রায় বাড়ি – ভৌতিক গল্প


তিন বন্ধু গ্রামে বিয়েবাড়িতে এসেছে প্রদীপ, মিলন আর সুজিত এই তিনজনেই শহরের ছেলে আর গ্রামে তাদের এই প্রথম আসা। ওদেরই এক বন্ধু পরিমলের বোনের বিয়েতে তাদের আসা। সারাদিনটা বেশ আনন্দ স্ফূর্তির মধ্যে দিয়ে কেটে গেল। কিন্তু মুশকিল হল রাতে। বিয়েবাড়ি বলে কথা, অনেক অতিথি অভ্যাগত দের থাকার পালা, তাদের সবার স্থান সং কুলান হয় না তাই বেশির ভাগ নিমন্ত্রিত লোককে পাঠান হল পাশের গ্রামে।

কিন্তু সমস্যা দেখা দিল প্রদীপ, মিলন আর সুজিত কে নিয়ে। বিয়েবাড়িতে উল্টো পালটা খাওয়ার ফলে মিলনের পেটের গণ্ডগোল শুরু হোল, নতুন হাওয়া লেগে প্রদীপের লাগল ইনফ্লুয়েঞ্জা আর সুজিত ওদের ফেলে রেখে পাশের গ্রামে যেতে পারল না। তাই ওদের তিনজনকে নিয়ে পরিমল বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল। অগত্যা সুজিতই প্রস্তাব টা পাড়ল। এখানে আসার পথে সে গ্রামের শেষ প্রান্তে একটা বহু পুরান পাকা বাড়ি দেখেছে টাংগা ওয়ালার কাছে শুনেছে ওটা পরিত্যক্ত রায়বাড়ি। সেই বাড়িতে যদি রাতে থাকার মত ব্যবস্থা…. সুজিত কে মাঝ পথেই থামিয়ে পরিমল হাত মুখ ঈশারা করে যা বলল তা হল “ওই বাড়িতে দিনের বেলাতেই কেউ ঢোকে না, রাতের কথা বাদই দাও বন্ধু, ও হল ভূতের বাড়ি।” সুজিত শহরের ছেলে।

হো হো করে হেসে বলল “ধুর, ভূত বলে কিছু আছে নাকি আজকের দিনে, থাকলেও আমরাই ওকে তাড়িয়ে ছাড়ব।” পরিমল কিন্তু হাসল না। সে এ কথা সে কথায় বন্ধুদের নিরস্ত করতে চাইল কিন্তু শেষতক তাকে বন্ধুদের জেদের কাছে হার মানতে হলো। দুটো চাকরের হাতে একটা লণ্ঠন আর বালিশ বিছানা তোষক সহ সুজিতরা এসে উঠল সেই পোড়ো বাড়িতে। রায়বাড়ির সামনে এসে তারা থামল তখন রাত দশটা বেজে গেছে।

আকাশে ঘোলাটে অর্ধ চন্দ্র, মাঝে মাঝে জোর হাওয়া উঠছে, রাতে যে ঝড়জল হবে বোঝাই যাচ্ছে। রায়বাড়ির চারপাশের পরিবেশটা কেমন নিঝুম নিস্তব্ধ। সুজিতরা এবার ভাল করে বাড়িটাকে দেখার সুযোগ পেল। অনেকখানি জায়গা নিয়ে পুরনো এই অট্টালিকা, সামনে ভগ্ন ফটক, ভেতরে দু একটা পরীর মূর্তি, সেগুলোর ও ভগ্ন দশা। ডানপাশে অনেকটা জায়গা নিয়ে অবিন্যস্ত ভাবে গজিয়ে উঠেছে জংলা গাছ, এককালে বোধ হয় বাগান টাগান ছিল এখানে। বাড়িটা তিনমহলা, ওপরে ভগ্নপ্রায় কারনিশঘেরা ছাদ, একেবারে ওপরে কালো রাতের শামিয়ানা। সুজিতরা এসবই দেখছিল, সঙ্গের চাকরদুটো তাগাদা লাগায় এবার।

ওদের আর তর সইছিল না, ওদের তাগিদেই সুজিতরা আর অপেক্ষা না করে ঢুকে পড়ে বাড়ির ভেতরে। চৌ হদ্দি পেরিয়ে ওরা সদর দরজার কাছাকাছি এসছে হঠাত মিলনের ভয় পাওয়া স্মর শোনা গেল। “আমার পায়ের তলা দিয়ে কি যেন সড়সড় করে চলে গেল” মিলন প্রচন্ড ভয় পেয়ে বলল। ওর কথায় সবাই হাতের টর্চ এর আলো ফেলল চারিদিক কিন্তু ঝোপঝাড় এতো ঘন যে কিছুই নজরে পড়ল না। লন্ঠন হাতে চাকরটা বলল “পুরনো বাড়ি তো, সাপখোপ থাকা বিচিত্র নয়, কারবলিক এসিড এনেছি, ঘরের চারিদিকে ছড়িয়ে রাখবেন। তারপর আপনমনে গজগজ করতে করতে সামনের দিকে পা চালাল। ‘কি বে আক্কেলে ছেলে রে বাবা, এই পোড়ো বাড়িতে কেউ রাত কাটাতে আসে! কান্ডজ্ঞান নেই এদের!! যা থাকে কপালে আমার কি” এরম নানা কথা বকবক করতে করতে লোকটা সদর দরজার সামনে এসে দাঁ ড়াল।

প্রদীপ ইনফ্লুয়েঞ্জা য়ে কাবু, সে সুজিতের কাধে ভর দিয়ে চলছে। মিলনের পেটের গন্ডোগোল টা ওষুধের প্রভাবে সামান্য ঠিক হয়েছে। সদর দরজা দিয়ে ঢুকে মস্ত হলঘর পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যে প্রথম ঘরটা পাওয়া গেল সেটাকেই সাফ করার কাজে লেগে গেল চাকরদুটো। ঝাড়ঝুট দিয়ে তোষক কম্বল বিছিয়ে বালিশ সাজিয়ে দিল তিন বন্ধুর জন্য। হ্যারিকেনটা রাখল ওদের পায়ের কাছে। মিলন আর সুজিত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঘরটাকে দেখছিল। জমিদার বাড়ির ঘর বলে কথা, উঁচু ছাদ, পুরু মলিন দেওয়ালের এখানে ওখানে দুটো করে ধুলায় ঢাকা অয়েল পেন্টিং ঝুলছে। অয়েল পেইন্টিং গুলোর ওপর ধূলা পড়ে নানা জায়গায় পোকায় কেটে কি ছবি কিছ্যু বোঝার উপায় নেই। শুধু শূন্য ফ্রেম গুলোই দেওয়ালে ঝুলছে, ফ্রেমগুলোর ওপরও ধূলার আস্তরন পরেছে পুরু হয়ে। এ ঘরের দরজার মাথায় রঙিন কাচের ভেন্টিলেটর, তার গায়েও পুরু ধুলা জমেছে। ওপাশের দেওয়ালে লাগান পুরনো মরচে পড়া তালা দেওয়া বদ্ধ ওয়ারড্রোব।

মিলন সেদিকে ইংগিত করে চাকরটাকে বল্ল “আচ্ছা ওই দেরাজটায় কি আছে? বহুদিন খোলা হয় না দেখেই বোঝা যাচ্ছে ।” সুজিত বিরক্ত হয়ে বলল “আহহা, তোর সবেতে বড্ড বেশী কিউরিসিটি, মিলন, একটা রাতের ব্যাপার কেন খামোকা টেনশন নিচ্ছিস একটা পুরনো বাড়ির দেরাজে কি আছে না আছে!” চাকরটা বালিশ গুছিয়ে রাখছিল, মিলনের প্রশ্নের উত্তরে বলল ” কে জানে বাবা, রায়বংশের শেষ প্রদীপ নিভে যাবার পর কেউ ও আলমারী খুলেও দেখে নি কোনওদিন, বাড়িটাও পরিত্যক্ত হয়ে গেল, কেউ ভুলেও এখানে কোনওদিন পা ও রাখতে আসেনি ” “কেন? কেউ কোনওদিন ভয় টয় দেখেছিল?” “ভয় বলতে কেউ অবশ্য নিজের চোখে কিছু দেখেনি। তবে গভীর রাতে এ বাড়ি থেকে অনেকে অনেক কিছু শুনতে পায়।

আমিও দু একবার শুনেছি।” “যেমন?” “এই ধরেন না কেন, বাড়ির ভেতরে মানুষের হাটাচলার শব্দ, ঘুংগুর পায়ে নাচার শব্দ, তবলার বোল, বন্দুকের গুলির শব্দ, মেয়েলি গলায় আর্তনাদ এসব আর কি।” “বল কি গো’ এ যে খাসা ইন্টারেস্টিং” সুজিত আর মিলনের গলায় উচ্ছাস। চাকরদুটো এবার যাবার উদ্যোগ করতে করতে বলল ” হু, আজকের রাতটা মানে মানে কাটাতে পারেন কিনা দেখেন”। তারপর একটু ভেবে বলল ” এখনো সময় আছে, ফিরবেন তো চলুন”. সুজিত হেসে তাকে আশ্বস্ত করে বলল” আরে না না, তোমার গল্পটা দারুন লেগেছে। আমাদের তো বহুদিনের ইচ্ছে ভূত দেখার।

দেখা যাক আজ তেনাদের সাথে দেখা হয় কিনা” মিলন এখন অনেকটা বল ফিরে পেয়েছে। সে এককাঠি এগিয়ে বলল ” বিয়েবাড়ি বলে ডিজিটাল ক্যামেরা এনেছি, ভাবছি সেটা দিয়ে আজ ভূতের ছবি তুলব”। প্রদীপ একটু ভীতু টাইপের তায় জ্ব্রর, তাই সে চুপ করে রইল। চাকরদুটো বিদায় নিল। েখতে দেখতে রাত্রি আরও গভীর হল। তিন বন্ধু বিছানায় শুয়ে বেশ অনেক রাত অব্দি গল্প করল। একসময় তন্দ্রা নেমে এল তাদের চোখে। একসময় সুজিতের ঘুমটা কি যেন কারণে হঠাত চটকে গেল, অনুভব করল পাশ থেকে কে যেন তাকে ঠেলছে। পাশ ফিরতে দেখল পাশে মিলন জেগে রয়েছে আর এতক্ষণ সে ই তাকে ঠেলছিল।

ঘুমজড়ান গলায় সুজিত বলল “কি রে ঠেলছিস কেন? ঘুমোস নি?” মিলন আস্তে করে তাকে থামতে ঈশারা করল তারপর ছাদের দিকে ঈশারা করল। সুজিত এতক্ষন খেয়াল করেনি, এবার ছাদের দিকে তাকিয়ে বেশ চমকে উঠল, এক লহমায় ঘুম তার চোখ থেকে বিদায় নিল, পরম আশ্চর্য হয়ে দেখল পুরনো পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ির ঘরটা যেন জাদুমন্ত্র বলে পালটে গেছে। ঘরের ছাদ থেকে একটা বিশাল দামী ঝাড়বাতি ঝুলছে, শুধু টুং টাং শব্দ করে দুলে উঠছে যেন কোনও অদেখা হাতের ছোঁয়ায়। এবার ঘরের চারিদিক চোখ বোলাল সুজিত। কোথায় সেই পুরনো লজঝরে বাড়ি! মেঝেতে পুরু পশমী দামি কারপেট, দেওয়ালে দেওয়ালে সুদৃশ্য সোনালী ফ্রেমে বাঁধান অপরূপ ভাস্কর্য মন্ডিত অয়েল পেন্টিং, দামি দামি আসবাব পত্রে সুসজ্জিত ঘর, কোথা থেকে সুগন্ধী ফুলের ঘ্রাণ ও আসতে লাগল।

তিন বন্ধু জেগে উঠে এসব লক্ষ্য করছিল, এবার তারা উঠে বসে অবাক হয়ে চারপাশে চোখ বুলোতে লাগল। ওপাশে একটা মেহগনি কাঠের খাট নজরে পড়ল। আরও ওদিকে একটা দেওয়াল জুড়ে বিশাল ড্রেসিংটেবিল, তাতে আয়নার সামনে বসে বসে এক তরুনী মহিলা একমনে প্রসাধন করছে। সুজিতদের দিকে যেন তার নজরই নেই, যেন সে তাদের দেখতেই পাচ্ছে না বা দেখেও না দেখার ভান করছে। তিনবন্ধু ওদিকে অবাক হয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মত মহিলাকে লক্ষ্য করতে লাগল। মহিলার সাজপোশাক অতীতের জমিদার গিন্নী দের মতো, সারা শরীরে সোনার অলংকার, মাথার খোঁপা য় হিরে বসান দামি পাথর যা ঘোমটার ভেতর দিয়েও ঝকমক করছে, দেহের নড়ন চড়নের সাথে সাথে মাথার টিকলি, নাকছাবি, হাতের পাচ আঙুল এর আংটি ঝিকিয়ে ঝিকিয়ে উঠছে। হঠাত এইসময় বাইরে নীচের হলঘর থেকে সুমধুর ঘুংগুর এর বোল ভেসে এল, সেই সংগে ভেসে এল তবলার বোলও। কে যেন অপরূপ ছন্দে নাচ করছে বোধ হয় কোন পারদর্শী নর্তকী। এতক্ষণ এ ঘরের মহিলা ছিলেন বেশ প্রসন্নবদনা কিন্তু নীচ থেকে নাচের শব্দ কানে আসতেই বিরক্তিতে আর ক্রোধে তার মুখমন্ডল লাল হয়ে উঠল।

সাজগোজ থামিয়ে তিনি উৎকর্ণ হয়ে শুনতে লাগলেন নাচের শব্দ, শুনতে শুনতে তার মুখ হিংস্র হয়ে উঠল, চোখদুটো যেন জ্বলন্ত অংগারখন্ডে পরিণত হল। তিনি সশব্দে হাতে থাকা সিন্দুরের কোটো টা টেবিলের ওপর ফেলে ধুপধাপ শব্দে পা ফেলে দরজা ঠেলে খুলে বেরিয়ে গেলেন। তার মূর্তি তখন রণরঙ্গিণী চামুন্ডা। ওদিকে তিনবন্ধুও সাহস সঞ্চয় করে গুটি গুটি ঘরের বাইরে এসে দেখে, নীচের হলঘরটায় বিশাল সুসজ্জিত কারপেট এর ওপর এক সুন্দরী রাজনর্তকী অপরূপ ছন্দে নেচে চলেছে, তার চারপাশে ঘিরে আছে তবলচী, গায়ক আর সেতার বাদকরা, একদিকে তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় একজন সুদর্শন বলিষ্ঠ যুবক, মুগ্ধ চোখে দেখে চলেছেন তার নাচ, চোখে কামের নেশা।

ঘুঙুর আর তবলার বোলের ছন্দে তিনি কোন জগতে যেন হারিয়ে গেছেন, হাতে ধরা গড়গড়া র পাইপটা হাতেই রয়ে গেছে। কিন্তু যা কিছু দেখা যাচ্ছে খুবই অস্পষ্ট, নাচের শব্দও যেন বহুদূর থেকে আসছে মনে হল। এদিকে সেই রণরঙ্গিণী মূর্তি ধারী মহিলা সদর্প পা ফেলে ফেলে একেবারে আসরের মাঝখানে উপস্থিত হলেন। তাকে আচমকা এভাবে উপস্থিত হতে দেখে আসরের সবাই সব ভুলে থেমে গেছে, এমনকি নর্তকী ও নাচ থামিয়ে ভীরু নজরে মহিলাকে নিরীক্ষণ করতে লাগল। মহিলার উধ্বত ক্রুধ্ব গলা শোনা গেল “তুমি আবার এ রায়বাড়িতে প্রবেশ করেছ? তোমায় বলা হয়েছিল না তুমি কোনওদিন এ বাড়িতে ঢুকবে না” নর্তকী কে লক্ষ্য করে বলে চলল মহিলা। এতটুকু না থেমে তিনি ফের বলতে লাগলেন” তোমাত এত স্পর্ধা তুমি আমার আদেশ অমান্য করেছ? এ অঞ্চলের রাণী মার আদেশ অগ্রাহ্য করেছ?” নর্তকী বিনম্রতার সাথে বলল ” রাণী মা…রাজাবাবুর আদেশেই আমি এসেছি, নইলে আমার কি স্পর্ধা যে আমি আপনার আদেশ অগ্রাহ্য করব!” রাণীমার মন ভিজল না এ কথায়, বরং তিনি আরও রেগে গিয়ে যারপরনাই গালমন্দ করতে লাগলেন। সেই সুদর্শন যুবক টি মানে রাজাবাবু এতক্ষণ সব শুনছিলেন এবার উঠে দাঁড়িয়ে রাণীকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলেন “বসুধা, ও এখানে আমার আদেশে এসেছে, আমার আদেশেই যাবে, তুমি ওর গায়ে ওভাবে হাত তুলো না বলছি।

দিনের পর দিন তোমার অত্যাচার সহ্য করেছি অনেক এবার কিন্তু আমার সহিষ্ণুতার বাঁধ ভেঙে যাবে “। “কি?” রাণী মা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন “সামান্য নর্তকীর জন্য তুমি সবার সামনে আমার মুখের ওপর কথা বলছ?” একটু চুপ করে থেকে তিনি বললেন “বেশ, দেখ আমি কি করি। রায়বংশ নিপাত যাক ” বলতে বলতে জমিদারবাবুর ওপর ক্রুদ্ধ চোখদুটো বুলিয়ে হন্তদন্ত হয়ে রাণী মা একটি ছোট কামরায় ঢুকলেন, একটু পরে বেরিয়ে এলেন একটা বন্দুক হাতে। বন্দুক হাতে ক্রুদ্ধ রাণী মাকে দেখে একমাত্র রাজামশাই আর সেই নর্তকী ছাড়া আসরের সবাই ছুটে পালিয়ে গেল ভীরু তাড়া খাওয়া হরিণের মত।

দুবার গুলি করলেন রাণী মা, দুটোই নর্তকী র বুকে লাগল, তার বুক রক্তে ভেসে গেল। চোখের সামনে নির্দোষ মেয়েটাকে খুন হতে দেখে রাজাবাবু আর সামলাতে পারলেন না, ঝাঁপিয়ে পড়লেন বন্দুক হাতে থাকা রাণীমার ওপর রাগে অধীর হয়ে রাজাবাবু রাণীর গলা টিপে ধরলেন সজোরে। উভয়ের মধ্যে প্রবল ধ্বস্তাধস্তি শুরু হল, ঠিক এইসময় আবার গুলির শব্দ হল। কার গুলি লাগল ঠিক বোঝা গেল না, পরক্ষনেই দেখা গেল রক্তাক্ত শরীরে রাজাবাবু লুটিয়ে পড়েছেন, কয়েকবার ছটপটানির পর ধীরে ধীরে নিথর হয়ে গেল তার শরীর। এবার যেন রাণীমার হুশ হল, তিনি রক্তাক্ত নিথর স্বামীকে দেখে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না, বন্দুকটা তার হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল, ওটা ধীরেধীরে তুলে নিয়ে এবার তিনি নিজের কপালে গুলি করলেন। জনমানবশূন্য পূরীতে তিনটে লাশ পড়ে রইল।

এতক্ষণ মিলনরা উদ্বেগের সাথে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে যেন একটা রুধ্বশ্বাস চিত্রনাট্য দেখছিল, এবার যেন তাদের সম্বিৎ ফিরল। তারা দেখল রায়বাড়ি আবার তার পুরোন অবস্থানে ফিরে এসেছে। চারদিকে ধূলো, মাকড়শা, কোথাও আর কোন ঝাড়লন্ঠন জ্বলছে না, কোনও লাশও কোথাও পড়ে নেই, যেন এতক্ষণ অদৃশ্য টিভির পরদায় একটা থ্রিলার মুভি চলছিল। তিনবন্ধু এতটাই হতবাক হয়ে গিয়েছিল যে তারা প্রথমটায় কথাই বলতে পারল না।

শুধু প্রদীপ অস্ফুট স্বরে বলল ” কি হল বল তো ব্যাপার টা! চল পালাই এখান থেকে” মিলন বলল ” ঠিকই বলেছিস, আর থেকে কাজ নেই এখানে, চল এইবেলা পালাই” সুজিত: “আজব!!! এ যে সত্যিই সত্যিই ভূতুড়ে বাড়ি” ওরা এসব আলোচনা করছে হঠাত যতসব অদ্ভুত ব্যাপার শুরু হয়ে গেল। কোথা থেকে একটা শূন্য চেয়ার উড়ে এসে পড়ল তাদের সামনে, তিনবন্ধু পরস্পরকে জাপটে ধরল ভয়ে। ধীরে ধীরে শূন্য চেয়ারে দেখা গেল কে যেন বসে আছে। রক্তমাংসের শরীর নয়, যে বসে আছে তার চেহারা যেন তরল কালো ধূম দিয়ে গঠিত। তিনজন তো ওদিকে ভয়ে কাঁপতে লাগল। তাদের সব সাহস নিমেষে উড়ে গেছে। ওদিকে সেই চেয়ারটা ধীরে ধীরে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।

তিনজনে ভয়ে কোনমতে পিছু হটতে হটতে নিজেদের জন্য বরাদ্দ সেই ঘরে ফিরে এল, চেয়ারটা ঘরে ঢুকল না, ধীরে ধীরে অন্যদিকে চলে গেল। ওদিকে জমিদারবাড়িতে নানা রকম শব্দ শোনা যেতে লাগল। নারীকন্ঠে মরন আর্তনাদ, গুলির শব্দ, পারস্পরিক তর্জন, বাকবিতণ্ডা। তিনবন্ধু যে ঘরে ছিল হঠাত তারা অনুভব করল ঘরের ভেতরটা কেমন ভ্যাপসা গরম হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে, তাদের দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল, কিন্তু তাদের এখন এক পা বাইরে বেরবার সাহস নেই, সামর্থ্য তো দূরের কথা।

হঠাত তাদের চমকে দিয়ে তাদের ঘরের দরজাটা ধীরেধীরে বন্ধ হয়ে গেল। তারা এখন এই ভয়ংকর অট্টালিকায় বন্দি। ঠিক এইসময় তাদের ঘরের এককোনায় দেখা গেল এক লম্বা শ্বেত মূর্তি যার মাথা ছাদ স্পর্শ করেছে, অনেক ওপরে দেখা যাচ্ছে মূর্তির অগ্নিময় চক্ষুদুটো। ধীরেধীরে সেই মূর্তি দেখা গেল ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল মানে বাইরের দেওয়ালের সাথে মিশে গেল। তিনবন্ধু আতঙ্ক এর প্রহর গুনতে লাগল, ভোর না হলে যে এই সমুদয় উপদ্রব থামবে না তা তারা বিলক্ষণ বুঝতে পারছিল।

মিলন তো বলেই ফেলল ” রাত এখন কটা বাজে বল তো? ভোরের আলো না ফুটলে যে বেরনো যাবে না। এতখানি সময়…. সুজিত বলল “তিনটে বাজে এখন, বাকি রাতটুকু জেগেই কাটিয়ে দিই, ভূত দেখার সাধ মিটে গেছে” প্রদীপ বলল “ঠিকই বলেছিস, এখন প্রাণ নিয়ে বেরোতে পারলে হয়, কি কুক্ষনে যে এলাম” ওরা এসব আলোচনা করছে হঠাত ওদের ঘরের দরজাটা নড়ে উঠল খটখট করে, তিনবন্ধু সংগে সংগে নিজেদের ফের জাপটে ধরল, এবার বুঝি তাদের মারতেই আসছে। দরজাটা খুলে গেল, দেখা গেল সেই একটু আগে যাকে খুন হতে দেখেছিল সেই নর্তকীটা দাঁড়িয়ে, তার পায়ের নূপুরের বোলও শোনা গেল।

তিনজনের অবস্থা তো তখন শোচনীয়, ঠকঠক করে কাঁপছে তারা। মেয়েটি জীবিত নয়, কিন্তু তার দেহের কোথাও এতটুকু বিকৃতি নেই, সুন্দর সুগঠিত নারীদেহ, যেন জীবিত রক্তমাংসের মানবী। হাতে ধরা একটা সেকেলে সেজবাতি। দরজা থেকেই মেয়েটি তাদের প্রতি মিষ্টি হেসে থেমে থেমে বলতে লাগল ” ভয় পেও না, আমি তোমাদের বাঁচাতেই এসেছি, এখুনি আমার সাথে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল, দেরী হলে রাণীমার হাত থেকে তোমাদের নিষ্কৃতি নেই।” সুজিতরা তখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না মেয়েটিকে, তারা তখনো অবিশ্বাস আর ভয় মেশান দৃষ্টিতে তাকে নিরীক্ষণ করে চলেছে। মেয়েটি এবার তাড়া লাগায় “তাড়াতাড়ি ওঠ, দেরী কোর না, বেরিয়ে এস বাইরে, রাণীমা এখনি এসে পড়বেন, তিনি তোমাদের ক্ষতি করতেই আসছেন, তিনি কিছুতেই তোমাদের জীবিত ফিরতে দেবেন না। তাই চল আর দেরী কোর না, এখুনি বাইরে চল।” মেয়েটির কথায় কি ছিল কে জানে ছেলেগুলোর মধ্যে সাহস ফিরে এল। তারা টলমল পায়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। তাদের উঠে দাঁড়াতে দেখে মেয়েটি বলল “এস আমার পেছনে, আর দেরী করা ঠিক হবে না।” মেয়েটির পিছু পিছু ওরা একেবারে জমিদার বাড়ির বাইরে এসে পড়ল। একটা ফাকা মাঠের মাঝখানে এসে মেয়েটি থামল।

ঘুরে তাকাল সুজিতদের দিকে। তিনবন্ধুর মন থেকে ততক্ষনে মেয়েটির ব্যাপারে ভয় চলে গিয়েছিল কিন্তু তারা তখনো হতবিহ্বল হয়ে তাকে দেখছিল। চোখের সামনে ভূত প্রেত, আত্মা দেখাটা যে কি জিনিস তা ওরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছিল। মেয়েটি ওদের উদ্দেশ্য করে বলল “এই মাঠ টা পেরোলেই তোমরা গ্রাম দেখতে পাবে যেখান থেকে তোমরা এসেছিলে, নির্ভয় যেতে পার এখন” সুজিত এবার অস্ফুট ভাবে বলল “আপনি”! মেয়েটি একটু হেসে বলল “আমি ললিতাবাঈ, এখানকার শেষ রায়বাহাদুর সূর্যনারায়ন রায়ের এই বাড়িতে নৃত্য কলা পরিবেশন করতাম। আমার ব্যাপারে আর বেশী কি বলব! বাকি সব তো নিজের চোখেই দেখলে।

রাণী বসুধা দেবী মোটেও গান বাজনা পছন্দ করতেন না তাই সেই রাতে তিনি ক্রোধে অন্ধ হয়ে ওই কাজ করেছিলেন। আজও আমার নিজেকে দোষী মনে হয়, মনে হয় জমিদার বাবু, রাণীমা আর আমার নিজের পরিণতি র জন্য আমি নিজেই দায়ী, কিন্তু সূর্য নারায়ণ বাবুর মতো অতিথি বৎসল আর সজ্জন মানুষের অনুরোধ ফেলতাম ই বা কেমন করে!” শেষের কথাটা বলার সময় ললিতাবাঈয়ের গলার স্বরটা কেমন স্তিমিত হয়ে এল, কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল যেন। তারপরই হঠাত সম্বিত ফিরে পেয়ে বলল “আচ্ছা, তোমরা এগোও, আমি চললাম” বলেই ললিতাবাঈয়ের শরীরটা মোমের মতো গলে গিয়ে ধূপের মৃদু ধোয়ার মতো রাতের বাতাসে মিলিয়ে গেল।

তিনবন্ধু নিরাপদে গ্রামে ফিরে এসেছিল ঠিকই কিন্তু ললিতাবাঈয়ের কথা তারা জীবনেও ভুলতে পারে নি। কোনওদিন পারবেও না। আজও তাদের মনে হয় সেদিন যদি ললিতাবাঈ তাদের বাইরে না নিয়ে আসত, তাদের অদৃষ্টে কি ঘটত!

No comments