অপেক্ষা – হুমায়ূন আহমেদ

অপেক্ষা – হুমায়ূন আহমেদ

বশির মোল্লার সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে তিনি কোন কিছুতেই রাগ করেন না।

রেগে যাবার মত কোন ঘটনা যখন ঘটে, তিনি সারা চোখে মুখে উদাস এক ধরনের ভাব ফুটিয়ে মৃদু গলায় বলেন–আচ্ছা, আচ্ছা।

না রাগার মহৎ গুনের জন্যে তিনি পরপর তিন বার ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হয়েছেন। বাড়িতে পাকা দালান তুলেছেন। দশ বছর আগে জমির পরিমান যা ছিল আজ তা বেড়ে তিন গুণ হয়েছে। সম্প্রতি একটি পাওয়ার টিলার কিনেছেন। অনেক দূর দূর থেকে মানুষজন চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ির বারান্দায় পলিথিনের কাগজে ঢেকে রাখা যন্ত্রটি দেখতে আসে। বশির মোল্লা যন্ত্রটি এখনো মাঠে নামান নি। এই সবই সম্ভব হয়েছে তাঁর ‘না রাগা’ স্বভাবের জন্যে, মোলায়েম কথাবার্তার জন্যে। অন্তত বশির মোল্লার নিজের তাই ধারণা।

আজ সকালে তার মনের অবস্থা শ্রাবণ মাসের আকাশের মতই ঘোলাটে। অবশ্যি তার মুখ দেখে কেউ তা বুঝতে পারবে না। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি বৃষ্টি ভেজা সকালের অবসর বেশ উপভোগ করছেন। ভেতরের বাড়িতে চায়ের কথা বলা হয়েছে। চা এখনো আসে নি। এই বাড়িতে শহরের বাড়ি ঘরের মত। দুবেলা চা হয়। খবরের কাগজ আসে। দুদিন দেরী হয় তবে নিয়মিত আসে।

শ্রাবণ মাসের সকাল।

দুদিন আগে প্যাঁচপ্যাঁচ বৃষ্টি শুরু হয়েছে এখনো শেষ হয়নি। আকাশ ঘোলাটে। মনে হচ্ছে দুপুরের আগে বৃষ্টি কমবে না।

বশির মোল্লা বাংলা ঘরের বারান্দায় ইজিচেয়ারে কাত হয়ে আছেন। নানান কারণে তার মন বিক্ষিপ্ত। আশে পাশে ডাকাতী হচ্ছে। তার বাড়িতেও হতে পারে। এখন পর্যন্ত কেন হয়নি সেটাই রহস্য। অবশ্যি একটি দোনলা বন্দুক তাঁর আছে। বন্দুকের অস্তিত্ব জানান দেবার জন্যে পাখি শিকারের নাম করে পরশু সকালেই তিনটা গুলি করলেন। কাজটা ঠিক হল কিনা তাও বুঝতে পারছেন না। হিতে বিপরিত হতে পারে। বন্দুকের লোভে ডাকাত আসতে পারে। ডাকাতের দুঃশ্চিন্তা ছাড়াও অন্য আরেকটি দুঃশ্চিন্তা তাঁকে কাবু করে ফেলেছে তিনি ঝোঁকের মথায় গত বৎসর আরেকটি বিয়ে করে ফেলেছেন। মেয়েটির বয়স অল্প। কিছুতেই পোষ মানছে না। তার নিজের বয়স পঁয়তাল্লিশ। এই বয়সে সতের বছরের তরুনীর মন ভুলাবার জন্যে যে সব ঢং করতে হয় তা করা বেশ কষ্ট। তবু তিনি করার চেষ্টা করছেন–লাভ হচ্ছে না। মেয়েটি পোষ মানছে না।

বশির মোল্লার কোলে খবরের কাগজ পড়ে আছে। তবে তিনি কাগজ পড়ছেন না। কাগজ পড়তে তার একেবারেই ভাল লাগে না। ছবিগুলি দেখেন। ছবির নীচের লেখাগুলিও সব সময় পড়া হয়না। পড়তে ভাল লাগে না। বশির মোল্লা অলস চোখে খবরের কাগজের একটা ছবির দিকে তাকিয়ে আছেন। ছবিতে এরশাদ সাহেবকে একজন বৃদ্ধের কাধে হাত রেখে কি যেন বলতে দেখা যাচ্ছে। গুচ্ছ গ্রাম ট্রাম হবে। একেক প্রেসিডেন্ট এসে একেকটা কায়দা করেন। জিয়া। সাহেব খাল কাটিয়ে গেছেন। ইনি বানাচ্ছেন গুচ্ছ গ্রাম। পরের জন এসে কি করবে কে জানে।

পেসিডেন সাব।

বশির মোল্লা, খবরের কাগজ থেকে চোখ তুললেন। এদিকের সবাই তাকে ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান পদের সুবাদে প্রেসিডেন্ট সাব ডাকে। তার ভালই লাগে। আজ লাগল না, কারণ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে কেরামত। কেরামত তার বাড়ির কামলা দশ বছর বয়স থেকেই আছে। এখন বয়স হয়েছে। ত্রিশ পয়ত্রিশ। বোকা ধরনের মানুষ। এরা কামলা হিসাবে অসাধারণ হয়। যা করতে বলা হয় মুখ বুজে করে। বশির মোল্লা কেরামতকে দেখে বিরক্ত হলেন। কারণ কেরামতের এখন ক্ষেতে থাকার কথা। তার সামনে ঘুর ঘুর করার কথা না।

কিছু বলবি না-কি রে কেরামত?

একটা কথা ছেল।

বলে ফেল।

কেরামত মাথা নীচু করে প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বলল, বয়সতো হইল। এখন যদি একটা বিবাহ দিয়া দেন। ঘর সংসার করি। ঘর সংসার করতে মন চায়।

বশির মোল্লা বিস্মিত স্বরে বললেন, বিয়ে করতে চাস?

কেরামত গলার স্বর আরো নীচে নামিয়ে বলল, বয়স হইতাছে। ঘর সংসার করতে ইচ্ছা হয়। নবিজীও বয়সকালে বিবাহের কথা বলেছেন, হাদিস কোরানে আছে।

পছন্দের কেউ আছে না–কি?

না। আপনে দেখাশোনা কইরা ….

আচ্ছা ঠিক আছে হবে। আমিই ব্যবস্থা করব। ঘর তুলে দিব। জমিও দিয়ে দিব। বেতনতো কিছু নেস না–সব জমা আছে। ব্যবস্থা করে দিব।

জ্বে আচ্ছা।

এখন যা কাজে যা। কাজ ফালায়া আসা ঠিক না।

জ্বে আচ্ছা।

বিয়ের কথা বারবার আমারে বলারও দরকার নাই। আমার মনে থাকব। সুবিধামত ব্যবস্থা করব। বিয়া সাদী তাড়াহুড়ার ব্যাপার না।

জে আচ্ছা। রাতে পাহরার ব্যাপারটা ঠিক আছেতো? খুব সাবধান। দল বাইন্ধা লাঠি শরকি হাতে পাহারা দিবি।

জ্বে আচ্ছা।

পরের তিন বৎসর বশির মোল্লার উপর দিয়ে নানান বিপদ আপদ গেল। জমি সংক্রান্ত এক মামলায় জড়িয়ে থানা পুলিশে অনেক টাকা গচ্চা গেল। তার দ্বিতীয় স্ত্রী এক মৃত সন্তানের জন্ম দিয়ে নিজেও মরমর হল। দীর্ঘদিন তাকে ঢাকায় রেখে চিকিৎসা করতে হল। তাঁর বাড়িতে একবার ডাকাতীও হল। তারচে বড় কথা তার অতি মোলায়েম স্বভাব সত্বেও তিনি পরপর দুটি ইলেকশনে হেরে গেলেন। স্কুলের কমিটির নির্বাচন এবং পৌরসভার নির্বাচন। এই রকম অবস্থায়। মেজাজ ঠিক থাকে না। কাজেই কেরামত আবার যখন বিয়ের প্রস্তাব তুলল তিনি রেগে গিয়ে বললেন, তুই এমন বিয়ে পাগলা হলি কেন বলতো? এই অবস্থায় বিয়ের কথা তুললি কি ভাবে?

কেরামত বলল, তিন বচ্ছর পার হইছে পেসিডেন্ট সাব।

আমার অবস্থা তুই দেখবি না? তুই কি বাইরের লোক? তুই ঘরের লোক না? একটু সামলে উঠি তারপর ব্যবস্থা করব।

জ্বে আচ্ছা।

তোর তো ঘর দোয়ারও লাগব। বউ এনে তুলবি কোথায়? একটু সামলে উঠি তারপর তোকে জমিজমা লিখে দিব। তখন বিয়ে হবে,তাড়াহুড়ার কোন ব্যাপার না।

জে আচ্ছা।

নিজের মনে কাম করে যা। তোর বিয়ের চিন্তা তোর করা লাগবে না। আমি আছি কি জন্যে? একটু সামলে উঠি।

বশির মোল্লা পাঁচ বছরের মাথাতেই সামলে উঠলেন। বেশ ভাল ভাবেই সামলে উঠলেন। স্কুল কমিটির সভাপতি হলেন। উপজেলা ইলেকশনে জিতলেন। রোয়াইল বাজারে বাড়ি বানালেন। গ্রামের বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি নিয়ে এলেন। তবে গ্রামের বাড়িতে এখন তিনি বেশী থাকেন না। রোয়াইল বাজারেই থাকেন। তার মনের শান্তি ফিরে এসেছে। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী আরো একটি মৃত সন্তানের জন্ম দিয়ে পুরোপুরি পোষ মেনে গেছে। পৌষ মাসের এক সন্ধ্যায় বশির মোল্লা গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেলেন। দিন তিনেক থাকবেন। আজকাল এক নাগারে বেশীদিন গ্রামের বাড়িতে থাকা হয়না। শহরের নানান কাজকর্ম থাকে। কাজকর্ম ফেলে গ্রামের বাড়িতে পড়ে থাকা সম্ভব না। তাছাড়া বেশ কিছু শত্রু তৈরী হয়েছে এরা কখন কি করে বসে, শহরে সেই সুযোগ কম।

বাড়িতে পা দেয়া মাত্র কেরামতের সঙ্গে দেখা হল। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, তুইতো দেখি বুড়ো হয়ে যাচ্ছিসরে কেরামত।

কেরামত মাথা নীচু করে ফেলল। যেন বুড়ো হয়ে যওয়া একটা অপরাধ। বশির মোল্লা বললেন, না এবার তোর বিয়েটা দিয়ে দিতে হয়–দেখি এই শ্রাবণেই ব্যবস্থা করব। বিয়ে শাদীর জন্যে শ্রাবণ মাস ভাল।

কেরামত ক্ষীণ স্বরে বলল, জ্বে আচ্ছা।

তুই একটা ঘর তুলে ফেল। পুনীর উত্তর পাড়ে যে জায়গাটা আছে ঐ খানে। বাশঝাড় থেকে বাঁশ যা লাগে নে। ঘরটা আগে হউক।

জ্বে আচ্ছা।

বিয়ে একটু বেশী বয়সে হওয়াই ভাল বুঝলি কেরামত এতে মিল মহব্বত ভাল হয়। তুই ঘর তুলে ফেল। উপরে ছন দিয়ে দিস। ছনের টাকা নিয়ে যাস। তোর তো টাকা পাওনাই আছে।

বশির মোল্লা তিন দিন থাকার পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিলেন থাকতে হল সাত দিন। স্কুল কমিটির কিছু সমস্যা ছিল সমস্যা মেটাতে হল। ফুড ফর ওয়ার্ক প্রগ্রামে একশ মন গম এসেছিল সেখানে থেকে সত্তুর মন গমের হিসাব পাওয়া যাচ্ছিল না। সেটাও ঠিক ঠাক করতে হল। কয়েকটা গ্রাম্য সালিশী করতে হল। দেখতে দেখতে সাতদিন কেটে গেল। শহরে ফেরার দিন তিনি অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে কেরামতের তৈরী ঘর দেখলেন। সে এই সাত দিনে সুন্দর ঘর তুলে ফেলেছে। ঘরের চারপাশে কাঠাল, আম এবং পেয়ারা গাছের চারা লাগিয়েছে।

বশির মোল্লা বললেন, গাছপালা লাগিয়ে তুইতো দেখি হুলুস্থুল করে ফেলেছিস।

কেরামত নিচু গলায় বলল, ফল-ফলান্তির গাছ, পুলাপান বড় হইয়া খাইব। ভাল করেছিস। ভাল। কয়েকটা নারকেল গাছও লাগিয়ে দে।

জে আচ্ছা।

দেখি এই শ্রাবণেই বিয়ে লাগিয়ে দিব।

জ্বে আচ্ছা।

সেই শ্রাবণে কিছু হল না। তার পরের শ্রাবণেও না। বশির মোল্লা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কিডনির অসুখ। চিকিৎসা করাতে সপরিবারে ঢাকা গেলেন।

কেরামতকে বলে গেলেন, সেরে উঠেই বিয়ের ঝামেলাটা চুকিয়ে ফেলবেন। মেয়ে কয়েকটা দেখে রেখেছেন। এদের মধ্যে স্বভাব চরিত্র ভাল দেখে, কাউকে ঠিক করা হবে।

বিয়ে শাদী হুট করে হয় না। লাখ কথার আগে বিয়ে হওয়া ঠিক না। চির জীবনের ব্যাপার।

কেরামত নিচু গলায় বলল, কন্যা স্বাস্থ্যবতী হইলে ভাল হয়। ঘরে কাজকর্ম আছে।

অবশ্যই। অবশ্যই। গ্রামের বউ রোগাপটকা হইলে চলে না। আছে, স্বাস্থ্যবতী মেয়েও সন্ধানে আছে। তুই এই বিষয়ে চিন্তা করিস না। আমি আছি কি জন্যে?

কেরামত চিন্তা করে না। নিজের হাতে লাগানো ফলের গাছগুলিকে যত্ন করে। একটা গাছও যেন না মরে। বিয়ের পর ছেলে পুলে হবে, ফল-ফলান্তির গাছ দরকার। বাজারে জিনিসপত্রের যা দাম। ছেলেপুলেকে ফল-ফলান্তি কিনে। খাওয়ানো সম্ভব না।

কেরামত বিয়ের জন্যে অপেক্ষা করে। সে জানে না তার বয়স পাঁচপঞ্চাশ পার হয়েছে। এখন তাঁর মাথায় চুল সবই সাদা। বাঁ চোখে ভাল দেখতেও পায় না। গায়ে সেই আগের জোরও নেই। কাজ কর্ম তেমন করতে পারে না। তবু পুরানো অভ্যাসে সারাদিন ক্ষেতে পড়ে থাকে। সন্ধ্যাবেলায় নিজের বাড়িতে এসে অনাগত স্ত্রী এবং পুত্র-কন্যাদের কথা ভাবতে তার বড় ভাল লাগে।

No comments