জুটি – সত্যজিৎ রায়

জুটি – সত্যজিৎ রায়

আজ আমি একজন ফিল্মস্টারের কথা বলতে যাচ্ছি, চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন তারিণীখুড়ো।

কে তিনি? তাঁর নাম কী? আমরা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম।

তাঁর নাম তোরা শুনিসনি, বললেন তারিণীখুড়ো। তিনি যখন রিটায়ার করেন তখন তোরা সবে জন্মেছিস।

তবু আপনি নামটা বলুন না, বললে নাছোড়বান্দা ন্যাপলা। আজকাল টেলিভিশনে অনেক পুরনো ফিল্মস্টারের ছবি আমরা দেখি।

তাঁর নাম হল রতনলাল রক্ষিত।

তা হলে তো ভালই হল, বললেন তারিণীখুড়ো। তাঁকে ছবিতে দেখে থাকলে গল্পটা আরও জমবে।

এটাও কি ভূতের গল্প? ন্যাপলা জিজ্ঞেস করল।

না, ভূত নয়। তবে ভূত বলতে তো শুধু প্রেতাত্মা বোঝায় না, ভূতের আরও মানে আছে। একটা মানে হল অতীত, অর্থাৎ যা ঘটে গেছে। ভবিষ্যতের উলটো। সেই অর্থে এটা ভূতের গল্প বলতে পারিস।

বেশ, তা হলে শুরু হোক।

তাকিয়াটাকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে তারিণীখুড়ো শুরু করলেন তাঁর গল্প—

রতন রক্ষিত রিটায়ার করেন ১৯৭০-এ সত্তর বছর বয়সে। শরীরটা হঠাৎ ভেঙে পড়েছিল, তাই ডাক্তার বললেন কমপ্লিট রেস্ট। তার আগে পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে একটানা অভিনয় করে গেছেন রক্ষিতমশাই। তার মানে সেই সাইলেন্ট যুগ থেকে। অগাধ টাকা করেছিলেন ছবি করে, আর সেই টাকার সদ্ব্যবহার কী করে করতে হয় সেটাও জানতেন। তিনখানা বাড়ি ছিল কলকাতায়। নিজে থাকতেন আমহার্স্ট স্ট্রিটে, আর অন্য দুখানা ভাড়া দিয়ে দিয়েছিলেন।

এই রতন রক্ষিত কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন যে, তাঁর একজন সেক্রেটারি চাই। আমি তখন কলকাতাতেই ছিলাম, বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। সারাজীবন টো টো করে ঘুরে নানান রোজগারের পন্থা ট্রাই করে সবে ভাবছি এবার ঘরের ছেলে যখন ঘরে ফিরেছি তখন সেটল করা যায় কিনা, এমন সময় বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়ল। দিলুম অ্যাপ্লাই করে। রতন রক্ষিতের নামের সঙ্গে যথেষ্ট পরিচয় ছিল, ভদ্রলোকের ছবিও দেখেছি বিস্তর। তা ছাড়া আমার যে সিনেমার প্রতি একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ আছে। সেটা তো তোরা জানিস।

দরখাস্তের রিপ্লাই এসে গেল সাতদিনের মধ্যে। আমার ডাক পড়েছে ইন্টারভিউ-এর জন্য।

গিয়ে হাজির হলুম রক্ষিত মশাইয়ের বাড়িতে।

জানি ভদ্রলোকের শরীর খারাপ, কিন্তু চেহারা দেখে সেটা বোঝার কোনও উপায় নেই। বেশ টান-টান চামড়া, ঝকঝকে দাঁতগুলো ওরিজিন্যাল বলেই মনে হল। প্রথমেই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন তাঁর ছবি দেখেছি কিনা। বললুম, পরের দিকের ছবি তো দেখেইছি, গোড়ার দিকেরও কিছু সাইলেন্ট ছবি দেখা আছে, যখন রক্ষিত মশাই কমিক ছবি করতেন।

উত্তর শুনে দেখলুম ভদ্রলোক খুশিই হলেন। বললেন, আমি গত কয়েক বছর ধরে আমার সব সাইলেন্ট ছবি সংগ্রহ করছি। আমার এই বাড়িতে একটি আলাদা ঘর আছে যেখানে এইসব ছবি দেখার জন্য একটা প্রজেক্টর বসিয়েছি এবং সে প্রজেক্টর চালাবার জন্য একটি লোকও রেখেছি। সাইলেন্ট ছবি আজকাল প্রায় পাওয়াই যায় না। জানেন তো, ফিল্মের গুদামে দুবার দুটি অগ্নিকাণ্ডে প্রায় সব বাংলা সাইলেন্ট ছবি পুড়ে যায়, ফলে সে সব ছবি এখন দুষ্প্রাপ্য। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। আমি কাগজে বিজ্ঞাপন দিই। তার ফলে জানতে পারি যে আমার অনেকগুলো সাইলেন্ট ছবি মীরচান্দানি নামে আমার এক প্রোডিউসারের গুদামে সযত্নে রাখা আছে। তার কারণ আর কিছুই না, মীরচান্দানি যে শুধু আমার প্রোডিউসার ছিলেন তা নয়; তিনি ছিলেন আমার ফ্যান। মীরচান্দানি মারা গেছেন বছর চারেক আগে; তার ছেলেকে বলে আমি ছবিগুলো কিনে নিই। এই ভাবে বার বার কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে আমি আমার সংগ্রহ তৈরি করি। অসুস্থতার জন্য আমাকে রিটায়ার করতে হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ফিল্মের জগৎ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা অসম্ভব। এইসব পুরনো ছবি দেখে আমার সন্ধ্যাগুলো দিব্যি কেটে যায়। আপনার কাজ হবে আমার এই ফিল্ম লাইব্রেরির তদারক করা, ছবিগুলোর একটা ক্যাটালগ তৈরি করা, আর আমার সংগ্রহে নেই এমন ছবি খুঁজে বার করা। পারবেন তো?

আমি বললাম, চেষ্টার ত্রুটি হবে না। যেগুলো রয়েছে সেগুলোকে ক্যাটালগ করে ঠিক করে রাখা কঠিন কাজ নয়; যে ছবি নেই, তার সন্ধানের কাজটা অবিশ্যি সহজ নয়। রক্ষিত বললেন, আমি যে শুধু সাইলেন্ট ছবির কথা বলছি তা নয়, গোড়ার দিকের কিছু টকি ছবিও আমার সংগ্রহে নেই। আমার মনে হয় ধরমতলা পাড়ায় প্রযোজক-পরিবেশকদের অফিসে খোঁজ করলে সেসব ছবি নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। মোটকথা, আমার সংগ্রহে যেন কোনও ফাঁক না থাকে। বুড়ো বয়সে আমার অবসর বিনোদনের পন্থাই হবে আমার নিজের পুরনো ছবি দেখা।

চাকরি হয়ে গেল। অদ্ভুত মানুষ। ভদ্রলোকের স্ত্রী মারা গেছেন বছর পনেরো হল। দুই ছেলে আছে, দুজনেই থাকেন দক্ষিণ কলকাতায়। এক মেয়ে থাকে এলাহাবাদে, স্বামী সেখানকার ডাক্তার। নাতি-নাতনিরা মাঝে মাঝে আসে দাদুর সঙ্গে দেখা করতে; ছেলেরাও যে আসে না তা নয়, তবে ফ্যামিলির সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই বললেই চলে। বাড়িতে থাকে দুটি চাকর, একটি রান্নার লোক, আর একটি খাস বেয়ারা, নাম লক্ষ্মীকান্ত! লক্ষ্মীকান্ত বাঙালি, বয়স ষাটের উপর এবং অত্যন্ত অনুগত। এমন একজন বেয়ারা পাওয়া খুব ভাগ্যের কথা।

এবং লক্ষ্মীকান্তের সাহায্যে কাজ করে আমি দিন দশেকের মধ্যে রক্ষিত মশাইয়ের সংগ্রহের একটা ক্যাটালগ করে দিলাম। তা ছাড়া ধরমতলায় ঘুরে উনি টকির আদি যুগে যে সব ছবি করেছিলেন তার অনেকগুলোর হদিস জোগাড় করে দিলাম। ভদ্রলোক সেগুলোর একটা করে প্রিন্ট কিনে নিজের। লাইব্রেরিতে রেখে দিলেন।

আমার কাজ দশটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত; কিন্তু মাঝে মাঝে সন্ধ্যাটাও রক্ষিত মশাইয়ের সঙ্গে কাটিয়ে যাই। সাড়ে ছটায় ভদ্রলোক ছবি দেখতে শুরু করেন, থামেন সাড়ে আটটায়। প্রোজেকশনিস্টের নাম আশুবাবু, বয়স পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন, কাজে কোনও ক্লান্তি নেই। দর্শক মাত্র তিনজন–রক্ষিত মশাই, বেয়ারা লক্ষ্মীকান্ত, আর আমি। বেয়ারাকে থাকতে হয়, কারণ বাবু গড়গড়ায় তামাক খান; সেই তামাক মাঝে মাঝে ফিরিয়ে দিতে হয়। তবে লক্ষ্মীকান্ত যে ছবিগুলো উপভোগ করে সেটা অন্ধকারে তার মুখের দিকে চেয়ে আমি বুঝেছি।

সবচেয়ে মজা লাগে যখন সাইলেন্ট যুগের ছবিগুলো দেখানো হয়। আগেই বলেছি যে রতন রক্ষিত সেই সময় হাসির ছবি করতেন। এইসব ছবির মধ্যে অনেকগুলো ছিল যাকে বলে শর্ট ফিল্ম। দু রিলের। ছবি, কুড়ি মিনিট ছিল তাদের দৈর্ঘ্য। এই ছবিতে দেখানো হত লরেল-হার্ডির মতো এক জুটির কীর্তিকলাপ। ছবিতে তাদের নাম ছিল বিশু আর শিবু। বিশু সাজতেন রতন রক্ষিত, আর শিবুর পার্ট করতেন শরৎ কুণ্ডু নামে এক অভিনেতা। দুই কমিক অভিনেতার হইহুল্লোড়ে বিশ মিনিট দেখতে দেখতে বেরিয়ে যেত। কখনও তারা ব্যবসাদার, কখনও জুয়াড়ি, কখনও সার্কাসের ক্লাউন, কখনও জমিদার আর মোসাহেব–এইরকম আর কি? কুণ্ডুরক্ষিতের এই জুটি তখন খুব পপুলার হয়েছিল এটা মনে আছে। বড় ছবির আগে এই কুড়ি মিনিটের শর্ট ফিল্ম দেখানো হত।

এই ছবি চলার সময় দেখবার জিনিস হত রক্ষিত মশাইয়ের হাবভাব। নিজের ভাঁড়ামো দেখে তিনি নিজেই হেসে গড়িয়ে পড়তেন। কোনও কমিক অভিনেতা যে নিজের অভিনয় দেখে এত হাসতে পারে, এটা বিশ্বাস করা কঠিন। তাঁর দেখাদেখি অবিশ্যি আমাকেও হাসতে হত। রক্ষিত মশাই বলতেন, জানো তারিণী, এইসব ছবি যখন করেছি, তখন এগুলো দেখে মোটেই হাসি পায়নি। বরং নির্লজ্জ ভাঁড়ামো দেখে বিরক্তই লাগত। কিন্তু এতদিন পরে দেখছি এর মধ্যে একটা নির্মল হাস্যরস আছে, যেটা আজকের হাসির ছবির তুলনায় অনেক ভাল।

একটা প্রশ্ন কিছুদিন থেকে আমার মাথায় ঘুরছিল, একদিন সেটা রক্ষিত মশাইকে জিজ্ঞেস করে ফেললাম। বললাম, একটা ব্যাপারে আমার একটু কৌতূহল হচ্ছে; আপনি তো বিশু সাজতেন, কিন্তু শিবু যিনি সাজনে সেই শরৎ কুণ্ডুর কী হল? তাঁর সঙ্গে আপনার কোনও যোগাযোগ নেই?

রক্ষিত মশাই মাথা নেড়ে বললেন, আমি যতদূর জানি, শরৎ কুণ্ডু সাইলেন্ট যুগের পর আর ছবিতে অভিনয় করেনি। আমরা যখন একঙ্গে কাজ করেছি তখন আমাদের দুজনের মধ্যে যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল। ভেবে ভেবে নানারকম ভাঁড়ামোর ফন্দি বার করতুম দুজনে। ডিরেক্টর যিনি ছিলেন তিনি নামকাওয়াস্তে। ছবির সঙ্গে মালমশলা সব আমরাই জোগাতুম। তারপর একদিন কাগজে দেখলুম হলিউডের ছবিতে শব্দ যোগ হচ্ছে, পাত্র-পাত্রীরা এবার থেকে কথা বলবে, আর সেই কথা দর্শকে শুনতে পাবে। সেটা ছিল ১৯২৮ কি ২৯ সাল। যাই হোক, হলিউডে সত্যিই টকি এসে গেল। আমাদের এখানে আসতে লাগল আরও তিন-চার বছর। সে এক হইহই ব্যাপার। সিনেমার খোলনলচে পালটে গেল। তার সঙ্গে অভিনয়ের রীতিও। আমার কিন্তু একটা থেকে আরেকটায় যেতে কোনও অসুবিধা হয়নি। গলার স্বরটা ভাল ছিল, তাই টকি আমাকে হটাতে পারেনি। তখন আমার বয়স ত্রিশ-বত্রিশ। বাংলা ছবিতে সুকণ্ঠ হিরোর দরকার। সেই হিয়োর পার্টে আমি অনায়াসে খাপ খেয়ে গেলুম। বিশ মিনিটের ভাঁড়ামোর যুগ শেষ হয়ে গেল। আমি হয়ে গেলাম ছবির নায়ক। কিন্তু সেই সময় থেকেই শরৎ কুণ্ডু কেমন যেন হারিয়ে গেল। যদূর মনে পড়ে, দু-একজনকে জিজ্ঞেসও করেছিলুম ওঁর কথা, কিন্তু কেউ সঠিক জবাব দিতে পারেনি। লোকটার অকালমৃত্যু হয়েছিল কিনা কে জানে।

তাই যদি হয়, তা হলে অবিশ্যি অনুসন্ধান করার কোনও মানে হয় না। কিন্তু আমার মনে তাও একটা খটকা থেকে গেল। ঠিক করলুম যে শরৎ কুণ্ড সম্বন্ধে খোঁজখবর চালিয়ে যেতে হবে। সত্যি বলতে কি, বিশ মিনিটের ছবিগুলো দেখে একটা জিনিস বুঝতে পারছিলাম যে, কমিক অভিনেতা হিসেবে রতন রক্ষিতের চেয়ে শরৎ কুণ্ডু কোনও অংশে কম ছিলেন না।

টালিগঞ্জ পাড়ায় ঘোরাঘুরি করে জানলুম যে নরেশ সান্যাল বলে এক ভদ্রলোক বাংলা ফিল্মের আদিযুগ নিয়ে রিসার্চ করছেন। ইচ্ছে, একটা প্রামাণ্য বই লেখার। ভদ্রলোকের ঠিকানাটাও জোগাড় হল। তারপর এক রবিবার সকালে তাঁর বাড়িতে গিয়ে হাজির হলুম। ভদ্রলোক বললেন যে, হ্যাঁ, শরৎ কুণ্ড সম্পর্কে কিছু তথ্য তাঁর জানা আছে। বছর পাঁচেক আগে একবার অনেক খোঁজ করে তাঁর বাড়িতে গিয়ে শরৎ কুণ্ডুর একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন সান্যাল মশাই। সে বাড়ি কোথায়? আমি জিজ্ঞেস করলুম। গোয়াবাগানের এক বস্তিতে, বললেন সান্যাল মশাই। ভদ্রলোকের তখন চরম দুরবস্থা।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, আপনি কি সাইলেন্ট যুগের অভিনেতাদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন নাকি?

খুব বেশি তো বেঁচে নেই, বললেন সান্যাল মশাই। যে কজন রয়েছেন তাঁদের নিতে চেষ্টা করছি।

আমি রতন রক্ষিতের কথা বলে দিলাম, আর বললাম যে, তাঁর সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা আমি করে দিতে পারি। ভদ্রলোক তাতে বেশ উৎসাহ প্রকাশ করলেন।

এর পর আমি আসল প্রশ্নে চলে গেলুম।

টকি আসার পর কি শরৎ কুণ্ডু আর ছবিতে অভিনয় করেননি?

আজ্ঞে না, বললেন নরেশ সান্যাল। ভয়েস টেস্টেই ভদ্রলোক বাতিল হয়ে যান। তারপর যে কী করেছেন সেটা ভদ্রলোক খোলাখুলি বললেন না। মনে হল খুবই স্ট্রাগল গেছে, তাই নিজের কথা বেশি বলতে চান না। তবে সাইলেন্ট যুগ সম্বন্ধে অনেক তথ্য আমি ভদ্রলোকের কাছে পেয়েছি।

এর পর টালিগঞ্জ পাড়ার আরও কয়েকজন পুরনো কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানলুম যে, টকি আসার পরেও বেশ কয়েক বছর শরৎ কুণ্ডু সিনেমা পাড়ায় নিয়মিত যাতায়াত করতেন। সে-সময় ওঁর অবস্থা নাকি খুব খারাপ। টালিগঞ্জেরই মায়াপুরী স্টুডিওর ম্যানেজার ধীরেশ চন্দর সঙ্গে কথা বলে জানলুম যে, শরৎ কুণ্ডু নাকি মাঝে মাঝে ছবিতে একার পার্ট করে পাঁচ-দশ টাকা করে রোজগার করতেন। এইসব পার্টে অভিনেতা সাধারণত ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকে; তার কথা বলার কোনও দরকার হয় না।

এই মায়াপুরী স্টুডিওতেই দ্বারিক চক্রবর্তী বলে এক বৃদ্ধ প্রোডাকশন ম্যানেজার আমাকে বললেন, বেনটিঙ্ক স্ট্রিটে নটরাজ কেবিনে গিয়ে খোঁজ করুন। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত সেখানে আমি শরৎ কুণ্ডুকে দেখেছি।

শরৎ কুণ্ডুকে বিস্মৃতির অন্ধকার থেকে টেনে বার করার জন্য নটরাজ কেবিনে গিয়ে হাজির হলাম। এর মধ্যে–একথাটা বলা হয়নি–গোয়াবাগান বস্তিতে গিয়ে খোঁজ করে জেনেছি যে শরৎ কুণ্ডু আর সেখানে থাকেন না। এটাও বলা দরকার যে, আমার উৎসাহের সঙ্গে তাল রেখে চলেছেন রক্ষিত মশাই। ছোঁয়াচে ব্যারামের মতো তাঁরও এখন ধ্যান জ্ঞান চিন্তা হল শরৎ কুণ্ডু। তাঁদের দুজনের মধ্যে যে কত সৌহার্দ্য ছিল সেটা এখন মনে পড়েছে রক্ষিত মশাই-এর। যুবা বয়সের স্মৃতি, আর দুজনে তখন ডাকসাইটে জুটি। লোকে আসল ছবির কথা চিন্তাই করে না; ছবির আগে বিশু শিবুর দু রিলের কীর্তিকলাপই হল তাদের কাছে আসল। সেই জুটির একটি রয়েছে, একটি উধাও। এমন হলে কি চলে?

নটরাজ কেবিনের মালিক পুলিন দত্তকে জিজ্ঞেস করাতে ভদ্রলোক বললেন, শরৎদা বছর তিনেক আগে অবধি এখানে রেগুলারলি আসতেন। তারপর আর আসেননি।

তিনি কি কোনও কাজ-টাজ করতেন?

সেকথা তাঁকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি, বললেন পুলিন দত্ত, কিন্তু কোনও সোজা উত্তর কখনও পাইনি। কেবল বলতেন, পেটের দায়ে এমন কোনও কাজ নেই যা আমি করিনি।তবে অভিনয় যে ছেড়ে দিয়েছিলেন সেটা আমি জানি, আর সেইসঙ্গে ছবি দেখাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। টকিই যে তাঁর কাল হয়েছিল সেটা বোধহয় উনি কোনওদিন ভুলতে পারেননি।

এর পরে আরও মাসখানেক নানান জায়গায় খোঁজ করেও শরৎ কুণ্ডুর কোনও পাত্তা পেলাম না। লোকটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কথাটা রক্ষিত মশাইকে বলতে উনি সত্যিই মর্মাহত হলেন। বললেন, এমন একটা গুণী অভিনেতা, টকি এসে তার পসার মাটি করল, আর ক্রমে সে মানুষের মন থেকে মুছেই গেল। এখন আর তাকে কে চেনে? সে তো বেঁচে থেকেও প্রায় মরারই শামিল।

শরৎ কুণ্ডুর ব্যাপারে আর কিছু করার নেই বলে আমি কাজের কথায় চলে গেলুম। ভদ্রলোককে একটা প্রশ্ন করার ছিল। বললুম, আপনার একটি সাক্ষাৎকার দিতে কোনও আপত্তি আছে কি?

কে চাইছে সাক্ষাৎকার?

আমি নরেশ সান্যালের কথা বললুম। ভদ্রলোক সেদিনই সকালে ফোন করেছিলেন, আগামীকাল আসতে চান।

বেশ তো, সকালে দশটায় আসুক। তবে বেশি সময় যেন না নেয়।

নরেশ সান্যাল ফোন নম্বর দিয়ে দিয়েছিলেন, আমি তাঁকে খবরটা জানিয়ে দিলাম।

সেদিন সন্ধ্যায় প্রোজেকশন ঘরে রয়ে গেলুম। বিশু-শিবুর কীর্তিকলাপ দেখার জন্য। বিশু-শিবুর ছবি হয়েছিল সবসুদ্ধ বেয়াল্লিশটা। তার মধ্যে সাঁইত্রিশটা আগেই জোগাড় হয়েছিল, বাকি পাঁচখানা আমার চেষ্টায় জোগাড় হয়েছে। আজ এই নতুন পাঁচখানা দেখতে দেখতে আবার মনে হল যে, শরৎ কুণ্ডু সত্যিই বেশ জোরদার কমিক অভিনেতা ছিলেন। রক্ষিত মশাইকে দু-একবার চুকচুক করতে শুনলুম, তাতে বুঝলুম যে তিনি শরৎ কুণ্ডুর অন্তর্ধানের জন্য আক্ষেপ করছেন।

পরদিন সকালে আমি আসার দশ মিনিটের মধ্যেই নরেশ সান্যাল এসে পড়লেন। রক্ষিত মশাই তৈরিই ছিলেন; বললেন, আগে চা হোক, তারপর ইন্টারভিউ হবে। সান্যাল মশাই কোনও আপত্তি করলেন না।

সকালে দশটায় রোজই রক্ষিত মশাই চা খান এবং সেইসঙ্গে আমিও খাই। এই সময়টাতেই আমাদের যা কিছু আলোচনা করবার তা হয়ে যায়, তারপর আমি বসে পড়ি কাজে, উনি চলে যান। বিশ্রাম করতে। ক্যাটালগিং হয়ে যাবার পর আমি যে কাজটা করছি সেটা হল বিশু-শিবুর প্রত্যেকটি ছবির গল্পের সারাংশ তৈরি করা এবং তাতে কে কে অভিনয় করেছে, পরিচালক কে, ক্যামেরাম্যান কে–এই সবের একটা তালিকা তৈরি করা। একে বলে ফিল্মেগ্রাফি।

যাই হোক, আজ অতিথি এসেছেন বলে দেখি চায়ের সঙ্গে চুরি এসেছে। ট্রে সমেত চা টেবিলে রাখা হতেই সান্যাল মশাই হঠাৎ একটা কথার মাঝখানে খেই হারিয়ে চুপ করে গেলেন। তাঁর দৃষ্টি ভৃত্যের দিকে। ভৃত্য স্বয়ং খাস বেয়ারা লক্ষ্মীকান্ত।

আমার দৃষ্টিও চলে গেছে লক্ষ্মীকান্তের দিকে, এবং সেই সঙ্গে রক্ষিত মশাইয়েরও। এই নাক, এই থুতনি, এই চওড়া কপাল, চোখের এই তীক্ষ্ণ চাহনি–এ কোথায় দেখেছি? অ্যাদ্দিন তো এর মুখের দিকে ভাল করে চাইনি। কেন চাইব? অকারণে বেয়ারার দিকে কে চেয়ে থাকে?

প্রায় তিনজনের মুখ দিয়েই একসঙ্গে বেরিয়ে পড়ল একটা নাম–

শরৎ কুণ্ড!

হ্যাঁ, কোনও সন্দেহ নেই, শরৎ কুণ্ডু এখন হলেন তাঁর এককালের ফিল্মের জুটি রতন রক্ষিতের খাস বেয়ারা।

কী ব্যাপার হে শরৎ? এতক্ষণে চেঁচিয়ে উঠলেন রতন রক্ষিত। তুমি আমার বাড়িতে–?

শরৎ কুণ্ডুরও মুখে কথা ফুটতে সময় লাগল।

কী আর করি, অবশেষে কপালের ঘাম মুছে বললেন ভদ্রলোক, নেহাত ইনি চিনলেন বলেই তো তোমরা চিনলে; অ্যাদ্দিন তো বুঝতে পারোনি! আর চল্লিশ বছর বাদে দেখে বুঝবেই বা কী করে! একদিন মীরচান্দানির ওখানে চাকরির আশায় গিয়ে শুনি তুমি নাকি এসে আমাদের সেই আদ্যিকালের ছবির অনেকগুলো কপি কিনে নিয়ে গেছ নিজের সংগ্রহের জন্য। ভাবলাম তোমার এখানে এসে নিশ্চয়ই সেসব ছবি আবার দেখতে পাব। এমনিতে তো দেখার কোনও সুযোগ নেই। সেসব ছবি যে এখনও টিকে আছে তাই জানতাম না। তাই বেয়ারার চাকরির জন্য চলে এলাম তোমার কাছে। তুমি আমায় চিনলে না, চাকরিও হয়ে গেল। কুলিগিরিও করেছি, বেয়ারার কাজ তো তার কাছে স্বর্গ। আর ভালও লাগছিল। সে যুগের ছবিতে কথা না বলে অভিনয় করেছি, সে তো নেহাত নিন্দের নয়! অবিশ্যি সেসব দেখার সুযোগ বোধহয় এখন বন্ধই হয়ে গেল!

কেন, বন্ধ হবে কেন? রক্ষিত মশাই চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছেন। তুমি এখন থেকে হবে আমার ম্যানেজার! তারিণীর সঙ্গে এক ঘরে বসবে তুমি; আমার এখানেই থাকবে, সন্ধেবেলা একসঙ্গে সে ছবি দেখব আমরা। এককালের জুটি ভেঙে গিয়েছিল দৈব দুর্বিপাকে, আবার এখন থেকে জোড়া লেগে গেল। কী বলো তারিণী?

আমি দেখছি নরেশ সান্যালের দিকে। তাঁর মতো এমন হতভম্ব ভাব আমি অনেকদিন কারুর মুখে দেখিনি। তবে তাঁর পক্ষে নির্বাক যুগের এই বিখ্যাত জুটির পুনর্মিলন যে একটা বড়রকম সাংবাদিক দাঁও হল, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে কি?

আনন্দ বার্ষিকী, ১৩৯২

No comments