দু-কান কাটা – অন্নদাশঙ্কর রায়
দু-কান কাটা সেই সব সুন্দর ছেলেরা আজ কোথায়, যাদের নিয়ে আমার কৈশোর সুন্দর হয়েছিল! মাঝে মাঝে ভাবি আর মন কেমন করে।
একজনকে মনে পড়ে। তার নাম সুকুমার। গৌরবর্ণ সুঠাম তনু, একটুও অনাবশ্যক মেদ নেই অথচ প্রতি অঙ্গে লালিত্য। চাঁদের পিছনে যেমন রাহু তেমনি চাঁদপানা ছেলেদের পিছনে রাহুর দল ঘুরত। তাদের কামনার ভাষা যেমন অশ্লীল তেমনি স্থূল। তাদের স্থূলহস্তাবলেপে সুকুর গায়ে আঁচড় লাগত। তা দেখে যাদের বুকে বাজত তাদের জনাকয়েক মিলে একটা দেহরক্ষা বাহিনী গড়েছিল। আমাদের কাজ ছিল তাকে বাড়ি থেকে ইস্কুল ও ইস্কুল থেকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া। আমরা নিঃস্বার্থ ছিলুম না। যে রক্ষক সেই ভক্ষক। সুকু তা জানত, তাই আমাদের প্রশ্রয় দিত না। তার দরুন আমার অভিমান ছিল। থাকবে না? রাহুদের একজন আমার ডান হাতে এমন মোচড় দিয়েছিল যে আর একটু হলে হাতটা যেত। যার জন্যে করি চুরি সেই বলে চোর।
ক্বচিৎ তাকে একা পেতুম। পেলেই আমার বুকভরা মধু তার কানে ঢালতে ব্যগ্র হতুম, কিন্তু তার আগেই সে পাশ কাটিয়ে যেত। সে যে আমার প্রকৃত পরিচয় জানল না একথা ভেবে আমার চোখে জল আসত। সময়ে অসময়ে তাই তাদের বাড়ির আশেপাশে ঘুরতুম। ভিতরে ঢুকতে ভরসা হত না। কারণ সুকু একদিন আমাকে বলেছিল, ‘তুই আমাদের বাড়ি অতবার আসিসনে, খোকন।’
তখন ঠিক বুঝতে পারিনি কেন এই রূঢ়তা। পরে বুঝেছি ওটা রূঢ়তা নয়। সুকুর বাবা মফস্সলে গেলে তার মা-র সঙ্গে তার ঠাকুমার বচসা বাঁধত। খোঁপা আর এলোচুলের সেই বচসা শুনে পাড়ার লোক জুটত তামাশা দেখতে। এতে সুকুর মাথা কাটা যেত। তার বাবা যখন ফিরতেন, মা-র কথায় কান দিতেন না, ঠাকুমার কাহিনি বিশ্বাস করতেন। মাকে দিতেন মার। তা দেখে সুকুর ভাইবোন বাবার পা জড়িয়ে ধরত, কিন্তু সুকু এত লাজুক যে লুকিয়ে কাঁদত। প্রতিবার মা ঘোষণা করতেন তিনি বাপের বাড়ি যাচ্ছেন, বাক্স বিছানা নিয়ে সত্যি সত্যি বাইরের বারান্দায় দাঁড়াতেন। রাজ্যের লোক জড়ো হত তাঁকে দেখতে ও তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে। এতে সুকুর বাবার মাথা কাটা যেত, সুকুরও। চাকর এসে বলত, ‘মা, একখানাও ঘোড়ার গাড়ি পাওয়া গেল না।’ তা শুনে ঝি বলত, ‘আর একটা দিন থেকে যাও মা। কথা রাখো।’ সেদিনকার মতো মা যাওয়া মুলতুবি রাখতেন। প্রতি মাসেই এই ব্যাপার। দুজনেই সমান মুখরা, যেমন মা তেমনি ঠাকুমা। একদিন সুকুর মা এমন মার খেলেন যে গাড়ির অভাবে পেছপাও হলেন না, দুনিয়ার লোকের চোখের উপর ঘোমটা টেনে দিয়ে পথে বেরিয়ে পড়লেন ও পায়ে হেঁটে রেলস্টেশনে গেলেন।
সুকুর ভাইবোন লোকলজ্জায় তাঁর সাথি হল না, কিন্তু সবচেয়ে লাজুক যে সুকু সে-ই তাঁর হাত ধরে পথ দেখানোর ভার নিল। কাজটা সুকুর মা ভালো করলেন না। সুকুর বাবার মাথা হেঁট হল। তিনি সেই হেঁট মাথায় টোপর পরে শোধ তুললেন। খবরটা যখন সুকুর মা-র কানে পড়ল তিনি কুয়োয় ঝাঁপ দিতে গেলেন। সবাই মিলে তাঁকে ধরে এনে ঘরে বন্ধ করে রাখল। তখন থেকে তিনি নজরবন্দি।
মামারা সুকুকে ইস্কুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেইস্কুলে যাবার নাম করে সেই যে বেরোত, ফিরত রাত করে। কেউ তাকে বকতে সাহস করত না, পাছে সে আত্মঘাতী হয়। শিবপুর হাটের তিনদিকে নদী। যেদিকে দু-চোখ যায় সেদিকে গেলে প্রায়ই নদীর ধারে পা আটকে যায়! সুকু পা ছড়িয়ে বসে, গা ঢেলে দেয়। কত নৌকো স্রোতের মুখে ভাসছে, উজান বেয়ে আসছে। কোনোটাতে চালের বস্তা, কোনোটাতে নতুন হাঁড়ি-কলসি, কোনোটাতে ঝুনো নারকেল। ছইয়ের চার কোণে মাকাল ফল দুলছে, ছইয়ের ভিতর ডাবা হুঁকো ঝুলছে। নৌকোর গায়ে কতরকম নকশা। নকশার কতরকম রং। নৌকোও কতরকম—জেলেদের ডিঙি, বারোমেসেদের নাও, গয়নার বোট, আরও কত কী। বাংলার প্রাণ নদী, নদীর প্রাণ নৌকো, নৌকোর প্রাণ মাঝি, মাঝির প্রাণ গান। সুকু একমনে গান শোনে আর গুনগুন করে সুর সাধে। এতেই তার শান্তি, এই তার সান্ত্বনা।
একদিন মেলা লোক যাচ্ছিল মেলা দেখতে। রঘুনাথপুরে রামনবমীর মেলা। তা বলে শুধু রামায়েত বৈষ্ণবরা নয়, নিমাইত বৈষ্ণবরাও আসে। নানা দিগদেশ থেকে জমায়েত হয় আউল-বাউল দরবেশরাও। একদল কীর্তনিয়া গান করতে যাচ্ছে দেখে সুকুও তাদের নৌকোয় উঠে বসল। মেলায় গিয়ে সে দলছাড়া হল না, সে যদি-বা ছাড়তে চায় দলের লোক ছাড়ে না! তারা একটা গাছতলা দেখে আস্তানা গাড়ল। সেখানে জোল কেটে বড়ো বড়ো হাঁড়ি চাপিয়ে দিল। কুটনো কুটতে বসল দলের মেয়েছেলেরা। বলতে ভুলে গেছি, দলের কর্তা যিনি তিনি পুরুষ নন, নারী। তাঁর নাম হরিদাসী। হরিদাসী নাম শুনে সুকু ধরে নিয়েছিল হিন্দু, আপনারাও সে-ভুল করতে পারেন। তাই বলে রাখছি তিনি মুসলমান দরবেশ। তাঁর দলের পুরুষদের নাম শুনে মালুম হয় না মুসলমান না হিন্দু। ইসব শা-ও আছে, আবার মনু শা-ও আছে। সুকু ধরে নিয়েছিল ওরা সকলেই হিন্দু, তাই আহার সম্বন্ধে দু-বার ভাবেনি। কেবল পানের সময় ‘পানি’ কথাটা শুনে একটু খটকা বেঁধেছিল।
হরিদাসীরা মউজ করে রাঁধে বাড়ে খায় আর গান করে। সুকুও তাদের শরিক। তার গলা শুনে হরিদাসী তাকে কাছে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘তোর হবে।’ এতদিন জীবন বিস্বাদ লাগত, এতদিনে স্বাদ ফিরল। সুকুর চোখে পৃথিবীর রূপ গেল বদলে। যেদিকে তাকায় সেদিকে রূপের সাগর। কানে ঢেউ তোলে হরিদাসীর কন্ঠধ্বনি—
এমন ভাবের নদীতে সই ডুব দিলাম না।
আমি নামি নামি মনে করি মরণ-ভয়ে নামলাম না।
মেলা ভাঙল। সুকুরও ভয় ভাঙল। মামারা যদি তাড়িয়েই দেন তবে তার আশ্রয়ের অভাব হবে না। তখনও সে জানত না যে ওরা মুসলমান, জানল শিবপুর হাটে অন্যের মুখে। তখন তার আরও একটা ভয় ভাঙল, জাতের ভয়। সে মনে মনে বলল, আমার জাত যখন গেছেই তখন দুঃখু করে কী হবে। যার জাত নেই তার সব জাতই স্বজাত। ওরা আমার আপনার লোক, আমিও ওদের।
দুই
অনুমতি না নিয়ে মেলায় যাওয়া, সেখানে মুসলমানের ভাত খাওয়া, এসব অপরাধের মার্জনা নেই। মামারা মারলেন না, বকলেন না, কিন্তু থালাবাসন আলাদা করে দিলেন। সেসব মাজতে হল সুকুকেই। তাতে তার আপত্তি ছিল না। বরং দেখা গেল তাতেই তার উৎসাহ। মামিমাদের কাছ থেকে সিধা চেয়ে নিয়ে সে নিজেই শুরু করে দিল রাঁধতে। কলাপাতা কেটে নিয়ে এসে উঠোনের এক কোণে খেতে বসে। কেউ কাছে গেলে সবিনয়ে বলে, ‘ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না, জাত যাবে।’ তার দশা দেখে তার মা দু-বেলা কাঁদেন। একটা প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা না করলেই নয়, মামারা স্বীকার করলেন। তা শুনে সুকু বেঁকে বসল। বলল, ‘মুসলমানের ভাত আরও কত বার খেতে হবে। ক-বার প্রায়শ্চিত্ত করব? গোবর কি এত মিষ্টি যে বার বার খেতে হবে।’
মামাবাড়ি থেকে চিঠি গেল বাবার কাছে। ইতিমধ্যে সৎমার হয়েছিল যক্ষ্মা, তাকে নিয়ে ঘরসংসার করা অসম্ভব হয়ে উঠছিল। সুকুর বাবা একটা ছল খুঁজছিলেন সুকুর মা-কে ফিরিয়ে আনবার। চিঠি পেয়ে আপনি হাজির হলেন। সুকুকে কোলে টেনে নিয়ে বললেন, ‘চল আমার সঙ্গে।’ স্ত্রীকে বললেন, ‘যা হবার তা হয়ে গেছে। আর তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারিনে। এসো আমার সঙ্গে।’
আবার সুকুদের বাড়িতে আনন্দের হাট বসল। আমরা তার পুরোনো বন্ধুরা তাদের ওখানে দিনরাত আসর জমালুম। এবার সে আমাদের বারণ করে না, করলেও আমরা মানতুম না। এ বলে আমার সুকু, ও বলে আমার সুকু। সুকু যেন প্রত্যেকের একান্ত আপন। ওর বাবা যদি ওকে ইস্কুলে ভরতি না করে দিতেন আমরা রোজ রোজ ইস্কুল কামাই করে বিপদে পড়তুম।
শিবপুর হাটের সেই যে অভ্যাস, সুকু সে-অভ্যাস কাটিয়ে উঠতে পারল না। কখন একসময় ক্লাস থেকে পালায়, আমরা চেয়ে দেখি সে নেই। আমাদের মহকুমা শহরে নদী আছে নিশ্চয়, কিন্তু নদীর ধারে ঘনবসতি, সুকুর তাতে অরুচি। সে যায় আউল দরবেশ বৈষ্ণবের সন্ধানে। ফকির দেখলেই সঙ্গ নেয়। তাদের সঙ্গে ঘুরে-ফিরে সন্ধ্যার পরে বাড়ি আসে। আমরা ততক্ষণ তার জন্যে ভেবে আকুল। তার খোঁজ নিতে এক একজন এক একদিকে বেরোয়, পেলেও তাকে ডেকে সাড়া মেলে না। আমরা যেন তার আপনার লোক নই, যত রাজ্যের ফেরার আসামি ভেক নিয়েছে বলে ওরাই হয়েছে তার আপনার। সুকু যে ওদের মধ্যে কী মধু পায় আমরা তা বুঝিনে। যত সব সিঁদেল চোর আর জাঁহাবাজ চোরনি গৃহস্থের বাড়ি গান গেয়ে বেড়ায় কার কী সম্পত্তি আছে সেই খবরটি জানতে। তারপরে একদিন নিশুতি রাতে গৃহস্থের সর্বস্ব চুরি যায়।
সুকুকে আমরা সাবধান করে দিই যেকোনো দিন চোর বলে সন্দেহ করে পুলিশ তার হাতে হাতকড়ি পরাবে। সে বলে, ‘সন্দেহ মিটলে খুলেও দেবে।’আমরা বলি, ‘কিন্তু কলঙ্ক তো ঘুচবে না। মুখ দেখাবি কী করে?’ সে বলে, ‘ওরা যেমন করে দেখায়।’ওরা মানে বাউল বোষ্টমরা।
সুকুর জন্যে আমাদের লজ্জার সীমা রইল না, দেখা গেল আমরাই ওর চেয়ে সলাজ। ওর সঙ্গে মিশতে আমাদের সংকোচ বোধ হল। প্রকাশ্যে মেলামেশা বন্ধ হয়ে এল, গোপনে মেলামেশা চলল।
হেডমাস্টারমশাই ছিলেন সুকুর বাবার বন্ধু। তিনি পরামর্শ দিলেন ওকে বোর্ডিং-এ রাখতে। ওর বাবা একদিন ওকে বোর্ডিং-এ রেখে এলেন। ওর তাতে আপত্তি নেই, বরং ছত্রিশ জাতের সঙ্গে পঙক্তিভোজনের আশা। আমরা কিন্তু হতাশ হলুম। বোর্ডিং-এর পাশেই হেডমাস্টারমশায়ের কোয়ার্টার। তাঁর চোখে ধুলো দিয়ে যে সুকুর কাছে যাওয়া-আসা করব সে-সাহস ছিল না।
কিছুদিন পরে এক মজার ব্যাপার ঘটল। হেডমাস্টারমশাই একদিন স্বকর্ণে শুনলেন দুটি বালখিল্য বালক ফুর্তিসে গান করছে—
যৌবন জ্বালা বড়োই জ্বালা সইতে না পারি
যৌবন জ্বালা তেজ্য করে গলায় দিব দড়ি।
দুঃখ রে যৌবন প্রাণের বৈরী।
মশাই তো দুই হাতে দুজনের কান ধরে টেনে তুললেন। অন্তরিক্ষে দোদুল্যমান ওই দুটি প্রাণী অবিলম্বে কবুল করল যে সুকুই ওদের ও-গান শিখিয়েছে। তখন তিনি সুকুকে তলব করলেন। সুকু বলল, ‘সব সত্যি। দোষ ওদের নয়, আমার।’
মশাই বললেন, ‘গোল্লায় যদি যেতে হয় তবে সদলবলে কেন? তুমি একা যাও।’ এই বলে একটা গাড়ি ডেকে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন।
সেও বাঁচল, আমরাও বাঁচলুম। তার বাবা কিন্তু তাকে নিয়ে মুশকিলে পড়লেন। ঘরে আটক করে রাখলে পড়াশোনা মাটি। ইস্কুলে যেতে দিলে সে ঠিকানা হারিয়ে ফেলে। যাদের কাছে পাঠ নেয় তারা মাস্টার নয়, বাউল ফকির। কিছুদিন তিনি নিজেই তাকে বিদ্যালয়ে পৌঁছে দিয়ে এলেন, সেখানে তার ওপর কড়া পাহারার বন্দোবস্ত হল। কিন্তু সে অঙ্কের খাতায় ইতিহাস ও ইতিহাসের খাতায় সংস্কৃত লিখে শিক্ষকদের উক্ত্যক্ত করে তুলল। এটা যে তার ইচ্ছাকৃত তা নয়। সে নিজেই বুঝতে পারে না কেন এমন হয়। আসলে তার মন ছিল না পাঠে।
সুকুর মা তার বাবাকে বললেন, ‘জানি আমার কথা হেসে উড়িয়ে দেবে। কিন্তু সেকালে কর্তারা এরকম স্থলে গিন্নিদের উপদেশ নিতেন।’
‘শুনি তোমার উপদেশটা কী?’
‘আমার ঠাকুরদার বিয়ে হয়েছিল ষোলো বছর বয়সে। সুকুর বয়স পনেরো হলেও ওর যেমন বাড়ন্ত গড়ন—’
সুকুর বাবা হেসে উড়িয়ে দিলেন।
তিন
ম্যাট্রিকে সুকু ফেল করল। আমি পাস। বাধ্য হয়ে আমাকে বড়ো শহরে যেতে হল। ভরতি হলুম কলেজে। চিঠি লিখে সুকুর সাড়া পেতুম না। ওর সঙ্গে দেখা হত ছুটিতে।
দিন দিন ব্যবধান বাড়তে থাকে। আমি যদি বলি ‘তুই’, সুকু বলে ‘তুমি’। আমার কষ্ট হয়। ডাকলে আসে, না ডাকলে খোঁজ করে না। গেলে দেখা দেয়, কিন্তু প্রাণ খুলে কথা কয় না। একদিন আমি কুন্ঠিতভাবে বলেছিলুম, ‘সুকু, আমি কি তোর পর?’ সে উত্তর দিয়েছিল, ‘তা নয়। আমি হলুম ফেল করা ছেলে। আর তুমি—’
আমি তার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলেছিলুম, ‘তোর জন্যে আমার সবসময় দুঃখ হয়।’
‘কিন্তু আমি তো মনে করি আমার মতো সুখী আর কেউ নেই। যেখানে যাই সেখানেই আমার ঘর, সেখানেই আমার আপনার লোক।’
বাউল ফকির দরবেশদের ও বলত আপনার লোক। ওরাও ওকে দলে টানত। রতনে রতন চেনে। আমাদের চোখে সুকু একটা ফেল করা ছেলে, ওর পরকালটি ঝরঝরে। ওদের চোখে সুকু একজন ভক্ত। গুরুর কৃপা হলে একদিন পরমার্থ পাবে। আমাদের হিতৈষীপনার চেয়ে ওদের হিতৈষিতাই ছিল ওর পছন্দ।
হাজার হলেও আমি ওর পুরোনো বন্ধু। বোধহয় তার চেয়েও বেশি। সুকু সেটা জানত, তাই আমাকে যত কথা বলত আর কাউকে তত নয়। তাকে দিয়ে কথা-বলানো একটা তপস্যা। গান করতে বললে দেরি করে না, কিন্তু মনের কথা জানাতে বললে দশ বার ঘোরায়।
সুকু নিজেকে সকলের চেয়ে সুখী বলে দাবি করলেও আমার অগোচর ছিল না যে ওর ভিতরে আগুন জ্বলছে আর সে-আগুনে ও পুড়ে খাক হচ্ছে। কাকে যে ভালোবেসেছে, কে যে সেই ভাগ্যবতী তা আমাকে জানতে দিত না। আমি অবশ্য অনুমান করতুম কিন্তু পরে বুঝেছিলুম সেসব অনুমান ভুল।
নায়িকা-সাধন বলে ওদের একটা সাধনা আছে। সুকু নিয়েছিল ওই সাধনা। প্রত্যেক নারীর মধ্যে রাধাশক্তি সুপ্ত রয়েছে। সেই শক্তি যখন জাগবে তখন প্রতি নারীই রাধা। যেকোনো নারীকে অবলম্বন করে রাধাতত্ত্বে পৌঁছোনো যায়। কিন্তু সে-নারীর সম্মতি পাওয়া চাই। সুকু একজনের সম্মতি পেয়েছে এইখানেই তার গর্ব। এইজন্যেই সে বলে তার মতো সুখী আর কেউ নয়। অথচ তার মতো দুঃখী আর কেউ নয়। ভদ্রলোকের ছেলে ছোটোলোকদের সঙ্গে খায়দায়, গায়-বাজায়, শোয়া-বসা করে। ওকে নৌকো বাইতে, গোরুর গাড়ি চালাতে, ঘর ছাইতে দেখা গেছে। ওর বাবা সম্মানীয় ব্যক্তি। তাঁর মাথা হেঁট। তিনি কিছু বলতে পারেন না এই ভেবে যে ইতিমধ্যে তাঁর ছোটোবউ মরেছেন, ছেলেকে শাসন করলে যদি বড়োবউ আবার বাপের বাড়ি যান তবে আর একবার টোপর পরার মতো বল বয়স নেই। মুখে বলেন, ‘ওটাকে ত্যাজ্যপুত্র করতে হবে দেখছি।’ কিন্তু ভালো করেই জানেন যে সুকু তাঁর সম্পত্তির জন্যে লালায়িত নয়। সুকুর মা ওকে বকেন। কিন্তু বকলে সুকু বাইরে রাত কাটায়। তখন তিনিই ওকে আনতে পাঠান।
মজনু ফকির ওর গুরু। গুরুর উক্তি ও সুকুর প্রত্যুক্তি কতকটা এইরকম—
‘বাবা, কাঁদতে জনম গেল। যদি সুখের পিত্যেশ পুষে থাক তবে আমার লগে আইসো না। আমি তোমায় সুখের নাগাল দিতে নারব।’
‘আমি চোখের জলে মানুষ হয়েছি। কাঁদতে কি ডরাই?’
‘সারা জনম কাঁদতে রাজি আছ?’
‘আছি।’
‘আমায় দুষবে না?’
‘না, হুজুর।’
‘তবে তুমি সুখের সন্ধান ছেড়ে রাধার সন্ধানে যাও। সে যদি সুখ দেয় নিয়ো। যদি দুখ দেয় নিয়ো। কিছুতেই ‘না’ বোলো না। তার ছলকলার অন্ত নেই। তেঁই তোমায় বলি, কাঁদতে জনম গেল রে মোর কাঁদতে জনম গেল।’
সুকু সেই যে ফেল করল তারপরে আর পরীক্ষা দিল না। তার পড়াশুনা সেইখানেই সাঙ্গ হল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাকে পরীক্ষা দিতে হল, সে-পরীক্ষা মাত্র একজনের কাছে। সে-একজন তার নায়িকা। তার গুরুই তাদের পরিচয় ঘটিয়ে দেন, এইটুকু আমি জানি, এর বেশি জানিনে। আর যা জানি তা লোকমুখে শোনা। লোকের কথা আমি বিশ্বাস করিনে, যদিও ল্যাটিন ভাষায় প্রবাদ আছে লোকের কথাই ভগবানের কথা।
একবার ছুটিতে বাড়ি এসে শুনি সুকু নিরুদ্দেশ। লোকে বলাবলি করছে সারী বোষ্টমি ওকে ভুলিয়ে নিয়ে গেছে। মেয়েটি নাকি প্রথমে ছিল মোদকদের বউ। অল্প বয়সে বিধবা হয়। পরে এক বৈষ্ণবের সঙ্গে বৃন্দাবনে যায়, সেখানে বেশ কিছুকাল থেকে চালাকচতুর হয়। বৈষ্ণবটির কৃষ্ণপ্রাপ্তি হলে দেশে ফিরে সারী তাঁর বিষয়-বাড়ি ভোগদখল করে। তারপর থেকে সুন্দর ছেলে দেখলেই সে ভুলিয়ে নিয়ে যায়, সর্বনাশ করে ছেড়ে দেয়। গুণের মধ্যে সে গাইতে পারে অসাধারণ। গান দিয়েই প্রাণ মজায়। ছেলেদের অভিভাবকেরা অবশেষে হাকিমের কাছে দরখাস্ত করেন। তখন জায়গাজমি বিক্রি করে বৈষ্ণবী একদিন নিখোঁজ হয়। তার সঙ্গে সুকুও। সুকুর বাবা থানা-পুলিশ করেন, কাগজে বিজ্ঞাপন দেন। কিছুতেই কিছু হয় না। তার মা কাতর হয়ে পড়েন।
সুকুর বাবা বললেন, ‘খোকন, তুমি তো পাস করলে, জলপানি পেলে, আমার ছেলেটি কেন অমন উচ্ছন্ন গেল! ছি ছি, একটা নষ্ট মেয়েমানুষের…’তিনি মাথা হেঁট করলেন। রুমালে চোখ মুছলেন।
সুকুর মা বললেন, ‘যে-ছেলে মা-র সঙ্গে বনবাসী হয় সেকি তেমন ছেলে! আমার মন বলে সুকু আমার কোনো কুকাজ করেনি। ওর সবটাই সু। কিন্তু কেন আমাকে বলে গেল না? আর কি ফিরবে!’
চার
পরবর্তীকালে সুকুর মুখে প্রকৃত বিবরণ শুনেছি। সব মনে নেই, যেটুকু মনে আছে লিখছি। সুকু, এ লেখা যদি কোনোদিন তোমার চোখে পড়ে, যদি এতে কোনো ভুলচুক থাকে, তবে মাফ কোরো।
ওর নাম সারী, তাই সুকুকে ও শুক বলে ডাকত। শুক দেখতে সুন্দর, সারী তেমন নয়। কিন্তু সারী রসের ঝারি, শুক শুকনো কাঠ। বৃন্দাবনে থাকতে সারী হিন্দি বলতে শিখেছিল, যাত্রীদের সঙ্গে মিশে দু-চারটে ইংরেজি বুকনিও! হিন্দি ও বাংলা গান যখন যেটা শুনত তখন সেটা কন্ঠসাৎ করত। এমন একটি গায়িকা নায়িকা পেয়ে সুকু ধন্য হয়েছিল। সারী ও শুকের মতো দুজন দুজনের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে গানের সুধা পান করত। সুকুও জানত কত বাউল ফকিরের গান, সারীকে শোনাত।
সুকুর মতো আরও অনেকে আসত সারীর কাছে, তারাও আশা করত সারী তাদের আদর করবে! করত আদর, কিন্তু সে-আদর নিতান্তই মৌখিক। রসের কথা বলে সারী তাদের ভোলাত। যাকে বলে সর্বনাশ সেটা অতিরঞ্জিত। এমনকী সুকুর বেলাও।
সারীর নামে যারা নালিশ করেছিল তাদের লোভ ছিল জমিখানার ওপরে। কারো কারো লালসা ছিল নারীর প্রতিও। হতাশ লোলুপের দল অভিভাবকদের সামনে রেখে হাকিমের এজলাসে দাঁড়ায়। তখন সারীকে সম্পত্তির মায়া কাটিয়ে শহর ছেড়ে যেতে হয়। সুকুর মতো আর যারা আসত তারা সেই দুর্দিনে তার সহায় হল না, যে যার পথ দেখল। কিন্তু সুকু তাকে ছাড়ল না, হাতে হাতে রেখে বলল, ‘একদিন মা-র সঙ্গে গেছলুম, আজ তোর সঙ্গে যাব।’
সারী বলল, ‘আমি কি তোর মা!’
সুকু বলল, ‘মাকে যেমন ভালোবাসতুম তোকেও তেমনি ভালোবাসি।’
সারী রসিয়ে বলল, ‘তেমনি?’
সুকু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ‘দূর। তেমনি মানে কি তেমনি?’
‘তবে কেমনি?’ সারী রঙ্গ করল।
‘এমনি।’বলে সুকু বুঝিয়ে দিল।
তখন তারা পরস্পরের কানে মুখ রেখে একসঙ্গে গান ধরল—
আশা করি বান্ধিলাম বাসা,
সে আশা হৈল নিরাশা,
মনের আশা।
ও দরদি, তোর মনে কি এই সাধ ছিল!
তারপরে রাত থাকতে পথে বেরিয়ে পড়ল।
সারীর এক সই ছিল, বিনোদা গোপিনী। গ্রামে তার বাড়ি। সারী ও শুক সেইখানে নীড় বাঁধল।
বিনোদা বলে, ‘সই, তোর সঙ্গে কি ওকে মানায়! ও যে তোর ভাইয়ের বয়সি।’
সারী বলে, ‘গোপালও ছিল গোপীদের ছোটোভাইয়ের বয়সি। কারো কারো ছোটো ছেলের বয়সি।’
বিনোদা মুখ বেঁকিয়ে বলে, ‘আ মরো! কার সঙ্গে কার তুলনা।’
সারী মাথা দুলিয়ে বলে, ‘যা বলেছিস। তোর বরের সঙ্গে আমার বরের তুলনা!’
আসলে সারীর বয়স অত বেশি নয়, ওটা বিনোদার বাড়াবাড়ি। বিনির মনে কী ছিল তা কিছুদিন পরে বোঝা গেল। সে চেয়েছিল তার দেওরের সঙ্গে সারীর কণ্ঠিবদল ঘটাতে।
সারী অবশ্য ও-প্রস্তাব কানে তুলল না। ফলে বিনোদার আশ্রয় দিন দিন তিক্ত হয়ে উঠল। একদিন শুক-সারী নীড় ভেঙে উড়ে গেল।
এবার গেল ওরা সুকুর চেনা এক দরবেশের বাড়ি। আহার সম্বন্ধে সুকুর বাছবিচার ছিল না, সারীর ছিল। ওরা আলাদা রাঁধে খায়, শুধু ফটিকচাঁদের আখড়ায় থাকে।
দরবেশ অতি সজ্জন। তাঁর ওখানে যারা আসে তারাও লোক ভালো, কিন্তু কী জানি কেন সারীর সন্দেহ জাগল সুকু তাদের একটি মেয়ের প্রতি মুগ্ধ। সুকু সুপুরুষ বলে সারী তাকে সযত্নে পাহারা দিত। অন্য মেয়ের সঙ্গে কথা কইতে দেখলে চোখা চোখা বাণ হানত।
তখন সুকুই অনুনয় করল, ‘চল, আমরা এখান থেকে যাই।’
সারী অভিমানের সুরে বলল, ‘কেন, আমি কি যেতে বলেছি?’
‘না, তুই বলবি কেন! আমিই বলছি। এক জায়গায় বেশিদিন থাকলে টান পড়ে যায়। সেটা কি ভালো!’
‘কীসের ওপর টান? জায়গার না মানুষের?’
এই নিয়ে কথা কাটাকাটি করতে সুকুর মনে লাগে। সে বিনা প্রতিবাদে স্বীকার করে যে সে দুর্বল। তখন সারী তাকে সানন্দে ধরা দেয়।
এমনি করে তারা কত গ্রাম ঘুরল। ঘুরতে ঘুরতে তাদের পুঁজি এল ফুরিয়ে। কারও কাছে তারা কিছু চায়ও না, পায়ও না; নিলে বড়োজোর চালটা আলুটা জ্বালানির কাঠটা নেয়। সারী শৌখিন মানুষ, হাটে কিংবা মেলায় গেলেই তার কিছু খরচ হয়ে যায়। পুঁজি ভাঙতে হয়।
সারী বলে, ‘চল আমরা শহরে যাই।’
সুকু বলে, ‘শহরে!’ বলতে পারে না যে, শহরে আত্মগোপনের সুবিধা নেই, লোকে বংশপরিচয় শুধাবে, পরিচয় দিলে কেউ-না-কেউ চিনবে সে কাদের কুলতিলক।
পাঁচ
যে-শহরে তারা গেল সেটা উত্তরবঙ্গের একটা মহকুমা শহর। পশ্চিমের মতো সেখানে টমটম বা এক্কা গাড়ি চলে। টমটমওয়ালারা পশ্চিমা দোসাদ।
টমটম পাড়ার একধারে পশুডাক্তারখানা। ডাক্তারটি পশুচিকিৎসায় যত-না পারদর্শী তার চেয়ে ওস্তাদ গানবাজনায় ও থিয়েটার করায়। সুকুর চেহারা দেখে ও গান শুনে তিনি তাকে তার ছেলেদের মাস্টার রাখলেন। মাস দুয়েক পরে যখন পশুদের ড্রেসারের চাকরি খালি হল তখন তিনি সাময়িকভাবে সুকুকেই বহাল করলেন।
সুকুর সারাদিনের কাজ হল টমটমের ঘোড়া, চাষিদের গোরু ও বাবুদের কুকুরের ক্ষত পরিষ্কার করে ওষুধ লাগানো ও ব্যাণ্ডেজ বাঁধা। বেচারিদের করুণ চিৎকারে তার কান ঝালাপালা হলে প্রাণ পালাই পালাই করে, কিন্তু পালাবে কোথায়! সে যা রোজগার করে তাই দিয়ে সারী সংসার চালায়। মাঝে মাঝে গৃহস্থের বাড়ি গান গেয়ে সারীও কিছু কিছু পায়। তা দিয়ে কেনা হয় শখের জিনিস।
বেশ চলছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন ডাক্তারবাবুর বদলির হুকুম এল। তাঁর ইচ্ছা ছিল সুকুকে সঙ্গে নিতে, কিন্তু সুকু তো একা নয়। অগত্যা সুকুর যাওয়া হল না। তাঁর জায়গায় যিনি এলেন তিনি গানবাজনার যম। সুকুর কাছে কাজ আদায় করতে গিয়ে তিনি দেখলেন সে আনাড়ি। তাঁর একটি শালা বেকার বসেছিল, সুতরাং এককথায় সুকুর চাকরি গেল।
ইতিমধ্যে টমটমওয়ালাদের সঙ্গে তার ভাব হয়েছিল। তারা তার জন্যে দল বেঁধে দরবার করল। তাতে কোনো ফল হল না, কারণ সুকুর না ছিল যোগ্যতা, না অভিজ্ঞতা, না মুরুব্বির জোর। যা ছিল তা দুর্নাম। তখন টমটমওয়ালারা বলল, আমরাই চাঁদা করে তোমাকে খাওয়াব, তুমি আমাদের গান গেয়ে শোনাবে।
একদিন দেখা গেল সুকু টমটম পাড়ার সভাগায়ক হয়েছে। তার সভাসদ হাড়ি, ডোম, মুচি, দোসাদ, জেলে, মালী প্রভৃতি ইংরেজি শিক্ষায় বঞ্চিত জনগণ। সুকু শুধু গান গায় না, গান ধরিয়ে দেয়। ছত্রিশ জাতের ঐকতান সংগীতে পল্লি মুখর হয়। জলসা চলে রাত একটা অবধি, তারপর সুকু বাসায় ফিরে সারীর পায়ে সঁপে দেয় আধলা পয়সা ডবল পয়সা।
সুকু তার পরিচয় গোপন করেছিল। ভেবেছিল কেউ তাকে চিনবে না। কিন্তু টমটম পাড়ার সভাকবি হবার পরে সে এতদূর কুখ্যাত হল যে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ মাইল দূর থেকে তার জন্যে নিমন্ত্রণ আসতে লাগল। এখানে-ওখানে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে করতে একদিন সে ধরা পড়ে গেল। খবরটা ক্রমে তার বাবার কানে পৌঁছোল। বাবা এলেন না, কাকা এলেন তাকে নিতে।
কাকা এসেই শহরের গণ্যমান্যদের বাড়ি গেয়ে বেড়ালেন ভাইপোর কীর্তি। গণ্যমান্যরা শিউরে উঠলেন। ছি ছি! মেয়েমানুষ নিয়ে ভেগেছে তার জন্যে দুঃখ নেই, কিন্তু ছোটোলোকদের সঙ্গে ছোটোলোক হয়েছে। ছি ছি!
সুকু কাকার কথা শুনল না। ভালোছেলে হল না। তিনি অনেক করে বোঝালেন, লোভ দেখালেন, ভয় দেখালেন। যাবার সময় এমন একটা চাল চেলে গেলেন যার দরুন সুকুকে তুষের আগুনে পুড়তে হল।
সারীর বড়ো গয়নার শখ। কিন্তু কোথায় টাকা যে গয়না গড়াবে। খেতেই কুলোয় না। সারী বোঝে সব, কিন্তু থেকে থেকে অবুঝ হয়। সুকু মনে আঘাত পায়, ব্যথার ব্যথী বলে দ্বিগুণ লাগে। গানের প্রলেপ দিয়ে বুকের বেদনা ঢেকে রাখে। দিন কাটে।
একদিন টমটমওয়ালাদের সভা থেকে সুকু সকাল সকাল ছুটি পেল। সারী যে তাকে দেখে কত খুশি হবে একথা ভাবতে ভাবতে বাসায় ফিরল। বাসায় ফিরে তার মনে একটু খটকা বাঁধল। সে ঠেলা দিয়ে দেখল ভিতর থেকে দ্বার বন্ধ। ডাকল, ‘সারী। ও সারী।’
মিনিট পাঁচ-সাত ডাকাডাকির পর দ্বার যদি-বা খুলল কোথায় সারী! সারীর বদলে কে একজন ঘর থেকে বেরিয়ে এল এবং ঘোমটায় মুখ ঢেকে হনহন করে চলে গেল। চলনটা মেয়েলি নয় মোটেই। সুকু ভেঙে পড়ল। তার মনে হল সে মরে যাবে, বাঁচবে না। মড়ার মতো কতক্ষণ পড়ে থাকল জানে না। যখন জ্ঞান হল দেখল সারী থরথর করে কাঁপছে। কাঁপতে কাঁপতে তার পা ছুঁতে চেষ্টা করছে, কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। সুকু পা সরিয়ে নিয়ে উঠে বসল।
সে একটা রাত। দুজনের একজনেরও চোখে ঘুম নেই, আহারে রুচি নেই, বুকে দুর্জয় রোদন। দুজনেই নিস্তব্ধ, নিশ্চল।
পরের দিন সারীই প্রথম কথা কইল। ‘তাহলে এখন তুমি কী করবে?’
সারী তাকে এই প্রথম ‘তুমি’বলল।
সুকু বুঝতে পারল না। জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকাল।
‘বাড়ি ফিরে যাবে না এখানে থাকবে?’
সুকু ভেবে বলল, ‘যেখানে তুমি সেইখানেই আমার বাড়ি।’
‘কিন্তু দেখলে না? আমি যে বেশ্যা।’
‘তুমি কে তাই যদি জানি তো সব জানলুম। তুমি কী তা তো জানতে চাইনে।’
‘আমি কে?’
‘তুমি রাধা।’
এ উত্তর শুনে সারী স্তম্ভিত হল। এবার ভেঙে পড়বার পালা তার। সে এমন কান্না কাঁদল যে সুকুর মনে হল তার সর্বস্ব চুরি গেছে। অথচ তখনও তার গলায় দুলছিল একছড়া সোনার হার, সদ্যনির্মিত।
ছয়
কাকার চাল ব্যর্থ হল। কিন্তু সারীর নামে যেসব কথা রটল তা কানে শোনা যায় না। সুকুর পক্ষে মুখ দেখানো দায় হল। কিন্তু নিরুপায়। টমটম পাড়ার টিটকারি সে গায়ে মাখে না, ছোটোলোকের রসিকতা মাথা পেতে নেয়।
এমন করে তাদের বেশিদিন চলত না। দৈবক্রমে সে-শহরে এলেন এক ইউরোপীয় পর্যটক, তাঁর সঙ্গে গান রেকর্ড করার যন্ত্র। তিনি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের লোকসংগীত সংগ্রহ করছিলেন। তাঁর সামনে সারী ও শুক উভয়েরই ডাক পড়ল। সারীর গলা তাঁর এত ভালো লাগল যে তিনি তার সাত-আটখানি গান রেকর্ড করলেন। তারপর সেসব রেকর্ড কলকাতার বন্ধুমহলে বাজিয়ে শোনালেন। তাঁর বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন এক রেকর্ড ব্যবসায়ী। তিনি সরাসরি সারীকে লিখলেন কলকাতা আসতে।
সারী এল, তার গান নেওয়া হল। সেসব গানের আশাতীত আদর হল। সাহেবের সার্টিফিকেট না হলে এদেশে বাংলা বইও বিক্রি হয় না। সারীর বরাতে জুটল সাহেবমহলের সুপারিশ। রেকর্ডের পর রেকর্ড করিয়ে সারী স্বনামধন্য হল। তখন তাকে বাস উঠিয়ে আনতে হল কলকাতায়। বলা বাহুল্য সুকু রইল সঙ্গে। তার গান কিন্তু কেউ রেকর্ড করতে চায় না, সাহেবের সুপারিশ নেই।
তারপরে সারী পড়ল এক ফিলম ব্যবসায়ীর সুনজরে। তার রূপের জৌলস ছিল না, কিন্তু রসের চেকনাই ছিল। ভালো করে মেক আপ করলে তাকে লোভনীয় দেখায়। যারা ফিলম দেখতে যায় তারা লোভনকে শোভন বলে ভুল করে। সে ভুলের পুরো সুযোগ পেল সারী। ডিরেক্টর তাকে পরামর্শ দিলেন ফিলমি গান শিখতে। লোকসংগীত ছেড়ে সে ‘আধুনিক’ সংগীত শিখল। কন্ঠের কৃপায় সে তাতেও নাম করল। ধীরে ধীরে সারী তারা হয়ে জ্বলল। চার-পাঁচ বছর পরে যারা তার ফিল্ম দেখল তারা জানল না তার অতীত ইতিহাস।
অবশেষে একদিন শুভলগ্নে সারীর বিয়ে হয়ে গেল কলকাতার এক অভিজাত পরিবারে। কেউ আশ্চর্য হল না, কারণ সারীর আয় তখন হাজারের কোঠায়।
এই ঘটনার কয়েক মাস পরে আমি চেঞ্জ থেকে ফিরছি। ট্রেনে ভয়ানক ভিড়। কোনোখানে একটিও বার্থ খালি নেই। বার কয়েক ঘোরাঘুরি করে আমি প্রায় হাল ছেড়ে দিচ্ছি এমন সময় একটা সার্ভেন্ট কামরা থেকে কে যেন আমাকে ডাক দিল, ‘খোকা? খোকা না?’ আমি পিছন ফিরে দেখি সুকু।
ওর পরনে গেরুয়া আলখাল্লা, মাথায় লম্বা লম্বা চুল, মুখে একরাশ গোঁফ-দাড়ি, গলায় একটা কালো কাঠের কি কালো কাচের মালা। ফিটফাট বেহারা চাপরাশির মেলায় ও নেহাত বেমানান। হাতে একটা একতারা না আনন্দলহরি ছিল, সেটা বাজিয়ে মোটা গলায় গান করছিল একটু আগে—
প্রেম করো মন প্রেমের তত্ত্ব জেনে।
প্রেম করা কি কথার কথা রে গুরু ধরো চিনে।
আমাকে পিছন ফিরতে দেখে সুকু কামরা থেকে নামল। নেমে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে? জায়গা মিলছে না?’
আমি বললুম, ‘এত রাত্রে কে আমার জন্যে জায়গা ছাড়বে?’
সে আমাকে টেনে নিয়ে চলল ফার্স্ট ক্লাসে, যদিও আমার টিকিট সেকেণ্ড ক্লাসের। দরজায় ধাক্কা মেরে বলল, ‘ও-সারী, একবার খুলবে?’
সারীর বদলে সারীর স্বামী দরজা খুললেন। তখন সুকু আমার পরিচয় দিয়ে বলল, ‘একটু কষ্ট করতে হবে এর জন্যে। আমার বাল্যবন্ধু।’
ভদ্রলোকের মুখে পাইপ, হাতে ডিটেকটিভ নভেল ও পরনে সিল্কের স্লিপিং সুট। ভদ্রমহিলার পরনেও তাই, উপরন্তু রংচঙে ড্রেসিং গাউন। তাঁরা বোধহয় শয়নের উদ্যোগ করছিলেন।
সে-রাত্রে আর কথাবার্তা হল না। আমি উপরের বার্থে সসংকোচে নিদ্রার ভান করে পড়ে রইলুম। কিছুতেই ঘুম আসে না। ভোরবেলা আসানসোল স্টেশনে সুকু এসে আমার খোঁজ করল। তার সঙ্গে প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করতে করতে তার কাহিনি শুনলুম। বাকিটুকু বর্ধমানে ও ব্যাণ্ডেলে।
হাওড়ায় শেষ দেখা। বিদায়ের আগে সুকুকে জিজ্ঞাসা করেছিলুম, ‘তোর পৌরুষ বিদ্রোহী হয় না? তোর আত্মসম্মান নেই?’
সুকু উত্তর দিয়েছিল, ‘ও যে রাধা!’
What Is SEO? This is a common question that most people especially those who are either new or not familiar with online marketing might be asking. SEO stands for search engine optimization. clipping path service
ReplyDelete