মোল্লা নাসিরুদ্দিন হোজ্জার ৬টি মজার গল্প


মোল্লা নাসিরউদ্দিন হোজ্জা ছিলেন একজন বেঁটে প্রকৃতির মানুষ। মাথায় পাগড়ি আর গায়ে জোব্বা পরে একটা গাধার ওপর চড়ে তিনি ঘুরে বেড়াতেন। হোজ্জাকে নিয়ে এক হাজারেরও বেশি গল্প চালু আছে। কোনো গল্পে তাকে খুব বুদ্ধিমান একজন মানুষ মনে হয়। আবার কোনো গল্পে তার আচরণ একেবারেই বোকার মতো হয়। তবে তিনি সারাবিশ্বে পরিচিতি পেয়েছেন তার রসবোধের কারণে। তার কথাবার্তা আমাদের যেমন হাসায়, তেমনি ভাবায়ও বটে।

আজকে ‘গল্পের আসরে‘ মোল্লা নাসিরউদ্দিন হোজ্জার ৬টি মজার গল্প নিয়ে সাজানো হয়েছে।

গল্প-১: কেউ কেউ জানি, কেউ কেউ জানি না

মোল্লা নাসিরউদ্দিন যে এলাকায় বাস করতেন সেখানকার লোকজন বেশ কিছুদিন ধরেই তাকে অনুরোধ জানাচ্ছিল যে, তাদের স্কুলে গিয়ে ছাত্রদের উদ্দেশে কিছু জ্ঞানের কথা শোনাতে হবে। ওদের অনুরোধ ফেললে না পেরে হোজ্জা শেষমেষ গেল স্কুলে। তারপর উপস্থিত ছাত্রদের উদ্দেশ্য করে হোজ্জা বললেন, “আমি আজ তোমাদের যা বলতে চাই, তা কি তোমরা জানো?”

খুব স্বাভাবিকভাবেই ছাত্ররা জবাব দিল, “না মোল্লা সাহেব, আমরা কেউই জানি না আপনি কী বলবেন।”

হোজ্জা তখন বললেন, “জানোই না যখন, তখন আর জেনে কী হবে?”

এই কথা বলে হোজ্জা গটগট করে হেঁটে চলে আসল।

পরের সপ্তাহে স্কুল থেকে আবার কয়েকজন এল হোজ্জাকে নিয়ে যেতে। হোজ্জা আবারও ওদের সামনে গিয়ে বললেন, “আমি আজ তোমাদের যা বলতে চাই, তা কি তোমরা জানো?”

এবার কিন্তু ছাত্ররা খুবই সাবধান। ওরা সবাই একসঙ্গে বলল, ‘জি মোল্লা সাহেব, আমরা সবাই জানি আপনি কী বলবেন।”

হোজ্জা তখন বললেন, “জানোই যখন, তখন আর আমার বলার দরকার কী?”

এই কথা বলে হোজ্জা আবার গটগট করে হেঁটে চলে আসল।

স্কুলের ছাত্ররা তো দমবার পাত্র না। ওরা করল কি, পরের সপ্তাহে আবার হোজ্জাকে ধরে নিয়ে গেল ওদের উদ্দেশে কিছু বলার জন্য। হোজ্জা এবারও ওদের সামনে গিয়ে বলল, “আমি আজ তোমাদের যা বলতে চাই, তা কি তোমরা জানো?”

ছাত্রদের মধ্যে কেউ কেউ বলল, ‘জি মোল্লা সাহেব, জানি।”

আর কেউ কেউ বলল, “না মোল্লা সাহেব জানি না।”

ভাবখানা এমন, এবার বাছাধন কোথায় যাবে? কিন্তু হোজ্জাও দমবার পাত্র না। তিনি বললেন, “তোমাদের মধ্যে যারা জানো তারা এক কাজ করো। কাজটি হলো- যারা জানে না, তাদের তা জানিয়ে দাও।” এই কথা বলে আবার হোজ্জা গটগট করে হেটে বাসায় চলে আসল।

গল্প-২: হযরত ইউনুস (আ.)-এর মাছ

মোল্লার বাবা একদিন মাছের কাবাব নিয়ে বাসায় এলো। মোল্লা তখন বাসায় ছিল না। মা খাবার দিতে দিতে বলল: ‘মোল্লা কখন আসে না আসে তার ঠিক নেই, চলো আমরা খেয়ে ফেলি। ও থাকলে তো মাছ সহজে আমাদের গলা দিয়ে নীচে নামবে না।’

বলতে না বলতেই মোল্লা ঘরের দরোজায় টোকা দিল। মা বড় দুটি মাছের কাবাব খাটের নীচে লুকিয়ে রেখে ছোট্ট মাছটি দস্তরখানে রাখল। ব্যাপারটা মোল্লা দরোজার ফাঁক দিয়ে দেখে ফেলল। দরোজা খুলে খেতে বসল মোল্লা। তার বাবা তাকে জিজ্ঞেস করল: বাবা! হযরত ইউনূস (আ) এর কাহিনীটা জানো?

মোল্লা কাবাব করা ছোট মাছটির মুখ কানের কাছে নিয়ে বলল: ওকে জিজ্ঞেস করে নিই, তারপর বলছি। কিছুক্ষণ পর মাছটা প্লেটে রেখে বলল: এই মাছ বলছে, সে সময় ও নাকি খুব ছোট ছিল। এই ঘটনাটা খাটের নীচের বড় মাছ দুটিকে জিজ্ঞেস করতে বলেছে।

গল্প-৩: হোজ্জার অঙ্ক কষা

পাড়ার এক ছেলে মোল্লা নাসিরউদ্দিনের হোজ্জা কাছে অঙ্ক বুঝতে এসেছে। হোজ্জা আবার অঙ্কে একেবারে অজ্ঞ। তাই বলে ছেলেটির কাছে ছোটও হতে চাচ্ছিল না। নিজের দুর্বলতা গোপন করে তিনি বিজ্ঞের মতো বললেন, ‘বল্‌, কোন্‌ অঙ্কটা বুঝতে পারছিস না?’

ছেলেটা বলল, ‘একটা ঝুড়িতে ৫০ টা কমলালেবু ছিল। ১৫ জন ছাত্রকে সমান ভাগ করে দিতে হবে। ঝুড়ি খুলে দেখা গেল তার মধ্যে ১০টা কমলালেবু পচে গেছে। তাহলে কয়টা কমলালেবু কম বা বেশি হবে?’

একটু মাথা চুলকে হোজ্জা বললেন, ‘অঙ্কটা কে দিয়েছে রে?’

ছেলে জবাব দিল, ‘স্কুলের মাস্টারমশাই।’

হোজ্জা রেগে বললেন, ‘তোর কেমন স্কুল রে! এমন বাজে অঙ্ক দিয়েছে? আর তোর মাস্টারমশাইয়েরও জ্ঞানবুদ্ধি একেবারেই নেই। আমাদের ছেলেবেলায় এ রকম অঙ্ক কখনো দিত না। আমাদের অঙ্ক থাকত আপেল নিয়ে। কমলালেবু তো পচবেই। আপেল হলে পচত না, আর অঙ্কটাও তাহলে সোজা হয়ে যেত। যেমন তোর পচা মাস্টার তেমনি তোর পচা অঙ্ক। এখন কেটে পড় দেখি, পচা কমলালেবুর বিশ্রী গন্ধ বেরোচ্ছে!’

ছেলেটা আর কী করে! অঙ্ক না করেই বাড়ি ফিরে গেল।

গল্প-৪: কে অপয়া?

একবার শিকারে বের হলেন রাজা। যাত্রা শুরু পর প্রথমেই পড়ে গেলেন নাসিরুদ্দীন হোজ্জার সামনে। রাজা ক্ষেপে গেলেন। পাইক-পেয়াদারের ডেকে বললেন, ‘হোজ্জা একটা অপয়া। যাত্রাপথে ওকে দেখলাম, আজ নির্ঘাত আমার শিকার পণ্ড। ওকে চাবুক মেরে দূর করে দাও।’

রাজার হুকুম তামিল হলো। কিন্তু সেদিন রাজার শিকারও জমে উঠল বেশ। গুণে গুণে ছাচ্ছিশটা নাদুসনুদুস হরিণ শিকার করলেন তিনি। প্রাসাদে ফিরে রাজা অনুতপ্ত হয়ে ডেকে পাঠালেন হোজ্জাকে। হোজ্জা দরবারে আসতেই রাজা বললেন, ‘কিছু মনে করো না, আমি তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম। ভেবেছিলাম তুমি অপয়া, আমার শিকার জুটবে না। কিন্তু এখন দেখছি আমার ধারণা উল্টো।’

রাজার কথা শুনে মওকা পেয়ে হোজ্জাও এবার রাগ দেখাল। বললেন, ‘আপনি আমাকে অপয়া ভেবেছিলেন। অথচ দেখুন, আমাকে দেখার পর আপনি ছাব্বিশটা হরিণ পেলেন, আর আপনাকে দেখে আমি খেলাম বিশ ঘা চাবুক। তাহলে অপয়া যে কে, সেটা বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই?’

গল্প-৫: সুখের সন্ধানে 

এক লোকের বউয়ের সঙ্গে খুব ঝগড়াঝাটি হতো। বউটি ছিল ভীষণ ঝগড়াটে। কোনোদিন সে তার স্বামীকে সুখে থাকতে দিতো না। একদিন সেই ভদ্রলোক কোনো উপায় না দেখে কিছু পয়সা ও জামাকাপড় পোঁটলায় বেঁধে কোথাও চলে যাওয়ার জন্য রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। কিছুদূর যাওয়ার পর সে একটা গাছের নিচে মুখ ভারত করে বসে রইল।

নাসিরউদ্দিন সেই লোকটিকে এমনভাবে বসে থাকতে দেখে প্রশ্ন করলেন, ‘ তোমার কী হয়েছে? কেন তুমি এমনভাবে রাস্তার ধারে বসে আছো?’

লোকটি বলল, ‘জীবন একেবারে বিষের মত হয়ে গেছে আমার স্ত্রীর জন্য মোল্লা সাহেব! হাতে কিছু পয়সা আছে বটে কিন্তু মনে সুখ নেই। তাই দেশে দেশে ঘুরতে বেরিয়েছি। যেখানে কোনো সুখের সন্ধান পাব, সেখানেই থেকে যাবো।’

লোকটির পাশে তার পোঁটলায় টাকাকড়ি জিনিসপত্র সব রাখা ছিল। তার কথা শেষ হতে না হতেই নাসিরউদ্দিন সেই পোঁটলাটা নিয়ে দৌড়ে পালাতে লাগলেন। মোল্লাকে পোঁটলাটা নিয়ে পালিয়ে যেতে দেখে লোকটিও তার পেছনে প্রাণপণ দৌড়াতে লাগল। দেখতে দেখতে মোল্লা রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলে ঢুকে হাওয়া হয়ে গেলেন। এভাবে লোকটিকে ধোঁকা দিয়ে তিনি আবার সেই রাস্তায় ফিরে পোঁটলাটা রাস্তার মাঝখানে রেখে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে রইলেন।

এদিকে লোকটিও কিছুক্ষণ পরে সেখানে এসে হাজির। তাকে এখন আগের চেয়েও বেশি দুঃখিত দেখাচ্ছে। কিন্তু রাস্তায় তার পোঁটলাটি পড়ে থাকতে দেখে মহাআনন্দে চিৎকার করে পোঁটলার উপর ঝাপিয়ে পড়ল।

পোঁটলা পেয়ে এতক্ষণে সে যেন প্রাণ ফিরে পেল। গাছের আঁড়াল থেকে মোল্লা নাসিরউদ্দিন বেরিয়ে এসে বললেন, “আমি ছিনতাইকারি নই, তোমার পোঁটলাটাও নিতে চাইনি। তোমার মতো একজন দুঃখী মানুষকে পোঁটলানা ফিরিয়ে দিয়ে সুখের সন্ধান দিলাম আর কী! তুমি নিশ্চয়ই খুশি হয়েছে- তাই না!!” এই বলে মোল্লা নাসিরউদ্দিন মুচকি হেসে চলে গেলেন।

গল্প-৬: ফুঁ দিলে গরম হয়, ঠাণ্ডাও হয়

তখন শীতকাল চলছিল। একদিন মোল্লা নাসিরউদ্দিন হোজ্জার কাছে এক লোক এসে বলল: মোল্লা সাহেব! শুনেছি আপনি অনেক জ্ঞানী মানুষ তাই আমি এলাম আপনার কাছে কিছু শিখব বলে। নাসিরউদ্দিন বললেন: ঠিক আছে শিখতে চাইলে এখানে বসো। লোকটি বসল। কিছুক্ষণ পর মোল্লার স্ত্রী একটি বাটিতে করে জ্বালানো কয়লা দিয়ে গেলেন ঘর গরম করার জন্য। কয়লা যখন নিবু নিবু তখন নাসিরউদ্দিন তাতে ফুঁ দিতে লাগলেন আগুনের তাপ বাড়ানোর জন্য। এ কথা শুনে লোকটি বলল: হুজুর! কয়লাতে ফুঁ দিচ্ছেন কেন? উত্তরে মোল্লা বললেন: এতে আগুন বাড়ে আর ঘর গরম হয়। তখন লোকটি বলল: যাক একটা নতুন জিনিস শিখলাম। ফুঁ দিলে গরম হয়।

এর কিছুক্ষণ পর মোল্লার স্ত্রী দু’কাপ চা দিয়ে গেলেন। মোল্লা চা খাওয়ার সময় আবার ফুঁ দিতে লাগলেন। লোকটি জিজ্ঞেস করল: এখন ফুঁ দিচ্ছেন কেন? জবাবে মোল্লা বললেন: এতে চা ঠাণ্ডা হবে। তখন লোকটি বলল: এটা কেমন কথা? ফুঁ দিলে গরম হয় আবার ঠাণ্ডাও হয়? আপনি দেখছি আমার থেকেও বোকা। আপনার কাছে আর কি শিখব।

#শিক্ষামূলক আর্টিকেল এবং নানান টিপস পেতে ভিজিট করুন অনুপ্রেরণা ডটকম


No comments