জামাইয়ের শ্বশুরবাড়ি যাত্রা – জসীম উদ্দীন

জামাইয়ের শ্বশুরবাড়ি যাত্রা – জসীম উদ্দীন

বিবাহের পর ছেলেটি এই প্রথম তার শ্বশুরবাড়ি যাবে। সে গোপনে কিছু টাকা-পয়সা সংগ্রহ করে বউ এর জন্য একটি শাড়ি, কয়েকগাছা চুড়ি আর একছড়া পুঁতির মালা কিনে সঙ্গে নিল।

যাওয়ার সময় মা উপদেশ দিলেন, বাবা! শ্বশুরবাড়ি যেতে কাউকে সঙ্গে নিবে না। আর সেখানে গেলে তোমার শাশুড়ি তোমাকে নানারকম জিনিস খেতে দিবে, কিন্তু তুমি যদি তার সব খাও, লোকে বলবে, জামাই একটা পেটুক। তাই শাশুড়ি কিছু পাতে দিতে গেলেই প্রথমে, না, না বলবে।”

ছেলে মায়ের সকল কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে, এই প্রতিজ্ঞা করে শ্বশুরবাড়ির পথে রওয়ানা হল।

তখন ছিল দুপুরবেলা। পথ চলতে চলতে বেলা গড়িয়ে পড়ল। সে পিছন ফিরে দেখল, তার সঙ্গে সঙ্গে ছায়া আসতেছে। এতক্ষণ সূর্য মাথার উপর ছিল বলে সে আগে তাঁকে দেখে নাই।

সে ছায়াকে বলতে লাগল, “ছায়া! তুই বাড়ি ফিরে যা। জানিস তো, মা আমাকে একলা শ্বশুরবাড়ি যেতে বলেছে। তুই আমার সঙ্গে আসিস না।”

ছায়া তবু তার সঙ্গে সঙ্গে আসে। ছেলেটি আরও অনুনয় বিনয় করে বলে, “ছায়া তুই আমার ভাই হবি? বন্ধু হবি? আমার গাই বিয়াইলে তার দুধ দিয়ে তোকে লাড়ু বানিয়ে দিব। উড়কি ধানের মুড়কি খেতে দিব। আম কেটে দিব, কাঁঠাল ভেঙ্গে দিব। তুই ডালে বসে খাইস। দেখ তুই আমার সঙ্গে আসিস না।”

ছায়া তবু তার পাছ ছাড়ে না।

ছেলেটি আবার বলে, “ছায়া! সোনা মানিক! তুই যদি এমন করে আমার পাছ নিবি, তবে যে আমার শ্বশুরবাড়ি যাওয়া হয় না।”

ছায়া তবু তার সঙ্গে সঙ্গে আসে। ছেলেটি তখন বউ-এর জন্যে যে একছড়া পুঁতির মালা নিয়ে এসেছিল, তাই পথের মধ্যে ফেলে দিয়ে বলল, “ছায়া! তুই এই মালাটি নিয়ে বাড়ি ফিরে যা। আমার সঙ্গে আসিস না।”

তখন একখণ্ড মেঘে সূর্য ঢাকা পড়েছিল। ছেলেটি পিছন ফিরে চেয়ে দেখল, ছায়া তার সঙ্গে সঙ্গে আসতেছে না। সে খুশি হয়ে জোরে জোরে পা ফেলে শ্বশুরবাড়ির দিকে হেঁটে চলল।

কতক্ষণ পরে সূর্যের উপর হতে মেঘ সরে গেল। ছেলেটি পিছন ফিরে চেয়ে দেখে, ছায়া আবার এসে তার পাছ নিয়েছে।

ছেলেটি বলল, “ছায়া! তুই আবার আমার সঙ্গে সঙ্গে আসতেছিস! আমার বউ এর জন্য দুই জোড়া কাঁচের চুড়ি নিয়ে এসেছি। তুই তাই নিয়ে বাড়ি ফিরে যা। আর আমার পিছু নিস না।”

এই বলে সে দুই জোড়া চুড়ি পথের মধ্যে ফেলে দিল। তখন সে একটি বনের মধ্যে এসে পড়েছিল। সে পিছন ফিরে চেয়ে দেখল, ছায়া তার সঙ্গে সঙ্গে আসতেছে না। ছেলেটি আরও জোরে জোরে পথে চলতে লাগল।

খানিক চলে বনের পথ শেষ হল। এবার পথের উপর বিকালের রোদ উঠেছে। ছেলেটি পিছন ফিরে চেয়ে দেখল, ছায়া এবার আরও বড় হয়ে তার পাছে পাছে আসতেছে।

ছেলেটি তখন আরও অনুনয় বিনয় করে বলল, “ছায়া! তোকে আমি পুঁতির মালা দিলাম, দুই জোড়া চুড়ি দিলাম, তবু তুই আমার পাছ ছাড়লি না? আর ত আমার কাছে একখানা শাড়িমাত্র আছে। তাও যদি তোকে দেই, তবে বউ এর কাছে কি নিয়ে হাজির হব? ছায়া! সোনা মানিক! তুই বাড়ি ফিরে যা।”

ছায়া তবু যায় না। তখন শাড়িখানা পথে ফেলে দিয়ে সে বলল, “ছায়া! শাড়িখানা নিয়েই তুই বাড়ি ফিরে যা।” এবার বেলা ডুবডুবু। সন্ধ্যা হয় হয়। ছেলেটি পিছন ফিরে দেখল, ছায়া চলে গিয়েছে। সে জোরে পা ফেলে নানা পথ ঘুরে শ্বশুরবাড়ি এসে উপস্থিত হল।

জামাই শ্বশুরবাড়ি এসেছে। শাশুড়ি কত রকমের খাবার তৈরী করেছে। কিন্তু খেতে বসে জামাই মায়ের উপদেশ মনে মনে আওড়াতে লাগল।

মা বলে দিয়েছিলেন, “শ্বশুরবাড়ি গিয়ে কম করে খাবি।”

শাশুড়ি জামাইকে খাওয়াতে বসে তার পাতে এটা দেয়—ওটা দেয়।

জামাই কেবল বলে, “না! না!! আর দিবেন না।”

শাশুড়ি ভাবল, জামাইর বুঝি অসুখ করেছে। তাই সে আর পীড়াপীড়ি করল না। জামাই না খেয়েই খাওয়া শেষ করল।।

রাত্রে শুতে গিয়ে ক্ষুধার জ্বালায় জামাইর আর ঘুম আসে না। জোর করে শাশুড়ি জামাইর পাতে যেসব বড় বড় গোস্তের টুকরা, সন্দেশ, রসগোল্লা, দই, মিষ্টি ইত্যাদি কত রকমের খাবার দিয়েছিল, জামাই না খেয়ে সেগুলি পাতে ফেলে রেখেছিল। তারাই যেন রাতের অন্ধকারের উপর মিছিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জামাইর ক্ষুধার্ত জিহ্বা হতে টস্ টস্ করে পানি পড়িতে লাগল। রাত্রি অনেক হল; কিন্তু দারুণ ক্ষুধার জ্বালায় কিছুতেই তার ঘুম আসে না! বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। কুকুর বিড়ালও জেগে নাই।

জামাই ভাবে, নিশ্চয়ই রান্নাঘরে এখনও অনেক কিছু খাবার পড়ে আছে। সে পা টিপে টিপে অতি ধীরে ধীরে ঘর হতে বাহির হল। ভয়ে তার বুক ঢিবঢিব করছে। মনে হচ্ছে, তার নিশ্বাস-প্রশ্বাস শুনেও লোক জেগে উঠতে পারে। আস্তে আস্তে পা ফেলে সে রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। হায়, হায়, ঘরের দরজা যে বাহির হতে শিকল আটকানো! দম বন্ধ করে সে অতি সাবধানে সেই শিকল খুলে রান্নাঘরের ভিতরে প্রবেশ করল।

এ হাঁড়িতে পেয়াজ-রসুন,- ও পাতিলায় মুগের ডাল, ওখানে মাছকাটা বঁটি। অন্ধকারে হাতড়িয়ে কিছুই ভালমতো বোঝার যো নাই।।

একটি হাঁড়ির ঢাকনি খুলতে কতকগুলি মুরগির ডিম তার হাতে লাগল। একে তো দারুণ ক্ষুধা—তার উপর খাওয়ারও অন্য কিছু নাই; সে তাড়াতাড়ি দুই তিনটি ডিম উঠাইয়া মুখে পুরিল, এমন সময় অসাবধানে হাত নাড়তে একটা হাঁড়ি আর একটা হাঁড়ির উপর পড়ে শব্দ করে ভেঙ্গে গেল।

অমনি বিড়াল ম্যাও ম্যাও করে ডেকে উঠল। বিড়ালের ডাক শুনে উঠান হতে বাঘা কুকুরটি ঘেউঘেউ করে তেড়ে আসল। শ্বশুর জাগল, শাশুড়ি জাগল, শালা-শালী সবাই জেগে কলরব করে উঠল। এ বাড়ি হতে, ও বাড়ি হতে, সে বাড়ি হতে, কেহ লাঠি নিয়ে, কেহ সড়কি নিয়ে, কেহ রামদা নিয়ে ছুটে আসল। চোর! চোর! চোর! বাড়িতে চোর ঢুকেছে!

সকলে এসে দেখল রান্নাঘরের দরজা খোলা। নিশ্চয় চোর রান্নাঘরেই লুকিয়ে আছে।

“ধর–ধর—চোর ধর।”

সকলে রান্নাঘরে এসে দেখল, জামাই ডিমের হাঁড়ির সামনে বসে কাঁপছে।

শ্বশুর ডাকে “ও জামাই কি হয়েছে?”

জামাই কোনো কথাই বলে না।

শাশুড়ি কেঁদে উঠল, “হায়! হায়! আমার জামাই বুঝি আর বাঁচবে না!”

বাড়ির কাছে ছিল এক নাপিত-ডাক্তার। তাঁকে ডেকে আনা হল। সে জামাইর হাতের নাড়ি পরীক্ষা করল–বুকের ঢিবঢিবানি গুনে দেখল, কিন্তু রোগের কোনো লক্ষণই খুঁজে পেল না। তারপর জামাইর মুখের দিকে চেয়ে দেখল, তার মুখ ফুলে রয়েছে।

অনেক ভেবে চিন্তে নাপিত বলল, “জামাইর মুখে ফোঁড়া হয়েছে। তাই জামাই কথা বলতে পারছে না। ফোঁড়া কেটে দিলেই জামাই কথা বলবে।”

এই বলে সে ঘচাঘচ করে তার ক্ষুরে ধার দিতে লাগল। ক্ষুর ধার দেওয়ার শব্দ যেন জামাইকে টুকরা টুকরা করে কাটতে লাগল। অনেকক্ষণ ধার দিয়ে নাপিত জামাইর মুখে যেই ক্ষুর ধরতে যাচ্ছে, তখনি জামাই বলে উঠল, “আমি ডিম খাই নাই।”

অমনি জামাইর মুখ হতে দুই তিনটি ডিম বের হয়ে আসল। লোকজন, পাড়াপড়শি সকলই বুঝতে পারল।

শাশুড়ি তাড়াতাড়ি জামাইকে খাওয়াতে অন্য ঘরে নিয়ে গেল।

No comments