হযরত মুসা (আঃ) ও এক যুবকের শিক্ষামূলক ঘটনা

হযরত মুসা (আঃ) ও এক যুবকের শিক্ষামূলক ঘটনা

হযরত মূসা (আ.)-এর কাছে একবার এক যুবক এসে বলল, হে আল্লাহর নবী! আমি জীবজন্তু লালন-পালন করি। আপনি দয়া করে আল্লাহর কাছে দু‘আ করুন, যাতে আমি তাদের দুঃখ-সুখের সকল কথা বুঝতে পারি আর উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারি।

যুবকটির কথা শুনে মূসা (আ.) বললেন, সাবধান! এর থেকে বিরত থাকুন। এর মধ্যে অনেক বিপদজনক ব্যাপার-স্যাপার লুকিয়ে আছে, যা আপনি সহ্য করতে পারবেন না।

কিন্তু যুবকটি নাছোড় বান্দা। সে বারবার কাকুতি-মিনতির সুরে একই আবদার জানাতে লাগল। মূসা (আ.) বললেন, এটা মঙ্গলজনক নয়। যুবকটি শেষে বলল, আর বেশী না হয়, অন্তত গৃহপালিত মোরগ ও কুকুরের ভাষা বুঝার ব্যবস্থা করে দিন। তার এ মিনতির দরুণ হযরত মূসা (আ.) আল্লাহর কাছে এ ব্যাপারে দু‘আ করলেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর দু‘আ কবূল করলেন এবং যুবকটিকে জীবজন্তুর ভাষা বুঝার ক্ষমতা দান করলেন।

যুবকটি খুশী মনে বাড়ী ফিরে গেল। আর মনে মনে বলল, এবার জীবজন্তুদের সব চালাকি ধরা যাবে।

পরদিন ভোরে যখন বাড়ীর হাঁস-মুরগী ছেড়ে দেয়া হলো, তখন সে যুবক মোরগের কথা শোনার জন্য বারান্দায় এসে বসল। বাড়ীর কাজের মেয়ে রাতের বেঁচে যাওয়া রুটির টুকরো উঠানে নিক্ষেপ করলো। কুকুরটিও কাছে ছিল। এমন সময় মোরগটি ঝাপটি মেরে রুটির টুকরো মুখে পুরে নিল। কুকুরটি প্রতিবাদের সুরে মোরগকে বললো, “রুটির টুকরো আমার ভাগে ছিল, তুই নিয়ে গেলি কেন?” উত্তরে মোরগ বললো, “একটু সবুর করো, অবস্থার দ্বারা বুঝতে পেরেছি, কালকেই আমাদের মনিবের সুন্দর ঘোড়াটা মারা যাবে। তখন তুমি মজা করে তার গোশত খেতে পারবে।”

বারান্দায় বসে থাকা যুবক মোরগের কথা শুনে চিন্তায় পড়ে গেলো। অতঃপর লোকসান এড়ানোর জন্য ঘোড়াটি বাজারে নিয়ে বিক্রি করে দিল।

পরদিন ভোরে আবারো যখন উঠোনে রুটির টুকরো ছড়ানো হল, তখন মোরগটি তা সাথে সাথে লুফে নিল। কুকুরটি সেদিনও বঞ্চিত হয়ে রাগ করে মোরগকে বললো, “ধোঁকাবাজ কোথাকার! কালকে রুটি নিলে, আজকেও নিয়ে গেলে। কই, ঘোড়া তো মরলো না। বরং মালিক তা অন্যখানে বিক্রি করে দিয়েছেন।” জবাবে মোরগ বললো, “ঘোড়াটি সত্যিই মরেছে, তবে অন্যখানে। অধৈর্য হয়ো না। অবস্থার দ্বারা জেনেছি, কালকে মনিবের উটটি মারা যাবে। তখন তুমি মজা করে ইচ্ছামতো খেতে পারবে।”

উটের মৃত্যুর কথা শুনে মনিব পেরেশান হয়ে গেলো। আর তৎক্ষণাত তা বাজারে বিক্রির জন্য পাঠালো এবং নিশ্চিত ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে গেলো।

পরদিন ভোরে আবারো রুটি ফেলা হলে, সাথে সাথে মোরগ রুটির টুকরো লুফে নিল। কুকুরটি আজও ব্যর্থ হলো। তখন সে তাচ্ছিল্যের সুরে মোরগকে বললো, “বড়ই প্রতারক দেখছি তোকে। প্রতিদিনই আমাকে ধোঁকা দিচ্ছিস!”

মোরগ বললো, “ধৈর্যহারা হয়ো না হে বন্ধু, কাল দেখবেÑমনিবের গোলামটা মারা যাবে। তখন শিরনি ইত্যাদি করবে। তখন গোশত, পোলাও ইত্যাদি অনেক কিছুই তুমি খেতে পারবে।”

মনিব মোরগের কথা শুনে বেচাইন হয়ে গেলো। সে তড়িৎ গোলামটাকে অন্য একজনের কাছে বিক্রি করে দিল এবং বিরাট ক্ষয়-ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেল। আর মনে মনে ভাবলো, এ জীবজন্তুদের ভাষা বুঝে ভালোই উপকার হলো। এতে অনেক ক্ষতি থেকে বাঁচা গেলো। কিন্তু এতে যে জেনে-বুঝে অন্যকে ক্ষতির সম্মুখীন করলো, সে চিন্তা সে করলো না।

চতুর্থদিন ভোরের কথা। রুটির টুকরো আজও একা লুফে নিল মোরগ। অসহায় কুকুর রাগের চোটে মোরগকে গালাগাল করতে লাগলো। মোরগ তাকে সান্ত¦নার বাণী শুনিয়ে বললো – “হে বন্ধু! আর একটু ধৈর্য ধর। কাল দেখবে মনিব নিজেই মারা যাবেন। কাল তিনি মারা গেলে ওয়ারিসরা গোশত, পোলাও, শিরনি ইত্যাদি করবে। তখন তুমি পেট পুরে খেয়ে নিও।”

আজ মোরগের কথা শুনে যুবকটি যারপরনাই বিচলিত হয়ে পড়লো। কাল যে সে মারা যাবেÑএ পেরেশানীতে অস্থির হয়ে গেলো সে।

আসলে আল্লাহ পাকের কুদরতের মাঝে অনেক গোপন কথা লুকায়িত থাকে, যা কেউ জানে না। কিন্তু মানুষ যখন সীমা লংঘন করে, তখনই যতসব বিপত্তি ঘটে। মাল-সম্পদের সামান্য ক্ষয়-ক্ষতিতে মনিবের জান বেঁচে যেত এবং মুসীবত মালের ওপর দিয়ে চলে যেতো। কিন্তু মনিব তা মানেনি। তাই বিপদ তার নিজের ওপরই চলে এসেছে।

নিরুপায় যুবক দৌড়ে মূসা (আ.)-এর দরবারে হাজির হলো। তাঁকে সকল ঘটনা খুলে বললো। অতঃপর মিনতি করে বললো, হে আল্লাহর নবী! আমাকে রক্ষা করুন। মূসা (আ.) বললেন, আমিতো আগেই বলেছি, সেই বিষয়টি আপনার জন্য মঙ্গলজনক হবে না। আপনি কেমন স্বার্থপর, শুধু নিজের স্বার্থ দেখলেন, অপরের ক্ষতি দেখলেন না! নিজের ক্ষতির কথা ভেবে সব বিক্রি করে দিলেন, অথচ যে তা কিনছে, সে যে ক্ষতির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে, সেটা বিবেচনায় নিলেন না। এ জন্য বিপদ আপনার ওপরই চলে এসেছে। এখন নিজেকে অন্য কারো কাছে বিক্রি করে দিন! তাতেই তো ভালো, এতে অনেক অর্থ-কড়ি ও ধন-সম্পদ লাভ হবে!

যুবকটি কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইলো এবং প্রাণরক্ষার জন্য হযরত মূসা (আ.)কে অনুনয়-বিনয় করতে লাগলো। মূসা (আ.) বললেন, দেখুন, কামান থেকে গুলী বেরিয়ে যাওয়ার পর তা কি আবার ওই কামানে ঢুকে? কখনো না। আপনার মৃত্যুও অবধারিত হয়ে গেছে। এর থেকে আপনার আর রেহাই নেই। তবে আমি আপনার জন্য ঈমানের সাথে মৃত্যুর দু‘আ করছি।

হযরত মূসা (আ.)-এর কথা শেষ হতে না হতেই যুবকটির শারীরিক পরিবর্তন শুরু হলো। একবার বমিও হলো। তার শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছিলো। সাকরাতের এ সময়টিতে চারজন লোক তাকে ধরে বাড়ীর দিকে নিয়ে গেলো। কিন্তু বাড়ী পৌঁছা গেলো না। মৃদু এক ঝাঁকুনি দিয়ে তার প্রাণ উড়ে গেল চিরদিনের জন্য। ধন-সম্পদ সব পেছনে ফেলে যুবকটি পরকালের পথে রওয়ানা দিল।

No comments