ধ্যাততেরিকা সংসার – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
মনে মনে আমরা পরস্পর পরস্পরকে ঠেলছি। ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইছি। আমার পথ থেকে তুমি সরে যাও। প্রয়োজনে আমাদের এক চেহারা। মুখে মিষ্টি সম্বোধন। ভাই বলে কাঁধে হাত। বাড়িতে এলে সব্যস্ত চিৎকার, ওরে চা চাপা, চা। পাঁপড় ভাজ মুচমুচে করে। ফুলকো লুচি, কড়কড়িয়া আলুভাজা। প্রয়োজন যেই ফুরিয়ে গেল, কেউ কাউকে চিনি না। প্রাচীন প্রবাদ আজও সমান সত্য :কাজের সময় কাজি, কাজ ফুরোলেই পাজি।
যার ভূতের ভয়, সে বাইরে গেলে মানুষ খোঁজে। আয় ভাই, তোরা যে যেখানে আছিস, আমাকে ঘিরে বোস। জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকালেই গা ছমছম করছে। একা যে। আমি শুতে পারি না। ভয়ে ঘুম আসে না। তোমরা যে-কেউ একজন আমার পাশে শোও। যেই ভোর হল, দিনের আলো ফুটল, গেট আউট, বেরোও।
বাইরে বেড়াতে যাব। বড় একা। দিনকাল সুবিধের নয়। চলো হে, আমার সঙ্গে চলো। বায়ু। পরিবর্তন হবে। আমি বেশ গোছগাছ করে ট্রেনের জানালার ধারে বসি। তুমি মালপত্তর তুলে বাঙ্কে গুছিয়ে রাখো। ভাড়াটাড়া মেটাও। স্টেশানে স্টেশানে চা ধরো। মাঝেমধ্যে ভালো ভালো খাবারদাবার। তুমি আমার ম্যানেজার। তুমি আমার প্রাণের বন্ধু। তাই তো সদলে চলেছি বায়ু। পরিবর্তনে। চোর-ডাকাতের ভয় আছে। প্রাদেশিকতার সমস্যা আছে। সেই কারণে বিদেশে। লোকবলের প্রয়োজন আছে। এই যে আঁতাত, এ কিন্তু চিরকালের নয়। সে ভুল কোরো না। উঁচু পদে চাকরি করি বলে, ফিরে এসেই ছেলের চাকরির কথা যেন বোলো না। ও আমার দ্বারা হবে না। তখন আবার অন্য প্রদেশের মানুষের চরিত্র তুলে আমার চরিত্র খাটো করার চেষ্টা কোরো না। তাদের একজনও কেউ কোথাও ঢুকলেই হল। দেশোয়ালি ভাইয়ে দপ্তর ছেয়ে যায়, ও সব সেন্টিমেন্টাল কথা বলে, আমাকে নীতিভ্রষ্ট করার চেষ্টা কোরো না। আমি বাঙালি। আমি আমার ছাড়া কারুর নই। একমাত্র আমার সন্তানের জন্যে, আমার পরিবারের জন্যে আমি কিছু করতে পারি। তোমরাও তাই করো না। কে বারণ করেছে? মুরুব্বি ধরা এক ধরনের অপরাধ। বাঙালি, নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখো। সেলফ-মেড হও। শুধু আমার দাঁড়াবার সময় তোমার পদযুগল আমাকে ধার দিও।
আমাকে ধান্দাবাজ বলাটা মনে হয় ঠিক হবে না। আমি বিশ্বাস করি, সুযোগ মানুষের জীবনে একবারই আসে। মাছের মতো। কাত করে এক চেষ্টায় ধরতে না পারলে পিছলে পালিয়ে যাবে অন্যের এলাকায়। পলাতক ভাগ্য, পলাতক যৌবন, কে না ধরে রাখতে চায়। আমি মধ্যবিত্ত, ইংরেজের তৈরি। অন্যের কাঁধে চড়ে পূর্বপুরুষদের ঘুরে বেড়াতে দেখেছি। কী ভীষণ হম্বিতম্বি। তাকেই নাকি বলা হত বাঘের মতো ব্যক্তিত্ব। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপমারা গোটাকতক চোতা হাতে এলেই মহাপণ্ডিত। কথায় ইংরেজির ফুলকি। অহমিকায় চোখ-মুখ বিকৃত। বিলেত গেলে তো কথাই ছিল না। সে সবই এখন ব্যঙ্গবিদ্রুপের বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপের আর সে দাম নেই। কেতাবের চেয়ে জীবন যে অনেক বেশি মূল্যবান, সেই সত্যটি ঝুলি ফুড়ে বেরিয়ে পড়েছে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার লম্ভ মারছেন, আমিই সব। মিস্ত্রি মুচকি হাসছেন, জনাব এগিয়ে এসো না, দেখি কেমন রড বাঁধতে পারো। ফিজিক্সের বাঘ হন্যে হয়ে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি খুঁজছেন। মিচিগান থেকে বাড়তি ন্যাজ এনেছেন। আমেরিকান অধ্যাপক-বন্ধু অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন—ব্যাপারটা কী? তুমি এত বিচলিত কেন ইন্দু? পাখা ঘুরছেনা সাহেব। চেয়ারে উঠে কলকবজা নেড়ে ঘুরিয়ে দাও। তুমি তো পদার্থবিজ্ঞানী? ওটা মিস্ত্রির কাজ সাহেব। আমি থিয়োরি জানি। পাখা কেমন করে ঘোরে, সাত পাতার থিসিস লিখে দিতে পারি; কিন্তু পাখা খুলে মেরামত জীবনে করিনি। নেভার। ইন মাই লাইফ। পূর্বপুরুষের এই ধারাই চলে আসছে। মানুষ দু-খোপে ঢুকে আছে—একদলের সাদা কলার, হোয়াইট কলারড, আর একদল ওই কুলিকামারি, চাষাভুসো, হেটোমেঠো। মেমসাহেব নাকিসুরে বলেন, ফিলদি, সাহেব হেঁড়ে গলায় বলেন, স্কাম অফ দি আর্থ। ব্যাটারা কোনওদিন মানুষ হবে না। বুঝলে এডুকেশান ছাড়া কোনও জাত এগোতে পারে না। সেন্ট পারসেন্ট এডুকেশান চাই।
সাহেব চোখ কপালে তুলে, চিবুক উঁচিয়ে হাত-পা নেড়ে থিয়েটারের ভঙ্গিতে বললেন, এডুকেশান মেকস এ ম্যান। লুক অ্যাট জুপ্যান, অস্ট্রিয়া, সুইডেন, ইউ.কে, ইউ. এস. এ. ইউ. এস. এস.। আর.। এই নাটকীয় আত্মবমনের পর শিশুপুত্রের দিকে নজর পড়ে যেতেই চিৎকার করে। উঠলেন, ওপাশের জানালাটা খুলেছিস কেন রাসকেল। বন্ধ কর। বন্ধ কর। ওই আমতলার বস্তি ছেলেমেয়েদের আর মানুষ হতে দেবে না দেখছি। নুইসেনস অ্যান্ড ভালগার। বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দাও।
ভদ্রলোক জিনিসটা কী?
এ গুড পেরেন্টেজ। ভালো পিতামাতার সন্তান। এ গুড বংশপরিচয়।
ভালো পিতামাতা মানে?
মানে রেসপেকটেবল। মাননীয়। সভায় বসলে বক্তা ভাষণ দিতে উঠে যাঁকে বলেন, মাননীয় সভাপতি, মাননীয়প্রধান অতিথি।
মানুষ মাননীয় হয় কীভাবে?
বেশ পুঁজিপাটা থাকা চাই। রেস্তোর জোর। বাড়ি, বিষয়-সম্পত্তি, হাঁকডাক, স্তাবক, উমেদার। অক্ষরজ্ঞান থাকলে তো কথাই নেই। একে শিক্ষিত, তায় বড়লোক। যেন গোদের ওপর বিষ ফোঁড়া! সেকালে শিক্ষার চেয়ে বাহুবল আর ধনবলেই মানুষ মানুষ হত। চিঠি আসত, মাননীয় অমুক, তলায় বিনয়াবনতের দল। একালের বাঙালির ধন কোথায়? সবই তো ঠনঠনিয়া, ঢনঢনিয়াদের হাতে চলে গেছে। পূর্বপুরুষের ভিটেয় কোথাও ভাঙা গাড়ি মেরামতির কারখানা, কোথাও জয় মা-কালী চোলাইখানা, কোথাও বহুতল বাড়ির পাদপীঠ, স্কাইস্ক্র্যাপার, মেঘালয়, নীলকমল, জলকমল, হলকমল! একালের রিয়েল ভদ্দরলোক সেইরকম কোনও খুপরিতে বসবাস করেন। একেশ্বরবাদী। বসের ভজন, বসামৃত পান। গণেশের পূজারী হলে আমলাদের পীঠস্থানে হত্যা প্রদান। নেতার ভজনা। চামচা সেবা।
তোমরা দূরেই থাকো। শুধু রাতের অন্ধকারে ওয়াগন ভেঙে গুদাম ভরে দাও, পার্কের রেলিং খুলে এনে আমার ঢালাই কারখানায় ফ্যালো। আমি ব্ল্যাকে-হোয়াইটে টু-পাইস কামিয়ে আরও ওপরে। উঠে মেঘলোকের কাছাকাছি। প্রায় বিমান। নীল আকাশ পরিষ্কার বাতাস। তোমরা আমার জন্যে পথের মিছিলে ঘোরো। আমার আসন পাকা হোক। আমার স্ত্রীকে চিকিৎসার জন্যে ভিয়েনা পাঠাই, ছেলেকে সায়েব করার জন্যে ডাওহিলে। তোমরা স্লোগান তোলো। বিনা চিকিৎসায় মরো। তোমাদের সন্তানসন্ততিদের তুলে দাও সমাজবিরোধীদের হাতে। সমাজবিরোধী সমাজের বিরোধী হলেও আমাদের বিরোধী নয়।
ভালো মানুষ, ভালো মানেই বোকা মানুষ। তাঁরা সব ঠ্যালা খেয়ে সরে গেছেন। কোথায় তাঁরা! নির্জন প্রবাসে। সংসারে থাকলে একঘরে। অফিসে থাকলে ইউনিয়নের বাইরে। সংসারের বাইরে থাকলে, হয় কোনও আশ্রমে, অথবা কোনও তীর্থে। সংসার দুলছে ঝড়ের খেয়ার মতো। ভাই ভাইকে বলছে, তুই আমার নাম্বার ওয়ান এনিমি। স্বামী স্ত্রীর পদসেবী। দ্যাখো নারী বড়ো প্রলোভন। সরে পোড়ো না। কী আশায় বাঁধি খেলাঘর। নেতা চালাচ্ছেন বিপ্লব, বিপ্লব।
ধ্যাততেরিকা সংসার। সবাই বললে, মানুষকে বিশ্বাস কোবরা। বিশ্বাস করে কী পাওয়া গেল? বিশ্বযুদ্ধ, অসম, বিষম, অর্থনীতি। ঝোলটানার দল, ঝোলছাড়ার দল। পাওয়া গেল গলাবাজি, দলবাজি। পাওয়া গেল অবিশ্বাসী নেতা, অত্যাচারী মাস্তান, মানুষমারা মাফিয়া। পাওয়া গেল। সংবিধানহীন সংবিধান।
ধ্যাততেরিকা সংসার। বসে আছি একপাশে। খঞ্জনি হাতে। নাম গাই তাঁর। যিনি মানুষের চিরবিশ্বাসে আছেন। যাঁকে পাওয়ার চেয়ে না-পাওয়াতেই সুখ।
Post a Comment