কাক ও কাঠগোলাপ - হুমায়ূন আহমেদ


তুহিনদের বাড়ির সামনে একটা প্রকাণ্ড কাঠগোলাপের গাছ। কাঠগোলাপের গাছ সাধারণত এত বড় হয় না। এই গাছটা হুলস্থুল বড়। ফুল যখন ফোটে তখন গন্ধে চারদিক ম ম করে। তুহিনদের বাড়ির সামনে দিয়ে যারা যেত তারা অবশ্যই কিছুক্ষণের জন্যে থমকে দাঁড়াত। গাছের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ গলায় বলত, বাহ্!

এক বৈশাখ মাসে তুহিনের বাবা নাসের সাহেব নাস্তার টেবিলে বললেন, কাঠগোলাপ গাছটা কাটার ব্যবস্থা করো।

তুহিনের মা সুলতানা বললেন, কেন? এত ফুল ফোঁটায় এই গাছ কেন কাটবে?

নাসের সাহেব বললেন, দুনিয়ার কাক এসে গাছে বাসা বেঁধেছে। শেষরাত থেকে কা-কা ডাক। ঘুমায় কার সাধ্যি! বাড়িটা হয়েছে কাকদের রাজধানী। কাকের আমার দরকার নেই।

তুহিনের ইচ্ছা হলো বাবাকে বলে, যেসব কাক গাছে বাসা বানিয়েছে ওরা যাবে কোথায়? ওদের ছোট ছোট বাচ্চারা যাবে কোথায়? তুহিন কিছু বলতে পারল না; কারণ তাদের বাড়ির নিয়ম হলো, খাওয়ার টেবিলে বড়দের কথার মধ্যে ছোটরা কথা বলতে পারবে না। খুব জরুরি কোনো কথা বলার থাকলে ডান হাত তুলে অনুমতির জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।

সে হাত তুলল। নাসের সাহেব ছেলের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বললেন, কিছু বলতে চাও?

তুহিন বলল, গাছ কেটে ফেললে, যেসব কাক গাছে বাসা বানিয়েছে ওরা যাবে কোথায়? ওদের ছোট ছোট বাচ্চারা যাবে কোথায়?

নাসের সাহেব বললেন, তুহিন, তুমি ভুলে গেছ কাকের ছেলেমেয়েরা তাদের বাসায় থাকে না। এরা বড় হয় কোকিলের বাসায়। কাক কোকিলের বাসায় ডিম পেড়ে আসে। কাজেই কাকের ছেলেমেয়েদের নিয়ে তোমার দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই।

বুঝেছ?

বুঝেছি।

আরেকটা কথা তোমাকে বলি-বড়রা যে সিদ্ধান্ত নেয় সেটা চিন্তা-ভাবনা করে নেয়। ছোটদের সেখানে কথা বলার কিছু নেই। বুঝেছ?

বুঝেছি।

ছোটা থাকবে ছোটদের মতো। ঠিক আছে?

ঠিক আছে।

.

তুহিন স্কুলে গেল মন খারাপ করে। গাছটা সত্যি সত্যি কেটে ফেলা হবে? কাঠগোলাপ গাছের একটা ডাল তার শোবার ঘরের জানালার পাশ দিয়ে গিয়েছে। সেই ডালে মাঝে মাঝে অসংখ্য কাক এসে বসে। তুহিন পাউরুটি টুকরা করে ওদের দিকে ছুঁড়ে দেয়। ওরা লাফালাফি-ঝাপাঝাপি করে পাউরুটি লুফে নেয়। এই অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য আর দেখবে না?

স্কুলেও তুহিন মন দিতে পারল না। তার সারাক্ষণ মনে হলো, এই বুঝি গাছটা কাটা হচ্ছে! এই বুঝি প্রকাণ্ড শব্দ করে গাছটা মাটিতে পড়ল! এই বুঝি সব কাক একসঙ্গে কাঁদতে শুরু করল! তুহিনদের ক্লাস টিচার মিস সোমা. বললেন, তোমার কি শরীর খারাপ নাকি তুহিন? তুমি ঝিম ধরে আছ!

তুহিন বলল, আমার শরীর ঠিক আছে।

আমার তো মনে হচ্ছে শরীর ঠিক নেই। দেখি কাছে আসো তো-জ্বর এসেছে কিনা দেখি। চোখ লাল হয়ে আছে।

তুহিন কাছে গেল। মিস সোমা তুহিনের কপালে হাত রেখে চমকে উঠে বললেন, তোমার অনেক জ্বর। তোমাকে বাসায় পাঠিয়ে দিচ্ছি। বাসায় গিয়ে বিশ্রাম করো।

আমি বাসায় যাব না।

বাসায় যাবে না কেন?

আজ আমাদের একটা গাছ কাটা হবে। গাছটা আমার খুব প্রিয়।

গাছ কাটা হোক বা না হোক, তুমি বাসায় যাবে। বিছানায় শুয়ে থাকবে। তোমার জ্বর এক শ’ তিনের বেশি।

.

তুহিন তার ঘরে শুয়ে আছে। তার যে খুব জ্বর এসেছে এটা সে কাউকে বলে নি। বলার মানুষও নেই। বাবা গেছেন অফিসে। মা গিয়েছেন নারায়ণগঞ্জে তাঁর মামার বাড়িতে। ফিরতে রাত হবে। তুহিন তাকিয়ে আছে জানালার দিকে। প্রকাণ্ড কাঠগোলাপ গাছের বিশাল ডালটা দেখা যাচ্ছে। খুব কম করে হলেও পঞ্চাশটা কাক সেখানে বসে আছে। গাছটা তাহলে এখনো কাটা হয় নি! তবে আজ দিনের মধ্যে অবশ্যই কাটা হয়ে যাবে। বাবার হুকুম এই বাড়িতে সঙ্গে সঙ্গে পালন করা হয়।

জ্বরে তুহিনের মাথা ঝিমঝিম করছে। রোদের দিকে তাকানোর কারণে চোখ কটকট করছে। তুহিন চোখ বন্ধ করে ফেলে আবার চোখ মেলল। গাছের ডালে কয়টা কাক বসে আছে গুনতে শুরু করল। এক দুই তিন চার পাঁচ…

তুহিনকে গোনা বন্ধ করতে হলো, কারণ ছয় নম্বর কাকটা উড়ে এসে তুহিনের জানালার কাছে বসে গম্ভীর গলায় বলল, আমরা আছি সাঁইত্রিশ জন। তোমাকে কষ্ট করে গুনতে হবে না।

তুহিন অবাক হয়ে বলল, তোমরা কথা বলতে পারো?

কাক বলল, পারব না কেন? পারি। নিতান্ত বিপদে না পড়লে কথা বলি না। আজ বিপদে পড়েছি বলে কথা বলছি। তুমি বোধহয় জানো না তোমার বাবা এই গাছ কাটিয়ে দিচ্ছেন। আমাদের বাচ্চা-কাচ্চারা এখনো উড়তে শিখে নাই। এরা সব মারা পড়বে-এইটাই কষ্ট। তুহিন, তুমি কি আমাদের বাচ্চা-কাচ্চার ব্যাপারটা তোমার বাবাকে একটু বুঝিয়ে বলতে পারবে?

তুহিন বলল, তোমাদের বাচ্চা তো হয় কোকিলের বাসায়। তোমরা গোপনে কোকিলের বাসায় ডিম পেড়ে আসো।

কাক বলল, কী সব উদ্ভট কথাবার্তা যে মানুষেরা আমাদের সম্পর্কে বলে! আমরা কি বাসা বানাতে পারি না যে কোকিলের বাসায় ডিম পাড়তে হবে? এই গাছেই আমাদের আঠারোটা বাসা আছে।

তাহলে তোমরা কোকিলের বাসায় ডিম পাড় এমন কথা সবাই বলে কেন?

জানি না কেন বলে! হয়তো কখনো কোনো কাকের বাসা ভেঙে গিয়েছিল, উপায় না দেখে সে কোকিলের বাসায় ডিম পেড়েছে। সেই থেকে এই গল্প ছড়িয়ে পড়েছে। এই শহরে হাজার হাজার কাক বাস করে। কোকিল অল্প কয়েকটা। তোমার কি ধারণা অল্প কয়েকটা কোকিলের বাসায় হাজার হাজার কাক ডিম পেড়ে আসবে? আমার কথায় যুক্তি আছে না?

তুহিন বলল, অবশ্যই আছে।

কাকটা চিন্তিত গলায় বলল, তোমার কি জ্বর নাকি?

হুঁ।

দেখে তো মনে হচ্ছে অনেক জ্বর। আমরা তোমাকে খুব পছন্দ করি, সেটা কি তুমি জানো?

না।

তুমি আমাদের রোজ পাউরুটি খাওয়াও, এইজন্যেই পছন্দ করি। কাকদের তো আর কেউ আদর করে কিছু খাওয়ায় না। আমরা দেখতে অসুন্দর। আমাদের কেউ পাখি বলেই মনে করে না। শুধু তুমি করো। তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে আমাদের খারাপ লাগবে। তোমার জ্বর তো মনে হয় খুব বাড়ছে।

হুঁ।

আহারে! তোমার জন্যে কী করা যায় বলো তো?

তুহিন ক্লান্ত গলায় বলল, কিছু করতে হবে না।

তোমার বাবা-মা কেউ দেখি বাসায় নেই। তোমার খারাপ লাগছে না?

লাগছে।

টেলিফোন করে তাদের আসতে বলো।

ইচ্ছা করছে না।

তোমার অবস্থা দেখে তো চিন্তা লাগছে। কী করা যায় বলো তো।

তুহিন জবাব দিল না। তার জ্বর হু হু করে বাড়তে থাকল। সন্ধ্যাবেলা তুহিনের মা বাসায় ফিরলেন। ছেলের অবস্থা দেখে তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন। তাকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। চারদিকে ছোটাছুটি পড়ে গেল।

তুহিনকে বরফ মেশানো ঠান্ডা পানিতে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে দেওয়া হলো। মা বললেন, বাবা, খুব খারাপ লাগছে?

তুহিন বলল, হুঁ।

তোমার শরীর এত খারাপ করেছে, তুমি বাবাকে একটা টেলিফোন করলেই তো বাবা চলে আসত।

বাবার ওপর আমি রাগ করেছি, এইজন্যে টেলিফোন করি নি।

রাগ করেছ কেন?

বাবা ভুল কথা বলেছে–এইজন্যে রাগ করেছি। কাকরা কোকিলের বাসায় ডিম পাড়ে না, তারা নিজেদের বাসাতেই ডিম পাড়ে।

কে বলেছে তোমাকে?

কাক বলেছে?

কাক বলেছে মানে? কাক কীভাবে বলবে?

কাকরা মানুষের মতো কথা বলতে পারে। তারা যখন খুব বিপদে পড়ে তখন মানুষের মতো কথা বলে। এখন তারা খুব বিপদে পড়েছে। গাছ কেটে ফেলা হবে-ওরা যাবে কোথায়? এইজন্যেই তারা মানুষের মতো আমার সঙ্গে কথা বলেছে।

মা বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। তোমার জ্বর এখন বেশি। তুমি চুপ করে থাকো। তোমার বাবা আসুক, তার সঙ্গে তখন কথা হবে।

তুহিনের বাবা রাত আটটার দিকে এলেন। ততক্ষণে তুহিনের জ্বর নেমে গেছে। তাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। বাবা বললেন, তুহিন শোনো। কাঠগোলাপের গাছ কাটাটা আপাতত বন্ধ আছে। কাজেই গাছ কাটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করবে না। সবার ধারণা গাছের চিন্তায় তোমার জ্বর এসে গেছে। তুমি খুশি তো?

তুহিন বলল, হ্যাঁ।

তুমি নাকি তোমার মাকে বলেছ কাক তোমার সঙ্গে কথা বলেছে?

হ্যাঁ বলেছি।

বাবা শোনো, কাক মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারে না। তোমার জ্বর খুব বেশি হয়েছিল। মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল বলেই মনে হয়েছে কাক তোমার সঙ্গে কথা বলেছে। বুঝতে পেরেছ?

তুহিন জবাব দিল না।

বাবা বললেন, তবে তুমি যে বুদ্ধি করে বলেছ কাক তার নিজের বাসাতেই ডিম পাড়ে–এটা ঠিক। আমি পক্ষীবিশারদের কাছে খোঁজ নিয়েছি।

তিনি ছেলের পাশে বসে ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, পশুপাখি মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারে না–এটা খুব দুঃখের। কথা বলতে পারলে ওরা সরাসরি ওদের সমস্যার কথা বলতে পারত।

তুহিন বিড়বিড় করে বলল, বাবা, অন্য পশুপাখিদের কথা জানি না; তবে কাকে যখন খুব বিপদে পড়ে তখন কথা বলে।

বাবা হাসলেন। কিছু বললেন না। তিনি বুঝতে পারছেন অসুস্থ ছেলের মাথায় ‘কাক কথা বলে’ এই ব্যাপারটা ঢুকে গেছে, এটা সহজে যাবে না। কিন্তু একটা খটকা তাঁর নিজের মাথাতে তৈরি হয়েছে। তুহিনের ঘরের জানালার পাশে শত শত কাক। এবং আরও কাক আসছে। তাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এরা এসেছে তুহিনকে দেখতে।

কেমন করে সবাই তাকিয়ে আছে তুহিনের দিকে।

তাদের চোখে অশ্রু টলমল করছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি তারা কেঁদে ফেলবে। এই রহস্যের ব্যাখ্যা কী?

বাবা কাকদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুহিন ভালো আছে। তোমরা এখন যেতে পারো।

এই কথায় সব কাক একসঙ্গে নড়ে উঠল এবং একসঙ্গে উড়ে গিয়ে কাঠগোলাপ গাছে বসল। এর মানেই বা কী? এরা কি সত্যি কথা বুঝতে পারছে?

No comments