চোর – লীলা মজুমদার

চোর – লীলা মজুমদার

ত্রিশ বছর আগে সম্পাদকমশাইরা গল্প চাইলেই আমি জিজ্ঞাসা করতাম, ‘কীসের গল্প লিখব?’ তাঁরা বলতেন, ‘হয় প্রেমের, নয় ভূতের, নয় চোরের।’ কাজেই আমিও বুঝে নিলাম ওই তিনটিই হল ছোট গল্পের প্রধান উপজীব্য। তারপর অনেক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি ওই তিনটির মধ্যে আবার শেষেরটিই হল প্রধান, প্রথমটি নয়। এখন দেখছি চারদিকে ছড়িয়ে আছে চোরের গল্পের সামগ্রী। জ্যান্ত জ্যান্ত চোরের গল্প, বানাতেও হয় না।

কয়েক বছর আগে শান্তিনিকেতনেই বেজায় চোরের উপদ্রব শুরু হয়েছিল। কেউ তার কোনও কিনারা করতে পারে না; একটা দুষ্কৃতকারীও ধরা পড়ে না। মাঝে মাঝে রাতে দলবল নিয়ে এসে জানলাটানলার শিক ভেঙে ঢুকে, বেবাক সামগ্রী পাচার করে দেয়। বাড়ির লোকে এমনি ঘুমোয় যে কিচ্ছু টের পায় না। কখনও কখনও গানের আসর, যাত্রা কিংবা নাটক-টাটক হলে, অনেকে বাড়ি বন্ধ করে, সদর দরজায় তালা দিয়ে, নিশ্চিন্ত মনে নাটক দেখে, বাড়ি ফিরে দেখে সব চাঁচাপোঁছা! কেউ ধরা পড়ে না।

এই সময় এক ছোকরা অধ্যাপক বিলেত থেকে সদ্য এসে কাজে যোগ দিলেন। সঙ্গে আনলেন খাসা ট্রানজিস্টর, রেকর্ড প্লেয়ার ইত্যাদির সঙ্গে চমৎকার এক হাত-ঘড়ি। ব্যাচেলর মানুষ, সংসারের ঝামেলা নেই। খালি বাড়ি ফেলে নাটক দেখে ফিরে এসে দেখে তালা যেমনকে তেমন ঝুলছে। কিন্তু ট্রানজিস্টর নেই, রেকর্ডপ্লেয়ার নেই আর সব চাইতে খারাপ হল যে হাতঘড়িটাও সেদিন ভদ্রলোক হাতে পরেননি, পাছে ভিড়ের মধ্যে হারায়। সেটিও নেই।

ছোকরা অধ্যাপক সহজে ছাড়বার পাত্র ছিলেন না। সে থানায়-টানায় গিয়ে মহা শোরগোল তুলল। ফলে চোরাই মালের একটা তালিকা তৈরি করে, থানায় থানায় দেওয়া হল। সবাই তাই নিয়ে হাসাহাসি করতে লাগল। কিছুদিন কেটে গেল। সবাই। বলল, হ্যাঁ, ওই করে চোর ধরা পড়লেই হয়েছে!

এমন সময় ইলেমবাজারের কাছাকাছি একটা পানের দোকানে থানার একজন ছোকরা সাব-ইন্সপেক্টর পান কিনতে গেছে। হঠাৎ মনে হল পানওয়ালার হাতে বাঁধা হাতঘড়িটাকে যেন চেনা-চেনা লাগছে! পান কেনা হলে, উঠিপড়ি করে ছোকরা থানায় ফিরে গিয়ে, তালিকাটা আরেকবার পড়ে দেখল। হ্যাঁ, এই তো সে-ই!

তখন পুলিশ-পেয়াদা নিয়ে পানওয়ালাকে ধরে জেরা করে জানা গেল যে ওদিককার কোনও গ্রামের একজন চেনা লোক ওই ঘড়িটি বন্ধক দিয়ে একশো টাকা ধার নিয়েছে। সেই চেনা লোকটির ঠিকানা জোগাড় করা হল। সেখানে পৌঁছে দেখা গেল মস্ত এক চালাঘর। চালাঘরের চার্জে একজন আধাবয়সি মহিলা।

তখন বেশ রাত। মহিলা বললেন, ‘আমার ছয় ভাই এবাড়ির মালিক। তারা নাইট্‌ ডিউটি করে, বোলপুরের ওদিকে। এখন আমি ঘরটর খুলতে পারব না।’

পেয়াদারা তখুনি বিদায় নিয়ে একটা আমবাগানে গাঢাকা দিয়ে রইল। ভোরে নাইট ডিউটি সেরে, দ্রব্যাদি নিয়ে ছয় ভাই ফিরলেই তাদের গ্রেপ্তার করা হল। সমস্ত চোরাই মালও উদ্ধার হল। শোনা গেল এটা ব্রাঞ্চ আপিস, হেড কোয়ার্টার কলকাতায়।

আরেকবার বিকেলের গাড়িতে আমাদের প্রতিবেশী অমরবাবু তাঁর স্ত্রী আর শ্যালীকে নিয়ে কলকাতা যাচ্ছে। ট্রেন দু’ঘণ্টা লেট। পথেই রাত হবে। শীতের বেলা, এখনি অন্ধকার হয়ে আসছে, ওঁরা গাড়ির দরজা-জানলায় ছিটকিনি এঁটে নিশ্চিন্ত হয়ে বসলেন।

সেকালের সেকেন্ড ক্লাস গাড়ি। ওঁরা ছাড়া তিনজন যাত্রী। তাদের মধ্যে এক বেচারা বউ ঘোমটা টেনে একধারে জড়সড় হয়ে বসে ছিল। আর দু’জনের মধ্যে একজনকে বেশ পয়সাওয়ালা ভারীক্কে ধরনের মনে হল। সঙ্গে লটবহর, নতুন সুটকেস, বাজারের থলি তাতে তাজা পালং, মুলো। তৃতীয় ব্যক্তি বোধ হল ওঁরই মোসায়েব। সারাক্ষণ হ্যাঁ কর্তা, যা বলেছেন কর্তা, করছিল।

ওঁদের কথায় মনে হল কর্তার মেয়ের বিয়ের জন্য কলকাতা যাওয়া হচ্ছে। পরিবারবর্গ আগেই চলে গেছে।

কৰ্ড লাইন দিয়ে ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে গাড়ি চলেছে। আলো নিবু-নিবু। হঠাৎ অন্ধকারে থেমে গেল। সময়কাল খারাপ৷ সবাই তটস্থ। বউটি একেবারে সিঁটিয়ে গেছে। চারদিক থমথম করছে। তারি মধ্যে হঠাৎ বউটি উঠে দরজার ছিট্‌কিনি খুলে অন্ধকারে নেমে গেল!

সবাই ব্যস্ত হয়ে ‘হাঁ-হাঁ-হাঁ— ও কী করছেন— ও কী করছেন?’ বলতে না বলতে অন্ধকারে সে মিলিয়ে গেল! আর চারজন সশস্ত্র যুবক কামরায় ঢুকে বলল, ‘যার যা আছে ভালয় ভালয় দিয়ে দিন। গোলমাল না করলে আমরাও কিছু বলব না।’

বলাবাহুল্য, যার যা ছিল, চুড়ি, হার, আংটি, বোতাম, হাতঘড়ি, মনিব্যাগ— সব পাচার হয়ে গেল। তারপর ওপর দিকে তাকিয়ে ভারীক্কে ভদ্রলোকের নতুন সুটকেসটিও তুলে নিয়ে তারাও অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

আরও কিছুক্ষণ পরে হট্টগোল শোনা গেল। ড্রাইভার, গার্ড, অন্যান্য যাত্রীরা নেমে জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগল। আরও পরে গাড়ি আবার ছাড়ল। বড় স্টেশনে নাকি রেলের পুলিশের কাছে ডায়রি হবে। হারানো সম্পত্তির ফর্দ দিতে হবে।

গাড়ি চলতে শুরু করতেই মোসায়েব বললেন, ‘আমাদের তো অল্পের ওপর দিয়ে গেল। বড় ক্ষতি হল আপনার।’ সবাই বলল, ‘কেন? কেন? কীসের বড় ক্ষতি?’ মোসায়েব বললেন, ‘ওই যে সুটকেসটি নিল, ওতে কর্তার মেয়ের বিয়ের দশ হাজার টাকার গয়না ছিল।— ও কী স্যার, মাথা নাড়ছেন কেন?’

কর্তা বললেন, ‘ছিল না!’

‘ছিল না? তবে গয়নাগুলো গেল কোথায়?’

বুড়ো আঙুল দিয়ে বাজার থলি দেখিয়ে কর্তা বললেন, ‘মূলোর মূলে?’ তাঁর বুদ্ধি দেখে সবাই হাঁ!

সুখের বিষয়, তিনদিন বাদে দলটি ধরা পড়ল, জিনিসপত্রও উদ্ধার হল। বউটি— যাকগে, এইসব কাঁচা মাল দিয়েই চোরের গল্প তৈরি হয়। বানাতে হয় না।

No comments