শার্লক হোমস: দ্য রেসিডেন্ট পেশেন্ট


বন্ধুবর শার্লক হোমসের সব কেসই যে কাহিনি-বৈচিত্র্যে জমজমাট, তা নয়। কিছু কেস স্মরণীয় তার নিজস্ব বিশ্লেষণী বৈচিত্র্যের জন্যে— কিছু স্রেফ কাহিনি বৈচিত্র্যের প্রসাদে, হোমসের অবদান সেখানে অকিঞ্চিৎকরণ, তবুও ঘটনা-পরম্পরার দৌলতে তা মনের মণিকোঠায় সাজিয়ে রাখবার মতো। বর্তমান কেসটি শেষোক্ত শ্রেণির।

অগাস্ট মাস। বর্ষাকাল। গুটিসুটি মেরে সকালের ডাকে আসা একটা চিঠি বার বার পড়ছে হোমস। আমি পড়ছি খবরের কাগজ। কিন্তু ভালো লাগছে না। খবর তো নেই। পালামেন্ট মুলতুবি। ছুটি কাটাতে সবাই এখন শহরের বাইরে। আমারও মন উড়ু উড়ু— কিন্তু পকেটে পাথেয় নাস্তি বলেই বেরোতে পারছি না। তা ছাড়া আমার এই সৃষ্টিছাড়া বন্ধুটির গ্রাম্য শোভার দিকে কোনো আকর্ষণই নেই যদি না সেখানে কোনো রহস্যের আকর্ষণ থাকে।

হোমস আত্মনিমগ্ন। কথাবার্তা সম্ভব নয় বুঝে খবরহীন খবরের কাগজখানা নিক্ষেপ করে বিভোর হলাম আকাশপাতাল ভাবনায়। এমন সময়ে ভাবনার ঘুড়ি ভোকাট্টা হয়ে গেল হোমসের গায়ে-পড়া আচমকা মন্তব্যে।

ওয়াটসন, ধরেছ ঠিক। বোকারাই এভাবে ঝগড়া মিটােয়। পন্থাটা খুবই অসংগত। অত্যন্ত অসংগত। অত্যন্ত ভ্রান্ত! বললাম সোচ্ছাসে। পরমুহুর্তেই খেয়াল হল, আরে! আমার মনের কথার প্রতিধ্বনি হোমসের কণ্ঠে কেন? সোজা হয়ে বসে বিষম বিস্মিত হয়ে বিস্ফারিত চোখে চাইলাম ওর পানে।

বললাম, ব্যাপার কী হোমস? এ যে কল্পনারও অতীত।

আমার ভ্যাবাচ্যাক মুখচ্ছবি দেখে অট্টহাসি হাসল হোমস। বললে, বন্ধু হে, কিছুদিন আগে এডগার অ্যালান পো-র রচনাবলি থেকে লেখা তোমাকে পড়ে শুনিয়েছিলাম। একজন যুক্তিবিশারদ তার সঙ্গী ভদ্রলোকের মনের অব্যক্ত ভাবনাগুলো হুবহু বলে গিয়েছিল। শুনে তুমি বলেছিলে, এ হল লেখকের কল্পনার লাগাম-ছাড়া দৌড়। আমি বলেছিলাম, ঠিক ওইরকমটি কিন্তু আমিও করি। তোমার বিশ্বাস হয়নি।
না তো!

অবিশ্বাসটা মুখে প্রকাশ করনি— চোখে-মুখে ফুটিয়ে তুলিয়েছিলে, তাই এখন কাগজ ফেলে দিয়ে যখন সাত পাঁচ ভাবতে বসলে— তোমার প্রত্যেকটা চিত্তার চেহারা বাইরে থেকে দেখছিলাম।

কিন্তু আমি তো চুপ করে বসে আছি। পো যার কথা লিখেছেন, মানে, যার ভাবনার চেহারা বাইরে থেকে আঁচ করা গিয়েছে, সে এক জায়গায় এভাবে বসে থাকেনি! কখনো আকাশের তারা দেখেছে, কখনো পাথরে হোঁচট খেয়েছে।

মানুষের মুখ হল মনের আয়না। অবয়ব তার নিত্যসঙ্গী।
তার মানে? অবয়ব দেখে মনের কথা বুঝতে পার?

অবয়ব আর চোখের ভাষা— দুটোর মধ্যে মনের চিন্তা ফুটে ওঠে। চিন্তার শুরু কখন খেয়াল আছে?
না।

আমি বলছি, শোনো। খবরের কাগজখানা ছুড়ে ফেলতেই আমার চোখ পড়ে তোমার ওপর। দেখলাম, তিরিশ সেকেন্ড শূন্য চোখে তাকিয়ে রইলে। অর্থাৎ মনও চিন্তাশূন্য। তারপরই চোখ পড়ল জেনারেল গর্ডনের বাঁধানো ছবিটার ওপর। মুখ-চোখের চেহারা একটু পাল্টাল। অর্থাৎ, ভাবনার আনাগোনা শুরু হল। এরপরেই হেনরি ওয়ার্ড বীচারের না-বাঁধানো ছবিখানার দিকে তাকিয়ে যা ভাবলে— তা মুখেই প্রকট হল। ভাবলে, আহারে! এ-ছবি বাঁধালে ফাঁকা জায়গাটা তো ভরাট হবেই, গর্ডনের ছবির পাশে মানাবেও ভালো।

অপূর্ব। ঠিক ধরেছ দেখছি!, উচ্ছসিত হয়ে উঠি আমি।

আবার তাকালে বীচারের ছবির দিকে। এবার নিবিড়ভাবে বীচারের চোখ-মুখ নিরীক্ষণ করলে। আস্তে আস্তে তোমার মুখ থেকে আলোড়ন মিলিয়ে গেল— মুখ নিস্তরঙ্গ, অর্থাৎ মন স্মৃতির রোমস্থনে ব্যাপৃত। অথচ তাকিয়ে আছ ছবির দিকে। তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছিলে মানুষটার মহান কীর্তির কথা, গৃহযুদ্ধে তার অবদানের কথা। তখন কিন্তু আমাদের অনেকেই তাকে ভুল বুঝেছিল, অবিচার করেছিল তার প্রতি। আমার মনে আছে, তখন তুমি ঘৃণায় ফেটে পড়েছিলে। আস্তে আস্তে তোমার চাহনি ছবির ওপর থেকে সরে এল— কিন্তু ভাবনা তখনও অব্যাহত রইল। অর্থাৎ ছবির মানুষকে নিয়ে আর ভাবছ না, ভাবছ এবার সেই ভয়ংকর গৃহযুদ্ধের কথা। কেননা, তোমার চোখ জ্বলে উঠল, ঠোঁট শক্ত হয়ে গেল, হাত মুঠো করে ফেললে। তারপরেই মুখটা বিষগ্ন হয়ে গেল। আপন মনে মাথা নাড়লে। যুদ্ধে যারা প্রাণ হারিয়েছে, তাদের কথা ভেবে মুখটা তোমার স্নান হয়ে গেল। আস্তে আস্তে তোমার নিজের ক্ষতচিহ্নটায় হাত বুলোলে, ফিকে হাসি হাসলে, এ-হাসি আমি চিনি, দেশে দেশে ঝগড়া মিটোনোর জন্যে রক্তক্ষয়ী এ-পস্থটা যে কতখানি নিবুদ্ধিতা আর অসংগত, তা ভেবে তুমি নিজের মনেই হেসে উঠলে। চিন্তার এই পর্যায়ে একমত হলাম তোমার সঙ্গে এবং তা ব্যক্ত করলাম সরবে।

এক্কেবারে ঠিক!
সেদিনকার সন্দেহ তাহলে মিটল তো? চলো এবার রাস্তার হাওয়া খেয়ে আসা যাক।
ঘণ্টা তিনেক টো-টো করে বেকার স্ট্রিটে ফিরে দেখলাম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একটা গাড়ি।
ডাক্তারের গাড়ি দেখছি, বললে হোমস। নতুন পসার শুরু করেছেন। জেনারেল প্র্যাকটিশনার, বিশেষজ্ঞ নন। তবে খাটিয়ে ডাক্তার। এসেছেন পরামর্শ করতে, কপাল ভালো ঠিক সময়ে ফিরেছি!

হোমসের পদ্ধতি আমি জানি। ব্রুহাম গাড়ির আলোর পাশে ঝোলানো বেতের বাস্কেটে কী-কী ডাক্তারি যন্ত্রপাতি রয়েছে এবং তাদের অবস্থা দেখেই বুঝলাম ঝট করে এত কথা কী করে বলল সে। ঘরের জানলায় আলো জ্বলছে। রাত দশটায় এসেছেন নিশ্চয় সমস্যা নিয়ে। কৌতুহলী হয়ে ঢুকলাম ঘরে।

বালি রঙের জুলপিওলা পাণ্ডুবৰ্ণ বছর তেত্রিশ-চৌত্রিশ বছরের একজন অস্থিচর্মসার ভদ্রলোক অগ্নিকুণ্ডের পাশে বসেছিলেন। বিগতযৌবন শক্তিহীন চেহারা, একটু নার্ভাস আর লাজুক। শিল্পীসুলভ সরু হাত, ডাক্তার বলে মনে হয় না।

হোমস খুশি উজ্জ্বল কণ্ঠে বললে, গুড ইভনিং ডক্টর, মিনিট কয়েক হল এসেছেন দেখছি।
উঠে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক বললেন, কোচয়ান বলল বুঝি?

আপনার পাশের মোমবাতিটা এইমাত্র জ্বালানো হয়েছে দেখে বললাম। বলুন কী করতে পারি আপনার জন্যে?
আমার নাম ডক্টর পার্সি ট্ৰেভেলিয়ান, থাকি ৪০৩ নম্বর ব্রুক স্ট্রিটে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, স্নায়ুরোগ সম্বন্ধে বিরল গ্রন্থটি তাহলে আপনার লেখা?

খুশি হলেন ভদ্রলোক। রক্তিম মুখে বললেন, যাক, বইটা পড়েছেন তাহলে। প্রকাশকের হিসেব অনুযায়ী নাকি বিক্রিই হয় না। আপনি ডাক্তার?

যুদ্ধে ছিলাম— অবসর নিয়েছি। স্নায়ুরোগে বিশেষজ্ঞ হওয়ার ইচ্ছে আমার আছে। মি. হোমস। আমার বাড়িতে পর-পর এমন সব ঘটনা ঘটছে যে আপনার কাছে ছুটে না-এসে আর পারলাম না।

বসল হোমস। পাইপ ধরিয়ে বললে, খুলে বলুন।

ডক্টর ট্ৰেভেলিয়ানও বসলেন, কতকগুলো কথা এতই তুচ্ছ যে শুনলে আপনার হাসি পাবে। কিন্তু না-বললেও রহস্যটা স্পষ্ট হবে না। তাই সব বলব, বাদসাদ আপনি দেবেন।

প্রথমেই বলি, ছাত্র হিসেবে আমি ভালো ছিলাম। ডিগ্রি নেওয়ার পর মূর্ছারোগ সম্পর্কে কৌতুহল জাগানো কিছু গবেষণা করেছিলাম। তারপর স্নায়ুরোগের ওপর ওই বইখানা লিখে ব্রুস পিনকারটন পদক আর পুরস্কার দুটােই পাই।

কিন্তু জমিয়ে প্র্যাকটিস করার মতো আমার পয়সা ছিল না। ক্যাভেন্ডিশ স্কোয়ারের ধারে কাছে ঘরভাড়া আকাশছোঁয়া, ডাক্তারি সরঞ্জামের খরচও অনেক। পসার না-জমা পর্যন্ত হাতে টাকাও দরকার। এত রেস্ত আমার ছিল না। হঠাৎ কিন্তু বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিড়ে পড়ল। আশ্চর্য একটা সুযোগ পেলাম।

বছর কয়েক আগে ব্রেসিংটন নামে এক অচেনা ভদ্রলোক সকালে আমার সঙ্গে দেখা করলেন এবং গায়ে পড়ে আমাকে সাহায্য করতে চাইলেন। ছাত্রজীবনে আমার সুনাম তিনি শুনেছেন, আমি যে পদক আর পুরস্কার পেয়েছি, সে-খবরও রাখেন। জিজ্ঞেস করে জেনে নিলেন, আমি মদ খাই না, বদ নেশায় আসক্ত নই, অথচ পকেটে রেস্ত নেই বলে পসার জমাতে পারছি না। উনি তখন বললেন, দেখুন মশায়, আমার বেশ কিছু টাকা এমনিই পড়ে আছে। আমি তা খাটাতে চাই। তাতে আপনার লাভ, আমারও লাভ।

শুনে তো আমার দম বন্ধ হয়ে আসে আর কি! এ যে মেঘনা-চাইতেই জল! উনি তখন খুলে বললেন প্রস্তাবটা। ঘরভাড়া, সাজসরঞ্জাম কেনা, লোকজনের মাইনে, সব খরচ ওঁর। আমার কাজ হবে কেবল রুগি দেখা। রোজগার যা হবে, যার তিন ভাগ উনি নেবেন, এক ভাগ আমি পাব।

আমি রাজি হয়ে গেলাম। লেডি ডে’-তে প্র্যাকটিস শুরু করলাম। দোতলার সবচেয়ে ভালো ঘর দুটোয় উনি নিজে রইলেন, হার্ট খারাপ বলেই সবসময়ে ডাক্তারের সান্নিধ্যে থাকতেন। ঘর থেকে খুব একটা বেরোতেন না, কারো সঙ্গে মিশতেন না, কিন্তু প্রতিদিন সন্ধে হলেই নীচে এসে আমার খাতাপত্র দেখে গিনি পিছু পাঁচ শিলিং তিন পেনি আমাকে দিয়ে বাকিটা নিজের ঘরে নিয়ে বাক্সে মজুত করতেন। রোজগারও ভালো হচ্ছিল। দেখতে দেখতে আমার পসার জমে গিয়েছিল। এই কয়েক বছরেই ভদ্রলোক বড়োলোক হয়ে গেলেন আমার দৌলতে।

কয়েক সপ্তাহ আগে হস্তদন্ত হয়ে এসে রেসিংটন বললেন, দরজা জানলায় মজবুত খিল লাগানো দরকার। ওয়েস্টএন্ডে নাকি সাংঘাতিক ডাকাতি হয়ে গেছে। ভীষণ উত্তেজিত দেখলাম ভদ্রলোককে। কয়েক সপ্তাহ কাটল অদ্ভুত অস্বস্তির মধ্যে— সবসময়ে জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখতেন বাইরে। রাত্তিরে ডিনারের পর একটু বেড়ানোর অভ্যেস ছিল, তাও বন্ধ হয়ে গেল এরপর। দেখে শুনে মনে হল ভয়ে সিঁটিয়ে আছেন অষ্টপ্রহর। কাকে বা কীসের জন্যে এত আতঙ্ক, জিজ্ঞেস করতে গিয়ে হল বিপত্তি।

তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। কাজেই আমি আর ও নিয়ে কথা বলিনি। আস্তে আস্তে সুস্থির হলেন। আগের মতো ডিনারের পর আবার বেড়ানো শুরু করলেন। তারপরেই এমন একটা ঘটনা ঘটল যে একেবারে বিছানা নিলেন।

দু-দিন আগে একটি চিঠি পাই আমি। চিঠিতে তারিখ নেই, ঠিকানা নেই। শুনুন, পড়ছি। ‘একজন খানদানি রুশ ভদ্রলোক বিখ্যাত বিশেষজ্ঞ ডক্টর পার্সি ট্ৰেভেলিয়ানকে দিয়ে তার মুর্ছারোগের চিকিৎসা করাতে চান। কাল সন্ধে ছ-টা পনেরো মিনিটে তিনি আসবেন ডাক্তারের চেম্বারে। ডাক্তারবাবু যেন হাজির থাকেন।

মূৰ্ছারোগের চিকিৎসায় সবচেয়ে বড়ো অসুবিধে হল রুগি পাওয়া। তাই খুব উৎসাহ পেলাম চিঠি পেয়ে। পরের দিন চেম্বারে এলেন দুই ব্যক্তি। একজন রোগা লম্বা, গম্ভীর, বয়স্ক— অতি মামুলি চেহারা— আভিজাত্যহীন। আর একজন কান্তিমান যুবক, চওড়া বুক, ধারালো নাক মুখ। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে যুবকটি পরিচয় দিলেন নিজেদের। বয়স্ক পুরুষ তার বাবা। মূৰ্ছারোগের প্রকোপে বড্ড কষ্ট পাচ্ছেন। চোখে দেখা যায় না। কানে শোনা যায় না। বাবাকে আমার কাছে রেখে তাই তিনি পাশের ঘরে থাকবেন।

বয়স্ক ভদ্রলোককে পরীক্ষা শুরু করলাম। জবাব দিলেন উলটোপালটা। বোধ হয় ভাষাটা ভালো জানা নেই বলেই। কিছুক্ষণ পরে কোনো জবাব না-দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন সামনে। চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেছে দেখে বুঝলাম রোগের আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। নাড়ি, জ্বর, মাংসপেশি, প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করে অবাক হলাম— সব স্বাভাবিক। তাই অ্যামাইল নাইট্রেট শুকিয়ে ঘোর কাটানো দরকার ভেবে ল্যাবরেটরিতে গেলাম ওষুধটা আনতে। মিনিট পাঁচেক পরে এসে দেখলাম ঘর খালি। তিনি নেই। পাশের ঘরে তার ছেলেও নেই। চাকরটা নতুন, তেমন চটপটে নয়। রুগি কোথায়, সে বলতে পারল না। আওয়াজ-টাওয়াজও নাকি পায়নি। দরজাটা ভেজানো, বন্ধ নয়। পুরো ব্যাপারটা একটা বিরাট রহস্য রয়ে গেল আমার কাছে।

ব্লেসিংটন বেড়ানো শেষ করে ফিরে এলেন একটু পরে। ইদানীং ওঁর সঙ্গে খুব কম কথা বলি। তাই এ-প্রসঙ্গে কোনো কথা বললাম না।

রুশ ভদ্রলোকরা আবার আসবেন ভাবিনি। পরের দিন ব্রেসিংটন বেরিয়ে যাওয়ার একটু পরেই তাই ওঁদের ঘরে ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। কাঁচুমাচু মুখে ওরা বললেন কালকের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত। রোগের আক্রমণ কেটে যাওয়ার পর ভদ্রলোকের মনে হল একটা নতুন জায়গায় বসে আছেন। কেন এসেছেন, কোথায় এসেছেন— কিছু মনে করতে পারলেন না। প্রতিবার ঘোর কেটে যাওয়ার পর এইরকমই হয়— আগের কথা খেয়াল থাকে না। তাই সোজা বেরিয়ে যান ঘর থেকে। বাবাকে বেরিয়ে যেতে দেখে ছেলে ভাবেন, ডাক্তারের সঙ্গে কাজ শেষ হয়েছে বলেই বুঝি বেরিয়ে যাচ্ছেন। পেছন পেছন তিনিও বেরিয়ে যান। বাড়ি যাওয়ার পর জানা যায় আসল ব্যাপারটা।

শুনে একচোট হেসে নিয়ে নতুন করে রুগির সঙ্গে আলোচনা করতে বসলাম। ছেলে গেলেন পাশের ঘরে।
আধ ঘণ্টা পরে প্রেসক্রিপশন লিখে দেওয়ার পর ছেলে এসে বাবাকে ধরে ধরে নিয়ে গেলেন বাইরে।
একটু পরেই বেড়িয়ে ফিরলেন ব্লেসিংটন। সটান গেলেন ওপরের ঘরে। পরমুহুর্তেই দুমদাম করে বললেন, কে ঢুকেছিল আমার ঘরে?

উন্মত্ত চেহারা দেখে মাথার ঠিক নেই বুঝে রুক্ষতাটা গায়ে মাখলাম না। সবিনয়ে বললাম, কেউ তো ঢোকেনি।

শুনে ঠান্ডা হওয়া দূরে থাকুক, তুৰ্ভুক নাচ নাচতে নাচতে সটান আমাকে মিথ্যেবাদী বলে বসলেন ব্লেসিংটন। ওপরের ঘরে টেনে নিয়ে গিয়ে দেখালেন, সত্যিই কার্পেটের ওপর কতকগুলো বড়ো আকারের পায়ের ছাপ— যা তার নয় মোটেই।

কালকে বিকেলে তুমুল বৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল মনে আছে নিশ্চয় আপনার। বেশ বুঝলাম, রুশ রুগির ছেলেটি ভিজে জুতো নিয়ে এই ঘরে ঢুকেছিলেন। জিনিসপত্রে হাত দেননি। কিন্তু বসবার ঘরে বসে না-থেকে ওপরের ঘরে ঢুকে পায়চারি করে গিয়েছেন কার্পেটে।

ব্যাপারটা এমন কিছু গুরুতর নয় যে ভেঙে পড়তে হবে। কিন্তু মি. ব্রেসিংটন দেখলাম আতঙ্কে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। আর্মচেয়ারে বসে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলেন। কিন্তু কান্নাটা কেন, সেটা স্পষ্ট করে বলতে পারলাম না— আমিও কথা বলতে পারলাম না। তাই আপনার কাছে এলাম। খামোকা ভয় পাচ্ছেন মি. ব্লেসিংটন। আপনি গিয়ে যদি একটু বুঝিয়ে বলেন তো ভালো হয়।
নিমীলিত চোখে পাইপ টানতে টানতে প্রত্যেকটা শব্দ কান খাড়া করে শুনল হোমস! ডাক্তারের কাহিনি যে তার প্রাণে সাড়া জাগিয়েছে, পাইপ থেকে ধুম উদগিরণের ধরন দেখেই তা বুঝলাম। কাহিনি শেষ হতেই উঠে পড়ল চেয়ার ছেড়ে। পনেরো মিনিটের মধ্যে এসে গেলাম ব্রুক স্ট্রিটে ডাক্তারের চেম্বারে। কার্পেট-মোড়া চওড়া সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছি, এমন সময়ে— ফস করে নিভে গেল ওপরের আলো। অন্ধকারের মধ্যে থেকে ভেসে এল কম্পিত কণ্ঠে ব্ৰজনাদ : খবরদার। হাতে পিস্তল আছে। ওপরে উঠলেই খতম করে দেব!

ডাক্তার বললেন, কী হচ্ছে মি. ব্লেসিংটন ? মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন দেখছি।
আরে ডাক্তার নাকি! সঙ্গে কারা?

অন্ধকারেই টের পেলাম আমার এবং হোমসের সারা গায়ে হাত বুলিয়ে কে যেন পরীক্ষা করছে। তারপরেই জ্বলে উঠল গ্যাসবাতি। ‘আসতে পারেন। আসতে পারেন। ঠিক আছে। কিছু মনে করবেন না— একটু হুঁশিয়ার থাকা দরকার।’

আলোয় দেখলাম বিচিত্র ভদ্রলোককে। এককালে খুব মোটা ছিলেন। এখনও মোটা রয়েছেন— কিন্তু আগের মতো নয়। বুলডগের মতো শিথিল চামড়া ঝুলছে মুখময়। ভীষণ ঘাবড়ে যাওয়ায় থির থির করে কাঁপছে গালের চামড়া। বালি রঙের পাতলা চুল যেন ভয়ের চোটে খাড়া হতে চাইছে। আমরা এগিয়ে যেতেই হাতের পিস্তলটা পকেটে রেখে বললেন— ‘আসুন মি. হোমস। ডাক্তারের কাছে শুনেছেন তো ঘরে কারা যেন ঢুকেছিল?

তারা কারা মি. ব্লেসিংটন? আপনাকে খুন করতেই-বা চাইছে কেন? প্রশ্ন করল হোমস।

ঘাবড়ে গেলেন ব্লেসিংটন। আমতা আমতা করে বললেন, তা তো জানি না। আপনাকে তলব করলাম আপনার মুখেই শুনব বলে।
আপনি জানেন না?

আসুন, আসুন, ওপরে আসুন।

গেলাম ওপরের ঘরে ভদ্রলোকের পেছন পেছন। সুন্দরভাবে সাজানো ঘরের এককোণে রাখা একটা পেল্লায় কালো বাক্সের দিকে আঙুল তুলে ব্রেসিংটন বললেন, আমার সারাজীবনের টাকা ওর মধ্যে আছে। ব্যাঙ্ক-কে আমি ভরসা পাই না। জীবনে একবারই টাকা খাটিয়েছি ডাক্তারের মারফত। ঘরে লোক ঢুকেছে দেখে সেই কারণেই এত ঘাবড়ে গেছি।

মি. ব্লেসিংটন, আমাকে ঠকালে কিন্তু সাহায্য পাবেন না।

সবই তো বললাম।

বিরক্ত মুখে পেছন ফিরল হোমস, তাহলে চললাম।
সে কী! কী করা উচিত বলে যান!, ভাঙা গলায় বললেন ব্লেসিংটন।

প্রাণ খুলে কথা বলা উচিত— যা সত্যি তা বলা উচিত, বলে আর দাঁড়াল না হোমস। আমাকে নিয়ে নেমে এল রাস্তায়।
হাঁটতে হাঁটতে বললে, অযথা ঝামেলায় তোমাকে টেনে আনার জন্যে আমি দুঃখিত, ওয়াটসন। তবে ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং।
তা তো বুঝলাম, কিন্তু মাথায় তো কিছু ঢুকছে না।

দুজন অথবা তিনজন লোক রয়েছে এর মধ্যে। ব্লেসিংটনের ওপর তারা খেপে আছে। এদের একজন রুগির ছদ্মবেশে ডাক্তারকে আটকে রাখে— আর একজন সেই ফাঁকে রেসিংটনের ঘরে ঢোকে।

রোগটা?

স্রেফ অভিনয়। কিন্তু কপালক্রমে দু-বারই ঘরের বাইরে রইল ব্লেসিংটন। তার মানে ওই সময়টা যে তার বেড়ানোর সময়, আততায়ীরা তা জানে। চুরির উদ্দেশ্যে ঘরে ঢুকলে জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করত। তা ছাড়া প্রাণের ভয় থাকলে চোখ দেখলেই তা বোঝা যায়— ব্লেসিংটনের চোখে আমি মৃত্যুভয় দেখেছি। ও জানে কারা ঘরে এসেছিল— কিন্তু চেপে যাচ্ছে।

অথবা হয়তো ঘরের মধ্যে লোক ঢোকার ব্যাপারটা মনগড়া। ডক্টর ট্ৰেভেলিয়ান বানিয়ে বলেছেন। নিজেই হয়তো ঘরে ঢুকেছিলেন কোনো বদ মতলবে।

মুচকি হাসল হোমস আমার কল্পনার দৌড় দেখে।

বলল, ‘ও-সম্ভাবনা বাতিল করে দিয়েছি সিঁড়ির কার্পেটে সেই জোয়ান লোকটার পায়ের ছাপ দেখে। মাপটা ডাক্তারের জুতোর মাপের চেয়ে বড়ো। তা ছাড়া, ডাক্তার ছুঁচোলো জুতো পরেন— সে পরে এসেছিল চৌকোনা জুতো। যাকগে, আশা করছি, কালকেই নতুন খবর পাব ব্রুক স্ট্রিট থেকে।

সত্যিই খবর এল, অত্যন্ত অভাবনীয়ভাবে। সাতসকালে ধড়মড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলাম হোমসের ধাক্কায়। চিরকুট এসেছে ডা. ট্ৰেভেলিয়ানের কাছ থেকে। নোটবুক থেকে ছেড়া কাগজে দ্রুত লিখেছেন, ‘ভগবানের নামে বলছি। এক্ষুনি আসুন, পি. টি.। চিরকুট পাঠিয়েছেন কোচোয়ানের হাতে— গাড়ি নিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে নীচে।

পনেরো মিনিট লাগল ডাক্তারের চেম্বারে পৌছোতে। আমাদের দেখেই মাথায় হাত দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন ভদ্রলোক, সর্বনাশ হয়ে গেল। মি. ব্লেসিংটন সুইসাইড করেছেন। গলায় দড়ি দিয়েছেন কাল রাতে।

শিস দিয়ে উঠল শার্লক হোমস।

কাতর কষ্ঠে ডাক্তার বললেন, কী করি বলুন তো? সব গুলিয়ে যাচ্ছে আমার। পুলিশ অবশ্য এসে গেছে, ওপরে আছে।
জানলেন কখন?

সকাল সাতটা নাগাদ রোজকার মতো চা নিয়ে গিয়েছিল ঝি। দেখল, ঘরের ঠিক মাঝখানে ঝুলছেন। ল্যাম্পের হুঁকে দড়ি বেঁধে কালো বাক্সটা থেকে লাফিয়ে ঝুলে পড়েছেন।

চিন্তামগ্নভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল হোমস। তারপর ডাক্তারের পেছন পেছন উঠল ওপরের ঘরে, সঙ্গে আমি। ঢুকেই দেখলাম ভয়াবহ সেই দৃশ্য। স্থূলকায় রেসিংটন ঝুলন্ত অবস্থায় যেন আরও মোটা হয়ে গেছেন। ছাল ছাড়ানো মুরগির মতো লম্বা হয়ে বেয়ে রয়েছে গলা, বাদবাকি দেহটা নরদেহ বলে মনে হচ্ছে না। অত্যন্ত অস্বাভাবিক, অত্যন্ত বেমানান লাগছে সব কিছু। গোড়ালি ফুলে উঠেছে। পাশে দাঁড়িয়ে চটপটে চেহারার একজন পুলিশ ইনস্পেকটর নোটবই খুলে কী যেন লিখছে।

হোমসকে দেখেই স্বাগত জানাল ইনস্পেকটর। হোমস বললে, আরে, ল্যানার যে। কী সিদ্ধান্তে পৌছোলে?

ভয়ের চোটে মাথার ঠিক রাখতে পারেননি ভদ্রলোক। ওই দেখুন না শোয়ার ফলে বিছানা দেবে রয়েছে— তারপর ভোর পাঁচটা নাগাদ উঠে ঝুলে পড়েছেন। জানেন তো বেশির ভাগ লোক ওই সময়ে আত্মহত্যা করে।

লাশ পরীক্ষা করে আমি বললাম, মাসল যে-রকম শক্ত হয়ে গেছে মনে হচ্ছে ঘণ্টা তিনেক আগে মারা গেছেন ইনি।
অস্বাভাবিক কিছু পেয়েছ ঘরে?, হোমস শুধোয়।

হাত ধোবার জায়গায় পেয়েছি একটা স্কু-ড্রাইভার আর কয়েকটা স্ক্রু। কাল রাতে চারটে চুরুট খেয়েছিলেন ভদ্রলোক— পোড়া অংশগুলো পেয়েছি ফায়ারপ্লেসে। এই দেখুন।

চুরুটের হোল্ডার?
না।
চুরুটের বাক্স?
এই তো— কোটের পকেটে ছিল।
বাক্স খুলে একটা চুরুট বার করে শুকল হোমস।

বলল, হাভানার চুরুট। কিন্তু এই পোড়া চুরুটগুলো ওলন্দাজরা আমদানি করেছে তাদের পূর্ব ভারতীয় উপনিবেশ থেকে। এসব চুরুট খড়ে মোড়া থাকে, একটু বেশি লম্বাটে আর সরু হয়।

বলতে বলতে পকেট ল্যাম্পের আলোয় পোড়া চুরুট চারটে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিয়ে বললে হোমস, দুটো চুরুট ছুরি দিয়ে কাটা, বাকি দুটো সাজানো দাঁত দিয়ে কাটা। ল্যানার, এটা আত্মহত্যা নয়, খুন। ঠান্ডা মাথায় মার্ডার।
অসম্ভব।

কে?
এত ঝামেলা পাকিয়ে কেউ খুন করে না।
সেটাই তো দেখতে হবে হে।
খুনিরা বাড়িতে ঢুকল কিভাবে?
সামনের দরজা দিয়ে।
দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল।
চলে যাওয়ার পর বন্ধ করা হয়েছিল।

জানলেন কী করে?

চিহ্ন দেখে। আরও খবর দিচ্ছি, বলে হোমস দরজার কাছে গিয়ে চাবি ঘুরিয়ে চুলচেরা চোখে উলটেপালটে দেখর চাবিটা। দেখল চাবির ফোকর। তরপর বিছানা, কার্পেট, চেয়ার, ম্যান্টলপিস, মৃতদেহ আর দড়ি পরীক্ষা করল। সবশেষে দড়ি কেটে ডেডবডি শোয়ানো হল চাদরের ওপরে।
বললে, দড়িটা কোত্থেকে এল?

ডক্টর ট্ৰেভেলিয়ান বিছানার তলা থেকে এক বান্ডিল দড়ি বার করে বললেন, এখান থেকে কেটে নেওয়া হয়েছে। পুড়ে মরার ভয়ে দড়ি রাখতেন খাটের তলায়— সিঁড়িতে আগুন লাগলে জানলা গলে যাতে পালাতে পারেন।

ফলে ওদের ঝামেলাও কমে গেল।— ম্যান্টলপিস থেকে ব্লেসিংটনের এই ছবিখানা নিয়ে চললাম— কাজে লাগবে।
কিন্তু কিছু তো বলে গেলেন না?

তিনজন এসেছিল এঁকে খুন করতে। রুশ রুগির ছদ্মবেশে বয়স্ক ব্যক্তিটিকে মাঝে রেখে সারি দিয়ে পা টিপে টিপে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠেছিল তিনজনে। সবার আগে ছিল সেই জোয়ান ছোকরা— ছদ্মবেশী রুগির সাজানো ছেলে। দরজা খুলে বাড়িতে ঢুকিয়েছিল যে তার হদিশ এখনও পেলাম না। ল্যানার, চাকরটাকে গ্রেপ্তার করো। ডাক্তারের মুখে শুনেছি সে নতুন এসেছে কাজে।

‘পালিয়েছে ছোড়া!’ গজ গজ করে বললেন ডাক্তার।

হোমস বললে, সে ছিল সবার পেছনে।

অভিভূত কন্ঠ বললাম, হোমস। এত কথা তুমি বলছ কী করে?

ভায়া, পায়ের ছাপ যে পর পর পড়েছে। ভুল হবার জো টি নেই। কোন ছাপটা কোন শ্রীমানের, সেটা তো কাল রাতেই জেনে গেছি! ওরা দরজার সামনে পৌছে তার দিয়ে খুঁচিয়ে খুলে ফেলল তালা— খালি চোখেই আঁচড়গুলো দেখা যায়। আতশকাচের দরকার হয় না। তারপর কাবু করল ব্লেসিংটনকে— খুব সম্ভব বিছানায় বসিয়ে নিজেরা বসল বিচারসভার মতো একটা পরামর্শসভায়। বুড়ো হোল্ডারে চুরুট লাগিয়ে বসল চেয়ারে। জোয়ান শাগরেদ এইখানে বসে চুরুট খেয়ে ছাই ঝাড়ল ড্রয়ার-আলমারিতে। তেসরা আদমি পায়চারি করতে লাগল ঘরময়। বিচারে সাব্যস্ত হল ফাঁসি দেওয়া হবে ব্লেসিংটনকে। ফাঁসি দেবে বলেই কাঠ বা পুলির মতো কপিকল জাতীয় কিছু একটা সঙ্গে এনেছিল নিশ্চয়। ফাঁসিকাঠ বানিয়ে নিত নিজেরাই— স্কু ড্রাইভার আর স্কু পর্যন্ত এনেছিল কড়িকাঠে সেটা লাগাবে বলে। কিন্তু ল্যাম্পের হুকটা দেখে সে হাঙ্গামা করতে হল না। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিয়ে বিদেয় হল জল্লাদরা, ভেতর থেকে স্যাঙাত বন্ধ করে দিল দরজা।

যেন প্রত্যক্ষ করে বলছে, এমনিভাবে প্রতিটি ব্যাপারে বিশদভাবে বলে গেল হোমস। ছোটো ছোটো চিহ্ন থেকে এইভাবে সাজানো খুনের দৃশ্য শুনে তাজব হলাম প্রত্যেকেই। ইনস্পেকটর তক্ষুনি বেরিয়ে গেল চাকরের খোঁজে।

বেকার স্ট্রিটে ফিরে ব্রেকফাস্ট খেয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল হোমস। বেলা তিনটের সময়ে এলেন ডাক্তার আর ইনস্পেকটর। হোমস ফিরল আরও পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে। মুখ প্রসন্ন— খবর শুভ নিশ্চয়।
কী খবর ইনস্পেকটর?, শুধোল ল্যানারকে।

শাবাশ। আর আমি পাকড়াও করেছি বাকি দুজনকে। ‘
সে কী? একযোগে চেঁচিয়ে উঠলাম তিনজনেই।

পাকড়াও করেছি মানে তাদের ঠিকুজি কুষ্ঠি জেনে ফেলেছি। রেসিং. টনকে পুলিশমহল চেনে। যারা খুন করে গেল, তাদেরকেও চেনে। এদের নাম বিডল, হেওয়ার্ড আর মোফাট।
ওয়াশিংটন ব্যাঙ্ক ডাকাত!, আঁতকে উঠল ইনস্পেকটর।

এক্কেবারে ঠিক!
তাহলে ব্লেসিংটনের আসল নাম সাটন?
তা আর বলতে।

হোমস বুঝিয়ে দিল— পাঁচজনে মিলে ডাকাতি করেছিল ওয়ার্দিংটন ব্যাঙ্কে। চারজনের নাম এইমাত্র বললাম— পঞ্চমজন হল কার্টরাইট। গার্ড টােবিনকে খুন করে সাত হাজার পাউন্ড নিয়ে চম্পট দেয় এরা। ঘটনাটা ঘটে ১৮৭৫ সালে। পুলিশ পাঁচজনকেই ধরে। রাজসাক্ষী হয় এই ব্রেসিংটন বা সাটন। অথচ এদের মধ্যে সবচেয়ে বদমাশ ছিল এই সাটন। ফাঁসি হয়ে যায় কার্টরাইটের। বাকি তিনজন জেলে যায়। পনেরো বছরের মেয়াদ ফুরোনোর বছর কয়েক আগেই ছাড়া পেয়ে এরা হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে সাটনকে। দু-বার খুন করতে এসে ফিরে যায়— ভাগ্যক্রমে বাড়ি থাকেনি সাটন। তৃতীয়বারে কাজ হাসিল করেছে।

ডক্টর ট্ৰেভেলিয়ান বললেন, খবরের কাগজে তিনজনের খালাস পাওয়ার খবরটা পড়েই বোধ হয় অতো ভয় পেয়েছিল ব্লেসিংটন।
হ্যাঁ। ডাকাতির গল্প যা বলেছিল, সেটা গল্পই।

কিন্তু আমার কাছে খুলে বললেই তো হত!

খুলে বলা কি যায়? পুরোনো দোস্তদের হিংস্র প্রকৃতি সে যতটা জানে, আর কেউ তা জানে না। জিঘাংসা যাদের রক্তে, তারা জেল থেকে বেরিয়ে কী করবে, তা হাড়ে হাড়ে বুঝেছিল বলেই আতঙ্কে আটখানা হয়ে গিয়েছিল পাপিষ্ঠ সাটন। অথচ লজ্জার মাথা খেয়ে আপনাকে বলতে পারেনি। তাই চেয়েছিল ব্রিটিশ কানুনের সাহায্য নিয়ে বাঁচতে। কিন্তু বিচার কানুনের চেয়ে বড়ো।

ব্রুক স্ট্রিটের রহস্যকাহিনির পরিসমাপ্তি এইখানেই। কেননা, তিন বিচারক-জল্লাদের টিকি ধরা আর যায়নি। বছর কয়েক আগে পর্তুগিজ উপকূলে একটা জাহাজ নিখোঁজ হয়! স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের বিশ্বাস খুনি তিনজন আরোহীদের মধ্যে ছিল।

No comments