এই আমি - হুমায়ূন আহমেদ


আমার বড় মেয়ে তার কলেজে একটা কোয়েশ্চেনীয়ার জমা দেবে। সেখানে অনেকগুলি প্রশ্নের ভেতর একটা প্রশ্ন হচ্ছে – “তােমার প্রিয় ব্যক্তি কে?” সে লিখলো, ‘আমার মা’।

আমি ভেবেছিলাম সে লিখবে – বাবা।

আমার সব সময় ধারণা ছিল আমার ছেলেমেয়েরা আমাকে খুব পছন্দ করে। অন্তত তাদের মা’র চেয়ে বেশি তাে বটেই। করারই কথা, আমি কখনাে তাদের বকা-ঝকা করি না। অথচ তাদের মা এই কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে করছে –

“বাথরুম ভেজা কেন?”
“সন্ধ্যা হয়ে গেছে, পড়তে বসনি। পড়তে বােস।”
“টুথপেস্টের মুখ লাগানো নেই, এর মানে কি?”
“বন্ধুর সঙ্গে এতক্ষণ টেলিফোনে কথা কেন?”
“ফ্রকে ময়লা কি ভাবে লাগলো?”
“মাছ তাে গোটাটাই ফেলে দিলে। বােন-প্লেট থেকে তুলে এনে খাও। তােল বলছি। তােল।”

এই সব যন্ত্রণা আমি তাদের দেই না। খাবার টেবিলে আমি ওদের সঙ্গে মজার মজার গল্প করি। ভিডিও ক্লাবে কোন ভাল ছবি পাওয়া গেলে সবাইকে নিয়ে এক সঙ্গে দেখি। তারচেয়েও বড় কথা, এমন সব কাণ্ড-কারখানা মাঝে মাঝে করি যা বাচ্চাদের কল্পনাকে উজ্জীবিত করবেই। যেমন শহীদুল্লাহ হল-এ যখন থাকতাম তখন ভরা জোছনার রাতে বাচ্চাদের খুম থেকে তুলে পুকুরে গােসল করতে নিয়ে যেতাম। বর্ষার প্রথম বৃষ্টিতে সবাইকে নিয়ে পানিতে ভেজা তাে আমার চিরকালের নিয়ম। সব সময় করছি। যে মানুষটি এমন সব কাণ্ডকারখানা করে সে কেন প্রিয় হবে না? আমার বড় মেয়ের কোয়েশ্চেনীয়ার দেখে হঠাৎ করে আমার মনে হল আমি কি এদের কাছ থেকে দূরে সরে গেছি? যদি দূরে সরে গিয়ে থাকি তাহলে তা কখন ঘটলো ?

সারাদিন নানান কাজে ব্যস্ত থাকি। ইউনিভার্সিটির কাজ, নাটকের কাজ, লেখার কাজ। এর ফাকে ফাকে লোক আসছে। প্রকাশকরা আসছেন লেখার তাগাদা নিয়ে। এসেই চলে যাচ্ছেন না, বসছেন, গল্প করছেন। চা খাচ্ছেন। নাটকে অভিনয় করতে ইচ্ছুক তরুণ-তরুণীরা আসছে। যে ভাবেই হােক তাদের টিভি নাটকে সুযোগ দিতে হবে। আমার গল্প-উপন্যাস পড়ে খুশি হয়েছে এমন লােকজন আসছে। খুশি হয়নি এমন লােকজন আসছে। আসছে পত্রিকা অফিসের মানুষ। কেউ বুঝতে পারছে না, আমি ক্লান্ত ও বিরক্ত। আমার বিশ্রাম দরকার, নিরিবিলি দরকার। আমার অনেক দূরে কোথাও চলে যাওয়া দরকার। আমার সবটুকু সময় বাইরের লোকজন নিয়ে নিচ্ছে । আমার ছেলেমেয়েদের জন্যে, আমার স্ত্রীর জন্যে একটুও সময় আলাদা নেই।

তবু ক্ষীণ আশা নিয়ে একদিন মেঝে মেয়েকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গেলাম। গলা নিচু করে কথা বলছি যেন অন্য কেউ কিছু শুনতে না পায়।
“কেমন আছ গো মা?”
“খুব ভাল, না মোটামুটি ভাল?”
“খুব ভাল।”
“এখন বল দেখি তােমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ কে ?”
“কোন প্রিয় মানুষ নেই বাবা।”
“না থাকলেও তাে এমন মানুষ আছে যাদের তােমার ভাল লাগে। আছে না?”
“মা তোমার সবচেয়ে প্রিয়?”
“হু–মা।”
“আর কেউ আছে?”
“আর ছােট চাচী।”
“আর কেউ?”
“শাহীন চাচা।”

আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম লিস্ট লম্বা হচ্ছে – কিন্তু সেই দীর্ঘ লিস্টে আমার নাম নেই। আমাকে সে হিসেবের মধ্যেই আনছে না। এ রকম কেন হবে। দু’দিন আমি খুব চিন্তা করলাম। ভেবেছিলাম ব্যাপারটা নিজের মধ্যেই রাখবো। আমার স্ত্রী গুলতেকিনকে জানাব না। এক রাতে তাকেও বললাম। সে বললো, “কি অদ্ভুত কথা বলছো? বাচ্চারা তােমাকে অপছন্দ করবে কেন? তুমি ওদের খুবই প্রিয়।”
“তুমি আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে বলছো?”

“মােটেই না। আমার ধারণা তােমার মত ভালো বাবা কমই আছে।”
“সত্যি বলছো?”
“হ্যা সত্যি। শীলার দুধ খাওয়ার ব্যাপারটা মনে করো। ক’জন বাবা এরকম করবে? শীলার দুধ খাওয়ার কথা মনে আছে?”
“আছে।”

আমার মেয়ের দুধ খাওয়ার গল্পটা বলি তার কাছে এই পৃথিবীর সবচেয়ে অপছন্দের খাবার হল দুধ। দুধের বদলে তাকে বিষ খেতে দেয়া হলেও সে হাসিমুখে খেয়ে ফেলবে। সেই ভয়াবহ পানীয় তাকে রােজ বিকেলে এক গ্লাস করে খেতে হয়। আমি আমার কন্যার কষ্ট দেখে, এক বিকেলে তার দুধ চুমুক দিয়ে খেয়ে ফেললাম! তাকে বললাম, মাকে বলিস না আমি খেয়েছি। এরপর থেকে রােজ তার দুধ খেতে হয়। এক সময় নিজের কাছেও অসহ্য বােধ হল। তখন দু’জন মিলে যুক্তি করে বেসিনে ফেলে দিতে লাগলাম। বেশিদিন চালানাে গেল না। ধরা পড়ে গেলাম
বাবা হিসেবে আমি যা করেছি তা আদর্শ বাবার কাজ না। তবে শিশুদের পছন্দের বাবার কাজ তাে বটেই। গুলতেকিন আমার কন্যার দুধের গল্প মনে করায় আমার উদ্বেগ দূর হল। আমি মােটামুটি নিশ্চিত হয়েই ঘুমুতে গেলাম। যাক, আমি খারাপ বাবা নই একজন ভাল বাবা। তবু সন্দেহ যায় না।

পরদিন ছােটমেয়ে বিপাশাকে আইসক্রীম খাওয়াতে নিয়ে গেলাম। সে বিস্মিত, তাকে একা নিয়ে যাচ্ছি। অন্য কাউকে নিচ্ছি না। ব্যাপারটা কি ?
তাকে ডলসি ভিটায় কোন আইসক্রীম কিনে ফিস ফিস করে বললাম, “আচ্ছা মা বল তাে, কাকে তােমার বেশি পছন্দ ? তােমার মা’কে, না আমাকে?”

সে মুখভর্তি আইসক্রীম নিয়ে বললো, “তােমাকে”।

তার বলার ভঙ্গি থেকে আমার সন্দেহ হল। আমি বললাম, “তােমার মা শিখিয়ে দিয়েছে এরকম বলার জন্যে, তাই না?”
“হুঁ।”
“সে আর কি বলেছে ?”

“বলেছে–বাবা যদি তােমাদের জিজ্ঞেস করে কে সবচেয়ে প্রিয় তাহলে আমার নাম বলবে না, তােমার বাবার নাম বলবে। না বললে সে মনে কষ্ট পাবে। লেখকদের মনে কষ্ট দিতে নেই।”

সত্যকে এড়ানাে যায় না, পাশ কাটানাে যায় না। সত্যকে স্বীকার করে নিতে হয়। আমি স্বীকার করে নিলাম। নিজেকে বুঝালাম – আমার ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তা যে কোন ব্যস্ত বাবার ক্ষেত্রেই ঘটবে। একদিন এই ব্যস্ত বাবা অবাক হয়ে দেখবেন এই সংসারে তার কোন স্থান নেই। তিনি সংসারের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। সংসারও তার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। এই এক আশ্চর্য খেলা।

No comments