বাদশাহ জুলকারনাইন এবং ইয়াজুজ-মাজুজের কাহিনী

বাদশাহ জুলকারনাইন এবং ইয়াজুজ-মাজুজের কাহিনী

ইয়াজুজ মাজুজ এরা তুরস্কের বংশোদ্ভুত দুটি জাতি। কুরআন মাজীদে এ জাতির বিস্তারিত পরিচয় দেয়া হয়নি। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে তাদের নাক চ্যাপ্টা, ছোট ছোট চোখ বিশিষ্ট। এশিয়ার উত্তর পুর্বাঞ্চলে অবস্থিত এ জাতির লোকেরা প্রাচীন কাল হতেই সভ্য দেশ সমুহের উপর হামলা করে লুটতরাজ চালাত। মাঝে মাঝে এরা ইউরোপ ও এশিয়া উভয় দিকে সয়লাবের আকারে ধ্বংসের থাবা বিস্তার করতো।

বাইবেলের আদি পুস্তকে(১০ম আধ্যায়ে) তাদেরকে হযরত নুহ (আঃ) এর পুত্র ইয়াকেলের বংশধর বলা হয়েছে। মুসলিম ঐতিহাসিক গন ও একথাই মনে করেন রাশিয়া ও ঊওর চীনে এদের অবস্থান বলে বর্ণনা পাওয়া যায়। সেখানে অনুরুপ চরিত্রের কিছু উপজাতি রয়েছে যারা তাতারী, মঙ্গল, হুন ও সেথিন নামে পরিচিত।

তাছাডা একথাও জানা যায় তাদের আক্রমন থেকে আত্নরক্ষার জন্ন ককেম্পসের দক্ষিণাঞ্চলে দরবন্দ ও দারিয়ালের মাঝখানে প্রাচীর নির্মান করা হয়েছিল। ইসরাঈলী ঐতিহাসিক ইউসীফুল তাদেরকে সেথীন জাতি মনে করেন এবং তার ধারণা তাদের এলাকা কিষ্ণ সাগরের উওর ও পুর্ব দিকে অবস্থিত ছিল। জিরোম এর বর্ণনামতে মাজুজ জাতির বসতি ছিল ককেশিয়ার উওরে কাস্পিয়ান সাগরের সন্নিকটে।

ইয়াজূজ এবং মাজূজের উদ্ভব

ইয়াজূজ এবং মাজূজ হচ্ছে আদম সন্তানের মধ্যে দু-টি গোত্র, যেমনটি হাদিসে এবং বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। তাদের মধ্যে কিছু মানুষ অস্বাভাবিক বেঁটে, আবার কিছু অস্বাভাবিক লম্বা। কিছু অনির্ভরযোগ্য কথাও প্রসিদ্ধ যে তাদের মাঝে বৃহৎ কর্ণবিশিষ্ট মানুষও আছে, এক কান মাটিতে বিছিয়ে এবং অপর কান গায়ে জড়িয়ে বিশ্রাম করে।

বরং তারা হচ্ছে সাধারণ আদম সন্তান। বাদশা জুলকারনাইনের যুগে তারা অত্যধিক বিশৃঙ্খল জাতি হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল। অনিষ্টটা থেকে মানুষকে বাঁচাতে জুলকারনাইন তাদের প্রবেশ পথ বৃহৎ প্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন।

নবী করীম (সাঃ) বলে গেছেন যে, ঈসা নবী অবতরণের পর তারা সেই প্রাচীর ভেঙে বেরিয়ে আসবে। আল্লাহ্‌র আদেশে ঈসা (আঃ) মুমিনদেরকে নিয়ে তূর পর্বতে আশ্রয় নেবেন।

অতঃপর স্কন্ধের দিক থেকে এক প্রকার পোকা সৃষ্টি করে আল্লাহ্‌ তাদেরকে ধ্বংস করবেন। নিচে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল:

ঐতিহাসিক সেই প্রাচীর নির্মাণ

জুলকারনাইনের আলোচনা করতে গিয়ে আল্লাহ্‌ পাক বলেন- আবার সে পথ চতলে লাগল। অবশেষে যখন সে দুই পর্বত প্রাচীরের মধ্যস্থলে পৌঁছল, তখন সেখানে এক জাতিকে পেল, যারা তাঁর কথা একেবারেই বুঝতে পারছিল না। তারা বলল: হে জুলকারনাইন! ইয়াজূজ ও মাজূজ দেশে অশান্তি সৃষ্টি করেছে। আপনি বললে আমরা আপনার জন্য কিছু কর ধার্য করব এই শর্তে যে, আপনি আমাদের ও তাদের মধ্যে একটি প্রাচীর নির্মাণ করে দেবেন। সে বলল: আমার পালনকর্তা আমাকে যে সামর্থ্য দিয়েছেন, তাই যথেষ্ট। অতএব, তোমরা আমাকে শ্রম দিয়ে সাহায্য কর। আমি তোমাদের ও তাদের মধ্যে একটি সুদৃঢ় প্রাচীর নির্মাণ করে দেব। তোমরা লোহার পাত এনে দাও। অবশেষে যখন পাহাড়ের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থান পূর্ণ হয়ে গেল, তখন সে বলল: তোমরা হাঁপরে দম দিতে থাক। অবশেষে যখন তা আগুনে পরিণত হল, তখন সে বলল: তোমরা গলিত তামা নিয়ে এসো, আনি তা এর উপর ঢেলে দেই। অতঃপর ইয়াজূজ ও মাজূজ তার উপরে আরোহণ করতে পারল না এবং তা ভেগ করতেও সক্ষম হল না…[সূরা কাহফ, আয়াত ৯২-৯৭]

কে সে জুলকারনাইন?

তিনি হচ্ছেন এক সৎ ইমানদার বাদশা। নবী ছিলেন না (প্রসিদ্ধ মতানুযায়ী), পৃথিবীর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ভ্রমণ করেছেন বলে তাঁকে জুলকারনাইন বলা হয়। অনেকে আলেকজান্ডারকে জুলকারনাইন আখ্যা দেন, যা সম্পূর্ণ ভুল। কারন, জুলকারনাইন মুমিন ছিলেন আর আলেকজান্ডার কাফের। তাছাড়া তাদের দুজনের মধ্যে প্রায় দুই হাজার বৎসরের ব্যবধান। (আল্লাহ্‌ই ভাল জানেন)

বিশ্ব ভ্রমণকালে তিনি তুর্কী ভূমিতে আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজানের সন্নিকটে দুটি পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে পৌঁছেছিলেন। এখানে দুটি পাহাড় বলতে ইয়াজূজ-মাজূজের উৎপত্তিস্থল উদ্দেশ্য, যেখান দিয়ে এসে তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করত, ফসলাদি বিনষ্ট করত। তুর্কীরা জুলকারনাইন সমীপে নির্ধারিত ট্যাক্সের বিনিময়ে একটি প্রাচীর নির্মাণের আবেদন জানাল। কিন্তু বাদশা জুলকারনাইন পার্থিব তুচ্ছ বিনিময়ের পরিবর্তে আল্লাহ্‌র প্রতিদানকে প্রাধান্য দিলেন। বললেন- ঠিক আছে! তোমরা আমাকে সহায়তা করো! অতঃপর বাদশা ও সাধারণের যৌথ পরিশ্রমে একটি সুদৃঢ় লৌহ প্রাচীর নির্মিত হল। ইয়াজূজ-মাজূজ আর প্রাচীর ভেঙে আসতে পারেনি।

ইয়াজূজ-মাজূজের ধর্ম কি? তাদের কাছে কি শেষনবীর দাওয়াত পৌঁছেছে?

পূর্বেই বলা হয়েছে যে, তারা হচ্ছে আদম সন্তানেরই এক সম্প্রদায়। হাফেয ইবনে হাজার (রহঃ) এর মতে- তারা নূহ (আঃ) এর পুত্র ইয়াফিছের পরবর্তী বংশধর।

ইমরান বিন হুছাইন (রাঃ) থেকে বর্ণিত, কোন এক ভ্রমণে আমরা নবীজীর সাথে ছিলাম। সাথীগণ বাহন নিয়ে এদিক-সেদিক ছড়িয়ে পড়ল। নবীজী উচ্চকণ্ঠে পাঠ করলেন- হে লোক সকল! তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর। নিশ্চয় কেয়ামতের প্রকম্পন একটি ভয়ংকর ব্যাপার। যেদিন তোমরা তা প্রত্যক্ষ করবে, সেদিন প্রত্যেক স্তন্য-ধাত্রী তার দুধের শিশুকে ভুলে যাবে এবং প্রত্যেক গর্ভবতী তার গর্ভপাত করবে এবং মানুষকে তুমি দেখবে মাতাল; অথচ তারা মাতাল নয় বস্তুত: আল্লাহ্‌র আযাব বড় কঠিন…[সূরা হাজ্ব, আয়াত:১-২] নবীজীর উচ্চবাচ্য শুনে সাহাবিগণ একত্রিত হতে লাগলেন, সবাই জড়ো হলে বলতে লাগলেন- তোমরা কি জান-আজ কোন দিবস? আজ হচ্ছে সেই দিবস, যে দিবসে আদমকে লক্ষ্য করে আল্লাহ্‌ বললেন: জাহান্নাম বাসী বের কর! আদম বলবে: জাহান্নাম বাসী কে হে আল্লাহ্‌…!?আল্লাহ্‌ বলবেন- প্রতি হাজারে ৯৯৯ জন জাহান্নামে আর একজন শুধু জান্নাতে!! নবীজীর কথা শুনে সাহাবীদের চেহারায় ভীতির ছাপ ফুটে উঠল। তা দেখে নবীজী বলতে লাগলেন- আমল করে যাও! সুসংবাদ গ্রহণ কর! সেদিন তোমাদের সাথে ধ্বংস-শীল আদম সন্তান, ইয়াজূজ-মাজূজ এবং ইবলিস সন্তানেরাও থাকবে, যারা সবসময় বাড়তে থাকে (অর্থাৎ ওদের থেকে ৯৯৯ জন জাহান্নামে, আর তোমাদের থেকে একজন জান্নাতে), সবাই তখন আনন্দ ও স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। আরো বললেন- আমল করে যাও! সুসংবাদ গ্রহণ কর! ঐ সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ নিহিত! মানুষের মাঝে তোমরা সেদিন উটের গায়ে ক্ষুদ্র চিহ্ন বা জন্তুর বাহুতে সংখ্যা চিহ্ন সদৃশ হবে…[তিরমিযী, মুসনাদে আহমদ]

অর্থাৎ হাশরের ময়দানে ইয়াজূজ-মাজূজ, পর্ববর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি এবং ইবলিস বংশধরদের উপস্থিতিতে তোমাদেরকে মুষ্টিমেয় মনে হবে। ঠিক উটের গলায় ক্ষুদ্র চিহ্ন আঁকলে যেমন ক্ষুদ্র দেখা যায়, হাশরের ময়দানেও তোমাদের তেমন দেখাবে।

ইয়াজূজ-মাজূজের সংখ্যাধিক্য

আব্দুল্লাহ্‌ বিন আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সাঃ) বলেন- ইয়াজূজ-মাজূজ আদম সন্তানেরই একটি সম্প্রদায়। তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হলে জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলবে। তাদের একজন মারা যাওয়ার আগে এক হাজার বা এর চেয়ে বেশি সন্তান জন্ম দিয়ে যায়। তাদের পেছনে তিনটি জাতি আছে-তাউল, তারিছ এবং মাস্ক…[তাবারানী]

দৈহিক গঠন

খালেদ বিন আব্দুল্লাহ্‌ আপন খালা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন- একদা নবী করীম (সাঃ) বিচ্ছু দংশনের ফলে মাথায় ব্যান্ডেজ বাধাবস্থায় ছিলেন। বললেন- তোমরা তো মনে কর যে, তোমাদের কোন শত্রু নেই! (অবশ্যই নয়; বরং শত্রু আছে এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে) তোমরা যদ্ধু করতে থাকবে। অবশেষে ইয়াজূজ-মাজূজের উদ্ভব হবে। প্রশস্ত চেহারা, ক্ষুদ্র চোখ, কৃষ্ণ চুলে আবছা রক্তিম। প্রত্যেক উচ্চভূমি থেকে তারা দ্রুত ছুটে আসবে। মনে হবে, তাদের চেহারা সুপরিসর বর্ম…[মুসনাদে আহমদ, তাবারানী]

অর্থাৎ মাংসলতা ও স্থূলতার ফলে তাদের চেহারা বর্ম সদৃশ দেখাবে।

যে ভাবে প্রাচীর ভেঙে যাবে

জুলকারনাইনের নির্মিত সুদৃঢ় প্রাচীরের দরুন দীর্ঘকাল তারা পৃথিবীতে আসতে পারেনি। প্রাচীরের ওপারে অবশ্যই নিজস্ব পদ্ধতিতে তারা জীবন যাপন করছে। তবে আদ্যাবধি তারা সেই প্রাচীর ভাঙতে নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, প্রাচীরের বর্ণনা দিতে গিয়ে নবী করীম (সাঃ) বলেন- অতঃপর প্রতিদিন তারা প্রাচীর ছেদন কার্যে লিপ্ত হয়। ছিদ্র করতে করতে যখন পুরোটা উন্মোচনের উপক্রম হয়, তখনই তাদের একজন বলে, আজ তো অনেক করলাম, চল! বাকীটা আগামীকাল করব! পরদিন আল্লাহ্‌ পাক সেই প্রাচীরকে পূর্বের থেকেও শক্ত ও মজবুত রূপে পূর্ণ করে দেন। অতঃপর যখন সেই সময় আসবে এবং আল্লাহ্‌ পাক তাদেরকে বের হওয়ার অনুমতি দেবেন, তখন তাদের একজন বলে উঠবে, আজ চল! আল্লাহ্‌ চাহেন তো আগামীকাল পূর্ণ খোদাই করে ফেলব! পরদিন পূর্ণ খোদাই করে তারা প্রাচীর ভেঙে বেরিয়ে আসবে। মানুষের ঘরবাড়ী বিনষ্ট করবে, সমুদ্রের পানি পান করে নিঃশেষ করে ফেলবে। ভয়ে আতঙ্কে মানুষ দূরে দূরান্তে পলায়ন করবে। অতঃপর আকাশের দিকে তারা তীর ছুড়বে, তীর রক্তাক্ত হয়ে ফিরে আসবে…

[তিরমিযী, মুসনাদে আহমদ, মুস্তাদরাকে হাকিম]

No comments