ফানুস – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

ফানুস – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

ফানুস – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

সেবার কালীপূজায় আমি আর পিন্টু ঠিক করলুম, ঠিক সূর্য্যাস্তের সময় আমাদের বাড়ির দোতলার ন্যাড়া ছাদ থেকে রংবেরং-এর বিশাল একটা ফানুস ছেড়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দেব। পিন্টুর বাবাকে আমরা কাকাবাবু বলতাম। কাকাবাবু সব জানতেন। তিনি কেমিস্ট ছিলেন। বাড়িতে একটা ছোট ল্যাবরেটরিও ছিল। ছুটির দিন মাঝে মাঝে মনমেজাজ ভালো থাকলে আমাদের ডেকে ডেকে নানা কেরামতি দেখাতেন। আগের বছর আমাদের একটা হাউইয়ের ফর্মুলা দিয়েছিলেন। ফর্মুলার কোনও দোষ ছিল না। আসলে খোলটা আমরা ঠিকমতো তৈরি করতে পারিনি। পারলে হাউই আকাশের ব্রহ্মতালু ভেদ করত নিশ্চয়ই। খোলের দোষে রকেট আকাশে উঠে বোতলসুদ্ধ ছাদে শুয়ে শুয়েই ফুলকি কেটেছিল। কাকাবাবু বলেছিলেন, টেরিফিক ফোর্স হয়েছে হে, তবে সাধারণ কাগজের খোল বলে কেতরে পড়েছে। যে কাগজে নোট তৈরি হয়, সেই পার্চমেন্ট কাগজের খোল তৈরি করতে পারলে দেখতে কাণ্ডটা হত কী!

ফানুসের খোলা নিয়েও প্রথমে সমস্যা হল। বিশাল একটা খোল চাই এস্কিমোদের ঘরের মতো। ধোঁয়া ঢুকবে সেই খোলে তবেই না তিনি আকাশে উঠবেন হেলে-দুলে। এসব ব্যাপারে চীনেরা ভারি এক্সপার্ট। তারা ড্রাগন করে, লণ্ঠন করে, হাতি করে। কাগজ দিয়ে তারা কী না করতে পারে। আমাদের দৌড় ঠোঙা পর্যন্ত। চীনে গুরু পাই কোথায়, পাড়ায় একটিমাত্র চিনের জুতোর দোকান। হাফা-সায়েব আবার এ-সব জানেন না। তাঁর মা জানতেন, তিনি দু-বছর আগে মারা। গেছেন।

ঠোঙা তৈরির বিদ্যে নিয়েই আমি আর পিন্টু বসলুম খোল বানাতে। ঘুড়ির কাগজ, এক বালতি আঠা আমাদের কাঁচামাল। তৈরি হবে গোলগাল খোল।

পিন্টু বলল, মোহনবাবুর চেহারাটা মনে রাখ। মোহনবাবুর পা-দুটো হেঁটে মাথাটা নীচু করে দিলে যে চেহারাটা হবে, আমাদের খোলটা হবে ঠিক সেই রকম। মোটা মোহনবাবুর জ্যামিতি নিয়ে পিন্টুদের বাড়ির বাইরের ঘরের মেঝেতে থেবড়ে বসে বেশ কিছুক্ষণ আমাদের গবেষণা চলল।

পিন্টু বলল, আসলে আমাদের একটা গোল জালা বানাতে হবে। গলার দিকটা সরু, মোহনবাবু

চিত হয়ে শুয়ে থাকলে তাঁর ভুঁড়িটা যেরকম দেখায়, ওই রকম দেখতে হবে।

সবই তো বোঝা গেল। হাতের কাছে চার দিস্তে ঘুড়ির কাগজ, কাঁচি, আঠাও রেডি; কাটাকুটি শুরু করলেই হয়। সাহসের অভাব।

পিন্টু বললে, এক কাজ করি চল, মানদামাসির কাছে একবার যাই। ঠোঙা তৈরির কায়দাটা শিখতে পারলেই মোটামুটি যা হয় কিছু একটা দাঁড়াবে।

মানদামাসি সারাদিনে হাজার হাজার ছোটবড় ঠোঙা তৈরি করে সংসার চালান। মাঝে মাঝে তাঁর পেয়ারের ছাগল ঠোঙা খেয়ে ফেলে। ছাগলের নাম বুধি। যদিও তার বুদ্ধিসুদ্ধি কিছু আছে কি না আমাদের সন্দেহ।

আমরা যখন মাসির বাড়ি গেলুম, বুধিকে নিয়ে মাসি তখন ভীষণ ব্যস্ত। বুধি একবাটি আঠা সহযোগে একদিস্তে খবরের কাগজ দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে চোখ উলটে পড়ে আছে। ঘটনাটা ঘটিয়েছে দড়ি ছিঁড়ে, মাসি যখন পুকুরে, তখন।

মাসি বুধিকে বলছেন ওঠ, বাবা ওঠ, যোয়ানের আরকটুকু খেয়ে নে মা, ঠিক হজম হয়ে যাবে। ও বুধি, বুধি!

ছাগলের চোখ এমনিই কী রকম ড্যাব ড্যাবা মরামানুষের মতো, তায় কাগজ খেয়ে মনে হচ্ছে যেন বোল্ড-টাইপে ছাপা শ্রাদ্ধের চিঠি।

মাসির কাছে কাজ আদায় করতে এসেছি, মাসির কাজে সাহায্য করলে, মনটা যদি একটু ভেজে।

আমরাও বুধির সেবায় লেগে গেলুম। পিন্টু চোয়াল ধরে হাঁ করাবার চেষ্টা করছে। আমি আস্তে আস্তে গায়ে হাত বুলিয়ে তোয়াজ করার চেষ্টা করছি। জুতোর চামড়ায় কি আর সুড়সুড়ি লাগে, বুধির চোয়াল ফাঁক করে কার পিতার সাধ্য! অথচ মাসিকে ছাগল-ছাড়া না করলে আমাদের কাজ বন্ধ। বুধি হঠাৎ তড়াক করে লাফিয়ে উঠে আমাদের সব কটাকে চার ঠ্যাঙের মোক্ষম লাথি। ঝেড়ে, আরকের বাটি উলটে দিয়ে, মাসির শোবার ঘরে ঢুকে গেল।

মাসি ধুলো ঝেড়ে মাটি থেকে উঠে আমাদের হাত ধরে তুলতে তুলতে বললেন, লাথির জোর দেখলি? তারপর একমুখ হেসে বললেন, আমার দুষ্টু মেয়ে। পিন্টুর কপালের কাছটা লাল হয়ে ফুলে উঠেছে।

মাসি বললেন, তোদের লাগল নাকি?

আমরা দুজনেই কাঁদো কাঁদো গলায় বললুম, বড় লেগেছে মাসি, ফ্যাকচার হয়ে গেছে। আহা বাছা রে! কী করতে পোরা এইছিলিস?

তোমার কাছে শিখতে। হায় কপাল! আমি কী জানি যে তোদের শেখাব রে! না জানি লেখাপড়া, জানি নাচগান। আমি যে তোদের মুখ মাসি রে।

তুমি যা জানো, আমরা জানলে আজ বর্তে যেতুম।

ধুর পাগল। তোদের মাসি একটা অপদার্থ।

ওসব বোলো না মাসি, আমরা কিন্তু রেগে যাচ্ছি। তুমি আমাদের ফানুসের খোল তৈরি করে দেবে। ঘুড়ির কাগজ কিনেছি, আঠা তৈরি করেছি, তুমি ছাড়া আমাদের কে আছে মাসি!

গ্রামের একপাশে মানদামাসির একলা আস্তানা, একটা ছোট্ট আটচালা, একটা ছাগল, একটা পেয়ারা গাছ—ব্যস আর কিছু নেই। ত্রিভুবনে মাসির কোনও আত্মীয়ও নেই। আমরা যেই বলেছি তুমি ছাড়া আমাদের কে আছে মাসি, মাসির চোখ দুটো ছলছল করে উঠল, ওরে আমার সোনা রে—বলে পিন্টু আর আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, নিয়ে আয় তোদের কাগজ। তা বাবা, আমি তো ঠোঙা তৈরির ইসপার্ট, আমি কি তোদের ফানুস মানুষ পারব রে?

খুব পারবে মাসি। দেখতে হবে ঠিক মোহনবাবুর মতো।

পাজি ছেলে! আচ্ছা নিয়ে আয় তোদের কাগজ আর আঠা।

তৈরি হল ফানুস। মন্দ হল না। তবে ঠিক গোল না হয়ে একটু লম্বাটে হয়ে গেল, বিশাল একটা ঠোঙার মতো।

কাকাবাবু বললেন, থাক গে যা হয়েছে। একটু বেঢপ হল বটে, তবে ধোঁয়াটা ধরে রাখা নিয়ে কথা। তা হবেখন।

খোলা দিকটায় একটা তারের গোল রিং লাগানো হল, মাঝখানে আড়াআড়ি দুটো তারে পাটে পাটে জড়ানো হল কেরোসিন তেলে ভেজানো কাপড়ের ফালি আর রজন।

পিন্টু বলল, যতটা পুরু করে পারিস জড়া। যত বেশি ধোঁয়া হবে তত উঁচুতে উঠবে, উঁচু, একেবারে স্বর্গে চলে যাবে রে!

কল্পনা ফানুসের আগে উড়ছে। লক্ষ্য একেবারে চাঁদে গিয়ে পৌঁছোনো। জিনিসটা বেজায় ভারী হয়ে গেল। এত ভারী উড়বে তো রে?

কী যে বলিস! আগেকার দিনে ফানুসে মানুষ উড়ত।

তেল-ভেজানো একটা দশ হাত কাপড় উড়বে না? —পিন্টুর অকাট্য যুক্তি কাকাবাবুও সমর্থন করলেন।

সন্ধে তখন হয় হয়। দীপাবলী, পশ্চিম আকাশ লালে লাল করে সূর্য ডুবছে। সমস্ত বাড়ির ছাদে ছাদে দিনের আলো নেভার আগেই আলসেতে মোমবাতি ফিট করার শব্দ হচ্ছে। এদিক-সেদিক থেকে ঠুসঠাস কয়েকটা পটকা ফাটার শব্দ হচ্ছে। নগেন একটা উড়োন-তুবড়ি টেস্ট করল। প্রথম ফানুস উঠল কামারপাড়ার দিক থেকে। কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে হুস হুস করে আকাশে উঠে গেল। নভেম্বরের মাঝামাঝি। দমকা উত্তরের হাওয়ায় মাতালের মতো টলতে টলতে ফানুস নিরুদ্দেশ।

আমাদের দলবল ছাদে উঠেছে। পিন্টুর হাতে লম্ভ, আমার হাতে প্যাকাটি। কাকাবাবু পাশে আছেন, অ্যাডভাইসর। আর আছেন পাঁচুদা, লম্বা মানুষ তিনি, দু-হাতে ফানুসটা মাথার ওপর তুলে ধরে থাকবেন। ধোঁয়া ঢুকে খোলটা ফুলে উঠবে। টান টান হয়ে উড়ে যাবার টান ধরবে, তারপর আপনা থেকেই আকাশের জিনিস আকাশে উড়ে যাবে।

পাঁচুদা লম্বা মানুষ। দু-হাত তুলে ফানুসে ধোঁয়ার টান ধরাচ্ছেন। দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। খোলটাই না পুড়ে যায়! কাকাবাবু বললেন, রজন বড্ড বেশি হয়ে গেছে রে। যাক, দেখা যাক কী হয়! ভগবানকে ডাক।

আশ-পাশের বাড়ির ছাদে কৌতূহলী মুখ। উড়বে ফানুস, উড়ছে ফানুস। রোগা মানুষ পাঁচুদা মোটা ফানুস ওড়াচ্ছেন। মাথার ওপর দু-হাত তুলে কতক্ষণ দাঁড়াবেন! হাত টনটন করছে। তার ওপর আগুনের আঁচ! মুখ-চোখ লাল। ফানুসটা একটু দুলে উঠতে তিনি তোললাই মেরে ঠেলে দিলেন। প্রথমে বেশ হাত পাঁচেক উঠে, উত্তরের দমকা হাওয়ায় ছাদের সীমানা পেরিয়ে গেল। তারপরই শুরু হল তার আসল খেল। সামনেই একটা একতলা বাড়ি। জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড টলতে। টলতে সেই বাড়ি টপকে গেল, তারপরই একটা পোড়ো দোতলা বাড়ি। ভাইয়ে-ভাইয়ে মামলা চলছে, কেউই মেরামত করে না। ভাঙা ছাদে লম্বা লম্বা ঘাস গজিয়ে ছিল। শীতের মুখে শুকিয়ে ঝনঝন করছে। ফানুসটার ইচ্ছে সেইখানেই শুয়ে পড়ে।

কাকাবাবু বললেন, সর্বনাশ করেছে। ঘাসে আগুন লেগে গেলে লঙ্কাকাণ্ড হবে যে! তোরা সব উইল ফোর্স প্রয়োগ কর। আমরা চোখ বুজিয়ে, জয় কালী, জয় মা কালীজপতে শুরু করলুম। একটু যেন কাজ হল। ফানুসটা পাখির মতো বসতে গিয়েও ঝিকি মেরে হাতখানেক উঠে শুকনো ঘাসে আগুনের তাত লাগিয়ে চিলেকোঠা পেরিয়ে গেল। আমরা ভয়ে কাঠ! ফানুসের এ কী বাঁদরামি, অনেকটা মানুষের মতো ব্যবহার! পোড়া বাড়িটার পর খেলার মাঠ। মাঠ দেখে যেন ফানুসের খেলতে ইচ্ছে করল। ওপরে না উঠে, একপাশে কেতরে ফানুস নামতে শুরু করল। এর পর আমরা আর কিছু দেখতে পেলুম না, বাড়ির আড়ালে আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে তার শয়তানি চলছে।

চারদিক অন্ধকার। সার সার আলো জ্বলে উঠছে বাড়িতে বাড়িতে। ঠুস ঠাস, ধুম ধাম—পটকা ফাটছে। মাইকে মাইকে গানের শোরগোল। পাঁচুদা বলছেন, যাক বাবা, মাঠে গিয়ে পড়েছে তবু রক্ষে! আর ঠিক সেইসময় মাঠের দিকে বাড়ির আড়ালে ধপ করে একটা আগুন লাফিয়ে উঠল। মাঠের ওপাশে চিৎকার উঠল—আগুন, আগুন! আমরা ভয়ে দরজা জানালা বন্ধ করে বসে রইলুম। পুলিশ-কেস হতে পারে, জেল হতে পারে, ধোলাই হতে পারে। অল্প কিছু সময় পরেই দমকলের ঘণ্টা শোনা গেল।

রাত দশটা নাগাদ ছাগলের গলার দড়ি ধরে বগলে একটা পুঁটুলি নিয়ে মানদামাসি আমাদের বাড়িতে এলেন। ফানুস মাঠ পেরিয়ে তাঁর শুকনো খড়ের চালে ল্যান্ড করেছিল। তাঁর জিনিস তাঁরই কাছে ফিরে এসেছিল রাগে আগুন হয়ে। যে ফানুস উড়ল না, সে ফানুসের দাম সাতশো টাকা। মানদামাসির নতুন খড়ে-ছাওয়া বাড়ি করিয়ে দিলেন কাকাবাবু। আমাদের বললেন, ঘাবড়াও মাত। আসচে বার আমি খোল তৈরি করব। এক্সপেরিমেন্ট ইজ লাইফ!

No comments