জাহাজ ধরা সহজ নয় – শিবরাম চক্রবর্তী

জাহাজ ধরা সহজ নয় – শিবরাম চক্রবর্তী

গঙ্গাযাত্রার থেকে শুনেছি, খুব কম লোকই বেঁচে ফেরে। পদ্মযাত্রাও আমার কাছে প্রায় তাই।

যতবার পদ্মযাত্রায় বেরিয়েছি একটা না একটা বিপদ ঘটেছেই। একবার তো আমার খুড়তুতো বোনকে শ্বশুরবাড়ি দিতে গিয়ে ….না, সে দুঃখের কথা কেন আর! ঠিক নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গের মত না হলেও, নাকাল হবার কাহিনী তো বেটই। 

পদ্মা আমার কাছে বিপদ-দা! আমার জীবনে বিপদের দান নিয়ে এসেছে বারবার।

সেই বিপদজ্জনক পথেই পা বাড়িয়েছি আবার। সাধের কলকাতা ছেড়ে আমার পদ্মাপারী মামার বাড়ি চলেছি এই গরমের ছুটিতে–আমের আশায়।

শেয়ালদা থেকে লালগোলার ঘাট–রেলগাড়ির লম্বা পাড়ি। সেখানে নেমে, পদ্মার ধারে গিয়ে গোদাগাড়ির ইস্টিমার ধরতে হয়। লালগোলার ঘাটে ইস্টিমারে চেপে পরপারে গোদাগাড়ির ঘাটে গিয়ে নামো, তারপর গোদাগাড়িরতে আবার চাপো রেলগাড়িতে। তারপরে প্রথম ইষ্টিশনই বুঝি

আমনুরা। ইষ্টিশনের নাম শুনেই সজল জিভে সেই আমের কথাই মনে পড়বে তোমার।

আমের রাজ্যের শুরু সেই আমনুরা থেকেই। তুমি মালদহের আমরাজ্যে এসে পড়লে–রাজ্যের আম যে যোগায় সেই মালদা। সারা বাংলায় যার সাম্রজ্য!

আমি অবিশ্যি আমনুরাতেই থামব না। আমনুরা ছাড়িয়ে–আরো কি কি সব পার হয়ে– ইংরেজবাজার পেরিয়ে–আরো কয়েক স্টেশন পরে পৌঁছব গিয়ে সামশিতে। আমের রাজ্য ভেদ করে–আমসত্ত্ব দেশের ওপর দিয়ে–অনেক-অনেক পরে নিজের গাঁয়ের ইষ্টিশনের গায়ে ভিড়ব গিয়ে–প্রায় আমসি হয়েই।

সামসি থেকে ফের এক হাঁটার পাল্লা-পাক্কা দশ মাইলের ধাক্কা–সারা পথটা পায়দলে যাও! ঘন্টা তিন-চার পায়দল যাবার পর তবেই আমাদের আমার মামাদের গ্রাম-চঞ্চল! আর সেই মামাতো–আমবাগান! ভাবতেই, ট্রেন থেকে নামতেই প্রাণে চাঞ্চল্য জাগল। লালগোলাতেই লালায়িত হয়ে উঠলাম–নিজেকে যেন একটু সজীব বোধ করলাম।

সুটকেশটা হাতে করেই পা চালালাম পাড়ের দিকে। শোনা ছিল, লালগোলার ইস্টিমারদের চালচলন সুবিধের নয়। কখন আসে, কখন যায়, তার কোন হদিস পাওয়া যায় না। খুশি মতন আসে, খেয়ালমাফিক ছাড়ে। কিছু তার ঠিকঠিকানা নেই, কাজেই সব–আগে ঘাটে গিয়ে তার পাত্তা নেওয়া ভাল।

চলেছিলাম হনহন করে! মাঝপথে থামাল এক মেঠাইওয়ালা।

আরে বাবু এতো দৌওয়াচ্ছেন কেন? আইসন, গরম পুরী খাইয়ে যান!

হ্যাঁ, বসে-বসে তোমার পুরী খাই, আর এদিকে আমার ইস্টিমার ছেড়ে দিক!

জাহাজ ছাড়তে আখুন ঢের দেরি আছে। জানায় মিঠাইওয়ালা : আখুন তো সজ ভি হোয়নি। সাত বাজবে, আট বাজবে, সওয়া-দশ-ভি বাজ যাবে, বহুৎ পাসিনজর আসবে–ডেক-উক সোব ভরতি হোবে, তব তত ছোড়বে জাহাজ!

ওমা! এমনি ধারাই জাহাজ নাকি? জাহাজের গতিবিধি বুঝি ওই রকম? তা হয়ত হতেও পারে। এমনটাই যে হবে তার একটা আন্দাজও ছিল আমার …মামাদের মুখে শুনে শুনেই। শুনেছিলাম যে, গোদাগাড়ির ইস্টিমারের গদাইলস্কলি চাল! তবে আর হন্যে হয়ে ছুটে কি হবে? আমিও এদিকে জাহাজী কারবার লাগাই না কনে? জাহাজের হন্যে হয়ে ছুটে কি হবে? আমিও এদিকে জাহাজী কারবার লাগাই না কেন? জাহাজের অনুকরণে নিজের পেটের খোল ভর্তি করতে লাগি। আমার উদরও তো বলতে গেলে জাহাজের মতই উদার।

মিষ্টি-টিষ্টি আছে কিছু?

আছে না? কি চাহি আপনার? রসগুলা, পেঁড়া, বরফি, জিলাবি–সবকুছ। বহুৎ বাঢ়িয়া বাঢ়িয়া মিটাই বাবু!

তা বেশ তো? দেখলাও কেইসা বাঢ়িয়া? সব চীজ দেও দো–চারঠো। ইস্টিমার যতক্ষণ না ছাড়ে ততক্ষণ তোমার মিষ্টি মারা যাক। ইস্টিমারকে সামনে রেখে আমার ইষ্টের সাধনায় লাগি। দহিবড়া থেকে শুরু করে, বরফি রসগোল্লা জিলাবি সাবড়ে, এমনকি, লাড্ড পর্যন্ত পান করতে বাকি রাখি না কিছুই। পেঁড়াও গোটা-চার পাচার করি।

খাবার মাঝখানে ইস্টিমারের বাঁশি কানে বাজে। চমকে উঠি–অ্যাঁ। ছাড়লো নাকি ইস্টিমার? মেঠাইওয়ালা কিন্তু ভরসা দেয়–ঘাবড়াইয়ে মৎ বাবু! উ তো পহলী আওয়াজ। ওই রোকম চার-চার দফে ভোঁ-ভো কোরবে তব তো ছাড়বে জাহাজ। দশ-দশ মিনিট যাবে, অউর এক-এক ভোঁ ছোড়বে।

ও, তাই নাকি? শুনে একটু ভরস পাই। তা-তাতো হতেই পারে ইস্টিমার তো ইংরেজি ব্যাকরণে স্ত্রীলিঙ্গই? প্রোনাউনে She! আর মেয়েরা কি একবার আসি বলে বিদায় নিতে পারে? নিয়েছে কখনো? বিনিকেই তো দেখছি, আসি ভাই, আসি ভাই, অন্ততঃ বিরাশীবার না বলে কিছুতেই নড়বে না!

আমি তখন আরো গোটাকয়েক মণ্ডা ঠাসি! মন ঠাণ্ডা করে।

তারপর হালকা-মনে হেলতে-দুলতে ইস্টিমার-ঘাটের দিকে এগোই। ঘাট পেরিয়ে জেটির ডেকে পা দিয়ে দেখি–ওমা একি! আমার ইষ্টিমার যে মাঝপদ্মায়! আমার জন্যে অপেক্ষা না করে নিজেই জেটির মায়া কাটিয়েছে!

সর্বনাশ! আবার কখন আসবে ইস্টিমার? খালাসীদের কাছে জানা গেল যে কাল সকালের আগে নয়। শুনে নিজের ওপর যতো না, তার চেয়ে বেশি রাগ হলো মিঠাইওয়ালার ওপর। সে কেন তার মিঠে বুলিতে এমন করে আমায় মজাল? মজা পেয়েছে?

তাকে পাকড়ালাম গিয়ে তক্ষুণি।

আমার গালাগাল সে অম্লানবদনে হজম করলো। তারপরে নিজের গালে হাত দিলো ঈস! হামকো ভি তো খেয়াল ছিলো না বাবু! আজ হাটবার ছিল যে! হাট-কা আদমি যেতো ফিরোৎ গিলো না? উসি—বাস্তে–জাহাজ জলদি ভোরে গিলো আর ছেড়ে ভি দিলো জলদি।

কিন্তু এই জলদিতে আমার আগুন নিভলো না।–তব-তব-তুম কাহে এইসা ঝুটমুঠ বাতলায়কে আমাকে তকলিফ দিলে?

তকফিল কেনো হোবে বাবু? একঠো একরাত কো বাত তো? আপনি হামার দু-কানে আইসুন ওহি হামার দুকান! মেঠাইওয়ালা অদূরে পথের ধারে তার খেড়োঘরের আটচালার দিকে আঙুল ছোঁড়ে–উখানে হামি থাকে। হামি আউর হামার বিটিয়া–লছমি। আজ রাতঠো হামার ঘরে থাকে, কাল সবেরে জাহাজমে চলিয়ে যান–পুরী-কাচৌরি খাকে নিদ যান খুশীসে-কুনো কসটো হোবে না। হামার পুরী-কছৌরিভি খুব উমদা চীজ আছে বাবু! লালগোলাকে কেতনা আমীর আদমী–

তোমার পুরীকচুরী খায়কে আধমরা হয়ে আছে। এই তো বলছো? তা আমি বুঝতা হ্যায়। কিন্তু বোঝা উচিত ছিলো অনেক আগে। কে জানে, তোমার ঐ সব গেলাবার মতলবেই তুমি আজ আমায় ইস্টিমার ফেল করাবে!

গজরাতে গজরাতে তার পিছু পিছু যাই। ঘরের সামনে গিয়ে সে হাঁক ছাড়ে–লছ মি? আরে বিটিয়া, এই বাবুকো–বাস্তে ই-ঘরমে হামরা খাঁটিয়াঠো…

দোকানের পাশের ঘরটিতে খাঁটিয়া পেতে আমার শোবার ব্যবস্থা সব সেই লছমিই করে দিলো, মেঠাইওয়ালার সেই মুখ-বুজে থাকা বাচ্চা মেয়েটি। আর সে নিজে তুলসীদাসী রামায়ণ পেড়ে তার লালটিম জ্বালিয়ে রামভজন গান করতে লাগল। নামেই লালটিম, আসলে কারো টি টিম্‌।

আর আমি আরেক দফা তার লাড্ডু-পেঁড়ার সঙ্গ রফা করে আমার খাঁটিয়ায় লম্বা হলাম। আর তার পরেই শুরু হল আমার দফা রফা! কী মশা রে বাবা সেখানে। আর যেমন মশা, তেমনই কি ছারপোকা। পদাতিকবাহিনী আর বিমানবহরে যেন যুগপৎ আমাকে আক্রমণ করল। ওপর থেকে–নীচের থেকে–এক সঙ্গে কামড়াতে লাগল আমায়। আগাপাশতলার কোথাও আর আস্ত রাখল না।

হাত পা ছুঁড়ে–এলোপাথাড়ি লাগলাম মশা তাড়াতে। কিন্তু কতো আর তাড়াবো? তাড়াবো কোথায়? পিন-পিন করে কোত্থেকে যে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে! আর সেই সঙ্গে লাখে লাখে ছারপোকাও! পিন পিন করে না এলেও, তাদের জাহাজে আলপিন নিয়ে আসার কসুন নেই। আর এদের রামভোজনের সঙ্গে তাল রেখে….. সেই সঙ্গে চলেছে মেঠাইওয়ালার রামভোজন।

ভোরের দিকে সারা গায়ে চাদরমুড়ি দিয়ে একটু ঘুমের মতো এসেছিলো বুঝি! তন্দ্রার ঘোরে আরেক দিনের ছবি দেখছিলাম! এই পদ্মাতেই আরেক যাত্রার ওই ইস্টিমারের বুকেই যে-কাণ্ডটা ঘটেছিল, তার ছবি কেমন করে জেগে উঠে আবার যেন আমার স্বপ্নালু চোখের ওপর ভাসছিল!

কী বিপদেই না পড়েছিলাম সেদিন-সেদিন এমনি এই পদ্মাতেই। সেই দুর্ঘটনার ঠেলাতেই না আমার ছোটবেলাকার তোতলামি সেরে গেল একবেলায়। একদিনেই জন্মের মতন। সেরকম দুর্দৈব যেন কারুর কখনো না হয়!….

সে-ই আরেক ইস্টিমারযাত্রা। পদ্মার বুকের ওপর দিয়ে চলেছি, পূর্ব্ব বাংলার মুলুকে– খুড়তুতো দিদির শ্বশুরবাড়িতে–দিদি আর জামাইবাবুর সঙ্গে। এইতো কবছর আগের কথা?

সেই প্রথম চেপেছি ইস্টিমারে। চেপে ফূর্তি হয়েছে এমন! ঘুরে-ঘুরে দেখছি চারদিকে। ইস্টিমার কেমন করে জল কেটে-কেটে যাচ্ছে! আঃ সে কী মজা!

আর, কী জোর হাওয়া রে বাব! উঠিয়ে নিয়ে যায় যেন। পদ্মার জলবায়ুর কী উপকারিতা কে জানে! গঙ্গার আর সমুদ্রের হাওয়া খেলে যেমন চেঞ্জের কাজ করে- জোর হয় গায় পদ্মার এই জোরালো-হাওয়ায় তেমনি হয়ে থাকে কিনা জানবার আমার কৌতূহল হয়।

জিজ্ঞাসু হয়ে জামাইবাবুর কাছে যাই। ব-বলি ও জা-জা-জা জাম-, বলতে গিয়ে কথাটা জাম হয়ে যায় গলায়।

ব-ব-বলছিলাম কি যে, এই চে-চে-চে-চে-চেঁ

এই চেঁচাচ্ছো কেন, হয়েছে কি? চেঁচিয়ে ওঠেন উনি নিজেই।

চে-চে-চেঁচাব কেন? ব-ব-বলছি যে, চে-চে-চে-চেইন…!

ঐ পর্যন্তই রইল। চেইন-কে আর ওর বেশি টানা গেল না।

না ইস্টিমারের চেইন থাকে না। ইস্টিমার কি রেলগাড়ি যে চেন থাকবে?

জবাব দিলেন জামাইবাবু।আর চেনের কথাই-বা কেন? চেন টেনে ইস্টিমার থামাবার কি দরকার পড়ল তোমার হঠাৎ, শুনি?

না-না, চে-চেইন না। চে-চে-চে-চে–জবাবদিহি দিতে গিয়ে আমার চোখ-মুখ কপালে উঠে যায়। কিন্তু ঐ চে-কারই সার, তার বেশি আর বার করা যায় না। তখন ভাবলাম যে, চেঞ্জ-কথাটা এই পাপ গলা দিয়ে যদি না গলতে চায়, তার বদলে বায়ু পরিবর্তনকেই না হয় নিয়ে আসি। কিন্তু শোনার ধৈর্য থাকলে তো জামাইবাবুর! চে-চে-চেন্না! ব-বলছি কি, যে বা-বা-বা-বা বা-বা-বাবা … কিন্তু মাঝ পথেই তিনি বাধা দিয়েছেন–বাবা রে-বাবা! পাগল করে দেবে নাকি?…বলেছি না তোমাকে? কতবার তো বলেছি যে তোমার যা বলবার তা গান করে বলবেশ করে সুরে ভেঁজে নিয়ে গাও? গানই হচ্ছে তোতলামির একমাত্র দাবাই। যদি সারাতে চাও তোমার এই তোতলামো তো গানের সাহায্য নাও। কেন, সুর খেলিয়ে বলতে কি হয়? আর সুর বার করা এমন কিছু শক্তও না। স্বরটা নাকের ভেতর দিয়ে বার করলেই সুর হয়। আর কিছু না থাক, নাক তো আছে?

তা তো আছে। কিন্তু তাই বলে হাতির মতন এমন কিছু লম্বা নাক নয় যে ইচ্ছে করলেই আমি শুঁড় খেলাতে পারবো? কিন্তু কথাটা আর মুখ খুলে বলার দুশ্চেষ্টা করি নে। মনে মনেই বলে বিমুখ হয়ে দিদির কাছে চলে যাই।

দিদি তখন ডেকের মেয়েলী এলাকায় রেলিঙের ধার ঘেষে পদ্মার শোভা দেখছিলেন। ইস্টিমারের দাঁত কেমন ঢেউ কেটে চলেছে, দেখছিলেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। দেখতে-দেখতে–

দেখতে না দেখতে তক্ষুণি আবার ছুটে আসতে হয়েছে তার বরের–সেই বর্বরের কাছেই আবার।

দি-দি-দি-দি-দি-দি…।

দিদির কথাটা ভাল করে বলতেই তার বাগড়া এল।–না, কিছু তোমার দিতে হবে না কিছু আমার চাইনে।

দি-দিচ্ছেনে তো–বলছি কি যে, তো-তো-তো-তো-তো।

অবার তোতলাতে লেগেছো? কি বললাম একটু আগে?

যা বললাম গান করে বলতে বলিনি? তিনি বেঁকিয়ে উঠলেন।

বলো, গান গেয়ে বলো! প্রাণ খুলে গাও, গান খুলে বাতলাও। আমি কান খুলে শুনি! শুনে আমার জন্ম সার্থক করি।

তখন বাধ্য হয়ে আমায় বাল্মীকি হতে হয়। তিনি যেমন ক্রৌঞ্চ বিরহে কাতর হয়ে তাঁর প্রথম শ্লোক ঝেড়েছিলেন, আমিও তেমনি মুখে-মুখে আমার গান বাঁধি–মনের দুঃখে :

ইস্টিমারে চেন থাকে না বলছিলে না মশায়,
কিন্তু থাকলে ভাল হতো এখন এরূপ দশায়।

বাঃ বাঃ বেশ! এই তো! এই তো খাসা বেরুচ্ছে। তিনি বাহবা দেন, বেশ সুরেলা হয়েই বেরুচ্ছে তো! তোফা!

ভগ্নকণ্ঠে আবার আমায় সুর নাড়তে হয়?

আমার দিদি, তোমার বৌ গো–
বলতে ব্যথা লাগে!
মরি হায় রে—

মরি হায় রে! মরে যাই–মরে যাই! বড়-বড় ওস্তাদের মতোই টিটকিরি মারতে শিখেছো দেখছি? তিনি টিটকিরি মারেন।

কিন্তু ওস্তাদি কাকে বলে জানি না, আমার গানের সুরগুলি নাকের থেকে- gun থেকে গুলির মতই শেষ পর্যন্ত না দেখে থামা যায় না–

মরি হায় রে!…
তোমার যে বৌ–আমার যে বোন–
বলতে বেদন জাগে।
জলে পড়ে গেছেন তিনি
মাইল তিনেক দূরে
মরি হায় হায় রে!!!

দুঃস্বপ্ন ভাঙতেই খাঁটিয়া ছেড়ে লাফিয়ে উঠেছি। কখন সকাল হলো? ইস, বড্ডো বেলা হয়ে গেছে যে! ইস্টিমার ধরতে পারলে হয় এখন!

সুটকেসটা তুলে নিয়েই ছুটলাম। পথে নামতেই সেই সদালাপী মেঠাইওয়ালা সামনে এল–আরে বাবু! জাহাজ ছোড়তে আবি বহু দেরি! জাহাজ আখুনো আসেই নাই! গরমাগরম পুরী ভাজিয়েছে–খাইয়ে যান!

তোমার পুরী আমার মাথায় থাক! বলে আমি মাথা নাড়ি : তোমার আর কি? তুমি খাইয়ে যাও, আর আমি খুইয়ে যাই! কালকেও তুমি ঐ কথাই বলেছিলে। ঐ বলে সারারাত তোমার ছারপোকা আর মশার কামড় খাইয়েছে। কিন্তু আর না!

সেই সঙ্গে সঙ্গীত–সুধা পানের কথাটা আর পাড়লাম না। পা বাড়ালাম। মনে মনেই বললাম, একবার নিজের পুরীতে গিয়ে যদি পৌঁছুতে পারি–আমনুরার গাড়ি ধরতে পারি যদি–তাহলে আসল মেঠাই খাবো আমার মামার বাড়ি। আমের চেয়ে মিঠে কিছু আর আছে নাকি? ঝুড়িখানেক আম আর এক গামলা ক্ষীর নিয়ে বসে যাও, খোসা ছাড়িয়ে ক্ষীরে ডুবিয়ে খোস মেজাজে থাকো। এক পয়সা খরচা নেই আমের পেছনে। আরামসে খাও। তারপর বিকেলে ছুরি হাতে বেরিয়ে পড়ো বাগানে, আমগাছের ডালে উঠে আমোদ করে! হনুমানদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লাগো। আমের জন্যে কোন ব্যয় নেই। যা কিছু ব্যায়াম তা শুধু খাওয়ার। হাতের আর মুখের।

ছুটতে-ছুটতে ঘাটের কিনারায় পৌঁছই। পৌঁছেই দেখি–আঃ ঐ যে আমার ইস্টিমার সামনেই খাড়া! ধড়ে আমার প্রাণ এল এতক্ষণে। এক দৌড়ে জেটির কোলে গিয়ে পড়লাম।

জেটিতে ইস্টিমারে চারধারেই তাড়া। ভীষণ হৈ-চৈ। এ-খালাসী ডাকছে ও খালাসীকে ভাইয়া হো! ইস্টিমারও ডাকছে কাকে তা বলা কঠিন। কিন্তু তার দারুণ ভেঁয়েজ কানে তালা ধরিয়ে দেয়।

জেটির কিনারে ইস্টিমারের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। ওমা, ইস্টিমার যে জেটির বাঁধ কেটেছেন! ইস্টিমারে আর জেটিতে তখন বেশ কিছুটা ফারাক! ইস্টিমারের পাটাতন ইস্টিমার ভিড়লে যেটি জেটির গায়ে এসে লাগে-সেতুবন্ধের মতই–যার ওপর দিয়ে যাত্রীরা ওঠে নামে–যায় আসে–গটগট করে হাঁটে– কুলীরা যতো মাল তোলে, নামায়–যার সঙ্গে ইস্টিমারের জ্যেঠতু্তো সম্পর্ক–সেই সম্পর্ক আর নেই।

সে-সম্বন্ধ ছিন্ন হয়েছে আমার আসার আগেই। ইস্টিমারের খালাসীরা তাদের পাটাতন তুলে নিতে যাচ্ছে…

এখন বুকের পাটা চাই। লালগোলায় ইস্টিমার ধরতে বেগ পেতে হবে বেশ–আমায় জানানো হয়েছিল বার-বার। সেই বেগ পেতে হলো এখন। আমি আগু-পিছু করি বেগ পাবো কি পাবো না? তারপর মারি একলাফ সবেগে। মরিয়া হয়ে পড়ি গিয়ে পাটাতনের ওপর পদ্মার ভগ্নাংশ পার হয়ে। গিয়ে বসে পড়ি। আমার কাণ্ড দেখে সবাই হৈ-হৈ করে ওঠে!

ইস্টিমারে–জোটির যতো লোক। কিন্তু কে কী বলছে, তা শোনার তখন কি আমার হুশ আছে! না কিছু দেখছি–না শুনছি! পায়ের তলায় পাটাতন পেয়েছি এই ঢের। মুহূর্তটাক বসে থাকি, তারপরে টলতে-টলতে উঠি-উঠে দাঁড়াই! সুটকেস আমার হাতে। তারপর আমার নজর, নীচের দিকে। পাটাতনের তলায়–ওমা, এ যে থৈ-থৈ জল! দেখে আবার আমি বসে পড়ি। পাটাতনের নীচেই পদ্মার বিস্তার! আমার মাথা ঘুরতে থাকে।

উপুড় হয়ে পড়ি আবার–পাটাতনের উপর হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটি…আস্তে আস্তে এগুতে থাকি…সুটকেস টানতে টানতে। দিচ্ছি তো দিচ্ছিই হামাগুড়ি। যেন এর শেষ নেইকো। ইস্টিমারের ডেক মনে হয়, মাইল দেড়েক দূরে। যাই হোক, যত দেরিই হোক, গুঁড়ি মেরে মেরে পৌঁছালাম গিয়ে। উঠলাম ডেকে। তখন দেহের সাথে সাথে সারা মনও যেন আমাকে ডেকে উঠল–পেয়েছি! পেয়ে গেছি!!

ডুকরে উঠল মনের থেকে ধন্যবাদ বিধাতার উদ্দেশ্যে ইস্টিমারের উদ্দেশ্যে আমার নিজের উদ্দেশ্যে মুখর হয়ে ডেকের উপর নিজেকে রেখে হাঁপাতে থাকলাম।

নাঃ, আর না–আর ককখনো না। কদাপি আর এমন বিপজ্জনক কাজে হাত দেবো না–হাত পা কোনাটাই নয়। শপথ করি নিজের মনে। মা দুর্গার দয়ায় বড্ডো বেঁচে গেছি এ-যাত্রা।

হুঁশ হতে দেখলাম, এক-জোড়া চোখ আমার দিকে তাকিয়ে।

নীল পোশাকে এক খালাসী।

ঈস! ইস্টিমার–ধরা কি চাট্টিখানি? হাঁপ ছেড়ে আমি বলি কিন্তু ধরতে পেরেছি শেষ পর্যন্ত। কি বল খালাসী সায়েব?

খালাসীটা হাসল-–কি দরকার ছিল বাবু এত মেহনতের? জাহাজ তো আমরা ভেড়াচ্ছিলাম জেটিতেই। খানিক পরে এমনি আসতেন–হেঁটেই আসতেন সোজা। সবুর করলেই পারতেন একটু।

অ্যাঁ? তাই নাকি? তখন আমার খেয়াল হলো। হ্যাঁ, তাও হতে পারে। পাটাতন তুলছিল না, নামাচ্ছিলই খালাসীরা। নামিয়ে জেটির গায়ে লাগানো হচ্ছিল–বুঝতে পারলাম তখন।

তাকিয়ে দেখলামও তাই। গোদাগাড়ির সোরগোল করে লালগোলার জেটির কোলে এসে ভিড়েছে। জ্যেঠতুতো সম্পর্কের আত্মীয়তা সুনিবিড় হয়েছে এতক্ষণে।

ওপারে যাত্রীদের নিয়ে ইস্টিমারটা এসে পৌঁছল সেই মাত্তর!

No comments