নিশি আতঙ্ক – অনীশ দাস অপু

নিশি আতঙ্ক – অনীশ দাস অপু

গত গ্রীষ্মে, প্যারিস থেকে কয়েক মাইল দূরে, সীন নদীর তীরে একটি ছোট বাড়ি ভাড়া করেছিলাম। ওখানে প্রতি রাতে ঘুমাতে যেতাম। কয়েকদিনের মধ্যেই, আমার এক পড়শীর সঙ্গে খাতির হয়ে গেল। লোকটির বয়স ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে। এরকম অদ্ভুত মানুষের সঙ্গে আগে কখনো পরিচয় হয়নি আমার। লোকটি দাঁড় বাইতে খুব পছন্দ করত। সবসময়ই তাকে পানির ধারে কিংবা নদীতে দেখতাম। এ লোকের বোধহয় নৌকার মধ্যে জন্ম, নৌকাতেই হয়তো একদিন তার মৃত্যু হবে।

একদিন সীন নদীর তীর ধরে দুজনে হাঁটছি, লোকটির কাছে নদী সংক্রান্ত অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলাম। হঠাৎ লোকটি উত্তেজিত হয়ে উঠল, তার চেহারার রং কেমন বদলে গেল, বাকপটু হয়ে উঠল সে এবং প্রায় কবিত্ব এসে গেল তার কথাবার্তায়। তার বুকের মধ্যে একটি জিনিসই শুধু অনুরণন তোলে, একটি বিষয়েই তার যত আগ্রহ এবং অনুরাগ আর তা হলো নদী।

আহ! বলল সে আমাকে, আমাদের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া এ নদীকে নিয়ে কত যে স্মৃতি রয়েছে আমার। আপনারা যারা শহরে থাকেন তারা নদীর মাহাত্ম বুঝতেই পারবেন না। কিন্তু একজন জেলের কাছে শব্দটি একবার কেবল উচ্চারণ করে দেখুন। তার কাছে নদী বড় রহস্যময়ী, প্রগাঢ়, অচেনা, কল্পনা এবং মরীচিৎকার এক দেশ। যেখানে রাতের বেলা মানুষ এমন কিছু দেখে যার কোনো অস্তিত্ব নেই, যেখানে লোকে অদ্ভুত সব শব্দ শোনে, যেখানে অকারণেই একজনের শরীরে উঠে যায় কাঁপুনি যেন গোরস্তানের ভেতরে সে হাঁটছে। এবং সত্যি এটি এক ভয়ানক গোরস্তান যে কবরখানায় কোনো কবর নেই।

জেলেদের কাছে জমিন সীমাবদ্ধ কিন্তু রাতের বেলা অমাবস্যার কালে নদী মনে হয় সীমাহীন। সাগরের প্রতি নাবিকদের কোনো অনুভূতি নেই। সমুদ্র মাঝে মধ্যে বেপরোয়া হয়ে ওঠে, তর্জন গর্জন করে, আবার আপনার সঙ্গে ভদ্র আচরণও করে। কিন্তু নদী নিরব এবং বিশ্বাসঘাতক। এটি কখনো ফিসফাস শব্দ করে না, নিঃশব্দে বয়ে চলে এবং নিরন্তর এই বয়ে চলা আমাকে সাগরের বড় বড় ঢেউয়ের চেয়েও বেশি আতঙ্কিত করে তোলে।

স্বপ্নচারীরা ভান করে সমুদ্র তার বুকে নীল দিগন্তকে লুকিয়ে রাখে যেখানে ডুবন্ত মানুষ বড় বড় মাছদের সঙ্গে সামনে-পেছনে পাক খায়। কিন্তু নদীর রয়েছে কেবল নিঃসীম কালো গভীরতা, যেখানে পিচ্ছিল কাদার মধ্যে পচে যায় লাশ। এর সমস্ত সৌন্দর্য ফুটে ওঠে যখন ভোরের সূর্যের আলোয় চিকমিক করে জল অথবা নলখাগড়ার গায়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের ফিসফিসানির সঙ্গে তীরে ছলাৎ ছলাৎ বাড়ি মারে জল।

তবে আপনি আমার স্মৃতিকথা জানতে চেয়েছেন। আপনাকে আমার জীবনের একটি অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা বলব যেটি ঘটেছিল দশ বছর আগে।

তখন আমি বাস করতাম, এখনও করি, বুড়ি ল্যাফনের বাড়িতে। আমার ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু লুইস বানেট, সে এখন সরকারি চাকরিতে ঢুকেছে বলে নৌকা চালানোর শখ বাদ দিয়েছে, বাস করত সি গাঁয়ে–এখান থেকে দুই ক্রোশ দূরে। আমরা প্রতিদিন একসঙ্গে ডিনার করতাম– কখনও ওর বাড়িতে, আবার কখনও ও আমার বাড়িতে আসত মেহমান হয়ে।

একা রাতে আমি একা একা বাড়ি ফিরছি, বেজায় ক্লান্ত, আমার বারো ফুট লম্বা ভারী নৌকাখানার দাঁড় বাইছি শ্রান্ত দেহে, যেটি আমি সাধারণত রাতের বেলাতেই করে থাকি, কয়েক সেকেন্ডের জন্য থেমে গেলাম রেলরোড সেতু থেকে শ দুই মিটার দূরের ঘন নলখাগড়ার ঝোঁপটার ধারে, খানিক দম নেয়ার জন্য। চমৎকার সুন্দর রাত; ঝলমলে চাঁদের আলোয় ঝিলমিল নদীর জল, বাতাস শান্ত এবং মৃদু। এমন চমৎকার পরিবেশে মনের সুখে ধূমপান করার মজাই আলাদা। আমি নদীতে নোঙর ছুঁড়ে দিলাম পাইপ ধরিয়ে টানবার জন্য।

নৌকা স্রোতের সঙ্গে ভেসে চলছিল, নোঙর সাঁ সাঁ করে নিচে নামতে নামতে একসময় দাঁড়িয়ে পড়ল; আমি স্টার্নে, ভেড়ার চামড়ার গালিচার ওপর আরাম করে বসলাম। কোথাও কোনো শব্দ নেই, শুধু তীরে ঢেউয়ের বাড়ি খাওয়ার মৃদু ছলাৎ ছলাৎ ছাড়া। ওখানে মানুষ সমান লম্বা নলখাগড়াগুলো অদ্ভুত সব আকৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মাঝে মধ্যে দোল খাচ্ছে বাতাসে।

নদী একদম স্থির এবং নিশ্চল, তবে চারপাশের অস্বাভাবিক নীরবতা আমি উপভোগই করছিলাম। সকল প্রাণীকুল –কোলা ব্যাঙ এবং সোনা ব্যাঙ, জলার নৌকা সঙ্গীত শিল্পী যারা –চুপ করে আছে। হঠাৎ আমার ডান দিকে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ডেকে উঠল একটা ব্যাঙ। চমকে উঠলাম আমি। তারপর আবার অটুট নিস্তব্ধতা। আমি আর কিছুই শুনতে পাচ্ছিলাম না। আমি ধূমপানে মনোনিবেশ করলাম। স্বভাবে অতিশয় ধূমপায়ী হলেও সে রাতে ধূমপান করতে পারছিলাম না। দ্বিতীয়বার পাইপে টান দেয়ার পরেই গা-টা কেমন গুলিয়ে উঠল। আর মুখ দিলাম না পাইপে। গুণগুণিয়ে একটি গানের সুর ভাঁজতে লাগলাম। নিজের গলার সুর নিজের কাছেই বড্ড বেসুরো ঠেকল। তাই আমি নৌকার তলায় হাত-পা টান টান করে শুয়ে নিবিষ্টচিত্তে আকাশ দেখতে লাগলাম। কিছুক্ষণ চুপচাপই শুয়ে ছিলাম, হঠাৎ নৌকাটি দুলতে শুরু করলে অস্বস্তি বোধ হলো আমার। মনে হলো এপাশে-ওপাশে ধাক্কা খাচ্ছে। তারপর মনে হলো কোনো অদৃশ্য শক্তি এটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে জলের তলায়, তারপর আবার তুলে ফেলছে ওপর দিকে। আমি যেন ঝড়ের মাঝখানে হুটোপুটি খাচ্ছি; চারপাশে নানারকম শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম; দারুণ চমকে গিয়ে সোজা হয়ে বসলাম। দেখি নদীর জলে রূপালি চাঁদের আলো গলে গলে পড়ছে, সবকিছু আশ্চর্য শান্ত।

আমার স্নায়ুগুলো অস্থির হয়ে উঠছিল। ঠিক করলাম এখান থেকে চলে যাব। নোঙরের শিকল ধরে টান দিলাম। দুলে উঠল নৌকা তখন বাধাটি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠলাম। আমি জোরে জোরে টানতে লাগলাম শিকল। কিন্তু নোঙর তো উঠে আসে না। নদীর তলায় কোনো কিছুতে ওটা আটকে গেছে। আমি টেনেও তুলতে পারছি না। আবার মারলাম টান- বৃথা চেষ্টা। বৈঠা দিয়ে নৌকার মুখ ঘুরিয়ে দিলাম উজানের দিকে নোঙরের অবস্থান পরিবর্তন করতে। কিন্তু কোনোই লাভ হলো না। নোঙর এখনও নদীর তলায় গেঁথে বা আটকে রয়েছে। রাগের চোটে আমি শিকল ধরে সজোরে নাড়া দিলাম। কিছুই ঘটল না। এ শিকল ভেঁড়ার সাধ্য আমার নেই কিংবা নৌকা থেকে এটা ছুটিয়ে নিতেও পারব না কারণ জিনিসটা ভয়ানক ভারী এবং ওটা নৌকার গলুইতে আমার বাহুর চেয়েও মোটা কাষ্ঠখণ্ডের সঙ্গে বোলটু দিয়ে আটকানো। তবে যেহেতু আবহাওয়া ছিল চমৎকার তাই ভাবছিলাম আমাকে বেশিক্ষণ হয়তো অপেক্ষা করতে হবে না। কোনো না কোনো জেলে নৌকার চোখে পড়ে যাব। আমাকে দেখলে তাদের কেউ এগিয়ে আসবে সাহায্য করতে। আমার দুর্বিপাক আমাকে শান্ত করে রাখল। আমি বসলাম এবং পাইপ ফুকলাম। আমার সঙ্গে ব্রান্ডির একটি ফ্লাস্ক ছিল। দুই-তিন গ্লাস ব্রান্ডি পান করলাম। প্রচুর গরম পড়েছে। প্রয়োজন হলে নক্ষত্ররাজির নিচে শুয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়েই পার করে দিতে পারব রাত।

হঠাৎ নৌকার পাশে একটা শব্দ হতেই আমি দারুণ চমকে গেলাম। মাথা থেকে পা পর্যন্ত শীতল স্রোতধারা বইল। শব্দটির উৎস, কোনো সন্দেহ নেই, স্রোতে ভেসে আসা কোনো কাঠের টুকরো, তবু একটা অদ্ভুত অস্থিরতা আমাকে গ্রাস করল। আমি নোঙরের শিকল চেপে ধরে প্রাণপণে টানতে লাগলাম। নোঙর স্থিরই রইল। আমি ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে বসে পড়লাম।

তবে ধীরে ধীরে নদী ঢেকে যাচ্ছিল ঘন সাদা কুয়াশার অবগুণ্ঠনে, জলের ওপর দিয়ে ভেসে আসছিল। আমি খাড়া হয়ে দাঁড়িয়েও না নদী, না আমার পা অথবা নৌকা কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। শুধু নলখাগড়ার ডগা এবং তার পেছনে চাঁদের আলোয় স্নান সমভূমি দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। সেদিকে বড় বড় কালো কালো বিন্দু সটান ঊর্ধ্বমুখী। ওগুলো ইটালিয়ান পপলার গাছের সারি। আমার কোমর পর্যন্ত ঢেকে গিয়েছিল সাদা কাপড়ের মতো। অদ্ভুত কুয়াশায়। তখন উদ্ভট সব চিন্তা খেলছিল মাথায়। কল্পনা করছিলাম কেউ আমার নৌকায় ওঠার চেষ্টা করছে। তবে কুয়াশার কারণে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। নদী অদৃশ্য অস্বচ্ছ কুয়াশার পর্দার আড়ালে। মনে হচ্ছিল ওই পর্দার পেছনে কিম্ভুত সব প্রাণী সাঁতরে আসছে আমার দিকে। ভয়ানক একটা অস্বস্তি ঘিরে ধরেছিল আমাকে। খুলির মাঝখানে শিরশিরে একটা অনুভূতি, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে; আমার মাথা ঠিকঠাক কাজ করছিল না। আমি সাঁতার কেটে পালাবার কথা ভাবছিলাম। তক্ষুণি একটা চিন্তা ভয়ে আমার অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিল। দেখলাম আমি যেন হারিয়ে গিয়েছি, দুর্ভেদ্য কুয়াশার মধ্যে এদিক সেদিক ভেসে চলেছি, চলেছি লম্বা লম্বা ঘাস আর নলখাগড়ার মাঝ দিয়ে, ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ, তীর দেখতে পাচ্ছি না, নৌকা খুঁজে পাচ্ছি না। এই কালো জলের অতলে কেউ আমার পা ধরে হিড়হিড় করে টেনে নামাচ্ছে।

আমার আসলে আগেই উচিত ছিল সাঁতরে নদীর পাঁচশো মিটার পথ পাড়ি দিয়ে নলখাগড়ার ঝোঁপের মধ্যে উঠে পড়া। ওখানে পায়ের নিচে মাটি থাকত আমার। তবে আমি যত ভালো সাঁতারুই হই না কেন দশ ভাগের মধ্যে নয় ভাগ ঝুঁকিই থাকত নদীতে ডুবে মরার।

আমি যুক্তি দিয়ে নিজেকে বোঝাতে চাইলাম। বুঝতে পারছিলাম আমার ইচ্ছাশক্তি ভয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারবে; তবে ইচ্ছাশক্তির পাশে আরেকটি জিনিস ছিল যেটির মধ্যে কাজ করছিল ভয়। আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম কীসে ভয় পাচ্ছি। আমার মনের সাহসী অংশ মনের ভীরু অংশকে তীব্র ভৎর্সনা করছিল; এবং আমি এর আগে এত ভালোভাবে কখনো উপলব্ধি করিনি যে আমাদের মনের মধ্যে বিপরীতধর্মী দুটি জিনিস সারাক্ষণ লড়াই করছে এবং একটি অপরটির ওপর কর্তৃত্ব করতে চাইছে।

এই নির্বোধ এবং ব্যাখ্যাতীত ভীতি আতঙ্কে পরিণত হলো। আমি নিশ্চল হয়ে রইলাম, চক্ষুজোড়া বিস্ফারিত, উৎকর্ণ কান। কীসের আওয়াজ বা শব্দ শুনব বলে আশা করছিলাম আমি? জানি না। তবে বোধহয় ভয়ানক কিছু একটা ঘটবে বলে আশঙ্কিত ছিলাম। ওই সময় যদি কোনো মাছ জল থেকে লাফিয়ে উঠত, যা সচরাচর ঘটে, আমি বোধকরি আঁতকে উঠে অজ্ঞানই হয়ে যেতাম।

তবু, প্রাণপণ চেষ্টায় আমি আমার বোধবুদ্ধি প্রায় ফিরে পেলাম যা আমার কাছ থেকে পালিয়েই যাচ্ছিল। আবারও ফ্লাস্কটি তুলে নিলাম হাতে, বড় বড় ঢোকে পান করতে লাগলাম পানীয়। তারপর একটি বুদ্ধি এল মাথায়। আমি শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে পুব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণে ঘুরে ঘুরে চিৎকার দিতে লাগলাম। গলা যখন পুরোপুরি ভেঙে গেল চিৎকার করতে করতে চুপ হয়ে গেলাম। পাতলাম কান। অনেক দূর থেকে ভেসে এল কুকুরের ডাক।

আবার ব্রান্ডি পান করলাম এবং নৌকার তলায় শুয়ে পড়লাম পিঠ দিয়ে। ঘণ্টাখানেক কিংবা দুই ঘণ্টাও হতে পারে ওভাবে শুয়ে রইলাম আমি চোখ মেলে তাকিয়ে। নানান দুঃস্বপ্ন ঘিরে থাকল আমায়। উঠে বসার সাহস হচ্ছিল না। যদিও প্রবল একটা ইচ্ছা জাগছিল মনে। মনে মনে নিজেকে বলছিলাম ওঠ! উঠে পড়! কিন্তু নড়াচড়া করতে বিষম ভয় লাগছিল। অবশেষে অনেক সাবধানে এবং নিঃশব্দে শরীরটাকে টেনে তুললাম আমি। উঁকি দিলাম নৌকার কিনার দিয়ে।

অমন অপূর্ব সুন্দর এবং মনোহর দৃশ্য জীবনে দেখিনি। ঘণ্টা দুই আগেও যে কুয়াশা ভাসছিল জলের ওপর তা ক্রমে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে নদী তীরে স্তূপ হয়ে জমে আছে। নদী এখন ঝকঝকে। কুয়াশা নদীর দুই পাশে ছয়-সাত মিটার উচ্চতায় নিচু দুটি পাহাড় তৈরি করেছে। পূর্ণিমার আলোয় মনে হচ্ছিল যেন বরফ পাহাড়। আমার মাথার ওপর নীল দুধ সাদা আকাশে বিশাল জ্বলজ্বলে চাঁদ।

জলের প্রাণীগুলো এবার যেন ফিরে পেল প্রাণ, কোলা ব্যাঙ ঘ্যাঙ ঘ্যাঙ করে ডাকতে লাগল, আমার ডান এবং বাম দিক থেকে ভেসে আসতে লাগল জলার ব্যাঙদের কোরাস। অদ্ভুত ব্যাপার আমার আর ভয় করছিল না। ওই অপরূপ দৃশ্যপট আমার মন থেকে সমস্ত ভয় দূর করে দেয়।

দৃশ্যটি কতক্ষণ দেখেছি মনে নেই। কারণ এক সময় আমি ঘুমে ঢুলতে থাকি। আবার চোখ মেলে দেখি চাঁদ নেই আকাশে, চারদিকে মেঘের ভেলা। নদীর জলে ছলাৎ ছলাৎ, বাতাসের কানাকানি, শীত শীত লাগছে, নিবিড় হয়ে এসেছে আঁধার।

ফ্লাস্কে যেটুকু ব্রান্ডি তখনও অবশিষ্ট ছিল পুরোটা গিলে নিলাম ঢকঢক করে। তারপর কম্পমান দেহে শুনতে লাগলাম নলখাগড়ার ঝোঁপের মধ্যে শরশর শব্দ আর নদীর ভুতুড়ে আওয়াজ। আমি চোখ কুঁচকে অন্ধকারে দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ভীষণ অন্ধকারে আমার নৌকা কিংবা নিজের হাত কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। হাত চোখের সামনে এনেও দেখতে। পাচ্ছিলাম না।

যাহোক, আস্তে আস্তে আঁধারের কালো পর্দাটি কেটে যেতে লাগল। হঠাৎ মনে হলো একটা ছায়া চলে এসেছে আমার পাশে। ভয়ে চিৎকার দিলাম! সাড়া দিল একটি কণ্ঠ- একজন জেলে। আমি তার উদ্দেশে হাঁক ছাড়লাম। সে এগিয়ে এল। আমার অসহায়ত্বের কথা তাকে জানালাম। সে তার নৌকা নিয়ে এল আমার নৌকার পাশে। দুজনে মিলে শিকল ধরে টানতে লাগলাম। কিন্তু নোঙর নড়ে না।

অবশেষে ফর্সা হলো। ধূসর, শীতল, বৃষ্টির একটি দিনের আবির্ভাব ঘটল। এরকম দিন সবসময়ই দুর্ভাগ্য ডেকে আনে। আমি আরেকটি জেলে নৌকা দেখতে পেয়ে ডাক দিলাম। এগিয়ে এল সে। ওই লোকটিও যোগ দিল আমাদের সঙ্গে। তিনজনে মিলে টানতে শুরু করলাম শিকল। একটু একটু করে আত্মসমর্পণ করল নোঙর। টের পাচ্ছিলাম খুব ভারী কিছু নিয়ে ওটা ওপরে উঠে আসছে। অবশেষে ওটাকে টেনে তুললাম কালো আবর্জনার একটা পিন্ডসহ।

আর আবর্জনার পিন্ডটি হলো এক বৃদ্ধার লাশ, গলায় মস্ত একটি পাথর বাঁধা!

গী দ্য মোপাসাঁর গল্প অবলম্বনে

No comments