মালিকানা – লীলা মজুমদার

মালিকানা – লীলা মজুমদার

জিনিসপত্রের মালিক হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়; এর মধ্যে কতরকম সমস্যা যে ঢুকে যায় তার ঠিক নেই। আমাদের বন্ধু অশোকদা সেকালে একবার ট্রামে করে যাচ্ছেন। তখন ট্রামে মুখোমুখি দু’খানা করে বেঞ্চি আড়ভাবে পাতা থাকত। কন্ডাক্টর পাদানিতে ঝুলে ঝুলে টিকিট দিত। অশোকদার সামনে বেঞ্চিতে একজন রোগা খিটখিটে চেহারার ভদ্রলোক ব্রাউনপেপারে মোড়া একটা প্যাকেট খুব সতর্কতার সঙ্গে কোলে করে নিয়ে চলেছেন। থেকে থেকে অশোকদার দিকে সন্দেহের চোখে চাইছেন, আবার জিনিসটির কোল বদল করছেন।

অশোকদার বুঝতে বাকি রইল না যে ওটি ওঁর প্রাণের প্রাণ। সঙ্গে সঙ্গে ওতে কী আছে জানবার জন্য অদম্য কৌতুহল হল। অথচ মালিকের যা তিরিক্ষে চেহারা, কিছু করবারও সাহস হল না। এমন সময় দেরিতে টিকিট নেওয়া নিয়ে কী একটা সামান্য কারণে কন্ডাক্টরের সঙ্গে রাগমাগ করে ভদ্রলোক নেমে গেলেন। টিকিটও কিনলেন না আর বিস্ময়বিহ্বল চোখে অশোকদা দেখলেন সেই ব্রাউনপেপারে মোড়া প্যাকেটটিও ফেলে গেলেন।

বারে বারে অশোকদার চোখ সেদিকে যেতে লাগল। কন্ডাক্টরও ছাই এদিকে আসে না। প্যাকেটটা কাছে টেনে নিয়ে, কন্ডাক্টরকে ডেকে অশোকদা—না প্যাকেটটা জমা দিলেন না, ওই বা কত সৎ লোক তাই বা কে জানে,—টিকিট কিনলেন। এই সব করতে করতে তাঁর বাড়ির স্টপ এসে গেল। উনিও ঘষটাতে ঘষটাতে দরজার কাছে গিয়ে, এক সময় টুপ করে নেমে পড়লেন। নামবার সময় ব্রাউনপেপার প্যাকেটটি নিতে ভুললেন না। কেন নেবেন না? উনি না নিলে তো আর কেউ নিত। তারই বা কী বিশেষ অধিকার? আদি মালিককে সে চোখে দেখেনি পর্যন্ত।

প্যাকেটটা বুকে চেপে অশোকদা এক সময় দৌড়তে দৌড়তে বাড়ি পৌঁছে নিজের পড়ার ঘরে ঢুকে, গিন্নির দৃষ্টি বাঁচিয়ে প্যাকেটটা খুলে দেখলেন তার মধ্যে এক পাউন্ড বড় পাতার সস্তার চা ছাড়া কিছু নেই। তখনকার দাম ছিল বড় জোর আট আনা, অর্থাৎ পঞ্চাশ পয়সা। হ্যাঁ, ভুল শুনছেন না, পঞ্চাশ পয়সাই।

কপালে ঘাম ছুটে গেছিল, হাত থরথর করে কাঁপছিল। ঘাম মোছার জন্যে রুমালটা বের করতে পকেটে হাত দিয়েই আঁতকে উঠলেন। মনিব্যাগটি নেই! নিজের টিকিট কাটার সময় উত্তেজনার চোটে মনিব্যাগ পকেটে না রেখে নিশ্চয় পাশে ফেলে রেখে চলে এসেছেন! এটা হল গিয়ে না-পাওয়ার দুঃখের গল্প।

এর উলটো গল্পও শুনেছি। তার নায়ক সুধীন্দ্রলাল হলেন খেরোর খাতার খ্যাতনামা হেমেন্দ্রলাল রায়ের জ্যাঠতুতো দাদা। কী করব বলুন? ওঁদের পরিবারের লোকদের যদি নানারকম রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়, সে তো আর আমার দোষ নয়। সে যাই হোক, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ওঁরা তথাকথিত অভিশপ্ত কলকাতা ছেড়ে পশ্চিমগামী এক ট্রেনের থার্ড ক্লাস কামরায় উঠে, লখনউ কি আগ্রা কি মথুরা কি বৃন্দাবন যাচ্ছিলেন।

হাওড়ায় তিল ধারণের জায়গা ছিল না। কিন্তু শেষরাতে ঘুম ভেঙে দেখেন সবাই কখন নেমে গেছে, খালি ওঁদের বাড়ির লোকেরা বেহুঁশের মতো ঘুমোচ্ছে আর তাঁর গিন্নির পায়ের কাছে কার একটা আধ হাত লম্বা, পেতল দিয়ে বাঁধানো, সুন্দর হাতবাক্স পড়ে আছে। সুধীন্দ্রলাল হাঁ!

গিন্নির ঘুম ভাঙলে বাড়িসুদ্ধু সবাই বাক্সটা নেড়েচেড়ে দেখলেন যে বেশ ভারী আর ভেতরে কেমন চুনচুন শব্দ হয়। ঢাকনি ধরে একটু টানাটানি করতেই কট্‌ করে সেটা খুলে গেল। বাক্স বোঝাই সোনার আর জড়োয়া গয়না! তাই দেখে শিউরে উঠে, সুধীন্দ্রলালের গিন্নি দুম করে বাক্সটি বন্ধ করে, পরের বড় স্টেশনে স্টেশনমাস্টারের ঘরে গিয়ে ওটি জমা দিয়ে আসতে সুধীন্দ্রলালকে বাধ্য করলেন। সে লোকটা একটা চিরকুটে রসিদ লিখে দিল বটে, কিন্তু দস্তখতটা ইংরেজিতে না হিন্দিতে তা পর্যন্ত বোঝা গেল না। ওইখানেই এ গল্পের শেষ। উত্তেজনায় আর নিজেদের মধ্যে খ্যাঁচাখেঁচির কারণে স্টেশনের নামটা পর্যন্ত কেউ দেখল না। আক্ষেপ করে সুধীন্দ্রলাল বলেছিলেন, যে বেচারাদের গয়না, তারা কি আর কখনও ওই দুষ্পাঠ্য-হস্তাক্ষরওয়ালার কাছ থেকে তাদের জিনিস উদ্ধার করতে পেরেছে? এখন গিন্নি যদি বাক্সটা রাখতে দিতেন, মালিক এসে প্রমাণ দিয়ে চাইলেই সুধীন্দ্রলাল ফেরত দিতেন। পাছে কোনও মামলায় জড়িয়ে পড়তে হয়, তাই গিন্নি পরে এ নিয়ে কোনও তদন্ত করতেও দেননি।

তবে সব গল্প এরকম হতাশাজনক নয়। মালিকানার অবিশ্যি অনেক জ্বালা তাতে সন্দেহ নেই। একদিন আমার ছোট মাসতুতো ভাই বলেছিল, ‘দাদার কাছে কিছু চেয়ে সুখ নেই।’ আমরা বললাম, ‘দেয় না বুঝি?’ বিমল বলল, ‘না, ঠিক তার উলটো। চাইলেই দিয়ে দেয়। ও রকম ভাল লাগে না। বেশ আমি চাইলে দাদা বলবে, “যা দেখবি অমনি নেওয়া চাই? না, পাবি না। যা, ভাগ!” আমি বলব, “না দাদা, দাও। দাও বলছি!” শেষটা তিতিবিরক্ত হয়ে আমার সামনে জিনিসটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলবে, “নে গে যা! হাড় জ্বালালি রে বাপু!” তবে সে না জিনিস নিয়ে সুখ।’

আমার মাসতুতো বোন উমা ছিল যেমনি রূপসি, তেমনি শৌখিন, আবার তার চেয়েও বেশি কিপটে! নিজে তো পয়সা খরচ করবেই না নিজের মা-কে পর্যন্ত খরচ করতে দেবে না! আত্মীয়স্বজনরা কোনও ভাল জিনিস দিল তো দিল, নইলে নিজে যত রাজ্যের গিল্টি করা আর নকল পাথরের গয়না দিয়ে গা ভরাত। সবগুলো যে দেখতে খারাপ তা বলছি না। কিছুদিন বাদে ওগুলো কালো হয়ে যেত, তখন অনিচ্ছুক কাউকে উপহার দিয়ে, নিজে আবার চকচকে নতুন গিল্টি গয়না কিনত। ওর আলমারি, দেরাজ সর্বদা গয়না দিয়ে ঠাসা থাকত।

এক দিন রাতে ওর ঘরে চোর ঢুকেছিল। চোরের ভয়েই উমা রাতে বুড়ি মায়ের ঘরে দরজা-জানলা এঁটে শুত। চোর যে এসেছিল সেকথা কেউ টেরও পায়নি।

পরদিন সকালে উমা নিজের ঘরে গিয়ে দেখে অ্যাসবেস্টসের ছাদের এক অংশ তুলে ফেলা হয়েছে, আলমারির দরজা চাড় দিয়ে ভাঙা, ঘরময় গয়নাগাঁটি রংচঙে কাপড় চোপড় ছড়ানো। সুখের বিষয় একটি জিনিসও হারায়নি।

তাই দেখে উমার সে কী রাগ! কী! আমার গায়ের গয়না কি এতই খেলো, এতই খারাপ যে চোরেও নেবে না! কেন? কী এমন মন্দ এগুলো? দেখে তো বোঝাও যায় না যে নকল। দিনে দিনে চোরগুলোর এমন বাড় বেড়েছে দেখে অবাক হই!

No comments