খিজির ও মুসা (আঃ) এর একটি শিক্ষণীয় ঘটনা


হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, হযরত উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হ’তে আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন যে, হযরত মূসা (আঃ) একদা বনী ইসরাঈলের এক সমাবেশে ভাষণ দিতে দাঁড়ালে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হ’ল, কোন ব্যক্তি সর্বাধিক জ্ঞানী?

তিনি বললেন, আমিই সর্বাধিক জ্ঞানী। জ্ঞানকে আল্লাহর দিকে সোপর্দ না করার কারণে আল্লাহ্‌ তাকে তিরস্কার করে বললেন, বরং দু’সাগরের সঙ্গমস্থলে আমার এক বান্দা আছে, যিনি তোমার চেয়ে অধিক জ্ঞানী। অতঃপর আল্লাহর আদেশ মত তিনি সফর শুরু করলেন।

কোন প্রামানিক পন্থায় এ বিষয় জানা যায়নি যে, হযরত মুসা (আ.) এর এই সফর কোন সময়ে ঘটেছিল এবং সঙ্গমস্থলটি কোথায় ছিল। কিন্তু কাহিনীটি নিয়ে চিন্তা করলে মনে হয়, মুসা (আ.) যখন মিশরে অবস্থান করছিলেন ঘটনাটি সেই সময়ে যখন ফিরাউনের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব চলছিল আর সঙ্গমস্থলটি ছিল – শ্বেতনীল (White Nile) কটানীল (Blue Nile) যার সঙ্গমস্থলে বর্তমানে খার্তুম শহর বিদ্যমান।

হযরত মূসা (আঃ) বললেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! তার নিকট পৌঁছাতে কে আমাকে সাহায্য করবে? কখনো সুফইয়ান এভাবে বর্ণনা করেছেন, আমি কিভাবে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে পারি? তখন বলা হ’ল, তুমি একটি থলিতে করে একটি মাছ নাও। যেখানে তুমি মাছটি হারাবে, সেখানেই আমার সে বান্দা আছে। অতঃপর হযরত মূসা (আঃ) একটি মাছ ধরলেন এবং থলিতে রাখলেন। অতঃপর মাছ নিয়ে তাঁর সঙ্গী ইউশা বিন নূনকে সাথে নিয়ে চললেন। শেষ পর্যন্ত তারা একটি পাথরের কাছে পৌঁছলেন এবং তার উপর মাথা রেখে বিশ্রাম নিলেন। হযরত মূসা (আঃ) ঘুমিয়ে পড়লেন। এ সময় মাছটি থলি থেকে বের হয়ে লাফিয়ে সমুদ্রে চলে গেল। অতঃপর সে সমুদ্রে সুড়ঙ্গের মত পথ করে নিল। আর আল্লাহ্‌ মাছটির চলার পথে পানির প্রবাহ থামিয়ে দিলেন।ফলে তার গমনপথটি সুড়ঙ্গের মত হয়ে গেল। অতঃপর তারা উভয়ে অবশিষ্ট রাত এবং পুরো দিন পথ চললেন।

পরদিন সকালে হযরত মূসা (আঃ) তার সাথীকে বললেন, “আমরা তো সফরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, এখন আমাদের খাবার আন”। হযরত মূসা (আঃ)-কে আল্লাহ্‌ যে স্থানে যাবার কথা বলেছিলেন, সেই স্থান অতিক্রম করার পূর্ব পর্যন্ত তিনি কোনরূপ ক্লান্তিবোধ করেননি। সাথী ইউশা বিন নুন তখন বলল, আপনি কি ভেবে দেখেছেন, যে পাথরটির নিকট আমরা বিশ্রাম নিয়েছিলাম সেখানেই মাছটি অদ্ভুতভাবে সমুদ্রের মধ্যে চলে গেছে।কিন্তু আমি মাছটির কথা আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। মূলত: শয়তানই আমাকে এ কথা ভুলিয়ে দিয়েছে। বর্ণনাকারী বলেন, পথটি মাছের জন্য ছিল একটি সুড়ঙ্গের মত আর তাঁদের জন্য ছিল এক আশ্চর্যজনক ব্যাপার।

হযরত মূসা (আঃ) বললেন, আমরা তো সেই স্থানটিরই অনুসন্ধান করছি। অতঃপর তারা তাদের পদচিহ্ন ধরে ফিরে চললেন এবং ঐ পাথরের নিকটে পৌঁছে দেখলেন, এক ব্যক্তি কাপড় মুড়ি দিয়ে বসে আছেন। মূসা (আঃ) তাঁকে সালাম দিলেন। তিনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন, এখানে সালাম কি করে এলো? তিনি বললেন, আমি মূসা। খিজির জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি বনী ইসরাঈল বংশীয় মূসা? মূসা (আঃ) বললেন, হ্যাঁ। আমি এসেছি এজন্য যে, সত্য পথের যে জ্ঞান আপনাকে দান করা হয়েছে, তা হ’তে আপনি আমাকে শিক্ষা দিবেন। খিযির বললেন, হে মূসা! আমার আল্লাহ্‌ প্রদত্ত কিছু জ্ঞান আছে, যা আপনি জানেন না।

আর আপনিও আল্লাহ্‌ প্রদত্ত এমন কিছু জ্ঞানের অধিকারী, যা আমি জানি না। মূসা (আঃ) বললেন, আমি কি আপনার সাথী হ’তে পারি? খিজির বললেন, ‘আপনি কিছুতেই আমার সাথে ধৈর্যধারণ করতে পারবেন না। আপনি আমার সঙ্গে থেকে আমার কার্যাবলী দেখলে আমার নিকট তথ্যানুসন্ধান ও জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকবেন। যেমনটি ছাত্র শিক্ষককে শিক্ষণীয় বিষয়ে অবিরত প্রশ্নবাদ করতে থাকলে তাকে সঙ্গে রাখা দুস্কর হয়ে পড়ে। তাছাড়া তুমি কিরূপে ধৈর্যধারন করবে এমন বিষয়ে যাহা তোমার জ্ঞান সীমার বাহিরে। (সূরা কাহ্ফ: ৬৮)

অতঃপর তাঁরা দু’জনে সাগরের কিনারা ধরে হেঁটে চললেন। তখন একটি নৌকা তাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তারা তাদেরকে নৌকায় তুলে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। তারা খিজির-কে চিনতে পেরে বিনা ভাড়ায় তাঁদেরকে নৌকায় তুলে নিলো। যখন তাঁরা দু’জনে নৌকায় চড়লেন, তখন একটি চড়ুই পাখি এসে নৌকাটির কিনারায় বসল এবং সমুদ্র থেকে এক ফোঁটা বা দুই ফোঁটা পানি পান করল। খিযির বললেন, ‘হে মুসা! আমার ও আপনার জ্ঞানের দ্বারা আল্লাহ্‌ জ্ঞান হ’তে ততটুকুও কমেনি যত টুকু এ পাখিটি তাঁর ঠোটের দ্বারা সাগরের পানি হ্রাস করেছে’।

অতঃপর খিজির একটি কুড়াল দিয়ে নৌকাটির একটা তক্তা খুলে ফেললেন। মূসা (আঃ) অকস্মাৎ দৃষ্টি দিতেই দেখতে পেলেন যে, তিনি কুড়াল দিয়ে একটি তক্তা খুলে ফেলেছেন। তখন তিনি তাঁকে বললেন, আপনি একি করলেন? লোকেরা বিনা ভাড়ায় আমাদেরকে নৌকায় তুলে নিলো, আর আপনি তাদেরকে ডুবিয়ে দেয়ার জন্য নৌকা ছিদ্র করে দিলেন? আপনি তো একটি গুরুতর কাজ করলেন। খিযির বললেন, আমি কি বলিনি যে, আপনি আমার সাথে ধৈর্যধারণ করতে পারবেন না। মূসা (আঃ) বললেন, আমার ভুলের জন্য আমাকে অপরাধী করবেন না এবং আমার এ ব্যবহারে আমার প্রতি কঠোর হবেন না।

অতঃপর তাঁরা যখন উভয়ে সমুদ্র পার হলেন, তখন তারা একটি বালকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন, যে অন্যান্য বালকদের সাথে খেলা করছিল। খিজির ছেলেটির মাথা দেহ হ’তে ছিন্ন করে ফেললেন। হযরত মুসা (আঃ) বললেন, আপনি একটি নিষ্পাপ শিশুকে বিনা অপরাধে হত্যা করলেন? আপনি খুবই খারাপ একটা কাজ করলেন। খিযির বললেন, আমি কি বলিনি যে, আপনি আমার সাথে ধৈর্যধারণ করতে পারবেন না। মূসা (আঃ) বললেন, এরপর যদি আমি আপনাকে আর কোন প্রশ্ন করি, তাহ’লে আমাকে আর সঙ্গে রাখবেন না। অতঃপর উভয়ে চলতে লাগলেন। চলতে চলতে তারা একটি জনবসতিতে গিয়ে পৌঁছালেন।

কিন্তু উক্ত গ্রামবাসীদের নিয়ম ছিল যে, সন্ধ্যা সমাগমের সঙ্গে সঙ্গেই তারা গ্রামের প্রবেশ দ্বার বন্ধ করে দিত। কারও জন্য খুলত না। হযরত মুসা (আ.) হযরত খিজির (আ.) তথায় পৌঁছে দরজা খুলতে বললে কেউ তাতে সাড়া দিল না। এমন কি তারা মুসাফির হিসেবে খাবার চাইলে তাও দিল না। তারা দু জনেই অনাহারে গ্রামের বাইরে রাত্রিযাপন করলেন। পরদিন তারা সেখানে একটি পতনোমুখ প্রাচীর বা দেয়াল দেখতে পেলেন। যা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। হযরত খিযির প্রাচীরটি মেরামত করে সুদৃঢ় করে দিলেন। হযরত মুসা (আঃ) বললেন, এই বসতির লোকদের নিকট এসে আমরা খাবার চাইলাম। তারা মেহমানদারী করতে অস্বীকার করল। অথচ আপনি এদের দেয়াল মেরামত করে দিলেন। আপনি তো ইচ্ছা করলে এর জন্য পারিশ্রমিক গ্রহণ করতে পারতেন। হযরত খিযির বললেন, খিযির বললেন, এই মুহূর্ত থেকে তোমার এবং আমার সহযাত্রা এখানেই শেষ। এক্ষণে যে বিষয়ে আপনি ধৈর্যধারণ করতে পারেননি, আমি এর তাৎপর্য বলে দিচ্ছি।

প্রথমত: সেই নৌকাটির ব্যাপার এই ছিল যে, সেটির মালিক ছিল কয়েকজন গরীব লোক। সাগরে যারা জীবিকা অন্বেষণ করত। আমি নৌকাটিকে ত্রুটিযুক্ত করে দিলাম এই কারণে যে, সামনে এমন এক বাদশাহর এলাকা রয়েছে যে প্রত্যেকটি নিখুঁত অর্থাৎ ভাল নৌকা জোর পূর্বক ছিনিয়ে নিত। তাই সেই রাজা যেন তা নিতে না পারে বা নিতে না চায়।

দ্বিতীয়ত: সেই ছেলেটির কথা। তার বাবা মা ছিল মুমিন বান্দা। আমি আশঙ্কা করলাম যে, সে পরবর্তীকালে তার নাফরমানী ও বিদ্রোহাচরণ করে তাদেরকে কষ্ট দিবে এবং কুফরীর দিকে তাঁদেরকে নিয়ে যাবে। অতএব, আমি চাইলাম বা ইচ্ছা করলাম যে তাঁদের রব্ব তাঁদেরকে উহার পরিবর্তে এমন সন্তান দান করেন, যে হবে পবিত্রতায় উহার চেয়ে উত্তম ও ভক্তি ভালবাসায় ঘনিষ্টতর রেওয়ায়েত আছে যে, নিহত ছেলেটির পরিবর্তে তাহার পিতা-মাতাকে আল্লাহ তায়ালা একটি কন্যা সন্তান দান করেছিলেন। তাহার বংশে পরবর্তীতে কয়েকজন পয়গাম্বর জন্ম গ্রহণ করেছিল।

তৃতীয়ত: ঐ দেয়ালটির ব্যাপার এই ছিল যে, ঐ প্রাচীরটি ছিল এই শহরের দুইজন এতীম ছেলের। তাঁদের পিতা ছিল একজন সৎ ও নেককার ব্যক্তি। এই প্রাচীর বা দেয়ালটির নিচে তাঁদের জন্য গুপ্তধন পোঁতা ছিল। তাই তোমার প্রতিপালক দয়া পরবশ হয়ে ইচ্ছা করলেন যে, তারা যেন যৌবনে উপনীত হয় এবং তারা তাদের গুপ্তধন উদ্ধার করে নেয়। সুতরাং তাদের পিতার পূণ্যের খাতিরে তদীয় উত্তরাধিকারীদের সম্পদ রক্ষা করা আল্লাহ তায়ালার অভিপ্রেত হয়েছে। কিন্তু এই প্রাচীর বা দেয়ালটি ধসে পড়লে দুষ্টেরা এই গুপ্তধন লুন্ঠন করতো। এখানে আমি কোন কাজই নিজের ইচ্ছায় করিনি। সবকিছুই আল্লাহর নির্দেশমত হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ভাল হতো যদি মুসা (আ.) আরও একটু সবর করতেন তাহলে তাঁদের মাধ্যমে আমাদের আরও কিছু কথা জানাতেন। বুখারী হাদীস নং -৪৭২৫

(কাহফ ৭৯-৮২; ছহীহ বুখারী হা/৩৪০১ ‘নবীদের কাহিনী’অধ্যায়, ‘খিজিরের সাথে মূসা (আঃ)-এর কাহিনী’অনুচ্ছেদ, মুসলিম হা/২৩৮০, ‘ফাযায়েল’অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪৬)।

শিক্ষা:
১. সকল জ্ঞানের আধার আল্লাহ্‌ রাববুল আলামীন। তিনি যাকে যতটকু ইচ্ছা প্রদান করেন।
২. জ্ঞান অর্জনের জন্য সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৩. শয়তান সর্বদা মানুষের পিছে পড়ে থাকে। সে তাকে প্রতিনিয়িত আল্লাহ্‌ বিমুখ করার চেষ্টা করে।
৪. জ্ঞান অর্জনের জন্য ধৈর্য অবলম্বন করা জরুরী।
৫. অহংকার করা বা নিজেকে সবচেয়ে জ্ঞানী ভাবা ঠিক নয়।

No comments