অত্যাচারী রাজা - শিক্ষামূলক গল্প


এক রাজার গল্প শোনো। সে ছিল ভারী অত্যাচারী। সে চাইতো, সে যা বলবে, সবাই তা মেনে নেবে। জি হুজুর বলে তাকে সমর্থন করবে। সে চাইতো, সে দিনকে রাত বলবে, রাতকে বলবে দিন–অমনি মন্ত্রী আর পরিষদরা বলবে, ঠিক হুজুর, ঠিক। সে চাইতো প্রজারা তার নাম শুনেই মাথা নত করবে। রাজার কথা সব সময়ই মেনে নেয়া সম্ভব হতোনা প্রজাদের। যেমন, একবার রাজা প্রজাদের আদেশ করলো, তোমাদের দ্বিগুণ খাজনা দিতে হবে। শুনেই প্রজাদের আর্তনাদ শুরু হয়ে গেলো। অনেকের পক্ষেই দ্বিগুণ খাজনা দেয়া সম্ভব হলোনা। রাজার কোটালরা এসে ধরে নিয়ে গেল তাদের। পাইকারী হারে মৃত্যুদন্ড দেয়া হলো। রাজ্যের বহুলোক প্রাণ হারালো। রাজার অত্যাচারে কেবল যে প্রজা মারা যেতো তা নয়; মন্ত্রী, অমাত্য এবং রাজকর্মচারীদেরও নিস্তার ছিলনা।

একজন মন্ত্রী হয়তো মনের ভুলে একটি সত্য কথা বলে ফেললো, রাজার তা পছন্দ হলোনা, অমনি সে তার প্রাণদন্ড দিলো। কারণে অকারণে মন্ত্রী, অমাত্য আর রাজকর্মচারীদের মৃত্যুদন্ড চলতে থাকলো রাজার হুকুমে। ফলে দরবারে মন্ত্রী, অমাত্য আর রাজকর্মচারীদের সংখ্যা কমতে লাগলো। শেষে এমন হলো যে, রাজদরবার অচল হয়ে পড়লো। সব চেয়ে সংকট দেখা দিলে মন্ত্রীর অভাবে। রাজা ঘোষণা দিলো, মন্ত্রী চাই, মন্ত্রী নিয়োগ করা হবে। কিন্তু ভয়ে কেউ মন্ত্রী হবার জন্যে এগিয়ে এলোনা। রাজা প্রহরী পাঠিয়ে দিলে মন্ত্রী খুঁজে আনার জন্যে। ঘোড়া নিয়ে সারা রাজ্যে ঘুরতে লাগলো প্রহরীরা। রাজার ঘোষণা যে শোনে, সে-ই পালিয়ে যায়। কেউ মন্ত্রী হতে চায় না।

প্রহরীরা পড়ে গেলো মহা বিপদে। মন্ত্রী নিয়ে রাজার কাছে ফিরে যেতে না পারলে তাদের যে গর্দান যাবে। প্রহরীদের দেখে সবাই যখন সরে যাচ্ছিল, তখন পাওয়া গেলো একটি লোককে। প্রহরীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। লোকটাকে বললো, ভাই, রাজা তোমাকে মন্ত্রী বানাতে চান। এখুনি চলো।

লোকটা ছিল মাতাল। সে প্রহরীদের কথায় রাজী হয়ে গেলো। জিজ্ঞেস করলো, আমাকে কি করতে হবে?

প্রহরীরা বললো, রাজার সব কথায় কেবল ‘জ্বি হুজুর’ বললেই চলবে। লোকটি ছিল জাতে মাতাল, তালে ঠিক। সে প্রহরীদের কথায় সায় দিয়ে বললো, তা পারবো।

প্রহরীরাও প্রাণে বেঁচে গেলো। নতুন মন্ত্রী পেয়ে রাজাতো ভারী খুশী। এমন অনুগত মন্ত্রী তার একটিও জোটেনি। কিছু না বলতেই সে জবাব দেয়, জ্বি হুজুর, ঠিক হুজুর। আগের মন্ত্রীরা রাজার প্রশ্ন শুনে কিছু একটা ভেবে চিন্তে কথা বলতো। নতুন মন্ত্রী ভাবনা চিন্তার ধার ধারে না। সোজা বলে বসে, জ্বি হুজুর, ঠিক হুজুর। রাজা ভাবলো, আহ্, এমন না হলে কি চলে!

কিছুদিনের মধ্যেই রাজা বিগড়ে গেলো। মানুষ হত্যার ইচ্ছেটা আবার চাড়া দিয়ে উঠলো তার মাথায়। মন্ত্রীকে হত্যা করার ছুতো খুঁজতে লাগলো সে। রাজা একদিন বললল। চলো মন্ত্রী, আমরা কোথাও থেকে ঘুরে আসি। মন্ত্রী বললো, জি হুজুর, ঠিক হুজুর।

রাজা আর মন্ত্রী ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে বের হলো। লোকজন যে যেখানে ছিল ভয়ে পালালো। কি জানি, পাগলা রাজা আর মাতাল মন্ত্রী কোন্ অঘটন ঘটিয়ে বসে।

দরবারের বাইরে এসে রাজা ভারী আনন্দ পেলো। মন্ত্রীকে বললোঃ চলো আমরা আরো সামনে এগিয়ে যাই।

সামনে খোলা মাঠ, মাথার ওপর উন্মুক্ত আকাশ — বেড়াবার খুব সখ হলো রাজার। ঘোড়া ছুটিয়ে উঁচু-নিচু পথ পেরিয়ে তারা এলো একটা বিশাল প্রান্তরে। এক পাশে সবুজ বন। বনের ধার ঘেঁষে বিরাট একটি দীঘি। এতক্ষণ পথ চলতে চলতে রোদের তাপে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল রাজা। দীঘির টলটলে জল দেখে তার ইচ্ছে করলে গোসল করতে। অমনি সে মন্ত্রীকে বললোর আমি গোসল করবো। তুমি জিনিসপত্র পাহাড়া দাও। মন্ত্রী বললো, জ্বি হুজুর, ঠিক হুজুর।

রাজা মুকুট খুললল। সব পোষাক খুললো। নাইতে নামলো দীঘিতে। ঠাণ্ডা পানিতে শরীরটা জুড়িয়ে গেলো তার। আরাম পেয়ে আরো সামনে এগিয়ে গেলো সে। তার খেয়ালও রইলো না যে, সে সাঁতার জানে না। সামনে এগিয়ে যেতে যেতে গভীর পানিতে ডুবে যেতে লাগলো রাজা। অমনি সে চিৎকার দিয়ে মন্ত্রীকে ডাকলোঃ বাঁচাও — বাঁচাও।

মন্ত্রী বললো, জ্বি হুজুর, ঠিক হুজুর। সে একটুও নড়লো না। রাজাকে উদ্ধার করার নামও নিলো না। দাঁড়িয়ে থেকে কেবল বললো, জ্বি হুজুর, ঠিক হুজুর।

এদিকে রাজা দাপাদাপি করতে করতে গভীর পানিতে ডুবে গেলো। মারা গেলে কিছুক্ষণের মধ্যেই।।

মন্ত্রী আর কি করে। রাজার মুকুট পরলো। পোষাক পরলো। ফিরে এলো রাজধানীতে। সবাইকে জানিয়ে দিলো, এখন থেকে আমিই রাজা।

নতুন রাজা পেয়ে প্রজারা খুশি না হলেও অত্যাচারী রাজার মৃত্যুতে স্বস্তি পেলো। তারা খুশি হলো। অত্যাচারী রাজার পরিণাম এমনই হয়ে থাকে।

No comments