নিশাচর – প্রেমেন্দ্র মিত্র


দশ বৎসর আগে বাংলার দুটি স্বামী-স্ত্রীর সাধারণ একটি দাম্পত্য কলহের যা নিদারুণ পরিসমাপ্তি ঘটিয়াছিল, তাহার কথাই বলি।

বাড়িটি তেমন ভাল নয়‚ অত্যন্ত জীর্ণ। সংস্কার অভাবে তাহার চারিধারের দেয়াল নানা জায়গাতেই ভাঙিয়া পড়িয়াছে। কিন্তু সে ভাঙা দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে সুদূর নীল পাহাড় আর শালের জঙ্গল যখন চোখে পড়ে, তখন তাহার জন্য কৃতজ্ঞ প্রকাশ করিতে ইচ্ছা হয়।

ছোট খড়ের দেয়াল। বাড়িটির সঙ্কীর্ণ বারান্দায় দাঁড়াইয়া কতদিন অমলা দূরের নীল পাহাড়-শ্রেণীর দিকে চাহিয়া আর চোখ ফিরাইতে পারে নাই। এমনটি আর সে কখনও দেখে নাই। বাঙলার সমতল আগাছা-আচ্ছন্ন পল্লীর সে মেয়ে। পৃথিবী যে এত বিশাল এমন সুন্দর—এ ধারণাই তাহার ছিল না। কাজ করিতে করিতে দিনে অন্ততঃ একশত বার সে বারান্দায় খানিকক্ষণের জন্য দাঁড়াইয়া দূরের পাহাড়ের দিকে চাহিয়া থাকে। স্বামীকে অন্ততঃ একশতবার দিনে ঘুরাইয়া ফিরাইয়া সেই এক কথাই বলে, ‘ভারী সুন্দর দেশ না গো?’

বিভূতিভূষণের অত উৎসাহ নাই। শুধু সংক্ষেপে ‘ই’ বলিয়া সায় দেয়, পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখিয়া তারিফ করিবার সময় নাই। তাহাকে অনেক কিছু ভাবিতে হয়। এক মাসের ছুটি মঞ্জুর হইয়াছে। তবু আধা মাহিনায়। ছুটি ফুরাইতে আরেকটা দরখাস্ত করিতে হইবে, কিন্তু মনিবেরা আর গ্রাহ্য করিবে বলিয়া মনে হয় না। অথচ অমলা এক মাসে কি-ই বা এমনি সারবে। দিন কুড়ি হইয়া গেল, তবু নিয়মিত জ্বর এখনও আসিতেছে। এখানকার লোকেরা বলে অন্ততঃ তিনমাস না থাকিলে নাকি এখানকার জল ভালো করিয়া গায়েই বসে না। কিন্তু তিন মাস ছুটি যদি না মিলে, এখানকার খরচ কুলাইবে কেমন করিয়া? সাহস করিয়া ভগবান ভরসা করিয়া সে রুগ্না স্ত্রীকে লইয়া চেঞ্জে আসিয়াছে, কিন্তু সাহসের একটা সীমা আছে। চেঞ্জের জায়গা হিসাবে বাড়িটির ভাড়া অত্যন্ত অল্পই বটে কিন্তু সেই অল্পই যে তাহার কাছে দুর্বহ বোঝা।

অমলা ইতিমধ্যে আর একটা কি মন্তব্য করে, সে শুনিতে পায় না।
অমলা একটু গলা চড়াইয়া বলে, ‘হ্যাঁ গা, কালা হয়েছ নাকি? এত কি ভাবছ বলো দেখি?’
বিভূতি একটু অসহিষ্ণু হইয়া বলে, ‘তোমারও একঘেয়ে এ সুন্দর তা সুন্দর শুনতে আর ভালো লাগে না বাপু। সুন্দর দেখে ত আর পেট ভরবে না।’

অমলা উচ্ছ্বাসের মধ্যে বাধা পাইয়া লজ্জিত হইয়া ওঠে, সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত ক্ষুণ্ণও হয়। স্বামীর ভাবনা যে কি তাহা সে জানে না, এমন নয়। কিন্তু স্বামী নিজেই তাহাকে বার বার সকল ভাবনা ত্যাগ করিতে বলিয়াছে। চেঞ্জে আসার কথায় খরচের কথা ভাবিয়া সে আপত্তি করিয়াছিল, কিন্তু নানা ভাবে বুঝাইয়া তাহার সে আপত্তি দূর করিয়াছে। সে সম্বন্ধে কোন কথা পাড়িলে স্বামী বলিয়াছে, ভাবনা-টানা ছেড়ে তুমি শুধু তাড়াতাড়ি সেরে ওঠবার চেষ্টা করে দেখি।

প্রথম প্রথম তাহাদের কি সুখেই কাটিয়াছে! নূতন দেশের সৌন্দর্যও বিস্ময় মুগ্ধ চোখে শুধু দেখিয়া নয়, পরস্পরকে বলিয়া যেন তারা ফুরাইতে পারে না। কিন্তু গত কয়দিন হইতে স্বামীর ভাব যেন কেমন বদলাইতে শুরু করিয়াছে, অমলার মনে হয়, দোষ তাহারই। চেঞ্জে আসিয়াও তাড়াতাড়ি না সরিয়া ওঠা তাহার অন্যায়। না সারিলে টাকা খরচ বৃথাই হইবে।

তবু স্বামীর এ বিরক্তি সে আশা করে নাই। মুখখানি ম্লান করিয়া সে ঘরের ভিতর চলিয়া যায়। ভাবে, স্বামীর এ বিরক্তি নিশ্চয়ই ক্ষণিকের; এখনি সে অনুতপ্ত হইয়া হয়ত ক্ষমা চাহিতে আসিবে। না, রাগ করিয়া সে থাকিবে না; কি একটা মজা করিবে। শুধু সৌন্দর্য দেখিয়াই একদিন সে সব ভুলিত, পেট ভরাইবার জন্য ব্যস্ত হইত না, তাহাই স্মরণ করাইয়া দিবে। কিন্তু অনেকক্ষণ কাটিয়া গেলেও বিভূতির আসিবার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। অমলা রাগ করিবে না ভাবিয়াছিল বলিয়াই বোধহয় তাহার অভিমান হঠাৎ প্রচণ্ড হইয়া ওঠে। অকারণে স্বামীর সামনে গিয়া দু’চার-বার যাতায়াত করিয়া সে ঘরে আসিয়া হঠাৎ খিল দেয়।
‘দরজায় খিল দিলে কেন গো। কি হ’ল আবার।’

অমলা সাড়া দেয় না। বিভূতি দু’চারবার কড়া নাড়ে, খুলিবার জন্য অনুরোধ করে, তাহার পর নিজে হইতেই বিরক্ত হয়। মেয়েদের কোনো কাজের যুক্তি খোঁজার নিষ্ফলতা সে অনেকদিন আগেই উপলব্ধি করিয়াছে।
খিল খুলিতে পীড়াপীড়ি করিলে বেশী দেরী হইবে একথা বুঝিয়া সে নীরবে নিজের কাজে চলিয়া যায়।

কিন্তু ঘণ্টাখানেক বাদেও ফিরিয়া আসিয়া দরজা বন্ধ দেখিয়া তাহার রাগ হয়। এতটা বাড়াবাড়ি কিসের জন্য। বিরক্ত হইয়া বলে, ‘সন্ধ্যা হয়ে এল, বেড়াতে যেতে হবে না? খিল দিয়ে ঘরে বসে থাকলেই শরীর সারবে নাকি?’
এবার ভিতর হইতে অমলা উত্তর দেয়, ‘বেড়াইতে সে যাইবে না, এ পোড়া শরীর তাহার চিতায় পুড়িলেই একেবারে সারিবে।’

বিভূতির রাগ বাড়ে। কড়া নাড়িয়া উষ্ণ স্বরে বলে, ‘ও সব ন্যাকামি রেখে তাড়াতাড়ি সাজ-পোশাক শেষ করে ফেল দিকি! অন্ধকার ত হয়ে গেল, আর বেড়াবার সময় কই?’
অমলা তথাপি দরজা খোলে না। তাহার অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠ শোনা যায়, আমি হয়েছি তোমার আপদ-বালাই, মরলেই তোমার হাড়-জুড়োয়! উঠতে বসতে দাঁত খিঁচোবে যদি, তাহলে চেঞ্জে আসার দরকার ছিল কি। কি হবে আমার শরীর সেরে?’

বিভূতির আর সহ্য হয় না। ‘বেশ কাঁদো তা হলে ঘরের ভেতর বিনিয়ে বিনিয়ে। আমি একাই যাচ্ছি বেড়াতে।’ বলিয়া রাগে সে বাহির হইয়া যায়।
বেড়াতে অবশ্য তাহার ভাল লাগে না। বাড়ির অদূরে একটা পাথরের উপর বসিয়া মেয়ে জাতটার এই অবুঝ অভিমানের কথাই সে ভাবে। এত রাগারাগি করবার মতো সে কি বলিয়াছে, আর যদি একটা রূঢ় কথা বাহির হইয়াই গিয়া থাকে, তাহার জন্য কি সন্ধ্যাটা মাটি করিতে হয় এমন করিয়া? আর কটা দিনই বা আছে। এখানের প্রত্যেকটা দিন যে তাহাকে কি মূল্যে কিনিতে হইয়াছে সে ভাল করিয়া জানে। এই কটি দিনের উপর সে ভরসা করিয়া আছে। অমলার জ্বর সারানো চাই-ই‚ তাহার ভেতর এই মূল্যবান দিনের একটি নষ্ট হইয়া গেল ভাবিয়া দুঃখের আর সীমা থাকে না। কে জানে কতটা উপকার এই দিনটিতেই হইতে পারিত। হয়ত কাল আর জ্বর আসিত না।
অন্ধকার হইতে সে বিষণ্ণ মনে বাড়ি ফিরিয়া আসে।

অমলা ঘর হইতে বাহির হইয়াছে। বেড়াইতে না যাক উনুন ধরাইয়া রান্না চড়াইতে ভোলে নাই। বিভূতির রাগ পড়িয়া তখন ক্ষোভ আসিয়াছে। কাছে গিয়া সে অত্যন্ত স্নেহের স্বরে বলে, ‘মিছিমিছি রাগ করে আজ বেড়ানোটা কেন নষ্ট করলে বলো দিকিনি! তুমি ভারী অবুঝ।’

অমলা কিন্তু ফোঁস করিয়া তিক্তকণ্ঠে জবাব দেয়, ‘যাও, আর সোহাগ করতে হবে না। নিজে বেড়িয়ে এসেছ ত তাহলেই হল।’
বিভূতি আঘাত পাইয়াও হাসিয়া স্নিগ্ধ স্বরে বলে, ‘বাবারে, এখনও রাগ যায়নি তোমার! তোমার ভালর জন্যেই বলছি লক্ষ্মীটি, রাগ করে শরীরের ক্ষতি এমন করতে আছে!’
অমলা রাগিয়া বলে, ‘আমার ভাল ত তুমি খুব চাও। চেঞ্জে আনতে টাকা খরচ হয়েছে বলে বুক টনটন করছে; উঠতে বসতে মুখনাড়া দিচ্ছো তাই।’

অন্যদিন হইলে ইহার চেয়ে অনেক বেশীই হয়ত বিভূতি সহ্য করিত। হয়ত আর একবার মান ভাঙাইবার চেষ্টা করিলেই সব গোলমাল মিটিয়া যাইতে পারিত। কিন্তু আজ তাহার হঠাৎ রাগ চড়িয়া যায়, উষ্ণ স্বরে বলে, ‘তোমার জন্যে টাকা খরচ হয়েছে বলে আমার বুক টনটন করছে বটে!’

‘করছেই তো।’ বিভূতি গলা চড়াইয়া বলে, ‘করবে নাই বা কেন! টাকা রোজগার করতে মেহনৎ হয় না? অমনি আসে? চেঞ্জে এসে ঘরে খিল দিয়ে থাকবে ত টাকা খরচ করবার কি দরকার ছিল?’
‘আমি তোমায় চেঞ্জে আনতে তো সাধিনি।’

বিভূতি সে কথায় কান না দিয়া ধরা গলায় বলিয়া যায়, ‘বিয়ে হওয়া ইস্তক জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মারলো। মরবে ত জানি, তা সোজাসুজি আগে থেকে মরলে ত আর আমার এত ঝঞ্ঝাট পোহাতে হয় না।’
অমলা সবেগে স্বামীর দিকে ফিরিয়া দাঁড়ায়, ‘আমার জন্যে তোমার ঝঞ্ঝাট পোহাতে হচ্ছে?’

অন্ধকারে বিভূতি মুখ নিচু করিয়া দাঁড়াইয়া থাকে উত্তর দেয় না। স্বামীর দিকে চাহিয়া খানিক দাঁড়াইয়া থাকিয়া অমলা রুদ্ধকণ্ঠে বলে, ‘বেশ আজই তোমার সব ঝঞ্ঝাট চুকিয়ে দিচ্ছি।’
অন্ধকারে অমলা খোল দরজা দিয়া হঠাৎ বাহির হইয়া যায়। বিভূতি আগাইয়া ধরিতে গিয়াও বোধহয় কি ভাবিয়া আবার ফিরিয়া বসিয়া পড়ে। অমলা ছেলেবেলা হইতে ভয়কাতর সে জানে। রাগ করিয়া বাহির হইয়া গেলেও বেশীক্ষণ সে থাকিতে পারিবে না। এখনি ফিরিবে।

কিন্তু একটু একটু করিয়া অনেকক্ষণ কাটিয়া যায়। তবু অমলা ফেরে না। বিভূতি এবার ভীত হইয়া ওঠে। দরজার কাছে আগাইয়া গিয়া কাহাকেও দেখিতে পাইয়া মৃদু স্বরে ডাকে, ‘অমলা’।
কোনো সাড়া-শব্দ নাই। বিভূতি আরো জোরে স্ত্রীর নাম ধরিয়া ডাকে। তবু কোনো উত্তর মিলে না। এক অজানিত আশঙ্কায় তাহার বুক কাঁপিয়া ওঠে। ঘরে আসিয়া লণ্ঠনটা জ্বালিয়া লইয়া সে দ্রুতপদে অমলাকে খুঁজিতে বাহির হইয়া যায়।

নিস্তব্ধ অন্ধকার রাত্রি। তাহারই মাঝে সুদূর পথে থাকিয়া বিভূতিভূষণের ব্যাকুলকাতর আহ্বান শোনা যায় ‘অমলা।’

ঘাটশীলার স্টেশনে বসিয়া গভীর এক অন্ধকার রাত্রে আমরা বিভূতি-অমলার দাম্পত্য জীবনের এই কাহিনীটি শুনিয়াছিলাম। কেমন করিয়া কি অবস্থায় শুনিয়াছিলাম, তাহার বিবরণ বড় অদ্ভুত।
ছিলাম চক্রধরপুরে। হঠাৎ রমেশের খেয়াল হইল অন্ধকারে মোটরে করিয়া গেলুডিতে গিয়া বিভাসকে চমৎকৃত করিয়া দিতে হইবে। আগের দিন সকালবেলা বিভাসের বাড়ি হইতেই তিনজন মোটরে করিয়া চক্রধরপুর রওনা হইয়াছিলাম। হঠাৎ পরের দিন গভীর রাত্রে তাহার দরজায় গিয়া ডাক দিলে বিস্মিত হইবার কথা। শুধু বিভাসকে চমকাইয়া দিবার জন্য এই রাত্রে এতখানি পথ যাইবার তেমন স্পৃহা আমার ও বীরেনের কাহারও ছিল না, কিন্তু রমেশের উৎসাহ দমাইয়া রাখা কঠিন! শেষ পর্যন্ত তাহার প্রস্তাবে রাজীই হইতে হইল। গোল বাধিল শুধু সোফারকে লইয়া। স্পষ্ট না বলিলেও, ভাবে বোঝা গেল, এই অন্ধকার রাত্রে মোটর হাঁকাইয়া যাইতে তাহার বিশেষ আপত্তি আছে। সে সম্বন্ধে সবিশেষ প্রশ্ন করিয়া মনে হইল, ভয়টা তাহার পার্থিব কোনো প্রাণী বা দ্রব্য বিশেষের জন্য নয়‚ তাহার ভয় ভৌতিক। এ পথে রাত্রে মোটর চালানো নাকি মোটেই নিরাপদ নয়।

কিন্তু তাহার কোনো আপত্তিই রমেশ টিঁকিতে দিল না। সন্ধ্যার খানিক বাদেই রওনা হইয়া পড়িলাম। পরিষ্কার সোজা পথ। গাঢ় অন্ধকারের ভিতর দিয়া আমাদের প্রখর হেডলাইট সে পথ ভেদ করিয়া চলিয়াছে। মনে হয় যেন অন্ধকারের ভিতর হইতে আমাদের আলোর পথ প্রতি মুহূর্তে আমরা সৃষ্টি করিয়া চলিয়াছি। যে বেগে মোটর চলিতেছিল, তাহাতে পৌঁছিতে অতিরিক্ত দেরি হইবার কথা নয়।
রমেশের পা-টা সামনের সীটের উপর তুলিয়া দিয়া আরামে মাথা হেলান দিয়া বলিল, ‘কি আরাম বলো দেখি! অন্ধকার রাত্রে মোটর চালাবার মতো মজা আছে? বিশেষতঃ এমনি পথে!’
বীরেন বলিল, ‘কিন্তু কি ভয়ঙ্কর অন্ধকার বলো দেখি? মনে হয় যেন আমাদের হেডলাইটকে সবলে ঠেলে এগুতে হচ্ছে।’

রমেশ কি বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু বলা হইল না। হঠাৎ সার্চলাইটটা নিবিয়া গেল; আর সেই মুহূর্তে মনে হইল আমাদের চারিধারে অন্ধকার যেন ওত পাতিয়া বসিয়া ছিল, আলো নিবিতে একেবারে সবেগে ঘিরিয়া ধরিল।
বীরেন বলিল, ‘একি!’

সোফার গাড়ি থামাইয়া নামিয়া বলিল, “কি জানি বুঝতে পারছি না।’ তার কণ্ঠস্বরে সম্মানের চেয়ে ভয় ও বিরক্তির পরিচয় বেশী পাইলাম।
দু’ধারে ঘন জঙ্গল, তাহার মাঝে সেই নির্জন পথে অন্ধকারে শুধু দেশলাইয়ের আলোক সম্বল করিয়া সোফার অনেকক্ষণ হেডলাইট জ্বালিবার বৃথা চেষ্টা করিয়া অবশেষে বলিল, ‘না, এ জ্বলবে না।’
‘তাহলে উপায়?’ সোফার বলিল, ‘গাড়ির অন্য আলো জ্বলবে মনে হচ্ছে, কিন্তু তাতে পথ ভালো দেখা যাবে না।’
রমেশ বলিল, ‘তাই জ্বেলেই চলো, এখান থেকে আর ফেরা যায় না।’
তাহাই হইল। মোটরের সামান্য আলোয় যে দুর্ভেদ্য অন্ধকার যতটুকু দূর করা যায় তাহাই করিয়া আবার অগ্রসর হইতে শুরু করিলাম। আলোর জোর নাই, সুতরাং গাড়ির বেগ একটু কমাইয়া চলিতে হইল।
বীরেন বলিল, ‘পথ চিনে ঠিক যেতে পারবে ত?’

প্রশ্নটা সকলের মনেই উঠিয়াছিল। সোফার বলিল, ‘তা কেমন করে বলি বাবু! একবার মাত্র এ পথে এসেছি, তাও দিনের বেলায়।’
তাহার গলায় বিরক্তির স্বর এবার স্পষ্ট। কিন্তু তখন তাহা লক্ষ করিবার সময় নাই। ভীতভাবে বলিলাম, ‘কিন্তু পথ ভুল হলে এই অজানা জায়গায় কি উপায় হবে বলে ত?”
সোফার কথা বলিল না। মনে মনে রমেশের উপর রাগ হইতেছিল। গোঁয়ার্তুমি করিয়া অন্ধকার রাত্রে অজানা বিপদসঙ্কুল পথে এমন করিয়া তাহার জেদেই বাহির হইতে হইয়াছে।

বীরেন বলিল, ‘ধরো‚ যদি ইঞ্জিনটা কোনরকমে খারাপ হয়ে যায়…’ এবং এই সম্ভাবনা ভালো করিয়া হৃদয়ঙ্গম করিবার আগেই আবার বলিল, ‘এসব বনে বাঘ আছে জানো তো?’
রমেশ আশ্বাস দিবার জন্য হাসিয়া বলিল, ‘মোটর খারাপ হবে, এমন আজগুবি কথা ভাবছই বা কেন?’ কিন্তু তাহার কণ্ঠস্বরে মনে হইল, তাহার নিজের কথায় নিজেরই আস্থার একান্ত অভাব।

তাহার পর খানিক সবাই নীরবে চলিলাম। চারদিকের নিস্তব্ধতা ও অন্ধকার আমাদের ছোট মোটরের ক্ষীণ আলোয় আমরা ক্ষীণভাবে ভেদ করিয়া চলিয়াছি। পাশের গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ জঙ্গলের আবছা মূর্তি যেন এই উপদ্রব প্রতিপদে ভ্রুকুটি করিতেছে মনে হইতেছিল। মোটরের সামান্য একটি বেয়াড়া শব্দেই বুক কাঁপিয়া উঠিতেছিল‚ এই বুঝি বন্ধ হইয়া যায়।

কিন্তু মোটর বন্ধ হওয়ার সমান বিপদই শেষ পর্যন্ত হইল। কত মাইল কতক্ষণ ধরিয়া তখন আসিয়াছি বলিতে পারি না। হঠাৎ সোফার গাড়ি থামাইয়া সামান্য ইতস্তত করিয়া বলিল‚ ‘পথের উপর একটা নালা পড়ে। এখনো এলো না। অন্ধকারে পথ ভুল হয়নি তো?’
রমেশ বলিল, ‘পার হয়ে আসনি, দেখেছ ঠিক!’
‘দেখছি বইকি।’
ইহার পর আর কি করা যাইবে, কিছুই ঠিক করিতে পারিলাম না। এখান হইতে আগানো বা পিছানো সমান বিপদ। এই অন্ধকার রাত্রে গহন জঙ্গলের মাঝে এদিক-ওদিক ঘুরিয়া মাঝপথে যদি পেট্রোল ফুরাইয়া যায়, তাহা হইলেই সর্বনাশ।

কি করা উচিত ভাবিতেছি, এমন সময়ে বীরেন বলিল, ‘রোসো রোসো একটা আলো দেখা যাচ্ছে না!’
সত্যি আলোই ত বটে! অদূরে কে একজন লণ্ঠন হাতে করিয়া আমাদের দিকেই আসিতেছে মনে হইল। কাছে আসিতে দেখিলাম লোকটি আর যাহাই হোক, প্রিয়দর্শন নয়। অন্ধকার রাতে তাহাকে হঠাৎ পথে দেখিলে আঁতকাইয়া উঠিবার কথা। শীর্ণ দেহ, শীর্ণ ঝাঁকড়া চুল সেই শীর্ণ মুখের ফণার মতো উঁচাইয়া আছে। হাড়-বাহির করা মুখে সবচেয়ে অদ্ভুত তাহার কোটর নিবিষ্ট চোখ দুটি। হঠাৎ মনে হয় বুঝি উন্মাদ। কিন্তু তখন অতো বিচারের সময় ছিল না। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘এই রাস্তায় কি গেলুডি যাওয়া যায় জান?’

লোকটার ধরন ধারণও অদ্ভুত। খানিক সে আমাদের কথায় কোনো উত্তরই দিল না। হয়ত সে শুনিতেই পায় নাই ভাবিয়া আবার জিজ্ঞাসা করিতে যাইতেছি এমন সময় অত্যন্ত গম্ভীরভাবে বলিল, ‘এই পথই বটে।’
লোকটির কথার ধরন দেখিয়া কিন্তু কেমন সন্দেহ হইল; বলিলাম, ‘ঠিক জান ত!’

এতক্ষণে সে অত্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাদের পর্যবেক্ষণ করিতেছিল, আমার কথায় হঠাৎ ক্রুদ্ধ হইয়া বলিল, ‘এইখানে বিশ বছর ধরে আছি আর গেলুডির পথ জানি না!’
যাক, হয়ত তাহার কথা সত্য। সোফার আবার গাড়ি ছাড়িয়া দিল। বলিলাম, ‘যা হবার হয়ে গেছে, এখন চলো সামনে যতদূর পথ মেলে।’

বহুক্ষণ‚ প্রায় ঘণ্টা দুয়েক হবে—এইভাবে চলিবার পর এক জায়গায় আসিয়া কিন্তু ঠেকিয়া গেলাম। সামনে পথ দ্বিধাবিভক্ত হইয়া চলিয়া গিয়াছে। সোফার বলিল, “কোনটায় যাব বুঝতে পারছি না।’
এবার সমস্যা সত্যই দারুণ। দুইটা পথই যে ঠিক নয় এটুকু বুঝিবার জন্য বেশি বুদ্ধির দরকার নাই। কিন্তু কোন পথে যাওয়া যায়? গাড়ি থামাইয়া আমরা সেই তর্ক করিতেছি, এমন সময় বীরেন বলিল, ‘না বিধাতা আমাদের সহায়, ওই আরেকটা আলো দেখা যাচ্ছে।’

এবারেও একটা লোক আলো লইয়া আসিতেছিল বটে! বলিলাম, এই জঙ্গলের মাঝে মানুষ থাকতে পারে ভাবিনি।’
এবারের লোকটা কাছে আসিতে সোফারই তাহাকে পথ জিজ্ঞাসা করিল।
লোকটা বিড়বিড় করিয়া কি বলিল, শুনিতে পাইলাম না। কিন্তু সোফারকে তাড়াতাড়ি গাড়ি চালাইয়া দিতে দেখিয়া বুঝিলাম‚ সে এবার রাস্তা বুঝিয়াছে।
হঠাৎ বীরেন বলিল, ‘দাঁড়াও, গাড়ি একটু থামাও ত!’
তাহার উত্তেজিতভাব দেখিয়া সভয়ে বলিলাম‚ ‘কেন?’

বীরেন কম্পিত গলায় বলিল, ‘লোকটাকে লক্ষ্য করেছ তোমরা!’ আমাদের উত্তরের অপেক্ষা না করিয়াই ফের বলিল, ‘প্রথম যে লোকটা আমাদের পথ বলে দেয় একেবারে হুবহু সেই লোক?’
ঠিক অমনি একটা সন্দেহ আমারও হইতেছিল, কিন্তু ভয় ধরা পড়িবার লজ্জায় বলিতে পারি নাই। বীরেনের কথায় সর্বাঙ্গে কাটা দিয়া উঠিল। যথাসাধ্য সাহস সংগ্রহ করিবার চেষ্টা করিয়া বলিলাম, ‘কিন্তু তাকে প্রায় বিশ মাইল দূরে ফেলে এসেছি!‘

‘সেই ত আশ্চর্য ব্যাপার! এই জনমানবহীন জঙ্গলের পথে দু’-দু’বার মানুষের দেখা পাওয়াই অদ্ভুত ব্যাপার। তার ওপর বিশ মাইল পার হয়ে সেই একই লোক!’
সোফার হঠাৎ গিয়ার বদলাইয়া দ্বিগুণ বেগে গাড়ি ছাড়িয়া দিল। বলিলাম, ‘ও কি করছ!’
সে তিক্তকণ্ঠে বলিল, “কি করব বাবু, আমার প্রাণের ভয় নেই?’
‘তুমিও দেখেছ নাকি?’

সোফার পিছনে না ফিরিয়াই ভীতস্বরে বলিল, “দেখেই না অত তাড়াতাড়ি গাড়ি ছেড়ে দিলাম।’
পরমুহূর্তে আমরা সকলে একসঙ্গে হৈ হৈ করিয়া চীৎকার করিয়া উঠিলাম! সোফার প্রাণপণে ব্রেক কষিয়া গাড়ি রুখিতে গেল। গাড়ি থামিল না, স্টিয়ারিং হুইল একেবারে পাক খাইয়া পাশে গড়ানে খাদ দিয়া হুড়–হুড় করিয়া নামিয়া চলিল। সামনের দিকে চাহিয়া সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্তে দেখিতে পাইলাম নীচে গভীর জল। বুঝিলাম, আমাদের সলিল সমাধি হইতে চলিয়াছে। ভয়ে চোখ বুজিলাম!
কিন্তু শেষ পর্যন্ত রক্ষা পাইলাম। সামনে বুঝি উঁচু একটা তারের জাল ছিল, তাহাতে গাড়ী আটকাইয়া গেল। এ রকম অবস্থায় গাড়ি উলটাইয়া যাইবার কথা, কিন্তু ভাগ্যক্রমে তাহা হয় নাই। চোখ খুলিয়া দেখিলাম, প্রবল ঝাঁকুনি খাইয়াও অক্ষত শরীরেই সবাই রক্ষা পাইয়াছি।

প্রথম কথা কহিল বীরেন। আতঙ্কের স্বরে বলিল, ‘লোকটার একেবারে কি বুকের ওপর দিয়ে গাড়ি গেছে সোফার?’
সোফারের পায়ে আঘাত লাগিয়াছিল। খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে বাহির হইয়া বলিল, কি জানি বাবু, ব্রেক কষতে কষতেই গাড়ি ঘুরে গেছে। রোখবার সময় পাইনি।’
তাড়াতাড়ি বাহির হইয়া বলিলাম, ‘এখনই দেখতে হবে চলো।’

সবাই মিলিয়া উপরে উঠিয়া আসিলাম। কিন্তু আশ্চর্য‚ তন্ন তন্ন করিয়া চারিদিক খুঁজিয়া কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না। এক জোয়ান মানুষ, সবাই মিলিয়া স্পষ্ট তাহাকে গাড়ির ধাক্কা খাইয়া পড়িয়া যাইতে দেখিয়াছি। তাহার দেহ এই এক মিনিটের ভেতর কোথায় উধাও হইয়া যাইতে পারে। যেদিকে খাদ সেদিকেও পড়ে নাই। পড়িয়াছে একেবারে সম্পূর্ণ অন্য দিকে, সেখান হইতে মৃত বা জীবন্ত কাহারও এক মিনিটে অন্তর্ধান হওয়া একেবারেই সম্ভব নয়।
বীরেন বলিল, ‘তাহলে কি?’

তাহার কথা শেষ করিতে হইল না। একই আতঙ্কে সবারই বুক কাঁপিতেছে। বলিলাম, ‘ও মোটর আজ আর ওঠান যাবে না। চলো, সবাই মিলে এগিয়ে যাই।’
রমেশ বলিল, ‘কিন্তু কোথায়?’
বলিলাম, ‘ওই দূরে একটা লাল আলো দেখা যাচ্ছে, বোধ হচ্ছে যেন স্টেশন একটা হবে।’
বীরেন বলিল, ‘কিন্তু—আবার আলো!’

সেদিন অনেক হয়রানির পর অবশেষে স্টেশনে পৌঁছাইয়া ছিলাম। পথ ভুলে যে কতখানি হইয়াছে স্টেশনের নাম দেখিয়াই বোঝা গেল। গেলুডি আসিতে একেবারে ঘাটশীলায় আসিয়াছি। গভীর রাত্রি। স্টেশনে তখন এক টেলিগ্রাফ মাষ্টারই জাগিয়া ছিলেন। লোকটি অত্যন্ত ভদ্র। আমাদের সাদর অভ্যর্থনা করিয়া আশ্রয় দিয়া বলিলেন, ‘আজকের রাতটা এখানে থাকুন, কাল আপনাদের মোটর তোলবার ব্যবস্থা করে দেব।’

ঘুমাইবার ব্যবস্থা একপ্রকার তিনি করিয়া দিয়াছিলেন, কিন্তু তখন আর ঘুমাইবার প্রবৃত্তি নাই! তাহাকে সমস্ত দুর্ঘটনার কাহিনীই বলিলাম।

ভদ্রলোক গম্ভীর হইয়া বলিলেন, ‘আপনারা জানেন না তাই, নইলে এ অঞ্চলে সাহেব-সুবোরাও রাত্রে ও-পথে মোটর নিয়ে বেরোয় না। আপনারা তবু প্রাণে বেঁচেছেন। পাঁচ ছ’টা মোটর লোকজন সমেত এই রাত্রে আশ্চর্যভাবে চুরমার হয়ে গেছে।’
সভয়ে বলিলাম, কিন্তু কি ব্যাপার মশাই?’
‘শুনি মোটরের উপরই তার যত আক্রোশ! সারারাত নাকি অমনি লণ্ঠন নিয়ে এই পথে ঘুরে বেড়ায়।’
ভীত-কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কে?’

সিগন্যালার মশাই ধীরে ধীরে বলিলেন, ‘দশ বৎসর আগে এখানকার একটি লোক রাত্রে তার স্ত্রীকে খুঁজতে বেরিয়েছিলেন আর বাড়ি ফেরেনি।’
তারপর একটু থামিয়া বলিলেন, ‘ওই পথে সে মোটর চাপা পড়ে মারা যায়।’

No comments