গঙ্গার ইলিশ (জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা-২) – সত্যজিত রায়
সরষেবাটা দিয়ে চমৎকার গঙ্গার ইলিশ সমেত দুপুরের খাওয়াটা হল ফাস্ট ক্লাস। জয়ন্তবাবুর সঙ্গে আলাপ হল খাবার টেবিলে। ইনি মাঝারি হাইটের চেয়েও কম, বেশ সুস্থ, সবল মানুষ। শঙ্করবাবুর পাসোনালিটি এঁর নেই, কিন্তু বেশ হাসিখুশি চালাক চতুর লোক।।
খাবার পর শঙ্করবাবু বললেন, আপনাদের এখন আর ডিস্টার্ব করব না, যা মন চায় করুন। আমি একটু গড়িয়ে নিই। বিকেলে চায়ের সময় বারান্দায় আবার দেখা হবে।
আমরা জয়ন্তবাবুর সঙ্গে বাড়ির আশপাশটা ঘুরে দেখব বলে বেরোলাম।
পশ্চিম দিকে একটানা একটা নিচু থামওয়ালা পাঁচিল চলে গেছে নদীর ধার দিয়ে। পাঁচিলের পরেই জমি ঢালু হয়ে নেমে গেছে জল অবধি। এই পাঁচলাই বাকি তিনদিকে হয়ে গেছে। দেড় মানুষ উঁচু। জয়ন্তবাবুর ফুলের শখ, তাই তিনি আমাদের বাগানে নিয়ে গিয়ে গোলাপ সম্বন্ধে একটা ছাটখাটা বক্তৃতা দিয়ে দিলেন। গোলাপ যে তিনশো রকমের হয় তা এই প্ৰথম জানলাম।
বাড়ির উত্তরে গিয়ে দেখলাম সেদিকে আর একটা গেট রয়েছে। শহরে কোথাও যেতে হলে এই গোটটাই নাকি ব্যবহার করা হয়।
আরেকটা সিঁড়িও রয়েছে এদিকে। জয়ন্তবাবু বললেন খুড়িমা, মানে ওঁর মা, গঙ্গাস্নানে যেতে ওটাই ব্যবহার করেন। একতলায় নদীর দিকে আর গঙ্গার দিকে চওড়া বারান্দা, দুদিক দিয়েই সিঁড়ি রয়েছে নীচে নামার জন্য।
দেখা শেষ হলে পর আমরা ঘরে ফিরে এলাম। জয়ন্তবাবু কাচের ঘরে চলে গেলেন অর্কিড দেখার জন্য।
আমাদের থাকার জন্য একতলায় একটা প্যাসেজের এক দিকে পর পর দুটো ঘর দেওয়া হয়েছে। উলটোদিকে আরও তিনটে পাশাপাশি ঘর দেখে মনে হল তাতেই বোধহয় তিনজন অতিথি থাকবেন। ঘরে ঢুকে বাহারে খাটে নরম বিছানা দেখে লালমোহনবাবু বোধহয় দিবানিদ্রার তাল করছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বললেন, পাখির বইগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া দরকার।
আমি একটা কথা ফেলুদাকে না জিজ্ঞেস করে পারলাম না।
আচ্ছা, এক বছর আগে যে লোক চুরি করেছে, সে যদি এবার আর চুরি না করে, তা হলে তুমি চার ধরবে কী করে?
ফেলুদা বলল, সেটা এই তিন ভদ্রলোককে স্টাডি না করে বলা শক্ত। যার মধ্যে চুরির প্রবৃত্তি রয়েছে, তার সঙ্গে আর পাঁচটা অনেস্ট লোকের একটা সূক্ষ্ম তফাত থাকা উচিত। চোখ-কান খোলা রাখলে সে তফাত ধরা পড়তে পারে। ভুলিস না, যে লোক চুরি করে তার বাইরেট যতই পালিশ করা হোক না কেন তাকে আর ভদ্রলোক বলা চলে না। সত্যি বলতে কী, ভদ্রলোক সাজার জন্য তাকে যথেষ্ট অভিনয় করতে হয়।
বিকেলে পর পর দুটো গাড়ির আওয়াজ পেয়ে বুঝলাম অতিথিরা এসে গেছেন। বারান্দায় চায়ের আয়োজন হলে পর শঙ্করবাবুই আমাদের ডেকে নিয়ে গেলেন তিন গেস্টের সঙ্গে আলাপ করানোর জন্যে।
ডাঃ সরকার এক মাইলের মধ্যে থাকেন, ইনি হেঁটেই এসেছেন। বছর পঞ্চাশ বয়স, চোখে চশমা, মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে, গোঁফটা কাঁচা হলেও, কানের পাশের চুলে পাক ধরেছে।
নরেশ কাঞ্জিলাল বিরাট মানুষ, ইনি সুন্ট-টাই পরে সাহেব সেজে এসেছেন। ফেলুদার পরিচয় জেনে বললেন, বনোয়ারিলালের জীবনী লেখার কথা আমি শঙ্করকে অনেকবার বলেছি। আপনি এ কাজের ভারটা নিয়েছেন শুনে খুশি হলাম। হি ওয়াজ এ রিমার্কেবল ম্যান।
মজার লোক হলেন কালীনাথ রায়। এর কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলছে, তাতে হয়তো ম্যাজিকের সরঞ্জাম থাকতে পারে। লালমোহনবাবুর সঙ্গে পরিচয় হতেই বললেন, পক্ষিবিদ যে মুরগির ডিম পকেটে নিয়ে ঘোরে তা তো জানতুম না মশাই। কথাটা বলেই খপ করে লালমোহনবাবুর পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা মুরগির ডিমের সাইজের মসৃণ সাদা পাথর বার করে দিয়ে আক্ষেপের সুরে বললেন, এ হে হে, এ যে দেখেছি পাথর; আমি তো ফ্রাই করে খাবার মতলব করেছিলুম!
কথা হল রাত্তিরে খাবার পর কালীনাথবাবু তাঁর হাতসাফাই দেখবেন।
সূর্য হেলে পড়েছে, গঙ্গার জল চিক্ চিক্ করছে, ঝিরিঝিরে হাওয়া, তাই বোধহয় নরেশবাবু আর কালীনাথবাবু নেমে গেলেন বাইরের শোভা উপভোগ করতে। লালমোহনবাবু কিছুক্ষণ থেকেই উস্খৃস্ করছিলেন, এবার বাইনোকুলার বার করে উঠে পড়ে বললেন,দুপুরে যেন একটা প্যারাডাইজ ফ্লাইক্যাচারের ডাক শুনেছিলুম। দেখি তো পাখিটা আশেপাশে আছে কি না।
ফেলুদার গম্ভীর মুখ দেখে আমিও হাসিটা কোনওমতে চেপে গেলাম।
ডাক্তার সরকার চায়ে চুমুক দিয়ে শঙ্করবাবুর দিকে ফিরে বললেন, আপনার ভ্রাতাটিকে দেখছি না-সে কি বাগানে ঘুরছে নাকি?
ওর ফুলের নেশার কথা তো আপনি জানেন।
ওঁকে তো বলেছি মাথায় টুপি না পরে যেন রোদে না ঘোরেন। সে আদেশ তিনি মেনেছেন কি?
জয়ন্ত কি ডাক্তারের আদেশ মানার লোক? আপনি তাকে চেনেন না?
ফেলুদা যে চারমিনার হাতে আড়চোখে ডাক্তারের কথাবার্তা হাবভাব লক্ষ করে যাচ্ছে সেটা বেশ বুঝতে পারছি।
আপনার খুড়িমা কেমন, আছেন? শঙ্করবাবুর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন ডাঃ সরকার।
এমনিতে তো ভালই, বললেন শঙ্করবাবু, তবে অরুচির কথা বলছিলেন যেন। আপনি একবার ঢুঁ মেরে আসুন না।
তাই যাই
ডাঃ সরকার চলে গেলেন খুড়িমাকে দেখতে। প্রায় একই সঙ্গে জয়ন্তবাবু ফিরে এলেন। বাগান থেকে-ঠোঁটের কোণে হাসি।
কী ব্যাপার? হাসির কী হল? জিজ্ঞেস করলেন শঙ্করবাবু।
জয়ন্তবাবু টি পট থেকে কাপে চা ঢেলে নিয়ে ফেলুদার দিকে ফিরে বললেন, আপনার বন্ধু কিন্তু চোখে বাইনাকুলার লাগিয়ে বেদম অভিনয় করে যাচ্ছেন পক্ষিবিদের।
ফেলুদাও হেসে বলল, অভিনয় তো আজ সকলকেই করতে হবে অল্পবিস্তর। আপনার দাদার পরিকল্পনাটাই তো নাটকীয়।
জয়ন্তবাবু গভীর হয়ে গেলেন।
আপনি কি দাদার পরিকল্পনা অ্যাপ্রভ করেন?
আপনি করেন না বলে মনে হচ্ছে? বলল ফেলুদা।
মোটেই না, বললেন জয়ন্তবাবু। আমার ধারণা চোর অত্যন্ত সেয়ানা লোক। সে কি আর বুঝবে না যে তার জন্য ফাঁদ পাতা হচ্ছে? সে কি জানে না যে দাদা অ্যাদ্দিনে টের পেয়েছে যে সিন্দুকের একটি মূল্যবান জিনিস গায়েব হয়ে গেছে?
সবই বুঝি, বললেন শঙ্করবাবু, কিন্তু তাও আমি ব্যাপারটা ট্রাই করে দেখতে চাই। ধরে নাও এটা আমার গোয়েন্দা কাহিনী প্রীতির ফল।
না। শুধু ইটালিয়ান নস্যির কৌটো আর মোগলাই সুরাপাত্র। ডাঃ সরকার খুড়িমাকে দেখতে গেছেন। উনি এলেই তুমি ওপরে গিয়ে জিনিস দুটো বার করে আনবে। আমি পকেটে রেখে দেব। এই নাও চাবি।
জয়ন্তবাবু অনিচ্ছার ভাব করে চাবিটা নিলেন।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ডাঃ সরকার ফিরে এলেন। ভদ্রলোক হেসে বললেন, দিবি ভাল আছেন। আপনার খুড়িমা। বারান্দায় বসে দুধভাত খাচ্ছেন। আপনাদের আরও অনেক’দিন জ্বালাবেন।
জয়ন্তবাবু চুপচাপ উঠে পড়লেন।
কী বসে আছেন চেয়ারে? ফেলুদার দিকে ফিরে বললেন ডাঃ সরকার। চলুন। একটু হাওয়া খাবেন!! এ হাওয়া কলকাতায় পাবেন না।
শঙ্করবাবু সমেত আমরা চারজনই সিঁড়ি দিয়ে নামলাম। বাঁয়ে চেয়ে দেখি লালমোহনবাবু বাগানের মাঝখানে একটা শ্বেতপাথরের মূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে এদিক ওদিক দেখছেন। পেলেন। আপনার প্যারাডাইজ ফ্লাইক্যাচারের দেখা? জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।
না, তবে এইমাত্র একটা জঙ্গল বাবলার দেখলুম মনে হল।
এখন পাখিদের বাসায় ফেরার সময়, বলল ফেলুদা। এর পরে প্যাচা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবেন না।
বাকি দুজনে গেলেন কোথায়? বাড়ির সামনের দিকে কি, না কাচের ঘরের পিছনে ফলাবাগানে?
শঙ্করবাবুর বোধহয় একই প্রশ্ন মনে জেগেছিল, কারণ উনি হাঁক দিয়ে উঠলেন—কই হে, নরেশ? কালীনাথ গেলে কোথায়?
একজনকে দেখলুম। এদিকের সিঁড়ি দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকতে, বললেন। লালমোহনবাবু।
কোনজন? প্রশ্ন করলেন শঙ্করবাবু।
বোধহয় সেই ম্যাজিশিয়ান ভদ্রলোক।
কিন্তু লালমোহনবাবু ভুল দেখেছিলেন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন কালীনাথবাবু নয়, নরেশ কাঞ্জিলাল।
সন্ধের দিকে ঝাঁপ করে টেমপারেচারটা পড়ে, বললেন কাঞ্জিলাল, তাই আলোয়ানটা চাপিয়ে এলাম।
আর কালীনাথ? প্রশ্ন করলেন শঙ্করবাবু।
সে তো বাগানে নেমেই আলাদা হয়ে গেল! বলছিল শুকনো ফুলকে টাটকা করে দেবার একটা ম্যাজিক দেখাবে, তাই–
মিঃ কাঞ্জিলালের কথা আর শেষ হল না, কারণ সেই সময় বুড়ে চাকর অনন্তর চিৎকার শোনা গেল।
দাদাঝাবু!
অনন্ত গঙ্গার দিকে বারান্দায় সিঁড়ি দিয়ে নেমে অত্যন্ত ব্যস্তভাবে ছুটে এল আমাদের দিকে।
কী হল অনন্ত? শঙ্করবাবু উদ্বিগ্নভাবে প্রশ্ন করে এগিয়ে গেলেন।
ছোট দাদাবাবু অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন দোতলায়।
Post a Comment