সুখী রাজকুমার - অস্কার ওয়াইল্ড


শহরের একটা উঁচু জায়গায় বড় একটা থামে সুখী রাজকুমারের মূর্তিটা স্থাপন করা হয়েছে। মূর্তিটার শরীর চমৎকার সোনার পাত দিয়ে মোড়ান। চোখ দুটোর স্থানে বসানো হয়েছে নীলকান্তমণি। তরবারির বাটে শোভা পাচ্ছে বড় লাল রঙের চুনি পাথর।

সবাই খুব পছন্দ করে মূর্তিটাকে। নগর কাউন্সিলরদের একজন তো বলেই ফেললেন, ‘মূর্তিটাকে বায়ু নির্দেশক পক্ষির মতো সুন্দর লাগে! ’শিল্পের প্রতি অনুরাগ আছে এ রকম অভিধায় অভিহিত হতে চান তিনি। বলেন, ‘তবে মূর্তিটার তেমন কোনো ব্যবহারিক মূল্য নেই।’ কথাটা তিনি বলেছেন এই ভেবে যে, পাছে লোকে তাকে ব্যবহারিক বুদ্ধিহীন লোক বলে বিবেচনা না করে বসে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি তো আর এ রকম ধারার লোক নন।

চাঁদটা হাতে পাওয়ার জন্যে কান্না করছিল এ-রকম এক শিশুর মা তাকে বলল, ‘তুমি সুখী রাজকুমারের মতো হতে পার না? কোনো কিছুর জন্যে কান্না করার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না সে।’

হতাশ একটা লোক মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘একথা ভেবে আমি খুবই আনন্দিত যে, এরকম একজন লোক অন্তত পৃথিবীতে আছে যে সুখী।’

গির্জা থেকে বেরিয়ে আসা টকটকে লাল পোশাক পরা এক বালিকা মন্তব্য করল, ‘তাকে একজন দেবদূতের মতো লাগছে।’

অঙ্কের শিক্ষক তার উদ্দেশে বললেন, ‘কী করে বুঝলে? তুমি তো আর দেবদূত দেখনি।’

‘স্বপ্নে তো অন্ত দেখেছি,’ বলল বালিকা। অঙ্কের শিক্ষক ভ্রুকুটি করলেন। তাকে দেখে মনে হলো বাচ্চা ছেলেপুলেদের স্বপ্নের ব্যাপারটাকে পাত্তা দিতে রাজি নন তিনি।

এক রাতে ওই শহরের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল একটা সোয়ালো পাখি। তার বন্ধুরা ৬ সপ্তাহ আগে মিসরে ফিরে গেলেও সে যায়নি, কারণ একটা নল-খাগড়ার সঙ্গে দারুণ সখ্য গড়ে উঠেছে তার। একটা দেয়ালি পোকার পিছে-পিছে উড়ে যাচ্ছিল সে নদীর সামান্য উঁচু দিয়ে। তখন নল-খাগড়াটাকে দেখে তার এত ভাল লেগে যায় যে, তার সঙ্গে একটুখানি ভাব জমানোর জন্যে নেমে পড়ে।

‘তোমাকে কিন্তু খুব ভাল লেগে গেছে আমার।’ সোয়ালো পাখির এই কথার উত্তরে নল-খাগড়াটা একটুখানি মাথা নুইয়েছিল। সোয়ালোটা তখন তার পাখা দিয়ে পানির ওপর আঘাত করে ছোট-ছোট রূপালি ঢেউ তুলেছিল। সখ্য আর ভালবাসা প্রকাশের এটাই ছিল তার ভাষা। গ্রীষ্মজুড়ে এ-কাজই করে আসছিল সোয়ালো পাখি।

দুই

এ বড়ই হাস্যকর সম্পর্ক, বলেছিল অন্য সোয়ালো পাখিরা, ‘ওর হাতে অর্থকড়ি নেই, আত্মীয় স্বজনদের থেকে সে অনেক দূরে। তারপর নদীতে নল-খাগড়ার কোনো কমতি নেই।’ শরৎ এলে তারা সব নিজ-নিজ গন্তব্যে চলে গেল।

তারা চলে গেলে সোয়ালোটা খুব নিঃসঙ্গ বোধ করতে লাগল, কারণ নল-খাগড়ার সঙ্গে বন্ধুত্বে ভাটা পড়েছিল আর বিরক্তও হয়ে উঠেছিল সে। ‘ও কোনো কথা টথা বলে না, ওর স্বভাবটা যেন যখন যেমন তখন তেমন ধরনের, সারাক্ষণই বাতাসের সঙ্গে মিতালি পাতাচ্ছে।’ কথাটা ঠিকও বটে- যখনই জোরে-জোরে বাতাস বয়ে যায় নল-খাগড়াটা পরম আনন্দে নতজানু হয়। ‘সে খুব ঘরকুনো একথা ঠিক’ভাবে সোয়ালো, ‘আমি তো আবার ভ্রমণ-পিপাসু, স্ত্রীকে খুব ভালবাসি…। শেষ পর্যন্ত সোয়ালো নল-খাগড়াটাকে বলল, ‘যাবে আমার সঙ্গে?’ কিন্তু মানা করল নল-খাগড়া। নিজের বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে রাজি নয় সে। সোয়ালোটা তখন বলল, ‘আমাকে তুচ্ছ করছ তুমি। থাক তোমার ঘর-বাড়ি নিয়ে। আমি চললাম মিসরের দিকে, পিরামিডের দেশে।’ একথা বলে উড়ে চলে গেল সে।

সারাদিন উড়ে রাতের দিকে নগরে এসে পৌঁছাল সোয়ালো। ‘এখন আমি থাকব কোথায়? আশা করি আমাকে ঠাঁই দেবার মতো জায়গা এ শহরে আছে। তখনই সুখী রাজকুমারের মূর্তিটা তার চোখে পড়ল। ‘ওখানেই থাকব আমি, চমৎকার আলো-বাতাস আছে।’ একথা ভেবে সে সুখী রাজকুমারের মূর্তির দুপায়ের ফাঁকে অবতরণ করল। এখানে চমৎকার একটা শোয়ার জায়গা পাওয়া গেল- মনে মনে একথা ভেবে ঘুমানোর আয়োজন করল সে। যখনই সে পাখনার তলায় মাথাটা দিয়ে ঘুমাতে গেল কয়েক ফোটা পানি এসে পড়ল তার গায়ে। ‘কী আশ্চর্য ব্যাপার! আকাশে এক ফোটা মেঘ নেই, জ্বলজ্বল করে আলো ছড়াচ্ছে তারা, তারপরও বৃষ্টি হচ্ছে। উত্তর ইউরোপের আবহাওয়া সত্যি খুব খারাপ। নল-খাগড়াটা বৃষ্টির জন্যে পাগল ছিল, কিন্তু ওটা তার স্বার্থপরতা।’তখন আর একটা বৃষ্টির ফোটা তার গায়ে এসে পড়ল।

‘বৃষ্টি ঠেকাতে না পারলে মূর্তি হয়ে লাভ কী! একটা ভার জায়গা দেখে চলে যেতে হবে।’একথা ভেবে ওড়ার মতলব করল সে।

তিন

ডানা মেলে দেওয়ার আগেই বৃষ্টির তৃতীয় ফোটা তার শরীরে এসে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ওপরে তাকাল সে। আহ্, এ আমি কী দেখছি?

সুখী রাজকুমারের চোখ ভরা পানি। তার গাল বেয়ে সেই পানি ঝরে ঝরে পড়ছে। চাঁদের আলোয় তার মুখখানা খুব সুন্দর লাগছে। দুঃখে ভরে উঠল সোয়ালো পাখির মন।

‘তুমি কে?’ জিজ্ঞেস করল সোয়ালো পাখি।

‘আমি হচ্ছি সুখী রাজকুমার।’

‘কাঁদছো কেন তুমি? তোমার চোখের পানিতে একেবারে ভিজে গেছি আমি।’

‘যখন বেঁচে ছিলাম আর মানুষের হৃদয় ছিল,’ বলল সুখী রাজকুমার, ‘জানতাম না চোখের পানি কী জিনিস। থাকতাম সঁসুচি রাজপ্রাসাদে যেখানে কোনো দুঃখের প্রবেশাধিকার নেই। সকালে বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে বাগানে খেলা করতাম আর সন্ধ্যায় গ্রেট হলে নাচতাম। নৃত্যানুষ্ঠানটার আমিই ছিলাম প্রধান। বাগানের চারপাশে ছিল উঁচু পাচিল। কিন্তু কখনোই জিজ্ঞেস করিনি পাচিলের ওপাশে কী আছে? আমার সবকিছুই ছিল ঠিকঠাক। সভাষদবৃন্দ আমাকে ‘সুখী রাজকুমার’ বলে ডাকত। সত্যিই আমি সুখী ছিলাম, যদি সুখ স্বাচ্ছন্দ্যই শুধু সুখ বলে অভিহিত করা হয়। এভাবেই জীবন চলছিল আমার, আর এভাবেই একদিন মৃত্যু হয়!

‘মৃত্যুর পর আমাকে এই এতো উঁচু স্থানটাতে স্থাপন করা হয়েছে। জায়গাটা মাটি থেকে এত ওপরে যে, শহরের যত কলুষ, যত দুঃখ-দুর্দশা আছে তা আমার চোখে ধরা পড়ে না। আমার হৃদয় সীসা দিয়ে গড়া হলেও তা দুঃখে ভরে ওঠে; তখন কান্না ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।’

‘ও তাহলে পুরো মূর্তিটা খাঁটি সোনায় গড়া নয়?’ ভাবে সোয়ালো পাখি। সে এত কোমল যে, উচ্চস্বরে কোনো ব্যক্তিগত মন্তব্য পর্যন্ত করতে পারে না।

মূর্তিটা বলতে থাকে, ‘এখান থেকে অনেক দূরে ছোট্ট একটা রাস্তায় আছে খুবই দরিদ্র একটা বাড়ি। বাড়িটার একটা জানালা খোলা। খোলা জানালা দিয়ে দেখতে পাই- একটা টেবিলে বসে আছে এক নারী। রোগা পাতলা আর শীর্ণ তার মুখমণ্ডল। লাল খসখসে আঙুলগুলোতে সূচ ফোটার দাগ। দরজির কাজ করে সে। একটা সাটিনের গাউনে সূচিকর্ম করছে সে। অতি মনোহর ওই গাউনটা পরিধান করবেন এ দেশের রানী। ঘরের কোণায় একটা শীর্ণ বিছানায় শুয়ে আছে একটা অসুস্থ ছেলে। প্রচণ্ড জ্বরে ভুগছে সে। কমলা খেতে চাইছে। মায়ের হাতে টাকা-পয়সা কিচ্ছু নেই, পানি ছাড়া ছেলের মুখে কিছুই তুলে দিতে পারছে না, তাই বসে-বসে কাঁদছে। সোয়ালো, ও আমার ছোট্ট সোয়ালো, আমার তরবারির খাপ থেকে চুনি পাথরটা খুলে নিয়ে ওই মেয়েটাকে দিয়ে আসবে না? আমার পা তো মাটির সঙ্গে আটকানো নড়াচড়া করতে পারি না।’

চার

সোয়ালোটা বলল, ‘আমি তো মিসর যাওয়ার অপেক্ষায় বসে আছি। আমার বন্ধুরা তো নীল নদের ওপর দিয়ে উড়ছে এখন। একবার ওপরে যাচ্ছে একবার নিচে নামছে। তারা বড় বড় সব পদ্মফুলের সঙ্গে কথা বলছে, আলাপ করছে। মহান রাজার গম্বুজে নিদ্রা দিতে যাবে তারা শিগগিরই। রং করা কফিনে স্বয়ং শুয়ে আছেন রাজা। হলুদ কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে, তাকে, মশলা মেখে রাখা হয়েছে সারা শরীরে। তার গলায় পরিয়ে রাখা হয়েছে সবুজ মণিমুক্তার মালা। তার হাত দুটো যেন শুকিয়ে যাওয়া পাতা।

‘ও আমার ছোট্ট সোয়ালো, শুধু একটা রাতের জন্যে কি অপেক্ষা করবে না আমার জন্যে? আমার দূত হয়ে কি যাবে না ওই পর্ণকুটিরে? তৃষ্ণায় ফেটে যাচ্ছে ছেলেটার ছাতি, মা-টার অবস্থা দেখ একটি বার চেয়ে, তার চেয়ে দুঃখী নারী আর কে আছে এই সংসারে?’

‘মনে হয় না এরকম বালকদের পছন্দ করি আমি। গেল গরমের সময়ের কথাই ধর না। নদীতে বাস করছিলাম তখন। দুটো অসভ্য ছেলে এসে হাজির হলো সেখানে, তারপর আমার ওপর পাথর ছুঁড়তে শুরু করে দিল। তার মধ্যে একজন ছিল মিল মালিকের ছেলে। ও তো আমাকে দেখলেই ইট মারে। ওরা অবশ্য আমার গায়ে লাগাতে পারেনি কখনো, কারণ আমরা সোয়ালোরা সব সময় আকাশের অনেক ওপর দিয়ে ওড়াউড়ি করে থাকি; তাছাড়া কর্মতৎপর বলে আমাদের পরিবারের একটা সুনাম আছে। সে যা-ই হোক, আমাদের ওপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ব্যাপারটা খুবই অসম্মানজনক।’

কিন্তু এত কথার পরও সুখী কুমারকে খুব দুঃখিত বলে মনে হলো। তা দেখে ছোট্ট সোয়ালোটা ব্যথিত না হয়ে পারল না। সুখী রাজকুমারকে তখন সোয়ালোটা বলল, ‘এখানে ঠাণ্ডা খুব বেশি। তারপরও তোমার জন্যে এক রাত থাকব এখানে, তোমার দূত হব।’

সুখী রাজকুমার বলল, ‘তোমাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব ভেবে পাচ্ছিনে।’

সোয়ালো তখন সুখী রাজকুমারের তরবারির বাট থেকে বড় আকারের চুনিটা খুলে নিয়ে শহরের আকাশের ওপর দিয়ে উড়তে লাগল। উড়ে যাওয়ার সময় তার চোখে পড়ল গির্জার টাওয়ার যেখানে মমির পাথরের দেবদূতের মূর্তি রাখা। রাজপ্রাসাদের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় নাচের শব্দ শুনতে পেল। খুবই সুন্দরী একটা মেয়ে তার প্রেমিককে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল। ছেলেটি বলল, ‘কী চমৎকার আকাশের ওই তারাগুলো। কী অসীম শক্তি ভালবাসার!’ মেয়েটি বলল, ‘রাজকীয় বল নাচের আসরের জন্যে আমার পোশাকগুলো নিশ্চয়ই তৈরি হয়ে গেছে। ওই পোশাকের ওপর চমৎকার ফুলের নকশা আঁকতে দিয়েছি; কিন্তু দর্জি মেয়েটা যে কী অলস না, কী বলব তোমাকে।’

নদীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সোয়ালো দেখল, জাহাজের মাস্তুলের সাথে লণ্ঠন বাঁধা। ইহুদি-মহল্লা অতিক্রম করার সময় তার চোখে পড়ল, বুড়োরা একে অন্যের সঙ্গে দর কষাকষি করছে আর টাকা মাপছে তামার দাড়ি পাল্লায়। শেষে সোয়ালো পাখি দরিদ্রদের সেই কুটিরে এসে হাজির হলো। ছেলেটা শুয়ে আছে বিছানায়। প্রচণ্ড ক্লান্তি আর অবসাদে তার মা ঘুমিয়ে পড়েছে তার পাশেই। সোয়ালেটা নিয়ে আসা লাল চুনি পাথরটা মেয়েটার টেবিলের ওপর রেখে দিল। তারপর সে ছেলেটার বিছানার চারপাশে একবার চক্কর দিল, বাতাস করল তার পাখা দিয়ে। ছেলেটা বলে উঠল, ‘কী শীতই না আমার লাগছে। আরও সেরে উঠব আমি।’

তখন সোয়ালোটা উড়ে-উড়ে ওখান থেকে চলে এল আর সুখী রাজকুমারকে সব কিছু জানাল। ‘খুবই অবাক হবার মতো ব্যাপার। প্রচণ্ড শীত এখনও তারপরও বেশ উত্তাপের আমেজ পাচ্ছি।’ মন্তব্য করল সে।

সুখী রাজকুমার শুনে বলল, ‘খুব ভাল একটা কাজ করেছ যে তা-ই।’ও কথাটা নিয়ে ভাবতে বসল সোয়ালো, তারপর এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল। কোনো কিছু ভাবতে গেলেই ঘুম চলে আসে তার।

ঘুম থেকে উঠে নদীতে গোসল করতে গেল। ওখান দিয়ে যাচ্ছিলেন পক্ষীবিজ্ঞানী এক অধ্যাপক। পাখিটা দেশে আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘এই শীতে সোয়ালো পাখি!’ বিষয়টা নিয়ে স্থানীয় এক পত্রিকার চিঠিপত্র কলামে লিখলেন তিনি। সবার মুখে-মুখে ছুটল চিঠির বিষয়টা, তবে ওখানে ব্যবহৃত অনেক শব্দের মানে তারা বুঝতে পারল না।

সোয়ালো বলল, ‘আজ রাতেই মিসরের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাব।’ সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে গিয়ে পৌঁছাল সে। শহরের নানান ভবন আর সৌধ পরিদর্শন করল, তারপর একটা গির্জার শিখরে গিয়ে বসল। যেখানেই সে গেল তাকে দেখে চড়ুই পাখিরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল, ‘ওই দেখ কী সম্মানিত এক অচেনা অতিথি।’ এ সব কথা সে খুব উপভোগ করল।

আকাশে চাঁদ উঠলে সুখী রাজকুমারের কাছে ফিরে গেল। বলল, ‘মিসরে আমাকে কোনো কাজ দেবে নাকি? রওয়ানা হচ্ছি আামি।’

একথা শুনে সুখী রাজকুমার কাতর হয়ে বলল, ‘আর একটা দিন কি থাকা যায় না আমার জন্যে?’

সোয়ালোটা বলল, ‘আমি তো মিসর যাওয়ার অপেক্ষায় আছি।’

‘সোয়ালো, হে আমার ছোট্ট পক্ষী,’ বলল সুখী রাজকুমার, ‘শহর ছাড়িয়ে দূরের এক চিলেকোঠায় একজন তরুণকে দেখেছি আমি। কাগজে ভর্তি একটা টেবিলের দিকে ঝুঁকে আছে সে। তার পাশেই একটা ফুলদানিতে রাখা শুকিয়ে যাওয়া একগোছা ভায়োলেট ফুল। কোকড়া বাদামি চুল তার, ডালিমের মতো টকটকে লাল তার ঠোঁট, স্বপ্নে ভরা তার বড় বড় দুটি চোখ। থিয়েটারের পরিচালকের কাছে জমা দেওয়ার জন্যে একটা নাটক লিখছে। ঠাণ্ডায় জমে গেছে সে, লেখা এগিয়ে নিতে পারছে না। আগুন নেই তার চিলেকোঠায়, পেটে দানাপানি না-পড়ায় চৈতন্য হারানোর উপক্রম হয়েছে তার।’

‘ঠিক আছে, আরও একটা রাত না হয় থাকব তোমার জন্যে। আরও একটা চুনি দিয়ে আসব নাকি ওকে?’ সোয়ালোটাকে খুব সুহৃদয়ের অধিকারী বলে মনে হলো।

‘কিন্তু হায় সোয়ালো, আমার কাছে তো আর চুনি নেই। শুধু চোখ জোড়া এখন আছে। ও গুলো অবশ্য দুর্লভ নীলকান্তমণি পাথরের তৈরি। হাজার বছর আগে সুদূর ভারত থেকে আনা হয়েছিল। ও গুলোর একটা তুলে নিয়ে তরুণ নাট্যকারকে দাও। ও গুলো বিক্রি করে সে খাবার দাবাড়, আগুনের জন্যে কাঠ কিনবে, তারপর প্রাণশক্তি ফিরে পেলে নাটক রচনার কাজ শেষ করবে।’

সোয়ালো বলল, ‘হে আমার প্রিয় রাজকুমার, আমাকে দিয়ে এসব কাজ হবে না।’এ কথা বলে সে অঝোরে কাঁদতে লাগল। সুখী রাজকুমার বলল, ‘কী হয়েছে রে সোয়ালো? আমি কি তাহলে তোকে হুকুম দেব?’

এ কথা শোনার পর সোয়ালো পাখি সুখী রাজকুমারের একটা চোখ তুলে নিয়ে চিলেকোঠাবাসী নাট্যকারের বাড়িতে গেল। তার কক্ষে ঢোকা কঠিন কাজ হলো না। তরুণ নাট্যকার দু-হাতে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়েছিল, ফলে পাখিটার উপস্থিতি টের পেল না। যখন যে চোখ মেলে তাকাল শুকিয়ে যাওয়া ভায়োলেট ফুলের ওপর সুন্দর নীলকান্তমণি পাথরটা দেখতে পেল।

পাথরটা দেখে সে বলল, ‘কারও কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়ার আশা আমার ছিল। এটা নিশ্চয়ই আমার কোনো অনুরাগী পাঠিয়েছে, এখন আমি নাট্য রচনার কাজ শেষ করতে পারব।’

পরের দিন সোয়ালো উড়ে-উড়ে বন্দরের দিকে গেল। বড় একটা জাহাজের মাস্তুলের ওপর বসতেই চিৎকার কানে ভেসে এল। দড়ি টেনে ওঠাতে-ওঠাতে নাবিকেরা বলছে, ‘হেইও হো, হেইও হো।’সোয়ালো জোরে-জোরে বলে উঠল, ‘আমিও মিসর যাচ্ছি।’তার একথায় কেউ কিছু মনে করল না। আকাশে চাঁদ উঠলে সোয়ালো সুখী রাজকুমারের কাছে চলে এল।

সোয়ালো বলল, ‘তোমার কাছ থেকে বিদায় নিতে এসেছি সুখী রাজকুমার।’

‘ও আমার ছোট্ট সোয়ালো, আর একটা দিন কি থাকা যায় না আমার সাথে?’

‘এখন তো শীতকাল। শিগগিরই বরফ পড়তে শুরু করবে। কিন্তু দেখ মিসরের আবহাওয়া, ওখানে তাল গাছের ওপর কিরণ দিচ্ছে উত্তপ্ত সূর্য। কী উষ্ণতাই না ছড়াচ্ছে। আর মাটিতে শুয়ে আছে কুমিরের দল। কী আলস্যই না তাদের শুয়ে থাকার ভঙ্গিতে। আমার সঙ্গীরা বালবেক সৌধে একটা বাসা বানাচ্ছে। গোলাপি আর সাদা ঘুঘুরা একে অপরের প্রতি কুউ কুই ধ্বনি ছুড়ে দিচ্ছে।

‘প্রিয় রাজকুমার তোমার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার এটাই সময়। তবে কোনো দিনও ভুলবো না তোমাকে। আগামি বসন্তে আবার আসব আমি। তোমার শরীর থেকে যে রত্ন দুটো খুলে নেওয়া হয়েছে তা পূরণ করে দেব আমি। দুটো রত্ন আমি নিয়ে আসব। যে-চুনিটা আনব সেটা লাল গোলাপের চেয়েও লাল হবে। নীলকান্তমণিগুলো বিশাল সমুদ্রের জলরাশির চেয়েও হবে বেশি নীল।’

‘ও আমার প্রিয় সোয়ালো, তাকাও নিচে, ওই স্কোয়ারের দিকে। ওখানে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট এক ম্যাচ বিক্রেতা-বালিকা। ওর ম্যাচগুলো নর্দমায় পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। ওগুলো বিক্রি করে কিছু টাকা-পয়সা বাড়িতে নিয়ে যেতে না পারলে ওর বাবা মারবে ওকে। এ কারণে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে ও। ওর পাশে জুতো-মোজা নেই, মাথাটাও খালি দেখ। আমার অন্য চোখের পাথরটা উপড়ে নাও, দিয়ে এসো মেয়েটার বাবাকে, তাহলে মেয়েটাকে আর মার খেতে হবে না।’

সোয়ালো কাতর হয়ে বলল, ‘আরও একটা রাত থাকব তোমার সঙ্গে; কিন্তু তোমার চোখ থেকে পাথর খুলে নিতে পারব না, তাহলে যে অন্ধ হয়ে যাবে তুমি।’

‘ওরে সোয়ালো তোকে কি হুকুম করব আমি?’ একথা শোনার পর সোয়ালো পাখি সুখী রাজকুমারের অন্য চোখটা তুলে নিয়ে উড়তে-উড়তে ম্যাচ বিক্রেতা মেয়েটার কাছে গেল, আর তার হাতের পাতায় রেখে দিল নীলকান্তমণি পাথরটা। ‘কী চমৎকার একটা কাচের খণ্ড!’ একথা বলে মেয়েটা হাসতে হাসতে বাড়ি চলে গেল।

সুখী রাজকুমারের কাছে ফিরে এসে সোয়ালো পাখি বলল, ‘এখন তো তুমি পুরোপুরি অন্ধ। আমি থেকে যাব তোমার কাছে।’

‘না সোয়ালো পাখি, তোমাকে মিসরে ফিরে যেতে হবে।’

‘কক্ষণো না। আমি তোমাকে ছেড়ে কোত্থাও যাব না চিরকাল থাকব এখানে।’একথা বলে সোয়ালো সুখী রাজকুমারের পায়ের কাছে ঘুমিয়ে পড়ল।

পরের দিন সোয়ালো পাখি সুখী রাজকুমারের কাঁধে বসে পৃথিবীর যে সব বিচিত্র জায়গায় সে গেছে তার গল্প শোনাল। সে শোনাল নীল নদের পাড়ে সার বেঁধে বসে সারস পাখি আর তাদের লম্বা ঠোঁট দিয়ে মাছ ধরার গল্প; বলল কিংস-এর কথা, যে কিনা থাকে মরুভূমিতে এই পৃথিবীতে সবচেয়ে প্রাচীন সে, আর দুনিয়ার সবকিছু সম্পর্কে অবহিত; জানালো সেই সব বণিকদের কথা যারা তাদের উটের রশি হাতে ধীরে-ধীরে পথ চলত আর বহন করত বাদামি রঙের পুঁতি।

সোয়ালো পাখির এইসব গল্প শুনে সুখী রাজকুমার বলল, ‘সোয়ালো পাখি, তোমার গল্পগুলো চমৎকারিত্বে ভরা, কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে জগতের নারী-পুরুষের দুঃখ কষ্ট। দুর্দশার মতো রহস্য জগতে আর একটিও নেই। এই শহরটার ওপর দিয়ে এক চক্কর ঘুরে এস, তারপর আমাকে বল কী দেখলে।’

অতএব সোয়ালো পাখি তার ডানা মেলে দিল আকাশে, ঘুরতে লাগল বিরাট শহরের ওপর দিয়ে। সে দেখল, ধনী লোকেরা তাদের বিরাট-বিরাট অট্টালিকায় বসে আনন্দ-ফূর্তি করছে আর ভিখারিরা বসে আছে তাদের দুয়ারে। অন্ধকার অলিগলির ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় সোয়ালো দেখল, অনাহারী শিশুরা অলসভাবে তাকিয়ে আছে অন্ধকার রাস্তার দিকে, তাদের চোখ-মুখ শুকনো। একটা ব্রিজের নিচে শুয়ে আছে দুটি বালক জড়াজড়ি করে। প্রচণ্ড শীতের কবল থেকে বাঁচার আশায় এভাবে শুয়ে আছে তারা। একজন চিৎকার করে বলল, ‘কী খিদেই না পেয়েছে।’ দারোয়ান চেঁচিয়ে উঠল, ‘এ্যাই এটা শুয়ে থাকার জায়গা নয়, ভাগ এখান থেকে।’ ওরা উঠে ওখান থেকে চলে যেতেই শুরু হলো প্রবল বৃষ্টি।

সোয়ালো এসব দেখে গিয়ে সব বলল সুখী রাজকুমারকে। সুখী রাজকুমার তখন বলল, ‘আমার সারা গা সোনার পাতে মোড়া। ওগুলো একটার পর একটা তুলে নাও সোয়ালো। সব দিয়ে এসো গরিব মানুষগুলোকে, যারা সব সময়ই মনে করে আসছে সোনা-দানা তাদের সুখী করতে সক্ষম।’

সোয়ালো তখন একটা একটা করে সুখী রাজকুমারের শরীর থেকে সব সোনার পাত খুলে নিয়ে গরিবদের দিয়ে এল। ওগুলো পেয়ে তাদের বাচ্চাকাচ্চাদের চোখে-মুখে হাসি ফুটে উঠল। তারা খেলাধুলায় মত্ত হলো আর বলতে লাগল, ‘আমরা বড় লোক হয়ে গেছি!’

এরপরেই এল তুষার আর বরফ পরার মৌসুম। রাস্তাঘাট ধারণ করল রূপালি রং। বেচারা ছোট্ট সোয়ালোটা ক্রমে ক্রমে জমে যেতে লাগল। কিন্তু সুখী রাজকুমারকে সে এত ভালবেসে ফেলেছে যে, তাকে ছেড়ে যেতে সে নারাজ। ক্ষুধা নিবারণের জন্যে সে বেকারির সামনে থেকে রুটির ছোট-ছোট অংশ কুড়িযে দিয়ে খাচ্ছিল আর শীত তাড়ানোর জন্য বার-বার ডানা ঝাপটাচ্ছিল। কিন্তু অচিরেই সে টের পেল, মারা যাচ্ছে সে। সুখী রাজকুমারের কাঁধ অবধি যাওয়ার শক্তি অর্জন করল সে কোনো রকমে। বলল, ‘এবার বিদায় দাও সুখী রাজকুমার, আমি কি তোমার হাতখানায় চুমু খেতে পারি?’

একথা শুনে সুখী রাজকুমার বলল, ‘জেনে খুব আনন্দ হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত তুমি মিসরে যাচ্ছ। এখানে তো অনেকদিন কাটালে! আমার হাতে নয় ঠোঁটে চুমু খাও হে আমার ছোট্ট সোয়ালো, কেননা আমি তোমাকে অনেক-অনেক ভালোবাসি!’

‘আমি মৃত্যুর ঘরে চলে যাচ্ছি রাজকুমার, মিসরে নয়। মৃত্যু হচ্ছে ঘুমেরই ছোট ভাই, তাই না?’

সোয়ালোটা পরম যত্নে সুখী রাজকুমারের ঠোঁটে চুমু খেল, তারপর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। তার নিথর দেহটা রাজকুমারের পায়ের তলায় গিয়ে পড়ল। ঠিক সেই মুহূর্তে মূর্তিটার ভেতরে কিছু একটা ফেটে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেল সবাই, যেন কিছু একটা ভেঙে পড়েছে। আসলে মূর্তির সীসার হৃদপিণ্ডটা ভেঙে দু-টুকরো হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই শক্ত কোনো বরফের চাপে এটা হয়েছে।

পরের দিন সকালে দুজন কউন্সিলরকে নিয়ে নগরীর মেয়র মূর্তিটার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ মূর্তিটার দিকে চোখ পড়তেই চিৎকার করে উঠলেন তিনি, ‘কেমন যাচ্ছে তাই দেখাচ্ছে রাজকুমারকে তাই না?’ বললেন তিনি।

‘ঠিকই বলেছেন জনাব, ঠিকই বলেছেন আপনি।’বলল কাউন্সিলর দুজন। মেয়রের সব কথাতে সব সময়ই সায় দেয় তারা। তিনজনে মিলে রাজকুমারের মূর্তিটা পর্যবেক্ষণ করতে গেল।

মেয়র বললেন, ‘তার তরবারির বাট থেকে চুনি খসে পড়েছে, চোখ দুটোও গেছে। তার সারা শরীরে সোনার চিহ্ন মাত্র নেই। তার অবস্থা ভিখারিদের চেয়ে সামান্য ভাল।’

কাউন্সিলরগণ বলে উঠল, ‘ভিখারিদের চেয়ে সামান্য একটু ভাল জনাব।’

মেয়র বলতে লাগলেন, ‘তার পায়ের তলায় একটা পাখি মরে পড়ে আছে দেখুন। আমাদের শিগগিরই এই মর্মে একটা আদেশ জারি করতে হবে যে, কোনো পাখিদের এখানে এসে মরা চলবে না।’মেয়রের সঙ্গে আসা দুজন কেরানী কথাগুলো নোট করে নিল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্প-শিক্ষক এসে বললেন, ‘যেহেতু সুখী রাজকুমারকে এখন দেখতে ভাল লাগছে না, সেহেতু এটার কোনো ব্যবহার নেই।’অতএব মূর্তিটাকে তারা টেনে নামাল। মূর্তির ধাতুগুলোকে বড় একটা চুল্লিতে দিয়ে গলিয়ে ফেলা হলো। মেয়র সাহেব গলিত ধাতু দিয়ে কী করা যায় সে বিষয়ে একটা সভা আহ্বান করলেন। মেয়র বললেন, ‘আমাদেরকে আর একটা মূর্তি গড়তে হবে এই ধাতু দিয়ে, আর মূর্তিটা হবে আমার নিজের।’

এ কথা শোনার পর কাউন্সিলর দুজন চিৎকার করে উঠল, ‘মূর্তিটা হবে আমার।’ এ নিয়ে তারা তুমুল ঝগড়া করতে লাগল। তাদের ঝগড়া থামতেই চায় না।

ওখানে কাজ করছিল এমন একজন ওয়ারসিয়ার বলে উঠল, ‘দেখ-দেখ কী আশ্চর্য ঘটনা। সুখী রাজকুমারের ভেঙে যাওয়া সীসার হৃদপিণ্ডটা চুল্লির আগুনে ফেলেনি। এটা ফেলে দিতে হবে।’ অতএব তারা হৃদপিণ্ডটা ময়লার স্তূপে নিক্ষেপ করল যেখানে সোয়ালো পাখির মৃতদেহটা পড়েছিল।

ঈশ্বর তার দেবদূতদের বললেন, ‘নগরী থেকে সবচেয়ে মূল্যবান দুটি জিনিস আমাকে এনে দাও।’ দেবদূতগণ সুখী রাজকুমারের সীসার হৃদপিণ্ড আর সোয়ালো পাখির মৃতদেহটা ঈশ্বরের হাতে দিলেন।

ঈশ্বর বললেন, ‘সঠিক জিনিসই তোমরা নিয়ে এসেছ। স্বর্গের বাগানে সারাক্ষণ এই পাখিটা গান গাইবে আর আমার স্বর্ণের নগরীতে সুখী রাজকুমার সব সময় আমার প্রশংসায় মগ্ন থাকবে।'

No comments