ভুতুড়ে ফুটবল – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
সেদিন বাড়ির রোয়াকে বসে কজন মিলে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল নিয়ে রীতিমতো হই-চই বাঁধিয়েছি, হঠাৎ কোত্থেকে একটা ফুটবল এসে দমাস করে মাঝখানে পড়ল। তারপর ফুটবলটা ডিগবাজি খেয়ে লাগল গিয়ে একেবারে ধনাদার গায়ে। ধনাদা সবে সেজেগুজে অফিসে বেরুচ্ছেন। ফিনফিনে আদ্দির পাঞ্জাবিতে একটা দাগড়া কালো ছোপ ফেলল। তবে সেটাও বড় কথা নয়, ধনাদা ধরাশায়ী হয়ে চেরাগলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, ধর! ধর! ধর ব্যাটাকে।
আমরা হকচকিয়ে গিয়ে এদিক-ওদিক তাকালাম। কিন্তু খেলোয়াড়দের দেখতে পেলাম না। গলিটা মোটামুটি চওড়া। এমাথা থেকে ওমাথা অবধি পরিষ্কার দেখা যায়। বলটা তাহলে এল কোত্থেকে?
ধনাদা উঠে দাঁড়িয়ে তেড়ে এলেন, ধরতে পারলিনে বলটা? কী রে তোরা!
আমরা হেসে ফেললাম। মিঠুন বলল, আপনি বলটা ধরতে বলছিলেন? আমরা ভাবলাম…
কথা কেড়ে ধনাদা দাঁত খিঁচিয়ে বললেন,–ওয়ার্থলেস! তোরা এতগুলো গাঁট্টাগোট্টা ছেলে থাকতে ব্যাটা ফের ফাঁকি দিয়ে কেটে পড়ল!
আমি বললাম,–কেটে পড়বে কোথায়? দাঁড়ান, খুঁজে দিচ্ছি।
ধনাদাকে ধরাশায়ী করে বলটা আবর্জনার গাদা ভর্তি একটা টিনের টবে পড়েছে দেখেছি। তাই দৌড়ে টবটার কাছে গেলাম। কিন্তু কোথায় বল?
ধনাদা বেজার মুখে বললেন,-নেই ফের হাওয়া হয়ে গেছে। হবেই, সে তো জানা। ঠিক আছে! আমারও নাম ধনপতি শর্মা! একদিন না একদিন খপ করে ব্যাটাকে ধরে ফেলবই। তারপর ফাটিয়ে ছাড়ব। আমার সঙ্গে ফড়ি!
আমরা অবাক হয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছিলাম। ধনাদার কথাবার্তা শুনে কিছু বুঝতে পারছিলাম না। ধনাদা বাড়ি ঢুকে একটু পরে জামা বদলে বেরুলেন এবং গম্ভীরমুখে চলে গেলেন।
নান্তু বললে, কিছু বোঝা গেল না। আয় তো বলটা খুঁজে দেখি। নিশ্চয় হারাধনের ঘরে গিয়ে ঢুকেছে।
হারাধন ধোপর ঘর আবর্জনার টবের ওপাশে। জামাকাপড় ইস্তিরি করছিল। আমাদের কথা শুনে আঁতকে উঠে ইস্তিরি, টেবিলের আশপাশ, তলা তন্নতন্ন করে খুঁজল। ঘরভর্তি ধোয়া কাপড়-চোপড়। ময়লামাখা একটা ফুটবল সেখানে ঢোকা ভালো নয়।
কিন্তু কোথায় বল? পাশের মুদি দোকান, সন্দেশের দোকান, দর্জির দোকান সবখানে খুঁজেও পাত্তা মিলল না, আশ্চর্য! ফুটবলটা কি শুন্যে উবে গেল? আমাদের জেদ চড়ে যাচ্ছিল। আশেপাশে প্রত্যেকটা বাড়ি খুঁজে তোলপাড় করলাম। কোথাও বলের হদিশ পাওয়া গেল না। কেউ ওটা লুকিয়ে রেখে আমাদের মিথ্যা কথা বলবে বলে মনে হয় না। পাড়ায় আমাদের এই দলটার ভীষণ দাপট!
শেষে অনি বলল, ধ্যাৎ! ছেড়ে দে। মনে হচ্ছে, গড়িয়ে গিয়ে যেভাবে হোক, হাইড্রেনের তলায় চলে গেছে।
কথাটা মনে ধরল। ও নিয়ে মাথা ঘামালাম না।
দিনকতক পরে দেখি, ধনাদার বাড়ির সামনে একটা টেম্পোতে মালপত্র বোঝাই হচ্ছে। ধনাদা ব্যস্তভাবে তদারক করছেন। কাছে গিয়ে বললাম, কী ব্যাপার ধনাদা? এসব নিয়ে কোথায় চলছেন?
ধনাদা গম্ভীরমুখে বললেন, বাসা বদলাচ্ছি।
–সে কী! এ পাড়ায় তো ভালোই ছিলেন।
ধনাদা আরও গম্ভীর হয়ে বললেন, না রে ভাই! এখানে এসেও রেহাই পেলাম কই? গত বছর নারকেলডাঙা থেকে তোদের পাড়ায় চলে এসে ভাবলাম, যাকগে, এবার স্বস্তিতে থাকা যাবে। কিন্তু হতচ্ছাড়া এখানেও আমার পেছনে লাগল।
অবাক হয়ে বললাম, কে সে? বলুন না তাকে আমরা ঢিট করে ছাড়ছি।
ধনাদা হতাশভাবে বললেন,-পারবি না। পারবি কি? কী সাহস দেখলি তো স্বচক্ষে সেদিন। ক্রমশ ব্যাটার স্পর্ধা বেড়ে যাচ্ছে। আগে তো ঘরের ভেতর একা বসে থাকার সময় এসে জ্বালাত–সেও সন্ধ্যার পর। এখন দিনদুপুরে সবার সামনে এসে বেয়াদপি জুড়েছে!
আমরা বললাম,-ব্যাপারটা কী বলুন তো?
ওই ফুটবল। আবার কী।ধনাদা গলা চেপে বললেন। গতবার নারকেলডাঙা থেকে পিছু নিয়েছে, যখন-তখন কোত্থেকে এসে দমাস করে গায়ে পড়ছে। তারপর হাওয়া!
বিশ্বাস হল না। বললাম, যাঃ! কী বলছেন! ফুটবল কি মানুষ? খামোকা আপনার পেছনে লাগবে কেন?
ও তোরা বুঝবিনে, বলে ধনাদা নিজে কাজে মন দিলেন।
আমি মিঠুনের খোঁজে চললাম। ব্যাপারটা ভারি রহস্যজনক। ওদের বলা দরকার।…
ধনাদা বাসা বদলে বেনেপুকুরে গিয়ে উঠেছিলেন। ঠিকানা জোগাড় করে আমি, নান্তু, মিঠুন আর কাজল কদিন পরে এক রবিবারে সেখানে হাজির হলাম। ধনাদাকে কেমন বিষয় দেখাচ্ছিল। বরাবর একা মানুষ। স্বপাক খান। একঘরের ফ্ল্যাট হলেই চলে যায়। বেনেপুকুরে এ বাসাটা একেবারে তিনতলার ছাদে, চিলেকোঠামতো একটা ঘর। মিঠুন দেখেটেখে বলল, এত ওপরে ফুটবলটা আর উঠতে পারবে না, ধনাদা।
ধনাদা করুণ হাসলেন। কী বলিস! ব্যাটা স্বগৃগে গিয়েও রেহাই দেবে না। বরং তেতলার ওপর উঠে দেখছি আরও ভুল করেছি। এখন প্রায়ই এসে হানা দিচ্ছে। একটু আগে ওখানটায় বসে চা খাচ্ছি, ব্যস! এসে গদাম করে পিঠে পড়ল! এই দ্যাখ না, জামার কী অবস্থা করেছে!
ধনাদার পিঠে জামার ওপর কাদার ছোপ দাগড়া হয়ে গেছে। কাজল মারকুটে ছেলে। গোঁ ধরে বলল, ঠিক আছে। এবার আসুক! ধরে অ্যায়সা কিক মারব, সোজা ধাপার মাঠে গিয়ে পড়বে বাছাধন।
ওর কথা শেষ হতে না হতে সেই অবাক-ফুটবল বাঁই করে এসে একেবারে ধনাদার মাথায় পড়ল। ধনাদা অঁক শব্দ করে পড়ে গেলেন। বলটা লাফিয়ে উঠতেই কাজল হেড করার ভঙ্গিতে দৌড়ে গেল। কিন্তু বলটা মহা ধড়িবাজ। গুলতির মতো ছুটে নিচে কোথাও গিয়ে পড়ল।
ধনাদাকে ওঠালাম। উঠে হাঁপাতে-হাঁপাতে বললেন,–দেখলি? দেখলি তো?
এবার দিনদুপুরেই আমাদের গা ছমছম করতে থাকল। এ নিশ্চয় ভূতে পাওয়া একটা ফুটবলের কীর্তিকলাপ। ভূতের ব্যাপার-স্যাপার যতদূর জানি মরা মানুষ কিংবা জন্তু-জানোয়ার সেজে ফকুড়ি করে বা ভয় দেখায়। ফুটবল রূপ ধরে এমন বেয়াড়াপনা করতে তো শোনা যায় না।
একটু পরে ধনাদা হপ সামলে বললেন,-এবার ভাবছি একজন ভূতের রোজা না ডাকলেই নয়।
বললাম, কিন্তু সব থাকতে একটা ফুটবল-ভূত কেন আপনার পেছনে লাগল বলুন তো?
ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে ধনাদা বললেন,–এই বলের পেছনে যে খেলোয়াড় আছে, তার নাম বললে তোরা চিনবিনে, তোদের তখন জন্মই হয়নি। ওর নাম ছিল গোবর্ধন ঘড়াই–মোহনবাগানের সে আমলে নামকরা সেন্টার ফরোয়ার্ড ছিল গোবর্ধন ঘড়াই। আর আমি ছিলাম তখনকার বিখ্যাত রেফারি। আই. এফ. এ. শিল্ডের খেলা। আমি রেফারি। ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে ফাইনাল খেলা হচ্ছে। গোবরা শেষ মুহূর্তে একটা গোল করল। কিন্তু আমার ডিসিশন অফসাইড। গোবরা গেল আমার ওপর খেপে। খেলা ড্র হয়ে গেল। মাথার ওপর শিল্ড ঝুলছে।
কাজল বলল,–তারপর? তারপর?
ধনাদা সে কথায় কান না করে বললেন,–গোবরার সারাজীবন এ দুঃখটা ছিল। গতবছর সে মারা গেছে। বয়স হয়েছিল আমার মতন।
নান্তু বলল, নামটা শোনা। গোবর্ধন ঘড়াই বললেন তো?
হুঁ। –বলে ধনাদা ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। বোস তোরা। চা-টা খেয়ে যাবি।
ধনাদা ঘরে ঢুকলে কাজল বলল, রেফারিগিরি করার এই বিপদ!
আমরা তাতে সায় দিলাম।–
এই ঘটনার মাসখানেক পরে এক সকালে যথারীতি রোয়াকে আড্ডা দিচ্ছি, ধনাদা ট্যাক্সি চেপে হাজির। মুখ বাড়িয়ে বললেন,–শিগগির! শিগগির! আমার সঙ্গে
আমরা দৌড়ে কাছে গেলাম। বললাম, কী হয়েছে ধনাদা?
ধনাদা চোখ নাচিয়ে ফিক করে হেসে বললেন,–ব্যাটাকে ধরে ফেলেছি আজ। ধরেই না রেশনের থলের মধ্যে পুরে মুখটা আচ্ছাসে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছি। দেখবি আয়।
ট্যাক্সিতে চেপে বসলাম আমরা। ট্যাক্সি ছুটে চলল বেনেপুকুরের দিকে।
উত্তেজনায় আমরা অধীর। ধনাদা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে-উঠতে বললেন, দরজায় দুটো তালা এঁটেছি। ব্যাটাকে থলেবন্দি করে রেখে দিয়েছি তক্তপোশের তলায়। যাবে কোথায়?
দরজার তালা খুলে তক্তপোশের তলা থেকে থলেটা বের করলেন ধনাদা। কাজল বুদ্ধি করে দরজার মুখে দাঁড়াল। থলের মধ্যে গোলাকার জিনিসটা হাতে টিপে আমরা আশ্বস্ত হলাম। ধনাদা মিটিমিটি হেসে বললেন,–এখানে বসে কাগজ পড়ছি। আর ব্যাটা সুড়ং করে এসে দু-ঠ্যাঙের ফাঁকে পড়েছে। মানে, কিক করেছে গোবরা কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল আর কী? খপ করে ধরে ফেলেছি তক্ষুনি। এবার?
বলে ধনাদা দুম করে এক কিল মারলেন থলের ওপর। অমনি থলেটা লাফিয়ে উঠল। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম,–পালাবে! পালাবে!
থলেটা ঘরের ভেতর লাফ দিতে শুরু করল। ধনাদার হাত ফস্কে গেল। দরজার কাছে এগোতেই কাজল দরজা বন্ধ করে দিল। নান্তু কিক ঝাড়ল সঙ্গে সঙ্গে। থলেটা ঘরময় লাফালাফি জুড়ে দিল। আমরা তার ওপর সমানে কিক ঝাড়তে থাকলাম। তারপর ধনাদা ওটার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে ধরে ফেললেন এতক্ষণে! হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন,–চল। ব্যাটাকে ধাপায় পুঁতে রেখে আসি…।
ধাপা অনেকটা পথ। কিন্তু গোবর্ধনবাবুর ফুটবল সারা পথ চুপ করে রইল বেগতিক দেখেই।
ধাপায় পৌঁছে কাজল একটা ছুরি দিয়ে গর্ত খুঁড়তে শুরু করল। খোঁড়া হলে সে থলেসুষ্ঠু ফুটবলটা গর্তে ফেলতে যাচ্ছে দেখে ধনাদা আঁতকে উঠলেন। আরে করিস কী? করিস কী? এটা আমার রেশন আনবার থলে। আড়াই টাকা দাম। বরং মুখটা ফঁক করে গলিয়ে দে।
কিন্তু দড়ি খোলার সঙ্গে-সঙ্গে ঘটল আরও উদ্ভট ব্যাপার। কোথায় ফুটবল। একটা কালো বুনো বিড়াল লাফ দিয়ে বেরিয়ে গেল? তারপর বাই বাই করে দৌড়ে গিয়ে একটা আবর্জনার ঢিবিতে উঠে থামল এবং আমাদের দিকে ঘুরে-ঘুরে জুলজুলে হলুদ চোখে তাকিয়ে দাঁত বের করে ধমক দিল, মা-ও-ও। তারপর আর তার পাত্তা পাওয়া গেল না। ধনাদা হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। তারপর হতাশ-ভঙ্গিতে বললেন,–এবারও ফস্কে গেল!
কাজল ফোঁস করে বললেন, ধুস! ছিল ফুটবল, হয়ে গেল বেড়াল। কোনও মানে হয়?
Post a Comment