সমুদ্র বিলাস – হুমায়ূন আহমেদ

সমুদ্র বিলাস – হুমায়ূন আহমেদ

প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে আমি ছোট্ট একটা ঘর বানাচ্ছি। পৃথিবী নামক এই গ্রহে নিজের জায়গা বলতে এইটুকু। কেন এই কাজটা করলাম? ব্যাপারটা কি তাৎক্ষণিক? হুট করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বসা?

আমরা সব সময় বলি–হুট করে কিছু না ভেবে কাজটা করেছি। ব্যাপারটা মনে হয় সে রকম নয়। মানুষ কখনোই তাৎক্ষণিকভাবে কিছু করে না। তার প্রতিটি তাৎক্ষণিক কাজের পেছনে দীর্ঘ প্রস্তুতি থাকে। এই প্রস্তুতি অবচেতন মনে হয়। সে তার খবর রাখে না।

আজ থেকে কুড়ি বছর আগে আমার অর্থনৈতিক অবস্থা খুব নড়বড়ে ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার হিসাবে সব মিলিয়ে সাতশ-টাকা বেতন। বিরাট সংসার, ছজন ভাইবোন এবং মা। আমার বেতন এবং বাবার সামান্য পেনশন আমাদের সম্বল। এই দুয়ের যোগফল এক হাজার টাকার মত। এই টাকায় এত বড় সংসার টেনে নেয়া সম্ভব নয়। এই অসম্ভব কাজটি করতেন আমার মা কিভাবে করতেন তিনিই জানেন। মাসের শেষের কটি দিন খুব কষ্টে যেত। আমার পকেট শূন্য। মনের আনন্দে আমি যে এক কাপ চা খেয়ে একটা সিগারেট ধরাব সে উপায় নেই। মাঝে মাঝে এমন হয়েছে, ইউনিভার্সিটির ক্লাস শেষ করে শ্যামলীর বাসায় ফিরেছি হেঁটে হেঁটে। রিকশা নেবার সামর্থ নেই। গাদাগাদি ভিড়ে বাসে ওঠাও সম্ভব নয়।

এই অবস্থায় একটা ঘটনা ঘটল। মাসের পঁচিশ তারিখে হঠাৎ করেই সাপ্তাহিক বিচিত্রা আমাকে নগদ তিনশ টাকা দিয়ে দিল। বিচিত্রা ঈদ সংখ্যায় অচিনপুর নামে একটা উপন্যাস লিখেছিলাম। এই টাকাটা তার সম্মানী। আমার মাথা খারাপ হবার জোগাড়, কি করব এই টাকাটা দিয়ে?

ইউনিভার্সিটি তখন বন্ধ। ক্লাসে যাবার তাড়া নেই। আমি ঠিক করলাম, ঘুরে। বেড়ানো যাক। কোথায় যাব তা ঠিক করা গেল না। টিকিট কেটে চিটাগাং মেইলে উঠে বসলাম। চিটাগাং আগে পৌঁছানো যাক–তারপর দেখা যাবে। সমুদ্র, পর্বত, অরণ্য অনেক কিছুই দেখার আছে। একটা বেছে নিলেই হবে।

সমুদ্র জয়ী হল। সন্ধ্যাবেলা কক্সবাজার পৌঁছলাম। ভাল হোটেল বলতে তখন হোটেল সায়েমান। তার ভাড়া সে সময়ে কম হলেও আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে। কক্সবাজারে অনেক সরকারী রেস্ট হাউস আছে। কিন্তু সেসব রেস্ট হাউস সরকারি কর্মকর্তা এবং ভিআইপিদের জন্যে। আমি সরকারি কর্মকর্তা নই, ভিআইপিও নই। সামান্য একজন শিক্ষক।

খুঁজে পেতে সস্তার একটা হোটেল বের করলাম। যার বিছানা নোংরা, বালিশ নোংরা, মেঝে বালিতে কিচকিচ করছে। কমন বাথরুম। অনেকখানি হেঁটে বাথরুমের কাছাকাছি যাবার পর টের পাওয়া যায়–ভেতরে একজন বসে আছে। সেই বাথরুমও বিচিত্র। দরজায় হুড়কো নেই, দড়ি লাগানো আছে। ভেতরে বসে শক্ত করে দড়ি টেনে রাখতে হয়। কারও পায়ের শব্দ পেলে কেশে জানান দিতে হয়–আছি, আমি আছি। রাতে মশারি দেয়া হল না। হোটেলের মালিক বললেন, সাগরের হাওয়ায় মশা থাকে না। মশারি লাগবে না। তার কথায় বিশ্বাস করে ঘুমুতে গেলাম। দেখা গেল, মশা শুধু যে আছে তাই না, প্রবলভাবেই আছে। সমুদ্রের স্বাস্থ্যকর হওয়ার কারণে মশারা। সবাই স্বাস্থ্যবতী। স্বাস্থ্যবতীরা ঝাঁক বেঁধে এসে আমাকে কামড়াতে লাগল। স্বাস্থ্যবতী মশা বলার উদ্দেশ্য–স্ত্রী মশারই মানুষের রক্ত খায়, পুরুষরা না। তসলিমা নাসরিন আবার যেন মনে না করে বসেন যে, আমি মহিলা মশাদের ছোট করার জন্যে এই কথা লিখছি। এটা একটা বৈজ্ঞানিক সত্য।

সারারাত মশার কামড়ে ঘুম হল না। সূর্য উঠার আগেই আমি বিছানা ছেড়ে উঠলাম। গেলাম সমুদ্র দেখতে। প্রভাতের সমুদ্র আমার সব দুঃখ, সব কষ্ট ভুলিয়ে দিল। বিপুল জলরাশির উপর আকাশের ছায়া। সমুদ্রের চাপা কান্না। সমুদ্রের পানিতে হাঁটু পর্যন্ত ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। তাকিয়ে আছি দিগন্তের দিকে। সীমাবদ্ধ জগতে দাঁড়িয়ে অসীমের উপলব্ধি। আমার সমস্ত শরীর কাপতে লাগল। আমি স্পষ্ট শুনলাম, সমুদ্র ডেকে ডেকে বলছে–হে মানব সন্তান, আদি প্রাণ শুরু হয়েছিল সমুদ্রে। কাজেই তোমরা আমারই সন্তান। এসো, আমার কাছে এসো। এসো, তোমার গায়ে হাত বুলিয়ে একটু আদর করে দেই।

আমার মনে হল, ইশ, যদি এমন হত, সুন্দর একটা বাংলো বাড়ি আছে আমার, যে বাড়ির বিশাল টানা বারান্দায় চেয়ার-টেবিল পাতা। আমি ক্রমাগত লিখে যাচ্ছি। যখন ক্লান্ত বোধ করছি তখনি তাকাচ্ছি সমুদ্রের দিকে। তাহলে কী ভালই না হত! আচ্ছা, সরকার কি পারেন না, এমন একটি বাংলো লেখক, কবি-শিল্পীদের জন্যে বানিয়ে দিতে? এঁরা তো সমাজের জন্যেই কাজ করেন–সমাজ কি এঁদের জন্যে কিছু করবে না? সৃষ্টিশীল এইসব মানুষ কি সমাজের কাছে এই সামান্য দাবি করতে পারে না?

ভেবেছিলাম সাত দিন সাত রাত্রি সমুদ্রের কাছে থাকবো। টাকা-পয়সা দ্রুত ফুরিয়ে আসায় তৃতীয় দিনের মাথায় ঢাকায় ফিরে এলাম–মাথায় ঘুরতে লাগল কবিসাহিত্যিকদের জন্যে বাংলো। অনেকের সঙ্গে আলাপ করলাম। একজন আমাকে কঠিন ধমক লাগালেন–

তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। তোমার চিন্তাধারা বুর্জোয়া। লেখক বাংলোতে বসে লিখবেন মানে? তিনি ঘুরবেন পথে পথে। তিনি থাকবেন বস্তিতে, মাঠে, নৌকায়। রাত্রি যাপন করবেন বেশ্যাবাড়িতে। তিনি সংগ্রহ করবেন অভিজ্ঞতা। সমুদ্রপাড়ের বাংলোতে বসে কফি খেতে খেতে সাহিত্য হয় না। সাহিত্য কঠিন জিনিস। তোমাকে দিয়ে এই জিনিস হবে না।

আমি ক্ষীণ স্বরে বলার চেষ্টা করলাম–লেখকের একটা কাজ হচ্ছে সৌন্দর্য। অনুসন্ধান ও ব্যাখ্যা। তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, সেই সৌন্দর্য জীবনের সৌন্দর্য, সমুদ্রের নয়।

আমি বললাম, প্রকৃতি কি জীবনের অংশ নয়? লেখকরা সব সময় প্রকৃতির কাছেই প্রশ্নের উত্তরের আশায় ফিরে যান।

ওরা কোন লেখক না। ওরা ভোগবাদী মানুষ। তুমি তোমার মাথা থেকে সমুদ্র দূর কর। অরণ্য, পর্বত, আকাশ, জোছনা, বৃষ্টি দূর কর। তাহলেই মহৎ সাহিত্য তৈরি। করতে পারবে।

সমুদ্র, পাহাড়, অরণ্য মাথা থেকে দূর করতে পারলাম না। যতই দিন যাচ্ছে ততই এরা আমার উপর চেপে বসছে। এক ধরনের হাহাকার আমাকে গ্রাস করতে শুরু করেছে। ঝকমকে বর্ষার রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে যে কথাটা প্রথম মনে হয় তা হল।–বর্ষার এই সৌন্দর্য দীর্ঘ দিন থাকবে। শুধু এই সৌন্দর্য দেখার জন্যে আমি বেঁচে থাকব না। হায়, জীবন এত ছোট কেন?

প্রতি বছর সমুদ্র দেখতে যাই। বিরানব্বই সনের শেষ দিকে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে গেলাম। দ্বীপের সৌন্দর্য আবার আমার ভেতর পুরানো হাহাকার জাগিয়ে তুলল। আমি মনে মনে বললাম, এখানে যদি ছোট্ট একটা ঘর বানানো যেত!

প্রকৃতি মানুষের কোন বাসনা অপূর্ণ রাখে না। পরম করুণাময় তৎক্ষণাৎ আমার প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন। ঢাকায় বসেই আমার এই দ্বীপে জায়গা কেনা সম্ভব হল। টেকনাফ এবং সেন্টমার্টিনের লোকজন গভীর আগ্রহে সেখানে বাংলো বানিয়ে দিতে এগিয়ে এলেন। বাংলোর নাম ঠিক করলাম সমুদ্র বিলাস।

সমুদ্রের মুখোমুখি ছোট্ট একটি কাঠের বাংলো, যার ছাদ টিনের। সেই টিন নীল রঙ করা যাতে বাংলোটিকে সমুদ্রের অংশ বলে মনে হয়। পেছনে অনেকখানি খালি জায়গা। খাকি জায়গা রাখার কারণ হল–আমার ইচ্ছা এ দেশের লেখকরা এ সমুদ্র বিলাসে কিছুদিন কাটাবেন, জোছনায় সমুদ্র দেখবেন। ফিরে আসার সময় ঐ খালি জায়গায় একটা গাছ পুঁতে আসবেন। পাখি উড়ে চলে যাবে। পাখির পালক পড়ে থাকবে। একদিন আমি থাকব না। কিন্তু আমার সমুদ্র বিলাস থাকবে। আমার ছেলেমেয়েদের জন্যে থাকবে না, থাকবে সৃষ্টিশীল মানুষের জন্যে। তাদের জন্যে এই আমার উপহার।

কুড়ি বছর আগে যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, কুড়ি বছর পর তার বাস্তবায়ন হল। এই আনন্দ আমি কোথায় রাখি?

আমারে তুমি অশেষ করেছ,
এমনি লীলা তব
ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ
জীবন নব নব।।

No comments