সোহরাব রোস্তম – মহাকবি আবুল কাসেম ফেরদৌসী
ইরানের পরাক্রমশালী রাজা ফেরিদুর কনিষ্ঠপুত্র রাজা ইরিজির কন্যা পরীচেহেরের পুত্র শাহ মনুচেহের যখন ইরানের রাজা হলেন তখন তাঁর সৈন্যদলে নামকরা বীর যোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন শাম নামে একজন বীর যোদ্ধা। শাম বহু যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন, কিন্তু তাঁর কোনো পুত্রসন্তান নেই। তাই মনে অনেক দুঃখ। পুত্রের আশায় বীর শাম দেবতার মন্দিরে মাথা ঠুকে মরেন। অবশেষে দেবতার আশীর্বাদে বীর শাম এক পুত্র লাভ করলেন। পুত্রের নাম রাখলেন জাল।
বলিষ্ঠদেহ জাল দেখতে সুন্দর কিন্তু তার মাথার সব চুল ধবধবে সাদা। সাদা রঙের চুলওয়ালা ছেলে অভিশাপ ডেকে আনতে পারে। এইরকম নানা আশঙ্কার কথা শুনে শাম নিজের হাতে নিজের পুত্রকে ফেলে এলেন আলবুরুজ পর্বতে। কিন্তু দেবতারা ছিল শিশু জালের প্রতি দয়াশীল। ঈগল পাখির মতো ঠোঁট এবং সিংহের মতো পা-বিশিষ্ট সি-মোরগ পাখি উড়ে এসে ঠোঁটে ঝুলিয়ে জালকে নিয়ে গেল। জাল পাখির বাসায় বড় হতে লাগল।
পুত্রকে ফেলে এসে বীর শাম পুত্রশোকে কাতর হয়ে দিনাতিপাত করছিলেন। তিনি আবার দেবতার মন্দিরে ছেলের জন্য মাথা ঠুকতে লাগলেন। সি-মোরগ পাখি জালকে ফেরত দিয়ে গেল এবং যাবার সময় নিজের পাখনা থেকে একটি পালক ছিঁড়ে উপহার দিয়ে বলল-‘বিপদের সময় এ পালকটি আগুনে তাতালেই আমি সাহায্যের জন্য ছুটে আসব’।
বাদশাহ মনুচেহের কিশোর জালকে দেখে খুশি হলেন। জালকে উপহার দিলেন তেজি ঘোড়া এবং শামকে দিলেন জাবুলিস্তানের শাসনভার। ক্রমে ক্রমে জাল অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠল। পিতা শাম গেলেন রাজার আদেশে মাজেন্দ্রানের দৈত্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে করতে। যুবক জাল জাবুলিস্তানের শাসনভার পরিচালনা করছে।
একবার যুবক জাল গেলেন কাবুল-রাজা মেহেরাবের রাজ্যে বেড়াতে। রাজা মেহেরাবের সুন্দরী কন্যা রুদাবার সঙ্গে প্রণয় হলো জালের এবং অবশেষে সকলের সম্মতি নিয়ে জাল ও রুদাবার বিবাহ সম্পন্ন হলো।
আনন্দে দিন কাটে নব দম্পতির। কিছুদিনের মধ্যে রুদাবারের হলো কঠিন অসুখ। কত ওষধ, বদ্যি, কিন্তু অসুখ সারে না। জাল তখন সি-মোরগের পালক ধরল আগুনের তাপে। সি-মোরগ উড়ে এসে হাজির হলো। সি-মোরগ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রোগিণীর রোগ পরীক্ষা করে বলল-ওহে ভাগ্যবান জাল তুমি অতি সত্বর পিতা হতে চলেছ। তোমার পত্নী রুদাবা এমন এক সন্তানের মা হতে চলেছে, যে সন্তানের নাম পৃথিবীতে খ্যাত হবে তার বীরত্ব ও সাহসের গুণে।’
সি- মোরগের কথা মিথ্যা হবার নয়। জাল এক শক্তিমান এবং বলবান পুত্রসন্তান লাভ করলেন। এই ছেলেই মহাবীর রোস্তম। ইরানের জাতীয় ইতিহাসে যার নাম এখনও অক্ষয় অমর হয়ে আছে।
শৈশবেই রোস্তমের মধ্যে বীরত্বের লক্ষণ ফুটে উঠল। সে তেজি ঘোড়ায় চড়ে দুরন্তবেগে ছুটতে ভালোবাসে, আর ভালোবাসে গদা ও গর্জ নিয়ে যুদ্ধে করতে। সামান্য খাদ্যে তার ক্ষুধা মেটে না। এক দাইমায়ের দুধপান করে তার তৃষ্ণা নিবারণ হয় না। সে পাঁচটি ছাগলের মাংসের কাবাব দিয়ে প্রাত:রাশ সম্পন্ন করে।
একদিন রাজার মত্ত হাতি শিকল ছিড়ে রাজপথে ছুটছে। হাতির পায়ের নিচে পড়ে মানুষ জীবন দিচ্ছে কিন্তু সাহস করে কেউ মত্ত হাতির মুখোমুখি হচ্ছে না। কিশোর রোস্তম গদা নিয়ে পাগলা হাতির সামনে ছুটে এল এবং গদার এক আঘাতে হাতিকে ধরাশায়ী করল। বীর রোস্তম অজেয় সোপান্দি দুর্গে কৌশলে প্রবেশ করে দুর্গের সর্দার ও সিপাহিদের হত্যা করে পিতামহের হত্যার প্রতিশোধ নিয়ে এল। পিতা জাল বীর পুত্র রোস্তমকে আলিঙ্গন করলেন। কেননা তিনি বারবার এ দুর্গ আক্রমণ করতে গিয়ে বিফল হয়েছেন। আজ পুত্রের শৌর্যে পিতার বুক গর্বে ফুলে উঠেছে।
তুরানের সেনাপতি আফরাসিয়াব ইরান আক্রমণ করে রাজা নওদরকে হত্যা করলেন এবং জালের রাজা জাবুলিস্তান আক্রমণের জন্য সৈন্য প্রেরণ করলেন। পিতা জালের সঙ্গে পুত্র রোস্তমও আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য যুদ্ধসাজ পরলেন। আস্তাবলে প্রবেশ করে সবচেয়ে দুরন্ত ও অবাধ্য যে ঘোড়া রখ্শ তাকেই নির্বাচন করলেন রোস্তম। রাক্ষস বংশের রখ্শ এতদিনে প্রকৃত মনিবকে পেয়ে মহানন্দে হ্রেষাধ্বনি করল। বীর রোস্তম রংধনু রঙের রেশমি পোশাক পরল। মাথায় তাজের ওপর ঝুলাল রেশমের বর্ণাঢ্য রুমাল আর হাতে তুলে নিল পিতামহ শামের সেই বিখ্যাত গদা।
রোস্তম যুদ্ধে চলল, কিন্তু বুকে ও বাহুতে নেই লোহার বর্ম। যে দেখে সে স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। যুদ্ধে তুরাণি সৈন্যদের পিছু হটতে হলো। তরুণ রোস্তমের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসে স্বয়ং সেনাপতি আফরাসিয়াব কোনোক্রমে প্রাণ নিয়ে পালালেন।
বীর রোস্তম হলেন ইরানের মহাবীর রোস্তম। রোস্তম ইরানের স্বাধীনতা উদ্ধার করলেন। রাজা কায়কোবাদ রাজসিংহাসনে বসলেন। জনগণ মহাবীর রোস্তমের জয়গানে ইরান মুখরিত করল। সুখে শান্তিতে ইরানবাসী দিনাতিপাত করতে লাগল।
কিন্তু রাজা কায়কোবাদের পর রাজা কায়কাউস রাজা হলেন। কায়কাউস ছিলেন খেয়ালি এবং চাটুকারিতা-প্রিয় রাজা। চাটুকারদের প্রশংসায় বিভ্রান্ত হয়ে কায়কাউস দৈত্যদের রাজ্য পাহাড়ি দেশ মাজেন্দ্রান জয় করতে ছুটে গেলেন। মাজেন্দ্রানের রাজা প্রতিবেশী বন্ধু মহাবলী সফেদ দৈত্যের সাহায্যে রাজা কায়কাউসের বিশাল সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে রাজা কায়কাউসকে বন্দি করে রাখল।
ইরান রাজার এ বন্দিদশার সংবাদ পৌঁছাল জাবুলিস্তানে। মহাবীর রোস্তম রুখশের পিঠে সওয়ার হয়ে ছুটলেন দৈত্যরাজ্য মাজেন্দ্রানে। দীর্ঘ পথ, পায়ে পায়ে বিপদ আর ছলনা। অপরিসীম মনোবলের অধিকারী রোস্তম সমস্ত বাধা অতিক্রম করে অবশেষে আলবুরুজ পর্বত ডিঙিয়ে এলেন মাজেন্দ্রানে। রোস্তমের গদার আঘাতে একে একে শত্রু ভূপাতিত হলো। রাজা কায়কাউস মুক্ত হলেন।
(২)
কিন্তু ভয়ংকর লোমশ প্রাণী সফেদ দেও-এর রক্ত না হলে অন্ধ রাজার চক্ষু ভালো হবে না। মহাবীর রোস্তমের সঙ্গে মহাবলী সফেদ দেও সম্মুখযুদ্ধ শুরু করল। মনে হয় এমন প্রলয়ংকর যুদ্ধ পৃথিবীতে কখনও ঘটেনি এবং ভবিষ্যতেও ঘটবে না।
দুই বীর যোদ্ধাই যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হলো। অবশেষে মহাবীর রোস্তমের আঘাতে সফেদ দেও-এর কোমর ভেঙে গেল। রোস্তম তলোয়ার দিয়ে সফেদ দেও-এর গলা দ্বিখন্ডিত করলেন। অন্ধ রাজা কায়কাউস দেও-এর রক্তের ফোঁটা পেয়ে দৃষ্টি ফিরে পেলেন। আবার ইরানে শান্তি ফিরে এল।
রোস্তম ফিরে গেলেন জাবুলিস্তানে।
মহাবীর রোস্তম একবার প্রিয় ঘোড়া রুখ্শের পিঠে চড়ে বেরিয়েছেন শিকার করতে। ঘুরে ঘুরে তিনি এসে পড়েছেন তুরানের কাছে এক জঙ্গলে। সারাদিন ঘুরে ঘুরে মনিব এবং অশ্ব দুজনই ক্লান্ত। বড় গাছের নিচে রোস্তম শুয়ে পড়েছেন। প্রগাঢ় ঘুমে তিনি নিমগ্ন। পাশেই প্রিয় রখশ ঘাস খাচ্ছে।
তখন নিশুতি রাত। রুখশ আপন মনে ঘাস খাচ্ছে। সে সময় একদল তুরানি সে পথ দিয়ে যাচ্ছিল। ঘোড়া চুরি করাই তাদের ব্যবসা। রুখ্শকে দেখে ওরা লোভ সামলাতে পারল না। ভুলিয়ে ভালিয়ে সে রাতেই ওরা রখশকে নিয়ে তুরান পালিয়ে গেল। কিন্তু ঘোড়াচোররা জানতেও পারল না তারা কার প্রিয় ঘোড়া নিয়ে পলায়ন করছে।
সকালের সূর্যের স্নিগ্ধ আলোয় এবং অরণ্যে পাখির কূজন শুনে মহাবীর রোস্তমের ঘুম ভাঙল। তিনি অভ্যাস মতোই প্রিয় রখ্শের নাম ধরে ডাকলেন। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই। এমন তো কখনও হয়নি! রোস্তম এখানে সেখানে খুঁজলেন, অবশেষে বনের প্রান্তে ধুলোর মধ্যে রখ্শের খুরের দাগ দেখে ঠিকই বুঝলেন তুরানি ঘোড়াচোররা তার প্রিয় রখশকে নিয়ে পালিয়েছে।
খুরের দাগ অনুসরণ করে ক্রোধে উন্মত্ত মহাবীর রোস্তম সামেনগান শহরে উপস্থিত হলেন। মহাবীর
রোস্তমকে চেনে না কে? যারা কোনোদিন চোখে দেখেনি তারাও এই বিশালদেহী মহাবীরকে দেখেই বুঝতে পারল ইনিই ইরানের বীর রোস্তম। বীরের ক্রোধবহ্নি-মিশ্রিত চক্ষু দেখে সকলে প্রাণভয়ে ছুটে পালাল। সামেনগান অধিপতির নিকট সংবাদ গেল তিনি দ্রুত ছুটে এলেন মহামান্য অতিথিকে অভ্যর্থনা জানাতে। ইতোমধ্যেই সামেনগান অধিপতি তার নগরকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য চতুর্দিকে লোক-লস্কর ছুটিয়ে দিয়েছেন ঘোড়াচোরদের গ্রেফতার করার জন্য।
সামেনগান অধিপতির বিনীতবাক্যে আপাতত তুষ্ট হয়ে রোস্তম এলেন প্রাসাদে রাজ-অতিথি হয়ে। রোস্তমের সম্মানে বিরাট ভোজের আয়োজন হলো। নৈশভোজ শেষ করে পরিতুষ্ট রোস্তম গেলেন রাজশয্যায় বিশ্রাম গ্রহণ করতে।
হাতির দাঁতের পালঙ্কে শুয়ে শুয়ে রোস্তমের চোখে তন্দ্রার ভাব এসেছে, তখন মনে হলো এক অপরূপ সুন্দরী তাঁর শয্যাপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। সুন্দরীর স্নিগ্ধ সরল রূপমাধুর্য দেখে রোস্তম বিমোহিত হলেন। রোস্তমের তন্দ্রা কেটে গেল। তিনি তাড়াতাড়ি শয্যা ত্যাগ করে দেখলেন স্বপ্নে আর বাস্তবে কোনো ভেদ নেই সত্যিই এক অপরূপ সুন্দরী কন্যা তার শিয়রের প্রান্তে দন্ডায়মান। রোস্তম বললেন, কে তুমি রমণী? রমণী সলজ্জ নেত্র তুলে বলল,আমি তহমিনা। সামেনগান অধিপতি আমার পিতা। আপনার বীরত্ব ও শৌর্যের কথা শুনে এতদিন আপনাকে নিয়ে স্বপ্নের মধুর জাল বুনেছি। আপনার বীরত্বকে আমি এতকাল অর্ঘ্য নিবেদন করেছি। সত্যিই যখন আজ আপনি আমাদের মহান অতিথি হয়ে এসেছেন, তখন জানাতে এসেছি আমি এতকাল আপনাকেই স্বামীত্বে বরণ করেছি।
এই কথা বলে হাওয়ার দোলায় ভেসে তহমিনা ঘর ছেড়ে চলে গেল। কিন্তু ঘরের বাতাস রেখে গেল তার মধুর দোলা এবং মহাবীর রোস্তমের অন্তরে রেখে গেল এক অনাস্বাদিত মধুর ঝংকার।
মহাবীর রোস্তম আর ঘুমাতে পারলেন না। সকালের প্রথম আলো জানালা দিয়ে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই রোস্তম ছুটে গেলেন সামেনগান অধিপতির কাছে। রোস্তম নিঃসঙ্কোচে প্রস্তাব করলেন, তিনি তহমিনাকে বিবাহ করবেন। সামেনগান অধিপতি যেন হাতে আকাশের চাঁদ পেলেন। মহাবীর রোস্তম হবে তার জামাতা, এ যে ধারণার অতীত। তিনি সানন্দে রাজি হলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে মহাসমারোহে বিয়ের আয়োজন করতে ছুটে গেলেন।
মহা উৎসব, বিপুল আয়োজনের মধ্যে জাঁকজমক সহকারে রোস্তমের সঙ্গে তহমিনার বিবাহ হয়ে গেল। রাত্রির চাঁদ বাতায়নে দাঁড়াল। নিশাবসানের পূর্বে মহাবীর রোস্তম প্রিয় স্ত্রীর চিবুক স্পর্শ করে বললেন-যদি আমাদের পুত্রসন্তান হয় তা হলে এই তাবিজটি তার হাতে পরিয়ে দিও, আর যদি কন্যাসন্তান হয় তাহলে এ তাবিজ তার চুলে বেধে দিও। এ তাবিজের ভেতর আমি নিজের নাম স্বাক্ষর করে রেখেছি।
তহমিনা ছলছল চোখে স্বামীর দিকে তাকায়। রোস্তম সেই জলভরা চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি বীরের স্ত্রী, কান্না তোমার শোভা পায় না। আমি আজই ইরান ফিরে যাব, শত্রুরা আবার প্রিয় ইরানের স্বাধীনতা হরণের জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে।
তহমিনা বিচ্ছেদ ব্যথায় কাতর হয়ে হয়তো কিছু বলতে চেয়েছিল। কিন্তু মহাবীর রোস্তম বাধা দিয়ে বললেন বীরের প্রকৃত স্থান যুদ্ধের ময়দান, যুদ্ধেই তোমার স্বামীর প্রকৃত পরিচয় ফুটে উঠবে।
প্রিয় অশ্ব রখ্শের পিঠে চড়ে মহাবীর রোস্তম ইরানের পথে চলে গেলেন। ঝরোকার ওপর চোখ রেখে
হতভাগিনী তহমিনা স্বামীর চলে যাওয়া দেখল। যতক্ষণ পর্যন্ত স্বামীর মাথার সোনার মুকুট দেখা গেল, তহমিনা অপলক দৃষ্টিতে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর যখন আর কিছুই দেখা গেল না, শুধু অশ্রুধারায় তার দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে এল। তখন স্বামীর ফেলে যাওয়া শয্যায় আছড়ে পড়ে ব্যাকুল ভাবে কাঁদাল। ইরানের অগ্নিদেবতা কি জানতে পেরেছিল তহমিনা কেঁদে কেঁদে বলেছিল-ওগো আমার ভাগ্যদেবতা, আমাকে তুমি পুত্রসন্তানের মা হতে দাও, যেন পুত্রের মুখ দেখে আমি বীর স্বামীকে হারানোর দুঃখ ভুলে থাকতে পারি।
হয়তো তহমিনার করুণ আবেদন সৃষ্টিকর্তা শুনেছিল। যথাসময়ে সুন্দরী তহমিনার কোল আলো করে এক পুত্রসন্তান এল। সকলেই মহাখুশি। সামেনগান অধিপতি নাতির নাম রাখলেন সোহরাব। মহাবীর রোস্তমের পুত্র সোহরাব। কিন্তু মা তহমিনার বুক সেদিন ক্ষণকালের জন্য হলেও কেঁপে উঠেছিল। তহমিনা যদিও ছেলের হাতে রোস্তমের দেয়া তাবিজ পরিয়ে দিলেন কিন্তু রোস্তমের কাছে দূত মারফত সংবাদ পাঠালেন তাদের একটি কন্যাসন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে।
দূতমুখে কন্যার সংবাদ পেয়ে রোস্তম বিমর্ষ হলেন। আশা করেছিলেন তিনি পুত্রের পিতা হবেন।
রোস্তম একরকম জোর করেই তহমিনার কথা ভুলে থাকতে চাইলেন।
(৩)
মহাবীর রোস্তম ইরানের ভরসা। যুদ্ধক্ষেত্র নিয়েই তাঁর দিনরাত্রি কেটে যায়। এদিকে সোহরাব দিনে দিনে আপন মহিমা ও শৌর্য নিয়ে বেড়ে উঠতে লাগল। যেমন তার বিশাল দুটি বাহু, তেমনি উদার প্রশস্ত বক্ষ একবার দেখলে বারবার দেখতে হয়। হবেই না কেন? রোস্তমের পুত্র আর এক অতুলনীয় বীর হয়ে পৃথিবীতে আসছে। জাল যার পিতামহ, শাম যার পিতামহ এবং স্বয়ং রোস্তম যার পিতা, সেই পুত্র সোহরাব কি আবার সামান্য বীর হবে! সেও দুরন্ত অশ্বের কেশর ধরে টান মারে, এক থাবায় বাঘের মুখকে চুরমার করে। তলোয়ার, বর্শা ও গদাযুদ্ধে সোহরাব সামেনগানের বীর বলে পরিচিত হলো।
একদিন কিশোর সোহরাব এসে মাকে বলল, মা আমার সমবয়সীরা সকলেই বাবার কথা বলে। আমি বাবার কথা কিছুই বলতে পারি না। তাহলে কি আমার বাবা যুদ্ধক্ষেত্রে অকালে প্রাণত্যাগ করেছেন?
তহমিনা ছেলেকে সান্তবনা দিয়ে বলল- না সোহরাব, তোমর বাবা জীবিত আছেন। তিনি ইরানের মহাবীর রোস্তম এই দেখো তোমার বাহুতে বাঁধা রয়েছে তোমার বাবার দেয়া তাবিজ। এই তাবিজে তাঁর নাম লেখা আছে।
সোবহার বাবার কথা শুনে, বাবার বীরত্বের মহিমা জানতে পেরে মাকে বলল- মা, আমি বাবার কাছে যাব বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বলব, পিতা, আমি তোমার স্নেহের পুত্র সোহরাব।
মা তহমিনা ছেলের মুখে আদরের চুম্বন দিয়ে বলল, তুই চলে গেলে আমি কী নিয়ে থাকব। সোহরাব, তোকে কাছে পেলে তোর বাবা কোনোদিন তোকে আমার কাছে ফেরত পাঠাবে না।
তহমিনার অশ্রুসজল চোখ দুটি মুছিয়ে স্নেহময় কন্ঠে সোহরাব বলল, কিন্তু বাবাকে না দেখলে আমার জীবন যে অপূর্ণ থেকে যাবে মা।
ইরানে আর তুরানে আবার যুদ্ধ শুরু হয়েছে। রাজা কায়কাউসের উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য ইরানের চিরশত্রুরা আবার তাদের পরাজয়ের শোধ নেয়ার জন্য সাজ সাজ রব তুলেছে। মাজেন্দ্রান জয়ের পর পার্শ্ববর্তী সব দেশই ইরানের বশ্যতা স্বীকার করেছিল। কেবল হামাউনের রাজা অধীনতা স্বীকার করলেন না।
রাজা কায়কাউস হামাউন আক্রমণ করলেন। হামাউনের রাজা মাত্র কয়েকজন দেহরক্ষী নিয়ে এক পাহাড়ি কেল্লায় পলায়ন করলেন। হামাউনের রূপসী কন্যা রুদাবার রূপে মুগ্ধ হয়ে রাজা কায়কাউস তাকে বিবাহ করলেন।
কিন্তু হামাউন মনে মনে এ বিবাহ স্বীকার না করলেও বাইরে তা প্রকাশ করলেন না। রাজা হামাউন সুযোগ বুঝে কন্যা ও জামাতাকে পাহাড়ি দুর্গে আমন্ত্রণ জানাল। রাজা কায়কাউস শ্বশুরের আমন্ত্রণ পেয়ে সরল মনেই পাহাড়ি কেল্লায় গেলেন। তাঁর আদর আপ্যায়নের কম হলো না। কিন্তু কায়কাউস বুঝতে পারলেন তিনি শ্বশুরের দুর্গে বন্দি হয়েছেন। এ খবর বাতাসের আগে ছড়িয়ে পড়ল। ইরানের শত্রুরা এবার কঠিন আঘাত হানার জন্য প্রস্ত্তত হলো। সবার আগে সৈন্যসামন্ত নিয়ে ছুটে এল তুরানের রাজকুমার আফরাসিয়াব।
সামেনগান তুরান রাজ্যেরই একটি নগর। সামেনগানের বীর সোহরাবও এ যুদ্ধে একজন সেনাপতি হয়ে তুরানের পক্ষে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এল।
মা তহমিনার বুক আর একবার কেঁপে উঠল। সে ছুটে এসে সোহরাবের পথ রোধ করে বলল, সোহরাব তুই এ যুদ্ধে যাসনে। এ ভয়ংকর যুদ্ধ, না জানি কী এক দুঃসহ ঘটনা ঘটাবে।
সোহরাব মাকে বলল, আমি তো যুদ্ধ করতে যাচ্ছিনে মা, আমি যাচ্ছি বাবার সঙ্গে দেখা করতে। বাবার সঙ্গে দেখা করে আমি নিজে তাঁর মাথায় ইরান তুরানের মিলিত মুকুট পরিয়ে দেব।
দ্রুতগতি অশ্বে চড়ে কিশোর সোহরাব বাবার সঙ্গে প্রথম দেখা করার জন্য ছুটে চলে গেল। তহমিনা সেদিনের মতো আজও ঝরোকায় চোখ রেখে ছেলের যাওয়া দেখল। যতক্ষণ ঐ লাল ঘোড়াটি দেখা যাচ্ছিল, ঘোড়ার পিঠে স্নেহের সোহরাবকে দেখল মা। তারপর অশ্রুতে ঝাপসা হলো তার চোখ। তহমিনা শয্যায় পড়ে ব্যাকুল হয়ে কাঁদল। আজও কী দেবতারা তার কান্না শুনতে পেল? তহমিনা কেঁদে কেঁদে দেবতার উদ্দেশে বলল- আমার সোহরাবকে অমঙ্গলের হাত থেকে রক্ষা করো, হে অগ্নিদেবতা।
তুরান যখন ইরান আক্রমণ করে তখন মহাবীর রোস্তম ছিলেন জাবুলিস্তানে। রাজা কায়কাউস দূত মারফত মহাবীরকে অনুরোধ করে পাঠালেন ইরানের এ দুর্দিনে ছুটে এসে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে।
যুদ্ধের দামামা শুনে প্রকৃত বীর কি ঘরের মধ্যে বসে থাকতে পারে? যুদ্ধের আহবান শুনে প্রিয় রখ্শ ছুটিয়ে মহাবীর রোস্তম এলেন ইরানে। ইরান-ভরসা রোস্তম এ যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন।
ইরান ও তুরান দুই প্রতিপক্ষ বাহিনীর যুদ্ধশিবির পড়েছে একই মাঠের দুই দিকে। তুরানি শিবিরের দিকে এক পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে কিশোর সোহরাব দেখছে ইরানের শিবির আর ভাবছে কোন ছাউনির মধ্যে তার বীর পিতা রয়েছেন। কেমন করে নির্জনে নিরালায় পিতার সঙ্গে তার দেখা হবে।
সোহরাব মনে মনে এক বুদ্ধি ঠিক করল। সে দ্বন্দ্বযুদ্ধে নির্জনে তার পিতার সঙ্গে মিলিত হবে।
তুরানের দূত গেল ইরানের শিবিরে। তুরান-বীর কিশোর সোহরাব, দ্বন্দ্বযুদ্ধ আহবান করেছেন প্রবীণ রোস্তমের বিরুদ্ধে। দূতের মুখে এ আহবান শুনে রোস্তম মৃদু হাসলেন। বালকের সাহস তো কম নয়! কে এই দুর্দম বালক? রোস্তম নিজের পরিচয় গোপন রেখে এ আহবানে সাড়া দিলেন নিতান্তই কৌতূহল বশে।
দুই শিবির থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে এলেন রোস্তম আর সোহরাব। নির্জন গিরিপথে পিতা পুত্রের দেখা হলো।পুত্র দেখল পিতাকে আর পিতা দেখল পুত্রকে। কিন্তু কেউ কাউকে চেনে না। রোস্তম বালক সোহরাবকে বললেন, ওহে বালক তোমার মায়ের চিত্তে কী ভয় নেই? কোন সাহসে তোমাকে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণ করেছেন? জীবনের মায়া থাকে তো এখনই পলায়ন করো।
সোহরাব বলল, আপনি কী সেই মহাবীর রোস্তম? বালকের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লজ্জা পেয়ে বললেন, না। রোস্তম এখন জাবুলিস্তানে। আমি রোস্তমের একজন ভৃত্য মাত্র।
সোহরাবের মন হতাশায় আচ্ছন্ন হলো। তবু যুদ্ধ শুরু হলো। বর্শা ভাঙল, তলোয়ার খানখান হলো। দুই বীরের শরীর রক্তাক্ত হলো। দিবসের শেষ সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ল। সোহরাবের গদার আঘাতে রোস্তম কিছুটা কাবু হয়ে পড়েছেন। সেদিনের মতো যুদ্ধ ক্ষান্ত দিয়ে সোহরাব বলল-আজ সন্ধি করলাম, কাল আমাদের হারজিতের পরীক্ষা হবে।
(৪)
দুই বীর তাঁবুতে ফিরে গেলেন। রোস্তম ভাবেন, কে এই বালক? তার বাহুতে এত শক্তি কোথা থেকে এল? আর সোহরাব ভাবে-কীজন্য এলাম যুদ্ধ করতে যদি আমার বাবা জাবুলিস্তানেই থেকে গেল?
পরের দিন আবার সেই নির্জন স্থানে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। সোহরাব পুনরায় জিজ্ঞেস করল, অনুগ্রহ করে বলুন আপনি কী সত্যি মহাবীর রোস্তম নন? যদি রোস্তম হন তাহলে আমি আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করব না।
রোস্তম তখন ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে সোহরাবকে উত্তেজিত করছেন: ওহে মুষিকপ্রবর, রোস্তমের সঙ্গে যুদ্ধ করা দুগ্ধপোষ্য বালকের কাজ নয়। আগে আমাকে পরাজিত করো, তাহলেই রোস্তমের সঙ্গে যুদ্ধ করার আস্পর্ধা করো।
সোহরাব এবার উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে রোস্তমকে প্রচন্ড শক্তিতে আঘাত করল। রোস্তম সে আঘাত সহ্য করতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেলেন সোহরাব তার বুকের ওপর বসে অস্ত্রের আঘাত করতে উদ্যত হয়েছে। রোস্তম কৌশল করে বললেন, এ তোমার কোন বীরত্বের রীতি? শত্রুকে পরপর দুবার পরাজিত না করলে তাকে প্রাণে বধ করা যায় না। ইরানের এই যুদ্ধরীতিকে তুমি অস্বীকার করতে চাও?
সোহরাব রোস্তমকে ছেড়ে দিল। সেদিনের মতো সন্ধি, আবার আগামীকাল যুদ্ধ।
তৃতীয় দিন আবার যুদ্ধ শুরু হয়েছে। সোহরাব দেখছে রোস্তমকে। একবার নয়, দুবার নয়, বারবার সে দেখছে রোস্তমের দিকে। রোস্তমের আজ সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। তিনি সামান্য এক বালকের হাতে
পরাজয়ের গ্লানি বহন করতে রাজি নন।
প্রচন্ড যুদ্ধ চলছে। কিন্তু আনমনা সোহরাবকে আজ রোস্তম ধরাশায়ী করে ফেললেন।
সোহরাবকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই প্রথম সুযোগে রোস্তম তীক্ষ্মধার তলোয়ার বের করে সোহরাবের বুকে ঢুকিয়ে দিলেন। সোহরাবের তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল।
কোথায় গেল ইরানের যুদ্ধের নিয়ম, কোথায় গেল মহাবীর রোস্তমের বীরত্ব। সোহরাব যন্ত্রণায় এবং ক্ষোভে ক্রন্দন করে বলল, শোনো ইরানি কাপুরুষ। তুমি অন্যায় যুদ্ধে প্রথম পরাজয়ে আমাকে প্রাণে বধ করলে। কিন্তু এ সংবাদ যখন আমার বাবা জানতে পারবেন তখন তুমি সাগরের অতলেই থাকো, কিংবা আকাশে নক্ষত্রের মধ্যে পলায়ন করো তিনি তোমাকে ক্ষমা করবেন না।
রোস্তম বলল, কে তোমার বাবা?
সোহরাবের বুক থেকে তখন রক্তের স্রোত গড়িয়ে পড়ছে। ক্লান্ত অবসন্ন সোহরাব বলল, মহাবীর রোস্তম আমার বাবা, আর সামেনগানের অধিপতির কন্যা তহমিনা আমার মা।
সহস্র বজ্রপাতের মতো মহাবীর রোস্তমের কানে সোহরাবের শেষ কথাগুলো শেলবিদ্ধ হলো। রোস্তম আর্তনাদ করে বলল, মিথ্যা কথা, ওরে বালক মিথ্যা কথা! আমার কোনো পুত্রসন্তান নেই। তহমিনা আমাকে সংবাদ দিয়েছে, আমার কন্যাসন্তান হয়েছে।
সোহরাব শেষবারের মতো চক্ষু মেলে বাবার দিকে দৃষ্টিপাত করে তার হাত তুলে দেখাল, সেখানে একটি তাবিজ বাঁধা আছে। সোহরাব বলল, বাবা আমার আর কোনো দুঃখ নেই। সোহরাবের চোখ বন্ধ হয়ে গেল।
সোহরাবের নিস্পন্দ দেহ পিতার বক্ষে আশ্রয় লাভ করল।
তখন নির্জন গিরিপথে কোনো প্রাণী ছিল না, আকাশের সূর্য এসে সোহরাবের মুখে পড়েনি, কোনো বিদায় রাগিণী বেজে উঠে সেই বিদায় দৃশ্যকে বিহবল করেনি। তবু রোস্তমের বুকফাটা হাহাকার ফিরে আয় মানিক। প্রতিধ্বনি ফিরে ফিরে এসে বারবার বলছিল, নেই সোহরাব নেই।
দিবসের শেষ সূর্য যখন পর্বতের ওপারে ঢলে পড়ল, তখনও হতভাগ্য মহাবীর রোস্তম ছেলের প্রাণহীন দেহ বক্ষে ধারণ করে বার বার বলছে: আয় সোহরাব ফিরে আয়।
সোহরাব রোস্তম
মূল: মহাকবি আবুল কাসেম ফেরদৌসী
রূপান্তর: মমতাজউদদীন আহমেদ
Post a Comment