পারিজাত ও ছোটকাকা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

পারিজাত ও ছোটকাকা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়


আপনি কি পুলিশের লোক?

কেন বলুন তো! আমাকে কি পুলিশের লোক বলে মনে হয়?

আজকাল কাউকে দেখে কি কিছু বোঝা যায়, বলুন! আমাদের নিমাইবাবুর কথাই ধরুন না কেন! দিব্যি মোটাসোটা, হাসিখুশি, দিলদরিয়া, নির্বিরোধী মানুষ। ভিখিরিকে ভিক্ষে দেন, কীর্তন শুনে কাঁদেন, পাড়ার বাচ্চাদের সঙ্গে ছুটির দিনে ব্যাটবল খেলেন, ঘরে ঠাকুর দেবতার ছবি আছে। অথচ একদিন সকালে তাঁর বাড়ি পুলিশে–পুলিশে ছয়লাপ। তাঁর শোওয়ার ঘরের খাটের তলা থেকে দুটো এ কে ফর্টি সেভেন অ্যাসল্ট রাইফেল, দুটো বেলজিয়ান পিস্তল, আর ডি এক্স, কার্তুজ আরও কী-কী সব যেন বেরোল। আমাদের এক গাল মাছি।

নিমাইবাবু ধরা পড়লেন বুঝি!

পাগল! শুনলুম, ওই থলথলে চেহারা নিয়েও তিনি নাকি নিজের বাড়ির ছাদ থেকে পাশের বাড়ির ছাদে লাফিয়ে পড়ে হাওয়া হয়েছেন। তাই বলছিলুম, লোক দেখে আজকাল আর কে যে কী তা চেনা মুশকিল। শুনলুম নিমাইবাবু নাকি কোন টেররিস্ট দলের সর্দার। বুঝুন কাণ্ড!

তা আমাকে দেখে কী মনে হয় আপনার?

শার্লক হোমস হলে বলতে পারতুম। তবে এমনিতে আপনাকে একজন মধ্যবয়স্ক, মধ্যবিত্ত, মধ্যশিক্ষিত, মধ্যম উচ্চতা ও মধ্যম স্বাস্থ্যের ভ ভদ্রলোক বলেই মনে হয়। একজোড়া সন্দেহভাজন জম্পেশ গোঁফ থাকলেও আপনাকে ভয়ঙ্কর মানুষ বলে মনে হয় না। আর ওইটেই হয়েছে মুশকিল। আজকাল লোক দেখে চেনার উপায় নেই কিনা।

কথাটা যে খুব ভুল বলেছেন তা নয়। আমি ভয়ঙ্কর লোক নই। তবে আমাকে যে কেন পুলিশ বলে আপনার মনে হল সেইটেই বুঝতে পারছি না।

বলছি বলে কিছু মনে করবেন না। আজ ছুটির দিনটা বাড়িতে বসে কাটাব না ঠিক করে সকালে রুটি তরকারি খেয়ে যখন বেরোলাম তখন শরৎকালের আকাশ দেখে মনটা ভারী খুশি হয়ে উঠল। শরৎ আমার ভারী প্রিয় ঋতু। যদিও কলকাতা শহরে শিউলি বা কাশফুল বড় একটা দেখা যায় না, হিমেল ভাবটাও ডিজেল আর জনসংখ্যার জন্য তেমন নেই। তবু যাকে বলে স্মৃতিতাড়িত হয়েই বেরিয়ে পড়েছিলুম। ভাবলুম আজ একটু প্রকৃতিচর্চা করে কাটাব।

আপনি কি একটু প্রকৃতি-প্রেমিক?

প্রকৃতিপ্রেমিক কে নয় বলুন তো! আমাদের পূর্বপুরুষেরা তো বনজঙ্গলেই থাকতেন। ফলে এর একটা উত্তরাধিকার আমাদের রক্তে আছেই। ইট, কাঠ, পাথরের মধ্যে নিজেকে মানিয়ে নিই। বটে, কিন্তু প্রকৃতি আমাদের সর্বদাই ডাকে।

অতি সত্য কথা। তাই আজ প্রকৃতির ডাকে বেরিয়ে পড়লেন বুঝি?

হ্যাঁ। তবে কলকাতায় প্রকৃতির জনপ্রিয়তা এতই বেশি যে কোথাও গিয়ে শান্তি নেই। ময়দানে যান, গুচ্ছের লোক। লেক–এ যান, গুচ্ছের লোক। নিরিবিলিতে যে উড়ুউড়ু মন নিয়ে বসে থাকবেন তার জো নেই। তাই আজ ভাবলুম, লোকাল ট্রেনে চেপে বারুইপুর কি লক্ষ্মীকান্তপুর কিংবা ক্যানিং কোথাও গিয়ে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে আসি।

তা গেলেন না কেন?

আরে মশাই, সেই কথাই তো বলছি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাস স্টপে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, তখনই দেখতে পেলুম বাসস্টপে একটা লোক আমাকে আড়ে-আড়ে লক্ষ করছে। এ ব্যাপারটা কিছু অভিনব। কারণ আমাকে লক্ষ করার মত কিছু নেই। আমি অতি সাদামাটা, নগণ্য মানুষ। অথচ লোকটা বারেবারেই আমার দিকে বেশ তীক্ষ্ণ চোখে তাকাচ্ছিল। এবং সেই লোকটা আপনি।

তা হবে হয় তো। আমি ইচ্ছে করেই যে তাকাচ্ছিলাম তা নয়। আসলে আমি খুব ভুলো মনের মানুষ। ভাবতে-ভাবতে কোনও দিকে হয়তো তাকিয়ে থাকি, কিন্তু কিছু দেখি না।

আপনাকে খুব আনমনা লোক বলে মনে হয় না কিন্তু।

কিন্তু একটু আগে আপনিই তো বলছিলেন তোক দেখে কে কেমন তা ঠিক বোঝা যায় না।

হ্যাঁ মশাই, তা বলেছি। তাহলে আপনি নিজেকে ভুলো মনের মানুষ বলেই দাবি করছেন? দাবিদাওয়া কীসের? আমি ভুলো মনের মানুষ কি না তাও সঠিক জানি না। তবে গত তেত্রিশ বছর ধরে আমার বউ বলে আসছে আমি নাকি বেজায় ভুলো মনের মানুষ। বউ যা বলে তা নাকি আমি বেমালুম ভুলে যাই। শুনে শুনে আজকাল কথাটা আমার বিশ্বাস হয়ে গেছে।

কিন্তু মুশকিল কি জানেন, বাস স্টপে আমি আপনাকে এড়ানোর জন্য তিনটে বাস ছেড়ে দিই। বাস ফাঁকাই ছিল, তবু আমি উঠিনি। দেখলুম, আপনিও হিসেব কষেই ওই তিনটি বাস ছেড়ে দিলেন।

তাই নাকি?

আজ্ঞে হ্যাঁ। ঠিক তাই। চতুর্থ বাসটায় উঠতেই দেখলুম আপনিও উঠে পড়েছেন। তখনই মনে একটা খটকা লাগল।

খটকা! খটকা লাগবে কেন? এরকম তো হতেই পারে। প্রতিদিন এই কলকাতা শহরেই কত লোক তিনটে বাস ছেড়ে দিয়ে চার নম্বর বাসে ওঠে। এতে খটকা লাগার কী আছে? আপনি একটু সন্দেহবাতিকগ্রস্ত, তাই না?

সন্দেহ তো এমনি হয় না মশাই, কারণ থাকলেই হয়। শ্যামবাজার থেকে শেয়ালদা যেতে যেতে আমি বারবারই লক্ষ করছিলাম যে, আপনি আমার ওপর নজর রাখছেন। আমি তখন আকাশ পাতাল ভেবেও বুঝতে পারছি না আমার ওপর কারও নজর রাখার কারণ কী হতে পারে। তাই আপনাকে বাজিয়ে দেখার জন্যই আমি শেয়ালদা না গিয়ে মানিকতলার মোড়েই নেমে পড়লুম। কাছেই আমার মেজো মাসির বাড়ি। অনেক কাল যাওয়া হয় না। প্রকৃতিচর্চা ছেড়ে অগত্যা মাসির বাড়িতেই এ-বেলাটা কাটিয়ে দেব বলে মনস্থির করে ফেললুম। কিন্তু কী আশ্চর্য! দেখলুম আপনিও ঠিক ওই স্টপেই নেমে পড়েছেন এবং দিব্যি আমার পিছু পিছু আসছেন।

আপনার কি মনে হয় যে মানিকতলায় আমারও কেউ থাকতে নেই? বললে হয়তো বিশ্বাস করবেন না, ওই মানিকতলায় আমার জ্যেঠতুতো ভাই পরেশের বাড়ি। পরেশ বেশ নামকরা লোক, করপোরেশনের কাউন্সিলার। সমাজসেবা–টেবা করে। শোনা যাচ্ছে সামনের ইলেকশনে। এম এল এ হওয়ার জন্যও ভোটে দাঁড়াবে।

খুব ভালো কথা। ফ্যামিলিতে একজন পলিটিক্যাল লোক থাকা খুব ভালো। বিপদে আপদে খুব কাজ দেয়।

তা যা বলেছেন। আজকাল পলিটিক্স ছাড়া বেঁচে থাকাই শক্ত।

দুঃখের বিষয় কী জানেন? আমার কোনও পলিটিক্যাল দাদা বা ভাই নেই। পলিটিক্যাল মুরুব্বি না থাকায় আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে নানা ধরনের ইনসিকিউরিটিতে ভুগতে হয়। খুঁটির জোর না থাকার ফলে আমরা কোনও সাহসের কাজই করতে পারি না।

খুবই ঠিক কথা। আজকাল সাহসের কাজ না করাই ভালো। অন্যায়ের প্রতিবাদ বা অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এসব করতে গেলে উলটো বিপত্তি হতে পারে।

হ্যাঁ। তা শেষপর্যন্ত আপনি তো আপনার ভাই পরেশবাবুর বাড়িতে যাননি!

কে বলল যাইনি?

আমিই বলছি। আজ মাসির বাড়িতেই একটা বেলা কাটিয়ে দেব বলেই স্থির ছিল। মাসিও আমাকে দেখে বেজায় খুশি। দুপুরে না খাইয়ে ছাড়বে না কিছুতেই। কিন্তু কিছুক্ষণ বসার পরই আমার কেমন উসখুশ শুরু হল।

কেবলই মনে হতে লাগল, লোকটা যে আমাকে ফলো করেছিল সে কি রাস্তায় এখনও ওৎ পেতে আছে? তিনতলার জানালা দিয়ে চেয়ে অবশ্য রাস্তায় আপনাকে দেখতে পাইনি।

আপনার মাসির বাড়ির নম্বরটা বলুন তো?

তিনের সি।

পরেশের বাড়ি তিনের সি বাই ওয়ান। পাশেই। আপনার মেসোমশাইয়ের নাম কি বিপুলকান্তি সেন?

ও বাবা! আপনি যে অনেক খবর রাখেন মশাই?

বিপুল সেন মস্ত অ্যাডভোকেট। পরেশের সঙ্গে খুব দহরম মহরম।

পরেশ গুপ্তর নাম অবশ্য আমি শুনিনি। তবে আপনার কথা সত্যি হলেও অবাক হওয়ার। ঘটনাও অস্বীকার করা যাচ্ছে না। মাসির সঙ্গে অনেকদিন পরে দেখা। সুখ-দুঃখের কথাও মাসির অনেক জমে আছে। কিন্তু উদ্বেগ আর উসখুশনির চোটে আমার দু-দণ্ড বসে থাকার জো রইল না। কেবলই মনে হতে লাগল, লোকটা এখনও নিশ্চয়ই আমার জন্য রাস্তায় অপেক্ষা করছে। মাসি পর্যন্ত আমার অস্বস্তি লক্ষ করে বলে উঠল, কী হয়েছে তোর? অমন ছটফট করছিস কেন? কথাটা ভেঙে মাসিকে বলতেও পারি না, মাসি নিশ্চয়ই হেসে উড়িয়ে দেবে। আমার মতো একজন অপদার্থর পিছু নিয়ে সময় নষ্ট করার মতো আহাম্মক কে আছে বলুন! তাই সামান্য কিছুক্ষণ বসে দুপুরের খাবার না খেয়েই বেরিয়ে পড়লাম।

দুপুরে না খাওয়াটা আপনার আহাম্মকিই হয়েছে। নিশ্চয়ই মাসি আজ ভালোমন্দ বেঁধেছিলেন। বিপুল সেনের অনেক টাকা, রোজই ভালোমন্দ খায় নিশ্চয়ই।

তা কথাটা আপনি খারাপ বলেননি। মাসির রান্নার লোকটি খুবই উঁচু জাতের।

বামুন নাকি?

আরে না, সেই জাতের কথা বলিনি। বলছি হাই গ্রেড রাঁধুনি। চাইনিজ, মোগলাই সব রাঁধতে জানে। আজ তো শুনলুম গুলাবি বিরিয়ানি আর রেশমি কাবাব রান্না হয়েছিল। তা বলে ভাববেন ওরা রোজ এরকম রিচ খাবার খায়। আজ মাসির বেয়াইবাড়ি থেকে কারা যেন আসবে। সেইজন্যেই ওসব স্পেশাল ডিশ।

একটু টেস্ট করে আসতেও পারতেন।

টেস্ট কি মশাই! সত্যি কথা বলতে কি পৃথিবীতে একটা জিনিসই আমি সত্যিকারের ভালোবাসি। আর তা হল খাওয়া। ভালো খাবারের প্রতি আমার আকর্ষণ দুর্নিবার। সুতরাং মাসির বাড়িতে আজ আমার পাত পেড়ে আকণ্ঠ খাওয়ার কথা। কিন্তু তাতে বাদ সেধেছেন আপনি। কে আমাকে ফলো করছে, কেন ফলো করছে সেই দুশ্চিন্তায় আমার অ্যাপেটাইট-টাই আজ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। শেষ অবধি এক কাপ কফি কোনওরকমে খেয়ে বেরিয়ে এলাম। মাসি অবশ্য খুবই মনঃক্ষুণ্ণ হল। হওয়ারই কথা। আমার মা–মাসিরা তিন বোন। একমাত্র আমার মা ছাড়া কারওই ছেলে নেই। দুই মাসিরই দুটি করে মেয়ে। ফলে আমি তাদের খুবই আদরের বোনপো।

আপনারা তো বোধহয় দুই ভাইবোন, তাই না?

আশ্চর্য তো! আপনি কী করে জানলেন?

জানি না তো! আন্দাজে বললাম। আপনি বোধহয় আমার ‘বোধহয়’ কথাটা লক্ষ করেননি!

করেছি। আপনি বলেছেন, আপনারা বোধহয় দুই ভাইবোন, তাই না?

আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি তাই বলেছি। অনুমানের ওপর নির্ভর করে।

অদ্ভুত আপনার অনুমানশক্তি। অবশ্য যদি সেটা সত্যিই অনুমান হয়ে থাকে। আমার মন বলছে আপনি আমার বিষয়ে সব খোঁজখবরই রাখেন।

আরে না না। আপনি সন্দেহবাতিকে ভুগছেন। এই তো একটু আগেই আপনি বললেন পরেশ গুপ্তের নাম আপনি শোনেননি। যদি তা নাই–ই শুনবেন তাহলে পরেশ যে গুপ্ত তা কী করে জানলেন বলুন তো! আমি আপনাকে পরেশের নামটা বললেও পদবিটা কিন্তু বলিনি। পরেশ যে গুপ্ত তা তো আপনার জানার কথাই নয়।

বলেছি নাকি?

হ্যাঁ বলেছেন।

তাহলে না জেনেই আন্দাজে বলেছি।

আমিও তো সেটাই বলতে চাইছি। আন্দাজে বলা অনেক কথা মিলে যায়।

আপনি খুব বুদ্ধিমান লোক, আর সেটাই ভয়ের কথা।

আপনার রজ্জুতে সর্পভ্রম হচ্ছে।

সেটা হওয়াই বরং ভালো। সর্পতে রজ্জুভ্রম হওয়া যে আরও মারাত্মক।

আপনার বিচলিত হওয়ার মতো কিছুই তো হয়নি!

সেটা আপনিই বলতে পারেন বটে, কিন্তু আমার সিচুয়েশনে পড়লে বিচলিত না হয়ে আপনারও উপায় থাকত না। কারণ মাসির বাড়ি থেকে দুপুরবেলা বেরিয়ে আমি আপনাকে কোথাও দেখতে না পেয়ে তাড়াতাড়ি কেটে পড়ার তালে ছিলুম। কিন্তু হঠাৎ দেখলুম আপনি মোড়ের পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে একজন মোটাসোটা লোকের সঙ্গে কথা কইছেন এবং আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। এমনকি সঙ্গের লোকটাকে ইশারা করে আমাকে দেখিয়ে। দিলেন বলেও আমার মনে হল। কারণ লোকটাও হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখল।

আহা, ওই তো পরেশ। ব্যাপারটা হয়েছিল কি, পরেশের বাড়িতে আমার একটু কাজ ছিল। সেটা সেরে বেরোতে যাব, পরেশ বলল , চলো দাদা, তোমাকে মোড় অবধি এগিয়ে দিই, কয়েক খিলি পানও কিনতে হবে। আমার আবার শিবুর পান ছাড়া চলে না। তা তাই পরেশের সঙ্গে দাঁড়িয়ে একটু কথা কইছিলুম। খারাপ কথাও কিছু নয়। বাগবাজারের এক গলির মধ্যে আমার পৈতৃক বাড়ি। তিনতলা বেশ বড় বাড়িই। তা পুরোনো বাড়ি ভেঙে বহুতল করার একটা কথা চলছে। কিন্তু বাদ সাধছে করপোরেশন। তারা বলছে ওই সংকীর্ণ গলির মধ্যে বহুতলের পারমিশন দেওয়া অসম্ভব। তা সেসব নিয়েই পরেশের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বলতে কি আপনাকে আমি লক্ষই করিনি।

লক্ষ করেছেন কি না তা জানি না। তবে তাকিয়েছিলেন।

তা ওরকম তো আমরা কতই তাকাই। তাকানো মানেই কি আর দেখা! সবকিছুর দিকেই তাকাচ্ছি অথচ কিছুই দেখছি না, এমন অবস্থা কি আপনার কখনও হয় না?

তা হবে না কেন? সবসময়েই হয়। ভুলো মনের মানুষদের তো আরও বেশি করেই হয়। তবু আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল আপনি তাকাচ্ছেন এবং দেখছেনও। তাই ভয়ে আমি তাড়াতাড়ি বড় রাস্তায় এসে দক্ষিণের একটা বাসে উঠে পড়ি।

আপনি এরপর কী বলবেন আমি জানি। আপনি বলবেন যে ওই বাসে আমিও সওয়ার হয়েছিলাম, তাই তো?

যদি অন্তর্যামী না হয়ে থাকেন তবে তা-ই। হাসছেন যে! হাসছি কি আর সাধে? কাকতালীয় আর কাকে বলে! আমারও যে আজ দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জে আমার বড় মেয়ের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল। তার শাশুড়ির অসুখ। যাব যাচ্ছি করে আর যাওয়া হয়ে উঠছিল না। আজ গিন্নি একেবারে মাথার দিব্যি দিয়ে বললেন, না-যাওয়াটা খুবই দৃষ্টিকটু হচ্ছে। আমাদের কিছু হলেই ওরা এসে দেখা সাক্ষাৎ করে যান।

কাকতালীয় কথাটার অর্থ আমি কিন্তু সঠিক জানি না। কাক আর তাল মিলিয়ে শব্দটা যা দাঁড়ায় তার কোনও মানে হয় কি?

সত্যি কথা বললে বলতে হয়, আমিও জানি না। ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি তাই বলি। বাংলা ভাষাটা যাচ্ছেতাই। বরং ইংরিজি শব্দগুলো একটু বোঝা টোঝা যায়। তা আপনি তো ইংরিজির এমএ, কাকতালীয় কথাটার ইংরিজি কী হবে বলুন তো!

স্ট্রেঞ্জ কো ইনসিডেন্স।

বা! এই তো বেশ বোঝা গেল। স্ট্রেঞ্জ কোইনসিডেন্স!

না মশাই, বোঝা গেল না। বরং আরও ঘোরাল হল।

কেন বলুন তো!

আমি যে ইংরিজির এম.এ তা আপনি কি করে জানলেন?

মোটেই জানি না মশাই, আন্দাজে একটা ঢিল ছুড়লাম। লেগে গেল।

বটে! আন্দাজে ঢিল ছুঁড়তে থাকলে এক-আধটা লাগতে পারে, সবক’টা লাগে কি?

তাহলে মশাই, কথাটা আপনাকে ভেঙেই বলি।

আজ্ঞে, আমি তো তার জন্যই অপেক্ষা করছি।

আসলে কারও কোয়ালিফিকেশন বা বেতন কিংবা জাত জিগ্যেস করাটা ঘোর অভদ্রতা। তাই আমি কারও বেতন জানবার দরকার হলে তাকে গিয়ে বলি, আরে রামবাবু আপনি তো মাসে চল্লিশ হাজার টাকা বেতন পান, তাহলে বারো টাকার বেগুন কিনতে পিছোচ্ছেন কেন। তখন। রামবাবু বলে উঠলেন, কে বলল চল্লিশ? আমার বেতন মোটে বাইশ হাজার সাতশো টাকা। কিংবা কারও জাত জানবার দরকার হলে তাকে গিয়ে বললাম, ওঃ আপনারা বামুনরাই দেশটার সর্বনাশ করলেন মশাই। তাতে লোকটা একটু তেড়িয়া হয়ে বলল , মোটেই আমি বামুন নই, আমরা বদ্যি। তেমনি কারও কোয়ালিফিকেশন জানার দরকার হলেই আমি তাকে বলি, আরে, আপনি তো ইংরিজির এমএ বলুন দেখি এই শব্দটার ইংরিজি কী হবে। খুবই প্রাচীন এবং বহু। ব্যবহৃত কৌশল। কাজও ভালো দেয়। আচ্ছা, আপনি কি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন?

ফেলিনি। আপনা থেকেই বেরিয়ে গেল।

দীর্ঘশ্বাস ফেলার মতো কিছু ঘটছে কি?

ঘটেছে।

কী বলুন তো?

আমার বেতন চল্লিশ হাজার, আমি বদ্যি এবং ইংরিজির এমএ।

বলেন কি মশাই? এঃ, আজ তো দেখছি আমার লটারি মারার দিন ছিল। কেন যে একটা রয়াল ভুটানের টিকিট কেটে রাখিনি!

আপনার মতো বুদ্ধিমান লোকেরা লটারির টিকিট কেটে পয়সা রোজগার করার স্বপ্ন দেখে না। লটারির টিকিট কাটে বোকারা। আপনার মতো লোকেরা বুদ্ধি খাঁটিয়ে লটারির চেয়ে অনেক বেশি টাকা কামাতে পারে।

কেন যে আমাকে লজ্জায় ফেলছেন জানি না। কয়েকটা কাকতালীয় ব্যাপার থেকে এতটা ধরে নেওয়া কি ঠিক?

তা কাকতালীয় ব্যাপারগুলো আজ এমন হিসেব করে ঘটছিল যে ঘটনাগুলোকে নিতান্তই বেহায়া এবং বেশরম বলতে হয়। বাসটা যখন ল্যান্সডাউন দিয়ে যাচ্ছে তখন আমি দুশ্চিন্তায় রীতিমতো ঘামছি। আপনার হাত এড়ানোর জন্য আমি অগত্যা আচমকাই একটা স্টপে নেমে পড়লাম।

বুঝেছি! বুঝেছি! ওই ন্যাপার দোকানের সামনে তো! দেখুন যোগাযোগ আর কাকে বলে। মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছি অথচ খালিহাতে। গিন্নি পইপই করে বলে দিয়েছিলেন, ওগো বেয়াই বাড়িতে খালি হাতে যেও না কিন্তু, ভালো দোকান থেকে একশো টাকার ভালো মিষ্টি নিয়ে যেও। কথাটা একদম খেয়াল ছিল না। মনে পড়তেই ওই ন্যাপার দোকানের স্টপে নেমে পড়লাম।

হ্যাঁ, সেখানে একটা বড় মিষ্টির দোকান ছিল বটে।

থাকতেই হবে, নইলে নামব কেন?

কিন্তু মশাই, নেমে আপনি তো দাঁড়িয়ে দোকানের সাইনবোর্ড পড়তে লাগলেন, মিষ্টি তো কিনলেন না।

বলিনি বুঝি আপনাকে? আমারও দেখছি আপনার হাওয়া লেগেছে। জরুরি কথা বেমালুম ভুলে যাই। আসলে সমস্যা হল, আমার বেয়াইমশাই হলেন ব্লাড সুগারের রুগি। চারশোর নীচে সুগার মোটে নামেই না। কিন্তু মিষ্টি খাওয়ার এমনই লোভ যে ঠাকুরের বাতাসা অবধি চুরি করে খান। তাই সে বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে যাওয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। বাস থেকে নেমেই কথাটা মনে পড়ে গেল বলে আমি আর মিষ্টি কিনিনি।

ব্লাড সুগার খুবই খারাপ জিনিস। আমার বাবারও সম্প্রতি ধরা পড়েছে এবং তাঁরও খুব মিষ্টি খাওয়ার ঝোঁক।

তাহলেই বুঝুন, এক বর্ণ মিথ্যে বলিনি।

আপনি বলেনও ভারী আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। শুনলে বিশ্বাস করতে ইচ্ছেও করে।

তাই তো বলছি। সত্যি কথার একটা আলাদা জোর আছে। বিশ্বাস না করেই পারা যায় না।

আপনার বড় মেয়ের শ্বশুরবাড়িটা কোথায় যেন?

সাউথে।

সাউথ তো বিরাট জায়গা। বেহালা, টালিগঞ্জ, গড়িয়া, কসবা। শুধু সাউথ বললে কিছুই বোঝা যায় না।

কথাটা আপনি খারাপ বলেননি। সাউথ কথাটা ভারী গোলমেলে। আজকাল তো সোনারপুর টুরও শুনি সাউথের মধ্যে চলে এসেছে। কলকাতা শহরের পরিধি যে শেষ অবধি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেইটেই বোঝা যাচ্ছে না। বাসন্তী, গোসাবা, সবই না শেষে কলকাতার মধ্যে চলে আসে।

খুব ঠিক কথা। সাউথ ক্রমশ স্ফীত হচ্ছে। নর্থও হাত পা গুটিয়ে বসে নেই। মধ্যমগ্রাম, বিরাটি, বারাসাত, রাজারহাট ছাড়িয়ে সেও ধাওয়া করেছে উত্তর চব্বিশ পরগনা গ্রাস করে নিতে।

আপনি তো ছোঁকরা মানুষ। আমরা একটু বয়স্করা তো দেখেছি। ওই যে আপনাদের ঝাঁ চকচকে সল্ট লেক সিটি, একসময়ে কী অখদ্দে জায়গাই না ছিল। সাপ গোসাপের আড্ডা, জলা, ভেড়ি। আমরা তো বলতাম বাদা অঞ্চল। এখনও সেখানে মাঝে মাঝে সাপখোপ বেরোয়।

শেয়ালের ডাকও শোনা যায়।

আগে এই লেকেই কত শেয়াল ছিল। আমাদের আমলের কথা বলছি।

আপনার বয়স কত?

সাতান্ন।

প্লাস?

ওসব প্লাস মাইনাস ঠিক বুঝতে পারি না। গত শ্রাবণে সাতান্ন কমপ্লিট করেছি। সার্টিফিকেটে অবশ্য দু-বছর কমানো আছে।

আপনাদের আমলে বয়স কমানোর একটা ব্যাড হ্যাবিট ছিল, তাই না?

হ্যাঁ, তা ছিল। ছেলে যাতে বেশিদিন চাকরি করতে পারে। মেয়ে যাতে বুড়ি হলেও হুঁড়ি থাকে তার জন্যই বয়স কমানো হত।

ব্যাপারটা কিন্তু মিথ্যাচার।

তা তো বটেই।

তবু আপনারা যাঁরা বয়স্ক তাঁরা নিজেদের আমলের পঞ্চমুখে প্রশংসা করেন।

ও হল নস্টালজিয়া। আপনিও বয়স হলে এই আমলের প্রশংসা করবেন।

বয়স তো আমার কিছু কম হল না!

তাই নাকি? আমার হিসেবমতো আপনার বয়স ঊনত্রিশ বছর দু-মাস হতে পারে।

কত বললেন?

উনত্রিশ বছর দু-মাস। খুব আন্দাজেই বলছি।

দাঁড়ান মশাই, হিসেব করে দেখি। আমারও তো অত অ্যাকিউরেট হিসেব করা নেই কিনা। দাঁড়ান। জাস্ট এ মিনিট।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, সময় নিন না। এখনও বেশি রাত হয়নি। মোটে তো আটটা বাজে।

আপনাকে কিন্তু পুলিশে দেওয়া উচিত।

কেন মশাই, কী করলাম?

আমার বয়স সত্যিই ঊনত্রিশ বছর দু-মাস। কিন্তু আপনি সেটা কী করে জানলেন?

জানার প্রশ্ন উঠছে না। চেহারা দেখেই বয়স অনুমান করা যায়।

তা যায়। কিন্তু এতটা অ্যাকুরেট ক্যালকুলেশন করা যায় না।

তাও যায়। আমার মনে হচ্ছিল আপনার বয়স আঠাশ থেকে ত্রিশের মধ্যেই হবে। তাই একটা মাঝামাঝি রফা করে নিয়ে বলে দিলাম। তা সেটা লেগেও গেল দেখছি। এক-একদিন এরকম হয় মশাই, মানুষের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বা তৃতীয় নয়ন যা-ই বলুন, বেশ ভালো কাজ করতে থাকে।

ভালো কথা, আপনার বড় মেয়ের শ্বশুরবাড়িটা কোথায় যেন বলছিলেন।

সাউথে। এখান থেকে কাছেই।

সাউথে এবং এখান থেকে কাছেই–এই কথা দুটোর কোনও অর্থ হয় না।

কেন মশাই, বাংলা কথাই তো।

হ্যাঁ, কিন্তু ও থেকে কিছু বোঝা যায় কি?

আহা, বুঝবার দরকারটাই বা কি? আমার বড় মেয়ের শ্বশুরবাড়ি দিয়ে আমাদের তো কোনও প্রয়োজন সিদ্ধ হবে না।

হবে। কারণ, আপনি সেখানেই যাবেন বলে বেরিয়ে শেষ অবধি সেখানে যাননি। আমার মৌটুসির শ্বশুরবাড়ি বালিগঞ্জেই এবং আমার সেখানেই যাওয়ার কথা ছিল বটে। কিন্তু হঠাৎ মনে। পড়ে গেল যে, তার চেয়েও একটা জরুরি কাজ আমার আছে।

সেটা কি টালিগঞ্জের মেজো মেয়ে মৌবনের শ্বশুরবাড়িতে যাওয়া!

আশ্চর্য! অতি আশ্চর্য! বয়সে নিতান্তই আমার ছেলের বয়সি না হলে আমি আপনাকে একটা নমস্কার জানাতাম।

কেন মশাই, আমি তেমন ভালো কাজ তো কিছু করিনি!

করেছেন বইকী! আমার মেজো মেয়ের নাম যে মৌবন সেটা আপনার জানার কথাই নয়। এমনকী আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হল তার শ্বশুরবাড়ি যে টালিগঞ্জে সেটাই বা আপনি জানলেন কী করে?

জানি না মশাই, আমি কিছুই জানি না। আপনি কী-কী অজুহাত দিতে পারেন তা আন্দাজ করতে গিয়ে যা মুখে এসেছে বলে দিয়েছি। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বা তৃতীয় নয়ন কিছুই আমার নেই।

কিংবা একটু বেশি মাত্রাতেই আছে। আমার মেজো মেয়ের নাম বা তার শ্বশুরবাড়ি কোথায় তা ঠিকঠাক বললেও একটা জায়গায় আপনার ভুল হচ্ছে। আমি কিন্তু বড় মেয়ের বদলে মেজো মেয়ের বাড়িতে যাচ্ছিলাম না। আসলে হঠাৎ মনে পড়ে গেল, মহেন্দ্র সিং নামে একটা লোকের কাছে আমি ছ’হাজার টাকা পাই। লোকটা অনেকদিন ধরে লেজে খেলাচ্ছে। গতকালই তাকে তার মোবাইল ফোনে ধরে কিছু হুমকি দেওয়াতে সে টাকাটা আজই দিয়ে দেবে বলে কথা। দিয়েছে। অধমর্ণদের তো জানেন, যতক্ষণ পারে টাকাটা আটকে রেখে সুদে খাঁটিয়ে দেয়। তা কথাটা মনে পড়তেই আমি গন্তব্য বদল করে মহেন্দ্র সিং-এর কাছেই যাচ্ছিলাম।

কিন্তু যাননি।

কেন যাইনি তারও গভীর কারণ আছে। মহেন্দ্র সিং ল্যান্সডাউনের একটা গলিতে থাকে। ন্যাপার দোকান থেকে একটুখানি পথ। যাব বলে পা বাড়িয়েই হঠাৎ দেখি মহেন্দ্র, পাশে তার বউ।

আপনি কি চেঁচিয়ে মহেন্দ্র সিংকে ডেকেছিলেন?

আহাম্মক হলে ডাকতাম। মহেন্দ্র সিং-এর গাড়ি এয়ারকন্ডিশন, জানলার কাঁচ আঁট করে বন্ধ ছিল।

তারপর?

তারপর আর কী? তারপর অগত্যা কিছুক্ষণ হাঁটা।

হ্যাঁ। আমার পিছু পিছু।

শুধু আপনি কেন, আমার সামনে আরও অনেক লোক হাঁটছিল।

আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, এত জরুরি কাজ ফেলে অবশেষে আপনি এই লেক-এর ধারে এসে বসে আছেন কেন? আপনি কি জানেন, আপনার জন্য আজ দুপুরে আমার খাওয়া হয়নি?

আপনি কি আমাকে আজ দুপুরে খেতে দেখেছেন?

না, তা দেখিনি।

আমারও আজ দুপুরে খাওয়া হয়নি। কাছেই সার্দান অ্যাভনিউয়ে একটা ভালো চিনে রেস্তোরাঁ আছে। যাবেন নাকি?

এটা কি আরও একটা ষড়যন্ত্র?

খিদের মধ্যে ষড়যন্ত্রের কী আছে বলুন। আপনি আমার ওপর একটু ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন, তাই আমার খুব ইচ্ছে করছে আপনাকে কিছু খাওয়াই। চাইনিজ তো আপনি ভালোই বাসেন।

না মশাই, আমার অ্যাপেটাইট নেই। ধন্যবাদ।

প্রেমে পড়লে দুরকম হতে পারে। কারও খুব খিদে হয়, আবার কারও একদম খিদে থাকে। দুটোই এক্সট্রিম।

কিন্তু আমি প্রেমে পড়িনি তো!

দেশবন্ধু পার্কে রোজ সকালে যে স্বপ্নের মতো একটা মেয়ে ঘুরে বেড়ায়, তার দিকে কি আপনি খুব হতাশ চোখে চেয়ে থাকেন না?

অ্যাঁ!

আহা লজ্জা পাওয়ার কী আছে বলুন তো! আপনি তো আপনার প্রিয় বন্ধুদের বলেইছেন যে ওই স্বপ্নের মতো মেয়েটি এতটাই স্বপ্নের মতো যে, আপনি আজ অবধি তার সঙ্গে ভরসা করে। কথাটাও বলে উঠতে পারেননি। আর যতই তাকে দেখেছেন ততই মেয়েটিকে আরও অধরা মনে হচ্ছে। আপনার নাকি ধারণা হয়েছে মেয়েটি রিয়াল নয়।

ইয়ে…দেখুন…এসব…

ঘাবড়ানোর মতো কিছু তো নয়। এরকম তো হতেই পারে। প্রেমে পড়লে অনেক সময় আত্মবিশ্বাস কমে যেতে থাকে। কত কী মনে হয়। মনে হয়, আমি তো কুচ্ছিৎ, আমি তো আনস্মার্ট, আমি তো ভিতু, আমি তো মোটেই ওর যোগ্য নই, আমাকে নিশ্চয়ই পাত্তা দেবে না। হয় না বলুন!

ইয়ে, মানে আমি…

আহা, আরও একটু ধৈর্য ধরে শুনুন না।

আপনি এসব কী করে…

ওটা কোনও কথা নয়। ঘটনাটা সত্যি কি না সেটাই আসল কথা। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নাকি?

হ্যাঁ। আসলে ও মেয়েটা সত্যিকারের রক্তমাংসের মানুষ নয়।

তাহলে তো চিমটি কেটে দেখতে হয়।

ছিঃ, কী যে বলেন! কিন্তু আপনি কী করে এসব…?

রবার্ট ব্লেক এজেন্সির নাম শুনেছেন?

রবার্ট ব্লেক এজেন্সি? না তো! তারা কারা?

একটা প্রাইভেট গোয়েন্দা সংস্থা।

ও বাবাঃ হঠাৎ তাদের কথা কেন?

আপনার সম্পর্কে গত এক মাসে তারাই সব তথ্য সংগ্রহ করেছে।

ও বাবা! কেন?

গূঢ় কারণ আছে যে!

কী কারণ?

ওই মেয়েটিই।

ওই মেয়েটি। কেন, সে কি আমাকে পুলিশে দিতে চায়? কিন্তু শুধু তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমি তো আর কোনও অসভ্যতা করিনি! তা ছাড়া, আমি ড্যাবড্যাব করেও তো চেয়ে থাকি না। খুবই বিশুদ্ধ চোখে তাকে আলতোভাবে দেখি। হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন, আমি খুব হতাশা নিয়েই চেয়ে থাকি। কারণ, তাকে আমার মর্তের মানবী বলেই মনে হয় না। কিন্তু আমি তাকে কখনও ডিস্টার্ব করিনি।

করেছেন বইকি! ডিস্টার্ব না করলে এত জলঘোলা করার দরকারই হত না।

তাহলে ঠিকই ধরেছিলাম। আপনি পুলিশের লোক।

আমি কথাটা অস্বীকার করছিনা।

মেয়েটি কি আমার নামেই অভিযোগ করেছে?

আপনার নামেই।

আর কেউ নয় তো! মানে অনেক দুষ্টু লোক তো থাকে, সুন্দর মেয়েদের পিছনে লাগে। ওরকম কারও সঙ্গে আমাকে গুলিয়ে ফেলেনি তো!

না। লম্বা, ফরসা, হ্যান্ডসাম, বাঁ-গালে আঁচিল। আপনিই।

বুঝেছি। আমাকে অ্যারেস্ট করার আগে আমি আপনাকে একটা অনুরোধ করতে পারি কি?

পারেন।

আমাকে দয়া করে ইভ টিজার হিসেবে অ্যারেস্ট করবেন না। সেটা লজ্জার ব্যাপার হবে। আমাদের পরিবারটি সম্ভ্রান্ত, তাদেরও মান থাকবে না। দয়া করে আমাকে একজন উগ্রপন্থী বা তোলাবাজ বা সাট্টা ডন যা খুশি অভিযোগে গ্রেফতার করুন। ইভ টিজারের চেয়ে এসবও বরং ভালো।

তার মানে আপনি ইভ টিজিং-এর মতো পেটি ক্রাইমের আসামি হতে চান না! কিন্তু অভিযোগ করলেই তো হবে না। অভিযোগ প্রমাণ হবে কীসে?

আমি অভিযোগ স্বীকার করে নেব।

ও বাবা! আপনি তো ডেনজারাস লোক মশাই!

বিশ্বাস করুন, ইভ টিজার হিসেবে আমাকে আদালতে তুললে আমার মা বাবা আমার আর মুখদর্শন করবে না। মেয়েটা হয়তো আমাকে খানিকটা শাস্তি দিতে চায়। তা যে কোনও অভিযোগে আমি কিছুদিন জেল খাটলেই তো হল! কী বলেন?

কথাটা ভেবে দেখতে হবে।

পুলিশ তো ঘুষটুষ খায়, তাই না? এ বাবদে না হয় আমি দু-পাঁচ হাজার টাকা দেব।

বলছেন?

বলছি বলে কিছু মনে করবেন না যেন। খারাপ ভেবে বলিনি। চাইনিজ খেতে চাইছিলেন, চলুন আজ আপনাকে আমিই না হয় খাওয়াচ্ছি।

সেটা কি খুবই খারাপ দেখাবে না? আমি বয়সে বড়, সম্পর্কেও বড়।

বয়সে বড় মানছি। কিন্তু সম্পর্কেও বড়টা বুঝতে পারলাম না। তা সে না হয় না-ই বা বুঝলাম। চলুন, যাওয়া যাক।

আরে মশাই, ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? কথাটা আগে খোলসা হোক।

বেশ খোলসা হোক। আপনি কত চান?

সেটা পরে ঠিক করা যাবে। তার আগে আজকের চাইনিজ ডিনারের দামটা কার দেওয়া উচিত সেটা পরিষ্কার হওয়া দরকার।

আমিই দেব।

সেটা যে হয় না।

কেন হয় না?

তাহলে একটু ব্যাকগ্রাউন্ডটা যে আপনার জানা দরকার।

ওর আর ব্যাকগ্রাউন্ড কী?

আছে মশাই। ব্যাকগ্রাউন্ড হচ্ছে ভোরবেলার দেশবন্ধু পার্ক। সেখানে আপনি একখানা বেঞ্চে বসে থাকেন আর সামনে একটা স্বপ্নের মেয়ে ঘুরে বেড়ায়, তাই তো?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

আপনি বলছেন মেয়েটাকে আপনি ডিস্টার্ব করেন না!

আজ্ঞে না।

অথচ মেয়েটা বলছে আপনি ওকে রীতিমতো ডিস্টার্ব করছেন।

যে আজ্ঞে।

ডিস্টার্ব করা বলতে আপনি কী বোঝেন?

পিছু নেওয়া, সিটি দেওয়া, ফলো করা, মন্তব্য ছুঁড়ে দেওয়া। চিঠিচাপাটি পাঠানো। এইসব আর কি।

আরও একরকমভাবে ডিস্টার্ব করা সম্ভব।

সেটা কীভাবে?

আপনি এক্সটারনালি মেয়েটিকে ডিস্টার্ব করেননি ঠিকই। কিন্তু ইন্টার্নালি হয়তো করেছেন। হয়তো নয়, করেছেনই।

আজ্ঞে না।

কী করে বুঝলেন করেননি? আপনি কি মেয়েটির মনের ভেতরটা দেখেছেন?

আরে না। মেয়েটা তো আমাকে কখনও লক্ষই করেনি। যে আমাকে লক্ষই করেনি তাকে আমার পক্ষে মানসিক উৎপীড়ন করা কি সম্ভব?

সম্ভব।

কীভাবে?

উৎপীড়ন না বলে যদি নাড়া দেওয়া বলি তাহলে কেমন হয়?

নাড়া দেওয়া! এ কথাটার অর্থ কি একটু আলাদা হয়ে যাচ্ছে না?

তা যাক না। ধরুন সেটাই হয়েছে।

একটু বুঝিয়ে বলুন।

খুব সাদামাটা কথায় বললে বলতে হয় পারিজাতবাবু, আপনি যেমন আড়চোখে মেয়েটিকে লক্ষ করেছেন তেমনভাবে মেয়েটিও আপনাকে লক্ষ করেছে। এবং সে একটু নাড়া খেয়েছে। এবং তারও মনে হয়েছে তার স্বপ্নের পুরুষটি রোজ সকালে নিতান্ত ভদ্র এবং কাপুরুষ বলে কখনও মেয়েটিকে হৃদয়ের কথা জানাতে পারেনি। অগত্যা মেয়েটি তার ছোটকাকার শরণাপন্ন হয়। ছোটকাকা ডাকসাইটে পুলিশ অফিসার। সে ওই রবার্ট ব্লেক এজেন্সিতে ছেলেটি সম্পর্কে খোঁজ খবর সংগ্রহ করতে লাগায়। সংগৃহীত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, পারিজাত সেনগুপ্ত মেধাবী, কৃতবিদ্য, লম্বা বেতন, সম্ভ্রান্ত পরিবারওলা ছেলে। কাপুরুষ সন্দেহ নেই। কিন্তু বরণীয়া। আপনার চোখ ছলছল করছে কেন?

বিশ্বাস হচ্ছে না।

আপনি আজ সকাল থেকে আগাগোড়াই আমাকে অবিশ্বাস করে আসছেন।

এখনও করছি। তবে ডিনারের বিলটা আপনি দিলে আমি আপত্তি করব না।

তাহলে চলুন, ওঠা যাক। এখন খিদে পাচ্ছে, তো?

হ্যাঁ, এখন বেশ খিদে হয়েছে ছোটকাকা।

No comments