মূকাভিনয় – দিব্যেন্দু পালিত

মূকাভিনয় – দিব্যেন্দু পালিত

মূকাভিনয় সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে কিছু বলার আগে একটু ভূমিকা করে নেওয়া দরকার। তাতে ঘটনাটা বুঝতে সুবিধে হবে অনেকেরই।

বাঁধা মাইনের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে আমি যখন হঠকারিতার পথ বেছে নিলুম, ঠিক সেই সময়ে আলাপ হয়েছিল অবাঙালি এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল আমার এক সাংবাদিক বন্ধু।

খবরের কাগজে নিয়মিত একটা ফিচার লেখার বিষয়ে আলাপ করতে গিয়েছিলুম বন্ধুর। অফিসে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে এটা ওটা কথা বলতে বলতে সে আমাকে বসিয়ে রাখল অনেকক্ষণ পরে, একটা টেলিফোন সেরে, বলল, ‘কাগজে ফিচার লেখার চেয়ে প্রফিটেবল একটা ব্যাপার ভেবে রেখেছি তোমার জন্যে একটু ঘোরাঘুরি করতে হবে। তবে কাজটা তোমার খারাপ লাগার কথা নয়। পয়সা আছে, অভিজ্ঞতাও বাড়বে অনেক। আপাতত মাস চার-পাঁচেক কাজ। ভদ্রলোক আসছেন এখুনি, আলাপ করে দ্যাখো।’

মূল ব্যাপারটা সে আর একটু বিস্তৃত করলা ভদ্রলোকের নাম গণেশ মানকড়া আসছে বোম্বাই থেকে এর একটা নাটকের দল আছে। কিন্তু সাধারণত যে সব নাটকের দলের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে, এদের ভূমিকা তার চেয়ে আলাদা। এরা মূকাভিনয় করো।

এতোক্ষণ আমি ছিলাম নীরব শ্রোতা কিন্তু এবার একটু খটকা লাগতে কয়েকটা প্রশ্ন নাড়া দিল মনো প্রধানত, এ ব্যাপারে আমি কোন কাজে লাগতে পারি।

মূকাভিনয় সম্পর্কে কিছু কিছু তথ্য জানা ছিল। নাট্যাভিনয়ের এই ধরনটির তেমন চল না থাকলেও এর আবিষ্কার সেই রোমান যুগো শব্দের অর্থ মানুষের কাছে ঠিকঠাক বোধগম্য হবার আগেই বোধ্য ছিল অনুভূতি ও অভিব্যক্তি শুধু অভিব্যক্তিময়, নির্বাক অভিনয় করে রোমানযুগে অভিনেতারা ব্যক্ত করতেন নিজেদের ভূমিকা। মুগ্ধ, অশিক্ষিত জনগণ সেইসব অভিব্যক্তির সঙ্গে সহজেই বিনিময় করতেন নিজেদের। পরে, কথার আধিপত্য বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে, লোকে গ্রহণ করতে শেখে সবাক অভিনয়। মূকাভিনয়ের দিন শেষ হয়ে যায় ক্রমশ

সন্দেহ নিরসন করল বন্ধু। গণেশ মানকড়ের দলটি পেশাদার এবং মূকাভিনয়ে এদের বেশ নামডাক আছে। ভ্রাম্যমাণ প্রধানত গ্রামাঞ্চলে, শিক্ষিতের সংখ্যা যেখানে কম, এরা মূকাভিনয় প্রদর্শন করে বেড়ায়। অভিনয়ের বিষয় প্রায়ই শিক্ষা বা প্রচারমূলক। ইতিমধ্যেই এরা উত্তর ও পশ্চিম ভারত ঘুরে এসেছে— রূপায়িত করেছে দু’একটি সরকারি পরিকল্পনাও। এবার পশ্চিম বাংলায়।

অসুবিধে হলো, বাংলা ভাষাটা গণেশ মানকড়ের আয়ত্তে নেই ভাঙা-ভাঙা কিছু কথ্য বুলি যদিও শিখে ফেলেছে এরই মধ্যো ওদের চাই একজন ভাষ্যকার—পরিকল্পনার প্রয়োজন বুঝে যে রচনা করবে ভাষ্য, মুহূর্ত ও নাট্যবস্তু।

কিছুক্ষণের মধ্যে আলাপ হলো গণেশ মানকড়ের সঙ্গে। প্রাথমিক পরিচয়ের পর সে আমার হাতে একটি কার্ড গুঁজে দিল। আইভরি বোর্ডের ওপর কালোয় ছাপা সুদৃশ্য কার্ড গণেশ মানকড়, প্যান্টোমাইমিস্ট, ডিরেক্টর, মাইম’ বয়স চল্লিশ-বেয়াল্লিশের মধ্যে, দীর্ঘ ও সুদর্শন, কথাবার্তায়, বিশেষত ইংরিজি বলায়, বেশ তুখোড়া লোকটির আদবকায়দা ও আচরণে এমন কিছু আছে যা সহজেই আকর্ষণ করে। পোশাকেও দুরস্ত। এই লোকের বেশিরভাগ সময়ই যে গ্রামে-গ্রামে কাটে, সহজ বুদ্ধিতে তা বিশ্বাস্য মনে হয় না।

সাধারণত চাপা স্বভাবের মানুষ আমি ভাবালুতা প্রশ্রয় দিই না চট করে এবং সিদ্ধান্ত নেবার হলে বেশ ভেবেচিন্তেই নিই। কিন্তু আগেই বলেছি, এই ভদ্রলোক, গণেশ মানকড়, তার সহজাত প্রতিভা দিয়ে মুগ্ধ করতে পারে অকপটে ও প্রায় প্রথম সাক্ষাতেই। তেমন করে কিছু ভেবে ওঠার আগে আমিও বশীভূত হলুম। গণেশ আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেল তার হোটেলে।

বলতে ভুলে গেছি, বন্ধুর অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়িতে হোটেলে আসার সময়েই গণেশ তার যথাসম্ভব জ্ঞান নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছিল বাংলায় বুঝলুম, আঞ্চলিক ভাষায় সে যতোটা সম্ভব রপ্ত হয়ে নিতে চাইছে—এইভাবেই এর আগে সে আয়ত্ত করে নিয়েছে দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তরের ছ’সাতটি ভাষা। কথা হচ্ছিল হোটেলে বসে বম্বের এক ভিটামিন খাদ্যপ্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের হয়ে গ্রামে গ্রামে তাদের তৈরি জিনিসের প্রচার চালাতে চায় গণেশা গ্রামের লোকের হাতে কিছু পয়সা আছে, কিন্তু আধুনিক খাদ্যপ্রণালী ও ভিটামিনের সঙ্গে তেমন পরিচয় নেই তাদের রোগ, অপুষ্টি ইত্যাদি ব্যাপারগুলোতে তারাই বেশি ভোগে। টিনের ভিটামিন গ্রহণের অভ্যাস শহরাঞ্চলে বেশ চালু হলেও এ-সবের প্রকৃত বাজার হলো গ্রামাঞ্চল, গ্রামের মানুষ। কিন্তু আধুনিক প্রচারমাধ্যমগুলির পক্ষে সম্ভব নয় গ্রামের একেবারে ভিতর পর্যন্ত ঢুকে আধুনিকতম এই স্বাস্থ্যার্জন প্রণালীর দিকে মানুষের চোখ ফেরানো দৈনন্দিন জীবনধারণে এগুলির উপযোগিতা বুঝিয়ে বস্তুগুলি ক্রয়ের দিকে তাদের আকৃষ্ট করা। মূকাভিনয় এই কাজটি ভালোভাবেই পারবে। কারণ, চড়া গলার যাত্রাভিনয়ের সঙ্গে পরিচিত গ্রামের মানুষের কাছে এটা হবে একেবারেই নতুন ব্যাপার উদ্দেশ্য ব্যবসায়িক হলেও সেটা আসছে পরে। মহারাষ্ট্র থেকে উত্তরপ্রদেশ ও বিহার হয়ে মানকড় এখন পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগুলি কভার করবে। মাস চারেকের প্রোগ্রাম। এখান থেকে যাবে আসামে।

মানকড় এবার আসল কথায় এলো তাদের দলের সদস্য সোল জন, তার মধ্যে জন তিনেক বাঙালিও আছে। তারা অভিনেতা, অভিনেত্রী। অসুবিধে হয়েছে ভাষ্য-রচনা নিয়ে অভিনয় চলাকালে পর্দার আড়াল থেকে শ্রোতা ও দর্শকদের সুবিধের জন্যে দরকার ধারাবিবরণীর। আমি যদি সেই কাজটা নিই।

বিষয়টি কৌতূহল সৃষ্টি করছিল আমার মধ্যে পারিশ্রমিকের অঙ্কও মন্দ নয়। সে তুলনায়, বলা উচিত, কাজ কমই। মোটামুটি রাজী হয়ে গেলাম। মানকড় আমাকে অভিনয়ের বিষয়গুলি বুঝিয়ে দিল।

পরের দিন সে আমাকে নিয়ে গেল মহড়া দেখাতে।

এটাকে গল্পের ভূমিকা হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে কিন্তু আমার নিজেরই সন্দেহ আছে এটা গল্প কি না। বস্তুত গল্পের পরিকল্পনা নিয়ে এই রচনার কথা ভাবা হয়নি আমার লক্ষ্য মূকাভিনয়ের সূত্রে পাত্র-পাত্রীদের কিছু চরিত্র অবলোকনা এই করতে গিয়ে প্রথমেই যেটা চোখে পড়ে তা হলো, মূকাভিনেতারা সাধারণ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের থেকে রীতিমতো আলাদা।

মানকড় নিজে এক অভিজাত হোটেলে উঠলেও তার দল উঠেছে ভবানীপুর অঞ্চলে একটি পুরনো বাড়িতে অনেক গলিঘুজি পেরিয়ে যেতে হয় সেখানে বাড়িটি চারতলা। নিচে স্কুল, আশপাশে ঘন জনবসতি তিনতলা সিঁড়ি ভেঙে উঠে চারতলাটি বিরাট হলঘর আকারের হতে পারে কখনো-সখনো বিয়ের জন্যেও ভাড়া দেওয়া হয়। সময়টা বিকেল, ছুটি হয়ে গেছে স্কুল। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে তাই একটা গা-ছমছম-করা স্তব্ধতা ঘিরে ধরে আমাদের প্রায় পোড়ো বাড়ির শূন্যতায় ছড়িয়ে আছে পায়রার বিষ্ঠার গন্ধ সিঁড়িময় ধুলো, আমাদের পদশব্দে লুকানো ঘুলঘুলি থেকে জানলা দিয়ে উড়ে যায় কয়েকটি পায়রা।

এটা মূকাভিনয়ের পটভূমি তৈরির চেষ্টা নয়া আসল ব্যাপারটি আসে পরে।

ছাদের ঘরটি বেশ বড়ো ধুলো ও আসবাবহীনতায় আরো বড় দেখায়। গোটা দু’তিন নড়বড়ে চেয়ার অবশ্য ছিল ঘরে ঢুকেই চোখে পড়ল একটা বিজাতীয় রূপ মুখে রঙমাখা জন চার-পাঁচ পুরুষ ও নারী—তাদের কেউ উবু হয়ে বসে আছে ধুলোয়, কেউ চেয়ারে আমাকে সহ মানকড়কে ঢুকতে দেখে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল লোকগুলি—আচরণে তৎপরতা বা অভ্যর্থনা প্রকাশ পেল না কোনো। বরং যেভাবে উঠে দাঁড়াল এবং বিভিন্ন স্থান থেকে একত্র হয়ে এলো, তাতেই হঠাৎই অন্য একটা ভাবনা এসে যেতে পারে মনে—দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত কয়েকজন অপরাধী ঘাতকের আবির্ভাবে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল।

কোনো আনুষ্ঠানিক পরিচয় দানের প্রয়োজন বোধ করল না মানকড়া ঘরে ঢোকার থেকে পরবর্তী কাজের মধ্যে ব্যবধান ছিল একটি সিগারেট ধরানোর, তারপরেই একটি স্বতঃস্ফুর্ত যান্ত্রিকতায় অভ্যস্ত তার বাচনভঙ্গি শোনা গেল, ‘স্টোরি নাম্বার থ্রিা অ্যাকশন—’

ঘটনাটি দেখবার মতো নির্দিষ্ট জায়গা থেকে প্রায় চারফুট দূরত্বে লাফিয়ে এলো কুশীলবদের একজন বলাই বাহুল্য, পুরুষ, সেই লাফের বিশিষ্টতা অর্জন কোনো মহিলার পক্ষে সম্ভব নয়। মঞ্চের অভাবে ধুলোমাখা মেঝেই তখন মঞ্চ। লোকটি তার হাত, পা, সমগ্র শরীর ও বিশেষত চোখের ভঙ্গিমায় ফুটিয়ে তুলছে অমানুষিক রূপ। মানকড় আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলল, ‘লোকটি বাড়ি ফিরছে সারাদিন লেবারের পর। কিন্তু অপুষ্টিতে হাঁটতে পারছে না—

মানকড়ের সূত্র থেকে কাহিনীক্রম তখন এগিয়ে গেছে আরো অনেক দূর—ঠিক সেই সময়ে ঘরের দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যুবতীটি এগিয়ে এসেছে লোকটির শুশ্রষায়, বোঝা গেল স্ত্রী মূর্ত তার অভিনয়ে যন্ত্রণার চেয়ে বেশি স্পষ্ট অসহায়তা—এবার সে একটি হঠাৎ-মৃত্যু প্রত্যক্ষ করবে প্রতিবেশীরাও সমবেতা প্রায় মিনিট দশেক এইভাবে চলার পর মৃত প্রথম অভিনেতাটিকে অন্যান্য প্রতিবেশীরা কাঁধে তুলে নিয়ে যাবার সময় মানকড় হঠাৎই চেঁচিয়ে উঠল, ‘বল, হরি…হরি বল…’। মূকাভিনেত্রীর মুদ্রায় বিভ্রম ঘটল না কোনো, ধূসর মেঝেয় সে তখনো মাথা ঠুকে চলেছে ক্রমাগত।

নরেনবাবু, আপনি যে লাফটা দিলেন তা হয়েছে হনুমানের মতো—’অভিনেতা-অভিনেত্রীরা আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবার পর মানকড় বলল, ‘শালা মরবার আগে যদি এইসে লাফ দিবেন তো মালনিউট্রিসনের ফিকির কি।’ যাকে বলা হলো সেই প্রথম অভিনেতা নরেনবাবুর চোখে কিছু বা অস্বস্তি ফুটে উঠল, আর কিছু নয়। অন্যরাও কথায় ফিরল না। মানকড় তখনো অন্যান্যদের খুঁটিনাটি উদ্ধার করছে। মেয়েটির নাম রাধা। হঠাৎই প্রত্যক্ষ করলুম, মূকাভিনয়ের এইসব পাত্র পাত্রীরা অভিনয়ের বাইরেও প্রায় স্তব্ধতায় বিশ্বাস করে। এতোটা সময়ের মধ্যে আমি একটিই অত্যন্ত মৃদু উচ্চারণ শুনলুম, মেয়েটির গলায়, ‘আমার চিরুনিটা কোথায়?

‘এক একটা শোয়ে এমন দশ থেকে বারো স্টোরি প্রেজেন্ট করা হয়—’ ফেরার পথে মানকড় আমাকে বোঝাতে শুরু করল, প্রত্যেক স্টোরিতেই একটা লেসেন আছে, দ্যাটিজ, আল-প্রোটিন হেলথ ভালো রাখার পক্ষে খুব জরুরি। তবে হ্যাঁ, রিভিসন দরকার—আই উড শো ইউ দ্য স্ক্রিপ্টস ডেথটা হাইলি মেলোড্রামাটিক—কী মনে করেন? পাবলিসিটি অ্যাসপেক্টটাও দেখতে হবে তো।’

আমি সায় দিলুম। পরের দিন থেকেই লেগে যেতে হলো স্ক্রিপ্ট তৈরির কাজে। আর দিন পাঁচ সাতের মধ্যেই বেরুতে হবে আমাদের।

মূকাভিনয়ের তাৎপর্য ও ধরন-ধারণ বিষয়ে ইতিমধ্যেই হয়তো কিছু ধারণা করা যাচ্ছে। এটা অভিনয়ের একটা ধরন মাত্র কিন্তু আমি ঠিক বলতে পারব না, মূকাভিনয়ের পাত্র-পাত্রীদের সঙ্গে অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের অভিনয়ের পাত্র-পাত্রীদের প্রভেদ ঠিক কোনখানে শুরু হয়। কিংবা, এ কথাও বলা খুব কঠিন, অভিনয় প্রত্যক্ষভাবে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চরিত্রে কোনো পরিবর্তন আনে কি না। সাধারণত আনে না। কিন্তু খুব নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি আমি, মানকড়ের দলের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চরিত্রে ও আচরণে সেই সময়েই আমি কিছু কিছু বৈচিত্র্য লক্ষ করেছিলুম-সাধারণ মানুষের চরিত্রোচিত ব্যবহার ও আচরণের সঙ্গে প্রায়ই যার পার্থক্য ঘটে যায়। প্রথমত, অভিনয়ের ক্ষেত্র ছাড়াও এঁরা কথা বলেন খুব কম এবং প্রায়ই বলেন না। আর যেটুকু বলেন সবই ভঙ্গির মাধ্যমে দ্বিতীয়ত, এঁরা নিঃসঙ্গ থাকতে ভালোবাসেনা এই দ্বিতীয় ব্যাপারটিই পরবর্তী কয়েক দিনে বিশেষভাবে চোখে পড়ে। এমন কি মাইম’ দলের সদস্যদের দু’জন, নরেনবাবু ও রাধা—স্বামী-স্ত্রী, যেটা পরে শুনেছিলুম মানকড়েরই মুখে—স্বামী-স্ত্রী হয়েও পরস্পরের মধ্যে রেখে চলেন এক অস্বাভাবিক দূরত্ব, যেটা যে-কোনো সাধারণ বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মনেই বিভ্রম সৃষ্টি করতে পারে।

যা বলছিলুম, মূকাভিনয়ের দলটির সঙ্গে গ্রামে-গ্রামে ‘আল-প্রোটিন’-এর প্রচার চালানোর কাজে বেরিয়ে পড়ার আগে দিন পাঁচ-ছয় নাট্যরূপ রচনার কাজেই ব্যস্ত থাকতে হলে আমাকে। নাট্যরূপ, ভাষ্য ও কিছু কিছু নেপথ্য সংলাপ। এ সবের জন্যে দৈনিক এক নাগাড়ে তিন-চার ঘণ্টা আমাকে কাটাতে হতো মানকড়ের সঙ্গে, তার হোটেলে সেখান থেকে রিহার্সালের জন্যে যেতে হতো ভবানীপুরের সেই পুরনো স্কুলবাড়ির ছাদে ইতিমধ্যে দলটির সঙ্গে প্রায় পরিচিত হয়ে গেছি। নরেনবাবু, রাধা, দুলি, কেষ্ট, শিউশরণ, রাজিন্দর পাঁড়ে, বুন্দেলকার, পদ্মা, যুগল— পরিচিত হয়ে গেছি এইসব নামের সঙ্গে। ভারী অদ্ভুত এই পরিচয়—যেখানে দূরত্ব থেকেই গড়ে ওঠে সম্পর্ক, অধিকাংশ বিনিময়ই চলে নৈঃশব্দ্যের মধ্যে দু’একদিন যাবার পরই এদের ধরন ধারণ আচরণ হাঁফিয়ে তুলছিল আমাকে, ঠিক বুঝতে পারছিলুম না এর কারণ কি! মানকড়ের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতাই কি এই মানুষগুলিকে আমার প্রতি ইঙ্গিতময় করে রাখে! এটা ঠিক, চঞ্চল হবার আগেই মানকড়ের এদের প্রচি আচরণ ক্ষমতাবান প্রভুর মতো একপেশে ও কঠোর কিছু বা বক্রও এটা একটা কারণ হতে পারে, নাও হতে পারে। বস্তুত, ইতিমধ্যে একধরনের ভয়ও আমাকে গ্রাস করতে শুরু করেছিল। লক্ষ করছিলুম, ইদানীং আমি নিজেও কথা বলছি কম, কিংবা বলছি ঠিক ততোটুকুই, যতোটা না বললেই নয়। লক্ষ করছিলুম, জিব ও ঠোঁট চঞ্চল হবার আগেই চঞ্চল হয়ে ওঠে আমার অন্যান্য অবয়ব প্রায় জোর করেই এইসব সময় নাড়া দিতুম নিজেকে, যাতে ফিরে পাই ব্যক্তিত্ব।

সম্ভবত আমরা একটা গল্পের মধ্যে চলে যাচ্ছি। কিন্তু আগেই বলেছি, এটা গল্প নয়। তবে ইচ্ছে করলে এই সব ছোটোখাটো অভিজ্ঞতা ও ঘটনা থেকেই যে গল্পের আবহ তৈরি করা যায় না, তা নয়। কমবেশি—তখনই মনে হয়েছিল আমার—এরা সকলেই এক-একটি চরিত্র এবং যতোই ক্ষুদ্র হোক, এদের প্রত্যেকেরই ইঙ্গিত-ভারাক্রান্ত দিনযাপনের আড়ালে কোনো-না-কোনো ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। বিশেষত মানকড়—সে নিজেই একটি চরিত্র। একটি ঘটনার উল্লেখ করা এখানে বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। মূকাভিনয়ের দলটির গতিবিধি সম্পর্কে আমাকে একেবারে অস্পষ্ট রাখা হলেও কাজের সময় ছাড়াও কোনো-না-কোনো ভাবে মানকড় যে এদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে সে-বিষয়ে আমার সন্দেহ ছিল না কোনো। কলকাতায় থাকতে থাকতেই একদিন এই সূত্রে আমি একটি বিরল ঘটনা প্রত্যক্ষ করি।

মানকড় সাধারণত সময় মেনে চলতে অভ্যস্ত। প্রতিদিনই ফেরার আগে সে আমাকে জিজ্ঞেস করে নিত পরের দিন ঠিক কোন সময়ে আমি আসবা যতোদূর সম্ভব আমি এই সময় মেনে চলতুম। যেদিনের কথা বলছি সেদিন নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় আধঘণ্টা আগেই আমি হোটেলে পৌঁছুই নির্দিষ্ট কোনো কাজের অভাবে মানকড়ের ঘরের দরজায় ‘ডু নট ডিসটার্ব’-এর নোটিস ঝোলানো ব্যাপারটাকে তেমন গুরুত্ব না দিয়েই সহজ বাঙালিপনায় অভ্যস্ত আমি কলিং বেল টিপি, কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করি, কোনো সাড়াশব্দ মেলে না। হয়তো অবেলায় ঘুমুচ্ছে এ রকম একটা ধারণা থেকে পুনরায় কলিং বেল ব্যবহার করার কিছুক্ষণের মধ্যে দরজা খোলে এবং অল্প-ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয় মানকড়ের বিরক্ত মুখ—

‘হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট? নোটিস দ্যাখেননি?’

‘একটু আগেই এসে পড়েছি–’, বিব্রত গলায় বলি আমি

মানকড়ের বিরক্ত মুখের পরিবর্তন হয় না। সোজাসুজি তাকিয়ে পরিষ্কার গলায় বলল, ‘তাহলে অপেক্ষা করুন লবিতে ঠিক সময়ে আমি ডাকব আপনাকে।’

সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় দরজা এবং সশব্দে। শব্দই বুঝিয়ে দেয় ঘটনাটি কতো অপমানজনক। লবির দিকে যেতে যেতে একটা প্রতিক্রিয়া শুরু হয় আমার মধ্যে, ভাবি, ফিরে যাওয়াই সঙ্গত। তবু কোনোরকমে নিরস্ত করি নিজেকে, নানা কথা বুঝিয়ে। আসলে আমার প্রয়োজনই আমাকে নিরস্ত করতে থাকে। একটা সিগারেট ধরিয়ে বিষণ্ণ আমি লবিতে ঘোরাফেরা করতে করতেই দেখতে পাই রাজিন্দরকে—মাইম’ গ্রপের এই যুবকটির উল্লেখ সম্ভবত আগেই করেছি। উত্তরপ্রদেশের এই যুবকটি ও তার বোন পদ্মা অনেকদিন কাজ করছে। মানকড়ের সঙ্গে শুনেছিলুম পদ্মা বিধবা এবং রাজিন্দরও সম্পূর্ণ অশিক্ষিত—যদিও মূকাভিনয়ে তাদের অভিজ্ঞতা অনেকদিনের। সে যাই হোক, চোখাচোখি হতেই সম্পূর্ণ অজ্ঞাত কারণে রাজিন্দর আমাকে এড়িয়ে যেতে তৎপর হয়ে ওঠো অভিনয়ের সময়েই শুধু নয়, রাজিন্দরের স্বাভাবিক পদক্ষেপেও একটা পা টিপে চলার ভঙ্গি আছে। সম্ভবত ব্যক্তিগত জীবন থেকেও এরা। শব্দকে বাদ দিতে চায়।

অপেক্ষা ক্লান্ত করে তুলছিল। ফলে নির্দিষ্ট সময়ের চার-পাঁচ মিনিট আগেই ফিরে যাই মানকড়ের ঘরের কাছে, অদূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। আর তখনই চোখে পড়ে ঘটনাটা দেখি, মানকড়ের ঘর থেকে এস্ত পায়ে বেরিয়ে আসছে পদ্মা এবং তার পিছনে একটি রোমশ হাত দরজায় ঝোলানো ডু নট ডিসটার্বের নোটিসটা তুলে নিচ্ছে। আমাকে দেখেই করিডোরের মধ্যে থমকে দাঁড়ায় পদ্মা কাঁধ থেকে হাত দুটো চল্লিশ ডিগ্রি রেখায় ছড়িয়ে পড়ে দু’ পাশে, শক্ত হয়ে ওঠে মুঠো এবং বিস্ফারিত হয়ে ওঠে চোখ দুটি সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে যায় আমার স্টোরি নাম্বার সেভেন, সিকোয়েন্স থ্রিা বস্তুত, এই দৃশ্যে পদ্মা হাততালি পাবার মতোই অভিনয় করে।

মূকাভিনয়ের পাত্র-পাত্রীদের চরিত্র অবলোকন করতে গিয়ে এরকম আরো অনেক ঘটনাই আমি প্রত্যক্ষ করি এ-রকম একটি খণ্ড রচনায় তার সব বিবরণ পেশ করা সম্ভব নয়। তবে দু’একটা ঘটনা হয়তো এখানেও উল্লেখের দাবী রাখে।

প্রথমটি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অনশন ধর্মঘট।

ঘটনাটি ঘটেছিল ফুলবেড়িয়া গ্রামে। এই গ্রামটিকে কেন্দ্র করে আশপাশের চার-পাঁচটি অঞ্চলে সে সময় আমরা শো করে বেড়াচ্ছি। জায়গাটার একটা সুবিধে ছিল গ্রাম-গাঁ হলেও এখানে বিদ্যুতের অভাব নেই কোনো এবং রাস্তাঘাটও মোটামুটি ভালো। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের একটি অর্ধসমাপ্ত পাকা বাড়িতে ক্যাম্প পড়ল আমাদের নিজে আলাদা থাকার সুবাদে মানকড় আমার জন্যেও একটু আলাদা ব্যবস্থা করেছিল। আলাদা মানে ঐ আর কি—মেঝের বদলে তক্তপোেশ, কাঁচের গ্লাসে জল, ইত্যাদি। তিনবেলা খাবার আসে কাছাকাছি এক গ্রাম্য রেস্তোরাঁ থেকে।

কেষ্ট নামে একটি ছেলে ছিল আমাদের দলে, বাংলা ও হিন্দি দু’ভাষাতেই কথা বলতে পারত এবং প্রায়ই মিশিয়ে এলাহাবাদের ছেলে। অভিজ্ঞতা বলে, দলের মধ্যে সেই যা একটু সবাক ছিল। বিপত্তি ঘটল তাকে নিয়েই।

জায়গার নাম বাণী। হ্যাজাক জ্বালিয়ে শো হবে। এই ধরনের অনুষ্ঠান জমানোর জন্যে যা করণীয় সকাল থেকেই বেরুতে হয় চোঙা নিয়ে ঘোষণায়, হাতে লেখা পোস্টারে লেই লাগিয়ে টাঙাতে হয় থানা, বাজার, বি-ডি-ও অফিস ও পোস্টাপিসের দেয়ালে। এ কাজগুলো কেষ্টই করত। অভিনয়ের জায়গায় পৌঁছে সমস্ত ব্যাপারটা একবার সরেজমিনে তদন্ত করে নিত। মানকড়া

সেদিন শো শুরু হবার সময় পেরিয়ে যেতেও লোকজন না আসায় রীতিমতো ব্যস্ত হয়ে পড়ল মানকড়া অভিনেতা-অভিনেত্রীরা মেকআপ নিয়ে তৈরি, পোর্টেবল মাইক্রোফোন সাজিয়ে আমিও তৈরি—এরকম হতাশা থেকে মাঝে মাঝে ‘হ্যালো’ ‘হ্যালো’ করে যাচ্ছি। তাতে দু’চারজন আগাছা কিশোর সমবেত হলেও কাজের কাজ কিছু হলো না। বলতে ভুলে গেছি, এ-ধরনের প্রচার কার্যের সাফল্যের প্রমাণ গ্রাম-প্রধানের সীলসহ সার্টিফিকেটা খোঁজ নিয়ে জানা গেল তিনি কাছেই থাকেন। তাঁর কাছে খোঁজখবর করতেই জানা গেল শো-এর ব্যাপারে কেউ কিছু জানে না, এমন কি তাঁর কাছেও কেউ আসেনি। একটুক্ষণ বিব্রত থেকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে মানকড় তাঁকে কী বোঝালো কে জানে, দেখলুম খড়ম পায়ে তিনি গুটি গুটি চলেছেন শো-এর জায়গায়। তাঁর পিছনে পিছনে ক্রমশ জড়ো হতে লাগল আরো কিছু লোক। তখন নিজেই মাইক্রোফোন। তুলে নিয়ে পরিত্রাহি গলায় চ্যাঁচাতে লাগল মানকড়, ‘ভাইসব, বোনসব—এ গ্রামের বিলকুল মেয়েপুরুষ সব লোকজন—চলে আসুন, দলে দলে আসুন দেখুন কেমন মজা হয়, যাত্রা হয়, নাটক হয় দেখুন বোবা মেয়েছেলে, পুরুষ ছেলে কেমন লাফালাফি, কাঁদাকাঁদি করে— ইত্যাদি। উৎসাহী ছেলে-ছোকরাও কিছু জুটে গেল দলে। মেয়ে-পুরুষের মোটামুটি ভিড় জমতে শো শুরু হলো, কেষ্টর দেখা নেই তখনো। দুটো স্টোরির মাঝখানে অল্প বিরতিতে থমথমে মুখে মানকড় বলল, বানচোত যাবে কোথায়! ওর লাশ ফিরত যাবে এলাহাবাদে!’

বস্তুত ঘটলও তাই। সেদিন শো-এর পর ক্যাম্পে ফিরে পাওয়া গেল কেষ্টকে। নেশা ক’রে চুর জানা গেল স্টেশনের কাছাকাছি কোথাও গড়াগড়ি যাচ্ছিল রাস্তায়। পোস্টারের বান্ডিল সমেত একজন তুলে দিয়ে গেছে ক্যাম্পে।

মানকড় সম্ভবত এইরকম একটি দৃষ্টান্তের অপেক্ষাতেই ছিল। কেষ্টকে দেখার পর যে রূপে ও ভূমিকায় সে নিজেকে আবির্ভূত করল তা নিশ্চিত কোনো মানুষের নয়। আরো আশ্চর্য, মূকাভিনয়ের পাত্র-পাত্রীরাও ক্রমাগত দেখিয়ে গেল প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে তাদের অদ্ভুত সংযম— চাবুকের আঘাতে একটি নেশাগ্রস্ত যুবকের চামড়া ফুটে রক্ত বেরুনোর মতো বিস্ময়কর দৃশ্য যেন আর হতেই পারে না।

মানকড় চলে যাবার পর আমি একটু একা হলুম। একা, কেননা মূকাভিনেতা নই। বাড়ির সামনে একটিতে পড়ে আছে ক্ষতবিক্ষত মানুষ, মৃত নয় বোঝা যায় মাঝে মাঝে তার এপাশ ওপাশ মাথা নাড়া দেখো তবে অর্ধমৃত নিশ্চয়ই। দেখলুম, একে একে তার পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে অন্যরা, মূক। লোকটিকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো ঘরে। গলার স্বর শুনে বোঝা গেল না কে ফাস্ট-এড বক্সের খোঁজ করছে। দীর্ঘ সময় পরে পরে কথা বলার ফলে এদের কণ্ঠস্বরের প্রাথমিকতা কখনোই জড়তামুক্ত হয় না এবং প্রায়ই উচ্চারিত হয় স্তব্ধতা মিশিয়ে

পরের দিন সকালে জানা গেল পুরো দলটিই ধর্মঘট শুরু করেছে। রাতে পরিবেশিত খাদ্য পড়ে রয়েছে যেমন কে তেমন, ছোঁয়নি কেউ। ঘরে ও বারান্দায় কাছাকাছি দূরত্ব রেখে বসে আছে কয়েকটি মেয়ে ও পুরুষ, চোখেমুখে ও বসার ভঙ্গিতে সুস্পষ্ট ক্লান্তি, গত সন্ধ্যার রঙ মুছে না। ফেলায় মুখগুলি আরো কিম্ভুত লাগে। যাকে নিয়ে এতো কাণ্ড, সেই কেষ্টকে সম্ভবত আগলে রেখেছে কোথাও।

আমি তৃতীয় পক্ষ, স্বভাবতই দূরে দূরে থাকছি। দায় মানকড়ের, ব্যাপারটার গুরুত্ব আঁচ করেই সম্ভবত নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে সে বেলার দিকে একটা বোঝাপড়ার জন্যে নরেনবাবু ও বুন্দেলকারকে ডেকে পাঠিয়েছিল ঘরে, সেই সময় তাদের মধ্যে চাপা গলায় কিছু কথাবার্তা হয়, কিন্তু কাজের কাজ হয় না কিছুই প্রমাণ, অনশনকারীরা স্থান পরিবর্তন করেনি—গত রাতের পর সকালে যাকে যেখানে দেখা গিয়েছিল পরেও দেখা যাচ্ছে সেখানে চা জলখাবার ছোঁয়নি, খাবার ছোঁয়নি। এখানে মাছির রাজত্ব। এইভাবে দুপুর গড়িয়ে গেল।

আজ রাতের শো হবে কি না বোঝা যাচ্ছে না। চিন্তাগ্রস্তভাবে মানকড়ের ঘরে ঢুকে দেখলুম হুইস্কির গ্লাস হাতে নিয়ে, মাথা ঝুঁকিয়ে সে বসে আছে চুপচাপা কথাটা জিজ্ঞেস করতে অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘আই ডোন্ট নো—’

এর কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজার সামনে পর পর দেখা যায় শিউশরণ, বুন্দেলকার ও নরেনবাবুকে। একটু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে তারা ঢুকে পড়ে ঘরে—পিছনে পিছনে আরো কয়েকজন অর্ধচন্দ্রাকারে মানকড়কে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপা আমি সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি, কেননা, এই প্রথম একটি উপলব্ধি আমার শরীরে শীতের অনুভূতির মতো বিশিষ্ট হতে থাকে মূকাভিনয়ের প্রচণ্ডতা যে ভাষার চেয়ে বেশি কার্যকর তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। অস্পষ্ট রঙমাখা মুখগুলির প্রত্যেকটি চোখে একই রকম অভিব্যক্তি, একই অভিব্যক্তি দাঁড়ানোর ও হাত মুঠো করার ভঙ্গিতে মানকড়ের চোখ ক্রমাগত ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের মুখের ওপর প্রায় মিনিট দশেক এইভাবে কাটানোর পর উঠে দাঁড়ালো মানকড়, হাত জোড় করল এবং বলল, বাবা, মাফ কর দেও। আর এমন হবে না–’

বুন্দেলকারের ইঙ্গিতে লোকগুলি তখনই প্রস্থান করল, একে একে, নিঃশব্দে। প্রস্থানের এই মূক ভঙ্গিতে এক ধরনের বিষণ্ণতা আছে—যা অতর্কিতে শব্দের সৃষ্টি করে, এবং স্বস্তির সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করা যায় বহুদূর আকাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া অদৃশ্য প্লেনের মতো এক দূরত্ব।

সেদিন রাতে আর শো হয়নি। মানকড় নিজেই বন্ধ করেছিল।

দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটেছিল চব্বিশ পরগণা ভ্রমণের সময়। এই ঘটনাটির খুঁটিনাটি আমার খুব ভালো করেই মনে আছে, কারণ এই ঘটনার পরেই বিক্ষুব্ধ আমি মূকাভিনয়ের দল ছেড়ে চলে আসি।

সেবারও ক্যাম্প পড়েছিল একটি স্কুলে এটিকে বেস বলা হয়—এটিকে কেন্দ্র করে বিশ বাইশ মাইল দূর পর্যন্ত এক-একটি জায়গায় শো অনুষ্ঠিত হয়। স্কুলবাড়ির এক প্রান্তে দু’টি ঘরে থাকি আমি আর মানকড়, আরেক প্রান্তে অন্যান্যরা। অসুস্থতার কারণে সেদিন আমি দু’তিনটি স্টোরি কভার করেই চলে আসি বেসে আমাদের যাতায়াতের জন্যে একটি জীপ ও একটি স্টেশন ওয়াগনের ব্যবস্থা ছিল জীপটি আমাকে পৌঁছে দিয়ে আবার ফিরে যায় শো-এর জায়গায়। অসুবিধা হবার কথা নয়। ইতিমধ্যেই শুনে শুনে বিভিন্ন সিকোয়েন্সের ভাষ্য রপ্ত করে নিয়েছিল মানকড় জানতুম অশুদ্ধ উচ্চারণে হলেও ধারাবিবরণীর কাজ সেদিনের মতো সে নিজেই চালিয়ে নিতে পারবে।

পরবর্তী সময়প্রবাহ বিষয়ে হুঁশ ছিল না কোনো। তবু হঠাৎই, ঘুমের মধ্যে ঘুম ভেঙে উঠে বসি আমি। একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছি অনেকক্ষণ ধরে কর্কশ ও থমথমে, শব্দটা অনুসরণ করে ঘর থেকে বেরিয়ে মানকড়ের ঘরের সামনে পৌঁছে যাই। দরজা বন্ধ। বাইরের অবিমিশ্র অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে একটি লোক। কিছুক্ষণের মধ্যেই চেনা গেল তাকে—নরেনবাবু। সম্ভবত দরজায় আঘাত করছিল।

বিষয়টা বোধগম্য হচ্ছিল না কিছুতেই। কী হয়েছে’ জিজ্ঞেস করাতে অস্ফুট উচ্চারণে লোকটি কী বলল বোঝা গেল না, তারপরেই কপাল চাপড়াতে শুরু করল দু’হাতে সেই মুহূর্তের আচ্ছন্নতাই সম্ভবত জ্ঞানশূন্য করে তুলল আমাকে বন্ধ দরজায় আঘাত করতে করতে চেঁচিয়ে উঠলুম, মানকড়, মিস্টার মানকড়–দরজা খুলুন—’

দরজা খুলল একটু পরে। মানকড় নিজেই খুলল। সে কিছু বলবার আগেই লণ্ঠনের আলোয় চোখে পড়ল, তক্তপোশের ওপর কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে বসছে রাধা। এটা গ্রাম, কলকাতার হোটেল নয়—মানকড়ও সম্ভবত ঘটনার আকস্মিকতায় হতচকিত হয়ে উঠেছিল, নাহলে সে আগের মতোই আত্মবিশ্বাসে তিরস্কার করে উঠত। এই অব্যবস্থার সুযোগে আমরা সবাই ঢুকে পড়েছি ঘরের মধ্যে।

কিন্তু, পরবর্তী ঘটনার জন্যে আমি আদৌ প্রস্তুত ছিলুম না। ঘরের অস্পষ্ট আলোয় লক্ষ করলুম, নরেনবাবুর হাতে ছুরি—মানকড়ের থেকে গজখানেক দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে সে, অদ্ভুত ভঙ্গি শরীরের, সমগ্রভাবে প্রস্তুত মনে হয় এর পরেই সমবেত দর্শকদের হাততালিতে মুখর হয়ে উঠবে পরিবেশ আতঙ্কজনক অবস্থা কী করব বুঝতে না পেরে স্তম্ভিতভাবে দাঁড়িয়ে থাকলুম আমি।

মানকড় বা রাধার সম্পর্কে এখানে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। আমি লক্ষ করছি নরেনবাবুকে। মূকাভিনেতার শ্রেষ্ঠ অভিব্যক্তি তার চোখে—খুন করার আগেই সে পরিপূর্ণভাবে খুনীকে গ্রহণ করে নিতে পারে চোখে অভিব্যক্তিই এখানে চূড়ান্ত হয়ে ওঠো খুন করার পর অনুতপ্ত খুনী যা যা করে, নরেনবাবুর সেই মুহূর্তের আচরণে সেইসব ধারাবাহিকতায় ত্রুটি ঘটল না কোনো। ছুরিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সে কপালের ঘাম মোছার ভঙ্গি করল, চলে গেল দূরত্বে—তারপরেই চকিতে পিছনে ফিরে রাজহাঁসের ডানা ঝাড়ার মতো লম্ববান দুটি হাত কাঁপতে কাঁপাতে ঘুরতে লাগল আমাদের চারদিকে

এতোক্ষণে চেঁচিয়ে উঠল মানকড়, নরেনবাবু!’ সেই চিৎকার সফল মূকাভিনেতার একাগ্রতায় বাধা পড়ল না কোনো। মেঝেয় হাঁটু মুড়ে বসে সে তখন মৃতের জন্যে শোক করতে ব্যস্ত।

আমার হুশ হলো পরে, যখন প্রায় আর্তনাদ করে চেঁচিয়ে উঠল রাধা, ‘পাগল—ও পাগল হয়ে গেছে—’বলেছি তো, সেদিন আমি ফিরে আসি।

No comments