আতংক যখন হিলিতে – মানবেন্দ্র পাল

আতংক যখন হিলিতে – মানবেন্দ্র পাল

পাহাড়ি রাস্তায় হাজার ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চালাতে হয়। খুব অভিজ্ঞ ড্রাইভার না নিলে বিপদের সম্ভাবনা। তা আমাদের ড্রাইভার বিক্রম থাপা ভালোই গাড়ি চালাচ্ছে। ‘শার্প কার্ড’ এর মতো বিপদসংকুল জায়গাগুলোও গোঁয়ার ড্রাইভারের মতো ফুল স্পিডে না চালিয়ে স্পিড কমিয়ে খুব সাবধানে চালায়। এতে আমরা খুশি। শিলিগুড়ি থেকে ওঠার সময় থেকেই আমরা ওকে বলেছি–তাড়াহুড়োর কিছু নেই। আমরা স্রেফ বেড়াতে বেরিয়েছি। এই সময়ে পাহাড়ে ফুলের শোভা বিশেষ করে রডোড্রেনড্রনের সমারোহ দেখবার মতো।

বিক্রমের অবশ্য এসব কথায় কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই, নিজের ইচ্ছেমতো যেমন স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছিল তেমনি চালিয়ে যেতে লাগল।

গাড়িটা আমরা ভাড়া করেছিলাম শিলিগুড়ি থেকে। আমরা বার্সে যাব শুনে গ্যারেজের মালিক একটু চুপ করে ছিলেন। শান্তনু জিগ্যেস করেছিল–কী ভাবছেন? কোনো অসুবিধে আছে?

গ্যারেজের মালিক বলেছিলেন–আর কিছু নয়, অত উঁচুতে—

উঁচু আর এমন কী? ৯০০০ ফুট।

মালিক হেসে বলেছিলেন–হিলেই তো ৯০০০ ফুট। তারপর চার কিলোমিটার ঢাল। গাড়ি যাবে না। হাঁটতে পারবেন তো?

শান্তনু মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব পারব।

ওখানে ভালো হোটেল-টোটেল আছে তো? মানে বেশ আরামদায়ক। মাংকিক্যাপ থেকে শুধু ঠোঁট দুটি বার করে প্রশ্ন করেছিলেন বিরূপাক্ষদা।

হোটেল? পাশের দুজন ড্রাইভার শ্রেণির লোকের দিকে তাকিয়ে হাসলেন গ্যারেজের মালিক।

হোটেলের আশা করে যাবেন না, স্যার। পথে সরাইখানা যদি দু-একটা পান তাহলে ভাগ্য বলতে হবে।

তা হলে শান্তনুভায়া, আমি ফিরে চললাম।

সে আবার কী? আপনারই উৎসাহে–

হ্যাঁ, পাহাড়ে সমতলে বেড়াতে ভালোবাসি বলে এই দুর্ধর্ষ শীতে হোটেল পাব না! নিউমোনিয়ায় পৈত্রিক প্রাণটা এই পাহাড়ের রাজ্যে হারাব নাকি?

অবস্থা বুঝে গ্যারেজের মালিক ভরসা দিয়ে বললেন-হোটেল নিশ্চয় পাবেন তবে বার্সেতে নয়। বার্সেতে পৌঁছাবার আগেই। সেখানেই রাতটা আরাম করে কাটিয়ে পরের দিন সকালে ফের রওনা দিয়ে বার্সেতে পৌঁছে যাবেন।

এ কথায় বিরপাক্ষদা তখনকার মতো শান্ত হলেও ড্রাইভারকে নিয়ে ঘটল বিপত্তি।

ভালো ড্রাইভারের কথা বলতে গ্যারেজের মালিক বিক্রমকে দেখিয়ে দিলেন। কিন্তু বিক্রম গোড়া থেকে সেই যে মুখ ফিরিয়ে বসেছিল তখনও তেমনি রইল।

কি রে যাবি? জিগ্যেস করলেন মালিক।

বিক্রম মাথা নাড়ল। যাবে না।

কেন?

তার উত্তরে ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেক কথা বলল যা থেকে বোঝা গেল ও যেতে চায় না এটাই আসল কথা।

তারপর আমরা বেশি টাকার লোভ দেখালেও ও যখন যেতে রাজি হল না তখন আমরা মুশকিলে পড়লাম। কেন যাবে না তার কারণ কিছুই বোঝা গেল না। শুধু বিক্রমই নয়, সংক্রামক ব্যাধির মতো ‘না’ কথাটা ছড়িয়ে গেল সব ড্রাইভারের মুখে।

অনেক অনুরোধে গ্যারাজের মালিক আমাদের আড়ালে বিক্রমকে বোঝাতে লাগলেন। একটু পরে ফিরে এসে বললেন, এক কাজ করুন। আপনাদের তো উদ্দেশ্য এই সময়ে পাহাড়ের ফুলের শোভা দেখা। তাহলে ‘সোমবারিয়া’, ‘হিলে’ হয়ে ‘বার্সে’ না গিয়ে জোংরি হয়ে ইয়ম পর্যন্ত গাড়িতে যান। তারপর কিছুটা হাঁটা পথ। এই পথ দিয়ে যেতে সব ড্রাইভার রাজি। এখানেও প্রকৃতির অফুরন্ত শোভা। যে দিকেই তাকাবেন দেখবেন সবুজের সমারোহ। এত সবুজ সমতল কোথাও নেই।

শান্তনু ঠোঁটের ফাঁকে হেসে ববল, সবই তো ঠিক। কিন্তু আসল কথাটাই চেপে গেলেন। ঐ যে বললেন ‘কিছুটা পথ’–সেটা কি সঠিক জানেন কতটা?

মালিক মুখ কাচুমাচু করে বললেন, না, ঠিক জানি না, তবে–

তবে-টবে নয়, আমি জানি পাক্কা ছাব্বিশ কিলোমিটার পথ হাঁটতে হবে। আর সে পথ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। রীতিমত নির্জন।

মালিক লজ্জিত হয়ে বললেন–তা হবে।

শান্তনু বলল, শুনুন, আমরা বুঝতে পারছি না কোনো ড্রাইভার ঐ পথ দিয়ে যেতে চাইছে না কেন। তবে ঐ পথ দিয়েই আমরা ‘বার্সে’ যাব। আমাদের যেমন প্রোগ্রাম করা আছে তেমনিই থাকবে। দেখি তাহলে অন্য কোনো গাড়ি পাওয়া যায় কিনা।

আমরা ফিরে যাবার জন্যে উঠতেই মালিক বললেন, দাঁড়ান, আর একবার কথা বলে দেখি। আবার কথা বলতে উঠলেন। এরপর কাজ হল।

বিক্রম থাপা রাজি। তবে সন্ধের আগেই বার্সের অনেক আগে ‘হিলে’ পৌঁছাতে চায়। তার বেশি যাবে না।

শান্তনু বলল, পাহাড়ে রাস্তায় এমনিতেই তো সন্ধের সময় গাড়ি চালানো নিষেধ।

বিক্রম বলল, তা তো সকলেরই জানা, আমি বলছি পথে কোথাও হল্ট করা চলবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ‘হিলে পৌঁছতে হবে।

বেশ, তাই হবে।

আর একটা কথা, স্যার। পথে যদি কেউ এমনকি পুলিশও গাড়ি দাঁড় করিয়ে ন্যাকামি করে জিগ্যেস করে আজ কী বার? বলবেন, সরি, খেয়াল নেই। কিছুতেই যেন বলে ফেলবেন না–আজ শনিবার! প্লিজ স্যার, একথাটা মনে রাখবেন।

জিগ্যেস করলাম, কেন?

আমাকে থামিয়ে দিয়ে শান্তনু বিক্রমকে বলল, ঠিক আছে। রাজি।

থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার! বলে বিক্রম এবার চটপট গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিল।

নিচু গলায় বললাম, হঠাৎ বার নিয়ে লুকোচুরি?

ফিসফিস করে শান্তনু বলল, এসব অঞ্চলে কত রকমের কুসংস্কার।

এই সময়ে বিরূপাক্ষদা বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেন, সবই কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিলে হবে না, ভায়া। আমাদের যাত্রাটাই অপয়া। আমি তো গোড়া থেকেই বলছি, ফুল দেখতে হিমালয়ে! এমন কথা কে কবে কস্মিনকালে শুনেছে! তাও গরমকালে নয়, মার্চ মাসের গোড়ায়! মার্চ মাস তো ওখানে ভরা শীতের সময়। জানলার কাচটা ভালো করে ফেলে দাও না। শীতে মলাম যে!

বললাম, কাচ তো ফেলাই আছে।

তা হলে ঠান্ডা ঢুকছে কোথা দিয়ে?

কাচের শার্সিটা ঠিকমতো লাগেনি বলে শান্তনু খানিকটা কাগজ গুঁজে দিয়ে বাতাস আটকে দিল।

কী ঝকমারি রে বাবা! ফুল দেখতে পাহাড়ে! কেন আমাদের দেশে কি ফুল নেই? গোলাপ, বেল, জুই, গাঁদা, রজনীগন্ধা, টগর, ডালিয়া–

শান্তনু রাগাবার জন্য বলল, কিন্তু ম্যাগনোলিয়া, ম্যাপল, পাইন, ওক, ফার, আরও কত কী!

বললাম, আসল নামটাই তো বললে না—’রডোড্রেনড্রন’?

ওটা না দেখলে বোঝানো যাবে না।

বিরূপাক্ষদা এসব কথা বুঝতে চান না। তিনি যেন কোনো ভালো প্রস্তাবেও প্রথম থেকে বিরূপ। উৎসাহ করে কোনো প্রস্তাব দিলে উনি প্রথমেই বলে উঠবেন, ‘পাগলের প্রলাপ। তাই আমরা ওঁকে ‘বিরূপাক্ষ’র বদলে ‘বিরূপ’দা বলে ডাকি। ভালো কথাতেও উনি বিরূপ। অন্তত প্রথমটা। তবু কোনো দূরপথে যেতে গেলে ওঁকে না পেলে যেন মন ভরে না। ঐ যে ওঁর মাংকিক্যাপ, ঐ যে মাংকিক্যাপের উপর দিয়ে মাফলারটা ভালো করে জড়ানো, ঐ যে গলার সবচেয়ে ওপরের বোতামটাও আটকানো, ঐ যে হাঁটুর নীচ পর্যন্ত ঝুল সেকেলে অলেস্টার–এমন অদ্ভুত পোশাকে মোড়া মানুষের যেন তুলনা নেই। তিনি সাধারণত ধুতি পরেন। প্যান্ট পরার অভ্যাস নেই, কিন্তু যেহেতু পর্বত আরোহণ করতে চলেছেন, অতএব তাকে ফুল প্যান্ট পরতেই হয়েছে। কথায় বলে, ‘অনভ্যাসের ফোঁটা কপাল চচ্চড়’–তারও সেই দশা। প্যান্ট তার পেট থেকে নেমে নেমে যাচ্ছে–ঢলঢল করছে। আর উনি প্রতিনিয়তই থাক সে কথা।

এঁকে না হলে যেমন আমাদের চলে না তেমনি আমাদের না হলে ওঁরও চলে না। আসলে তিনি নিজেও ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন। তা বলে তার সমবয়সীদের সঙ্গে নয়, আমাদের মতো ছোকরাদের সঙ্গে।

শিলিগুড়ি ছাড়িয়ে গাড়ি ক্রমশই ওপরে উঠছে। আবার তিস্তা। টানা দেখা দেয় না। মাঝে মাঝে অন্তর্ধান করে। আবার ক্ষণেকের জন্যে দেখা মেলে। এ যেন লুকোচুরি খেলা। একটু পরে পাওয়া গেল রংগীতকে। যেন তিস্তার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। দূরে ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সারি। উইন্ডস্ক্রিনের মধ্যে দিয়ে দেখছি। প্রকৃতির এই রূপ তো শস্যশ্যামল সমতলদেশে মেলে না।

ও বিরূপদা, আপনি ঢুলছেন!

বিরূপাক্ষদা অর্ধনিমীলিত চোখে একবার তাকালেন–ঢুলব না তো কী করব? তোমাদের মতো শুধু পাহাড় আর খাদ দেখব? কী দেখবার আছে? বলেই মাংকিক্যাপটা ঠিক করে আবার চোখ বুজলেন। চোখ বুজিয়েই বললেন, ও ড্রাইভার-ভায়া, চায়ের দোকান দেখলে একটু থামিও। তুমি যে পক্ষীরাজ ঘোড়া ছোটাচ্ছ!

বিক্রম থাপা উত্তর দিল না।

বললাম, এখানে চায়ের দোকান নেই, বিরূপদা। আপনি ঘুমোন।

কিন্তু–

সত্যিই তো! বড়ো জোরে চালাচ্ছে গাড়ি। আমরা তো বারণ করেছিলাম। তবু–কিসের এত তাড়া?

ভেবেছিলাম বিরূপাক্ষদা বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিন্তু না, হঠাৎ তিনি চোখ বুজিয়েই সেই একই কথা নিয়ে বকবক করে চললেন।–পাগল! পাগল না হলে কেউ এই প্রচণ্ড ঠান্ডায় ফুলের বাহার দেখার জন্যে পাহাড়ে পাহাড়ে ছোটে!

বিরূপদা, কিছু বলছেন?

বলব আর কী! তোমাদের পাল্লায় পড়ে এই বয়েসে আমার লাইফ খতম হতে চলেছে।

কিন্তু আপনি তো পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরতে ভালোবাসেন।

হ্যাঁ, এক্সকারশান, অ্যাডভেঞ্চার আমি ছোটবেলা থেকেই ভালোবাসি। তবে তা ফুলের শোভা কিংবা নদীর কুলুকুলু গান শোনার জন্যে নয়। হ্যাঁ, বুঝতাম যদি বৃহৎ শিকারের জন্য কোথাও গেলাম–

‘বৃহৎ শিকার’ জিনিসটা কী, দাদা?

যা নিছক পাখি, খরগোশ মারা নয়। যা লেপার্ড, হিমালিয়ান ব্ল্যাক বিয়ারের পিছু পিছু চেজ করতে করতে গুলি করে মারা।

অবাক হলে গেলাম। চোখের সামনে ভেসে উঠল বহুদিনের পরিচিত তার সেই গোল মুখ, ভারী গাল, মোেটা বেঁটেখাটো, থপথপে চেহারা যা কোনোরকমেই শিকারীর উপযুক্ত নয়।

শান্তনু বলল, কিন্তু আপনি কি জীবনে কোনোদিন বন্দুক ধরেছেন? গুলি ছোঁড়া তো পরের কথা।

এইবার বিরগদা চোখ মেলে তাকালেন, বললেন, আমি বন্দুক ধরতে যাব কেন? হান্টার’দের সঙ্গে থাকব। বাহবা দেব। সেটাও একটা কাজ। ফুটবল খেলায় দেখ না প্লেয়ারদের চেয়ে চেঁচাবার লোক অনেকগুণ বেশি। এও তেমনি।

হান্টার!–হাসলাম আমরা। কথায় জোর দেবার জন্যে বিরূপদা মাঝে মাঝেই প্রচলিত সহজ বাংলার বদলে ইংরিজি বলেন। যেমন একদিন বললেন, ‘নো নো, আমি ওর মধ্যে নেই।’ আর একদিন বললেন, আমার ‘ফাদার’ ছিলেন অহিংস প্রকৃতির মানুষ। ইত্যাদি।

হান্টারদের সঙ্গে থাকলে তো শুধু থাকাই হবে। শিকার করা হবে না।

তা না হোক এনজয় তো করা হবে।

এ যাত্রায় শিকারে যাওয়া হল না। তাহলে?

পারের বার অন্য কিছু ভাবব। তবে কিছুতেই ফুল দেখতে কিংবা পাহাড়ে সূর্য ডোবা দেখতে যাব না। এই দুটো ছাড়া যে কোনো অ্যাডভেঞ্চার করতে–

মানে–যেখানে ভয়-ভয়, গা-ছমছমে কিছু—

বুঝেছি, যেখানে ভয় থাকবে কিন্তু বিপদ থাকবে না। তাই তো?

বিরূপদা যেন ধরা পড়ে গেলেন। দাঁতের ফাঁকে একটু হাসলেন।

হঠাৎ বিক্রম গাড়ির স্পিড কমিয়ে হাত পিছনে ফিরিয়ে সবাইকে কম কথা বলতে ইঙ্গিত করল।

আমরা তো অবাক। এতখানি পথ। রহস্য-রসিকতাও করা চলবে না? কিন্তু কারণ জিগ্যেস করতে ভরসা পেলাম না। গাড়িতে উঠে পর্যন্ত যা গম্ভীর হয়ে আছে! গম্ভীর হয়ে থাকাই কি বিক্রম থাপার স্বভাব, না কোনো বিপদের আশঙ্কা করছে ও! ঈশ্বর জানেন!

আমরা এখন আরও ওপরে উঠে এসেছি। রংগীত নদীর তীরে জায়গাটার নাম জোরথাং। দক্ষিণ সিকিমের একটি বড়ো ব্যবসাকেন্দ্র।

জায়গাটা ভালোই মনে হল। ঠিক করলাম এখানে নেমে কিছু খেয়ে নেওয়া যাক। কারণ পথে কোথাও এরকম জায়গা পাওয়া যাবে কি না কে জানে! গাড়ি থেকে নেমে একটা মোটামুটি রেস্টুরেন্ট গোছের চায়ের দোকান পাওয়া গেল। আমরা চারটে চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম।

বিক্রম থাপা কিন্তু এখনও কোনো কথা বলছে না। একপাশে বসে খেতে খেতে কেবলই আকাশের দিকে তাকাচ্ছে।

আশ্চর্য! কী আছে আকাশে? এমন রৌদ্রোজ্জ্বল বেলা এগারোটায়?

হঠাৎ এই সময়ে বিক্রম এক কাণ্ড ঘটিয়ে বসল।

ও যেখানে বসেছিল তার সামনেই হাত দু-একের ব্যবধানে হোটেলের ম্যানেজারের টেবিল। টেবিলে একটা প্লেটে কিছু মশলা, ক্লিপ করা কতকগুলো ফর্দ আর সরু একটা খাতা। আর একটা ডেস্ক-ক্যালেন্ডার! ড্রয়ারটা খোলা। এইমাত্র একজন খদ্দের পয়সা দিয়ে গেল। ড্রয়ারটা খুলে রেখেই ম্যানেজার কিচেনে ঢুকলেন বোধহয় তদারকি করতে। বিক্রম তার চেয়ার থেকে বডিটা তুলে এক মুহূর্তের জন্যে হাত বাড়াল। তার পরেই হাত গুটিয়ে চুপচাপ নিজের চেয়ারে বসে কফির পেয়ালায় চুমুক দিল।

কিছু বোঝবার আগেই বিরূপদা নিঃশব্দে আমার গায়ে আঙুলের খোঁচা দিলেন। চাপা গলায় বললেন, দেখলে আমাদের গুণধর মৌনীবাবা বিক্রমের খেলা? কিছু একটা হাতসাফাই করল।

শান্তনু সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, কিছুই হাতসাফাই করেনি। ডেস্ক-ক্যালেন্ডারের বড়ো বড়ো অক্ষরে ছাপা SATURDAY কথাটা উল্টে দিয়ে চোখের আড়াল করে দিল।

কেন?

শান্তনু যথাসম্ভব নিচু গলায় বলল, তা বলতে পারব না। হয়তো ঐ কথাটায় ওর এলার্জি হয়। বলে হাসল।

এ আবার কী রহস্য রে বাবা! গজগজ করে উঠলেন বিরূপাক্ষদা।

.

০২.

চা আর টুকটাক কিছু খেয়ে নিয়ে আমরা একঘণ্টার মধ্যে গাড়িতে গিয়ে বসলাম। পেটে খিদে ছিল। কিন্তু বিরূপাক্ষদা বারবার সাবধান করে দিয়েছিলেন, ভারী কিছু খাবে না ভায়ারা। পথে-ঘাটে হালকা খাওয়াই উচিত।

তার এই সাবধানবাণীটা শিরোধার্য করে নিয়েছিলাম আমরা।

গাড়িতে উঠেই বিক্রম স্টার্ট করে দিল। তার যেন একমুহূর্ত বিলম্ব সহ্য হচ্ছিল না। কীসের যে এত তাড়া বুঝতে পারছিলাম না। পাহাড়ের গা বেয়ে নুড়ি বিছানো আঁকাবাঁকা পথ ক্রমশ উঠে গেছে ওপরের দিকে। এই ভেবে আশ্চর্য হই যে, পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা এই দুর্গম জায়গায় কে তৈরি করেছিল এই পথ! কী করে তারা জেনেছিলেন এই পথের শেষ ঠিকানা কোথায়? সত্যি, ভাবতে গিয়ে অবাক হয়ে যাই।

এক পাহাড় থেকে আর এক পাহাড়। প্রকৃতি যেন খেয়ালের বশে পর পর পাথর, গাছপালা দিয়ে দুর্লঙ্ প্রাচীরের পর প্রাচীর সৃষ্টি করে রেখেছেন। মনে হচ্ছে পাঁচিল টপকালেই অজানা রহস্যময় কোনো জগৎ খুঁজে পাওয়া যাবে।

ওপরে উঠতে উঠতেই দেখা যাচ্ছিল পাহাড়ের ঢালে অনেক নীচে ছোটো ছোটো ঘরবাড়ি। সবুজের পটভূমিতে আঁকা যেন অপরূপ ছবি। কিন্তু–ওগুলো কী?

এত ওপর থেকেও দেখা যাচ্ছি প্রায় প্রত্যেক বাড়ির ওপরে বাঁশে বেঁধে ওড়ানো হয়েছে রঙ-বেরঙের লম্বা কাপড়ের পতাকা। দূর থেকে ভারী সুন্দর লাগছে দেখতে।

আমি বিক্রমকে জিগ্যেস করিনি। (জিগ্যেস করে লাভ নেই। কারণ ও তো কথাই বলছে। )। কিন্তু ওই হঠাৎ উত্তর দিল—’প্রেয়ার ফ্ল্যাগ’। বলেই দু’হাত তুলে কারও উদ্দেশে বার কয়েক নমস্কার করল।

বিরূপাক্ষদা চোখ বন্ধ করেই ছিলেন, এবার চোখ খুললেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, কীসের প্রেয়ার? কার কাছে?

এবার উত্তর দিল শান্তনু। বলল, অশুভ শক্তি তাড়াবার জন্যে নানা জায়গায় বিশেষ করে নির্জন জায়গায় ধর্মপুস্তক থেকে কোনো অমৃত বাণী লিখে লিখে টাঙিয়ে দেয় এখানকার মানুষ। এরা এমন অনেক কিছু বিশ্বাস করে যা আমরা ভাবতে পারি না। ‘অশুভ শক্তি’ মানে বুঝতে পারছেন তো, বিরূপদা?

বিরূপদা উত্তর দিলেন না। মুখ আরও গম্ভীর করে বসে রইলেন।

একটু হেসে শান্তনু বলতে লাগল, কলকাতায় একজন ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল– ডাঃ দাস। কিছুকাল ভুটানে ছিলেন। সাউদার্ন ভুটানের ডিস্ট্রিক্ট টাউন সরভং। সেখানে সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার (M.O) হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলতেন এইসব পাহাড়ি অঞ্চলের সাধারণ দরিদ্র মানুষজন ভূতে শুধু বিশ্বাস করাই নয়, প্রচণ্ড ভয় পায়। এরা তাই বাড়ির আনাচে কানাচে লাল-সাদা পতাকায় বুদ্ধের বাণী লিখে টাঙিয়ে দেয়। তাদের বিশ্বাস পতাকাগুলো যত নড়বে বুদ্ধের বাণী ততই অভয়বার্তা নিয়ে ছড়িয়ে পড়বে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে।

বিরূপাক্ষদা হাঁ করে শুনছিলেন। বলে উঠলেন, ও বাবা এখানেও ভূত! তবে কি আমরা ভূতের রাজ্যের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি? কোথাও আর নিস্তার নেই। বলে মাংকিক্যাপের উপর দিয়ে গরম চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিলেন। যেন কোনো ফাঁক দিয়ে ভূতের নিঃশ্বাসটুকুও ঢুকতে না পারে।

হাসতে হাসতে বললাম, কোনো ভূতের গল্প-টল্প?

শান্তনু বলল, বলেছিলেন বৈকি! একেবারে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে। শুনবে?

বলেই শান্তনু শুরু করল, দাস সাহেবের কোয়ার্টারটি পাহাড়ের ওপর। বেশ সুন্দর। কিন্তু ওখানে থাকতে না থাকতেই ছন্দপতন। রুগি থেকে আরম্ভ করে অন্যান্য ডাক্তাররাও বলতে লাগলেন, দাস সাহেব, একটু সাবধানে চলাফেরা করবেন। সন্ধ্যার পর যেন মোটেই বেরোবেন না। বিশেষ করে পাহাড়তলিতে। জায়গাটা নাকি খারাপ। তারপর একদিন

হঠাৎ বিরূপাক্ষদা রেগেমেগে বলে উঠলেন, জায়গাটা যখন খারাপ বলে জেনেছ তখন ওসব নিয়ে কথা বাড়িয়ে লাভ কী?

শান্তনু হেসে বলল, ভয় পাচ্ছেন নাকি?

বিরূপাক্ষদা বললেন, স্থান-কাল ভেদে সব মানুষই ভয় পায়। ভয়ের কারণ যেখানে থাকে সেখানে তার ভয় না পাওয়াটা স্বাভাবিক নয়।

বললাম, তবে যে বললেন, ‘বৃহৎ শিকারে যেতে চান–হিমালয়ান ব্ল্যাক বিয়ার, রেডপান্ডা, আরো কত সব বৃহৎ জন্তু?

বিরূপাক্ষদা বললেন, ওদের কথা আলাদা। ওদের রক্ত-মাংসের শরীর আছে। বন্দুক ছুড়লে গায়ে লাগে। মরে। আর এরা? নাও আর কথা বাড়িও না। ও বাবা! থাপা সাহেব যে গাড়িটা উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এবারে খাদে ফেলবে আর অশরীরীদের দলে আমাদেরও নাম লেখাবে।

সত্যি বিক্রমের আবার কী হল? জোরে চালাচ্ছিলই, এখন বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছে আর গাড়ির স্পিড বাড়াচ্ছে। পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি ছুটছে–নুড়িগুলো চাকার ধাক্কায় ছিটকে যাচ্ছে–যেন গুলি বৃষ্টি করছে! কেবলই মনে হচ্ছে এইবার বুঝি গাড়িটা উল্টে গড়িয়ে পড়বে পাশের গভীর গর্তে।

সত্যিই পাহাড়ের আবহাওয়ার মর্জি বোঝা দায়। এই মিষ্টি রোদ–তারপরেই হঠাৎ মেঘলা হয়ে গেল চারিদিক। শুরু হল টিপ টিপ বৃষ্টি। আবার একটু পরেই রোদ্দুর। এইজন্যেই ভ্রমণকারীরা ইংরেজিতে একটা কথা বলে থাকেন, ‘হিমালয়ের আবহাওয়া আনপ্রেডিক্টেবল।

এতক্ষণ দূরে দূরে কারু, র‍্যাটং, নরসিং প্রভৃতি যে পর্বতশিখরগুলি দেখা যাচ্ছিল হঠাৎ সেগুলো অদৃশ্য হয়ে গেল। চারিদিক থেকে রাশি রাশি ভাসমান তুলোর মতো কী যেন এগিয়ে আসতে লাগল। আমি আতংকিত হয়ে পড়লাম। মনে হতে লাগল একটু পরেই ঐ ভাসমান তুলোর মতো ভয়ংকর জিনিসগুলো গাড়ির মধ্যে ঢুকে আমাদের দম বন্ধ করে মেরে দেবে।

এদিকে থাপা প্রাণপণে এক্সেলারেটারে ক্রমাগত চাপ দিয়েই যাচ্ছে। গাড়ি কখনও হেলতে দুলতে চলেছে–কখনও ঘটাং ঘটাং করে লাফাতে লাফাতে। বিক্রমের চুলগুলো মাথার ওপর খাড়া হয়ে উঠেছে। সে এক ভয়ংকর দৃশ্য।

এইবার বিরূপাক্ষদা হাঁকড়ে উঠলেন, ড্রাইভার, গাড়ি সামলে চালাও। কী পেয়েছে আমাদের? খাঁচায় আটকানো কতকগুলো ইঁদুর। তোমাকে পুলিশে দেব।

বিক্রম উত্তর দেবার দরকার মনে করল না। হঠাৎ ও উইন্ডস্ক্রিনের দিকে ঝুঁকে পড়ে চোখ ছোটো করে কী যেন লক্ষ করতে লাগল। গাড়ির স্পিড কমাতে লাগল। হঠাৎ থাপার এ আবার কী হল? ওর দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও কেমন যেন মিইয়ে গেছে। সেই অবস্থাতেই ও চট করে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে একটা দোলানি দিয়ে গাড়িটাকে বাঁ পাশে নিয়ে এল।

আমরা চমকে উঠলাম। সামনে অল্প দূরে যেন মাটি খুঁড়ে উঠে এল একটা বলদে টানা গাড়ি। একটাই বলদ। খুবই হৃষ্টপুষ্ট। কুচকুচে কালো রঙ। তার শিঙ দুটোতে সিঁদুর মাখানো। দু’দিকে তীক্ষ্ণ ফলা লাগানো একটা লম্বা শিক বলদটার নাক এফোড়-ওফোঁড় করে দু’দিকে বেরিয়ে পড়েছে। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। আর–

সেই ছাউনিহীন গাড়িতে চালকের আসনে বসে আছে যে, সাক্ষাৎ যমদূতের মতো তার চেহারা। এই প্রচণ্ড ঠান্ডায় তার গায়ে শুধু একটা চাদর আর মাথায় পাগড়ি। দু’চোখ লাল। কপাল জুড়ে সিঁদুর মাখা। একেবারে আমাদের গাড়ির সামনে এসে কোমরে দু’হাত রেখে দাঁড়াল।

বিক্রম গাড়ি থামিয়ে নীচে নেমে হাত জোড় করে হাঁটু গেড়ে বসল। আমরা তো অবাক! তারপর চলল দুজনের পাহাড়ি ভাষায় তর্ক-বিতর্ক। না, তর্কও নয়, বিতর্কও নয়। একজন ক্রমাগত চোখ গোল গোল করে ধমক দিয়ে যাচ্ছে আর আকাশের দিকে আঙুল তুলে কী দেখাচ্ছে। অপর দিকে আমাদের থাপা বাহাদুর হাত জোড় করে মুখ কাচুমাচু করে কিছু একটা উত্তর দিচ্ছে। বারকয়েক পাহাড়ি ভাষায় শনিবার কথাটা শোনা গেল। হাবেভাবে যতটুকু বোঝা গেল তা হচ্ছে যমদূত সদৃশ লোকটি বিক্রমকে ধমকাচ্ছে, কেন সে আজ এই পথে এল? বলছে, আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখো। তুমি কি জান না এর পরিণতি কী? তুমি কি ভুলে গেছ আজ কী বার?

শান্তনু নিচু গলায় বলল, ও বোধ হয় এ অঞ্চলের একজন গুরু–মাতব্বর। এরা পাহাড়িদের কাছে পুজো পায়। দেবতার মতোই। এমন শুনেছি সেই ডাক্তার দাসের মুখে। সহজে এদের মতো উচ্চস্তরের মানুষের নাকি দেখা পাওয়া যায় না। ‘

তবে এ লোকটা ভালো। সে সাবধান করে কী যেন বলল, অমনি বিক্রম সভয়ে পিছনে তাকিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল। আর আশ্চর্য! বলদের গাড়িটা সামনে তো এগোলই না যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকেও গেল না। পাশের ঢাল দিয়ে দ্রুত নামতে লাগল–চাষের ভুই তছনছ করে।

আমরা তো হতবাক! ব্যাপারটা কী হল? কেন মাতব্বরটি সামনে গেল না, কেনই বা ফিরেও গেল না? যেন কোনো কিছুর আভাস পেয়ে ভয়ে তাড়াতাড়ি নেমে গেল!

আমরা যেন নিজেদেরকেই প্রশ্ন করলাম! নিজেরাই উত্তর খুঁজলাম। শেষ পর্যন্ত নিজেরাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করে চুপ করে গেলাম।

কেবলই শুনছি স্যাটারডে, স্যাটারডে–ব্যাপারটা কী হে!–গলার স্বর উঁচু করেই জিগ্যেস করলেন বিরূপাক্ষদা।

শান্তনু চাপা গলায় বলল, কিছু একটা ঘটনা আছে, যা আমরা জানি না। জানতে চাই এটাও হয়তো চায় না কেউ। বলে ইশারায় বিক্রমকে দেখিয়ে দিল। তারপর ফিসফিস করে বলল, আমাদের একেবার চুপ করে থাকাই উচিত।

ভয় পেয়ে বিরূপাক্ষদা বললেন, ও বাবা! ফুল দেখতে বেরিয়েও স্পিকটি নট!

হ্যাঁ, অন্তত ‘হিলে’ পৌঁছানো পর্যন্ত।

এমনি সময়ে গুড় গুড় করে কয়েকবার মেঘ ডেকে উঠল। বিদ্যুৎচমকে পাহাড়ের ওপর গাছগুলোকে স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিল। তারপরই প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল। গগনচুম্বী পাহাড়ের শ্রেণিতে বজ্রপাত দেখেছ তোমরা? না দেখে থাকলে ভালোই। সুন্দরও যে সময়ে সময়ে কত ভয়ংকর হয় তা না দেখলে বুঝতে পারবে না।

বাজের শব্দে বিরূপাক্ষদা ওঁর ভারী শরীরটা নিয়ে প্রায় আধ হাত লাফিয়ে উঠেছিলেন। পড়ে যাচ্ছিলেন, কোনো-রকমে ড্রাইভারের সিটটা আঁকড়ে ধরে সামলে নিলেন। তারপর দু’কান চেপে ধরে জিগ্যেস করলেন, বাজটা কোথায় পড়ল হে? খুব কাছেই মনে হচ্ছে?

শান্তনু আঙুল দিয়ে একটা বিশাল উঁচু পাহাড়ের শৃঙ্গ দেখিয়ে দিল। দেখিয়ে দিল পাহাড়ের ওপর ছোটো ছোটো গাছপালা বাজের আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে। মনে হচ্ছে যেন পাহাড়টা আগুনের মালা মাথায় জড়িয়ে ম্যাজিক দেখাচ্ছে। দেখতে দেখতেই চোখে পড়ল আগুনের কয়েকটা স্ফুলিঙ্গ পাশের পাহাড়ের গাছে গিয়ে পড়ল। যেন অগ্নিবৃষ্টি করছে।

চমকে উঠলাম সবাই। কী সর্বনাশ! দাবানল হয়ে যাবে নাকি?

হয়নি। রক্ষে, এই সময়ে নামল বৃষ্টি।

আর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল ড্রাইভার বিক্রমের ছটফটানি। গাড়ি চালাতে চালাতেই সে ফিরে ফিরে কাচ লাগানো স্ক্রিন দিয়ে দেখছিল। বৃষ্টি জোরে হচ্ছিল না। তাই বাইরের জিনিস মোটামুটি দেখা যাচ্ছিল।

বিক্রম সেই গাড়িতে ওঠার পর থেকে কেবল আকাশের দিকে তাকাচ্ছিল। এখন তাকাচ্ছে। পিছনের দিকে। কী যেন বারবার দেখার চেষ্টা করছে। ও যেন নিশ্চিত জানে আজ যখন শনিবার আর আকাশ থেকে যখন জল পড়েছে বজ্রপাতের সঙ্গে তখন কিছু একটা দেখা যাবেই। না ভালো নয়–ভালো নয়–মোটেই ভালো নয়। তবু যদি ওর একান্তই আবির্ভাব ঘটে তাহলে আগে থেকেই প্রস্তুত হতে হবে।

হঠাৎ বিক্রম অতিমাত্রায় সতর্ক হয়ে উঠল। ভয়ে তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

শান্তনু চেঁচিয়ে উঠল, এ কী করছ? অ্যাকসিডেন্ট হবে যে!

ও কোনোরকমে অদ্ভুত কায়দায় গাড়ি সামলে বাঁ হাত তুলে পিছনের রাস্তাটা দেখিয়ে দিল। আমরা ঘাড় ঘোরালাম। স্ক্রিনের ভিতর দিয়ে বাইরে তেমন কিছু দেখা গেল না। সেই পাথর ছড়ানো উঁচু-নিচু পথ, পথের একপাশ থেকে মাথা উঁচু করে উঠেছে পাহাড়, অন্য পাশে গভীর গর্ত বা খাদ। তার পিছনে ঘন কুয়াশা। কিন্তু বিক্রম এরই মধ্যে দিয়ে। কিছু দেখতে পেয়েছিল। তাই মুহুর্মুহু তার মুখের ভাব বদলাচ্ছিল।

কই হে, কিছুই তো দেখছি না। অনেক কষ্টে বিরূপাক্ষদা তাঁর দেহভার উত্তোলন করে কোনোরকমে ঘাড়টা ফিরিয়েছিলেন। তারপরেই তিনি যেন চমকে উঠলেন–হ্যাঁ, হা, কী যেন আসছে!

কী আসছে?

আমি আর শান্তনু ফের ঝুঁকে পড়লাম। হাঁ, পিছনে অনেক দূরে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসছে কী যেন–বৃষ্টির মধ্যেই নেমে আসছে–

কী ওটা?

বিক্রম না দেখেই বলল, কুকুর।

কুকুর! ও কীরকম কুকুর?

দেহের তুলনায় মুখটা বীভৎস রকম বড় ও উঁচলল। ছুটে আসছে। লক্ষ আমাদের গাড়িটা।

চোখে ধাঁধা লেগে যাচ্ছিল। বিক্রমকে উদ্দেশ করে বললাম, ওটা তো কুকুর মনে হচ্ছে না।

তা হলে দেখুন বোধহয় বানর।

সে আবার কী? বিরূপাক্ষদা বললেন, ম্যাজিক না কি? এই বলছ কুকুর, তার পরই বলছ বানর! তাজ্জব!

আপনিই দেখুন না।

বিরূপাক্ষদা বললেন, আমার নজর কি অতদূরে পৌঁছাবে?

শান্তনু হঠাৎ গম্ভীর গলায় বলল, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। কুকুর নয়, বানরও নয়, কুচকুচে কালো কিছু একটা দু’পায়ে ভর দিয়ে হাঁটছে, লম্বা হাত দুটো পাশে ঝুলছে। ঠিক যেন ওরাং ওটাং!

হিমালয়ের পাহাড়ে ওরাং ওটাং!

তার চেয়ে অবাক কাণ্ড চেয়ে দ্যাখো কী জোরে ছুটে আসছে। …

বিক্রম তখন ভয়ংকর কিছু বুঝে স্টিয়ারিংয়ের ওপর ঝুঁকে পড়ে মরিয়া হয়ে স্পিড তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

ও শান্তনু, আমার তো মনে হয় বানরও নয়, ওরাং ওটাংও নয়, একটা মানুষ–

তাই তো। হাঁটুর নীচে পর্যন্ত ঝোলা ঢিলে ওয়াটারপ্রুফ গায়ে ঢলঢল করছে। মাথায় কানে ওয়াটারপ্রুফ টুপি। ছুটে আসছে এই দিকে।

কী ওটা?

একবার মনে হল কুকুর, একবার মনে হল বানর। আবার পরক্ষণেই মনে হল ওরাং ওটাং। আর এখন মনে হচ্ছে বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে এগিয়ে আসছে বর্ষাতি জড়ানো লম্বা একটা মানুষ! এ তো একটা রহস্য! আর কেনই বা উঁচু পাহাড়ের পথ দিয়ে ছুটে আসছে? কেনই বা ওর লক্ষ আমাদের গাড়িটা?

এসবের উত্তর একমাত্র দিতে পারে আমাদের ড্রাইভার বিক্রম থাপা। কিন্তু ও তো গাড়িতে উঠে পর্যন্ত মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। তারই বা কারণ কী? ও কি জানে এই পথে বৃষ্টি পড়লে এই অদ্ভুত পাহাড়ি জীবটির আবির্ভাব হয়? সেই জন্যেই এই পথে আসতে চায়নি। আর এও জানে ঐ যে বহুরূপী জীবটি গায়ে ওয়াটারপ্রুফ জড়িয়ে লাফাতে লাফাতে ছুটে আসছে সে নিশ্চয় কলা, শাঁকালুভোজী প্রাণী নয়। আর আমাদের সঙ্গে নিছক আলাপ করার জন্যে ছুটে আসছে তাও নয়।

ও ভাই থাপাজি, কিছু একটা বলল। পেছনে ধাওয়া করে আসছে ওটা কী?

থাপাজি উত্তর দিল না। বাঁ হাতটা তুলে শুধু কথা বলতে বারণ করল।

দেখতে দেখতে ওয়াটারপ্রুফওলা ঢ্যাঙা লোকটা হুড়মুড় করে কাছে এসে পড়ল। একটা ছুটন্ত গাড়িকে ধরে ফেলে আর কি! এও আশ্চর্যের কথা! একটা মানুষ কী করে দৌড়ে একটা গাড়ির নাগাল পায়–যে গাড়িটা পাহাড়ের রাস্তাতেও অ্যাকসিডেন্টের ভয় তুচ্ছ করে ছুটছে দুর্দান্ত গতিতে!

আমরা বুঝতে পারলাম এসব রহস্য বিক্রম ভালো করেই জানে। আর হিংস্র লোকটার নাগালের মধ্যে এসে পড়লে কী পরিণতি হবে তাও তার অজানা নয়। অথচ পালানো ছাড়া পরিত্রাণের উপায় আর কী হতে পারে তা বোধহয় থাপাজি জানে না। এ অবস্থায় আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইলাম। একবার বিরূপাক্ষদাকে দেখলাম। চোখ বুজিয়ে শুধু ইষ্টনাম জপ করে যাচ্ছেন।

আকাশে এখন জমাট মেঘ তেমন নেই। তবু মেঘ আছে। টিপটিপ বৃষ্টিও পড়ছিল। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের চমকানি। বিক্রম আগের মতোই আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। আর বিড়বিড় করে কিছু যেন প্রার্থনা করছে।

হঠাৎ মনে হল পিছনে যেন একটা ঝড়ের আভাস। অথচ আশেপাশে ঝড়ের চিহ্নমাত্র নেই। ঘাড় ঘোরাতেই চমকে উঠলাম। এখন আর পায়ে হেঁটে নয়, দু’পা শূন্যে তুলে ভেসে আসছে মানুষটা। এখন প্রায় দশ হাতের মধ্যে এসে পড়েছে। বোঝাই যাচ্ছে একবার নাগালের মধ্যে পেলে ঐ মানুষের আকারবিশিষ্ট জীবটা কী করবে।

এই সময়ে বৃষ্টিটা যেন প্রায় থেমে এল। আর তৎক্ষণাৎ অসাধারণ তৎপরতায় বিক্রম স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে গাড়িটাকে নিয়ে গেল পাহাড়ের কোল দিয়ে অন্যদিকে। সেখানে পৌঁছতে

কোথায় বৃষ্টি কোথায় ঝড়–কোথায় বা মেঘ ডাকা! একেবারে দুপুরবেলার সোনা গলানো বোদ!

পিছনে তাকিয়ে দেখলাম কোনো জীবজন্তুর চিহ্নমাত্র নেই। শুধু পাহাড়ের পর পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে একরাশ চাপা রহস্য বুকে নিয়ে। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। সবচেয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছে। যেন বিক্রম। বার বার পিছনে ফিরে সেই পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে মাথা নত করতে লাগল। যেন কোনো অদৃশ্য দেবতার উদ্দেশে প্রণাম জানাল।

কিন্তু এতক্ষণ ধরে ব্যাপারটা কী ঘটল বুঝতে পারলাম না।

শান্তনু বলল, আমিও ঠিক জানি না। দেখি বিক্রম যদি এখন কিছু বলে!

গাড়ির স্পিড বিশেষ না কমিয়ে বিক্রম গাড়ি চালাচ্ছে। হিলে’ এখনও প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। বিক্রমকে খুশি করার জন্য শান্তনু এবার ভাঙা ভাঙা পাহাড়ি ভাষায় জিগ্যেস করল, এখানে যা ঘটল সে বিষয়ে কিছু বলো। আমরা তো শুধু ভয়ই পেয়ে গেলাম। কিছু বুঝলাম না।

উত্তরে বিক্রম কোনো কথা না বলে স্টিয়ারিং থেকে বাঁ হাতটা তুলে শুধু একবার কায়দা করে ঘুরিয়ে দিল। তার অর্থ কী তা ঠিকমতো বুঝতে না পারলেও এটুকু বোঝা যায় যে, হয় সে নিজেও জানে না, নয় তো সে বলতে পারবে না।

অগত্যা আমাদের চুপ করে থাকতে হল। বিরূপাক্ষদা শুধু অধৈর্য হয়ে গজগজ করতে লাগলেন। বললেন, এ তো আচ্ছা রহস্য!–বলে যেন অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে শার্সি বন্ধ জানালায় মাথা ঠেকিয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করলেন।

গাড়ি এখন চলছে অনেকটা স্বাভাবিক গতিতে। তবু বিক্ৰম গাড়ি চালাতে চালাতেই মাঝে মাঝে ঘড়ি দেখছে। এতেও আমার ভয়-না জানি আবার কী হয়।

আমি ইশারাতে শান্তনুকে জিগ্যেস করলাম, এত ঘড়ি দেখার ঘটা কেন?

শান্তনু বললে, বাঃ! মনে নেই আমাদের সঙ্গে তো কথাই ছিল বেলা থাকতে থাকতেই এসে পৌঁছতে হবে ‘হিলে’তে।

তার মানে এখনও যথেষ্ট ভয় আছে।

শান্তনু একটিপ নস্যি নিয়ে বলল, ভয় পেয়েছি ঠিক। কিন্তু বিপদে পড়িনি এখনও। একটুর জন্যে মৃত্যুর ছোঁওয়া থেকে বেঁচে গিয়েছি।

হ্যাঁ, বেঁচে গিয়েছি বিক্রমের তৎপরতার জন্যে। কিন্তু ওকে ধন্যবাদ জানিয়েও লাভ নেই। ও তো কথাই শুনবে না। আচ্ছা, বিক্রমের রহস্যটা কী বলে মনে হয় তোমার?

কী করে বলব? তুমিও যেখানে আমিও সেখানে। হয়তো আমি হিমালয়ের পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরেছি কয়েকবার, তা বলে এমন রহস্যময় ঘটনা কখনো ঘটতে দেখিনি। শুধু বিক্রম কেন, জানতে ইচ্ছে করে কেন কোনো ড্রাইভার আসতে চায় না? কেন শনিবারটা যাত্রা করা নিষেধ? ঐ যে বহুরূপী মূর্তিটাকে ও? কেন, কী করে কখনও কুকুর, কখনও ওরাং ওটাং, কখনও মানুষের রূপ ধরছিল? বিজ্ঞানের যুগে একি সম্ভব? তা যদি না হয় তাহলে বলতেই হয়, সবটাই চোখের ভুল। পাহাড়ের মায়া।

কিন্তু এও তো গোঁজামিলের কথা। আমরা তো সম্পূর্ণ দেখলাম শেষ মুহূর্তে মনুষ্যমূর্তি জীবটি গাড়ির দিকে ওয়টারপ্রুফটা ছুঁড়ে দিয়ে আমাদের আটকাতে চেয়েছিল। এ তো চোখের ভুল হতে পারে না। তাই না?

শান্তনু বলল, মনে হয় এসবের উত্তর আমরা পেতে পারি বার্সে পৌঁছে, ওখানকার কেউ না কেউ হয়তো জানতে পারে।

বললাম, হয়তো তাই, ও–আচ্ছা, আমাদের বার্সে পৌঁছে দিয়ে বিক্রম আমাদের নিয়ে ফিরবে তো? নাকি ফেলে পালাবে? তা হলেই তো চিত্তির!

শান্তনু বলল, আমাদের নিয়ে ফিরতে না পারে। সেটা তার ইচ্ছে। কিন্তু আজ হিলে পৌঁছে ওকে নাইট হল্ট করতেই হবে। রাত্রে পাহাড়ি রাস্তায় যাবে না। ফিরলে কাল সকালে। তবে এ কথাও ঠিক–এ পথ দিয়ে ফিরবে না। আর আমাদের না নিয়ে ফিরলে ওর লাভ কী?

বিরূপাক্ষদা হঠাৎ অধৈর্য হয়ে বলে উঠলেন, এই ড্রাইভার সাহেব, গাড়িটা একবার রোখো। লং জার্নি–একটু নামার দরকার হয় তা কি তুমি বোঝ না?

কিন্তু থাপা শুনতেই পেল না। এবার শান্তনু ওকে একটু ঠেলা দিয়ে পাহাড়ি ভাষায় গাড়িটা একটু দাঁড় করাতে বলল। বিক্রম যেন বিরক্ত হয়েই একধারে গাড়িটি দাঁড় করাল।

বিরূপাক্ষদা দরজা খোলবার জন্যে ব্যস্ত হলেন। কিন্তু দরজার কলক্তি ঠিক বোঝেন না। শুরু করলেন ধাক্কাধাক্কি। বিক্রম ইশারায় বিরূপাক্ষদাকে নিরস্ত করে পিছু না ফিরেই ডান হাত বাড়িয়ে লকটা খুলে দিল। সবাইকে উদ্দেশ করে এতক্ষণে বিক্রম মাত্র আধখানা করা বলল, ‘Ten minutes only.’ বলে দশটা আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল।

ঠিক আছে। বলে এ দরজা দিয়ে আমি আর শান্তনু নেমে পড়লাম। আঃ! কী মুক্ত প্রকৃতি! এতক্ষণ বন্ধ গাড়ির মধ্যে থেকে যেন হাঁপিয়ে উঠেছিলাম, এখন বেরোতেই শীত ধরে গেল। হাত-পা একটু খেলিয়ে নেবার জন্যে আমরা প্রথমে আলিস্যি ভেঙে তারপর জোরে জোরে পা ফেলে খানিকটা হাঁটলাম। একবার পিছনে ফিরে দেখলাম বিরূপদা আপাদমস্তক গরম কম্বল মুড়ে গুটিগুটি এদিকে আসছেন। কিন্তু বিক্রম কোথায় গেল? ও কি নামেনি? আশ্চর্য! এতখানি জার্নি করেও কি একবার মাটিতে পা রাখার দরকার ওর হয় না?

যাই হোক, বিক্রমের জন্যে ভাবার দরকার নেই। এসব অঞ্চলে আগে ঘুরেছে। বিরূপাক্ষদাকে নিয়েই যত ভাবনা। এই যে আমরা ওঁকে ফেলে এগিয়ে এসেছি তাতে উনি আমাদের প্রতি বিরূপ।

খাস হিমালয়ের গোটা পাহাড়ের একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে এর আগে আমরা কখনো নগ্ন পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখার সুযোগ পাইনি। আজই দেখলাম, পাহাড়ের গায়ে যে জমা শ্যাওলা তারও মধ্যে যেন একটা বিশেষত্ব আছে। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে কতরকম গাছের চারা। একেবারে শীর্ষে বড়ো বড়ো গাছ যেন আকাশকে ধরতে চাইছে। তাছাড়া আছে। হরেকরকমের ফুল। বেশির ভাগই ভায়োলেট কালার। কোনো কোনো সাদা ফুলের পাপড়িতে পাপড়িতে রঙের শোভা। কোথাও থোকা থোকা লাল টকটকে ফুল। আর সেইসব ফুলে উড়ে এসে বসছে কতরকমের প্রজাপতি। আমরা তন্ময় হয়ে দেখছিলাম। শান্তনু উত্তেজিত হয়ে বলল, আরে ঐ তো রডোড্রেনড্রন! দ্যাখো কেমন থোকা থোকা লাল ফুল। এই ফুল দেখে আর কোথায় কোনো ফুল মনে পড়ে বলো তো!

বললাম, আমাদের গরমকালের পলাশ। বসন্তে বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায় যেন আগুন ধরিয়ে দেয়।

রাইট! সিকিমিরা রডোড্রেনড্রনকে নাকি ‘গুরাস’ বলে। গুরাস ফুটলে গ্রামের সিকিমিরা আনন্দে মেতে ওঠে।

গুরাসও কি এমনি লাল?–বোকার মতোই প্রশ্ন করি।

শান্তনু হেসে বলল, লাল তো বটেই। যখন বলছি রডোড্রেনড্রন–এরই আর এক নাম ‘গুরাস’।

লজ্জিত হয়ে বললাম, স্যরি!

তবে এক রকমের সাদা গুরাসও নাকি হয়। দারুণ সুন্দর। আরে! ঐ তো সাদা গুরাস! কতো বড়ো! দ্যাখো দ্যাখো। চলো, ফুলটা তুলে আনি। যে ক’দিন পারি অচেনা পাহাড়ি বন্ধুর স্মৃতি হিসেবে রেখে দেব।

আমরা এগিয়ে গিয়ে ফুলটা তুলতে যাচ্ছি। হঠাৎ ভুইফেঁড়ের মতো জঙ্গলের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল সেই বলদে টানা গাড়ির অদ্ভুত দর্শন লোকটি। যাকে দেখেছিলাম অনেক দূর পিছনে। চমকে উঠলাম। সেই সিঁদুর লেপা চওড়া কপাল। সেই খালি গা। হাতের ইশারায় ফুলটা ছুঁতে নিষেধ করল। তারপর সে একটি মাত্র কথা বলেই উধাও হয়ে গেল। কথাটার অর্থ আমি সঠিক বুঝতে না পারলেও শান্তনু বুঝতে পেরে বলল, ভয়ানক বিষ। কোনো রকমে ঠোঁটে ঠেকালেই মৃত্যু। এমনকি হাত দিয়ে ছুঁলেও তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে ফেলতে হয়। নইলে ভুলে মুখে ঠেকিয়ে ফেললে আর রক্ষে নেই।

তা না হয় হল। কিন্তু ভোজবাজির মতো ব্যাপারটা কী হল? শান্তনুও বুড়ো আঙুল। দিয়ে গাল চুলকোতে চুলকোতে ঐ একটা কথাই বলল, তাই তো। ব্যাপারটা কী হল?

উত্তর তখনই পাওয়া গেল না। রিস্টওয়াচের ওপর চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম। দশ মিনিট কখন হয়ে গেছে! চলো–চলো।

আমরা হুড়মুড় করে গাড়ির দিকে চললাম। পাহাড়টা ঘুরতেই যে জায়গাটা সেখানেই তো গাড়িটা থাকার কথা। কিন্তু–

তাহলে আমরাই জায়গা ভুল করেছি। শান্তনু বলল।

বললাম, না, আমরা কিছু ভুল করিনি। ঐ দ্যাখো বিরূপাক্ষদা দাঁড়িয়ে আকাশ-পাতাল কী ভাবছেন।

বলিহারি যা হোক! আমাকে একা ফেলে কোথায় গিয়েছিলে তোমরা? গাড়িটাও নিয়ে গেলে?

গাড়িটা নিয়ে গেলাম মানে?

মানে তো আমিই জানতে চাই। এই সরু রাস্তায় গাড়ি নিয়ে যাবার কী এমন দরকার পড়ল?

আমরা আবার গাড়ি নিয়ে কোথায় যাব? আমরা কি গাড়ি চালাতে জানি?

তোমরা চালাতে যাবে কেন? ড্রাইভারকে নিয়েই গেছ।

আমরা অবাক হয়ে দুজনের দিকে তাকালাম। নিশ্চয় বলতে পারতাম এই মায়াবী পাহাড়ি রাস্তায় এতক্ষণ ধরে ঘুরতে ঘুরতে বিরূপাক্ষদার মাথা গোলমাল হয়ে গেছে। কিন্তু এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম গাড়িটা সত্যিই নেই।

বাঃ রে মজা! ড্রাইভার সুষ্ঠু মোটর গাড়ি উধাও!

এবার আমাদের দুর্ভাবনা হল। কী সব হচ্ছে!

ব্যাপারটা একটু খুলে বলুন তো বিরূপাক্ষদা!

খুলে আর বলব কী? প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ঐ ঝোপটার দিকে গিয়েছিলাম। উঠে দাঁড়িয়ে আলিস্যি ভাঙলাম। দেখলাম অজস্র টকটকে লাল ফুল–থোকা থোকা লাল ফুল। শুনেছিলাম রডোড্রেনড্রন নাকি লালফুল। ভাবলাম এগুলোই যদি রডোড্রেনড্রন হয় তাহলে তোমাদের ডেকে দেখিয়ে দিই। ব্যাস এখানেই যদি নয়ন সার্থক হয়ে যায় তাহলে আর এগোবার দরকার কী? এই ভেবে ডাকতে গিয়ে দেখি তোমারও নেই গাড়িও নেই। আমি তো ভয়ে কাটা। এই জনমানবশূন্য জায়গায় অমি একেবারে একা! ভাবো তো কী অবস্থা!

শান্তনু বলল, এ ব্যাপারটা পরে গাড়িতে বসে ভাবলেও চলবে। এখন আরও গুরুত্বপূর্ণ ভাবনার কথা হচ্ছে–থাপা আমাদের না জানিয়ে গাড়িটা নিয়ে গেল কোথায়?

আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, আমাদের ফেলে রেখে পালাল নাকি?

শান্তনু বলল, পালাবে? কেন পালাবে? আমাদের জব্দ করার কারণ তো কিছু ঘটেনি। তাছাড়া ভাড়ার মোটা টাকা হাতছাড়া করবে বিক্রম এমন বুদ্ধ নয়।

আমি ইতস্তত করে বললাম, তবু লোকটাকে তো ঠিক স্বাভাবিক বলে মনে হয় না।

বিরূপাক্ষদা চোখ গোল গোল করে একবার আমার দিকে একবার শান্তনুর দিকে তাকাচ্ছিলেন আর সভয়ে আমাদের কথা শোনবার এবং মানে বোঝবার চেষ্টা করছিলেন। এবার আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। বলে উঠলেন, পালানোর কথা কী সব বলছ তোমরা একটু স্পষ্ট করে বলো।

দেখছি গাড়িও নেই, বিক্রমও নেই। এর মানে কী হতে পারে তাই আলোচনা করছিলাম।

বিরূপাক্ষদা একেবারে আঁতকে উঠলেন–অ্যাঁ! এসব কী কথা! বিক্রম যদি চলে গিয়ে থাকে তাহলে আমরা যাব কী করে? আর থাকবই বা কোথায়? এ তো মানিকতলা থেকে শ্যামবাজারের মোড় পর্যন্ত কিংবা বাড়ি থেকে বাজার যাওয়া নয়। হায় হায়! শেষ পর্যন্ত পাহাড়ের নীচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শীতে কাঁপতে কাঁপতে মরতে হবে। আমার তো আবার বেজায় ঠান্ডার ধাত! ও শান্তনু, তুমি অমন গোমড়া হয়ে থেকো না।

শান্তনু বলল, না, আমি অন্য কথা ভাবছি।

কী? ভয়ে ভয়ে বিরূপাক্ষদা তাকালেন।

ভাবছি, আমরা শীতে মরব, না হিংস্র প্রাণীদের উদরপূর্তির সহায়ক হব?

আঁৎকে উঠলেন বিরূপাক্ষদা–আবার হিংস্র জন্তু-টন্তুর কথা কী বলছ? এই ঘোর বিপদের একেবারে মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে তোমরা কি মজা করছ? আমায় ভয় দেখাচ্ছ?

শান্তনু মাথা নাড়ল–না বিরূপদা, আমরা অমন বেরসিক নই। চেয়ে দেখুন। এই ছাপগুলো কোন জীবের বলতে পারেন?

চমকে লাফিয়ে উঠে দু’পা পিছিয়ে এসে চশমাটা ঠিক করে নিয়ে ঠাওর করলেন বিরূপাক্ষদা। এ তো কুকুরের পা। ও বাবা এ তো দেখছি অনেকগুলো। এত কুকুর–একসঙ্গে!

কাছাকাছি গেছেন। কিন্তু ফুল মার্কস পেলেন না। এগুলো কুকুরের থাবা নয়। কুকুরের থাবা অন্যরকম। আপনি নেকড়ের থাবা দেখেছেন?

নেকড়ের থাবা! কলকাতায় ঘোরাঘুরি করে একটা গোটা নেকড়েই দেখলাম না তো নেকড়ের থাবা! কী বলতে চাও তুমি?

শান্তনু গম্ভীর গলায় বলল, এইসব অঞ্চলের পাহাড়ে এক ধরনের নেকড়ে আছে যারা আসল নেকড়ে নয়, তবে নেকড়েদের জাতভাই। ওরা সাধারণত কুকুরের চেয়ে বেশ ছোটো। মাটি শুঁকতে শুঁকতে, সামনের দিকে শরীর ঝুঁকিয়ে, ক্ষিপ্রগতিতে ছোটে। নেকড়ের চেয়ে আকারে ছোটো। কিন্তু ঢের বেশি হিংস্র। একটা বিদেশী বইয়ে পড়েছিলাম এরা একাই একটা পূর্ণবয়স্ক মানুষকে খেয়ে ফেলতে সময় নেয় আট থেকে দশ মিনিট। মারাত্মক কথা হচ্ছে, এরা থাকে পাহাড়ে। এক জায়গা থেকে বেরিয়ে যখন অন্য জায়গায় যায় তখন দলবদ্ধভাবে ছুটতে ছুটতে যায়। সামনে কেউ পড়লে তার রক্ষা থাকে না।

বিরূপাক্ষদা বললেন, ও বাবা, তুমি এতও জান। গোয়েন্দাকেও হার মানাও দেখছি। তা এতগুলি নেকড়ে-শাবক একযোগে গেলেন কোথায়? ‘পুনরাগমনায় চ’–ফিরে আসার জন্যে যায়নি তো?

মনে হয় ফিরবে আর এই পথ দিয়েই। আমি যতদূর পড়েছি তাতে জেনেছি এদের স্বভাবই এই–দিক পরিবর্তন করে না।

এমনি সময়ে ঝোপঝাড়ের মধ্যে থেকে গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। আর মিনিট তিনেকের মধ্যেই পাইন বনের মধ্যে থেকে আমাদের গাড়িখানাকে আসতে দেখা গেল।

শান্তনু তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল–আরে বিক্রমজি, কাঁহা গিয়া থা?

বিক্রম তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে দরজা খুলে দিল।

জলদি স্যার!

কোনোরকমে আমরা ঢুকতে ও গাড়ি স্টার্ট দিল। সংক্ষেপে যা বলল তা এই–

গাড়ি থেকে আমরা নেমে গেলেও বিক্রম নামেনি। কারণ সে জানত শনিবার দিনটা এখানে বড় অশুভ দিন। অনেক অঘটন ঘটে। সে এও জানত এইরকম কোনো জায়গায় এইরকম সময়ে উত্তরের পাহাড় থেকে দলবদ্ধ হয়ে নেমে আসে এক ধরনের জীব। তাদের সামনে পড়লে কারোর রক্ষা নেই। সে জন্যে সে ভাবছিল কী করবে?

গাড়িটা রাস্তা জুড়ে রাখা ঠিক নয়। ওদের জন্যে পথ ছেড়ে রাখতে হবে। কিন্তু ঠিক কখন কোন পথে ওরা নামবে সেটাই বুঝতে পারছিল না। আর তখনই চোখে পড়ল দূরে উত্তরের একটা পাহাড়ের দিকে। দেখল ছাই রঙের কী একদল জন্তু পাহাড়ের গায়ে গা মিলিয়ে সার বেঁধে নেমে আসছে। তখনই বিক্রম বুঝতে পারল আর একমুহূর্ত দেরি করা যাবে না। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি নিয়ে সে পথ থেকে পাশের গভীর ঝোপের দিকে চলে এসেছিল।

ওরা কি দক্ষিণের পাহাড়গুলোর দিকে গেল?

হ্যাঁ।

আবার ফিরবে কখন?

তার ঠিক নেই। ফিরলে এই পথ দিয়েই ফিরবে। কথা শেষ করতে না করতেই বিক্রম হঠাৎ স্পিড বাড়িয়ে দিল।

কী হল?

ঐ দেখুন। ওরা নেমে আসছে।

যাক কী ভাগ্যি, ওরা এদিকে এল না। চলে গেল উত্তরের পাহাড়ের দিকে। যে পথ দিয়ে এসেছিল।

.

০৩.

অতঃপর একঘণ্টার মধ্যেই অর্থাৎ বিকেল তিনটে বাজবার আগেই আমরা ‘হিলে’ এসে পৌঁছালাম। পাহাড় ঘেরা ৯০০০ ফুট উঁচুতে ছোট্ট জায়গা। না গ্রাম, না পাহাড়। এখানে পৌঁছানোর পরই বিক্রম একেবারে অন্য মানুষ। মনের মধ্যে যেন একটা চাপা ভয় ছিল সেটা চলে গেছে।

যেখানে গাড়ি থামল সেটা গাড়ির স্ট্যান্ড। নানা দিক থেকে বাস আসে। কোনোটা আসে জোরথাং থেকে, কোনোটা সোমবারিয়া থেকে। তবে হুড়মুড় করে আসে না। তিন চার ঘণ্টা অন্তর। তার কারণ পাহাড়ি রাস্তা। সন্ধের ঢের আগেই বাস চলাচল বন্ধ করে দিতে হয়। আরও যে সব জায়গা থেকে আসে তার নাম জানা নেই।

বিক্রম নেমেই চলে গেল কাছেই যে চায়ের দোকানে ড্রাইভাররা বসে সেখানে। অনেকক্ষণ গল্প করতে পারেনি। মন-প্রাণ আনচান করছিল।

আমরাও গাড়ি থেকে নেমে পড়েছি। বিরূপাক্ষদা মাটিতে পা দিয়েই বলে উঠলেন, রাতে থাকব কোথায়? ভালো হটেল-টোটেল…

হেসে ছড়া কেটে বললাম, ‘মোটে মা রাঁধে না, তপ্ত আর পান্তা! ভালো হোটেল মাথায় থাকুক, একটা মাথা গোঁজার মতো সরাইখানা পেলেই ভাগ্যি বলে মানব।

বিরূপাক্ষদা কথাটা শুনেও যেন শুনলেন না। বললেন, ওহে শান্তনু, থাপা গেল কোথায়?

ভাববেন না, বলেই শান্তনু ডাকল, বিক্রমজি—

বিক্রম এসে দাঁড়াল।

তোমার ভাড়া কি মিটিয়ে দেব?

মিটিয়ে দেবেন? মানে ছেড়ে দেবেন? তারপর ফিরবেন কার গাড়িতে?

শান্তনু তাড়াতাড়ি বলল, না–না, ছেড়ে দেব কেন? আসলে আমরা বুঝতে পারছি আমরাই বা থাকব কোথায়? আর খাবই বা কোথায়?

বিক্রম বলল, আমার থাকবার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু আপনারা কী করবেন দেখুন।

আমরা কাল বার্সে যাব। চার কিলোমিটার পথ। দরকার হলে হেঁটেই যাব। (এ কথা শুনে বিরূপাক্ষদা মুখ কিছু না বললেও আঁৎকে উঠলেন) এসেছি তো বেড়াতে। এখন রাত্তিরে থাকার ব্যবস্থা কোথায় করব?

বিরূপাক্ষদা বললেন, কোথা ফাইভ স্টার মার্কা হোটেল-টোটেল–বেড়াতে এসেছি, টাকার মায়া করলে কি হয়?

খুব ঠান্ডা বলে এখন বিক্ৰম কাশ্মীরিদের মতো টুপি পরেছে। তার ফর্সা চ্যাপ্টা মুখে মানিয়েছে ভালো। টুপিটা ঠিক করে বসিয়ে নিয়ে চিন্তিত মুখে বলল, তেমন হোটেল তো এখানে নেই।

না না, ‘তেমন’ হোটেলের দরকার নেই। যেমন-তেমন পেলেই হল। বলল শান্তনু।

চলুন দেখি। বলে বিক্রম আমাদের নিয়ে চলল। দু-তিনটে হোটেল দেখাল। প্রথমটা খুব নোংরা। দ্বিতীয়টা ছোটো বলেই চার-পাঁচজন বোর্ডারের বেশি জায়গা দিতে পারে না। বলল, এঁরা আগেই ‘বুক’ করে এসেছেন।

এইটুকু শুনেই হতাশ হয়ে বিরূপাক্ষদা বলে উঠলেন, তাহলে কি পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে–

শান্তনু ধমক দিয়ে বলল, অল্পেতেই এত হতাশ হয়ে পড়েন কেন? চেষ্টা তো করা হচ্ছে। ছোট্ট জায়গা। কটাই বা হোটেল থাকতে পারে?

তারপর শান্তনু বিক্রমকে বলল, যা হোক কোনো ব্যবস্থা তো তোমাকেই করতে হবে।

বিক্রম নিরুপায় হয়ে এদিক-ওদিক তাকাল। বাসের একজন খালাসিকে দেখতে পেয়ে ডাকল। পরিচিত লোক। বিক্রম তাকে আড়ালে অবস্থা বুঝিয়ে বলল, একটা থাকার ব্যবস্থা কি করা যায় বলো তো!

লোকটা চিন্তা করে বলল, হোটেল আর নেই। তবে ‘সুইট হোমে’ একবার চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।

শান্তনু উৎসাহিত হয়ে বলল, তাই চলুন।

বিক্রম একটু চিন্তা করে বলল, ওটা কোনো হোটেল নয়। প্রাইভেট বাড়ি। পেয়িং গেস্ট হিসেবে যতদিন খুশি থাকতে পারেন।

তা খারাপ কী? চার্জ কি খুব বেশি?

না, মডারেট। কিন্তু মালিক একজন চিনা মহিলা।

চিনেম্যান!–দাঁত খিঁচিয়ে উঠলেন বিরূপাক্ষদা।

বললাম, ‘চিনেম্যান’ নয় বিরূপদা, ‘চিনা ওম্যান’।

ও-ই হল। কিন্তু চিনে খানা–মানে–আরশোলা, টিকটিকি খেতে পারব না। একটা চৌকি আর লেপ কি মিলবে?

খাবার কথাটা শুনে বিক্রম আর তার সঙ্গী দুজনেই হাসল।

শান্তনু বলল, আরশোলা, ব্যাঙ, সাপ খেতে হবে না। হাতরুটি আর তরকারি পাওয়া যাবে তো, বিক্রম?

অনেক। বুঝিয়ে দিল বিক্রম। সঙ্গে মাংস।

কীসের মাংস ভাই? আতংকিত বিরূপাক্ষদা ঝুঁকে পড়ে জিগ্যেস করলেন।

যে মাংস খেতে চাইবেন। দরকার হলে রেস্তোরাঁ থেকে আনিয়ে দেবে।

তবে চলল। এখন কিছু খেতে হবে। তারপর লেপমুড়ির ব্যবস্থা। হাত দুটো জমে গেছে।

কিন্তু বিক্রম যেন কিছু চিন্তা করছে।

এনি প্রবলেম? আর কোনো সমস্যা?

জায়গাটা কিন্তু একটু দূরে। আর–

মুখ শুকিয়ে গেল আমাদের। যদি বা আশ্রয়ের একটা সন্ধান পাওয়া গেল তাও দূরে। আর এই অবেলায়!

তবু কতদূরে?

বিক্রম মনে মনে হিসেব করে বলল, তা দু কিলোমিটার তো বটেই। ঐ যে পাহাড়টা দেখছেন ওর ঢালের মুখে। জায়গাটা অবশ্য খুবই ভালো লাগবে আপনাদের। খুব কাম অ্যান্ড কোয়ায়েট।

বুঝতে পেরেছি। অর্থাৎ নির্জন–জনমানবশূন্য–

ভয়ংকর। বলে উঠলেন বিরক্ত বিরূপাক্ষদা। ‘কিন্তু আর’–বলে কী বলতে যাচ্ছিলে, ভাই বিক্রম?

না, কিছু নয়। দাঁড়ান, গাড়িটা আনি–বলে চলে গেল।

সুইট হোমের সামনে গিয়ে যখন বিক্রম গাড়ি দাঁড় করাল তখন পশ্চিম দিকের আড়ালে সূর্য নেমে গেছে। পাহাড়গুলোর চুড়ো যেন অস্তসূর্যের রাঙা আলোয় ঝলমল করছে।

কোথায় তোমার সেই চিনে গেস্ট হাউস? জিগ্যেস করল শান্তনু!

বিক্রম হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, ঐ যে সাইনবোর্ড।

তাকিয়ে দেখলাম সাইনবোর্ডে ইংরিজিতে লেখা ‘SWEET HOME’। তার নীচে অপেক্ষাকৃত ছোটো অক্ষরে ইংরিজিতে লেখা–পোর–জোঅ্যান্ড–চিয়াং।

বললাম, একজন চিনা মহিলার প্রাইভেট হোটেলের ইংরিজি নাম!

শান্তনু বলল, বুদ্ধিমতীর পরিচয়। এখানে চিনা ভাষা কে কত বুঝবে? তাই অতিথিশালার নাম দিয়েছে ইংরিজিতে। আর এ অতিথিশালা তো গতানুগতিক নয়, অন্যস্বাদের খাবার পাওয়া যাওয়া সম্ভব সেটা বোঝাবার জন্য প্রোপাইটার নিজের চিনা পরিচয়টুকুও প্রচার করে দিয়েছে।

বিরূপাক্ষদা তাড়া দিলেন, ঠান্ডায় মরে গেলাম। চলো চলো ভেতরে চলো।

বিক্রম জিগ্যেস করল, তাহলে কাল কখন আসব? কালই তো ফিরবেন?

শান্তনু বলল, একটু দাঁড়াও। আগে থাকার ব্যবস্থা করি।

চলে আসছিলাম–বিক্রম থামিয়ে দিয়ে চাপা গলায় বলল, অচেনা জায়গা তো। রাতে ঘর থেকে না বেরোনোই ভালো। বলেই গাড়িতে গিয়ে উঠল।

‘হোম’টি লম্বা একতলা। সামনে অনেকখানি জায়গা ঘিরে কম্পাউন্ড। কম্পাউন্ডের মাঝখানে পানপাতা আকারে সিমেন্টে বাঁধানো একটু বসার জায়গা। সামনেই অফিস ঘর। তার দু’পাশে টানা বারান্দা। বারান্দার ধারে ধারে কয়েকটি ঘর। বোঝাই যাচ্ছে এগুলিতে বোৰ্ডাররা থাকে।

অফিস ঘরের মেঝেটা কাঠের। কার্পেট বিছানো। ঘরটা মাঝারি সাইজের। আসবাবগুলো খুবই পুরোনো আমলের। কাজেই দামি। ঐরকম কাঠ এখন সচরাচর দেখা যায় না। টেবিলে রয়েছে পোর্টেবেল টাইপ মেশিন, একটা টেলিফোন। আর একটা পাথরের কালভৈরবের ভয়ংকর মূর্তি। মহিলাটির অল্প দূরে অপেক্ষাকৃত ছোটো একটা টেবিল যেন আগলে বসে আছে এক বৃদ্ধ চিনা। তার মাথায় টুপি, গায়ে কালো কোট, থুতনিতে পাকা দাড়ি। বাদামের মতো দুটো চোখে নির্জীব দৃষ্টি। টেবিলে একটুকরো কাচের ফলকে লেখা RECEPTION। পাশেই পর্দা ফেলা একটা ছোটো ঘর থেকে শোনা যাচ্ছে টাইপরাইটারের টকটক শব্দ।

বিশাল অর্ধবৃত্তাকার একটা টেবিলের সামনে বসে আছেন একজন সুন্দরী চিনা মহিলা। হলদেটে রঙ, সাদা ব্লাউজ গায়ে, নীচে নীল রঙের চাপা স্কার্ট। চকচকে কালো চুলে একটা বিনুনি। মহিলাটি একমনে নখে রঙ মাখাচ্ছিলেন, হঠাৎ অনেকগুলো জুতোর শব্দ শুনে উঠে দাঁড়ালেন। আমাদের ক্লান্ত মুখ, ধকল-সওয়া জামা-প্যান্টের অবস্থা আর পিঠে ঝোলানো স্যাক দেখে অনুমান করে নিলেন আমরা কী জন্য এখানে এসেছি।

নমস্তে, ওয়েলকাম বলে হেসে হাত জোড় করে নমস্কার করে অভ্যর্থনা করলেন। টেবিলের সামনেই খানকতক গদি-মোড়া চেয়ার ছিল। তাতেই বসলাম।

From Kolkata?

Yes.

সঙ্গে সঙ্গে চিনা মহিলা হেসে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললেন, বাংলাতেই বলুন, মহাশয়েরা। আমি কুছ কুছ বাংলা বুঝি।

বাংলা বোঝেন জেনে আমরা স্বস্তি পেলাম। বললাম, ধন্যবাদ। শান্তনু প্রথমেই বলল, রুম পাওয়া যাবে তো?

Oh! Yes!

বিরূপাক্ষদা তবু ইংরিজিতেই (সম্ভবত তিনি ইংরিজি বলতে পারেন জানাবার জন্যেই) Toyota, May we have each a cup of coffee? Hot coffee!

Oh sure! কিন্তু এখানেই খাবেন, না আপনাদের ঘরে গিয়ে আরামসে–হেসেই উত্তর দিলেন মহিলাটি। এবার হাসবার সময়ে তার একটি সোনা বাঁধানো দাঁত দেখা গেল।

ফাস্ট রাউন্ডটা এখানেই হয়ে যাক।-উৎসাহে বলে উঠলেন বিরূপাক্ষদা।

O.K.বলে মহিলাটি সেই বৃদ্ধকে ডেকে তিন কাপ কফি দেবার কথা বলে দিলেন।

কফি খাওয়া হয়ে গেলে চিনা মহিলা টেবিলে লাগানো অদৃশ্য কোনো বোতাম টিপলেন বোধ হয়। দু’মিনিটের মধ্যে একজন ভৃত্য গোছের লোক ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। পরনে চেক চেক লুঙ্গি। গায়ে ভেড়ার লোমের ময়লা সোয়েটার। কণ্ঠনালীটা বেজায় উঁচু। যেন গলার চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

মহিলাটি হিন্দিতে বললেন, ইস্কাইন, এঁরা তিনজন থাকবেন। স্পেশাল কোন ঘরটা দেবে?

চার।

ঠিক আছে বলে মহিলা ড্রয়ার থেকে এক থোকা চাবি বের করে দিলেন।

ইস্কাইন খালি কাপ তিনটে ট্রেতে তুলে নিল। মহিলাটি ইশারায় আমাদের ওর সঙ্গে যেতে বললেন।

এক নজরেই ঘর পছন্দ হয়ে গেল আমাদের। নিতান্ত ছোটো ঘর নয়। পাশাপাশি তিনটে বেড। তাছাড়াও আর একটা উল্টো দিকে। ঘরটা বেশ গরম। পায়ের কাছে ফর্সা ওয়াড় পরানো পুরু লেপ। লাগাও বাথরুম। বেসিনে সব সময় জল, গরম জলের ব্যবস্থা আছে। বড়ো কথা–ঘরটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বিরূপাক্ষদা জানলার ধারটা বাদ দিয়ে অন্য দিকে শুলেন। শার্সি লাগানো সব জানলাই শীতের দাপটের জন্য বন্ধ।

থাকার ব্যবস্থা করে আমরা বিক্রমকে জানিয়ে দিলাম। কালই যাব কিনা সকালে জানিয়ে দেওয়া হবে।

রাতের খাওয়াও মন্দ হল না। লুচি আর মুরগির মাংস। তবে অনেক উৎসাহ নিয়ে খেতে বসলেও বিরূপাক্ষদা ভালো করে খেতে পারলেন না। বললেন, মাথাটা বেজায় ধরে আছে। বলে কপাল টিপে ধরলেন।

বললাম, এবার আপাদমস্তক লেপমুড়ি দিয়ে একটা টানা ঘুম লাগান।

কাল তো আবার কোথায় যেন যেতে হবে। চার মাইল পথ?

শান্তনু বলল, কালই যেতে হবে তার কোনো মানে নেই। একদিন এখানে রেস্ট নিয়ে—

ঠিক আছে। তোমরাও এখন শুয়ে পড়বে?

না, ম্যানেজার মহিলা যদি থাকেন তাহলে খাতা-পত্রে সই-সাবুদগুলো সেরে নেব।

বলে আলো নিভিয়ে বেরোতে যাচ্ছি, উনি হাঁ হাঁ করে উঠলেন–আলো জ্বালা থাক।

ঘরের আলো জ্বেলে রেখেই আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। মনটা বেশ ফুরফুরে। সারাদিন শরীর আরে মনের ওপর দিয়ে ধকল গেছে। এখন নিশ্চিত একটা ডেরা পেয়ে। যেন হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছি। কিন্তু হঠাৎ পা দুটো যেন আটকে গেল।

ওটা কী? ঐ যে—

শান্তনু আমার হাতটা চেপে ধরে গতি রূদ্ধ করে দিল।

প্যাসেজের বাম্বটা বোধ করি ফিউজ হয়ে গেছে। তাই অন্ধকার। তবু অফিস ঘরে যে আলো জ্বলছিল ওরই কিছুটা এসে পড়েছিল বারান্দার একদিকে। একটা ছোট্ট বাঁক ফিরলেই অফিস ঘর। আমরা নিশ্চিন্তেই এগোচ্ছিলাম হঠাৎ কুকুরের চেয়ে আকারে কিছু ছোটো কোনো জন্তু চক্ষের নিমেষে ছুটে পাঁচিল টপকে পিছনের ঝোপ-জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেল।

কী ওটা?

শান্তনু বলল, বুঝতে পারলাম না। তবে কুকুর নয়, ভাম বা খটাসও নয়, বনবেড়ালও নয়–

আমরা অফিস ঘরে গিয়ে দেখলাম মহিলাটি একটা খাতায় যেন কী লিখছেন। সামনে বসে আছে সেই বৃদ্ধ চিনাটি। বোধহয় সেদিনের হিসেব বুঝিয়ে দিচ্ছে।

আমাদের দেখেই মহিলাটি হেসে অভ্যর্থনা করলেন, আসুন। খাওয়া হল?

বললাম, হ্যাঁ। ভালোই।

আপনাদের সিনিয়ার পার্টনারটি কি শুয়ে পড়েছেন? খাওয়ার কোনো অসুবিধা–

না, তবে বয়েস হয়েছে তো, ক্লান্তি—

আপনারা কি কালকেই বার্সে চলে যাচ্ছেন?

দেখি! ভাবছি একটা গোটা দিন যদি হিলেই কাটানো যায়—

সেটাই ভালো।

বৃদ্ধ চিনা কী একটা রেজিস্টার নিয়ে এসে দাঁড়াল।

মহিলাটি বললেন, এঁরা কাল থাকবেন। সকালে করলেই হবে।

বৃদ্ধটি চুপচাপ গিয়ে নিজের চেয়ারে বসল।

মহিলাটি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন, ওয়ন, আপনি যেতে পারেন।

ওয়ন তখনই খাতাপত্র তুলে রেখে মহিলাটিকে অভিবাদন করে বেরিয়ে গেল।

এবার মহিলাটি আমাদের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। যেন জানতে চাইলেন আমরাও এখন শুতে যাব কিনা।

আন্দাজে প্রশ্নটা ধরে নিয়ে উল্টে আমরাই জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি সাধারণত কতক্ষণ অফিস ঘরে থাকেন?

উনি বললেন, যতক্ষণ না বোর্ডাররা সবাই খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়ছেন ততক্ষণ থাকি।

একটু থেমে নিজেই বললেন, ক’জনই বা বোর্ডার! এগারোটার মধ্যেই হোম নিস্তব্ধ হয়ে যায়।

আপনার এখানে বোর্ডার বেশি নেই বোধহয়।

ঠিকই বলেছেন। আসলে যতই যত্ন-আত্তি করি, ভালো খাওয়াই, হিলের বাজার থেকে অনেকটা দূরে বলে লোক আসতে চায় না। আবার কখনও কখনও বেশ ভিড় হয়।

আপনি এখানেই থাকেন তো?

হ্যাঁ, এটাই আমার ঘরবাড়ি। আমার মাতামহই সেই কবে নানা জায়গা ঘুরে বহু বিপদ মাথায় নিয়ে হংকং থেকে এখানে আসেন। এই জায়গাটাকেই খুব নিরাপদ মনে করেছিলেন।

শান্তনু বিনীতভাবে বলল, কিছু যদি মনে করেন তাহলে জিগ্যেস করি বিপদটা কী ধরনের!

উনি একটু চুপ করে থেকে বললেন, অনেক কিছুই আমার জানা নেই। কারণ, তখন আমি নিতান্তই শিশু। পরেও বাবা-মা আমাকে সব ঘটনা বলত না। তবু যতদূর মনে আছে সে সময়ে রেড চায়না থেকে অনেককেই পালিয়ে যেতে হচ্ছিল। আমরাও সে দলে ছিলাম। কখনও পাহাড়-জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, কখনও বোটে করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। আমার দাদু ছিলেন খুব স্ট্রং, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। বিপদে ঘাবড়ে যেতেন না। বাবা জোয়ান হয়েও যা পারত না, দাদু বুড়ো হয়েও তাই করে ফেলতেন।

একটু থেমে বললেন, একদিনের কথা আমার মনে আছে। বিদেশি পুলিশ আমাদের পুরো দলকে তাড়া করেছে। ঠিক কী কারণে রেড চায়না থেকে আমাদের পালাতে হয়েছিল জানি না, কেন পুলিশ তাড়া করেছিল তাও আজ পর্যন্ত জানি না। এইটুকু শুধু জানি অন্যদের মতো আমাদেরও কোনো সরকারি কাগজপত্র বা পরিচয়পত্র ছিল না। শেষে সেবার আমরা নৌকা নিয়ে ঐ অঞ্চলের জেলেদের নৌকোর মধ্যে ভিড়ে গিয়েছিলাম। মনে আছে আমাদের নৌকোর ছইটা ছিল ফুটো। বৃষ্টি পড়ছিল। টপটপ করে গায়ে জল পড়ছিল। শীতে খুব কাঁপছিলাম। মা একটা লাল রঙের টুপি মাথায় পরিয়ে দিয়েছিল।

মহিলাটি একটু থামলেন।

শান্তনু জিগ্যেস করল, তারপর?

তারপর অনেক ঘুরে, অনেক বাধা কাটিয়ে আমরা হংকং-এ একটা উদ্বাস্তু কলোনিতে এসে পৌঁছালাম। ভেবেছিলাম এখন নিশ্চিন্ত। কিন্তু তা হল না। একজন বিদেশী পুলিশ অফিসার দাদুর কাছ থেকে মোটা ডলার ঘুষ খেয়েও পেছনে লেগেছিল–আরও টাকা দিতে হবে। যেখানেই পালাই সেখানেই দুশমন হাজির।

সেই বিদেশী পুলিশটা খুবই নিষ্ঠুর ছিল। দাদুর ভালোমানুষির সুযোগ নিয়ে যখন-তখন পিছু পিছু ধাওয়া করে আসত। তার সঙ্গে থাকত একটি ভয়ংকর কুকুর। কখনও থাকত পোষা ওরাং ওটাং জাতীয় বিদেশী হিংস্র পশু। আমাদের পিছনে লেলিয়ে দিত।

তখন বাধ্য হয়ে দাদুকে অন্য ব্যবস্থা করতে হল। সেদিন সন্ধে থেকে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি পড়ছিল। দাদু পুলিশ অফিসারকে ডেকে আনলেন একটা নির্জন বারে কী কী শর্তে আরও ডলার দেবেন তাই নিয়ে আলোচনা করার জন্যে। তারপর গোপনে মদের গেলাসে বিষ মিশিয়ে মেরে দিয়ে পালিয়ে এলেন। সেদিনের তারিখ আর বার SATURDAY!

এই পর্যন্ত বলে মহিলাটি একটু থামলেন। তারপর বলতে লাগলেন, অনেক খুঁজে শেষ পর্যন্ত এই হিলেতেই পাকাপাকিভাবে আশ্রয় নেন দাদু। কিন্তু তবু

তবু কী?

এখানেও সেই পুলিশটি—

মানে? সে তো তখন মৃত!

পরে বলব।

শান্তনু বলল, ম্যাডাম, আপনি কি এখুনি উঠবেন?

হাসলেন মহিলাটি। বললেন, কেন? গল্প করবেন?

শান্তনু বলল, কিছু জানবার ছিল। যা আমাদের জ্ঞানের বাইরে।

বাবা! আপনাদের জ্ঞানের বাইরে! তা আমার মতো সামান্য একটা হোটেল-গার্লের পক্ষে—

যতটুকু পারেন।

বেশ। কী জানতে চান বলুন।

প্রথমেই জানতে চাই আপনার নাম। টাইটেল। নইলে কথা বলার অসুবিধে হবে।

আমার নাম! উনি একটু অবাক হয়ে তাকালেন। জানেন না? তারপর ড্রয়ার থেকে একটা কার্ড বের করে দিলেন। তাতে লেখা ‘SWEET HOME’। নীচে প্রোপাইটারের নাম ছাপা।

তাই তো! এই নামই তো বাইরের সাইনবোর্ডে জুলজুল করছে।

ধন্যবাদ মিস চিয়াং। আপনার নামটা আগেই আমাদের মনে করা উচিত ছিল।

উত্তরে চিয়াং হাসলেন একটু।

বলুন, এবার কী জানতে চান?

তার আগে কি আমরা শুনে নেব আপনার দাদুর বাকি কথা?

মিস চিয়াং বললেন, সেটা পরে বলব। আপনিই শুরু করুন মিস্টার রায়। আপনার কি ঘুম পাচ্ছে?

না না, আমি যখন চোখ বুজিয়ে থাকি তখন জানবেন আমি কিছু ভাবছি।

তাই নাকি? বাঃ! বেশ তো! তাহলে কী ভাবছেন বলুন। যদি দুর্ভাবনা হয় তাহলে ফয়সলা করবার চেষ্টা করব। বলে তাকালেন আমার দিকে।

বললাম, পৃথিবীর এমন কি কোথাও কোনো হোটেল, বোর্ডিং বা গেস্ট হাউস আছে যেখানে কোনো একজন বোর্ডারেরও সাড়া পাওয়া যায় না?

লক্ষ করলাম মিস চিয়াং-এর মুখটা যেন শুকিয়ে গেল।

আপনি কি আমার এই ‘হোমের’ কথা বলছেন?

ঠিক তাই।

মিস চিয়াং দুঃখমাখা গলায় বললেন, সে তো আমি আগেই বলেছি যতই যত্ন করি না কেন বাজার থেকে দূরে বলেই এখানে লোক আসে না। কিন্তু কী করব? ইচ্ছে করলেই তো নিজেদের বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে পারি না। এই ‘হোম’ আমার দাদুর তৈরি। এর প্রতিটি পাথরে দাদুর স্মৃতি জড়িয়ে।

বললাম, সেটা বুঝি। কিন্তু বোর্ডার যেখানে নেই বললেই হয় সেখানে খরচ চালান কী করে? আপনার কর্মচারীদের মাইনেও দিতে হয়–তা যত কমই হোক।

মিস চিয়াং মাথা নিচু করে রইলেন। দেখে মায়া হল।

এখন ক’জন বোর্ডার আছে? আমাদের বাদ দিয়ে?

মিস চিয়াং নিঃশব্দে মাথা নাড়লেন। যার অর্থ একটিও না। তৎক্ষণাৎ বললাম, আমার মনে হচ্ছে আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।

মিস চিয়াং অবাক হয়ে তাকালেন।

আমি নিশ্চিত যে, একটু আগে পর্যন্ত আরো কেউ ছিল।

কী বলছেন মিঃ রায়?

ঠিকই বলছি, আমি নিজে কানে কারো পায়ের শব্দ শুনেছি।

পায়ের শব্দ।

হ্যাঁ।

কোথায়?

আমাদের পাশের ঘরে।

তাহলে আরও বলি মিস চিয়াং, একটু আগে যখন আপনার অফিস ঘরে আসছিলাম তখন হঠাৎ দেখলাম কুকুরের চেয়ে ছোটো আকারের নেকড়ে জাতীয় কোনো জন্তু ছুটে ওদিকের পাঁচিলে উঠে পাহাড়ের দিকে মিলিয়ে গেল।

একথা শুনেই মিস চিয়াং চঞ্চল হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। কিছু যেন বলতে চাইলেন। কিন্তু বলতে পারলেন না। উদ্ভ্রান্তের মতো একবার এদিক-ওদিক তাকালেন। তারপর ক্ষমা চেয়ে বললেন, আমি আর বসতে পারব না। বলে উঠে দাঁড়ালেন।

ঠিক আছে। বলে আমরাও উঠে পড়লাম।

চলুন, আপনাদের রুমে পৌঁছে দিই।

তার দরকার হবে না।

কিন্তু কথাটা তার কানে গেল না। তিনি আমাদের উদ্দেশ করে বললেন–আসুন আমার সঙ্গে। বলে ড্রয়ার থেকে কতকগুলো চাবি নিয়ে এগিয়ে চললেন। চার নম্বর ঘরের সামনে এসে বললেন, এটাই তো আপনাদের রুম?

হ্যাঁ, ম্যাডাম।

ভেতরটা একবার দেখে আসবেন?

দেখবার কিছু ছিল না। বিরূপাক্ষদা নিশ্চিন্তে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছেন।

ম্যাডাম আমাকে বললেন, আপনি কোন ঘরে পায়ের শব্দ পেয়েছিলেন?

আমি হাত দিয়ে পাশের ঘরটা দেখিয়ে দিলাম। ঘরটা তালাবন্ধ ছিল। উনি নিজেই তালা খুললেন। নিজেই সবার আগে ঢুকে গেলেন অন্ধকার ঘরে। সুইচ টিপলেন। আলো জ্বলল। বললেন, দেখুন ভালো করে।

দুজনেই দেখলাম। কেউ কোথাও নেই।

তাহলে সত্যিই এদিকে আপনারা তিনজন ছাড়া আর কেউ নেই। তাই তো?

খুব জোরের সঙ্গে মিস চিয়াং নিজের কথাটা যে ঠিক তা বোঝাবার চেষ্টা করলেন বটে কিন্তু গলায় যেন তেমন জোর ছিল না।

.

০৪.

ভালোভাবেই রাতটা কেটে গেল। ভোরবেলা প্রথমেই ঘুম ভাঙল আমার। নতুন জায়গা বলে প্রথমটা ঠিক ঠাহর করতে পারিনি কোথায় আছি। একটু পরেই সব মনে পড়ল। তাড়াতাড়ি উঠে পড়লাম। তখনও শান্তনু ঘুমোচ্ছে। আর লেপের ওপর দু’খানা কম্বল চাপিয়ে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছেন বিরূপাক্ষদা।

পুরু সোয়েটারের ওপর একটা গরম চাদর জড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

তখন ভোরের আলো সবে ফুটে উঠছে। বাড়ির পিছনেই পাহাড়টা। কাল সন্ধেবেলায় ভালো বোঝা যায়নি। আজ দেখে রীতিমতো ভয় করল। পাহাড়টা যেন কেমন অস্বাভাবিকভাবে ঝুঁকে আছে মিস চিয়াং-এর হোটেলের ওপর। কুচকুচে কালো পাথর। আর আশ্চর্য, পাহাড়ের গায়ে গাছপালার চিহ্নমাত্র নেই। বলা যেতে পারে ন্যাড়া পাহাড়। আর সেই পাহাড়ের পিছনেই ঘন অরণ্য। রহস্যঘেরা।

এবার একটু ঘুরে দাঁড়াতেই অবাক হয়ে গেলাম। দেখলাম হোটেলের গায়েই অজস্র লাল ফুলের সমারোহ। এত লাল ফুল! রডোড্রেনড্রন নয় তো? তাহলে তো ভালোই!

শান্তনুকে দেখাবার জন্যে ডাকতে যাব ভাবছি, দেখি শান্তনু ঘুমচোখে এসে দাঁড়িয়েছে, লাল ফুল দেখে সেও চমৎকৃত। বলল, আমারও মনে হচ্ছে এটাই প্রকৃত রডোড্রেনড্রন! তারপর হঠাৎ জিগ্যেস করল, কাল যে মিস চিয়াংকে বললে পায়ের শব্দ শুনেছিলে সেটা সত্যি?

অবাক হয়ে বললাম, কী বলছ তুমি! মিথ্যে বলতে যাব কোন দুঃখে?

শান্তনু আমতা আমতা করে বলল, আয়্যাম স্যরি। আসলে, কাল অনেক রাত পর্যন্ত ভেবেছি। বিশ্বাস করতে পারিনি। লোক নেই, জন নেই তবু পায়ের শব্দ! আচ্ছা সে কি হেঁটে বেড়াচ্ছিল?

ঠিক যে বেড়াচ্ছিল তা নয়। তুমি যখন অফিস ঘরে মিস চিয়াং-এর সঙ্গে গল্প করছিলে তখন একটু বিশেষ দরকারে আমি আমাদের রুমে ফিরে এসেছিলাম। দরজা ঠেসানো ছিল। ঘরে আলো তো জ্বালাই ছিল। বিরূপাক্ষদা নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। হঠাৎ মনে হল পাশের ঘরে কেউ যেন আছে। তারপরেই শুনলাম তার পায়ের শব্দ।

শব্দটা কীরকম?

ভারী থপথপে পা ফেলে কেউ যেন ঘর থেকে বেরোবার চেষ্টা করছে। মোটেই স্বাভাবিক মানুষের মতো স্টেপ ফেলা নয়। অনেকটা খোঁড়া মানুষের মতো পা ঘষটে হাঁটা।

সে কি ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল?

সেইরকমই মনে হল। পায়ের শব্দটা ঘর থেকে বেরিয়ে ঐ পাঁচিলের দিকে গেল।

অর্থাৎ পাহাড়ের দিকে?

তাই হবে। তারপরেই মিলিয়ে গেল।

শান্তনু জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। মুখে বলল, হুঁ। বুঝলাম।

এমনি সময়ে হাসিমুখে ঢুকলেন মিস চিয়াং।

গুড মর্নিং!

গুড মর্নিং–গুড মর্নিং! বলে আমরা দুজনেই সানন্দে অভ্যর্থনা জানালাম তাঁকে।

কেমন ঘুম হল নতুন জায়গায়?

বললাম, ফাইন। চমৎকার।

কিন্তু আপনাদের সিনিয়ার ফ্রেন্ড তো এখনও ঘুমোচ্ছে। শরীর ভালো তো?

না-না, মোটেই ভালো নয়। বলে বিরূপদা চোখ বুজিয়েই পাশ ফিরলেন।

কী হল আপনার? বলে মিস চিয়াং ঝুঁকে পড়লেন।

বিরূপাক্ষদা কোনোরকমে বললেন, জ্বর। পাহাড়ে জ্বর। এবার বোধহয় এই বিদেশ-বিভুঁয়ে প্রাণটাই রেখে যেতে হবে।

মিস চিয়াং নিঃসংকোচে বিরূপদার কপালে হাত রেখে জ্বর কতটা বুঝে নিলেন। মুখে বললেন, কোনো ভয় নেই। আমাদের জানা ডাক্তার আছে। ডাকলেই চলে আসবে। এখন একটু চা খাবেন?

না পরে। বলে পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।

মিস চিয়াং বললেন, ওঁকে ঘুমোতে দিন। চলুন, আমার অফিস ঘরে। ওখানেই ব্রেকফাস্ট সারা যাক।

আমরা জিনজনেই ব্রেড, বাটার, এগ পোচ আর গরম কফি নিয়ে বসলাম। কাল যে মহিলাটিকে দেখেছিলাম আজ মনে হচ্ছে ইনি যেন তিনি নন। আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কাল রাত্তিরে তাঁর মুখের ভাবের যে পরিবর্তন ঘটেছিল, যে দুশ্চিন্তার ছাপ তার মুখে কাল ছায়া ফেলেছিল, আজ সকালে তার আর বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। একেবারেই স্বাভাবিক।

মিস চিয়াং কথা শুরু করলেন এইভাবে মিস্টার রায়, কাল রাত্তিরে বলছিলেন কার পায়ের শব্দ শুনেছিলেন, সারা রাতের মধ্যে আর কি কোনো শব্দ–

না না, তেমন কিছু নয়। আমি লজ্জিত হয়ে বললাম।

তাহলে ভুল শুনেছিলেন স্বীকার করছেন তো?

হ্যাঁ, তা করছি।

যাক, নিশ্চিন্ত হলাম।

শান্তনু মিস চিয়াং-এর দৃষ্টি এড়িয়ে কটমট করে আমার দিকে তাকাল। আমি হেসে চোখ টিপে বুঝিয়ে দিলাম যা আমি শুনেছি তা ভুল কখনই নয়।

মিস চিয়াং আরও কী বলতে যাচ্ছিলেন, দরজায় জুতোর শব্দ শুনে তাকালেন।

কাকে চাই?

আগন্তুক ইশারায় আমাদের দেখিয়ে দিল। আমাদের উদ্দেশে বিক্রম সেলাম করল। বুঝলাম আজ আমরা শিলিগুড়ি ফিরব কিনা জানতে এসেছে।

শান্তনু বলল, বিক্রম, আজ আর ফেরা যাবে না। দাদাজির তবিয়ত খারাপ।

তবে কাল?

মিস চিয়াং আধা হিন্দি আধা চিনা ভাষায় বললেন, সন্ধেবেলা এসো। তখন জানিয়ে দেওয়া হবে।

বিক্রম ফের সেলাম করে চলে গেল। মনে হল আজ যেতে হবে না বলে যেন খুশিই হয়েছে। এখানে অনেকে তার জানাশোনা আছে। তাছাড়া একদিন থেকে যাওয়া মানেই ভালো টাকা লাভ।

বিক্রম চলে গেলে আমিই প্রথম কথা বললাম।

আপনার হোটেলের পিছনে বিস্তর লাল ফুল দেখলাম। এগুলো কি রডোড্রেনড্রন?

খুশিতে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল মিস চিয়াং-এর। বললেন–একেবারে আসল রডোড্রেনড্রন। রঙটা লক্ষ করলেন?

করেছি বৈকি!

শান্তনু বলল, এখানেই যখন আসল রডোড্রেনড্রনের দর্শন লাভ হয়েই গেল তখন আর বার্সে গিয়ে কী লাভ?

মিস চিয়াং বললেন, যদি শুধু ফুল দেখতে যাওয়াই উদ্দেশ্য হয় তাহলে ওখানে গিয়ে আর লাভ নেই।

তাহলে তো কালকেই আমরা এখান থেকে ব্যাক করতে পারি।

তা পারেন। অবশ্য কাল আপনাদের সিনিয়ার পার্টনারের শরীর কেমন থাকে তার ওপরই আপনাদের যাওয়া নির্ভর করছে। আর এককাপ করে চা হবে নাকি?

শান্তনু বলল, একটু পরে।

তাহলে এখন বলুন কাল কী কথা জানতে চাইছিলেন। আমার যদি উত্তর ঠিক জানা থাকে তাহলে সবই বলব।

শান্তনু বলল, দেখুন রহস্যটা গোড়া থেকেই। আর টানা অনেকক্ষণ ছিল।

মিস চিয়াং বললেন, আর একটু পরিষ্কার করে যদি বলেন। আপনারা কি কোনো অলৌকিক ব্যাপারের অভিজ্ঞতা বলতে চাইছেন?

বললাম, এক কথায় তা বলে বোঝানো যাবে না। দেখুন পাহাড়ে বেড়াতে ভালোবাসি বলেই আমি আর শান্তনু বেরিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ এসে জুটলেন বিরূপাক্ষদা–যাঁকে আপনি বলেন আমাদের সিনিয়ার পার্টনার।

মিস চিয়াং হাসলেন একটু–তারপর?

বিরূপাক্ষদা আমাদের চেয়ে বয়েসে অনেক বড়ো। ভ্রমণের নেশার কাছে উনি বয়েসকে পাত্তা দিতে চান না। তাই সহজেই মিশে আছেন আমাদের সঙ্গে।

তবে ফুল-টুলের মর্ম বুঝতে চান না। সামান্য ফুল দেখার জন্য শিলিগুড়ি থেকে পাহাড় ডিঙিয়ে সিকিমের বার্সে যাওয়াটা তার ভালো লাগেনি। তার মতে এটা পাগলামো।

মিস চিয়াং একটু হাসলেন। তারপর বললেন, রহস্যটা শুরু কোথা থেকে হল?

রহস্য শুরু হল শিলিগুড়ি থেকেই। কোনো ড্রাইভারই হিলের পথে যেতে রাজি হয় না। বিশেষ বারটা যখন শনিবার।

দেখলাম মিস চিয়াং কিছু নোট করলেন।

বললাম, আমাদের প্রথম প্রশ্ন–শনিবারে যেতে এত আপত্তি কীসের?

একটু থেমে বললাম, যাই হোক, অনেক বুঝিয়ে-সুজিয়ে, বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে ঐ ড্রাইভারটিকে রাজি করানো হল। কিন্তু কিছুদূর যাবার পরই শুরু হল ড্রাইভারের ছটফটানি। ভয় পেতে লাগল। কীসের যেন আতংক।

এটা কোনখান থেকে?

আমার হয়ে শান্তনুই উত্তর দিল, জায়গাটার নাম জোরথাং। রংগীত নদীর কাছে।

একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। বিক্রম হিলে যেতে রাজি হলেও এই পথ দিয়ে কিছুতেই আসবে না। আমাদেরও জেদ এই পথ দিয়েই যেতে হবে। শেষে রাজি হল বটে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না এলেই ভালো হত।

মিস চিয়াং টুকটুক করে কিছু নোট করে নিয়ে সকৌতূহলে জিগ্যেস করলেন, তারপর?

তারপরের ঘটনাগুলো (হিলে পৌঁছবার আগে পর্যন্ত) সব আমরা বলে গেলাম। উনি নোট করে নিলেন।

তার মানে আপনারা বলতে চাইছেন মেঘ ডাকা, বৃষ্টি পড়ার সঙ্গে ঐ কালো সুটপরা ওয়াটারপ্রুফ গায়ে লোকটির একটা সম্পর্ক আছে।

হ্যাঁ অবশ্যই।

তবে সবচেয়ে অবাক হচ্ছি যখন রাস্তার একদিকে পাহাড় থেকে দলে দলে নেকড়ের বাচ্চাগুলো নেমে অন্যদিকের পাহাড়ে গিয়ে উঠল। এত নেকড়ে দেখা যায়?

মিস চিয়াং একটু হাসলেন। বললেন, ওগুলো নেকড়ের বাচ্চা নয়।

তাহলে? অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম।

কিছুই না। চোখের ভ্রম। দুর্গম পাহাড়ে এইরকম চোখের ভুল হয়। খুবই বিপজ্জনক। এইভাবেই পাহাড়ের অশুভ শক্তি অসহায় মানুষকে সর্বনাশের মুখে ঠেলে দেয়। খুব বেঁচে গেছেন।

না হয় তর্কের খাতিরে মেনেই নিলাম চোখের ভুল। কিন্তু কাল সন্ধেবেলাতেই আপনার এই হোটেলে যে জীবটিকে মুহূর্তের জন্য দেখা গিয়েছিল সেটাও কি চোখের ভ্রম? এ তো আর পাহাড় নয়। আপনার সাজানো-গোছানো ‘হোম’!

মিস চিয়াং এবার চট করে উত্তর দিতে পারলেন না। মুখটার ওপর একটা ছায়া নেমে এল। একটু চুপ করে থেকে বললেন, বুঝতে পারছি না। অন্য কেউ হলে বলতাম চোখের ভুল। কিন্তু আপনাদের সে কথা তো বলতে পারি না।

শান্তনু বলল, আপনি হয়তো জানেন শুধু ইন্ডিয়াতে নয়, ইন্ডিয়ার বাইরেও প্রায় সব দেশেই ভূতের ওপর অনেক ঘটনা আছে। তার সবই যে কাল্পনিক এমন ভাবার কারণ নেই। বেশির ভাগই যে সত্য তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। আর এই সব সত্যি-মিথ্যে কাহিনির সঙ্গে দেখা যায় একটি হিংস্র পশুকে। সে পশু বাঘ, সিংহ, ভাল্লুক নয়। নেকড়ে। প্রায় প্রতিটি কাহিনিতে নেকড়ে কী করে এল তার সঠিক তথ্য আমার জানা নেই।

তাই যদি হয়, অর্থাৎ আমাদের দেখা সেই নেকড়ের বাচ্চাগুলি যদি চোখের ভুলই হয়, তবে তো স্বীকার করে নিতেই হবে, শিলিগুড়ি থেকে হিলে পর্যন্ত আমরা পথে যা দেখেছি–যা কিছু ঘটল তা সমস্তই চোখের ভুল। কিছু মনে করবেন না মিস চিয়াং। একথা আমরা মানতে পারব না। বিশেষ করে আমরা স্বচক্ষে যা দেখেছি। আচ্ছা, আমাদের কথা না হয় বাদ দিন। কিন্তু আমাদের ড্রাইভার বিক্রম থাপা। ও তো আজ সন্ধ্যায় এখানে আসবে। তখন আপনিই ওকে জিজ্ঞাসা করবেন।

মিস চিয়াং একটু হাসলেন, বললেন, আপনাদের ধারণাকে না হয় সত্য বলে মেনে নিলাম। তা বলে নেকডের বাচ্চা এ বাড়িতে দেখার দুঃস্বপ্ন দু’চোখে নিয়ে বসে থাকলেও যেন ভেবে বসবেন না আমার এই হোমে ঘোস্ট জাতীয় কিছু আছে। আজ পর্যন্ত বহু বোর্ডার এখানে থেকে গেছে। তারা কেউ তেমন কথা বলেনি।

তারা কেউ বলেননি কেন তা জানি না, জানবার ইচ্ছেও নেই। আমরা এখানে ভূতের গল্পের প্লট খুঁজতে আসিনি। তবে যা দেখেছি যা শুনেছি তা অস্বীকার করতে পারব না।

মিস চিয়াং মুখ লাল করে বললেন, সেটা আপনাদের ব্যাপার।

আমি আড়ালে শান্তনুকে বললাম, তর্ক কোরো না। মিস চিয়াং রেগে যাচ্ছেন। এখনও আমরা কিন্তু ওঁর আশ্রয়েই আছি।

শান্তনু একটু সামলে নিয়ে সহজ গলায় বলল, যাই হোক, ও প্রসঙ্গ থাক। আপনি কি আমাদের রহস্যটার ব্যাপার বুঝিয়ে বলবেন? আপনার কথামতো আমরা কিন্তু সব ঘটনা খুলে বলেছি। এখন আপনার ইচ্ছা।

মিস চিয়াং একটু ভেবে বললেন, বেশ বলুন কী জানতে চান?

শান্তনু বলল, প্রথমেই জানতে চাই শনিবারটা ড্রাইভারদের কাছে অপয়া কেন? কেন তারা এই পথ দিয়ে আসতে চাইছিল না? কে ঐ ওয়াটারপ্রুফ পরা লোকটা?

মিস চিয়াং একটুক্ষণ চোখ বুজিয়ে কী ভাবলেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন, একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন করলেন। ঠিক আছে। আমি উত্তর দেবার চেষ্টা করছি। শেষ থেকেই শুরু করব।

আপনাদের আমি যে লোভী অত্যাচারী বিদেশি পুলিশের কথা বলেছিলাম সেই হচ্ছে, যাকে আপনারা পাহাড়ের রাস্তায় ওয়াটারপ্রুফ গায়ে দিয়ে দাপাদাপি করতে দেখেছিলেন। ঐ পাহাড়ি রাস্তায় বৃষ্টির সময়েতেই অমনিটাই ঘটে। বৃষ্টি পড়ে বলেই ওয়াটারপ্রুফ। ওর নাম গর্ডন। দিনের পর দিন লোকটা দাদুকে ভয় দেখিয়ে টাকা নিয়েছে। শেষ পর্যন্ত দাদু আর সহ্য করতে পারলেন না। ঠিক করেন সময়মতো সাহেবকে সরিয়ে দেবেন।

কিন্তু সেও তো যে-সে লোক নয়। হাতে প্রচুর ক্ষমতা। তখন দাদু মতলব ভাঁজতে লাগলেন। পুলিশ অফিসারটিকে আরও বেশি ডলারের লোভ দেখিয়ে হিলে ডেকে আনলেন। তারপর নানা অছিলায় নিয়ে গেলেন একেবারে জোরথাং। সেখানে একটা ছোটো রেস্টুরেন্টে আগে থেকেই ভালো ভালো খাদ্য-পানীয়ের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন দাদু টাকা ছড়িয়ে। শুধু খাদ্য-পানীয়ের ব্যবস্থাই নয়, খাবার ঘরটির এক কোণে ভালো পর্দা, সুন্দর সুন্দর ফুল দিয়ে ফ্লাওয়ার ভাস সাজিয়ে রাখার ব্যবস্থাও করে রেখেছিলেন। তাছাড়াও রেস্টুরেন্টের মালিকের সঙ্গে পরামর্শ করে অনেক টাকা দিয়ে জনা দশেক গাড়ির ড্রাইভার আর স্থানীয় পাহাড়ি লোকের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন।

সাহেব টাকার লোভে দাদুর ফাঁদে পা দিলেন। আর তাকে ফিরতে হল না।

মৃত্যুর পর ঐ বিরাট দেহটার ব্যবস্থা কী করা হবে তাও ঠিক করা ছিল। একটু অন্ধকার হতেই সবাই ধরাধরি করে দেহটাকে পাশের খাদে ফেলে দিল। শত্রুর শেষকৃত্য এইভাবেই দাদু সম্পন্ন করে আমার কাছে ফিরে এলেন।

এই পর্যন্ত বলে মিস চিয়াং থামলেন।

শান্তনু জিগ্যেস করল, ঐ ড্রাইভারদের মধ্যে আমাদের বিক্রমও ছিল কিনা কে জানে?

মিস চিয়াং বললেন, গাড়ি চালাতে চালাতে ও যেরকম ভয় পাচ্ছিল বলছিলেন, তাতে মনে হয় ও-ও এসবের দলে ছিল। খুব বেঁচে গেছে।

আচ্ছা, এ ঘটনা কত বছর আগের মনে করেন?

বছর কুড়ি তো বটেই। আমার বয়সই দেখুন না। খুব বুড়িয়ে গেছি কি? বলে হাসলেন।

তারপর?

তারপর দাদু কিন্তু শান্তিতে থাকতে পারলেন না। কী এক দুশ্চিন্তায় ক্রমশই ভেঙে পড়তে লাগলেন। যতই জিগ্যেস করি, দাদু, কী হয়েছে তোমার?’ দাদু বলেন, না, কিছু হয়নি। আগে রোজ সকালে-বিকালে হিলের বাজারে বেড়াতে যেতেন। আস্তে আস্তে বিকালে বেরোনো বন্ধ করে দিলেন। তারপর একদিন দেখলাম সকালেও বেরোচ্ছেন না। সর্বক্ষণ শুয়ে থাকছেন। বললাম, ‘আজ একেবারেই বেরোলে না?’ দাদু আমাকে ইশারায় কাছে ডাকলেন। তারপর এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে নিচু গলায় বললেন, আমার মনে হচ্ছে বিদেশি পুলিশটা ঠিকমতো মরেনি।

‘ঠিকমতো’ মরেনি মানে কী? মরা তো মরাই। না মরলে বেঁচে থাকা।

দাদু অস্পষ্টভাবে কী বলতে চাইলেন প্রথমে কিছু বুঝতে পারিনি। তারপর অনেক কষ্টে বুঝলাম। দাদু বোঝাতে চাইছিলেন পুলিশটা গভীর খাদে পড়েও বেঁচে আছে।

শুনে আমি চমকে উঠেছিলাম। অত গভীর খাদে যাকে পাঁচ-ছ’জন মিলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল সে কখনও বাঁচতে পারে? আর সত্যিই যদি ভাগ্যক্রমে বেঁচে থাকে তাহলে তো দাদুকে শেষ করে দেবে?

তারপর দাদু এক-এক দিন এমন সব কাণ্ডকারখানার কথা বলতে লাগলেন যা থেকে বুঝলাম পুলিশটা ঠিকমতো মরে গেছে বলেই আরও শক্তি নিয়ে ফের জেগে উঠেছে। এখন তাকে ঠেকানো মানুষের অসাধ্য। মৃত্যুভয়ে দাদু অস্থির। হিলে’ থেকে একটু ওপর দিকে উঠলেই দেখা যাবে তাকে। পাহাড়ি জায়গায় বৃষ্টি প্রায় সব সময়েই লেগে থাকে। আর বৃষ্টি পড়লেই তার আবির্ভাব। ইউনিফর্মের ওপর ওয়াটারপ্রুফ জড়িয়ে হু হু করে তেড়ে আসছে। …এরই মধ্যে একদিন ঘটল একটা ঘটনা।

আমরা একটু নড়ে-চড়ে বসলাম।

… হিলেতে সবে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। জোর বৃষ্টি নয়। ঝিরঝিরে বৃষ্টি। কনকনে বাতাস যেন গায়ে ছুঁচ ফোঁটাচ্ছে। আমার হোটেলে এমনিতেই বোর্ডার কম। বৃষ্টি পড়লে তখন কোনো বোর্ডার আসবে এমন আশা করিনি। দরজা, জানলা বন্ধ করে ঘরে আলো জ্বেলে এইখানে ঐ চেয়ারটায় বসে আছি।

হঠাৎ কে যেন দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল। অকারণেই আমি ভয় পেয়ে চমকে উঠলাম। বাইরের আলো জ্বালতে গেলাম। আশ্চর্য, জুলল না। অথচ ভেতরে আলো জ্বলছে।

আবার দরজায় ধাক্কা। এবার উঠতে হল। দরজার কাছ এগিয়ে ভারী পর্দাটা সরিয়ে দিলাম। তারপর কাচের দরজা দিয়ে যা দেখলাম তাতে শিউরে উঠলাম। দেখলাম দাদু যে বিদেশি পুলিশটার কথা বলেন, যে আমার এখানে বারকয়েক এসেছিল, যাকে জোরথাং-এর রেস্টুরেন্টে দাদু মেরে ফেলেছিলেন, যার দেহটা পাঁচ-ছ’জন মিলে গভীর খাদে ফেলে দিয়েছিল সেই ‘গর্ডন’ সাহেব সশরীরে এসে দাঁড়িয়েছে। তার ওয়াটারপ্রুফের হুডটা নেমে এসেছে কপাল পর্যন্ত। কপালের নীচে ভুরুশূন্য, পলকশূন্য দুটি লাল গর্তের মধ্যে ঝকঝক করছে দুটো হিংস্র চোখ। সে কথা বলার জন্য একবার হাঁ করল। অমনি বেরিয়ে এল কালো কালো দাঁত। দু’পাশের কষে কাদা।

আমি কাঁপা কাঁপা গলায় জিগ্যেস করলাম, হুম ডু ইউ ওয়ান্ট?

সে ফ্যাসফ্যাসে গলায় কী বলল বুঝতে পারলাম না। তবে যখন দরজার কাচের ওপর ‘হিপ হো’ নামটা আঙুল দিয়ে লিখে দিল তখন বুঝলাম দাদুকেই খুঁজছে। এও বুঝলাম দাদুর আর রক্ষে নেই।

তখনই দরজার ওপর পর্দা টেনে দিয়ে ভেতরে ছুটে এলাম দাদুর কাছে। দেখি দাদু কীভাবে বুঝতে পেরেছেন। ভয়ে মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ করে শব্দ করছেন আর চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে এসেছে, আমি দাদুকে দু-তিন বার বললাম, ভয় পেও না। যে এসেছিল বুদ্ধের নাম করতেই সে চলে গেছে। দাদু দুই কঁপা কাঁপা হাত তুলে বুদ্ধের উদ্দেশে প্রণাম করলেন।

তারপর?

এবার মিস চিয়াং বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর চোখের জল সামলে বললেন, এরপর তিনি আর বাঁচতে চাননি। শেষের দিকে বলতেন, আমার বডি সাবধানে সমাধিস্থ কোরো। যত কম লোক সঙ্গে নিতে পারো, ততই ভালো। অন্ধকারে নিয়ে যাবে নিঃশব্দে। ও যেন জানতে না পারে কোথায় আমার বডি আছে। আমার বডির হদিস পেলে নানাভাবে উপদ্রব করবে তা জানি। সাবধান!

তারপর সেদিন ভোরবেলায় উঠে দাদুকে কফি দিতে গিয়ে দেখি দরজায় খিল দেওয়া নেই। অন্যদিন ঘড়ির কাটায় ছ’টা বাজতেই দাদু দরজা খুলে দিতেন। আমি কফির পেয়ালা নিয়ে ঘরে ঢুকতাম। বলতাম… গুড মর্নিং গ্র্যান্ড!

হেসে, দাদু উত্তর দিতেন, ইয়েস! ভেরি গুড মর্নিং!

আজ দেখলাম দরজা ঠেসানো। ঠেলে ঘরে ঢুকতেই কাপ থেকে খানিকটা কফি চলকে পড়ে গেল। দেখলাম দাদু সিলিং থেকে ঝুলছেন! বলতে বলতে মিস চিয়াং দু’হাত দিয়ে মুখ ঢাকলেন।

তারপর?

কিন্তু–

ওখানে কি কেউ দাঁড়িয়ে আছে?

না, দাঁড়িয়ে নেই। কালো কোট, কালো টুপি। কেউ যেন অন্ধকারে গা মিশিয়ে আমাদের ঘরে ঢোকার চেষ্টা করছে।

আমি তখনই নিঃশব্দে মিস চিয়াং-এর চেম্বারে ফিরে এসে চাপা গলায় শান্তনুকে ডাকলাম, শিগগির।

শান্তনু চটপট উঠে আমার পিছনে পিছনে আসতে লাগল। আমাদের হাবভাব দেখে মিস চিয়াং নিশ্চয়ই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। নইলে তিনিও ব্যস্ত হয়ে আমাদের পিছু পিছু আসবেন কেন?

কিছু যেন দেখলাম।

কী দেখলে? কোথায় দেখলে?

আমাদের ঘরে ঢুকেছিল–ঐ যে ঐ যে বেরিয়ে যাচ্ছে।

মিস চিয়াং হয় তো দেখতে পাননি। কেননা তিনি তখনও দূরে ছিলেন। আমরা দুজনেই দেখলাম একটা চলন্ত প্যান্ট আর একটা কোট–আর একটা টুপি। দেহ নেই, কোনো অস্তিত্বই নেই। স্রেফ ভাসতে ভাসতে বাইরের পাঁচিলের দিকে চলে গেল। যেখানে মাত্র গত সন্ধ্যায় সেই নেকড়ের শাবক তার ছায়াশরীর নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। সব শুনে মিস চিয়াং হতাশ সুরে বললেন, কই, আমি তো কিছুই দেখতে পেলাম না।

দুঃখের সঙ্গে কথাগুলো বললেও গলায় যেন ছিল আর একটা চাপা বেসুর।

শান্তনু ইশারা করে আমায় বলল, কী দেখলাম তা যেন চিয়াংকে না বলি।

কেন?

আমাদের ধারণা ও সব জানে। সব জেনেও না জানার ভান করছে। কেন?

কী উদ্দেশ্য?

আবার আমরা চেয়ারে গিয়ে বসলাম। মিস চিয়াং আগের মতোই যেন গল্প করতে মন দিলেন। কিন্তু গল্প যেন জমছিল না। আমরা তিনজনেই কেমন অন্যমনস্ক।

এইভাবে ঘণ্টা দেড়েক চলল। এরই মধ্যে আমরা গিয়ে বিরূপদার সঙ্গে কথা বলে এসেছি। জ্বরটা অনেক কমে গেছে। একটু উঠে বসেছেন।

এই তো গুড বয়ের মতো ভালো হয়ে উঠেছেন। চলুন, বাইরের ঘরে গিয়ে বসবেন।

ওখানে বসে কী হবে? ওখানে তো যত অনাসৃষ্টি ইয়ের গল্প। সন্ধেবেলায় ওসব গল্প করা ঠিক নয়। বিশেষ এইরকম বাজে জায়গায়।

তাহলে আমরা যাই?

হ্যাঁ, তা যাও। আমি আর একটু ঘুমোবার চেষ্টা করি।

মিস চিয়াংকে এই খবর জানালে তিনি বললেন–বয়েস হয়েছে। তার ওপর জ্বর গেল। শরীরটা দুর্বল হয়ে গেছে। উনি কথা শেষ করেছেন, আর তখনই দরজায় জুতোর শব্দ। স্পষ্ট লক্ষ করলাম সামান্য জুতোর শব্দতেই …. উনি চমকে উঠলেন।

কে? কে ওখানে?

আমি ম্যাডাম। আসব?

আমরাও তাকালাম। বিক্রম থাপা।

ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বিক্ৰম বলল, আসতে একটু দেরি হয়ে গেছে। বললাম, তাতে কোনো অসুবিধে হয়নি। হ্যাঁ, আমরা কালই যাব। এখনও পর্যন্ত এইরকমই

ঠিক।

কাল কখন গাড়ি আনব, স্যার?

ব্রেকফাস্ট করে বেরোব।

ঠিক আছে। বলে বিক্রম যাবার জন্য ঘাড় ঘোরাল। কিন্তু এরপরই তার ঘাড়টা যেন শক্ত হয়ে গেল। ওর দৃষ্টি তখন ঘরের জানলার ভেতর দিয়ে বারান্দার দিকে যেখানে একটা ইউক্যালিপটাস গাছ অন্ধকারে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে।

মনে হল বিক্রমের চোখ দুটো যেন ক্রমশ বড়ো হয়ে উঠল। আর সেই চোখের ভাষায় শুধু বিস্ময়–ভয়!

বিক্রম কি কিছু দেখেছে? অমন করে তাকাচ্ছে কেন?

বিক্রম!

বিক্রম উত্তর দিল না। তখনও ওর একটা পা দরজায় আর ঘাড়টা বেঁকিয়ে বিস্ফারিত চোখে সেই ইউক্যালিপটাস গাছের নীচে। ঠোঁট দুটো কাঁপছে অস্বাভাবিকভাবে।

বিক্রম! ধমকে উঠল শান্তনু, কী দেখছ অমন করে?

কে ওখানে? কে ও? একজন বুড়ো-সাদা দাড়ি-ক্রমশই লম্বা হচ্ছে! … চললাম স্যার। এখানে আর একদণ্ড নয়। যদি বেঁচে থাকি তাহলে কাল ঠিক সময়ে গাড়ি নিয়ে আসব। বলতে বলতে বিক্রম যেন মরিয়া হয়ে অন্ধকারে ঝাঁপ দিল।

শান্তুনু আর আমি মিস চিয়াং-এর অনুমতি না নিয়েই বাঁ দিকের সেই ইউক্যালিপটাস গাছটার দিকে ছুটলাম। গাছটার পিছনেই পাহাড়। তারই গায়ে একটা গুহার মতো। তখন কোনো মূর্তি দেখা গেল না। শুধু সাদা খানিকটা ধোঁওয়া গুহার মুখ দিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে।

আশ্চর্য! মিস চিয়াং-এর কিন্তু ব্যস্ততা নেই। অনেক পিছনে তিনি হন্তদন্ত হয়ে আসছেন। মুখে ভয়ের ছাপ–কিন্তু কৃত্রিম। তাঁর মুখে ভয় কিন্তু অন্তরে নয়।

কী ব্যাপার, মিস্টার রায়? কিছু কি দেখতে পেলেন?

আমরা যতটুকু দেখেছি তাতেই যা বোঝবার বুঝে নিয়েছি। মুখে বললাম, কই? কিছুই তো নেই।

আমি জানতাম। এসব আমার ‘হোম’-এর বিরুদ্ধে বদনাম রটানোর চেষ্টা। বলে আর এগিয়ে না এসে ফিরে গেলেন নিজের চেয়ারে।

এই অবসরে শান্তনু চাপা গলায় বলল, আজই আমাদের সুবর্ণ সুযোগ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস চিয়াং-এর দাদুকে এ বাড়িতেই রাখা আছে। আজ তার গোপন ডেরা থেকে বেরোনোর কথা বোধ হয় ছিল না। কিন্তু ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যাওয়ায় তিনি অস্বস্তিতে পড়েছেন। তবু দেখা করতেই হবে। তাই আমার বিশ্বাস আজ কিছু একটা ঘটবে। সজাগ থেকো।

মিস চিয়াং-এর চেম্বারে এসে বসলাম। এতক্ষণে লক্ষ পড়ল বৃদ্ধ চিনা ওয়ন একমনে খাতাপত্র নিয়ে ঘাড় গুঁজে বসে কাজ করেই যাচ্ছে। এত যে কাণ্ড ঘটে গেল তা কি ওর কানে যায়নি? না কি গুরুত্ব দেয়নি? আশ্চর্য!

ঘরে ঢুকতেই বিরূপাক্ষদা জিগ্যেস করলেন, কাল আমরা ফিরছি তো?

শান্তনু বলল, তাই তো ভাবছি।

অমন হেঁয়ালি করে কথা বল কেন? এই তো বললে কালই যাওয়া হবে। তাহলে—

শান্তনু হেসে বলল, আমি তো বলিনি কাল যাওয়া হবে না।

তাহলে?

আগে রাতটা নিরাপদে কাটুক।

বিরূপাক্ষদা যেন চুপসে গেলেন। বললেন, ওরে বাবা!

অনেক রাতে শান্তনুর খোঁচা খেয়ে ঘুম ভেঙে গেল। চমকে উঠতেই শান্তনু আমাকে চুপ করে থাকতে বলল, কিছু শুনতে পাচ্ছ?

বললাম, এ তো বিরূপাক্ষদার নাক ডাকা।

দূর! ভালো করে কান পেতে শোনো।

এবার শুনতে পেলাম। কাছেই কোথাও কেউ শাবল দিয়ে কোদাল দিয়ে পাথর সরাচ্ছে।

হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি।

তাহলে আর দেরি নয়। চটপট বেরিয়ে পড়ো।

তাই করলাম। কোনোরকমে পাজামার উপর পাঞ্জাবি চড়িয়ে দরজা বাইরে থেকে ঠেসিয়ে দুজনে বেরিয়ে পড়লাম।

মনে মনে বললাম, বিরূপদা, এইরকম বিপদের সময়ে আপনাকে কিছুক্ষণের জন্যেও একা রেখে যাচ্ছি। উপায় নেই। তার জন্য ক্ষমা করবেন। ঈশ্বর আপনার সহায় হোন।

আবার সেই অন্ধকার প্যাসেজ। এখন যেন আরও বেশি অন্ধকার মনে হচ্ছে। প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছে এই বুঝি কেউ ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বে।

রাত বলেই মিস চিয়াং-এর চেম্বারে একটা হাল্কা আলো জ্বলছে। সেই আলোয় আমরা সাবধানে চেম্বারের বাঁদিকের প্যাসেজ ধরে এগিয়ে চললাম।

চাপা গলায় বললাম, নিরস্ত্র অবস্থায় এইভাবে কি যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে?

শান্তনু বলল, তাছাড়া উপায় কী? আমরা করো সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাচ্ছি না। শুধু রহস্যভেদ করতে যাচ্ছি। তবে যদি কেউ আক্রমণ করে তাহলে শক্তি পরীক্ষা দেব।

শান্তনুর অভয়বাণী শুনলাম বটে, কিন্তু সাহস পেলাম না। এই তো সেই জানালা। যে জানালা দিয়ে পিছনের বারান্দাটা দেখা যায়। কিন্তু এখন সব অন্ধকারে লেপা। আমরা আমাদের এদিকের বারান্দা দিয়ে পাঁচিল পর্যন্ত গিয়েছি। কিন্তু এদিকটা আসার সুযোগ হয়নি।

সাবধানে টর্চ জ্বালব?

বললাম, না–না!

আঃ! পেন্সিল টর্চটা আনলে হত।

সাবধানে হাঁটতে হাঁটতে কোদালের শব্দ অনুসরণ করে আমরা আরও খানিকটা এগিয়ে এসেছি। হঠাৎ শব্দটা থেমে গেল। আমরাও থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। তারপর অন্ধকারের মধ্যে সেই ইউক্যালিপটাস গাছটার নীচে থেকে যেন একটা মূর্তি উঠে দাঁড়াল।

সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দুজনের হাতের টর্চ একসঙ্গে জ্বলে উঠল।

সেই জোরালো আলোয় কালো গাউন পরা মিস চিয়াং স্পষ্ট হয়ে দেখা দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর হাত থেকে শাবলটা পড়ে গেল।

এ কি আপনারা? এখানে কী করছেন?

আপনাকে জানতে চেষ্টা করছি।

মিস চিয়াং কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে এসে দু’চোখ তুলে বললেন–কী জানতে চান বলুন? এর আগে তো সব বলেছি।

না, সব বলা হয়নি। সেইটুকুই শুনব।

বেশ বলুন কী জানতে চান। এখানে কী করছিলাম?

তা জানি। আপনি পাথর সরিয়ে কোনো সুড়ঙ্গপথের দরজা খুলছিলেন।

মিস চিয়াং বললেন–হ্যাঁ তাই।

এখানে কী আছে?

অনেক গোল্ড অনেক–আমার সারা জীবনের সম্পদ।

গোল্ড!

শান্তনু এবার মিস চিয়াং-এর চোখের ওপর টর্চ ফেলল।

মিথ্যে কথা।

মিস চিয়াং চুপ করে রইলেন।

গোল্ডের চেয়ে ঢের মূল্যবান কিছু।

একটু থেমে শান্তনু বলল, আমরা কিন্তু জানতে পেরেছি কী আছে।

মিস চিয়াং আঁতকে উঠে বললেন, কী? কী জানতে পেরেছেন, বলুন।

শান্তনু বলল, ওখানেই শোয়ানো আছে আপনার দাদুর দেহ। যার মাথার চুল পাকা, যাঁর বুক পর্যন্ত লম্বা সাদা দাড়ি। যিনি এখন বাতাসের চেয়েও হালকা।

একটু থেমে শান্তনু আবার বলল–এও জানি সেই শয়তান লালমুখো পুলিশের প্রেতাত্মার ভয়ে দাদুর বডি আপনি অন্য কোথাও সমাধিস্থ না করে বাড়িতেই করেছিলেন।

মিস চিয়াং চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনতে লাগলেন। তারপর ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন, তাহলে আর আমার বলার কিছু নেই। এখন কী করতে চান? লোকাল পুলিশকে জানাবেন আমার দাদুর আত্মঘাতী হওয়ার কথা? জানাবেন বেআইনিভাবে একটা ডেড-বডি আমারই হেফাজত থেকে লোপাট করে পাহাড়ের সুড়ঙ্গে লুকিয়ে রেখেছি। তাই যান। থানায় যেতেই বা হবে কেন? চলুন আমার অফিস ঘরে। ওখানে টেলিফোন আছে। বলতে বলতে মিস চিয়াং উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।

আসুন আমার অফিস ঘরে। বলে আমাদের পাশ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে ঘরের আলো জ্বেলে দিলেন।

অনুগ্রহ করে বসুন।

আমরা বসতেই উনি টেলিফোনটা এগিয়ে দিলেন।

এই যে পুলিশ স্টেশনের নাম্বার। ওদের আসার অপেক্ষায় থাকব। আমায় অ্যারেস্ট করুন। আমি রেডি।

শান্তনু ফোনটা সরিয়ে দিয়ে বলল, আপনি দয়া করে শান্ত হন, মিস চিয়াং। আমরা তদন্ত করতে আসিনি। দাদুর কাছ থেকে সরিয়ে আপনাকে থানাতে পাঠাতেও নয়। যে রহস্যকে সঙ্গে নিয়ে এতদূর এসে পড়েছিলাম সেই রহস্যের সমাধান আজই হয়ে গেল। এখন কালই চলে যাব। কিন্তু একটা কথা–সেই পুলিশের প্রেতাত্মা আপনার দাদুর বডি খুঁজতে খুঁজতে আপনার হোম পর্যন্ত চলে এসেছে। জানেন তো?

জানি।

এখন বডিটাকে বাঁচাবেন কী করে?

জানি না। সপ্তাহে একদিন-দু’দিন বডিটাকে দেখে আসি। একটা তেল মাখাই। তবু দাদু মাঝে মাঝে কফিন থেকে বেরিয়ে পড়ে। যেমন আজ হঠাৎ বেরিয়ে পড়েছিল। বোধহয় বুঝতে পেরেছে তার শত্রু কাছেই এসে পড়েছে। আমাকে সাবধান করতে চায়।

কিন্তু–

কিন্তু আমি আর কী করে সাবধান হব? বলুন–আপনারা বলুন—

বলতে বলতে মিস চিয়াং-এর দু’চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়ল।

বললাম–ভয় নেই। আপনি পারবেনই। কারণ আপনার দাদুর দেহই বলুন আর আত্মাই বলুন আপনার ভালোবাসা পেয়ে অজেয় হয়ে উঠেছে। কোনো অশুভ শক্তির সাধ্য নেই সেই পবিত্র দেহের ক্ষতি করতে পারে।

কথা শেষ করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম।

ভোরের আকাশ তখন ফর্সা হয়ে আসছে।

[শারদীয়া ১৪১৫]

No comments