ভুডু (প্রেতচক্র) – অনীশ দাস অপু

ভুডু (প্রেতচক্র) – অনীশ দাস অপু

সেদিন যদি বৃষ্টি না হত, এসব কিছুই ঘটত না। বেলাল চাচা বেঁচে থাকতেন আর আমার বোনেরও অমন দশা হত না।

চিলেকোঠায় হানা দেয়ার মতলব ছিল তিতলি আপুর। ওর বয়স পনেরো আমার চেয়ে তিন বছরের বড়। আর আমি ওকে খুব ভয় পাই। ও যা বলে বিনাবাক্যব্যয়ে সব পালন করি।

বেলাল চাচা কিংবা মলি চাচীকে একবার বলা উচিত ছিল না? জিজ্ঞেস করলাম তিতলিকে।

আরে, গাধা ওরা কি বাসায় আছে নাকি যে অনুমতি চাইবি? খেঁকিয়ে উঠল তিতলি আপু যেন পাঁচ বছরের একটা মেয়েকে চোখ রাঙাচ্ছে। বড় বোনদের নিয়ে এই-ই সমস্যা-তারা ভাবে তারা সবজান্তা, আসলে সবকিছু জানে না। চাচা-চাচী বাসায় থাকলেই কী না থাকলেই কী, বলে চলল আপু। আমি যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি চিলেকোঠায় টু দেব, দেবই। তোর ইচ্ছে হলে আসবি না হলে নাই।

তিতলি আপুর সঙ্গে আমি পারতপক্ষে তর্ক করি না মার খাওয়ার ভয়ে। অবশ্য চিলেকোঠায় উঁকি দেয়ার ইচ্ছে আমারও কম নয়। বাবা-মা গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পরে চাচা-চাচীর বাড়িতে এসেছি মাস ছয় হতে চলল। চিলোকোঠার ঘরটির প্রতি আমাদের দুবোনেরই দুর্দমনীয় আকর্ষণ। কিন্তু ও ঘর দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত পড়ে আছে বলে ওখানে আমাদের যাওয়া বারণ। শহরের উপকণ্ঠে বেলাল চাচার এই বিশাল বাড়িটির বয়স নাকি প্রায় শতাব্দী ছুঁই ছুঁই। আমাদের জমিদার প্রপিতামহ এ বাড়ি বানিয়েছেন। বংশের শেষ প্রদীপ নিঃসন্তান বেলাল চাচা তার স্ত্রীকে নিয়ে এ বাড়িতে এখন বাস করছেন। বাড়ির সামনে বিরাট একটি বাগানও আছে। তবে বর্ষা চলছে বলে আমরা বাগানে তেমন খেলতে যাই না। আজ ছুটির দিন, চাচা-চাচী জরুরী কী একটা কাজে বাইরে গেছেন, অবসর কাটানোর মত তেমন কিছু নেই, তাই চিলোকোঠায় উঁকি দেয়ার পরিকল্পনা করেছে। তিতলি আপু।

মই বেয়ে চিলোকোঠার ঘরে উঠে এল আপু, পেছন পেছন আমি। যেন আলাদিনের গুহায় ঢুকেছি। বড় বড় ট্রাংক, বাক্স, আসবাব। একটা মস্ত কাঠের সিন্দুকও আছে। ধুলো পুরু হয়ে জমে রয়েছে ওগুলোর ওপর। জিনিসগুলো দেখে প্রথমদিকে উত্তেজনাবোধ করলেও একটু পরেই হারিয়ে ফেললাম আগ্রহ। ভেবেছিলাম গুপ্তধন-টন পেয়ে যাব। জমিদার বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে কাঠের সিন্দুকে গুপ্তধনের ম্যাপট্যাপ থাকে, গল্পে পড়েছি। কিন্তু এ ঘরের সিন্দুকে হাবিজাবি বোঝাই। আবর্জনার বর্ণনা দিয়ে আপনাদের মেজাজ খারাপ করতে চাই না। তবে আমার মেজাজ খারাপ হলো চিত্তাকর্ষক কিছু দেখতে না পেয়ে। আপুকে বললাম এই আধা-অন্ধকার, গুমোট ঘরে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি নিচে যাচ্ছি।

দাঁড়া, এই ট্রাঙ্কটা একটু খুলে দেখি, আমাকে বাধা দিল তিতলি আপু। পুরানো একটা ট্রাঙ্ক খুলছে ও।ট্রাঙ্কের মাথায় কালো, বড় বড় অক্ষরে লেখা J.C.

J.C. মানে জামিল চৌধুরী। আমাদের বড় চাচা। আমাদের জন্মেরও আগে। মারা গেছেন। বাবার কাছে বড় চাচার অনেক গল্প শুনেছি। উনি ছিলেন বিশ্ব পর্যটক। পৃথিবীর এমন দেশ নেই যেখানে ঘুরতে যাননি। শুনেছি বোর্নিওতে জাহাজ-ডুবি হয়ে মারা গেছেন জামিল চাচা। চাচার ট্রাঙ্কের ভেতরে হয়তো রহস্যময় কিছু পাওয়া যাবে ভেবে আমরা উৎসাহী হয়ে উঠলাম। কিন্তু পুরানো জামা-কাপড় আর ভ্রমণ সংক্রান্ত মোটামোটা ইংরেজি বই ছাড়া আর কিছু নেই। না, আছে আপু কাপড়ের স্তূপের নীচ থেকে বের করে আনল জিনিসটা।

একটা পুতুল।

কাপড়ের পুরানো একটা পুতুল। ভুল বললাম কাপড় নয়, কতগুলো পালক দিয়ে বানানো হয়েছে পুতুলটাকে। গায়ে কাপড়ের পরিমাণ খুবই অল্প। চোখের জায়গায় সাদা বৃত্ত একে কালো কালি দিয়ে চোখের মণি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কদাকার দেখতে।

জানিস এটা কী? জিঝেহস করল তিতলি। ডান-বামে মাথা নাড়লাম আমি। জানি না। এটা হলো ভুডু পুতুল। বলে পুতুলটা আমার মুখের সামনে এনে হাউ করে উঠল ও।

ফাজলামি কোরো না তো! মুখ সরিয়ে নিলাম আমি। ভুডু কী জিনিস?

কালো যাদু। ক্যারিবিয়ানের লোকজন ব্লাক ম্যাজিক বা কালো যাদুর চর্চা করে। জামিল চাচা নিশ্চয় ওখানে গিয়েছিল। ভূতের ওঝারা এসব ভুডু পুতুলের গায়ে পিছনের খোঁচা মেরে মানুষজনকে অসুস্থ বানিয়ে ফেলে। আরও কতকিছু করে!

তুমি এতসব জানলে কী করে? ভুডু পুতুলের এত ক্ষমতা বিশ্বাস হতে চাইল না আমার।

কেন, বইতে পড়েছি, বলল তিতলি আপু। সেবার হরর লেখক অনীশ দাস অপুর ভুডুর ওপর একটা বই আছে। ওতে ভুডু নিয়ে বিস্তারিত সব লেখা আছে, ছবিসহ।

তিতলি আপু হাতের পুতুলটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ওর চাউনিটা কেমন অদ্ভুত। আমার গা শিরশির করে উঠল।

আমার দিকে চোখ তুলে চাইল আপু। জানিস, ওই বইটা পড়ার পরে আমার বহুবার মনে সাধ জেগেছে। ইস, ওরকম একটা পুতুল যদি সত্যি পেতাম! স্বপ্নটা আজ পূরণ হলো।

লেখকরা বানিয়ে অনেক কিছু লেখে। তা কখনও সত্যি হয় নাকি? ঠোঁট ওল্টালাম আমি।

তুই ভুডু পুতুল সম্পর্কে কিছুই জানিস না। তাই গাধার মত কথা, বলছিস, দাবড়ি দিল আপু। ভুডু সত্যি নাকি মিথ্যা তার প্রমাণ তোকে দেখিয়ে দিচ্ছি।

পুতুল নিয়ে নিচে নেমে এল তিতলি আপু। ওর পড়ার টেবিলের পিন কুশন থেকে একটা পিন নিল। বিড় বিড় করে বলল, এটা কার ওপর ব্যবহার করা যায় ভাবছি। হঠাৎ চোখ পড়ল বুড়ো মালী বারেক দাদুর ওপর। শুনেছি এ বাড়িতে বহুদিন ধরে আছে মানুষটা। তার একমাত্র কাজ বাগানের যত্ন নেয়া। মাঝে মধ্যে বাড়ির ফাইফরমাশও খাটে। তবে বেশিরভাগ সময় তাকে দেখি নাক ডেকে ভোসভোস করে ঘুমাচ্ছে। লোকটা অলস এবং ফাঁকিবাজ।

বারেক দাদুকে দিয়েই এক্সপেরিমেন্টটা হয়ে যাক! উৎসাহী গলায় বলল তিতলি আপু।

বুড়ো লোকটাকে আমার তেমন পছন্দ হয় না। কাজেই তাকে দিয়ে আপু ভুডু এক্সপেরিমেন্ট করবে শুনে আমি সোৎসাহে আপুর কথায় সায় দিলাম। তাছাড়া সত্যি এতে কাজ হয় কিনা দেখার কৌতূহলও হচ্ছিল বেশ।

বারেক দাদু বারান্দার কাঠের টুলে বসে ঝিমোচ্ছিল। তিতলি আপু বলল, আমাদের শুধু যা করতে হবে তা হলো এ পুতুলটাকে ভাবতে হবে বারেক দাদু। পণ্ডিতি ভঙ্গিতে আমার ওপর লেকচার ঝাড়ছে ও। পুতুলের গায়ে যে-ই পিনের খোঁচা দেব, দেখবি দাদু বাবারে মারে করে চিৎকার দিয়ে উঠেছে।

আমরা পুতুলটার দিকে তাকিয়ে এক মনে ভাবতে লাগলাম, এটা বারেক দাদু। তারপর তিতলি পুতুলের পিঠে ঢুকিয়ে দিল পিন।

কিন্তু কিছুই ঘটল না।

বলেছিলাম না এসব ভুয়া, হি হি করে হেসে উঠলাম আমি।

চুপ! এটা ভুয়া না, ঠোঁট কামড়াল আপু, এটা দিয়ে তো কাজ হবার কথা ছিল। হয়তো আমি কোনও ভুল করে ফেলেছি।

আমার বড় বোনের মাথায় একবার কোনও মতলব ঢুকলে ওটা সে হাসিল করে ছাড়বেই।

আয় আমার সঙ্গে, হুকুম দিল আপু। ওর পেছন পেছন চললাম চাচার লাইব্রেরিতে। চাচা বইয়ের সাংঘাতিক পোকা। হাজার হাজার বই আছে তাঁর। আমি অবশ্য গল্পের বইটই তেমন পড়ি না। তিতলি আপু পড়ে। তবে বেশিরভাগ হরর গল্প। এজন্যই বোধহয় ওর মাথায় সবসময় হরর চিন্তা গিজগিজ করে।

চাচার বিশাল লাইব্রেরির একটা আলমারি বোঝাই শুধু সেবা প্রকাশনীর বই। মাসুদ রানা, অনুবাদ, ওয়েস্টার্ন, তিন গোয়েন্দা। আরও কত কী! তিতলি আপু আলমারি খুলে একটা বই বের করল।

বইয়ের নাম ভুডু লেখক অনীশ দাস অপু। আপু বইয়ের পাতা খুলে মনোযোগ দিয়ে কী যেন পড়ল কিছুক্ষণ। তারপর লাফিয়ে উঠল, ইয়েস! পেয়ে গেছি!

কী পেয়েছো?

এখানে লিখেছে ভুডু পুতুল দিয়ে ভূতের ওঝারা যার ক্ষতি করতে চাইত, আগে ওই লোকের শরীর থেকে কিছু একটা সংগ্রহ করে নিত।

কী রকম?

ধর চুল-টুল জাতীয় কিছু।

আমরা চলে এলাম বারান্দায়। এখন আর বৃষ্টি পড়ছে না। বেশ ঠাণ্ডা একটা হাওয়া বইছে। শীতল বাতাসে বারেক দাদু রীতিমত নাক ডাকতে লেগেছে।

বুড়োর মাথা থেকে কীভাবে চুল আনা যায় বল তো?

ফিসফিস করল আপু।

গিয়ে বলব নাকি দাদু তোমার এক গাছি চুল দেবে? আমাদের খুব দরকার।

আরে ছাগল, ভৎর্সনার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল তিতলি। তাহলে তো বুড়ো সন্দেহ করে বসবে। হঠাৎ কী দেখে যেন ওর চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। পেয়ে গেছি।!।

কী পেয়েছে?

বুড়োর টুপি। ওর টুপিতে নিশ্চয় চুল লেগে আছে। আঙুল বাড়িয়ে বারেক দাদুর মাথার টুপিতে ইঙ্গিত করল আপু। যা, টুপিটা খুলে নিয়ে আয়! আদেশ করল ও।

আমি পারব না বাপু! সভয়ে এক কদম পিছিয়ে গেলাম। যদি জেগে যায়?

যতসব ভীতুর ডিম, আমার দিকে রোষকষায়িত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল তিতলি আপু। তারপর পা টিপে টিপে এগোল বারেক দাদুর দিকে। পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল মিনিটখানেক। আমি দশ হাত দূরে দাঁড়িয়েও বুড়োর নাসিকা গর্জন শুনতে। পাচ্ছি। মনে হচ্ছে বোমা ফাটালেও এ ঘুম ভাঙবে না। দেখলাম আপু আলগোছে দাদুর মাথা থেকে সাদা টুপিটি খুলে নিল। টুপির ভিতরে চালিয়ে দিল আঙুল। তারপর আবার আগের জায়গায় ফিরে গেল টুপি। আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বুড়ো আঙুল তুলে দেখাল আপু। তারপর বেড়ালের মত নিঃশব্দ পায়ে ফিরে এল। মুঠো খুলে দেখাল। কয়েক গোছ সাদা চুল হাতে।

টেপ দিয়ে চুলের গোছা ভুডু পুতুলের গায়ে লাগিয়ে দিল তিতলি আপু। ফিরে এলাম বারান্দায়। দাঁড়ালাম একটা থামের আড়ালে। হাতে আলপিন নিয়ে আপু বলল, নে, এবার আবার আগের মত ভাবতে শুরু কর।

আমরা আবার ভাবতে লাগলাম পুতুলটা অন্য কেউ নয়, স্বয়ং বারেক দাদু। তারপর ওটার নিতম্বে পিন ফুটিয়ে দিল আপু।

বিকট একটা চিৎকার দিয়ে টুল থেকে লাফিয়ে উঠল বুড়ো, পাছায় হাত ঘষছে। চেহারায় যন্ত্রণা এবং হতবিহ্বল ভাব।

হিসহিস করে উঠল আপু, কাজ হয়েছে!

এটা কাকতালীয়ভাবেও ঘটতে পারে, বললাম আমি।

ঘটনা দেখে অবাক হলেও আমি বিস্ময়ের ভাবটুকু গোপন করেছি। কারণ চাই না আপু বুঝে ফেলুক তার কর্মকাণ্ডে আমি মুগ্ধ এবং তাজ্জব।

তোর বিশ্বাস হচ্ছে না, না? ঠিক আছে, দ্যাখ! বলতে বলতে পিনটা এবার পুতুলের পায়ে ঢুকিয়ে দিল তিতলি। আরেকটা আর্তনাদ ছাড়ল দাদু, এক ঠ্যাঙে লাফাতে লাগল। যে পায়ে খোঁচা খেয়েছে সেই ঠ্যাঙটা হাত দিয়ে ধরে লাফাচ্ছে।

তিতলি আপু এবার পুতুলের অপর পায়ে পিন ফোঁটাল। বাবারে মারে! বলে বুড়ো সঙ্গে সঙ্গে মেঝেতে ধপাশ।

বারেক দাদুকে কোলা ব্যাঙের মত হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে থাকতে দেখে হাসি চেপে রাখতে পারলাম না। আপু আমার মুখে হাত চাপা দিয়ে দ্রুত বারান্দা থেকে টেনে নিয়ে এল পাছে বুড়ো আমার হাসি শুনতে পায়।

দেখলি তো কী জিনিস আমরা পেয়ে গেছি, বিজয় উল্লাস আপুর চোখে। সত্যিকারের একটি ভুডু পুতুল!

.

চাচা-চাচী বাসায় ফিরলেন বিকেল পাঁচটায়। তিতলি আপু আমাকে বলল, চল, একটু মজা করে আসি। পুতুল নিয়ে নিচে নেমে এলাম আমরা। চাচা-চাচী বাগানে চেয়ার পেতে বসেছেন। বারেক দাদু তাঁদের জন্য চায়ের আনজামে ব্যস্ত। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে বেচারা। যন্ত্রণাক্লিষ্ট চেহারা।

আপনার কী হয়েছে, বারেক চাচা? উদ্বেগ নিয়ে জানতে চাইলেন মলি চাচী। খোঁড়াচ্ছেন কেন?

জানি না, আম্মা… দুপুরবেলা একটু ঝিমুনির মত আইছিল… হঠাৎ পায়ে এমন বেদনা হইল… লাফ মাইরা উঠলাম, চেহারা করুণ করে বলল বারেক দাদু।

বাতের ব্যথা নয়তো? জানতে চাইলেন বেলাল চাচা। তোমার তো মাঝে মধ্যেই বাতের ব্যথা ওঠে।

বাতের বেদনা নয় গো, ছোট সাব। বাতের বেদনা এত ব্যথা দেয় না। মনে হইল কেউ আমার পায়ে গরম লোহার পেরেক ঢুকাইয়া দিছে।

আমরা রান্নাঘরে, জানালার পাশে দাঁড়িয়ে খিকখিক করে হাসলাম। এখান থেকে বাগান দেখা যায় পরিষ্কার, লোকজনের কথাও শোনা যায় স্পষ্ট।

আমাকে পুতুলটা একটু দাও না, ফিসফিস করে বললাম তিতলি আপুকে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমার হাতে পুতুলটা দিল ও। আমি পুতুলের হাঁটুতে ঘঁাচ করে ঢুকিয়ে দিলাম পিন।

বারেক বুড়ো লাফ মেরে হাঁটু চেপে ধরল, তার সামলাতে না পেরে পড়ে গেল মলি চাচীর গায়ে। চাচী পট থেকে চা ঢালছিলেন কাপে। হাত থেকে ছিটকে গেল। পট। মাটিতে পড়ে ঝনঝন শব্দে ভাঙল। চাচা হাত বাড়িয়ে চাচীকে না ধরলে পটের সঙ্গে তাঁরও পপাত ধরণীতল হত।

আয় হায় আম্মা। এইডা কী হইল। মাফ করেন গো, আম্মা। আমারে মাফ কইরা দেন। হাঁটুর ব্যথা ভুলে গিয়ে চাচীর কাছে হাত জোর করে মাফ চাইতে লাগল মহা বিব্রত বারেক দাদু।

না, না। ঠিক আছে, নিজেকে সামলে নিয়েছেন চাচী।

বেলাল চাচা বুড়োকে বললেন, বারেক চাচা, তোমার আসলে ডাক্তার দেখানো উচিত। কল্লোল সাহেবকে ফোন করে দিচ্ছি। তুমি তার চেম্বারে চলে যাও।

ডা. মিজানুর রহমান কল্লোল আমাদের হাউজ ফিজিশিয়ান। কাছেই তাঁর চেম্বার। রিকশা করে যাওয়া যায়।

.

সে রাতে শুতে যাবার সময় তিতলি আপুকে বললাম সে যেন পুতুলটা জামিল চাচার ট্রাঙ্কে ভরে রেখে আসে। কারণ এমন অশুভ শক্তির একটা জিনিস নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া না করাই ভালো। কখন কী অঘটন ঘটে যায় কে জানে! পুতুল দিয়ে মজা করা এক জিনিস আর মানুষের ক্ষতি করা আরেক জিনিস, আপুকে বলেই ফেললাম শংকার কথা।

রাখ তোর পণ্ডিতি, ঝংকার দিয়ে উঠল তিতলি আপু। কারও যদি আমি ক্ষতি করিই তো তোর কী? আমার যারা ক্ষতি করেছে আমি তাদের এবারে মজা টের পাইয়ে দেব। আর শোন- হঠাৎ আমার হাতটা জোরে মুচড়ে দিল ও। ভুডু পুতুলের কথা আমরা ছাড়া কেউ জানে না। তুই যদি কাউকে বলেছিস তো আরেকটা মোচড় দিল হাতে।-এ পুতুল দিয়ে তোর বারোটা বাজিয়ে ছাড়ব।

পরদিন পুতুল নিয়ে স্কুলে গেল তিতলি। ও আর আমি একই স্কুলে পড়ি। আপু নাইনে, আমি সিক্সে।

হস্তিনী জাহেদার আজ খবর আছে, স্কুলে ঢুকতে ঢুকতে বলল তিতলি আপু। জাহেদা ওর ক্লাসমেট। ইয়া মোটা। কমপক্ষে ৯০ কেজি হবে ওজন। আপুর সঙ্গে তার প্রায়ই খিটিমিটি লাগে।

লাঞ্চ ব্রেকের আগে আর তিতলি আপুর সঙ্গে দেখা হলো না। ওকে খুশি খুশি লাগছে।

হস্তিনীটাকে আজ উচিত শিক্ষা দিয়েছি, হেসে উঠল ও। তারপর ঘটনাটা বলল।

জাহেদার পাশে আপু আজ সেধে গিয়ে বসেছিল। জাহেদা ক্লাস চলার সময় টয়লেটে গেলে সে চট করে ওর ব্যাগ খুলে চিরুনি বের করে। চিরুনিতে জাহেদার চুল লেগে ছিল। আপু চুলগুলো লাগিয়ে দেয় ভুডু পুতুলের মাথায়।

ভূগোল ক্লাসে বসে ওকে শায়েস্তা করেছি, খিক খিক হাসল তিতলি আপু। তুই তো জানিস আমাদের ভূগোলের প্রাকটিকাল আলাদা ক্লাসে হয়। আমি সবার পেছনের বেঞ্চিতে গিয়ে বসেছিলাম। তারপর চুপিসারে পুতুলটা বের করে আনি ব্যাগ খুলে। না, আজ পিন ব্যবহার করিনি। পুতুলটার মাথাটা শুধু একটু মুচড়ে দিয়েছিলাম। তাতেই হস্তিনীর অবস্থা যদি তুই দেখতি, তুলি! মাথা চেপে ধরে। মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে খেতে বাচ্চাদের মত চিৎকার করছিল আর গোঙাচ্ছিল!

জাহেদার অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল সবাই। টিচার স্কুলের এক বুয়াকে দিয়ে তক্ষুনি জাহেদাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। হস্তিনী কাল আবার আসুক। আরেকটা ডোজ দেব ওকে। ওর মাথা যন্ত্রণা ইহ জীবনে যাতে না ছাড়ে সে ব্যবস্থা আমি করছি।

আপুর চেহারাটা হঠাৎ করুণ দেখাল। তবে দুঃখ কী জানিস, ওকে বলতে পারব না এসব কাণ্ড আমিই ঘটাচ্ছি। ও জীবনেও জানতে পারবে না আমার সঙ্গে ঝগড়া করার শোধ নিচ্ছি এভাবে। বললেই তো পুতুলের কথা জেনে যাবে।

আমার দিকে তাকাল আপু, চাউনিতে স্পষ্ট হুমকি। আমাদের গোপন কথাটা কেউ জানবে না, তাই না, তুলি?

পরদিন জাহেদা স্কুলে এসে আবার তিতলি আপুর প্রতিহিংসার শিকার হলো। ভয়াবহ মাথা ব্যথা নিয়ে আজও তাকে স্কুল ছাড়তে হলো। তারপরের দিনও একই ঘটনা ঘটল। আসলে আমার বোনটা সাংঘাতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ। একবার কারও ওপর রেগে গেলে তার চরম সর্বনাশ না করে ছাড়ে না।

মুটকি জাহেদাকে আমারও পছন্দ নয়। কিন্তু দিনের পর দিন ওকে এভাবে নির্যাতিত হতে দেখে ওর জন্য শেষে খারাপই লাগছিল। কিন্তু আমি কী করব? আমি আপুকে একবার অনুরোধ করেছিলাম জাহেদাকে আর কষ্ট না দিয়ে রেহাই দিতে। সে আমার দিকে এমন হিমদৃষ্টিতে তাকাল যে আমার বুকের রক্ত জমে বরফ। বলল আমি যেন নিজের চরকায় তেল দিই নইলে আমারও নাকি জাহেদার মত অবস্থা হবে।

যতই দিন যাচ্ছে, তিতলি আপুকে ততই যেন গ্রাস করে নিচ্ছে অশুভ ভুডু পুতুল। কোনও কারণ ছাড়াই সে বারেক দাদুর পেছনে লেগে রয়েছে। নানানভাবে ত্যক্ত করছে মানুষটাকে। বেচারাকে এখন প্রায়ই দৌড়াতে হচ্ছে ডাক্তার কল্লোলের কাছে কখনও হাত, কখনও পিঠ কখনও বা পেটে ব্যথা নিয়ে।

তিতলির কবল থেকে যেন কারও রেহাই নেই। সেদিন ওর ঘরে গিয়ে দেখি বিছানায় বসে চাচার পুরানো সিগার বক্স নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। বক্সটা বেশ ফুলো ফুলো দেখাচ্ছে।

কী আছে এর ভেতরে? জানতে চাইলাম আমি।

গর্বভরে ভেতরের জিনিসগুলো বের করে আমাকে দেখাল ও। অনেকগুলো দেশলাইয়ের বাক্স। গায়ে হিজিবিজি হস্তাক্ষরে নানাজনের নাম লেখা। বেশিরভাগ ওর ক্লাসের সহপাঠীদের নাম, দুএকজন শিক্ষকেরও নাম আছে।

তুমি এদের সবার চুল জোগাড় করে এসব বাক্সে রেখেছ? জানতে চাইলাম আমি।

শুধু চুল না-আরও অনেক কিছু আছে, জবাব দিল আপু। রিদওয়ান রহমান লেখা একটি দেশলাইয়ের বাক্স খুলল ও। মি. রহমান ওদের ম্যাথ টিচার। বাক্সের ভেতর রক্তমাখা পুরানো তুলল।

রহমান সারের আঙুল কেটে গিয়েছিল টেবিলের ধারালো কোনায় লেগে। জানাল তিতলি আপু। রক্ত মুছে তুলোটা তিনি ময়লা ফেলার ঝুড়িতে ফেলে দিয়েছিলেন। আমি ওটা কুড়িয়ে এনেছি।

রক্ত দিয়েও কাজ হয়?

অবশ্যই। যে কোনও কিছু-লোকের শরীরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত থাকলেই হলো।

আরেকটা বাক্স খুলল তিতলি। ভেতরে দুতিনটে কাটা নখ।

এ নখগুলো কার?

বেলাল চাচার। শয়তানি হাসি ফুটল আপুর মুখে। আঁতকে উঠলাম আমি। কিন্তু এগুলো দিয়ে কী করবে তুমি?

তোর কী ধারণা, ছাগল? দ্যাখ-আমি মলি চাচীও এক গোছা চুল জোগাড় করেছি।

কি-কিন্তু কেন? তুমি নিশ্চয় ওদের কোনও ক্ষতি করবে না?

না, এখনই সেরকম কোনও ইচ্ছে নেই। তবে বাধ্য হলে করব।

কাজটা ঠিক হচ্ছে না, আপু, বললাম আমি। এ জিনিসগুলো এক্ষুনি ফেলে দাও। নইলে–

নইলে কী?

আমি তোমার ভুডু পুতুলের কথা সবাইকে বলে দেব।

আরেকটা দেশলাইয়ের বাক্স বের করল তিতলি। ওতে আমার নাম লেখা। খবরদার কাউকে এ কথা বলবি না। বললে তোর দশা কী হবে বুঝতে পারছিস?

বাক্স খুলল ও। ভেতরে আমার দুধ দাঁত। জীবনের প্রথম দুধ দাঁত। যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম নিজের টেবিলের ড্রয়ারে। তিতলি আপু কখন ওটা হাতিয়ে নিয়েছে টেরও পাইনি।

ঠিক আছে, ঠিক আছে! ভয় পেয়ে গেলাম আমি।

নিজের ঘরে ফিরে এলাম। ভয়ে শুকিয়ে গেছে কলজে। যে সব জিনিস জোগাড় করেছে তিতলি আপু ও দিয়ে অনেক লোকের ক্ষতি করতে পারবে ও। আমাকেও যে ছেড়ে কথা কইবে না তা তো বুঝিয়েই দিল। অবশ্য যদি আমার আপন বোন হত তা হলে নিশ্চয় আমার ক্ষতি করার হুমকি দিত না। ওর সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক নেই বলেই আমার ক্ষতি করতে দ্বিধা করবে না তিতলি। দিন দিন যেভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠছে, আমার মন বলছে শীঘ্রি খুব খারাপ কিছু হয়তো ঘটবে।

এক হপ্তা পরে সত্যি ভয়ঙ্কর একটি ঘটনা ঘটল। ভুডু পুতুল নিয়ে দিনরাত মেতে থাকা তিতলি আপু স্কুলের পড়ায় একটুও মন দিচ্ছিল না। সাপ্তাহিক পরীক্ষাগুলোয় বেশিরভাগ সাবজেক্টে ফেল করছিল ও। শাস্তি হিসেবে হেড মিস্ট্রেস ওকে নাচের দল থেকে বহিস্কার করলেন। বললেন সাপ্তাহিক পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল না করা পর্যন্ত ওকে নাচের দলে নেয়া হবে না। ওর জায়গায় শারমিন দীপা নামে একটি মেয়ে সুযোগ পেয়ে গেল। দীপার দুর্ভাগ্যই বলতে হবে কারণ তিতলি আপু এ মেয়েটির একগুচ্ছ চুল তার সিগার বক্সে সযত্নে রেখে দিয়েছে।

ঘটনাটা যখন ঘটাল আপু, আমি তখন ওর সঙ্গে ছিলাম। আমরা স্কুলের মূল সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। আমাদের স্কুলটা বিশাল। তিনতলা। নাইন এবং টেনের ক্লাস নেয়া হয় তিনতলায়। তিতলি তার ইউনিফর্মের পকেটে ঢুকিয়ে এনেছে ভুডু পুতুল। শাস্তি দেবে শারমীন দীপাকে। শারমীন দীপার অপরাধ সে আপুর জায়গা দখল করার পরে নাকি মশকরা করে বলেছিল, তোমার কপাল ভালোই পুড়েছে, তিতলি। মনে হয় না নৃত্যাঞ্জলিতে নাচার সুযোগ তুমি আর কোনদিন পাবে।

নৃত্যাঞ্জলি নামে চ্যানেল আইতে একটি নাচের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। আমাদের স্কুল ওই প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে। আগামী সোমবার অনুষ্ঠানটির রেকর্ডিং। আপুর খুব শখ ছিল টিভিতে নাচবে। কিন্তু শখটা আর পূরণ হলো না। শারমীন দীপার নাম ছিল ওয়েটিং লিস্টে। তিতলি আপু দল থেকে বাদ পড়ায়। টিভিতে চেহারা দেখানোর সুযোগ পেয়ে গেছে ও। এমনিতেই অপমানে জ্বলছিল আপু, তার ওপর দীপার বক্রোক্তি ছিল ওর জন্য কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে। রাগে ওর ফর্সা মুখ লাল। আমি ভেবেছি শারমীন দীপাকে হয়তো হালকা শাস্তি দেবে আপু। কিন্তু ওর প্রতিহিংসা যে কত ভয়ানক চাক্ষুস প্রমাণ পেলাম সেদিন। ক্রুদ্ধ ঘোড়ার মত মেঝেতে পা ঠুকছিল আপু। আর ও রেগে গেলে উন্মাদ হয়ে ওঠে। এবং উন্মাদ হয়ে উঠলে যা খুশি তাই করতে পারে তিতলি আপু।

ওই যে আসছে ইঁদুরটা, সাপের মত হিসহিস করে উঠল আপু। দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নামছে শারমীন দীপা। আপু পকেট থেকে পুতুলটাকে বের করেই বা পায়ে দিল এক মোচড়।

প্রাণঘাতী আর্তনাদ বেরিয়ে এল দীপার মুখ থেকে। বিস্ফারিত চোখে দেখলাম ওর বাঁ পা অদ্ভুতভাবে বাঁকা হয়ে গেছে, পরমুহূর্তে হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল দীপা। ডিগবাজি খেতে খেতে সিঁড়ি বেয়ে ছিটকে মেঝেতে হাঁটু ভাঙা দ-এর মত পড়ল। পড়েই থাকল। আর নড়াচড়া করছে না। পতনের চোটে নাক-মুখ ফেটে গেছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। সবাই ছুটে এল। ক্লাসে যাচ্ছিলেন আমাদের এক টিচার, মি. শামসুদ্দীন। তিনিও ছুটে এলেন। তারস্বরে চিৎকার করতে লাগলেন রক্তাক্ত দীপাকে দেখে। ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স আনা হলো। দীপাকে নিয়ে হাসপাতালে রওনা হয়ে গেল অ্যাম্বুলেন্স।

শারমীন দীপার এমন অবস্থা দেখে আমার চোখে প্রায় জল এসে গেল। তিতলি আপুর খুবই অন্যায় হয়েছে কাজটা। তার বদলে দীপাকে তার নাচের দলে নেয়া হয়েছে এটা নিশ্চয় মেয়েটার দোষ নয়। আর দীপা যদি আপুকে নিয়ে একটু মশকরা করেই থাকে তাই বলে এত বড় শাস্তি দিতে হবে? দীপার নিশ্চয় পা ভেঙে গেছে। কিন্তু আমার বোনের কোনও বিকার দেখলাম না। সে আমাকে টেনে নিয়ে গেল ওখান থেকে। মুখে তৃপ্তির হাসি।

এবার দেখব শারমীন দীপা কীভাবে টিভিতে নাচে! কণ্ঠে বিষ ঢেলে বলল আপু।

পরদিন স্কুলে এসে শুনলাম দীপাকে ভাঙা পা নিয়ে কমপক্ষে পনেরো দিন হাসপাতালে শুয়ে থাকতে হবে। আরও একমাসের আগে তার হাঁটাচলার জো নেই। তিতলি আপুকে আবার নাচের দলে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। তবে শারমীন দীপা দেড়মাস স্কুলে আসতে পারবে না শুনে সে দুঃখ প্রকাশ তো করলই না বরং মুচকি হেসে আমাকে বলল, আমার সঙ্গে লাগতে এলে এখন থেকে সবার দশা এরকম করব। কাউকে ছেড়ে দেব না।

তিতলি আপুকে নিয়ে আমার খুব চিন্তা হচ্ছিল। দিন দিন ও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। মানুষকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পাচ্ছে। ওকে কী করে ঠেকাব বুঝতে পারছি না।

একদিন সকালে বেলাল চাচার কাছে একটি চিঠি এল। লিখেছেন আমাদের প্রধান শিক্ষয়িত্রী। চিঠি পড়ে রেগে আগুন চাচা।

তিতলি কোথায়? গর্জন ছাড়লেন তিনি।

ওর ঘরে, বললাম আমি।

ঝড় তুলে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলেন চাচা। আমার চাচার স্বভাবটা শান্ত। তবে রেগে গেলে তিনি বাঘ। আমি চাচার পেছন পেছন ওপরে চলে এলাম। তবে আপুর ঘরে ঢোকার সাহস হলো না। দাঁড়িয়ে রইলাম দরজার পাশে। ভয়ে ধড়ফড় করছে বুক। চাচা যেরকম রেগেছেন আপুর কপালে কী আছে আল্লাই জানেন…।

এর মানে কী! বেলাল চাচার ক্রুদ্ধ হুঙ্কার ভেসে এল। তোমার হেডমিস্ট্রেস কমপ্লেন লেটার পাঠিয়েছেন। বলছেন তুমি নাকি পড়াশোনায় একদম মনোযোগী নও। সাপ্তাহিক সবগুলো পরীক্ষায় ফেল মেরে বসে আছ। আর শিক্ষকদের সঙ্গেও নাকি ভালো ব্যবহার করছ না। তুমি জানো কত কষ্ট করে ওই স্কুলে তোমাদের দুবোনকে ভর্তি করিয়েছি? হেডমিস্ট্রেস যদি এখন তোমাকে স্কুল থেকে বের করে দেন?

জবাবে বিড়বিড় করে কী যেন বলল তিতলি আপু ঠিক বোঝা গেল না।

তোমাকে একটা কথা পরিষ্কার বলি, তিতলি, শোনো, গরগর করে উঠলেন চাচা। এখন থেকে প্রতিদিন স্কুল শেষে বাড়ি ফিরে সোজা হোমওয়ার্ক নিয়ে বসবে। আমি নিজে তোমার পড়া নেব। আমি সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত তোমার ছুটি নেই।

তাই নাকি? ভেসে এল তিতলি আপুর চিৎকার, তুমি আমাকে জোর করলেই হলো? আমাকে তোমার শাসন করার অধিকার নেই। কারণ তুমি আমার বাবা নও! চটাস করে চড় মারার শব্দ হলো। সাথে সাথে আপু গলা ছেড়ে কেঁদে উঠল।

আবার যদি আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলেছ? ভেসে এল চাচার গমগমে কণ্ঠ। তারপর খুলে গেল দরজা। থমথমে চেহারা নিয়ে বেরিয়ে এলেন চাচা।

আমি আপুর ঘরে ঢুকলাম। বিছানায় বসে কাঁদছে ও। ফর্সা ডান গাল লাল হয়ে আছে। আঙুলের দাগ পড়ে গেছে। আমাকে দেখে মুখ তুলে তাকাল ও।

ও কে যে আমার গায়ে হাত তোলে? ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল তিতলি আপু, তোর বাবা-মা পর্যন্ত কোনদিন আমার গায়ে একটা টোকা পর্যন্ত দেয়নি। আর ওই লোকটা আমাকে এভাবে মারল! ঠিক আছে, আমিও দেখাচ্ছি মজা।

লাফ মেরে বিছানা ছাড়ল আপু। ছুটে গেল ওয়াড্রোবের সামনে। ওর রাতের পোশাকের নিচে লুকানো সিগার বক্স। বের করল ওটা। বক্স খুলে বের করল বেলাল চাচার নাম লেখা দেশলাইয়ের বাক্স।

ক-কী করছ তুমি? আঁতকে উঠলাম আমি।

দ্যাখ না কী করি!

তিতলি আপু বেলাল চাচার একটা কাটা নখ পুতুলের গায়ে সেঁটে দিল সেলোটেপ দিয়ে। তারপর মুখটা বিকৃত করে ধাই করে পিন ঢুকিয়ে দিল পুতুলের বুক বরাবর।

নিচে, লাইব্রেরি ঘর থেকে ভেসে এল বেলাল চাচার চিৎকার।

আমি ঊধ্বশ্বাসে সিঁড়ি বেয়ে নিচে ছুটলাম। ভয়ে শুকিয়ে গেছে কলজে। জানি না কী দেখব!

বেলাল চাচা লাইব্রেরি ঘরের মেঝেতে বুক চেপে গড়াগড়ি খাচ্ছেন, ব্যথায় নীল হয়ে গেছে মুখ, কোটর ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে চোখ। গলা দিয়ে ঘরঘর আওয়াজ বেরুচ্ছে।

আমি ঘর ফাটিয়ে চিৎকার দিলাম, চাচীইই!

.

স্কয়ার হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্স চলে এল। ডা. কল্লোল ফোন পাওয়া মাত্র ছুটে এসেছেন। চাচাকে পরীক্ষা করে বললেন হার্ট-অ্যাটাক। রক্তশূন্য মুখে মলি চাচী চাচাকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে উঠলেন। কল্লোলও গেলেন সঙ্গে। আমি ছোট বলে সঙ্গে নিলেন না। আর তিতলি আপু ঘর থেকেই বেরুল না। বারেক দাদু দেশের বাড়ি। অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতলে রওনা হবার পরে আমি ঘরের দরজা বন্ধ করে ওপরে চলে এলাম। সোজা ঢুকলাম তিতলির কামরায়। সে বিছানায় বসে কুৎসিত চেহারার পুতুলটাকে আদর করছে। পুতুলের বুকে তখনও গেঁথে আছে আলপিন।

তুমি মানুষ নও, ডাইনি! তিতলির দিকে তাকিয়ে গলা ফাটালাম আমি। পর যে আপন হয় না তুমি আজ আবার প্রমাণ করলে। বাবা-মা যে কী কুক্ষণে তোমার মত মেয়েকে দত্তক নিয়েছিলো! চাচা যদি মরে যায়!

শ্বাপদের মত জ্বলে উঠল তিতলির চোখ।তোরা কেউ আমার আপন নোস্ তা তো ভালো করেই জানিস তা হলে আবার প্যাচাল পাড়ছিস কেন? তোর চাচা মরে গেলে আমার কী? আমার গায়ে হাত তুলেছে। এখন তার ফল ভোগ করুক।

আমি কটমট করে তাকিয়ে থাকলাম তিতলির দিকে। তোমাকে আমার আপু ডাকতেও ঘৃণা হচ্ছে! বলে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে।

রাত নটার দিকে মলি চাচী হাসপাতাল থেকে ফোন করলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন মারা গেছেন বেলাল চাচা। এটা তাঁর দ্বিতীয় হার্ট স্ট্রোক। ডা, কল্লোল নাকি চাচার প্রথমবার স্ট্রোকের সময়ই বলেছিলেন দ্বিতীয়বার স্ট্রোক হলে চাচাকে বাঁচানো মুশকিল হবে। চাচা সাবধানতা অবলম্বন করে চলতেন। কিন্তু তিতলি তাকে বাঁচতে দিল না।

.

চাচী বাসায় ফিরলেন রাত একটার সময়, লাশ দাফন করে। জানালেন ডা. কল্লোলই সব ব্যবস্থা করেছেন। আমাদেরকে গোরস্তানে যেতে দেয়া হয়নি যদি ভয় পাই! ঢাকায় চাচীর কোন আত্মীয়-স্বজন নেই। পরম আত্মীয়ের কাজ করেছেন কল্লোল চাচা। তার স্ত্রী, ওয়ানাইজা চাচী সর্বক্ষণ ছিলেন মলি চাচীর সঙ্গে। রাতে আমাদের সঙ্গে থাকতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু মলি চাচী বললেন দরকার নেই।

ওয়ানইজা চাচী চলে যাবার পরে অনেকক্ষণ কাঁদলেন মলি চাচী। তার সঙ্গে আমিও কাঁদলাম। একবার ভাবলাম চাচীকে বলে দিই ভুডু পুতুলের কথা। কিন্তু বিশ্বাস করবেন না বলে চুপ করে রইলাম। বেলাল চাচাকে আমি খুব পছন্দ করতাম। বাবার মৃত্যুর পরে তিনি আমাদেরকে বাবার আদর দিয়ে পিতা-মাতার মৃত্যু শোক অনেকটাই ভুলিয়ে দিয়েছিলেন। অথচ তিতলিটা এরকম একজন মানুষের ভালোবাসার প্রতিদান দিল এভাবে!

কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লেন চাচী। আমি একটা কথা দিয়ে তার গা ঢেকে দিলাম। তারপর চলে এলাম তিতলির ঘরে। তিতলি নাইটি পরে আছে তবে ঘুমায়নি এখনও। ভুডু পুতুলটাকে দোল খাওয়াচ্ছে আর গুনগুন করে গান গাইছে। আমার ওর দিকে আর তাকাতে ইচ্ছে করছিল না। ঘেন্না লাগছিল। চলে আসছি, পেছন থেকে খপ করে আমার হাত চেপে ধরল তিতলি। ঘুরলাম আমি। তিতলির চোখ উন্মাদের মত চকচক করছে।

পুরো ঘটনাটার জন্য মলি চাচী আমাকে দোষারোপ করবে জানি আমি, খসখসে গলায় বলল ও। পুতুলটার কথা অবশ্য সে জানে না, তবে বেলাল চাচার সঙ্গে আমার কথা কাটাকাটি তো শুনেছে। সে ধরেই নেবে আমার কারণে হার্ট-অ্যাটাক হয়েছে চাচার।

ঠিকই তো, তোমার জন্যই মারা গেছে চাচা। এই পুতুলটা তোমাকে একটা ডাইনি বানিয়েছে, আপু।

আপু বলতে চাইনি, কিন্তু মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে।

আমি ডাইনি না, হিসিয়ে উঠল তিতলি, ডাইনি তোর মলি চাচী। সে তোকে যতটা ভালোবাসে তার সিকিভাগও আমাকে বাসে না। বাসবেই বা কেন আমি তো তোর আপন বোন নই। এখন আমার জীবনটাকে নরক বানিয়ে ছাড়বে। কিন্তু আমি সে সুযোগ তাকে দেব না।

কেন? কী করবে তুমি তার? আমার মুখ শুকিয়ে গেল। প্লীজ, চাচীর কোন ক্ষতি কোরো না।

এ বাড়িতে শুধু তুই আর আমি থাকব, শীতল হাসল তিতলি। তোকে আমি যতই বকঝকা করি না কেন তোকে আমি যথেষ্ট ভালোবাসি, তুলি। এ বাড়িতে শুধু আমরা দুজন থাকলে কেউ আমাদেরকে চোখ রাঙাতে পারবে না, কিছু বলতে পারবে না।

তিতলির হাসি আমার সমস্ত শরীরে ঢেলে দিল বরফ জল। ওকে তো আমি চিনি। ও যখন প্ল্যান করেছে ঠিকই খুন করে ফেলবে মলি চাচীকে। ওকে আমার থামাতেই হবে…!

আমি হাঁটু গেড়ে ওর সামনে বসলাম। করজোড়ে বললাম, প্লীজ, আপু, চাচীকে মেরো না। মলি চাচী তোমাকে কম ভালোবাসে কথাটা ঠিক না। সে তোমাকে আমার মতই ভালোবাসে।

আরে যা ছাগল! ঠোঁট ওল্টাল তিতলি।

তাহলে কাল সকাল পর্যন্ত অন্তত চাচীকে বেঁচে থাকতে দাও, আকুতি করলাম আমি। এখন তুমি রাগের চোটে উল্টোপাল্টা বলছ। কাল সকালে হয়তো তোমার গরম মাথাটা ঠাণ্ডা হবে। তখন আর এসব খুন খারাবীর চিন্তা করবে না।

আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তার নড়চড় হবে না, নিষ্ঠুর গলায় বলল তিতলি। আমার পা ধরে কান্নাকাটি করলেও লাভ নেই। তোর চাচীকে মরতেই হবে। সে আজ রাতে হোক আর কাল সকালেই হোক।

আমি থ হয়ে গেলাম। পনেরো বছরের একটা মেয়ে কী অবলীলায় বলছে সে একজন মানুষকে খুন করবে। এটা কি সত্যি তিতলি নাকি ওই শয়তান ভুডু পুতুলটা ওর ওপর ভর করেছে, ওকে সম্মোহন করে এসব কাজ করাচ্ছে? আমি ভুডু বইটা পড়েছি তিতলির কাছ থেকে নিয়ে। কোনও কোনও ভুডু পুতুলের ওপর নাকি পৈশাচিক আত্মা ভর করে। তারা ভুডু পুতুলের মালিককে সম্মোহন করে তাকে দিয়ে যা ইচ্ছে তাই করায়। তিতলির ক্ষেত্রে এমন কিছু ঘটেনি তো?

তিতলি আবার তার পুতুল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমি ওর ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। ঢুকলাম নিজের ঘরে। শুয়ে পড়লাম বিছানায়। কিন্তু ঘুম আসছে না। ভাবছি তিতলি মলি চাচীর কোনও ক্ষতি করার আগেই ওর কাছ থেকে কীভাবে পুতুলটাকে বাগিয়ে আনা যায়।

কিন্তু তিতলি পুতুলটাকে কখনও কাছ ছাড়া করে না। এমনকী ঘুমায়ও ওটাকে বুকে জড়িয়ে। পুতুল চুরি করতে গেলে ও নির্ঘাত জেগে যাবে।

হঠাৎ একটা বুদ্ধি এল মাথায়। কাজটা ভয়ঙ্কর কিন্তু এ ছাড়া তিতলিকে থামাবার কোনও উপায় নেই।

আমি অনেকক্ষণ চুপচাপ শুয়ে রইলাম বিছানায়। মোটামুটি যখন নিশ্চিত হলাম এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে তিতলি, পা টিপে টিপে বেরিয়ে এলাম নিজের কামরা থেকে। আমার পাশের ঘরটাই তিতলির বেডরুম। ওর ঘরে ঢুকলাম বুকে হৃৎপিণ্ডের ধড়াশ ধড়াশ নিয়ে। সোজা চলে গেলাম তিতলির ওয়াস্রোবের সামনে। লুকানো জায়গা থেকে বের করে নিলাম সিগার বক্স।

চাঁদের আলোয় মলি চাচী লেখা দেশলাইয়ের বাক্সটি তুলে নিলাম। বাক্সের ভেতরে মলি চাচীর কয়েক গাছি চুল।

আমি নিঃশব্দ পায়ে চলে এলাম আমার ঘুমন্ত বোনের শিয়রে। ড্রেসিং গাউনের পকেটে আগেই নিয়ে আসা ছোট, ধারালো কাঁচিটি বের করে অত্যন্ত সাবধানে তিতলির এক গোছা চুল কেটে নিলাম। চাচী এবং তিতলি দুজনের চুলই কুচকুচে কালো। খুব ভালোভাবে লক্ষ না করলে বোঝা যাবে না কার চুল কোটা।

চাচীর চুল দেশলাই বাক্স থেকে বের করে ফেলে দিলাম। ওখানে ভরে রাখলাম তিতলির চুল। তারপর চুপচাপ সিগার বক্স যথাস্থানে রেখে বেড়ালের পায়ে ফিরে এলাম নিজের ঘরে। সে রাতে আর ঘুম হলো না আমার। সারারাত কাঁদলাম চাচার জন্য এবং তিতলির জন্য। আমি এরকম কিছু করতে চাইনি। কিন্তু মলি চাচীকে বাঁচাতে এ ছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিল না।

পরদিন সকালে উঠে তিতলির পায়ে ধরলাম যেন সে মলি চাচীর কোনও ক্ষতি না করে। কিন্তু আমার কথা কানেই তুলল না। সে ইতিমধ্যে পুতুলের গায়ে সেলোটেপ দিয়ে জড়িয়ে দিয়েছে চুল।

আয়, বলল তিতলি, এক সঙ্গে উপভোগ করি মজা।

মলি চাচী ডাইনিং টেবিলে বসে আছেন। তাকিয়ে আছেন দেয়ালের একটি বাঁধানো ফটোগ্রাফের দিকে। চাচী আর চাচার বিয়ের রঙিন ছবি। আমাদের দিকে পেছন ফেরা। তবে থেকে থেকে পিঠটা কেঁপে উঠছে বলে বোঝা যায় চাচী কাঁদছেন।

তিতলি পিন ঠেকাল ভুডু পুতুলের মাথায়।

প্লীজ, আপু…প্লীজ, ফিসফিস করলাম আমি, আমাকে গ্রাহ্য করল না তিতলি। মলি চাচীর দিকে তাকিয়ে অশুভ, ভয়ঙ্কর একটা হাসি ফুটল মুখে।

তারপর সে পিনটা আমূল বসিয়ে দিল পুতুলের মাথায়।

বিস্মিত, যন্ত্রণাকাতর একটা দৃষ্টি ফুটল তিতলির চোখে। হাত থেকে খসে পড়ে গেল পুতুল। গগনবিদারী একটা চিৎকার দিল তিতলি। তারপর পুতুলের মত সে-ও চেয়ার থেকে পড়ে গেল মেঝেতে। বাঁকা-তেড়া হয়ে শুয়ে রইল।

আমি লাফ মেরে মেঝে থেকে তুলে নিলাম পুতুল, একটানে খুলে নিলাম পিন।

কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে…

.

স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো তিতলি আপুকে। ও বেঁচে আছে। তবে ডাক্তাররা বলেছেন ওর ভয়ানক ব্রেন হ্যাঁমারেজ হয়েছে। বাকি জীবনটা হাসপাতালেই কাটাতে হবে। মেশিনের সাহায্যে বেঁচে থাকবে ও, তবে মানুষ হিসেবে নয়। একটা ভেজিটেবল হয়ে।

আমি মলি চাচীর সঙ্গে আছি। বড্ড নিষ্প্রাণ আমাদের জীবন। চাচাকে হারিয়ে চাচীর মুখ থেকে সেই যে নিভে গেছে হাসি, ফিরে আসেনি আর।

আমরা প্রতি বিষুদবার তিতলি আপুকে দেখতে হাসপাতালে যাই। ও আমাদেরকে চিনতে পারে না।

আর ভুডু পুতুল? ওটা এখন আমার জিম্মায়। ওটা মানুষের যে ক্ষতি করেছে, আমি চাই না ওকে অন্য কেউ আবার ব্যবহার করার সুযোগ পাক… শুধু আমি ছাড়া!

No comments