যেতে চেষ্টা করব রায় ছাড়া আর কোনদিন কিছু ছিলাম আমি, ভুলেও যাব আস্তে আস্তে। যাক আরও একটা কথা শোনোপরশু থেকে আমি মাসীমার দেওয়া সেই কাজে ভর্তি হবো। তোমাকে সকালবেলা স্কুলের ভাতটা মাসীমার কাছেই খেতে হবে। সেই ব্যবস্থাই করেছি।

আমি খাব না।

সীতেশের গলায় বিদ্রোহ। কিন্তু সে বিদ্রোহে কি আর্দ্রতার ছোঁয়া?

অতসী নরম গলায় বলে, খাব না বললে তো রোজ চলবে না, একটা ব্যবস্থা তো করতে হবে।

তুমি ওপরের বুড়ির কথা শুনলে কেন? ওই বিচ্ছিরি কাজ নিলে কেন?

অতসী মৃদু হেসে বলে, বিচ্ছিরি ছাড়া সুচ্ছিরি কাজ কে আমায় দেবে বল? আমি কি বি. এ., এম. এ., পাশ করেছি? আর কাজ না করলে

না না না, তুমি কাজ করবে না। তুমি ঝি হতে পাবে না। বলে সহসা জীবনে যা না করে সীতু, তাই করে বসে। উপুড় হয়ে পড়ে উথলে উথলে কেঁদে ওঠে।

নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে থাকে অতসী, সান্ত্বনা দিতে ভুলে যায়। অমনি করে উপুড় হয়ে পড়ে কেঁদে ভাসাবার জন্যে তার অন্তরাত্মাও যে আকুল হয়ে উঠেছে।

খুকু খুকু! খুকুমণি! কতদিন তোকে দেখি নি আমি! কী করছিস তুই মা মরা হয়ে গিয়ে। কে তোকে খাওয়াচ্ছে খুকু, কে ঘুম পাড়াচ্ছে? মা মা করে খুঁজে বেড়ালে কী বলছে তোকে ওরা? মা নেই, মা মরে গেছে। মা চলে গেছে, আর আসবে না! শুনে কেমন করে কেঁদে উঠছিস তুই খুকু সোনা। খুকু তুই কেমন আছিস? খুকু তুই কি আছিস?

হরসুন্দরী প্রতি কথায় বলেন, তোমার মেয়ে নেই মা বাঁচোয়া। নিজের মেয়েদের প্রতি দুরন্ত অভিমানের বশেই হয়তো বলেন, কিন্তু তিনি কেমন করে বুঝবেন তার এই সান্ত্বনাবাক্যে অতসীর বুকের ভিতরটা কী তোলপাড় করে ওঠে, জননীহৃদয়ের সমস্ত ব্যাকুলতা কেমন করে ষাট ষাট করে ওঠে।

সারাদিনের বেঁধে রাখা মন রাতে বাঁধ মানে না। নিঃশব্দ ক্রন্দনে নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলতে চায়।

আলাদা চৌকীতে সীতু।

ঘরে জায়গা কম, এ চৌকী যতটা স্বল্পপরিসর হওয়া সম্ভব ততটা স্বল্প, পাশ ফিরতে পড়ে যাবার ভয়। তবু রাত্রির অন্ধকারে অতসীর মনে হয় যেন তার কোলের কাছে একটা বিশাল শূন্যতা! সেই শূন্যতা অতসীকে গ্রাস করে ফেলতে চাইছে, অদৃশ্য দাঁত দিয়ে অতসীকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে চাইছে।

বুকের মধ্যেটা মুচড়ে মুচড়ে ওঠে। সর্বশরীরে সেই মোচড়ানির যন্ত্রণা অনুভব করে অতসী। যেন দেহের কোথাও ভয়ঙ্কর একটা আঘাত করতে পারলে কিছুটা উপশম হবে। চীৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করে তার। চীৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, খুকু খুকু, তোর মা নেই। তোর মা মরে গেছে, বুঝলি?

মৃগাঙ্ক কি খুকুকে নিজের কাছে নিয়ে শোন?

ঝাপসা করে এইটুকু শুধু ভাবতে পারে অতসী, এর বেশি নয়। মৃগাঙ্কর কথা ওর থেকে বেশি ভাববার ক্ষমতা অতসীর নেই।

ভয়ঙ্কর ক্ষতের দৃশ্যটা যেমন ঢাকা দিয়ে রাখতে চায় মানুষ, দেখতে পারে না, তেমনি সেই ভয়ঙ্কর চিন্তাটাকে সরিয়ে রাখে অতসী, ঢেকে রাখে আতঙ্ক দিয়ে।

শুধু রাত্রে যখন সীতু ঘুমিয়ে পড়ে, যখন আবছা অন্ধকারে ওর রোগা পাতলা ছোট্ট দেহটাকে একটা বালক ছাড়া আর কিছু মনে হয় না, তখন তীক্ষ্ণ অস্ত্রাঘাতের মত একটা প্রশ্ন অতসীকে কুরে কুরে খায়–আমি কি ভুল করলাম? আমার কি আরও ধৈর্য ধরা উচিত ছিল?

কিন্তু ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করবার মত অবস্থা কি ঘটে নি?

.

সকাল হতে না হতেই সমস্ত চিন্তা আর সমস্ত প্রশ্নে যবনিকা টেনে দিয়ে তাড়াতাড়ি ছুটতে হয় মনিববাড়ি। ছটার মধ্যে গিয়ে পৌঁছতে না পারলেই অনুযোগ সুরু করে বুড়ি, আজ তোমার এত দেরি যে আতুসী? কতক্ষণে মুখ ধোওয়াতে আসবে বলে রাত থেকে দুয়োরের পানে তাকাচ্ছি। দেরি না হলেও অনুযোগটা তার উদ্যত।

অনিদ্রা রোগীর রাত বড় দীর্ঘ। সকালের আলোের আশায় পলক গোনে সে।

অতসী তর্ক করে না, প্রতিবাদ করে না, এই একটু দেরি হয়ে গেল দিদিমা। উঠুন, মুখ ধুয়ে নিন। বলে তৎপরতা দেখায়।

তারপর কাজ আর কাজ।

মুখ ধোওয়ান, বিশুদ্ধ কাপড় পরিয়ে তাকে জপ আহ্নিক করতে বসানো, নিজে স্নান করে এসে তবে তাকে খাওয়ানো, ওষুধ খাওয়ান। ঠিক রোগী নয়, বলতে গেলে রোগটা জরা, তবু ওষুধ খেতে ভালবাসেন চক্রবর্তী গিন্নী। ভালবাসেন সেবা খেতে। তাই হাত খালি হলেই তেল মালিশ করতে হয় বসে বসে। আর বসে বসে শুনতে হয় তার ছেলের প্রশংসা আর ছেলের বৌয়ের নিচ্ছে। এই শোনাটাও একটা বিশেষ কাজ।

এই কাজ আর অকাজের অবিচ্ছিন্ন ধারার মধ্যে তলিয়ে থাকে চিন্তা ভাবনা। মনে করবার অবকাশ থাকে না অতসী কে, অতসী কি, অতসী এখানে কেন। যেন এই খামখেয়ালি বড়লোক বুড়ির খাস পরিচারিকা, এইটাই অতসীর একমাত্র পরিচয়।

মানুষটা খিটখিটে নয়, এইটুকুই পরম লাভ। মিষ্টিমুখে সারাক্ষণ খাঁটিয়ে নেন। মালিশ হলেই বলেন, অ আতুসী, মালিশের তেলের হাতটা ধুয়ে দুটো পান ছাচ দিকি খাই। পান ছাচা হলেই বলবেন, আতুসী দেখ তো বিছানায় পিঁপড়ে হয়েছে না ছারপোকা? চব্বিশ ঘণ্টা কী যে কামড়ায়।

সন্ধ্যাবেলা সব মিটে গেলে, চলে যাবার সময় পর্যন্ত ডাক দেন, আতুসী, মশারীটা ভাল করে খুঁজেছ তো? কাল যেন একটা মশা ঢুকেছিল মনে হচ্ছে।

আসল কথা সারাক্ষণ একটা মানুষের স্পর্শ আর সান্নিধ্যের লোভ! সংসার যার পাওনা চুকিয়ে দিয়েছে, অবস্থা যাকে নিঃসঙ্গ করে দিয়েছে, তার হয়তো এমনিই হয়। মানুষের সঙ্গ লালসা, এমনিই চক্ষুলজ্জাহীন করে তোলে তাকে। এই কাজের জগতে বার্ধক্যকে সঙ্গ দেবে এমন দায় কার? তাই ওই সঙ্গ দেওয়াটাই যার ডিউটি, তাকে পুরো ভোগ করে নিতে চান চক্রবর্তী গিন্নী সুরেশ্বরী।

আবার ভাল কথাও বলেন বইকি!

খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অতসীর জীবনকাহিনী শুনতে চান তিনি, চান আহা করতে। চান অতসীর আত্মপরিজনকে কটুবাক্যে তিরস্কার করতে। বলেন, এই বয়সে, এই ছবির মতন চেহারা, কোন প্রাণে তারা একলা ছেড়ে দিয়েছে। এই যাই ভাল আশ্রয়ে এসে পড়েছ তাই রক্ষে। নইলে কার খপরে যে পড়তে! আবার বলেন, ছেলেকে তো কই একদিন আনলে না আতুসী! দেখতে চাইলাম!

অতসী বলে, আসবে না দিদিমা। বড় লাজুক।

সুরেশ্বরী বলেন, আহা আসতে আসতেই লজ্জা ভাঙবে। আনলে চাইকি আমার আনন্দর নেকনজরে পড়ে যেতে পারে। তখন তোমার ওই ছেলের বই খাতা জুতো জামা কোন কিছুর অভাব হবে না। আনন্দর যে আমার বড় মায়ার শরীর, গরীবের দুঃখ একেবারে দেখতে পারে না।

অতসী কাঠের মত শক্ত হয়ে যাওয়া হাতে অভ্যস্ত ভঙ্গীতে মালিশ চালিয়ে যায়, আর সহসা এক সময় বলে ওঠেন সুরেশ্বরী, কাজ করতে করতে থেকে থেকে তোমার যে কী হয় আতুসী, যেন কোথায় আছে মন কোথায় আছে দেহ। একটু মন দাও বাছা। মাস গেলে কম গুলি করে তো গুনতে হয় না আমার আনন্দকে, এই বুড়িমার আরাম স্বস্তির জন্যে!

হ্যাঁ, এটুকু স্পষ্ট কথা তিনি বলেন। নিজের গৌরব গরিমা বাড়াতেই বলেন।

তা এটুকু না সইলে চলবে কেন?

উদয়াস্ত খিটখিট করলেই কি সইতে হত না? মনিব খিটখিটে বলে একশ পঁচিশ টাকার চাকরিটা ছেড়ে দিত? তাই কেউ দেয়? ঘরে যার ভাত নেই?

ওদিকে এদিক ওদিক থেকে সুরেশ্বরীর ছেলের বৌয়ের সঙ্গে চোখোচোখি হয়ে গেলেই তিনি হাতছানি দিয়ে ডেকে সহাস্যে বলেন, কেমন কাজ চলছে?

অতসী মৃদু হেসে বলে, ভাল।

তা ভাল না বলে আর উপায় কি। বলি এক মিনিট বসতে শুতে পাও কোনদিন? ইস তা আর নয়, ওই চীজটিকে আমার জানতে বাকী আছে কিনা। চব্বিশ ঘণ্টা খালি ফরমাস আর ফরমাস। বাবাঃ! তা বাপু আমি মুখফেঁড় মানুষ বলে ফেলি। এমন চেহারাখানি তোমার, এমন মিষ্টি মিষ্টি গলা, তুমি মরতে এই অখদ্যে কাজ করতে এলে কেন? সিনেমায় নামলে লুফে নিত।

অতসী উত্তর দেয় না, শুধু কান দুটো যে তার কত লাল হয়ে উঠেছে সেটা নিজেই অনুভব করে।

ভদ্রমহিলা আবার হেসে হেসে বলেন, একটা তো ছেলেও আছে তোমার শুনেছি। তোমার মতনই সুন্দর হবে নিশ্চয়। মায়ে ছেলেয় নেমে পড়। আজকাল ছোট ছেলের চাহিদা ও লাইনে খুব। হাড়ির হাল থেকে রাজার হাল হবে। নইলে এই দাসীবৃত্তি করে ছেলেকে আর কতই মানুষ করে তুলতে পারবে? তার চাইতে ও লাইনে অগাধ পয়সা।

অতসী মৃদুস্বরে বলে, আপনারা হিতৈষী, আপনারা অবিশ্যি যা ভাল তাই বলবেন, দেখব। ভেবে।

হিহি করে হাসেন ভদ্রমহিলা আর বলেন, তোমার মতন অবস্থা আমার হলে ওসব ভাবাভাবির ধার ধারতাম না, কবে গিয়ে হিরোইন হতাম। ভাল থেকে হবেটা কি? কেউ তোমায় ভাত দেবে, না সামাজিক মানমর্যাদা দেবে?

ভদ্রমহিলার মতবাদকে অযৌক্তিক বলা যায় না।

না, তুমি ছাড়া আপনি এবাড়িতে কেউ বলে না অতসীকে। বাসনমাজা ঝিটাও বলে, তুমি আবার এখন কলে পড়তে এলে? সরো বাপু সরো, আমায় বাসন কখানা ধুয়ে নিতে দাও আগে।

সুরেশ্বরীর চা দুধ খাওয়া পাথরের বাটি গেলাস অতসীকেই মেজে নিতে হয়, সুরেশ্বরীর নির্দেশ। সেই দুটো হাতে করে অপেক্ষা করতে হয়ে অতসীকে যুগযুগান্তর কলের আশায়।

সন্ধ্যাবেলা ঘরে ফিরে কোনদিন দেখে সীতু আধময়লা বিছানাটায় গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, কোনদিন দেখে হ্যারিকেনের আলোর সামনে রক্তাভ চক্ষু মেলে পড়া করছে। বেশিক্ষণ পারে না তখুনি গুটিয়ে শুয়ে পড়ে। লাইট নেই।

বারো টাকা ভাড়া ঘরে লাইট থাকে না। ওই দামে কোঠা ঘর পাওয়া গেছে এই ঢের।

অতসী এসে কাপড় ছাড়ে, হাত পা ঘোয়, উনুনে আগুন দিয়ে রুটি তরকারি করে ডাক দেয়, সীতু ওঠ, খাবার হয়েছে।

সীতু আস্তে আস্তে উঠে খেতে বসে।

না বসে উপায়ই বা কি?

খিদেয় যে পাকযন্ত্র শুদ্ধ পরিপাক হয়ে থাকে। ইস্কুল থেকে এসে কে হাতের কাছে খাবার জুগিয়ে দেবে?

অতসী মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে বলে, কৌটায় মুড়ি থাকে, নাড়ু থাকে, পাঁউরুটি আনা থাকে, কিছু খাস না কেন সীতু?

সীতু গম্ভীর ভাবে বলে, খিদে পায় না।

এমনি করে কাটে দিন আর রাত্রি।

.

কয়েকটা মাস গড়িয়ে যায়।

সুরেশ্বরী আর একটু অপটু হতে থাকেন। আর সুরেশ্বরীর ছেলের বৌ রোজ একবার করে অতসীকে প্ররোচনা দেন-ছেলেকে সিনেমায় না দিলে তোমার কাছে এখানেই নিয়ে এসে রাখো না। সারাদিন তোমার চোখে চোখে থাকবে।

অবশেষে একদিন অতসীকে সুরেশ্বরীর কাছ থেকে আড়ালে ডেকে আসল কথাটা পাড়ে সুরেশ্বরীর ছেলের বউ, কই গো, তোমার ছেলেকে একদিন আনলে না?

অতসী একবার ওই মদগর্বমণ্ডিত মুখের দিকে তাকিয়ে ঘাড় নীচু করে বলে, ছেলে লাজুক, আসতে বললে আসতে চাইবে না।

বাঃ, দিব্যি তো কথা এড়াতে পারো তুমি! বউ যেন ঝাঁজিয়ে ওঠে, আসতে বললে আসতে চাইবে কি না চাইবে, আগে থেকেই বুঝছ কি করে?

অতসী চোখ তুলে মৃদু হেসে বলে, ছেলে কি চাইবে না চাইবে মায়ে বুঝতে পারে বইকি।

হু। ভদ্রমহিলার মুখখানি থমথমে হয়ে ওঠে। বোধকরি তার সন্দেহ হয় শাশুড়ির নার্সের এটি তার সন্তানহীনতার প্রতি কটাক্ষপাত। কিন্তু এখন একটি মতলব নিয়ে কথা সুরু করেছে সে, প্রথম নম্বরেই মেজাজ দেখিয়ে কাজ পণ্ড করলে লোকসান। তাই আবার কষ্টে মুখে হাসি টেনে বলে, আহা, বেড়াতে আসার নাম করে.ভুলিয়েভালিয়ে নিয়ে আসবে একদিন। মানুষের বাড়ি মানুষ বেড়াতে আসে না?

অতসী কষ্টে মৃদু হেসে বলে, তা একদিন নিয়ে এসেই বা লাভ কি?

যাক আলোচনাটা অনুকূলে আসছে, বউ হৃষ্ট হয়ে ওঠে। মুচকি হেসে বলে, একদিন থেকেই চিরদিন হয়ে যেতে পারে, আশ্চর্য কি!

অতসী একথার অর্থ গ্রহণে অক্ষম হয়েই বোধকরি চুপ করে চেয়ে থাকে।

সুরেশ্বরীর ছেলের বৌ, যার নাম নাকি বিজলী, সে ঠোঁটের কোণে একটু বিজলীর চমক খেলিয়ে বলে ওঠে, তুমি বাবু বড় বেশি সরল, কোন কথা যদি ধরতে পারো। বলছিলাম তুমি তো ওই হরসুন্দরী বামনীর ভাড়াটে। যা বাহারের বাড়ি তার, দেখেছি তো! সেই ভাঙা ঘরেরও কোন না পাঁচ সাত টাকা ভাড়া নেয়, সেখানে ওই ভাড়া গুনে নাই বা থাকলে? এখানে আমার এতবড় বাড়ি, নীচের তলায় কত ঘরদোর পড়ে, ছেলে নিয়ে অনায়াসে এখানে এসে থাকতে পারো।

তাই কি আর হয়! বলে কথায় যবনিকা টেনে চলে যেতে উদ্যত হয় অতসী। কিন্তু বিজলী তাকে এখন ছাড়তে রাজী নয়, তাই ব্যগ্রভাবে বলে, দাঁড়াও না ছাই একটু। বুড়ি আর তোমাবিহনে এক্ষুনি গলা শুকিয়ে মরছে না। তাই কি আর হয় বলছ কেন? এতে তো তোমারই সুবিধে, আর–গলা খাটো করে বিজলী আসল কথায় আসে, দুদিক থেকেই তোমার হাতে কিছু পয়সা হয়। ঘরভাড়াটা বাঁচে, আর তোমার ছেলে যদি বাবুর ফাই-ফরমাসটা একটু খাটতে পারে তাতেও পাঁচ সাত টাকা–।

হঠাৎ যেন সমস্ত পৃথিবীটা প্রবল বেগে প্রচণ্ড একটা পাক খেয়ে অতসীকে ধরে আছাড় মারে। সেই আছাড়ের আকস্মিকতা কাটতে সময় লাগে। কথা বলবার শক্তি সংগ্রহ করতে দেরি হয়। ততক্ষণে বিজলী আর একটু বিদ্যুহাসি হেসে বলে, বাবুর যা দিলদরিয়া মেজাজ, হাতে হাতে ঘুরে মন জুগিয়ে চলতে পারলে বখশিশেই–

হ্যাঁ, এতক্ষণে শক্তি সঞ্চয় হয়েছে।

অতসী ঝাঁ ঝাঁ করা কান আর জ্বালা করা চোখ দুটো নিয়েও কথা বলতে পেরেছে। কিন্তু সে কথা শুনে মুহূর্তে বিজলী বজ্র হয়ে ওঠে। তীব্রস্বরে বলে, কী বললে? ভবিষ্যতে যেন আর কখনো এ ধরনের কথা না বলি? তেজটা তোমার একটু বেশি নার্স! বলি আমার বাড়িতে থেকে ছেলে যদি তোমার ঘরের ছেলের মত একটু কাজকর্ম করত, মানের কানা খসে যেত তার? তবু তো তুমি পাশ করা নার্স নও। মা যার দাস্যবৃত্তি করছে, তার ছেলের এত মান! বাবাঃ! কিন্তু এটি জেনো নার্স, এত মান নিয়ে পরের বাড়ি কাজ করা চলে না। মান একটু খাটো করতে হয়।

অতসী এতক্ষণে স্থির হয়ে গেছে। স্বাভাবিক রং ফিরে পেয়েছে ওর চোখ আর কান।

সেই স্থির চেহারা নিয়ে ও বলে, আপনার আর কিছু বলবার আছে? যদি থাকে তো বলে নিন।

বিজলী এবার বোধকরি একটু থতমত খায়, তবু থতমত খেয়ে চুপ হয়ে যাবার মেয়ে সে নয়। তাই ভুরু কুঁচকে বলে, আর যা বলবার আছে, সেটা বাবুকে বলব, তোমাকে নয়। কুমীরের সঙ্গে বিবাদ করে জলে বাস করা যায় না। এটা মনে রেখো।

মনে রাখব। বলে চলে এসে অতসী যথারীতি সুরেশ্বরীকে ওষুধ খাওয়ায়। মালিশ করে দেয়। তারপর সহজ শান্তভাবে বলে, বিকেল থেকে আমি আর আসব না দিদিমা!

তার মানে? আসবে না মানে? নেহাৎ অপটু তাই, নইলে বোধকরি ছিটকেই উঠতেন সুরেশ্বরী, আসবে না বললেই হল?

তা আসতে যখন পারব না, তখন বলে যাওয়াই তো ভাল।

বলি পারবে না কেন বাছা সেইটাই শুধোই। বুঝেছি বুঝেছি আমার ওই বৌটি নিশ্চয় ভাঙচি দিয়েছে। ডেকে নিয়ে গিয়ে ওই শলা-পরামর্শই দিল তাহলে এতক্ষণ? বলি তুমি তো আর হাবার বেটি নও? শুনবে কেন ওর কথা? বুঝছ না আমার ওপর হিংসে করে তোমায় ভাঙচি দিচ্ছে? এই যে তুমি আমায় যত্নআত্তি করছ, দেখে হিংসেয় বুক পুড়ছে ওর। মহা খল মেয়েমানুষ মা, মহা খল মেয়েমানুষ! কান দিও না ওর কথায়।

অতসী গম্ভীর ভাবে বলে, বৃথা ওসব কথা বলবেন না দিদিমা, উনি আমায় যেতে বলেন নি। আমার অসুবিধে হচ্ছে।

তাই বল–সুরেশ্বরী সহসা একগাল হেসে বলেন, বুঝেছি। চালাকের বেটির আরও কিছু বাড়ানোর তাল। তা বলব আমি, ছেলেকে বলব। বলে কয়ে সাড়ে চার টাকা রোজ করে দেবো তোমার। তাতে হবে তো? হবে না কেন, মাস গেলে পনেরোটা টাকা তো বেড়ে গেল। তা হা মা আতুসী, একথা মুখ ফুটে একটু বললেই হত। দেখছ যখন তোমাকে আমার মনে ধরেছে। না বাছা, ছাড়ার কথা মুখে এনো না। এই বুড়ি যে কটা দিন আছে থেকো। আমি প্রাতর্বাক্যে আশীর্বাদ করছি, তোমার ভাল হবে।

অতসী বৃদ্ধার ওই উদ্বিগ্ন আটুপাটু, আবার প্রায় নিশ্চিন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে। মনে ভাবে, একের অপরাধে আরের দণ্ড! পৃথিবী জুড়ে তো এই লীলা! আমি আর কি করব? বুড়ির জন্যে মায়া হচ্ছে, কিন্তু উপায় কি? এখানে আর থাকা যায় কি করে?

সুরেশ্বরী তার ছানিপড়া চোখের দৃষ্টি যতটা সম্ভব তীক্ষ্ণ করে অতসীর মুখের দিকে তাকান এবং সে মুখে অনমনীয়তার ছাপ দেখে বিচলিত কণ্ঠে বলেন, তা ওতেও যদি তোমার মন না ওঠে, পাঁচ টাকা রোজই করিয়ে দেবো বাছা। আর তো মন খুঁতখুঁত করবে না? কিন্তু তাও বলি আতুসী, আমার ছেলে খুব মাতৃভক্ত, আর টাকায় দুখদরদ নেই বলেই এতটা কবুল করতে সাহস করলাম আমি। নইলে এ তল্লাটে এর অর্ধেক দিয়েও কেউ বুড়ো মায়ের সেবার জন্যে লোক রাখতে চাইবে না। বৌটি হারামজাদা হয়েই হয়েছে আমার কাল। তুই ডাণ্ডা খাণ্ডা বাঁজা মানুষ, শাশুড়ির সেবা করতে পারিস না? সোয়ামীর এতগুলো করে টাকা জলে যাচ্ছে, তাই দেখছিস বসে বসে? কী বলব আতুসী, জ্বলে পুড়ে মলাম, জ্বলে পুড়ে মলাম।

অতসী মৃদুস্বরে বলে, দুঃখ যন্ত্রণার বিষয় বেশি আলোচনা না করাই ভাল দিদিমা, ওতে কষ্ট বাড়ে ভিন্ন কমে না।

সুরেশ্বরী সহসা বিগলিত স্নেহে অতসীর হাতটা চেপে ধরেন, বলেন, এই দেখো তো মা, এই জন্যেই তোমায় ছাড়তে চাই না। কথা শুনলে বুক জুড়োয়। আর আমার বৌটি! কথা নয় তো, যেন এক একখানি চ্যালা কাঠ! যাকগে বাছা, তুমি মনকে প্রফুল্ল করো, দিন পাঁচ টাকা করেই পাবে।

অতসী দৃঢ়কণ্ঠে বলে, পাঁচ টাকা দশ টাকার কথা নয় দিদিমা, দিন কুড়ি টাকা করে হলেও আমার পক্ষে আর এখানে থাকা সম্ভব হবে না।

সুরেশ্বরী স্তম্ভিত বিস্ময়ে কিছুক্ষণ হাঁ করে থেকে বলেন, বুঝেছি, ওই হারামজাদী তোমায় কোনও অপমানের কথা বলেছে। আচ্ছা ডাকাচ্ছি ওকে আমি একবার। দেখি কী তোমায় বলেছে? যতই হোক তুমি হলে ভদ্রঘরের মেয়ে, তোমাকে একটা মান অপমানের কথা বললে .তো গায়ে লাগবেই। কে যাচ্ছিস রে ওখানে? নন্দ? তোদের বৌদিদিকে একবার ডাক তো।

অতসী ব্যাকুলভাবে বলে, মিথ্যে কেন এসব মনে করছেন দিদিমা? আমি বলছি উনি কিছু বলেন নি। আমারই থাকা সম্ভব হচ্ছে না। এমনিই হচ্ছে না। আগে বুঝতে পারি নি

সুরেশ্বরী হঠাৎ দপ করে জ্বলে উঠে বলেন, আগে বুঝতে পারো নি বলে আমায় তুমি গাছে তুলে মই কেড়ে নেবে? এই যে আমার সেবার অভ্যেসটি ধরিয়ে দিলে, তার কি?

সুরেশ্বরীর অভিযোগের ভাষা শুনে এত যন্ত্রণার মধ্যেও হাসি পেয়ে যায় অতসীর। প্রায় হেসে ফেলে বলে, ওর আর কি, যে থাকবে, সেই করবে। এত এত টাকা দিলে এক্ষুনি লোক পেয়ে যাবেন।

সুরেশ্বরী নিজের আগুনে নিজেই জল ঢালেন।

কাঁদো কাঁদো হয়ে বলেন, লোক পাব না তা বলছি না। লোক পাব। ভাত ছড়ালে কাকের অভাব নেই। কিন্তু মা আতুসী, সব কাকই যে দাঁড়কাক। যারা আসবে, তারা হয় একেবারে ঝি চাকরাণীর মতই নোংরা ইল্লুতে ছোটলোক হবে, নয় হাসপাতালের নার্সদের মত গ্যাডম্যাড ফ্যাড হবে। তোমার মতন এমন সভ্য ভব্য শান্ত ভদ্দর মেয়ে আমি আর কোথায় পাব শুনি?

অতসী চুপ করে থাকে আর ভাবে, ভেবেছিলাম মনকে পাথর করে ফেলেছি, মমতাকে জয় করেছি। কিন্তু দেখছি বড্ড বেশি ভাবা হয়ে গিয়েছিল।

সুরেশ্বরী আবার ভাবেন, মৌনং সম্মতি লক্ষণম্। অতসীর বোধ হয় মন ভিজছে। তাই আকুলতার মাত্রা আর একটু বাড়ান তিনি। আবার হাত ধরেন, চোখের জল ফেলেন, অতসীকে কাজের শেষে সকাল সকাল ছেড়ে দেবেন বলে শপথবাক্য উচ্চারণ করেন, তার ফাঁকে ফাঁকে নিজের বৌ সম্পর্কে ন ভূতো ন ভবিষ্যতি করেন। কিন্তু অতসী অনমনীয়। মমতাকে সে জয় করতে পারে নি সত্যি, কিন্তু ওইটুকুই, তার বেশি নয়। মমতায় বিগলিত হয়ে সংকল্পচ্যুত হবে, সে এমন দুর্বল নয়।

অনুরোধ, উপরোধ? তাতে টলানো যাবে অতসীকে? যদি তা যেত, অতসীর ইতিহাস অন্য হত।

অতসী চলে এল।

শেষের দিকে সুরেশ্বরী রাগ করে গুম হয়ে রইলেন। অতসী নিঃশব্দে চলে এল। বিজলী দোতলার বারান্দা থেকে দেখল। আর একই সঙ্গে বিপরীত দুই মনোভাবে কেমন বিচলিত হল।

অতসী এসে পর্যন্ত সুবিধা হয়েছিল তার অনেক, সুরেশ্বরী যতই গালমন্দ করুন এবং নিজে সে যতই বিধিয়ে বিঁধিয়ে শোনাক শাশুড়িকে, তবু শাশুড়ি সম্পর্কে একটা দায় তার ছিল, অতসী এসে পর্যন্ত সেই দায়টা ঘুচেছিল। আবার সেই দায়টা ঘাড়ে এসে পড়বে এই ভেবে মনটা বিরস হচ্ছিল, কিন্তু পরক্ষণেই একটা হিংস্র পুলকে ভাবছিল–ঠিক হয়েছে, বেশ হয়েছে, বুড়ি জব্দ হবে।

কিন্তু আশ্চর্য! ভাল বলতে গিয়ে মন্দ হওয়া!

ছেলেকে চাকর রাখায় আপত্তি। বেশ বাপু আপত্তি তো আপত্তি। তোমার ছেলে না হয় জজ ম্যাজিস্ট্রেটই হবে, তুমি লোকের বাড়ি পা টিপে আর কোমরে তেল মালিশ করে ছেলেকে রূপোর খাটে বসিয়ে মানুষ করগে, কিন্তু দুম করে চাকরিটা ছেড়ে দেবার দরকার কি ছিল? এতই যদি তেজ তো পরের বাড়ি খাটতে আসা কেন?

এইভাবে যুক্তি সাজিয়ে বিজলী নিজেকে দোষমুক্ত এবং অতসীকে দোষযুক্ত করে তুলল, কিন্তু তবু তেমন নিশ্চিন্ত হতে পারল না।

স্বামী এসে কী বলবেন?

মায়ের আবার পুনমুর্শ্বিক অবস্থা দেখে খুশী নিশ্চয় হবেন না এবং সন্দেহ নেই বিজলীকেই এ ঘটনার নায়িকা মনে করবেন।

তাই করে লোকটা। সব সময় করে। বলে না কিছু, কিন্তু নীরব থেকেও শুধু চোখ মুখের ভাবে বুঝিয়ে ছাড়ে; সব দোষ বিজলীর।

আর সুরেশ্বরী?

তিনি বিশ্বসংসারের সকলকে শাপশাপান্ত করছেন, এমন কি হরসুন্দরীকেও রেহাই দিচ্ছেন না। জেনে শুনে এরকম নিষ্ঠুরপ্রাণ মেয়েমানুষকে সে কোন হিসেবে দিয়েছিল? হরসুন্দরীকে সামনে পেলে আরও যে কী বলতেন তিনি!

অতসী অবশ্য বাড়ি এসে কিছুই বলল না।

সামনের ঘরের পড়শীনি চোখখাচোখি হতে বললেন, দিদি যে আজ এক্ষুনি?

অতসী বলল, এমনি। চলে এলাম।

সীতু তখন স্কুল থেকে আসে নি, ঘরের দরজায় একটা সস্তাদরের তালা ঝুলছে। এ ব্যবস্থা হরসুন্দরীর নিজের। ভাড়াটের ভালমন্দের দায়িত্ব তারই এই বোঝেন তিনি। কিছু যদি চুরি যায়, তার বাড়িরই বদনাম হবে।

কিন্তু অতসীর কি চুরি যাবে। কি হচ্ছে তার?

তালার চাবিটা নিতে দোতলায় উঠতেই হল। হরসুন্দরী অবাক হয়ে বললেন, এমন সময় যে?

অতসী একটু ইতস্তত করে বলল, কাজ ছেড়ে দিয়ে এলাম।

কাজ ছেড়ে দিয়ে এলে! হরসুন্দরী আঁতকে ওঠেন, কেন গো? বুড়ি হয়ে গেল নাকি?

না না, কী আশ্চর্য, তা কেন? এমনিই।

হরসুন্দরী হাঁ করে তাকিয়ে বলেন, এমনি! ঘরে তো অদ্যভক্ষ্য ধনুর্গুণ, এমনি তুমি কাজটা ছেড়ে দিলে? বুড়ি খুব খিটখিট করেছিল বুঝি?

না না, কিছুই বলেন নি তিনি।

তবে ওই বৌ ছুঁড়ি ক্যাঁটকেঁটিয়ে কিছু বলেছে নিশ্চয়! ওর কথাই অমনি। দেখ না শাশুড়ি পর্যন্ত জ্বলেপুড়ে মরে। তবু বলি, রাগের মাথায় ঝপ করে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে আসা তোমার উচিত হয়নি মেয়ে। এ জগৎ বড় কঠিন ঠাঁই।

অতসী আস্তে চাবিটা কুড়িয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তর তর করে চলে আসতে পারে না।

হরসুন্দরী আবার বলেন, বুঝছি তোমার কপালে এখন অশেষ দুঃখু তোলা আছে। নইলে অমন কাজটা ছেড়ে দিলে! আর কোথাও কিছু জোগাড় করেছ নাকি?

অতসী ক্ষুব্ধ হাসি হাসে, আমি আর কোথায় কি জোগাড় করব?

তাও তো সত্যি। কিন্তু এও বলি অতসী, ঝোঁকের মাথায় কাজটা ছেড়ে না দিয়ে একবার বাড়ি এসে বিবেচনা করা উচিত ছিল। পরের দাসত্ব করতে গেলে গায়ে গণ্ডারের চামড়া পরতে হয় মা!

সেটা পরতে সময় লাগবে মাসীমা! বলে অতসী চলে আসতে চায়। হরসুন্দরী বাধা দিয়ে সন্ধিগ্ধভাবে বলেন, শাশুড়িও কিছু বলে নি বলছ, বৌও কিছু বলে নি, তবে ব্যাপারটা কী হল বল তো? বুড়ির ছেলেকে তো ভাল বলেই জানতাম, সেই কোনরকম কিছু বেচাল দেখাল নাকি?

আঃ ছি ছি, কী বলছেন মাসীমা! অতসী রুদ্ধকণ্ঠে বলে, কী করে যে এই সব আজগুবি কথা মাথায় আসে আপনাদের? বলেই চলে আসে, আর দাঁড়ায় না।

স্কুল থেকে ফিরে সীতু কোনদিন মাকে বাড়িতে দেখতে পায় না। অতসী আসে সন্ধ্যার পর। আজ ঘরের দরজা খোলা দেখে ঈষৎ বিস্ময়ে দরজায় উঁকি দিয়েই পুলকে রোমাঞ্চিত হল সে। তার সীল করা মনও এই পুলককে লুকিয়ে রাখতে পারল না।

বই রেখেই মার কাছাকাছি বসে পড়ে উজ্জ্বল মুখে বলে উঠল সীতু, মা এখন?

অতসী কী এই উজ্জ্বল মুখে কালি ঢেলে দেবে? বলবে, ঘুচিয়ে এলাম চাকরি? এবার নেমে আসতে হবে দুর্দশার চরমে?

না, এই মুহূর্তে তা পারল না অতসী। শুধু মৃদুহেসে বলল, দেখে বুঝি রাগ হচ্ছে?

ইস রাগ বইকি! রোজ তুমি থাকবে। ইস্কুল থেকে এসে তালা খুলতে বিচ্ছিরি লাগে।

অতসী তেমনিভাবেই বলে, বেশ রোজ আমি থাকব, তোকে আর দরজার তালা খুলতে হবে না। কিন্তু রোজগারের ভার তুই নিবি তো?

না, কালি ঢেলে দেওয়া রদ করা গেল না। সুর কেটে গেল।

সীতু আস্তে আস্তে উঠে গেল মুখ হাত ধুতে।

কিন্তু নিজে ছাড়লেও কমলি ছাড়ে না।

পরদিন হরসুন্দরী এসে জাঁকিয়ে বসলেন, শুনলাম বাছা তোমার কাজ ছাড়ার কারণ কাহিনী।

অতসী অনুভব করল সীতু হেঁটমুণ্ডে অঙ্ক কষতে কষতেও উৎকর্ণ হয়ে উঠেছে। তাড়াতাড়ি বলল, থাক মাসীমা ও কথা।

কিন্তু হরসুন্দরী তো এসেছেন দূত হয়ে, কাজেই এক্ষুনি থাকলে তার চলবে কেন? তাই প্রবল স্বরে বলেন, তুমি তো বলছ বাছা থাক ও কথায়। কিন্তু তারা যে আমায় আবার খোসামোদ করছে। বুড়ি তো মা আমার হাতে ধরে কেঁদে ভাসাল। শুনলাম সব। বৌটা নাকি তোমার ছেলেকে বাবুর ফাইফরমাস খাটতে চাকর রাখতে চেয়েছিল? অহঙ্কার দেখ একবার! তুমি না হয় অভাবে পড়ে দাসীবিত্তি–

মুখের কথা মুখেই থাকে হরসুন্দরীর, হঠাৎ সীতু খাতা ফেলে উঠে এসে তীব্র চীৎকারে বলে, তুমি চলে যাও।

একে তুমি তায় চলে যাও!

হরসুন্দরীর আগুন হয়ে উঠতে পলকমাত্রও দেরি হয় না।

তিনি দাঁড়িয়ে উঠে বলেন, তোমাদের মায়ে-বেটার তেজটা একটু বেশি সীতুর মা! কপালে তোমার দুঃখু আছে। আচ্ছা চলে আমি যাচ্ছি। ঠিক ঠিক সময়ে ঘরভাড়াটা যুগিও বাছা, তোমার ছায়া মাড়াতেও আসব না। আত্মজন ছেড়ে কেন যে তুমি ওই ছেলে নিয়ে অকূলে ভেসেছ, বুঝতে পারছি এবার।

হরসুন্দরী বীরদর্পে চলে যান। অতসীর অকূলের তৃণের ভেলা, অসময়ের একমাত্র হিতৈষী হরসুন্দরী বাড়িওয়ালী।

অতসী কি ছুটে গিয়ে ওই ভেলাকে আঁকড়ে ধরবে? বলবে, জানেনই তো মাসীমা, ছেলে আমার পাগলা।

না, অতসীর সে শক্তি নেই। ছুটে যাওয়ার শক্তি। স্থাণু হয়ে গেছে সে।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়, নির্বাক দুটো প্রাণী বসে থাকে সেই অন্ধকারে। এমনি করেই কি লেখাপড়া চালাবে সীতু? মানুষ হবে, বড়লোক হবে? মৃগাঙ্ক ডাক্তারের অর্থঋণ শোধ করবে?

হঠাৎ এক সময় অতসী পিঠে একটা স্পর্শ অনুভব করে। একটা চুলে ভরা মাথা আর হাড় হাড় রোগা মুখের স্পর্শ।

ও কেন ওকথা বলবে? রুদ্ধ অস্ফুট স্বর।

অতসী নির্বাক।

আর একবার সেই রুদ্ধস্বর বলে ওঠে, আমার বুঝি বিচ্ছিরি লাগে না? আপোসের স্বর, কৈফিয়তের স্বর।

অতসী স্থির স্বরে বলে, পৃথিবীর কোনটা তোমার বিচ্ছিরি লাগে না, সেটা আমার জানা নেই সীতু। নতুন করে আর কি বলবে?

চাকর বললে, দাসী বললে, চুপ করে থাকব?

হ্যাঁ থাকবে। অতসী দৃঢ় স্বরে বলে, তাই থাকতে হবে। আমারই ভুল হয়েছিল কাজ ছেড়ে আসা। ঠিকই বলেছিল ওরা। আমাদের অবস্থার উপযুক্ত কথাই বলেছিল। অহঙ্কার আমাদের শোভা পাবে কিসে? জানো, একমাস যদি এ ঘরের ভাড়া দিতে না পারি, রাস্তায় বার করে দিতে পারেন উনি! জানো, জেনে রাখো! এসব জানতে হবে তোমায়। জেনে রাখো তোমার বিচ্ছিরি লাগা আর ভাল লাগার বশে পৃথিবী চলবে না। অতসী যেন হাঁপাতে থাকে, কাল থেকে আবার আমি ওখানে কাজ করতে যাব। পায়ে ধরে বলব, আমার ভুল হয়েছিল–।

না না না! বাণ খাওয়া পশুর মত আর্তনাদ করে ওঠে বাক্যবাণবিদ্ধ ছেলেটা।

আশ্চর্য, এত নিষ্ঠুর কি করে হল অতসী?

নাকি ছেলেকে চৈতন্য করিয়ে দিতে ওর এই নিষ্ঠুরতার অভিনয়? অভিনয় কি এত তীব্র হয়? নাকি অহরহ খুকুর মুখ তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিচ্ছে?

ওই আর্তনাদে একটু সামলায় অতসী। একটু চুপ করে থাকে। তারপর সহজ গলায় বলে, না তো চলবে কিসে তাই বল?

নাই বা চলল? সীতু তেমনি একগুঁয়ে স্বরে বলে, আমরা দুজনেই মরে যাই না?

অতসী উঠে দাঁড়ায়, যথাসম্ভব দৃঢ় স্বরে বলে, কেন? মরে যাব কেন? মরে যাওয়া মানেই হেরে যাওয়া তা জানো? হারতে চাও তুমি? যদি হেরেই যাব, তাহলে তো ও বাড়িতেই মরতে পারতাম। এ খেয়ালকে মনে আসতে দিও না সীতু। মনে রেখো তোমায় বাঁচতে হবে, জিততে হবে। দেখাতে হবে, যে অহঙ্কার করে চলে এসেছ, সে অহঙ্কার বজায় রাখবার যোগ্যতা তোমার আছে।

উঠে গিয়ে উনুন ধরাতে বসে অতসী।

কিন্তু কদিন উনুন ধরাবে? কোথা থেকে আসবে রসদ?

কী করে কি করছে ওরা?

কি করে চালাচ্ছে? কোথা থেকে আসছে ওদের রসদ?

এই কথাটাই আকাশপাতাল ভাবেন মৃগাঙ্ক ডাক্তার। ভাবেন সত্যিই কি এইভাবে ভেসে যেতে দেবেন ওদের?

না, অতসীর আস্তানা এখন আর তার অজানা নেই। অনেকদিন ভেবে ভেবে অবশেষে মাথা হেঁট করে শ্যামলীর বাড়ি গিয়ে সে খোঁজ করে এসেছেন। যদিও অতসীর সহস্র নিষেধ ছিল, তবু শ্যামলী বলতে মুহূর্ত বিলম্ব করে নি। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলেছিল, লজ্জায় আমি আপনার কাছে মুখ দেখাতে পারি না কাকাবাবু, না হলে কবে গিয়ে বলে আসতাম! আমি বলি কি, আপনি আর ওঁদের জেদের প্রশ্রয় দেবেন না। এবার পুলিশের সাহায্য নিয়ে জোর করে ধরে এনে বাড়িতে বন্ধ করে রেখে দিন। আবদার নাকি, ওই ভাবে একটা বস্তির বাড়ির মত বাড়িতে থেকে আপনার মুখ পোড়াবে?

বোকাদের মুখরতা মৃগাঙ্কর অসহ্য, তবু সেদিন ওই বোকা মেয়েটার মুখরতা অসহ্য লাগেনি। সহসা মনে হয়েছিল, জগতে এই সরল সাদাসিধে অনেক কথা-বলা লোক কিছু আছে বলেই বুঝি পৃথিবী আজও শুকিয়ে উঠে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায় নি। ভেবেছিলেন, আশ্চর্য, মেয়েটার ওপর এত বিরূপই বা ছিলাম কেন!

তোমরা কোনদিন গিয়েছিলে? সসঙ্কোচে প্রশ্ন করেছিলেন মৃগাঙ্ক।

শ্যামলী মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল, উপায় আছে? একেবারে কড়া দিব্যি! দেখা করব না, খোঁজ করব না, কোন সাহায্য করব না–

সাহায্য শব্দটা উচ্চারণ করে অপ্রতিভ হয়ে চুপ করে গিয়েছিল শ্যামলী। চলে এসেছিলেন মৃগাঙ্ক। চলে তো আসতেই হবে। নিতান্ত কাজ ব্যতীত বাইরে থাকার জো আছে কি? খুকু নামক সেই ভয়ঙ্কর মায়ার পুতুলটা আছে না বাড়িতে? সারাক্ষণ যাকে ঝি-চাকরের কাছে পড়ে থাকতে হয়। মৃগাঙ্ক এলেই যে কোথা থেকে না কোথা থেকে ছুটে এসে বাব্বা বাব্বা বলে ঝাঁপিয়ে কোলে ওঠে।

শুধু ওই বাবা ডাকেই চিরদিন সন্তুষ্ট থাকতে হবে খুকুকে! মা বলতে পাবে না! মা নেই ওর! হঠাৎ একদিন মোটর অ্যাকসিডেন্টে মা মারা গেছে ওর!

বাবাই তাই বুকের ভেতরে চেপে ধরে খুকুকে।

কিন্তু থাকে না। বেশিদিন থাকে না এই অভিমান। থাকানো যায় না।

গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান মৃগাঙ্ক।

শিবপুরের এক অখ্যাত গলির ধারে কাছে ঘুরে বেড়ান। একদিন নয়, অনেকদিন। কিন্তু কী যে হয়, কিছুতেই সাহস করে গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে সেই বাই-লেনের ছায়াচ্ছন্ন অন্ধকারের মধ্যে এগিয়ে যেতে পারেন না। বুকটা কেমন করে ওঠে। পা কাঁপে।

যদি অতসী পরিচয় অস্বীকার করে বসে? যদি অন্য পাঁচজনের সামনে বলে ওঠে, আচ্ছা লোক তো আপনি? বলছি আপনাকে চিনি না আমি

চলে আসেন।

আবার যখন গভীর রাত্রে ঘুম থেকে জেগে ওঠা কান্নায় উদ্দাম খুকুকে কিছুতেই ভোলাতে না পেরে, কোলে নিয়ে পায়চারি করে বেড়ান, তখন মনে মনে দৃঢ় সংকল্প করেন, কাল নিশ্চয়ই। কিন্তু আবার পিছিয়ে যায় মন।

এই কাল কাল করে কেটে যায় কত বিনিদ্র রাত, আর অশান্ত দিন।

তারপর সেদিন।

যেদিন খুকু

কিন্তু এমন কি হয় না? ডাক্তার হয়েও এত বেশি নার্ভাস হলেন কি করে?

হয়তো অত বেশি নার্ভাস হয়ে উঠেছিলেন বলেই খুকু…

৫. রাগে ফুঁসে প্রতিজ্ঞা

সেদিন অপদস্থ হয়ে ঘরে গিয়ে রাগে ফুঁসে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন হরসুন্দরী, রোসো! ঝেঁটিয়ে বিদেয় করছি। ওমা আমি গেলাম তোদের ভাল করতে, আর তোরা কিনা–পুঁচকে ছোঁড়াটা যেন কেউটের বাচ্ছা!

আসল কথা দুদিকে জ্বালা হল তার।

হঠাৎ অতসী কাজটা ছেড়ে আসায় সন্দেহাকুল মনে গিয়েছিলেন তল্লাস নিতে, ভেবেছিলেন খুব একটা কিছু ঘটে গেছে বোধহয়।

কিন্তু এমন আর কি!

তাঁ, বুঝলাম ভাল ঘরের মেয়ে। ছেলেটাকে মানুষ করে তোলবার জন্যে শরীর পতন করতে বসেছে, চাকর রাখা কথাটা ভাল লাগে নি। তা বলে ঝপ করে কাজটা ছেড়ে দিবি?

সুরেশ্বরী হাত ধরে কেঁদেছিলেন।

তুমি যেমন করে পারো তাকে বুঝিয়ে বাঝিয়ে নিয়ে এসো বাপু। সেবার হাতটি তার বড় ভাল। এমনটি আর পাব না। আর যে আসবে, সেই তো হবে কি না কি জাত। এমন ভাল জাতের মেয়ে

হরসুন্দরী ভেবেছিলেন, অনুরোধ উপরোধের জাল ফেলে মাছকে টেনে তুলবেন। উপরোধে ঢেঁকি গেলানো যায়, আর এ তো ছানার মণ্ডা। অভাবের জ্বালায় মান অভিমান কতক্ষণ থাকে? নিজের ওপর আস্থা ছিল হরসুন্দরীর।

বলেই এসেছিলেন সুরেশ্বরীকে, আচ্ছা আমি বুঝিয়ে বাঝিয়ে নিয়ে আসব আবার। উপরোধের মতন উপরোধ করতে জানলে ঢেঁকি গেলানো যায় লোককে, আর এ তো গিয়ে ছানার মণ্ডা। ভাল ঘরের মেয়ে তো, হঠাৎ মান অপমান বোধটা বেশি।

কিন্তু এখন তাদের কী বলবেন? উপরোধ করার স্পৃহা তো আর নেই হরসুন্দরীর।

ওই ঢেঁটা ছেলেটা তার চিত্ত বিষ করে দিয়েছে। তাই একমনে দিন গুনছেন তিনি মাসকাবারটা কবে হয়। কবে ভাড়া না দিয়ে চুপচাপ বসে থাকার দায়ে ওই আঝাড়া বাঁশ দুখানাকে ঘরছাড়া করেন।

গরীবের উপকার করতে বুক বাড়িয়ে দেওয়া যায়, যদি গরীব গরীবের মত নত থাকে, গরীবের অহঙ্কার অসহ্য!

.

হরসুন্দরী মাসকাবার পর্যন্ত অপেক্ষা করে বসে আছেন, কিন্তু অতসীর যে দিন কাটে না। তার স্বল্পসঞ্চয় ভাঁড়ারের সব কিছুই তো শেষ হয়ে গেছে। কাল পর্যন্ত চালটা ছিল, আজ তাও নেই।

চাল নেই!

মৃগাঙ্ক ডাক্তারের স্ত্রী চালের শূন্য কলসীটার সামনে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। এই অদ্ভুত পরিস্থিতিতে মৃগাঙ্ক ডাক্তারের স্ত্রী কাঁদবে? না হেসে লুটিয়ে পড়বে?

কলসীটা নেড়ে নাচাতে নাচাতে এসে বলবে, ওরে সীতু কী মজা! আজ মার বেশ রান্না করতে হবে না! বেশ কেমন যত ইচ্ছে ঘুমাবো মজা করে!

হুঁ, সেই কথাই বলতে গিয়েছিল অতসী। সত্যিই কলসীটা হাতে করে গিয়েছিল।

নাচাতে নাচাতে বলেওছিল, ওরে সীতু আজ কী মজা! আজ আর রাঁধতে হবে না আমায়

কিন্তু এত হাসি যে কোথা থেকে এল অতসীর?

প্রগলভ প্রবল হাসি! সেই হাসির ধমকে মাটির কলসীটা হাত থেকে ছিটকে গড়িয়ে ভেঙেই পড়ল একদিকে। আর অতসী লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।

এক ঝাঁক স্কুলের মেয়ে একত্রে থাকলে যেমন করে তুচ্ছ কথায় হেসে লুটোপুটি খায়, একা অতসী তেমনি লুটোপুটি খাবে নাকি?

এই হাসির দিকে তাকিয়ে আতঙ্কবিহ্বল একজোড়া দৃষ্টি যেন পাথর হয়ে তাকিয়ে থাকে।

আর ঠিক এই সময় হরসুন্দরী দরজায় এসে দাঁড়াল, তার বড় মেয়েকে নিয়ে।

মহিলা দুটি ঘরের সম্পূর্ণ দৃশ্যটি একবার যাকে বলে অবলোকন করে গালে হাত দিয়ে বিস্ময় বিমুগ্ধ কণ্ঠে বলেন, হ্যাঁ গা ব্যাপার কি! ও খোকা, মা পড়ে গিয়ে কাৎরাচ্ছে নাকি গো!

খোকা অবশ্য এক ডাকে কথা কয় না, এখনো কইল না।

হরসুন্দরী এগিয়ে এসে বলেন, অ সীতুর মা, কাৎরাচ্ছ কেন? কলসীটাই বা ভেঙে গড়াগড়ি যাচ্ছে কেন, মায়ে ছেলের মুখে রা নেই যে!

এবার ছেলে রা কাড়ে। স্বভাবগত তীব্র স্বরে বলে, কাৎরাবেন কেন? হাসছেন।

হাসছেন!

মা মেয়ে দুজনে বোধকরি হাঁ করে হাঁ বন্ধ করতে ভুলে যান।

কিন্তু অতসী উঠে পড়ছে না কেন? কেন উঠে পড়ে বলছে না, বোকাটার কথা শুনছেন কেন মাসীমা! হঠাৎ পেটটা বড্ড ব্যথা করছে বলে!…ওই ব্যথার দাপটেই হাত থেকে কলসীটা পড়ে গিয়ে

না, অতসী উঠছে না। মাটিতে মুখ গুঁজেই পড়ে আছে সে। শুধু দেহটা যে কেঁপে কেঁপে উঠছিল সেটা স্থির হয়ে গেছে।

হরসুন্দরী যদিও নিজের মেয়েদের সম্পর্কে সর্বদাই বিদ্বেষবাক্য উচ্চারণ করেন, কিন্তু আপাতত দেখা গেল মায়ে-ঝিয়ে একতার অভাব নেই। মেয়েও অবিকল মায়ের ভঙ্গীতে গালে হাত দিয়ে বলে, হঠাৎ এত হাসির কি কারণ ঘটল যে গড়াগড়ি দিয়ে হাসতে হচ্ছে? সিদ্ধি খেয়েছ নাকি গো অতসী?

তোমরা সব্বাই এত অসভ্য কেন? সীতু স্বর আরও তীব্র করে, কলসীতে চাল নেই, রাঁধতে হবে না বলে মা হাসছেন! সিদ্ধি! সিদ্ধি মানুষে খায়? শুধু তো দারোয়ানরা খায়।

সহসা মাতা কন্যা চুপ করে যান, এবং পরস্পর একটি অর্থপূর্ণ দৃষ্টিবিনিময় হয়। আর মিনিট খানেক তাকিয়ে থেকে হরসুন্দরীর চোখে যে আলোটি ফুটে ওঠে, সেটি প্রেমেরও নয়, করুণারও নয়, স্রেফ জয়োল্লাসের।

সেই আলোঝরা চোখে বলে ওঠেন হরসুন্দরী, তোমাদের রঙ্গলীলা তোমরাই জানো। ঘরে চালের দানা নেই, মেজাজ চালে মটমট! এই অবধি বুড়ি কী খোসামোদটাই করল আমাকে! তোমাদের মতিগতি দেখে আর বলে অপমান্যি হলাম না। এতদিনে তারা হতাশ হয়ে অন্য লোক রাখল। যাক গে মরুক গে! ভেতরের কথা তোমরাই মায়ে পোয়ে জানো। আমার কথা বলে যাই। ভাড়া না নিয়ে ভাড়াটে পুষি এমন সঙ্গতি আমার নেই। মাসের আর দুদিন আছে, এর মধ্যে অন্য ব্যবস্থা করে ফেলো, পয়লা থেকে আমার মেয়ের ভাগ্নী এসে থাকবে। এর যেন আর নড়চড় না হয়।

দুম দুম করে চলে আসেন দুজনে। কিন্তু দোষ হরসুন্দরীকে দেওয়া যায় না। অসহায়া বিধবাকে দেখে মায়া তার পড়েছিল। ওদের যাতে ভাল হয় তার চেষ্টাও কম করেন নি। কিন্তু মায়া যে নেয় না, ভাল যে চায় না, তার ওপর কতক্ষণ আর কার চিত্ত প্রসন্ন থাকে?

তার উপর আজকের এই পরিস্থিতি।

বলতে এসেছিলেন অবিশ্যি বাড়ি ছাড়ারই কথা। কিন্তু রয়ে বসে আর একবার শেষ চেষ্টা দেখে বলবেন ভেবেছিলেন। ওমা এ আবার কী ঢং! ঘরে চাল নেই, রান্নার ছুটি বলে আহ্লাদে গড়াগড়ি দিয়ে হাসছে! হয় পাগল, নয় তলে তলে অন্য ব্যাপার! হয়তো আসলে গরীব নয়, ঘর ভেঙে পালিয়ে টালিয়ে এসেছে। আবার হয়তো ফিরে যাবে। তবে আর মায়া করার কী দরকার?

মেয়ে বলে, তুমি মোটেই আশা কোর না মা, যাবে। ও দেখো ঠিক ঘর কামড়ে পড়ে থাকবে।

হরসুন্দরী থমথমে গলায় বলেন, নাঃ সেদিকে তেজ টনটনে। ছেলের হাত ধরে গাছতলায় গিয়ে দাঁড়াবে, তবু মচকাবে না।

.

হ্যাঁ, হরসুন্দরী বাড়িওয়ালি চিনেছিলেন অতসীকে। মানুষ চেনবার ক্ষমতা তার আছে।

এই তালাচাবিটা রইল মাসীমা, ঘরটা ধুয়ে রেখে গেলাম। বলে ভাঙা নড়বড়ে সেই তালাটা হরসুন্দরীর কাছে নামিয়ে দিয়ে একটা নমস্কারের মত করে অতসী।

হরসুন্দরী নীরস গলায় বলেন, আশ্রয় একটা জোগাড় করেছ, না তেজ করে ছেলের হাত ধরে ফুটপাথে গিয়ে দাঁড়াচ্ছ?

অতসী ঈষৎ হেসে বলে, আপনাদের আশীর্বাদই আশ্রয় মাসীমা, উপায় হবেই যা হোক একটা কিছু।

হরসুন্দরী নিঃশ্বাস ফেলে চাবিটা কুড়িয়ে নিয়ে বলেন, ধর্মে মতি থাক, ছেলেটা মানুষ হোক। তবে এও বলি অতসী, তোমার যত দুৰ্গতি ওই ছেলে থেকেই। ওর চেয়ে এক গণ্ডা মেয়ে থাকাও ভাল।

মেয়ে সম্পর্কে বিরক্তি-পরায়ণা হরসুন্দরী আজ এই রায় দিয়ে বসেন।

আর কি শোনবার আছে? আর কি বলবার আছে? এখন শুধু দেখতে বেরুনো পৃথিবীটা কত ছোট।

.

না, মাসপয়লায় হরসুন্দরীর মেয়ের ভাগ্নী এসে ভাড়াটে হল না তার। ওটা ছল। ঘরটা শূন্য পড়ে রইল আর দশ বিশ দিন। এ ঘরের উপযুক্ত খদ্দের আবার জোটা চাই তো?

কিন্তু পয়লা তারিখে হরসুন্দরী বাড়িওয়ালির ওপর একটা মস্ত ধাক্কা এসে লাগল। ওই সরু বাইলেনের মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল প্রকাণ্ড একখানা গাড়ি। আর সেই গাড়ি থেকে রাজার মত চেহারার একটা মানুষ নেমে এসে খুঁজেছিল হরসুন্দরী বাড়িওয়ালিকে।

আচ্ছা, তার সীমানা কি ওইটুকু পর্যন্তই ছিল? তাহলে হরসুন্দরী অমন করে কপালে করাঘাত করেছিলেন কেন?

এই ঘর বাবা! এই দুদিন আগেও ছিল। হঠাৎ কী মতি হল—

নিজের দুর্মতির কথাটা আর মুখ দিয়ে উচ্চারণ করেন না হরসুন্দরী। সেটা মনের মধ্যে পরিপাক করে তুষের আগুনে জ্বলতে থাকেন।

কী কুকাজই করেছেন! আর দুটো দিন যদি ধৈর্য করে অপেক্ষা করতেন! তাহলে আজকের নাটকটা কতখানি জমে উঠত, একবার প্রাণভরে দেখে নিতেন।

তা কি করেই বা জানবেন হরসুন্দরী যে, বলতে মাত্রই পরদিন সকালবেলাই দম্ভ দেখিয়ে চলে যাবে ছুঁড়ি! দুটো দিনও থাকবে না!

আহা-হা ইস! এই রাজার মত মানুষটা তাকে খুঁজতে এসে ফিরে যাচ্ছে।

এবারে বোঝাই যাচ্ছে, বাড়ি ছেড়ে চলে আসা নিছক রাগের ব্যাপার। যা তেজ যা রাগ! মানুষটা অতসীর কি রকম আত্মীয় সেটা জানবার দুরন্ত ইচ্ছেকে দমন করে থাকেন হরসুন্দরী। এই হোমরা-চোমরা দীর্ঘদেহ সাহেবী পোশাক পরা লোকটাকে জিগ্যেস করতে সাহস হয় না। তবু মনে মনে অনুভব করেন, হয় বড় ভাই, নয় ভাসুর। তা ছাড়া আর কি হতে পারে? ভাসুর হওয়াই সম্ভব, ভাই হলে যতই হোক চেহারায় আদল থাকত।

কোনও ঠিকানা রেখে যায় নি?

নাঃ! হরসুন্দরী ক্ষোভ প্রকাশ করেন, মানুষকে তো মনিষ্যি জ্ঞান করে না! কেমন যে একবগ্গা জেদী মেয়ে!

এক বগগা জেদী! সে কথা মৃগাঙ্কর চাইতে আর বেশি কে জানে!

ঘরটা এমন কিছু বিশাল বিস্তৃত নয় যে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সবটা দেখা যায় না, বলতে গেলে তো এ দেওয়ালে ও দেওয়ালে হাত ঠেকে। তবু মৃগাঙ্ক সহসা চৌকাঠের মধ্যে পা রাখলেন।

দেখতে চেষ্টা করছেন কি, দুদিন আগেও যারা এঘরে ছিল, তাদের উপস্থিতির রেশ এখন এর মধ্যে সঞ্চরণ করে ফিরছে কিনা? না, তা নয়, মৃগাঙ্ক শুধু অস্ফুট একটা শব্দে শিউরে ওঠাটা দমন করলেন।

এই ঘরে বাস করে গেছে অতসী! এই দুদিন আগে পর্যন্তও ছিল?

রাত্রে দরজা বন্ধ করলে তারের জাল ঘেরা ঘুলঘুলির মত ওই জানলাটা ছাড়া নিঃশ্বাস ফেলার দ্বিতীয় আর পথ নেই। আর সেই পথ থেকে উঠে আসছে নীচের কচা নর্দমার দুর্গন্ধবাহী বাতাস।

কিন্তু এত বিচলিত হচ্ছেন কেন মৃগাঙ্ক, সুরেশ রায়ের বাড়ি কি তিনি দেখেন নি?

তবু ব্যাকুল মৃগাঙ্ক ব্যগ্র স্বরে বললেন, যদি কোন দিন আসে, যদি আপনার সঙ্গে দেখা হয়, বলবেন, তার যে ছোট্ট বাচ্চা একটা মেয়ে আছে, তার খুব বেশি অসুখ–

মেয়ে!

কথা শেষ করতে দেন না হরসুন্দরী, চমকে উঠে গালে হাত দেন, মেয়ে! বলেন কি বাবা? মেয়ে আছে তার? আপনি যে তাজ্জব করলেন আমাকে! ছেলের থেকে ছোট মেয়ে? সেই মেয়ে ছেড়ে

মৃগাঙ্ক বোধ করি এবার সচেতন হন। মৃদু গম্ভীর স্বরে শুধু বললেন, হ্যাঁ, দুর্ভাগ্য শিশু! যাক যদি কোনরকম যোগাযোগ–আচ্ছা–একদম একা গেছে? না কোনও

না বাবা, কেউ না। একেবারে একা। মায়ে ছেলে দুজনে চলে গেল একটা রিকশ ডেকে। তাই সে রিকশর ভাড়াটাই যে কি করে দেবে ভগবান জানেন! ঘরে তো ভাঁড়ে মা ভবানী! আপনাদের মতন এমন সব আত্মীয় থাকতে

মৃগাঙ্ক ততক্ষণে উঠোনে নেমেছেন।

না, মৃগাঙ্কর পক্ষে সম্ভব নয় নিজেকে এর থেকে বেশি ব্যক্ত করা, যতই ব্যাকুল হয়ে উঠুক অন্তর।

আশ্চর্য! আশ্চর্য!

দুদিন আগে এলেন না মৃগাঙ্ক! খুকুর টাইফয়েড! খুকু প্রবল জ্বরের ঘরে মা মা করছে, এ শুনলেও হয়তো কাঠ হয়ে বসে থাকত সেই পাষাণমূর্তি! বলত, খুকুর মা তো অনেকদিন আগে মরে গেছে!

হয়তো তাই বলত!

জ্বরে আচ্ছন্ন খুকুকে নার্সের কাছে রেখে এসেছেন মৃগাঙ্ক। আর স্বেচ্ছায় এসে বসে আছে সেই মেয়েটা। যে মেয়েটা সুরেশ রায়ের ভাইঝি।

গতকাল খুকুর একটা টাল গেল। শহরের সেরা সেরা ডাক্তারের ভিড় হয়ে উঠল বাড়িতে, নার্সের উপর নার্স এল। আর সহসাই সেই সময় ওই মেয়েটা খুকুর খবর নিতে এল। পথে এ বাড়ির কোন ঝি-চাকরের সঙ্গে দেখা হয়েছে, শুনেছে খুকুর অসুখ।

ভাবলে অবাক লাগে, সেই কাল থেকে মেয়েটা মৃগাঙ্কর বাড়িতেই রয়ে গেল। নার্সের সঙ্গে মিলে মিশে দেখাশোনা করতে লাগল খুকুকে। মৃগাঙ্ক অস্বস্তি বোধ করে বারবার অনুরোধ করেছেন বাড়ি ফিরে যেতে, তার যে একটা ছোট ছেলে আছে–সেকথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু শ্যামলী গ্রাহ্য করে নি ব্যাপারটা। বলেছে ছেলে তার যথেষ্ট বড় হয়ে গেছে।

মৃগাঙ্ক অবাক হয়ে দেখলেন মেয়েটা কত সহজে সহজ হয়ে গেল। পরের বাড়ি থেকে গেল। সময়মত চান করে খেয়ে নিল, কাকাবাবু আপনি একটু বিশ্রাম করুন গে বলে জোর করে পাশের ঘরে ঘুমোত পাঠিয়ে দিল মৃগাঙ্ককে। কোথাও ঠেক খেলো না। সরল–মানে বোকা! আর বোকা বলেই হয়তো বা নিজের জীবনকে কোনদিন জটিল করে তুলবে না।

.

হয়তো মৃগাঙ্কর ভাবনাই ঠিক।

অতসী আর অতসীর ছেলের বুদ্ধি প্রখর, তাই ওরা জীবনকে ক্রমশ জটিল করে তুলছে। নইলে খেটে খাওয়া ছাড়া যার জীবনে আর কোনও গতি রইল না, সে তুচ্ছ একটু অভিমানের বশে সুরেশ্বরীর কাজটা ছেড়ে দেয়।

সে তো তবুও মোটা মাইনের সম্ভ্রম ছিল। এখন যে খাওয়া পরা রাঁধুনীর কাজ।

হ্যাঁ তাই মেনে নিতে হয়েছে। ঘণ্টা কয়েকের মধ্যে আহার আর আশ্রয় জোগাড় করবার এছাড়া আর উপায় কি?

এই যে জোগাড় হয়েছে সেটাই আশ্চর্য! এমন হয় না। রিকশা করে অনেকটা দূর এগিয়ে অতসী হঠাৎ একটা গেটওয়ালা বড় বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে ছেলেকে বলেছিল, দাঁড়া তুই এই জিনিসপত্ৰ আগলে, আমি আসছি।

আর খানিকক্ষণ পরে বেরিয়ে এসে ছেলেকে দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিল, আয়।

এখানে কি? সীতু আড়ষ্ট হয়ে বলে উঠেছিল, এরা তোমার চেনা?

না! চেনা করে নিতে হবে। করে নিলাম।

অতসীর অনেক ভাগ্য যে ঠিক যে সময় বাড়ির গিন্নী রাঁধুনীহীন অবস্থায় কারে পড়ে রয়েছেন, সেই সময় অতসী গিয়ে সোজাসুজি প্রশ্ন করেছিল, রান্নার লোক রাখবেন?

রান্নার লোক!

গিন্নী ভাবলেন তার আকুল প্রার্থনায় স্বয়ং ভগবান কি ছদ্মবেশিনী কোন দেবীকে পাঠিয়ে দিলেন। বিহ্বলতা কাটতে কিছুক্ষণ গেল। তারপর থতমত সুরেই বললেন, রাখব তো, লোকের তো দরকার। কিন্তু তুমি কে কি বৃত্তান্ত না জেনে

অতসী মনকে দৃঢ় করে এনেছে, এনেছে স্নায়ুকে সবল করে। তাই স্পষ্ট গলায় বলে, আমাকে দেখে কি আপনার চোর ডাকাত অথবা খুব খারাপ কিছু মনে হচ্ছে?

না না, খারাপ কেন? সরস্বতী প্রতিমাখানির মত তো চেহারা! তা বলছি না। মানে

মানে ভাববার কিছু নেই। আমি আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি, আমার জন্যে কোন বিপদে পড়তে হবে না আপনাকে।

তা তুমি হঠাৎ এমনভাবে কোথা থেকে

বুঝতেই পারছেন খুব একটা অসুবিধেয় না পড়লে এভাবে মানুষ আসে না। সেইটা মনে করে আমার সম্পর্কে বিচার করবেন।

আঘাত খেয়ে খেয়ে শক্ত হয়ে উঠেছে অতসী, শিখেছে কথা বলতে।

তা বেশ, থাক তবে। আজ থেকেই থাক। রান্নাটান্না জানো তো?

অতসী মৃদুহেসে বলে, চালিয়ে নেবো।

হু, মনে হচ্ছে জানো। তা মাইনে টাইনে

এবার অতসী আরও বুক শক্ত করে ফেলেছে। তাই অবলীলার ভানে বলে, মাইনে লাগবে না, তার বদলে আমার ভার নিতে হবে।

ছেলে!

গিন্নীর মুখটা পাংশু হয়ে যায়। ছেলে আছে?

অতসী শান্ত দৃঢ়স্বরে বলে, হ্যাঁ। ছেলে না থাকলে শুধু নিজের জন্যে কে অপরের দরজায় দাঁড়াতে আসে বলুন? পৃথিবীতে মৃত্যুর উপায়ের অভাব নেই।

গিন্নী আরও থতমত খেয়ে বলেন, কিছু মনে কোর না বাছা, মানে কর্তাকে না জিগ্যেস করে ছেলের বিষয়

তিনি বাড়ি নেই?

আছেন। ওপরে আছেন। বেশ তুমি বোসো, জিগ্যেস করে আসি। কত বড় ছেলে?

ক্লাস সিক্সে পড়ে।

ওমা তাহলে তো বড় ছেলে!

গিন্নী অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেন, দেখে তো তোমায় খুব ভদ্রঘরের মেয়ে বলেই মনে হচ্ছে, এ অবস্থা কত দিন হয়েছে?

অতসী মাথা নীচু করে বলে, ওকথা জিগ্যেস করবেন না।

ভদ্রমহিলা আসলে ভদ্র-প্রকৃতি। এবং অতসীর মধ্যে তিনি সাধারণ রাঁধুনীর ছাপ দেখতে পান নি বলেই আকর্ষিত হলেন। ভাবলেন ঠাকুর মুখপোড়া যদি দেশ থেকে আসে তো একে ঘরের কাজের জন্যে রাখব। বাড়ির মেয়ের মত থাকবে। ছেলেটা? তা ওর মাইনের বদলে তো ছেলেটার ইস্কুলের মাইনে আর খাওয়া দাওয়া একটু বেশি পড়বে বটে–থাক, ভদ্রঘরের মেয়ে বিপাকে পড়েছে।

মিনিট দুই তিন পরেই নেমে এলেন তিনি, বললেন, কর্তার অমত নেই। তাহলে ছেলেকে নিয়ে এসো। কখন আসবে?

এখনই। বলে বেরিয়ে গেল অতসী।

কর্তা গিন্নীর বয়েস হয়েছে। মেয়ে নেই, আছে দুটি বিবাহিত ছেলে। দুটিই বিদেশে কাজ করে, স্ত্রী পুত্র নিয়ে বছরে একবার ছুটিতে আসে। বাকী সময় কর্তা গিন্নী এত বড় বাড়িটায় একাই থাকেন। চাকর বাকর নিয়েই সংসার।

অবস্থা ভাল, তাই সাধারণ নিয়মে গিন্নীর হার্টের অসুখ, বাতের কষ্ট। রান্নার লোক বিহনে দুদিনেই হাঁপিয়ে ওঠেন।

অতসীকে দেখে তার মনটা আশায় উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে। বৌরা চলে গিয়ে পর্যন্ত এমনি ঘরের মেয়ের মত একটি ভদ্র মেয়ে তার কল্পনার জগতে ছিল।

কর্তাও এক কথায় রাজী হয়ে যান। বলেন, নাতিপুতি কেউই তো থাকে না, একটা ছেলে থাকুক পড়ালেখা করুক, ভালই।

আশ্রয় জুটল। নিরাপদ আশ্রয়। ভাল ঘর, সৎ পরিবেশ। আর তবে কিছু চাইবার নেই অতসীর?

গভীর রাত্রে যখন সীতু ঘুমিয়ে পড়েছে, ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় অতসী। হ্যাঁ, দোতলাতেই ঠাই পেয়েছে সে। গিন্নী বলেছেন, নীচে চাকর বাকরের আড্ডা। ওখানে আমি তোমাকে থাকতে দিতে পারব না বাছা, ওপরেই আমাদের ঘরের কাছাকাছি থাকো। সকল ঘর দোরই তো খালি পড়ে।

বারান্দার কোণের দিকের ছোট একটা ঘরে মা ও ছেলে আশ্রয় পেল।

রাত্রে যখন ঘুম আসে না বারান্দায় এসে দাঁড়ায় অতসী। নিজেকে যেন আর সেই হরসুন্দরী বাড়িওয়ালির ভাড়াটের মত দীনহীন মনে হয় না, আর সেই সময় ভাবতে থাকে অতসী, তাহলে আর কিছু চাইবার রইল না তার? এই পরম পাওয়ার ভেলায় চড়ে সমুদ্র পার হবার সাধনা করে চলবে? পৃথিবীর আরও অসংখ্য দুঃখী মেয়ের মত দাসীবৃত্তি করে ছেলেকে কোন রকমে বড় করে তুলবে, তারপর ছেলের উপার্জনের ভাত খেয়ে মনে করবে জীবনের চরম সার্থকতার সন্ধান মিলল তবে? মিলল দীর্ঘ সংগ্রামের পুরস্কার?

জীবনে মৃগাঙ্ক বলে কোনদিন কোনও এক দেবতার দর্শন মিলেছিল সে কথা নিশ্চিহ্ন করে মুছে ফেলতে হবে সমস্ত চেতনা থেকে? আর তুলোর পুতুলের মত সেই একটা জীব যে কোনদিন পৃথিবীতে এসেছিল, একেবারে ভুলে যেতে হবে সে কথা?

আশ্চর্য, তবু বেঁচে থাকবে অতসী। বেঁচে আছে। সহজ সাধারণ মানুষের মত খাচ্ছে ঘুমচ্ছে, নিশ্বাস নিচ্ছে, কথা বলছে, এমনকি হাসছেও।

সেই তুলোর পুতুলটার কোন বার্তা আর কোনদিন জানতে পারবে না।

সে বার্তা নিয়ে যে অতসীর দরজায় দাঁড়াতে এসেছিল একজন, জানতেও পারল না অতসী।

হরসুন্দরী বাড়িওয়ালি অতসীদের খবর খবর করে হাঁপিয়ে মরলেন, অথচ এ বুদ্ধিটুকু মগজে আনতে পারলেন না, সীতুর স্কুলে একবার খোঁজ করে দেখলে হত! অতসীর যে একটা মেয়ে আছে, তার বাড়াবাড়ি অসুখ শুনলে কী করত অতসী সেটা আর দেখা হল না হরসুন্দরী বাড়িওয়ালির।

বেইমান! মহা বেইমান!

ভাবলেন হরসুন্দরী। নইলে এত যে উপকার করলেন তিনি, সে সব ভস্মে গেল। এতটুকু কি একটু বললেন, বড় হয়ে উঠল সেইটাই? একবার কি দেখা করতে আসতে পারত না?

অতসীও স্তব্ধ রাত্রে জনশূন্য রাস্তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবে, সীতু অকৃতজ্ঞ সীতুর মা-ই বা অকৃতজ্ঞতায় কী কম যায়! নইলে শ্যামলীর কাছ থেকেও নিজেকে লুপ্ত করে নিল কি করে? শ্যামলী হরসুন্দরীর বাড়ি জানত, এ বাড়ির সন্ধান পাবার কোন উপায় তার নেই।

কিন্তু চিঠি লিখে ঠিকানা জানাবে অতসী কোন পরিচয় বহন করে?

শিবনাথ গাঙ্গুলীর বাড়ির রাঁধুনী?

.

কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি।

আকাশে নক্ষত্রের সভা। অনেকক্ষণ চেয়ে থাকলে কেমন একটা ভয় ভয় আর মন ঝিমঝিম করা অনুভূতি আসে। তেমনি অনুভূতিতে অনেকক্ষণ নিথর হয়ে থেকে অতসী ভাবে, এমন করে হারিয়ে গিয়ে আবার কোনদিন কি তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোনা যাবে?

ছেলেকে তো দৃঢ়চিত্তে শাসন করেছিল সে সেদিন, মরে যাব কেন? মরে গেলেই তো হেরে যাওয়া হল। তোমাকে মানুষ হতে হবে, মানুষের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর উপযুক্ত হতে হবে।

কিন্তু কবে সেই উপযুক্ততা আসবে সীতুর? আর যখন আসবে, তখন কি তারা অবিকল থাকবে, যাদের সামনে উঁচু মাথা নিয়ে গিয়ে দাঁড়ানোর মূল্য?

যদি তা না হয়, যদি এই হারিয়ে যাওয়া দিন থেকে কূলে উঠে দেখে অতসী, যাদের দেখাবার জন্যে এই কাঁটাবনের সংগ্রাম, তারাই গেছে হারিয়ে? আর সেই পুতুলটা

অসম্ভব একটা যন্ত্রণায় মাথাটা দেওয়ালে ঠুকতে ইচ্ছে করে অতসীর। ইচ্ছে করে খুকু খুকু করে চীৎকার করে কাঁদে। কিছুই করতে পারে না, শুধু স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে ঊর্ধ্বলোকের নক্ষত্রসভায়।

মৃগাঙ্ক কি কোনদিন রাত্রে জেগে থাকেন? তাকিয়ে থাকেন আকাশের দিকে?

কিন্তু যদিই থাকেন? সে খবর জানবার দরকার কি–শিবনাথ গাঙ্গুলীর বাড়ির রাঁধুনীর?

.

বর্ষা যায় শরৎ আসে, গাঙ্গুলীদের মেয়ের মতন রাঁধুনীর দিন কাটে মৃদু মন্থরে। ভারাক্রান্ত, ক্লান্ত ছন্দ, রাঁধার পরে খাওয়া আর খাওয়ার পরে রাঁধার একটানা একঘেয়ে পুনরাবৃত্তি।

কাজের চাপ বেশি থাকলেও বুঝি ছিল ভাল, তাতে তাল উঠত দ্রুত। কিন্তু এঁদের সংসার ছোট, চাহিদা কম, পুরনো চাকর আছে, সে প্রায় সবই করে, অতসীর অনেক অবসর।

কিন্তু সে অবসরকে কাজে লাগাবার সুবিধে কোথায়? অতসী ভাবে, আমি কি আবার লেখাপড়া করব? আমি কি চেষ্টা করে কোথাও সেলাই শিখব? আমি কি আমার আয়ত্তাধীন বিদ্যে পশম বোনাটাকে কাজে লাগিয়ে উপার্জনের চেষ্টা করব? একটা কিছু না করে কি করে কাটাব আমি? আর কতদিন বহন করব এই রাঁধুনীর পরিচয়?

ভাবে, ভেবে ভেবে উত্তাল হয়ে ওঠে তার দিনের অবসর, বিনিদ্র রাত্রি মর্মরিত হয়ে ওঠে সে ভাবনার দীর্ঘশ্বাসে। কিন্তু কিছুই করে উঠতে পারে না। ভয়ঙ্কর এক ভয় গ্রাস করে থাকে তাকে, পথে পা বাড়াতে দেয় না।

এ তো হরসুন্দরীর পাড়ার সর্পিল গলি নয়, এটা বড় রাস্তা। আর জীবনের সম্ভ্রম খুঁজে নিতে পা বাড়াতে হলে তো বড় রাস্তার পথ ধরেই চলতে হবে।

কিন্তু বড় রাস্তায় পা ফেলতে যে সেই দুর্দমনীয় ভয়। যদি কারও সঙ্গে দেখা হয়ে যায়!

দেখা হয়ে গেলে কী হয়? অনেক দিন ভেবেছে অতসী, আর ভাবতে ভাবতে খেই হারিয়ে ফেলেছে। কী হয়, সেটা আর সম্পূর্ণ একটা ছবিতে পরিণত করতে পারে নি।

খেই হারাতে হারাতে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে তার অতীত জীবন। শ্লেট পাথরের মত একটা বিবর্ণ ভারী ভারী অনুভূতি ছাড়া সবই যেন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। ভুলে যাচ্ছে এ বাড়ির রাঁধুনী ছাড়া আর কোন পরিচয় অতসীর ছিল।

তা এমন অতীত হারানো বিস্মৃতির কুয়াশা অনেক মেয়ের জীবনেই তো ক্রমশ পাকা বনেদ নিয়ে বসে। বিদেশে বাসায় রাজার হালে কাটাতে কাটাতে হঠাৎ ওঠে কালবৈশাখীর ঝড়, তচনচ করে উড়িয়ে নিয়ে যায় পাখীর বাসাটুকু, ভাগ্যহতের পরিচয় সর্বাঙ্গে বহন করে এসে আশ্রয় নিতে হয় তাদের কাছে, যারা এযাবৎ তার সুখসৌভাগ্যে আনন্দের থেকে ঈর্ষা অনুভব করেছে বেশি। সেখানে গৃহকর্মের সমস্ত দায় মাথায় নিয়ে সেই মেয়েকে টিকে থাকতে হয় সংসার নামক বৃক্ষের শাখায়। যদি তাকে টিকে থাকাই বলা হয়।

তখন সেই দাস্যবৃত্তির অন্তরালে কোনও দিন কি কখনো মনে পড়ে তার একদা অনেক সুখ তার হাতের মুঠোয় ছিল?

ভুলে যায়! অতসীও ক্রমশ ভুলছে। ভুলছে বললে ঠিক বলা হয় না, মনে আনার চেষ্টাই। করছে না। কেন করবে, অতসীকে তো তার ভাগ্য প্রত্যক্ষ আঘাত হানে নি। আপাতদৃষ্টিতে তো দেখলে মনে হয় অতসী নিজেই হাতের মুঠো আলগা করে ছড়িয়ে ফেলে দিয়েছে তার সুখ, তার জীবন।

তাই অতসীর অনেক ভয়। ভয়, যদি পথে বেরিয়ে হঠাৎ মুখোমুখি হয়ে যেতে হয় সেই অনেক সুখের অতীত জীবনের সঙ্গে?

কিন্তু অতসী কি বুঝতে পারে সীতুও আজকাল ওই এক রোগে ভুগছে। ওই ভয় রোগে। যদি কারও সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। এই আতঙ্কে সীতু স্কুলে যায় আসে প্রায় চোখ বুজে।

না, অতসী জানে না।

সে দিনের সে কথা সীতু অতসীকে বলে নি। তা কবে আর কোনও কথা মার কাছে বলে সীতু? তাই সেদিন বলবে পথে কী ভয়ানক ঘটনা ঘটেছিল? সেদিন সীতু শুধু আরক্ত মুখ আর ভয়ঙ্কর ওঠা পড়া বুক নিয়ে ছুটে এসেছিল। আর অতসীর ব্যাকুল প্রশ্নে বলেছিল রাস্তায় পড়ে গেছি।

অতসী কি করে জানবে সেদিন স্কুল থেকে বেরিয়ে মোড় পার হবার মুহূর্তে সীতুর পাশ দিয়ে ধাঁ করে বেরিয়ে গিয়েছিল একখানা ভয়ঙ্কর পরিচিত মোটরগাড়ি। আর তার চালকের আসনে যে বসেছিল সে সীতুর দিকে চোখ ফেলে নি বলেই এ যাত্রা রক্ষা পেয়েছিল সীতু।

হ্যাঁ, সে লোকটার এদিক ওদিক কোনদিকেই যেন দৃষ্টি ছিল না। গাড়িটা চোখের সামনে দিয়ে চলে যাওয়া সত্ত্বেও অনেকক্ষণ পর্যন্ত যেন বিশ্বাস হয়নি সীতুর, যা দেখল সত্যি কিনা, অথচ ভেবে দেখলে সত্যি হওয়াটা কিছুই আশ্চর্য নয়।

আশ্চর্য নয়, তবু বজ্রাহতের মত দাঁড়িয়ে রইল মিনিটের পর মিনিট।

ও যে কোথায় ছিল, কোথায় যাচ্ছিল, সবই যেন বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল সেই অদ্ভুত মুহূর্তগুলিতে।

চেতনার জগতে ফিরে এল ঘাড়ের ওপর একখানা ভারী হাতের থাবার চাপে আর একটা দুর্বোধ্য চীৎকারে

চমকে পিছন ফিরে কাঠ হয়ে গেল সীতু।

হরসুন্দরী বাড়িওয়ালি!

তীব্রস্বরে চেঁচাচ্ছেন, ও সর্বনেশে ছেলে, এখনো তোরা এ তল্লাটেই আছিস? আর আমি

আঃ লাগছে, ছেড়ে দিন–

সীতু কঁধটায় ঝাঁকুনি দিয়ে সেই ভারী খাবার কবলমুক্ত হতে চেষ্টা করে। কিন্তু থাবাটি বড় শক্ত ঘাঁটি। তাছাড়া হরসুন্দরী তখন রাগে দুঃখে আবেগে উত্তেজনায় মরীয়া। তিনি বরং আরও শক্ত করে চেপে বলেন, এইখানেই আছিস! এখনো এই স্কুলেই পড়িস! ওমা আমার যে মাথা খুঁড়ে মরতে ইচ্ছে করছে গো! অতবড় একটা মান্যিমান লোক রোজ আসছে আমার দরজায় তাদের তল্লাস নিতে, রোজ আমি লজ্জায় অধোমুখ হয়ে যাচ্ছি, দিতে পারছি না একটা খবর। বলি কী ব্যাপার তোদের? অতবড় গাড়ি চড়ে অমন মানুষটা হ্যাং হ্যাং করতে করতে আসে তোদের মা বেটার খবর নিতে, আর তোরা ঘাপটি মেরে বসে আছিস এখানেই? হা আমার কপাল! বলি তোর মার এত তেজ কেন বল তো?

চুপ করুন। আপনাকে মার কথা বলতে হবে না।

না, তা তো হবেই না। যেমন তুমি আর তেমনি তোমার মা! এদের জন্যে আবার মানুষ খবর খবর করে খুঁজে বেড়ায়! আমি হলে তো

সীতু হঠাৎ কেমন একটু শিথিল ভাবে বলে, কে খুঁজতে আসে?

কে তা তোমরাই জানো। তোমার মামা-দাদা কি জ্যাঠা-খুড়ো। হোমরাচোমরা চেহারা, তাই দেখি। এই নিত্যদিন আসছে খবর আছে কিনা।

আমিও আজ শুনিয়ে দিয়েছি, তারা খবর দেবার লোক নয় মশাই, বেইমানের ঝাড়। মিথ্যে আপনি আশা করছেন। যে মেয়েমানুষ কোলের কচি মেয়ে ফেলে তেজ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে–

ছেড়ে দিন। কাঁধ ছাড়িয়ে পথে নামে সীতু।

আর হরসুন্দরী তীক্ষ্ণ কণ্ঠে অনেক বিষাক্ত রস মিশিয়ে চেঁচিয়ে বলে ওঠেন, এই শোন ছোঁড়া, শুনে যা। সেই আহাম্মক লোকটা বলে গেছে যদি তোদের সঙ্গে দেখা হয় তো–যেন জানাই তোর মার কোলের সেই কচিটার মরণবাঁচন অসুখ, বুঝলি? যায় যায় অবস্থা! বাড়িতে দিন দশটা করে ডাক্তার আসছে!

প্রতিহিংসা চরিতার্থের বিষাক্ত আনন্দে হাঁপাতে থাকেন হরসুন্দরী। আর সীতু? সে যেন হঠাৎ স্থাণু হয়ে যায়। ভুলে যায় সে পুতুল নয়। কিছু না হোক নিঃশ্বাস ফেলাও তার একটা ডিউটি।

যখন চেতনা ফেরে, দেখে অনেক দুরে হরসুন্দরীর পিঠের চাদরটা শুধু দেখা যাচ্ছে।

সীতু কি ছুটে যাবে? ছুটে গিয়ে চীৎকার করে বলবে, কী অসুখ হয়েছে সেই খুকুটার? বল শীগগির!

না, সীতু ছুটে যেতে পারে না। বলতে পারে না।

শুধু তার সমস্ত প্রাণ আছড়াপিছড়ি খেতে থাকে সেই প্রশ্নটার ওপর।

কী অসুখ হয়েছে সেই খুকুটার? বল শীগগির!

তবু অতখানি যন্ত্রণার ভার নিজের মধ্যে সংহত রেখেছিল সে। বাড়ি এসে বলেছিল রাস্তায় পড়ে গেছি।

কিন্তু মাকে যা হোক বলে বোঝানো যত সহজ, নিজেকে বোঝানো কি তত সহজ? প্রত্যেকটি মুহূর্ত যে ছুঁচের মত ফুটিয়ে ফুটিয়ে একটা কথা উচ্চারণ করছে–সেটা মরণবাঁচন অসুখ!

তুলোর পুতুলের মত গোলগাল খ্যঁদা খ্যাঁদা সেই ছোট্ট মানুষটারও ওই রকম ভয়ানক বিচ্ছিরি অসুখ করতে পারে? হরসুন্দরী যাকে বলেন মরণবাঁচন।

আর যদি শেষের কথাটা আর না থাকে?

শুধু প্রথম কথাটাই

শিউরে কেঁপে ওঠে সীতু, আর ভাবতে পারে না। সেই বিশেষ একটি রাস্তার উপরকার বিশেষ একখানি বাড়ি তীব্র একটা আকর্ষণে অহরহ টানতে থাকে চির-নির্মম চির-উদাসীন একটা বালক চিত্তকে। অথচ পথে বেরুতে তার ভয় করে পাছে দেখা হয়ে যায় কারও সঙ্গে। এ এক আশ্চর্য রহস্য!

সীতু কি স্বপ্নে কোন মন্তর পেয়ে যেতে পারে না যাতে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া যায়, আর উড়ে চলে যেতে পারা যায়–যেখানে ইচ্ছে?

রোজ রাত্রে ঘুমের আগে কাতর প্রার্থনা করে সীতু–যে ভগবানকে মানে না সেই ভগবানের কাছে। প্রার্থনা করে যেন সেই অলৌকিক স্বপ্ন দেখে, যাতে এক জটাজুটধারী সন্ন্যাসী এসে মৃদু হেসে বলছেন, বর চাস? কী বর?

হায়, প্রতিটি সকাল আসে ব্যর্থতা বহন করে। সীতুর জ্ঞানের জগতে যত কটুক্তি আছে, সমস্ত বর্ষণ করে সে অক্ষম ভগবানের উপর। অথচ আবার ঘুরে ফিরে সেই অলৌকিকের কথাই ভাবতে থাকে।

ধরো, পথ চলতে চলতে পায়ের কাছে কুড়িয়ে পেল সীতু একটা শিকড়, সেটা কুড়িয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অদৃশ্য হয়ে গেল সে, আর উড়তে আরম্ভ করল।

তারপর?

তারপর

সেই একখানি ঘরের একটি বিশেষ জানালার বাইরে ঘন্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে এক অদৃশ্যদেহী বালক, বিস্ফারিত দৃষ্টি মেলে।

ঘরের মধ্যে দশটা ডাক্তার ঘুরে বেড়ায়, ফিসফিসিয়ে কী যেন বলাবলি করে, বুকের মধ্যেটা ঠাণ্ডা হয়ে আসে ওই ছেলেটার।

ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে দেখে সেই পুতুলটা কোথায়?

ছোট্ট খাটের মধ্যে লেপ চাপা দিয়ে শুয়ে প্রবল জ্বরে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে? নাকি নিঃশ্বাস আর কোনদিন ফেলবে না সে?

.

হঠাৎ কেঁদে ওঠা ঘুমন্ত ছেলেকে ষাট ষাট করে ভোলায় অতসী, বলে, জল খাবি সীতু? গরম হচ্ছে সীতু? খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস সীতু?

সীতু আর সাড়া দেয় না। শুধু মায়ের হাতটা আঁকড়ে ধরে।

অতসী স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। অস্বাভাবিক সীতুর মধ্যে কি তাহলে তীব্র কোনও মানসিক ব্যাধির সৃষ্টি হচ্ছে?

সকালবেলা মনিবগিন্নী প্রশ্ন করেন, রাত্তিরে ছেলে কেন কেঁদে উঠেছিল সীতুর মা?

অতসী ম্লান ভাবে বলে, স্বপ্ন দেখে মা!

হ্যাঁ, আর মাসীমা নয়, মা।

শ্রদ্ধার ডাক, ভালবাসার ডাক, আবার প্রভুভৃত্যের চরম মামুলি ডাক। তবু মা বলতেই হয়। মনিবগিন্নীর তাই বাসনা।

মাসীমা কেন গো? মা বলবে। আমার মেয়ে নেই। বলেছিলেন তিনি।

মেয়ে নেই তাই তো মেয়ের মতন। তাই তো অতসীরও এ এক পরম বন্ধন।

.

স্বপ্ন দেখে? মনিবগিন্নী বলেন, পেট গরম হয়েছে। একটু মৌরীমিশ্রীর জল করে খাইয়ে দিও দিকি, ঠাণ্ডা হবে।

সরল মানুষ এর চাইতে বেশি কিছু জানেন না, বোঝেনও না। সত্যিই ভারি সরল।

আজ সকালে কিন্তু তার কথাতেও একটু অসারল্যের ছোঁয়াচ লাগল। অতসীকে ডেকে বললেন, শুনেছ অতসী, আমার ব্যাটা, ব্যাটার বৌ যে দয়া করে গরীবের কুঁড়েয় পদার্পণ করতে আসছেন।

অতসী ঈষৎ বিস্মিত হয়। আনন্দের বদলে এমন সুর কেন?

তবে সে সহজভাবেই বলে, পূজোর ছুটি হয়েছে বুঝি?

হ্যাঁ তাই লিখেছিলেন বাবু! পূজোর আগেই বেরুচ্ছি, দিন পনের ছুটি বাড়িয়ে নিয়েছি। তা তোমায় মিথ্যে বলব না অতসী, বউ আমার মন্দ নয়, মতি বুদ্ধি ভালই ছিল। কিন্তু কথায় আছে, সঙ্গদোষে শত গুণ নাশে। তোমার কাছে তো সব কথাই বলি–আমার ওই ছেলেটিই যেন বিলেতের সাহেব! যত ফ্যাসান, তত ফি কথায় নাকবাঁকানি! ওর সঙ্গে পড়ে বউও

অতসী শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকায়। কি জানি আবার কোন ঝড় ওঠে! কে জানে এই স্তিমিত নিস্তরঙ্গতার উপর সে ঝড় কোন তরঙ্গ তুলবে! যে ছেলে বিলেতের সাহেবটি, সে কি বরদাস্ত করবে রাঁধুনী আর রাঁধুনীর ছেলের উপর তার মায়ের এই স্নেহাতিশয্য?

আর সেই বউ? সঙ্গদোষে যার শতগুণ নাশ হয়েছে? বউ-জাতীয়াকে বড় ভয় অতসীর। যদি সুরেশ্বরীর ছেলের বৌয়ের মত হয়?

কবে আসবেন?

কবে কি গো, আজই। মনিবগিন্নী স্বভাবছাড়া একটু ব্যঙ্গহাসি হাসেন, ট্রাঙ্ককলের টেলিফোন জানো? তাই করে খবর দিল যে এক্ষুনি। আমার ছেলের কোন কিছুতেই দিশিয়ানী নেই। দুদিন আগে খবর দেবে না। পথে বেরিয়ে কোন ইস্টিশন থেকে টেলিফোন করবে। বললে বলে, নিজের বাড়িতে আসব তার আবার খবর কি! কিন্তু শুনতেই ওই নিজের বাড়ি। এক মাসের ছুটি তো কুড়ি দিন শ্বশুরবাড়িতেই কাটাবে।

ছেলে বৌয়ের সম্পর্কে অনেকগুলি তথ্য পরিবেশন করে ফেলেন ভদ্রমহিলা।

.

অতসী আর কি করবে? সমস্ত রকম অবস্থার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত রাখা ছাড়া? ওঁর বৌ ছেলে যদি রাঁধুনী আর রাঁধুনীর ছেলেকে নিজেদের পাশাপাশি সহ্য করতে না পারে, যদি নীচে নামিয়ে দেয়, তাও মেনে নিতে হবে বইকি।

নীচের তলায় নামাটা তো কিছু নয়, অন্য সব চাকরবাকরদের চোখে অনেক নেমে যাওয়া এই যা! তবু তাই যেতে হবে। সেইটাই তো প্রস্তুতির সাধনা।

শুধু সীতু? বিরাট একটা জিজ্ঞাসার চিহ্ন।

.

কিন্তু অতসীর আশঙ্কা অমূলক।

ওরা ও রকম নয়।

অতসী দোতলায় কেন আছে, বা একতলায় কেন থাকবে না, এ নিয়ে মাথা ঘামাল না ওরা।

ট্রেন থেকে নেমেই স্নান সেরে বাপের বাড়ি যাবার জন্যে প্রস্তুত হতে হতে বৌ বলল, মা আপনার ঘরের পাশে ওই ছোট ঘরটায় কাকে যেন দেখলাম? কেউ এসেছেন নাকি?

মা বলে ওঠেন, ওটি আমার একটি কুড়নো মেয়ে বৌমা! ঈশ্বর-প্রেরিত। ঠাকুর দেশে চলে যাওয়ায় যখন অসুবিধেয় মরছি, তখন হঠাৎ একদিন

বৌ কথায় যবনিকাপাত করে বলে, ওঃ রান্নার লোক? তা দেখতে তো বেশ পরিচ্ছন্ন, নেহাৎ লো ক্লাস বলে মনে হল না।

অতসী পাশের ঘর দিয়ে যাচ্ছিল। দেয়ালটা ধরল। শুনতে পেল না তারপর আর কি কথা হল। সচেতন হল তখন, যখন বৌ ব্যস্তভাবে এদিকে যেতে যেতে অতসীকে দেখে বলে উঠল, আচ্ছা ওই ছেলেটি তোমার তো?

অতসী মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

বৌ দালানে টাঙানো আরশিটার সামনে তাকিয়ে বেশবাসে দ্রুত আর একটি সমাপ্তি স্পর্শ দিতে দিতে বলল, ওকে আমার সঙ্গে আমার বাপের বাড়িতে নিয়ে যাব?

আপনার বাপের বাড়িতে! অতসী অবাক হয়। অতসী কারণ নির্ণয় করতে পারে না। অতসী দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বলে, ছেলেটা বড্ড লাজুক, যেতে চাইবে কি?

চাইবে না?

সভ্য তরুণী আর জোর করে না, বলে তবে থাক। গেলে একটু সুবিধে হত। ওখান থেকে বেবিকে ধরার লোকটিকে আনতে পারি নি, বেচারার অসুখ করেছে। এই ঠিক তোমার ছেলের মতই ছেলে। তাই ভাবছিলাম ওকে পেলে হয়তো–যাকগে আমার বাপের বাড়িতে তো লোজনের অভাব নেই। তবে যেত, ভাল ভাল খেত, খেলত

হঠাৎ অতসী দৃঢ়স্বরে বলে, আচ্ছা দাঁড়ান আমি বলছি।

ঘরে গিয়ে তেমনি দৃঢ় স্বরেই বলে, সীতু ওই যিনি এসেছেন, ওর সঙ্গে ওর বাপের বাড়ি যেতে হবে তোমায়।

সীতু এ আদেশের মর্ম ঠিক ধরতে পারে না, থতমত খেয়ে বলে, কেন, আমি লোকেদের বাপের বাড়িতে যেতে যাব কেন?

অতসী আরও দৃঢ়স্বরে বলে, কেন যাবে শুনবে? ওর সঙ্গে ওর ওই বাচ্চাটিকে কোলে করে বেড়াতে।

ইস! সীতু তীব্রকণ্ঠে বলে, টিকটিকির মত ওই মেয়েটাকে আমি কোলে নেব বইকি! ছুঁতেই ঘেন্না করে।

চুপ! এসব কথা মুখে আনবে না। যাও ওই আলনা থেকে জামা পেড়ে পরে চলে যাও ওঁর সঙ্গে, সেখানে খেতে পাবে। খুব ভালো ভালোবুঝলে, যাও ওঠ।

মায়ের এই নিষ্ঠুরতায় কঠিন কঠোর সীতুর বুঝি চোখে জল এসে যায়। লাল লাল মুখে বলে, না যাব না। আমি কি চাকর?

অতসী হঠাৎ ফেটে পড়ে।

চাপা গর্জনে বলে ওঠে, হ্যাঁ তাই। বুঝতে পারো নি এতদিন? টের পাও নি চাকর হওয়াই তোমার বিধিলিপি! আমি হুকুম করছি চাকরই হওগে। যাও ওঁর সঙ্গে, সারাদিন ওঁর মেয়ে কোলে নিয়ে বেড়াওগে। ওরা যদি উঠোনের ধারে খেতে বসতে দেয় মাথা হেঁট করে তাই খাবে, একটি কথা বলবে না। যাওযাও বলছি। অপেক্ষা করছেন উনি। কী, তবু বসে রইলে? পেড়ে আনো জামা

মাটিতে বসে পড়ে অতসী। হাঁপাতে থাকে।

আর সীতুর চোখের সামনে বুঝি সমস্ত পৃথিবী ঝাপসা হয়ে আসে। মার ওই বসে পড়া চেহারাটার দিকে তাকাতে সাহস হয় না। উদভ্রান্তের মত আলনা থেকে শার্টটা পেড়ে গায়ে গলাতে গলাতে নীচে নেমে যায়। গিয়ে দাঁড়ায় বাইরে গাড়ির কাছে। যে গাড়ি বৌকে নিতে এসেছে তার পিতৃগৃহ থেকে।

বৌ বোধকরি হাতে চাঁদ পায়, হৃষ্টচিত্তে বলে, ও তুমি যাচ্ছ? এসো, গাড়িতে উঠে এসো।

সত্যিই গাড়িতে উঠে বসে সীতু।

কিন্তু সে কি সত্যিই সীতু? নাকি কোন যন্ত্রচালিত পুতুল?

.

বৌ ওর কোলে নাইলনের ফ্রক পরা সেই টিকটিকি বিশেষণপ্রাপ্ত শিশুটিকে গুছিয়ে বসিয়ে দিয়ে বলে, নাও বেশ ভাল করে ধরো। ফেলে দিও না যেন।

না, সীতু ফেলে দেবে না।

কিন্তু সেই কাঠির মুঠি মেয়েটাই প্রবল আপত্তি তুলে সীতুকে তচনচ করে দেয়। অচেনা কোল বলে? নাকি শিশু বোঝে অনাগ্রহের অনুত্তাপ?

এই দেখো, তুমি যে সামলাতেই পারছ না? বৌ রেগে ওঠে না, হেসে ওঠে। সহজভাবে বলে, ভাল করে ধরতে পারছ না কিনা, তাই মহারাণীর মেজাজ গরম হয়ে উঠেছে। তোমার তো কোন ছোট ভাই বোন নেই, তাই অভ্যাস নেই। দাও আমায়, কী রে দুষ্ট, বাহন পছন্দ হল না?

মেয়েকে কোলে করে ভোলাতে ভোলাতে শান্ত করে বলে সে, চিনে যাবে। দুদিনেই চিনে যাবে। দেখো তখন তোমাকে ছাড়তেই চাইবে না। তুমি যে আবার স্কুলে পড় শুনলাম। তাছাড়া তোমার মার তুমি এক ছেলে, মা নিশ্চয় ছাড়তে রাজী হবে না। নইলে তোমায় আমার সঙ্গে আমার কাছে নিয়ে যেতাম। ঠিক এই রকম একটি কমবয়সী বাঙালীর ছেলেই খুঁজছি আমি।

.

সীতু কি রূঢ়কণ্ঠে প্রতিবাদ করে উঠল? তীব্র চীৎকারে প্রশ্ন করে উঠল, আমায় কী ভেবেছ তুমি? আমি চাকর?

না, ওসব কিছু করল না সীতু। ওসব কথা বোধকরি ওর কানেও ঢোকে নি। ও গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে তাকিয়ে আছে বিস্ময়বিস্ফারিত নেত্রে।

এ কী!

এ কোথায় আসছে সে?

এই শিবমন্দির কোন পাড়ার? ওই গম্বুজ দেওয়া লাল বাড়িটা কোন রাস্তায়? নীল কাঁচের জানলা বসানো ওই ফোটো তোলার দোকানটা? আর ওই সিনেমাবাড়িটা? গাড়ি দ্রুত পার হতে থাকে আর সীতুর সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করতে থাকে।

একবার দরদর করে ঘাম ঝরেছিল, এখন একটা শুকনো দাহ।

বুঝতে পেরেছে সীতু, বুঝতে পেরেছে এবার।

এ সমস্তই ষড়যন্ত্র। ওই বৌটার বাপের বাড়ি যাওয়াটাওয়া সব বাজে, সীতুকে ভুল বুঝিয়ে ফন্দী ফিকির করে সেইখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যেখানকার লোক রোজ এতবড় মোটর হাঁকিয়ে হরসুন্দরী বাড়িওয়ালির বাড়ি যায় সীতুকে খুঁজতে!

আগে থেকেই তাহলে তৈরি হয়ে আছে এই সব ব্যাপার। আর মা? সীতুর মা?

সন্দেহ নেই তিনিও এই ষড়যন্ত্রের মধ্যে আছেন। আর সীতু এমন বোকা যে তাতেই ভুলে

উঃ!

মা নিজে যেতে পারলেন না, বেচারী সীতুর ওপর দিয়েই

ওঃ, ওঃ এই তো এসে গেছে…পার্কের রেলিঙ দেখা যাচ্ছে। পার্কটা পার হলেই

সীতু জানলা থেকে মুখ ফিরিয়ে তীব্র প্রশ্ন করে, এটা কোন রাস্তা? আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?

এ প্রশ্নে গাড়ির চালক পর্যন্ত ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। বৌ অবাক হয়ে বলে, কেন, আমার বাপের বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। সব্যসাচী রোডে যাব। কেন, তোমার মা বলে নি?

কিন্তু ততক্ষণে স্তিমিত হয়ে গেছে সীতু, ততক্ষণে সন্দেহ সরে গেছে তার।

গাড়িটা পার হয়ে গেছে ভয়ঙ্কর একটা ভয়ের জায়গা।

আতঙ্কটা ঘুচল। কিন্তু আশা? যে আশা শিশুমনের অজ্ঞাত অবচেতনে জন্ম নিচ্ছিল পরিচিত পথের ছলনায়?

.

এ রাস্তা তুমি চেনো?

সীতু মাথা নেড়ে বলে না।

.

গাড়ি নির্দিষ্ট জায়গায় থামে। বাড়ির মধ্যে ঢুকতে না ঢুকতেই অনেক ছোট বড় মাঝারি বয়সের মেয়ে পুরুষ এসে কলকন্ঠে সম্ভাষণ জানায়, একটি মধ্যবয়সী মহিলা সীতুর দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে বলেই ফেলেন, এটি কে রে ছন্দা?

এতক্ষণে সীতু জানতে পারে বৌটার নাম ছন্দা।

ছন্দা ওর দিকে একটি স্নেহদৃষ্টি ফেলে বলে, এ? এ হচ্ছে আমার শ্বশুরবাড়ির নতুন বামুন দিদির ছেলে! বেবির চাকরটাকে নিয়ে আসি নি বলে ভাবলাম ওকেই বরং

গরম সীসে কানে ঢেলে দিলে কি কানে এর চাইতে দাহ হয়?

মধ্যবয়সী মহিলাটিও সস্মিত কণ্ঠে বলেন খাসা ছেলেটি! তোর শাশুড়ী জোটায়ও বেশ। বুড়োবুড়ি একা থাকে, এ বেশ নাতির মত–

ছন্দা হেসে ওঠে, ওমা, সে আর বোলো না! আমার শাশুড়ীর তো এমন ব্যবস্থা, নাতি কোথায় লাগে! দোতলার ঘর, খাট বিছানা, মশারি টেবিলফ্যান, পড়ার টেবিল চেয়ার

কথা শেষ হয় না, সমবেত হাস্যরোলে চাপা পড়ে যায়।

বামুনদি আর বামুনদির ছেলের জন্য এ হেন অভিনব ব্যবস্থা রীতিমত হাস্যকর বৈকি। বামুনদির মনিবগিন্নীর পাগলামীর পরাকাষ্ঠা!

সীতু কি সকলের অলক্ষ্যে কোন এক সময় এই কুৎসিত কদর্য বাড়িটা থেকে বেরিয়ে যাবে?

কিন্তু এরা কি খারাপ?

এরা কি হৃদয়হীন? তা তো নয়।

ছন্দার মার এবার মেয়ের দিক থেকে নাতনীর দিকে মন যায়, হাত বাড়িয়ে কোলে নিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু নাতনী তারস্বরে আপত্তি জানায়। অনেক ভুলিয়ে কোলে নিয়েই ভদ্রমহিলা যেন শিউরে ওঠেন, ওমা, মেয়ের সমস্ত শরীরটুকুই যে হাড়! কী মেয়ে, কী করে ফেলেছিস ছন্দা?

ছন্দা মলিনভাবে বলে, কত বড় অসুখে ভুগল তা বল? লিখেছিলাম তো সবই। একেবারে–যায় যায় অবস্থা হয়েছিল।

যায় যায় অবস্থা!

যায় যায় অবস্থা! সীতুর প্রত্যেকটি লোমকূপের মধ্যে থেকে কি ওই নতুন শেখা শব্দটা উঠছে?

যায় যায় অবস্থা!

ছন্দা তখনো বলে চলে, একদিন তো আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। পাড়ার সবাই আমায় বলতে লাগল, বেঁচে উঠেছে নেহাৎ তোমার কপালজোরে।

দিদিমা নাতনীর গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, বোশেখ মাসে স্বপ্ন তোর ওখান থেকে বেড়িয়ে এসে তো আহ্বাদে কুটিকুটি, বলে, মা, দিদির মেয়েটা হয়েছে যেন মাখনের পুতুল! আর তেমনি হাসিখুশী ।

হাসি-খুশী ততক্ষণে সানাই বাঁশী বাজাতে সুরু করেছে।

দিদিমা বিরক্ত চিত্তে বলেন, বাবা, আমার কাছে জন্মাল, মানুষ হল, এখন আমাকে একেবারে ভুল?

ছন্দা মেয়ে কোলে নিয়ে অপ্রতিভভাবে বলে, অসুখ করে পর্যন্ত ওই রকম মেজাজী হয়ে উঠেছে। এই তো ছেলেটাকে আনলাম, তা গেলে তো ওর কাছে! কি যেন তোমার নাম থোকা? সীতু না কি? সীতানাথ না সীতারাম?

বলাবাহুল্য উত্তর পাওয়া তার ভাগ্যে ঘটে না।

ছন্দার মা বলেন, বড্ড দেখছি মুখচোরা। যাও খোকা, ওদিকে বাইরের বারান্দায় বোসোগে।

বাইরের বারান্দা! মুক্তির আহ্বান বহে আনছে কথাটা।

ছন্দার অনেকখানি সময় কেটে যায় অনেক কথায় অনেক হুল্লোড়ে। স্বপ্না এসেছে, এসেছে স্বপ্নার বর। খুশীর স্রোত বইছে।

হঠাৎ এই স্বচ্ছন্দ স্রোতে ঢিল পড়ে। ছন্দার মা এসে উদ্বিগ্ন প্রশ্ন করেন, তোর সঙ্গে যে ছেলেটি এসেছিল, কোথায় গেল বল দিকি? দেখতে পাচ্ছি না তো? গণেশকে দিয়ে খেতে ডাকতে পাঠালাম, বলছে বাইরে দাওয়ায় নেই। রাস্তায়ও নেই–

.

কিন্তু সত্যিই কি সীতু রাস্তায়ও নেই?

আছে। রাস্তাতেই আছে সীতু। নেশাচ্ছন্নের মত পথ চলেছে। তার চোখের সামনে শুধু বারেবারে ছায়া ফেলে ফেলে যাচ্ছে একটা তুলোর পুতুলের ধ্বংসাবশেষ! যায় যায় অবস্থা হয়ে যে নাকি টিকটিকির মত হয়ে গেছে!

মূর্তিটা ঠিক গড়তে পারছে না সীতু, কি রকম যেন হারিয়ে যাচ্ছে ছড়িয়ে যাচ্ছে। তার পিছনে একটা ভীষণদর্শন দাঁতাল জন্তু উঁকি মেরে মেরে বলছে, ওরকম হলে বেঁচে যায় শুধু মায়ের কপালজোরে, বুঝলি?

কিন্তু যার মা নেই? অবহেলায় ফেলে চলে গেছে?

সীতু কি জমাদারের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠবে?

কিন্তু তারপর?

অদৃশ্য হয়ে যাবার শিকড় কই তার? কই আর কুড়িয়ে পেল সে বস্তু? তবে?

সীতু কি নীচু হবে? ছোট হবে? বলবে একবার শুধু খুকুকে—

ওরা যদি সকলে মিলে হেসে ওঠে? বামুনদি, নেপবাহাদুর, বাসনমাজা সেই ঝিটা?

সীতু কি তাহলে সোজা মাথা তুলে সেই মানুষটার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে? স্পষ্ট গলায় বলবে, তুমি আমাদের খুঁজতে গিয়েছিলে কেন? বলবে, খুকুর কি এখনো যায় যায় অবস্থা?

কিন্তু সেই মানুষটা যদি ভয়ঙ্কর লাল চোখে তাকায়? যদি ভারী ভারী গলায় বলে, খুকু নেই।

.

টেলিফোন ঝনঝনিয়ে ওঠে শিবনাথ গাঙ্গুলীর বাড়ি।

গিন্নী যথারীতি বলে ওঠেন, অ অতসী, দেখ তো মা কে ডাকে–

কিন্তু ততক্ষণে গিন্নীর পুত্ররত্ন কর্মভার হাতে তুলে নিয়েছেন। আর পরক্ষণ থেকেই তার কণ্ঠযন্ত্র লহরে হরে ঝঙ্কার তুলতে সুরু করেছে।

অ্যাঁ! বল কি? কতক্ষণ?…আঃ কী মুশকিল, তোমারও যেমন কাণ্ড! চেনো না জানো না, কী নেচারের ছেলে না খোঁজ করেই

ছেলে!

অতসী দরজার বাইরে আটকে যায়। তার সমস্ত ইন্দ্রিয়ের শক্তি বুঝি শ্রবণেন্দ্রিয়ে এসে ভিড় করে। কে কোথা থেকে খবর দিচ্ছে? কার ছেলের কথা বলছে? কী হয়েছে তার?

এদিকে তারযন্ত্র আর কণ্ঠযন্ত্র পাল্লা চালিয়ে যাচ্ছে….আচ্ছা আমি এখুনি যাচ্ছি। যাচ্ছিলামই কি বলছ? বিপদ? তা ইচ্ছে করে বিপদকে ডেকে আনলে সে আসবে বইকি!… কী বললে? গাড়ি চাপা? না না, অতদূর ভাববার দরকার নেই। তোমার কল্পনাশক্তি দূরপ্রসারী বটে। আমার মনে হচ্ছে এখানে পালিয়ে এসেছে।

এখানে!

তাহলে আর সন্দেহের অবকাশ নেই অতসীর, কোন ছেলের কথা হচ্ছে।

কী হল? বাসে ট্রামে চড়তে জানে না? হুঃ, কলকাতার এই সব বামুন চাকর ক্লাসের ছেলেদের তো চেনো না! ওরা সাত বছর বয়স থেকে পাকা হয়ে ওঠে। আমি বলছি অত উতলা হবার কিছু নেই। ঠিক শুনবে দিব্যি বিকশিত দন্তে বিড়ি খেতে খেতে এখানে এসে হাজির হয়েছে।..যাক আমি যাচ্ছি। তোমার যখন দায়িত্ব।

অতসী কি ছুটে গিয়ে রিসিভারটা কেড়ে নেবে ওই হৃদয়হীন লোকটার হাত থেকে? নাকি দুড়দুড়িয়ে নেমে গিয়ে ছুটে বেরিয়ে যাবে রাস্তায়?

কিন্তু তারপর?

মনিবগিন্নীর বেহাইবাড়ি কোন রাস্তায় সে কথা কি জেনে নিয়েছে অতসী? ভাগ্যের নিষ্ঠুরতায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে চরম নিষ্ঠুরতার আঘাত হেনেছে সে সেই অবোধ অভিমানী বালকচিত্তের উপর। আর কিছু করে নি। এখন অতসী ছেলে ছেলে বলে উভ্রান্ত হলে ভগবান সূকুটি করবেন না?

ফোন কে করছে রে খোকা? অতসীর মনিবানী এগিয়ে আসেন, বৌমা বুঝি?

হ্যাঁ, যত সব ঝামেলা! খোকা ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, তোমাদের যেমন কাণ্ড! বুদ্ধিসুদ্ধি যদি কোন কালে হবে! খামোকা তোমার রাঁধুনীর না কার ছেলেকে ওদের ওখানে পাঠাবার কী ছিল? সে ছেলে নাকি ওখান থেকে হাওয়া!

ওমা সে কি! চোখ কপালে তোলেন ভদ্রমহিলা, ওখানে অচেনা পাড়ায় একা একা সে আবার কোথায় যাবে?

কোথায় যাবে তোমরাই জানো। এখন ছুটতে হবে আমাকেও। ভেবেছিলাম সন্ধ্যের দিকে যাব। এখন তোমার বৌমা অস্থির হচ্ছে। বলছে পরের ছেলে নিজের দায়িত্বে নিয়ে এসেছি!

শিবনাথগিন্নী কাতর বচনে বলেন, এত সব আমি কি করে জানব বাছা? বৌমা বলল নিয়ে যাই, আমি বললাম যেতে চায় তো নিয়ে যাও। মুখচোরা ছেলে। তা অনিচ্ছেয় জোর করে নিয়ে গেছে নাকি অতসী, তোমার ছেলে….কই গো তুমিই বা কোথায় গেলে? অতসী….অ সীতুর মা…ওমা এই তো এখানে ছিল, সে আবার কোথায় গেল!…এ সব কী ভূতুড়ে কাণ্ড গো! অ খোকা, দেখ দেখ ছেলে হারানো শুনে সে আবার রাস্তায় বেরিয়ে গেল কিনা! ছেলেঅন্তপ্রাণ! কিন্তু একা মেয়েমানুষ বেরিয়ে কি করবে? অ খোকা–ওমা আমি কেন মরতে তার ছেলেকে যেতে দিতে রাজী হলাম

.

মৃগাঙ্ক চুপচাপ বসে ভাবছিলেন টেবিলে কনুই রেখে, চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে। একটু আগে রোগী দেখে ফেরার সময় একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেছে। অথচ এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না ঘটনাটা সত্যি কিনা।

আসলে কিন্তু কোনও ঘটনা কি? না, ঘটনা বলতে কিছুই নয়, শুধু একটা চকিত ছায়া, একটা অবিশ্বাস্য বিস্ময়। তখন থেকে বার বার ভাবছেন মৃগাঙ্ক, তিনি কি ঠিক দেখেছেন? নাকি তার একাগ্র বাসনা ছায়ামূর্তি ধরে তাকে ছলনা করছে? কিন্তু ছলনাটা বড় অবিকল!

গাড়িতে আসতে আসতে হঠাৎ দেখতে পেলেন পাশ দিয়ে একটা গাড়ি সাঁ করে বেরিয়ে গেল, তার মধ্যে সীতু।

সীতু এতবড় একখানা গাড়ির আরোহী হয়ে বসেছে এটাও যেমন অবিশ্বাস্য, মৃগাঙ্ক সীতুকে চিনতে পারবেন না সেটাও তেমনি অসম্ভব।

কিন্তু সে গাড়িতে আর কে ছিল?

দেখতে পান নি মৃগাঙ্ক, আদৌ দেখতে পাননি, দেখবার চেষ্টা করবার অবকাশও পাননি, শুধু যা দেখেছিলেন তাতেই দিশেহারা হয়ে গিয়ে মুহূর্তের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন, আর সেই বিস্মৃতির মুহূর্তে হঠাৎ গাড়িটাকে আড়াল করে ফেলেছিল প্রকাণ্ড একটা লরী। আর ট্রাম চলছিল এপাশ দিয়ে।

লরির শত্রুতাপাশ থেকে উদ্ধার হয়ে যখন কোন রকমে নিজের গাড়িখানা উদ্ধার করলেন মৃগাঙ্ক, তখন সেই মায়ামৃগ মিলিয়ে গেছে ধূসর শূন্যতায়।

গাড়ির নম্বরটাও দেখে নেবার সুবিধে হয় নি। এখন মাথায় হাত দিয়ে ভাবছেন মৃগাঙ্ক যা দেখেছেন তা কি সত্যি? সত্যি হওয়া সম্ভব? না প্রখর সূর্যালোকের মাঝখানে দিবাস্বপ্ন?

৬. শিবপুরের হরসুন্দরী

শিবপুরের হরসুন্দরী দেবীর বাড়ি আর যাওয়া হয়নি। অনবরত যেতে যেতে ভয়ানক একটা কুণ্ঠা আসছিল। আর শেষদিন তো ভদ্রমহিলা প্রায় ক্ষেপেই উঠেছিলেন। বলেছিলেন, মিথ্যে আপনি খোঁজাখুঁজি করছেন। যে মেয়েমানুষ কোলের কচি বাচ্ছা ফেলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে, সে আবার ঘরে ফেরে নাকি? আপনার যে এখনো তার ওপর রুচি আছে, এই আশ্চর্য! জানি না আপনার কে হয়, তবে মুখের ওপরই বলছি-তাদের নিয়ে ঘর করা সম্ভব নয়। নইলে আমি কি কম ইয়ে করেছিলাম বাবা

ভয়ানক একটা লজ্জা হয়েছিল সেদিন মৃগাঙ্কর। আর ভেবেছিলেন সত্যিই তো ইচ্ছে করে যে হারিয়ে থাকতে চায়, তাকে খুঁজে বার করা কি সহজ? আর খুঁজে বার করে লাভই আছে নাকি কিছু?

কিন্তু এতটা করবার কি সত্যিই দরকার ছিল অতসীর? এই নিষ্ঠুরতা কি সম্পূর্ণ অর্থহীন নয়? ছেলে নিয়ে আলাদাই যদি থাকত, মৃগাঙ্কর ব্যবস্থা না নিত, তাই হত। কিন্তু একটু ঠিকানা একটু সন্ধান, বেঁচে আছে কি মরে গেছে তার একটু খবর, এটা জানাতে দোষ কি ছিল?

খবরের আশায় শ্যামলীদের বাড়ি গিয়ে গিয়েও আর বিব্রত করতে ইচ্ছে হয় না, ইচ্ছে হয় না খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে। তবু নিজের নাম না দিয়ে একটা আবেদন করেছিলেন কয়েকটা সপ্তাহের কাগজে, অতসী, অন্তত খবর দাও কোথায় আছ। সাড়া এল না তার। অতসী যে খবরের কাগজের জগৎ থেকে অনেক দূরের গৃহে বাস করছে, সেটা ভাবেন নি মৃগাঙ্ক। ভেবেছেন ইচ্ছাকৃত।

ক্রমশই শিথিল হয়ে যাচ্ছিলেন মৃগাঙ্ক, কঠিন করে তুলতে চেষ্টা করছিলেন মনকে, কিন্তু আজ আবার এ কী আলোড়ন!

মৃগাঙ্ক কি আবার শিবপুরে যাবেন?

আবার নির্লজ্জের মত বলবেন, কোন ছলে কোন প্রয়োজনে তারা কি আবার এসেছিল?

যদি সেই প্রৌঢ়া মহিলা ধিক্কারে ছিঃ ছিঃ করে ওঠেন! সইতেই হবে সেই ধিক্কার।

তবু জানতে চেষ্টা করতে হবে মৃগাঙ্ককে, সীতু কার সঙ্গে গাড়ি চড়ে চলে গেল, অতসী কোথায় রইল।

তখন সামনে আড়াল করে দাঁড়ানো সেই লরিটাকে যদি মৃগাঙ্ক ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে বিলুপ্ত করে দিতে পারতেন।

চলমান সেই গাড়িখানার নম্বরটা টুকে নিতে পারলে মৃগাঙ্ক কি এখন এমন করে বসে থাকতেন যন্ত্রণায় খাক হয়ে?

কিন্তু সত্যিই কি সীতু?

অস্নাত অভুক্ত মৃগাঙ্ক আবার গাড়ি বার করবার আদেশ দিলেন।

দিনের আলোয় সম্ভব নয়।

মনে হয় সমস্ত পৃথিবী ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। পার্কের কোণের দিকে গাছের আড়ালে ঢাকা একটা বেঞ্চে বসে থাকে সীতু সন্ধ্যার অন্ধকারের অপেক্ষায়। দুঃসহ হচ্ছে প্রতীক্ষার প্রহর, অথচ দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছে ইচ্ছে।

সীতু এখন ভেবে পাচ্ছে না ছোট্ট সেই পুতুলটা, যে সীতুকে দেখলেই দাদদা দা্দদা বলে ছুটে আসত, তাকে এতদিন একবারও না দেখে কি করে ছিল সীতু!

খুকুটা যদি পার্কে আসে!

সেই লাল সিল্কের ফ্রকের নীচে থেকে নেমে আসা মোট্টা মোট্টা গোল গোল পা দুখানা নিয়ে থথপিয়ে হেঁটে ছুটে আসে সীতুর দিকে। সেই নরম ফুলের বস্তাটাকে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নেবার দুরন্ত আকুলতাটা সীতুকে ভুলিয়ে দেয়, তার নাকি মরণবাচন অসুখ হয়েছিল, যায় যায় অবস্থা হয়েছিল!

আস্তে আস্তে দুপুরের রোদ ঢলে পড়ে। প্রায় ঢলে পড়ে সীতুও।

পেটের মধ্যে খিদেয় পাক দিচ্ছে। সামনে দিয়ে হেঁকে যাচ্ছে অবাক জলপান, ঘুগনিদানা, ঝালমুড়ি, আইসক্রীম।

ওদিকে সীতুর তাকাতে নেই।

কিন্তু যখন তাকাতে ছিল? তখন কি তাকাত সীতু? না, সীতু শুধু মুখ বিষ করে বসে থাকত বেঞ্চে। নেহাৎ চাকরদের সঙ্গে ঠেলে পাঠিয়ে দেওয়া হত তাকে পার্কে, তাই আসত।

আজ পার্কের বেঞ্চে বসে থাকতে থাকতে সীতুর হঠাৎ মনে হয়, আচ্ছা সীতু সব সময় অমন বিশ্রী হয়ে থাকত কেন? থাকে কেন? জগতে এত ছেলে আহ্লাদের সাগরে ভাসছে, কেন সীতু কেন পারে না সে সাগরে ভাসতে!

পারে না মৃগাঙ্ক ডাক্তারের উপর আক্রোশে আর বিতৃষ্ণায়? কিন্তু মৃগাঙ্ক ডাক্তার কি সত্যিই অত খারাপ? যদি অত খারাপ, তাহলে কেন খুঁজে বেড়াচ্ছেন সীতুকে আর সীতুর মাকে?

সীতুরা তো তাকে অপমানের চূড়ান্ত করেছে।

নিজের বাবা না হলে কি হয়? কি হয় তাকে বাবা বলে ডাকলে?

অনেকক্ষণ ধরে ভাবল সীতু।

যে বাড়িতে তারা থাকত, সে বাড়ির কর্তা বুড়োটা তো তার নিজের দাদু নয়, তবু তো সীতু তাদের বাড়ি থাকে, তাকে দাদু বলে। অতসী বলে বাবা। বুড়িটাকে বলে মা।

কিন্তু কই, তাতে তো রাগ হয় না সীতুর, অপমান বোধ করে না অতসী।

তবে কেন সীতু মৃগাঙ্কর বেলাতেই–?

সীতুই খারাপ, সীতুই যত নষ্টের মূল। সীতুর জন্যেই সীতুর মাকে রাজরাণী থেকে ঘুঁটে কুড়নি হতে হয়েছে। হরসুন্দরীর বাড়ির মতন বিচ্ছিরি বাড়িতে থাকতে হয়েছে, লোকেদের বাড়িতে ঝি হতে হয়েছে।

এ বাড়িটায় বিচ্ছিরি ঘর নয়, কিন্তু ভাল করে রেখেও কী বলে ওরা সীতুর মাকে? রাঁধুনী! রাঁধুনী! বামুনদির মত ভাবে সীতুর মাকে!

নিজের মাকে ঝি করেছে সীতু, রাঁধুনী করেছে। মৃগাঙ্ক খুব খারাপ লোক নয় তবু তাকে কষ্ট দিয়েছে, অপমান করেছে।

আর খুকুকে?

খুকুকে সীতু? খুকুকে সীতু মেরে ফেলেছে। হ্যাঁ হ্যাঁ, মেরেই ফেলেছে। খুকুর মাকে কেড়ে নিয়েছে সীতু, কেড়ে নিয়েছে মায়ের কপাল জোর।

তবে মেরে ফেলা ছাড়া আর কি?

শার্টের ঝুলটা তুলে মুখে চাপা দিয়ে চেঁচিয়ে কেঁদে ওঠাটা রোধ করে সীতু। তারপর অনেকক্ষণের পর আস্তে আস্তে বেঞ্চ থেকে নামে।

খুকু পার্কে আসবে এ আশা আর নেই সীতুর। খুকু যেন একটা বিভীষিকার ছায়া নিয়ে ঝাপসা হয়ে আছে।

তবু

তবু সীতু

সন্ধ্যার অন্ধকারে জমাদারের সিঁড়ি দিয়ে উঠে সেই সরু বারান্দাটা পার হয়ে জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে একবার দেখে নেবে খুকুর খাটটায় কেউ শুয়ে আছে কিনা–টিকটিকির মত রোগা কাঠির মত রোগা যা হোক।

আর যদি সেখানে কিছু না থাকে?

যদি দেখে খাটটা খালি, খাটের পায়ের কাছের সেই ছোট্ট নীচু আলনাটা খালি! আলনার তলায় সাজানো নেই লাল নীল সবুজ ছোট্ট ছোট্ট জুতো, আর খাটের ধারে ঝোলানো নেই রঙিন রঙিন তোয়ালে!

কী করবে সীতু?

কী করবে তখন? কী করবে তা জানে না। আর বেশি ভাবতে পারছে না। শুধু জানে সীতুকে যেতেই হবে।

খুকুর সম্পর্কে ভয়ঙ্কর একটা দাঁতখিঁচোনো অন্ধকারের ভয় নিয়ে টিকতে পারবে না সীতু।

.

হরসুন্দরী কপালে করাঘাত করে বলেন, আগে কি করে জানব বলুন এখনও এই চত্বরে আছে তারা! পাড়ার ইস্কুলেই পড়ছে। ইস্কুলের কথা আমার মাথায় আসে নি। সেদিন যেদিন শেষ এসেছিলেন, আপনিও গেলেন, আমিও ঘুরে দেখি সামনে মূর্তিমান। তা দাঁড়ায় একদণ্ড? আপনার কথা বলতে গেলাম, কানেই নিল না, ঠিকরে চলে

স্কুলটা দেখিয়ে দিতে পারেন?

ইস্কুল তো ওই–ও রাস্তার মোড়ে। জগদীশ স্মৃতি বয়েজ ইস্কুল। কিন্তু এখন তো ইস্কুল বন্ধ, পূজোর ছুটি পড়ে গেছে।

পূজোর ছুটি পড়ে গেছে।

দারোয়ান সুদ্ধু দেশে চলে গেছে।

মাস্টারদের ঠিকানা?

সে আবার আশপাশের কে জেনে মুখস্থ করে রেখেছে?

শূন্যগাড়ি নিয়ে ফিরে আসেন মৃগাঙ্ক। ফিরে আসেন শিবনাথ গাঙ্গুলীর বাড়ির সামনে দিয়ে। যখন টেলিফোনে ওরা সীতুর অন্তর্ধান বার্তা বলাবলি করছে। যার একমিনিট পরে গাঙ্গুলীগিন্নী অতসীকে খুঁজে পান নি।

.

কিন্তু মৃগাঙ্ক কি ক্রমশ পাগল হয়ে যাচ্ছেন?

জলাতঙ্ক রোগী যেমন জলের দিকে তাকালেই লক্ষ লক্ষ কুকুরের ছায়া দেখতে পায়, মৃগাঙ্ক কি তেমনি সর্বত্র তার পরম শত্রুর ছায়া দেখতে পাচ্ছেন?

নইলে এই ঘণ্টাকয়েক আগে কতটা দূরে যে মূর্তি একখানা চলন্ত গাড়িতে দেখেছিলেন, সেই মুর্তিকে কেন বসে থাকতে দেখবেন পার্কের মধ্যেকার একটা বেঞ্চে?

এও চকিত ছায়া?

দূর রাস্তা থেকে চলন্ত গাড়িতে বসে দেখা।

গাড়ি পিছিয়ে আনলেন মৃগাঙ্ক, নামতে উদ্যত হলেন, তারপর সহসাই সামলে নিলেন নিজেকে। ভ্রান্ত দৃষ্টির বিভ্রান্তিতে ভুলবেন না আর মৃগাঙ্ক।

মৃগাঙ্ক বুদ্ধিমান।

কিন্তু আশ্চর্য, সর্বত্র অতসীর ছায়া দেখছেন না মৃগাঙ্ক, দেখছেন কিনা সীতুর!

এই জন্যেই কি মহাপুরুষরা বলেন–ঈশ্বরকে শত্রুরূপে ভজনা কর।

কিন্তু সেই হতভাগ্য বুদ্ধিভ্রংশ ছেলেটাকে কি আর এখন নিজের প্রতিপক্ষ বলে মনে হয় মৃগাঙ্কর? মনে হয় শত্রু বলে?

হরসুন্দরী বাড়িওয়ালির ঘর দেখবার পরেও?

সেই বাড়ির ভাড়া যোগাতে পারে নি বলে চলে গেছে অতসী। কোথায় তবে গেছে? আরও কত সঙ্কীর্ণ গলিতে? আরও কত জঘন্য ঘরে?

.

রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে অনেক পরে সন্ধ্যার অন্ধকারে বাড়ি ফিরে এলেন মৃগাঙ্ক। আস্তে আস্তে উঠে গেলেন ওপরে। ভুলে গেলেন আজ অভুক্ত আছেন।

ঘরটা এখনও অন্ধকার।

অন্ধকারেই একবার শুয়ে পড়লে হয়। শুধু তার আগে একবার স্নানের দরকার।

বাইরের পোশাক ছেড়ে বাথরুমের দিকে এগিয়েই জমাদারের সিঁড়ির দিকে চোখ পড়ল। পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সহসা একটা বিকৃত আর্তনাদ করে পড়ে গেলেন মৃগাঙ্ক, ঘর থেকে বাথরুমে যাবার প্যাসেজটায়।

মৃগাঙ্ক এবার বুঝতে পেরেছেন পাগল হয়ে যাচ্ছেন তিনি। সেই বুঝতে পারার মুহূর্তে এই আর্তনাদ!

তারপর চলে গেল সেই বোধশক্তিটুকুও। পড়ে গেলেন। মুখগুঁজে পড়ে রইলেন সরু প্যাসেজটায়।

.

সারাদিন শ্যামলী কাছে রাখে মেয়েটাকে।

মেয়েটারও অসুখ থেকে উঠে পর্যন্ত শ্যামলীর ওপর ভয়ঙ্কর একটা ঝোঁক হয়েছে। তার কাছে ছাড়া নাইবে না, খাবে না, ঘুমোবে না।

শ্যামলীরও এ এক পরম আনন্দ। সারাদিনের পর সন্ধ্যাবেলায় এ বাড়িতে নিয়ে আসে তাকে, তাও বেশিরভাগ দিনই ঘুম পাড়িয়ে রেখে তবে ফিরতে পায়।

আঁচল ধরে আগলায় খুকু। বলে, শ্যাম্মী যাবে না। শ্যাম্মী থাকবে। খুকুকে গপপো বলবে। নিজের ছেলেটার অযত্ন হয় তবু শ্যামলী পারে না তাকে বিমুখ করতে।

.

আজও যথারীতি সন্ধ্যার পর খুকুকে নিয়ে পথে পা দিয়েছে শ্যামলী, আর যেন ভূত দেখে ঠাণ্ডা হয়ে গেল।

কে? কে দাঁড়িয়ে? সীতু না? তুই এখানে? একা যে? মা কই?

সীতু কাঁপছে।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। তার বুকের ওঠাপড়া বুঝি দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে।

মা কই, বল লক্ষ্মীছাড়া ছেলে! বল! মরে গেছে বুঝি? মাকে মেরে ফেলে

চেঁচিয়ে ওঠে শ্যামলী।

আর সীতু শার্টের ঝুলটা তুলে মুখে চেপে কেঁদে ওঠে, মা আছে, বাবা মরে গেছে।

কে মরে গেছে? চেঁচিয়ে ওঠে শ্যামলী।

বাবা! ক্লান্ত ভাঙা গলায় বলে সীতু। খুকু যে টিকটিকির মতন হয়ে গিয়েছে কাঠের মতন হয়ে গিয়েছে এ বুঝি আর দেখতে পাচ্ছে না সীতু।

তার সমস্ত চৈতন্য আচ্ছন্ন করে রয়েছে একটা ভয়ঙ্কর দৃশ্য।

একদা অহরহ যে লোকটার মৃত্যুকামনা করেছে সীতু, তার মৃত্যু যে সীতুর কাছে এমন ভয়ানক যন্ত্রণাকর হতে পারে, এ সীতুর বোধের বাইরে, ধারণার বাইরে।

সীতুর সমস্ত শরীরটাকে চিরে ছিঁড়ে টুকরো করে ফেললে যদি সেই মুখগুজড়ে পড়ে থাকা মানুষটা উঠে বসে তো এক্ষুনি সীতু নিজেকে চিরে ফেঁড়ে শেষ করে ফেলতে পারে।

.

এ বাড়িতে তখন ভয়ঙ্কর একটা ছুটোছুটি চলছে। সারাদিনের অভুক্ত সাহেবকে এখন খানা দেওয়া হবে কিনা জিগ্যেস করতে এসে নেবাহাদুর এমন একটা আর্তনাদ করে উঠেছে যে, বাড়িতে যতগুলো লোক ছিল সবাই ছুটে এসেছে মৃগাঙ্কর শোবার ঘরে।

কিন্তু লোক মানে তো চাকরবাকর?

আর কে লোক আছে মৃগাঙ্কর বাড়িতে? হয়তো বাড়ির কাজের ব্যাপারে ওরা বুদ্ধিমান-নেবাহাদুর, মাধব, বামুনদি, কানাই, সুখদা, কিন্তু এমন একটা আকস্মিক বিপদপাতে তারা বুদ্ধিভ্রংশ হয়ে গেছে। সকলে মিলে জটলাই করছে, খেয়াল করছে না একজন ডাক্তার ডাকা প্রয়োজন।

বামুনদি আর সুখদা তারস্বরে মুখে চোখে জল দেবার নির্দেশ দিচ্ছে আর ওরা এঘর ওঘর ছুটোছুটি করছে।

.

নাটকের এই জটিল দৃশ্যের মাঝখানে সহসা এসে দাঁড়াল শ্যামলী, যথারীতি খুকুকে নিয়ে। কিন্তু তার পিছনে ও কে?

ওই ছেলেটা!

আধময়লা নীল ডোরাকাটা সার্ট আর বিবর্ণ খাকি প্যান্ট পরা!

এতগুলো লোকের এত জোড়া চোখ যেন পাথর হয়ে গেছে। সাহেবের জ্ঞানশূন্যতার মত ভয়ঙ্কর বিপদটাও ভুলে গেছে ওরা। হাঁ করে তাকিয়ে আছে ওই ছেলেটার দিকে।

কিন্তু ছেলেটা তো শুধু শ্যামলীর পিছন পিছন নীরবে এসে দাঁড়ায়নি, বসে পড়েছে ঘরের মেজেয়। যেখানে মৃগাঙ্কর অচৈতন্য দীর্ঘ দেহখানাকে কোনরকমে টেনে এনে মাথার তলায় একটা বালিশ গুঁজে শুইয়ে রেখেছে ওরা।

খুকুকে সুখদার কোলে ছেড়ে দিয়ে শ্যামলীও বসে পড়ে রুদ্ধশ্বাসে বলে, কী হয়েছে?

সবগুলো লোক একসঙ্গে কী হয়েছে বোঝাতে চেষ্টা করে সবটাই দুর্বোধ্য করে তোলে। আর সেই গোলমাল ছাপিয়ে একটা তীব্র বেদনার্ত ভাঙা গলা গুমরে ওঠে, মরে গেছে, বাবা মরে গেছে!

আঃ সীতু থাম! ওকি বিচ্ছিরী কথা! ছি ছি! শ্যামলী বকে ওঠে, দেখতে পাচ্ছিস না অজ্ঞান হয়ে গেছেন!…এই তোমরা শুধু গোলমাল করছ কেন? একটা ডাক্তার ডাকতে পারোনি?

ডাক্তার!

তাই তো!

ডাক্তার সাহেবের বাড়ির লোক তারা, বাইরের ডাক্তারের কথা মনে পড়েনি।

কাকে ডাকবে তাহলে?

কোন ডাক্তারকে?

সাহেবের তো চেনাজানা অনেক ডাক্তার বন্ধু আছে। কিন্তু কে তাদের নাম জেনে রেখেছে?

শ্যামলী হঠাৎ মুখগুঁজে বসে থাকা সীতুকে একটা ঠেলা দিয়ে দৃঢ়স্বরে বলে, এই সীতু শোন, তুই জানিস কাকাবাবুর কোনও ডাক্তার বন্ধুর নাম?

সীতু বিভ্রান্তের মত মুখ তুলে তাকায়। তারপর সমস্ত পরিস্থিতিটার উপর চোখ বুলোয়। এই তার সেই আশৈশবের পরিচিত জগৎ। ওই টেবলের উপর টেলিফোন যন্ত্রটা, ওই তার পাশে তার গাইডবুক।

যখন আরও ছোট ছিল, যখন সীতু ওই অসহায়ভাবে এলিয়ে পড়ে থাকা মানুষটাকে বাবা বলেই জানত, তখন একদিন অতসী বলেছিল, দাও না একে ফোন করতে শিখিয়ে। ভারী কৌতূহল বেচারার।

তখনো সম্পর্কে অত তিক্ততা আসেনি, তখনো মৃগাঙ্ক এই যে সীতুবাবু বলে ডেকে কথা বলতেন। তাই অতসীর অনুরোধ রেখেছিলেন, কাছে ডেকে বলেছিলেন, এই দেখ, এইভাবে নম্বর ঘোরাতে হয়। আর এই বই দেখে দেখে লোকেদের নাম বার করতে হয়। এখন তুমি ইংরিজি পড়তে পার না, যখন পড়তে পারবে তখন সব বুঝতে পারবে। আচ্ছা এখন দেখ–

নমুনাস্বরূপ নিজের একজন সহকারী ডাক্তারকে ডেকেছিলেন মৃগাঙ্ক। আর একটু হেসে সীতুর দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, দেখ, শিখলে তো? এখন ধর যদি হঠাৎ আমার কোনদিন বেশী অসুখ করে গেল, আমি আর কথা বলতে পারছি না, তুমি এইভাবে ডাকবে,–ডাক্তার মিত্র আছেন? ডাক্তার মিত্র?…হ্যাঁ, আমি ডাক্তার মৃগাঙ্ক ব্যানার্জির বাড়ি থেকে বলছি

.

মানুষ কি কোনও একটা মুহূর্তে হঠাৎ এক একটা বয়সের সীমা অতিক্রম করে? শৈশব থেকে বাল্যে, বাল্য থেকে যৌবনে, যৌবন থেকে বার্ধক্যে? সীতু সহসা এই মুহূর্তে অতিক্রম করে গেল তার শৈশবকে? তাই শ্যামলীর একবারের ডাকেই উঠে দাঁড়াল, এগিয়ে গেল টেবিলের দিকে, গাইড দেখে বার করল প্রার্থিত নাম, আর ভাঙা গলায় আস্তে আস্তে থেমে থেমে বলতে থাকল–ডাক্তার মিত্র আছেন? ডাক্তার মিত্র? আমি ডাক্তার মৃগাঙ্ক ব্যানার্জির বাড়ি থেকে বলছি…হা..বাবা হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেছেন। এক্ষুনি আসতে হবে।

হ্যাঁ, হঠাৎ একদিন বেশি অসুখ করে গেছে মৃগাঙ্কর, কথা বলতে পারছেন না, তাই সীতু সীতু পারছে। সীতু এখন ইংরিজি শিখেছে।

.

কিন্তু সীতু কি শুধু ইংরিজিই শিখেছে?

আরও কিছু বুঝতে শেখে নি? বুঝতে শেখে নি নিজের হিংস্র নিষ্ঠুরতা? যে নিষ্ঠুরতায় এই রাজবাড়ির রাণীকে ভিখিরির সাজ সেজে পরের বাড়ি দাসত্ব করতে হচ্ছে, ওই চিরকঠিন শক্তিমান লোকটা জীর্ণ হতে হতে ক্ষয়ে যাচ্ছে, আর–আর খুকু—

খুকু!

এতক্ষণে বুঝি মনে পড়ে সীতুর খুকুর কথা, যখন জ্ঞান ফেরার পর ঔষধের প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে ঘুমোচ্ছেন মৃগাঙ্ক। তার শান্ত শ্বাসপ্রশ্বাসের ওঠাপড়া দেখা যাচ্ছে।

শ্যামলীর কাছে এসে দাঁড়ায় সীতু।

অস্ফুট দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বলে, খুকু কোথায়?

খুকু!

শ্যামলী এত ঝঞ্ঝাটের মধ্যেও হঠাৎ হেসে ফেলে বলে, খুকু কোথায় কিরে? এই তো খুকু। চিনতে পাচ্ছিস না?

নিজের কোলের দিকে চোখ মেলে শ্যামলী বলে, কিছুতে ঘুমুতে চাইছে না। আসল কথা কাঁচা ঘুম থেকে উঠে পড়েছে তো? তাই দেরী হচ্ছে।

কিন্তু এত কথা কে শোনে?

সীতু অবাক বিস্ময়ে বিস্ফারিত লোচনে তাকিয়ে থাকে শ্যামলীর ক্রোড়স্থিত জীবটার দিকে। ওইটা খুকু? ওই রোগা সিরসিরে ঢ্যাঙা ন্যাড়ামাথা, সত্যিই টিকটিকির মত মেয়েটা খুকু? ওকে তো এই এতক্ষণ ধরে শ্যামলীরই মেয়ে ভাবছিল সীতু!

সেই লাল লাল খাদা খ্যাদা আর সোনালি চুলওয়ালা খুকুটা তাহলে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে? আর তার হত্যাকারী সীতু?

ও কার খুকু?

তীক্ষ্ণ প্রশ্নে বিদীর্ণ করে ফেলতে চায় শ্যামলীকে সীতু–বল না কার খুকু?

কী মুশকিল! কার আবার, তোদেরই! সত্যি চিনতে পারছিস না?

সীতু আস্তে মাথা নাড়ে।

তা চিনতে আর পারবি কোথা থেকে। শ্যামলী আক্ষেপ করে–চেনবার কি জো আছে? এমনিই তো কতদিন দেখা নেই, তাছাড়া যা হয়েছিল।

শ্যামলী খুকুর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে সস্নেহে বলে–সবচেয়ে শক্ত টাইফয়েড। আর তার মধ্যে জ্বরের ঘোরে অবিরত শুধু মা মা বলে–হ্যাঁ, এইবার বল দিকি তোদের খবর? এতক্ষণ তো–তিনিই বা কোথায়? তুই বা কোথা থেকে?

.

মৃগাঙ্ক যখন চোখ মেললেন তখন সকাল হয়ে গেছে। চোখ মেলেই স্তব্ধ হয়ে গেলেন তিনি। তাহলে কি ভুল নয়? সত্যিই পাগল হয়ে গেছেন তিনি?

যদি পাগল না হন, তাহলে বিশ্বাস করতে হয় তার ঘরে তারই বিছানার কাছাকাছি অতসীর খাটটায় পড়ে যে ছেলেটা অঘোরে ঘুমোচ্ছ, সে সীতু!

আর সীতুর গা ঘেঁষে, সীতুর গায়ে হাত পা বিছিয়ে অকাতরে পড়ে ঘুমোচ্ছে যে, সেটা খুকু! চুপ করে এই দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে রইলেন মৃগাঙ্ক। ডাকলেন না, যেন ডাক দিলেই এই অপূর্ব পবিত্রতার ছবিখানি অপবিত্র হয়ে যাবে।

তাহলে কাল ছায়ামূর্তি দেখেন নি মৃগাঙ্ক?

কিন্তু কোথা থেকে এল ও? কে ওকে এখানে প্রতিষ্ঠিত করে গেল?

কিন্তু একা কেন? অতসী কোথায়?

তবে কি অতসী–তাই ছন্নছাড়া ছেলেটা পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে–কেঁপে উঠলেন মৃগাঙ্ক। ভুলে গেলেন, এই ছবিখানি নষ্ট করতে চাইছিলেন না।

ডেকে উঠলেন।

হয়তো আকস্মিকতায় একটু বেশি জোরালো হল সে ডাক।

চমকে চোখ মেলে চাইল সীতু। উঠে বসল। চোখ নামাল।

মৃগাঙ্ক মিনিটখানেক তাকিয়ে থেকে গম্ভীর মৃদু স্বরে উচ্চারণ করলেন, তুমি একা এসেছ?

সীতু চোখ তুলল, হ্যাঁ।

তোমার মা মারা গেছেন?

না না, ওকি! শিউরে ওঠে সীতু।

তবে?

সীতু প্রতিজ্ঞা করেছে এবার থেকে সে সভ্য হবে, ভদ্র হবে, কেউ কথা বললে উত্তর দেবে। তাই ক্ষীণস্বরে বলে, আমি এমনি একা-খুকুকে দেখতে

খুকুকে দেখতে! খুকুকে দেখতে এসেছ তুমি!

হ্যাঁ।

.

এবার আর হরসুন্দরীর বাড়ির দরজায় নয়।

শিবনাথ গাঙ্গুলীর দরজায় এসে থামে সেই মস্ত চকচকে গাড়িখানা।

কাকে চাই?

এ বাড়ির রাঁধুনীকে!

যেন রূপকথার গল্প! ঘুঁটেকুড়ানির জন্যে চতুর্দোলা!

কিন্তু এখানেও কপালে করাঘাত–এই দুদিন আগেও ছিল বাবা! হঠাৎ ছেলে ছেলে করে। বিভ্রাট হয়ে–গোড়া থেকেই বুঝেছি আমি, সে যেমন তেমন নয়, শাপভ্রষ্ট দেবী আমাকে ছলনা করতে এসেছিল।…কিন্তু তুই দুষ্টু ছেলে হঠাৎ অমন করে কোথায় চলে গিয়েছিলি? ছেলে হারিয়েছে শুনেই তোর মা যে পাগলের মত

কিন্তু মৃগাঙ্ক আর পাগলের মত হন না। হবেন না।

ফিরে এসে সীতুকে হাত ধরে গাড়িতে তুলে দিয়ে নিজে উঠে স্টার্ট দিতে দিতে গম্ভীর মৃদুকণ্ঠে বলেন, কাঁদিস নে সীতু, কাঁদলে চলবে না। খুঁজে তাকে আমরা বার করবই। খুঁজে না পেলে চলবে কেন আমাদের বল! কিন্তু আর আমার ভয় নেই। তখন একা ছিলাম, তাই হেরে গিয়েছিলাম, আর তো আমি একা নই। আর হারব না। দেখব আমাদের দুজনকে হারিয়ে দিয়ে, কতদিন সে হারিয়ে বসে থাকতে পারে!

(সমাপ্ত)

No comments